অসাধারণ পর্ব-০২

0
271

#অসাধারণ ২

সেদিনের পর থেকে আমার মাথা মোটামুটি এলোমেলো হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া করতে ভালো লাগে না, পড়তে তো ভালো লাগেই না৷ বইয়ের একটা শব্দও মাথায় ঢোকে না৷ টিউশন ব্যাচে বসে থাকি চুপচাপ। সবই শুনি, কিছুই বুঝি না। বন্ধুরাও লক্ষ্য করল ব্যাপারটা, “কিরে শিলা, তোর কী হয়েছে? এমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিস কেন?”

আমি বলতাম, বাড়ি থেকে ভালো রেজাল্টের জন্য খুব প্রেশার দিচ্ছে৷ কথা বলতে ভালো লাগে না।

তখন আমার আরেকটা জগৎ গড়ে উঠছিল। রঙিন, স্বপ্নিল একটা জগৎ। তাতে শুধু আমি আর টগর। সেই জগতটা আমার ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেখানে আমার একটা কাল্পনিক সংসার আছে। সে রোজ সকালে অফিসে যায়, সন্ধ্যায় ফেরে। ফিরবার সময় হাতে থাকে আমার জন্য একগুচ্ছ সাদা ফুল। আমি সেগুলো পরম যত্নে সাজিয়ে রাখি ফুলদানিতে। তার পছন্দের আইটেম রান্না করি। সে তৃপ্তি করে খায়৷ খাওয়াদাওয়া শেষে সব আলো নিভে যায়। জ্বলে ওঠে কিছু সুগন্ধি মোম। সেই মোমের আলোয় সে আমাকে খুব ভালোবাসে।

এ তো গেল কল্পনা। কল্পনাটুকু বাস্তব বানাতেও আমি কত কী না করেছি! ভোরে আমি অংকের টিউশন পড়তে যেতাম। যেদিক দিয়ে যেতাম সেদিক দিয়েই পাড়ার ক্লাব ছিল। ক্লাবের একটা ঘরে ছেলেদের জিম করার কিছু ইন্সট্রুমেন্টও ছিল। টগর রোজ যেত সেখানে। আর আমি টিউশনে দেরি করতাম তাকে দেখতে গিয়ে। সে জানত না, তার ব্যয়ামঘরের জানালার পাশের ঝাঁকড়া গাছের আড়াল থেকে কেউ একজন মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখে যায়।

বিকেলে তার আড্ডার জায়গা ছিল মঞ্জুর চায়ের দোকান৷ সেখানটা সব মেয়ে এড়িয়ে চলত একদল ছেলের আনাগোনার জন্য। আমি ইচ্ছে করে সেদিক দিয়ে যেতাম। একটু ধীর হয়ে যেত গতি। মানুষটাকে আরেকবার দেখতাম আঁড়চোখে। সেও দেখত, কিন্তু কখনো কিছু বলত না।

এভাবেই চলছিল। হঠাৎ এক দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার সময় আমি খেয়াল করলাম পেছন থেকে কেউ এসে হাঁটছে। তাকাতেই লম্বা অবয়বটা চোখে পড়ল। আমার বুকে কাঁপুনি ধরে গেল। কিচ্ছু বলতে পারলাম না।

সে বলল, “শোনো শিলা, বিকেলে ওই রাস্তা দিয়ে যাবে না তুমি।”

“কেন?”

“বখাটেরা থাকে।”

“আপনিও তো থাকেন।”

“তাতে কী? আমি তো আর মেয়ে নই।”

“মেয়েরা গেলে হলে কী হয়?”

“ওরা তোমাকে নিয়ে আলোচনা করে।”

“তাতে কী?”

“আমার ভালো লাগে না।”

“কেন?”

সে বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার ভালো লাগে রোজ একগাদা ছেলের মধ্যে দিয়ে যেতে? আরও তো পথ আছে। সেদিকেই কেন যেতে হবে? তুমি দেখতে যা সুন্দর, ছেলেরা কথা বলবেই। তাই দয়া করে নিজেকে একটু সম্মান করতে শেখো। খেলো হয়ে যেও না।”

সে এটুকু বলে চলে গেল। আমার চোখে পানি চলে এলো। সে বকেছে বলে নয়৷ প্রথমত, সে আমাকে নিয়ে ভাবে সেজন্য। আর দ্বিতীয় কারনটা হলো, সে আমাকে আজ সুন্দর বলেছে।

আমি সেই পথে যাওয়া ছেড়ে দিলাম। তবে ভোরে তাকে দেখা বন্ধ হলো না। আর বন্ধ হলো না আমার কল্পনার জগৎ। বরং বিস্তৃত হতে লাগল দিনকে দিন।

এদিকে সময় এগিয়ে যাচ্ছিল। আমার প্রি টেস্ট পরীক্ষা কেমন করে যেন চলে এলো। পরীক্ষা দিলামও৷ কিন্তু পুরো সময়টা যেন নিজের মধ্যে ছিলাম না আমি। পারা পড়াগুলো খাতায় লিখতে ইচ্ছে করত না। কেমিস্ট্রি পরীক্ষার খাতায় আমি গান লিখলাম৷ ফিজিক্সের খাতায় লিখলাম কবিতা।

সেবার পুরো ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ রেজাল্ট হলো আমার। তার ওপর আমার গান, কবিতা লেখার অপরাধে আমার বাবা মাকে ডাকা হলো। এরপর কী হলো তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অতশত বকা খেয়ে, মার খেয়ে, মায়ের কান্না দেখেও আমি যেন আমিতে ফিরতে পারছিলাম না। অন্ধ প্রেম আমাকে শেষ করে দিচ্ছিল।

আমি দিনে মার খেয়ে রাতে দরজা বন্ধ করে টগর ভেবে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম। কল্পনার সে আমাকে সান্ত্বনা দিত। বেশি করে আদর করত। আমি সব ভুলে যেতাম।

এর মাঝে তার সাথে বাস্তবেও বহুবার দেখা হয়েছে। দেখা হলে সে পড়াশুনার খবর নিত। শুধুমাত্র তখনই আমার সত্যিকারের পড়াশুনা করতে ইচ্ছে করত। তারপর আবার ইচ্ছেটা উধাও হয়ে যেত তার রাতের উপস্থিতিতে।

বাস্তবে টগরের সাথে দেখা হলে সে ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়াত৷ মিষ্টি করে হেসে কথা বলত, আমি নতুন করে পাগল হতাম।

প্রি টেস্টের ভয়ানক রেজাল্টের পর আমার জীবনযাত্রায় অবশ্য একটু পরিবর্তন হলো। ব্যাচে পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবা বাড়িতে টিচার রেখে দিলেন৷ আমাকে পড়াতে শুরু করলেন আমাদেরই স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্র হিমেল। খুব ভালো রেজাল্ট করে সে ঢাকায় পড়তে চলে গিয়েছিল। এখন এসেছে বাড়িতে নিরিবিলিতে বসে চাকরির প্রস্তুতি নিতে। বাবা তাকে ধরে নিয়ে এলেন দিনে ঘন্টা দুই আমাকে সময় দিয়ে সেবারের মতো উদ্ধার করে দিতে।

স্যার আমাকে পড়াতে শুরু করার পরপরই বুঝলেন আমার কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আমার সমস্যাটা গোপন, তাকে বলার প্রশ্নই আসে না। তবুও তিনি রোজ জিজ্ঞেস করতেন, তাকে বন্ধু ভেবে বলতে বলতেন। আমি কিছুই বলতাম না। তবুও তিনি পড়াশুনার দিকে আমার মন কিঞ্চিৎ ফেরাতে পেরেছিলেন। খুব সুন্দর করে পড়াতেন। প্রচুর উদাহরণ দিয়ে একেকটা টপিক বুঝিয়ে দিতেন যেন না ভুলে যাই। আমি তার কাছে পড়ার সময়টুকু সব ভুলে শুধু পড়তাম৷

এদিকে একদিন ক্লাসে আরেক কান্ড হলো। আমার এক বান্ধবী বলে বসল, সে একজনকে ভালোবাসে। তাকে প্রপোজ করবে খুব শীঘ্রই। কে সে? চেপে ধরে জানা গেল আর কেউ নয়, আমাদের পাড়ার টগর ভাই।

মেয়েরা টগরের জন্য পাগল সেটা জানা ছিল আমার। বাবাই বলতেন, টগরের জন্য রোজ রোজই নাকি ভালো ভালো সম্বন্ধ আসছে। আর সে সব সম্বন্ধই না করে দিচ্ছে। তার নাকি অন্য পছন্দ আছে। তবে সেই পছন্দের মেয়ে এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। আমি মনে মনে জানতাম, সেই মেয়েটা আমি। আমি এখনো ছোটো, তাই সে অপেক্ষা করে আছে।

কিন্তু সেদিন বান্ধবীর কথায় আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। আমি ঠিক করলাম, সরাসরি টগরের সাথে কথা বলে নেয়াই ভালো। নয়তো আমার চুপচাপ ভঙ্গি দেখে সে যদি অন্য কারো জন্য রাজি হয়ে যায় তখন?

সমস্যাটা হলো, তাকে পাচ্ছিলাম না। সে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেছে। একগাদা কম্পিউটার কিনেছে। সেই ব্যবসা দাঁড় করাতে ভীষণ ব্যস্ত। পাওয়াই যায় না। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম সুযোগের।

একদিন পেয়েও গেলাম। সেদিন ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। সাথে ঝোড়ো বাতাস। বিকেলে নোটসের কথা বলে যখন বেরিয়েছিলাম তখনো আকাশ মেঘলা ছিল, তবে এত বৃষ্টি নামবে বুঝিনি। ছাতা ছিল, তবুও আমার গোলাপি রঙের জামাটা ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম সেদিন বিকেলে টগরকে ক্লাবের সামনে পাওয়া যাবে। কারন আমি একটা রহস্যময় উড়ো চিঠি ফেলে রেখে এসেছিলাম তার ঘরের জানালা দিয়ে।

আমি যখন পৌঁছুলাম তখন সে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। আমাকে দেখে সরে জায়গা করে দিল। এলাকায় তখন লোডশেডিং চলছে। বেশ অন্ধকার ক্লাবঘরে সে একা ছিল। আমিও একা একটা মেয়ে। তবে ভয় হলো না মোটেও। বরং ইচ্ছে করল খুব ভুল কিছু করে বসতে।

চলবে
সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে