অসাধারণ পর্ব-০১

0
376

#অসাধারণ ১
সুমাইয়া আমান নিতু

আজ সন্ধ্যা থেকে আকাশে মেঘ জমেছে। খুব ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। এক কাপ চা হাতে বারান্দায় গিয়ে বসতেই গানের শব্দ ভেসে এলো- “আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি..” গানটা একেবারে বুকের ভেতরে গিয়ে বাজল! কত স্মৃতি এই গানের সাথে আমার! আমার জীবনের প্রথম অধ্যায়ের গল্পের সাথে অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা সেই গান!

আমার মেয়ের ইদানীং পুরানো গান শোনার শখ হয়েছে৷ যখন তখন তার ল্যাপটপে বাজছে চেনা সুর৷ আজকের আবহাওয়া আর তার গানের সুর আমাকে হঠাৎ পুরানো সময়ে টেনে নিয়ে গেল নিজের অজান্তেই৷ ঠিক যেন সিনেমার পর্দায় ফ্ল্যাশব্যাকের মতো। যখনকার সময়ে ফিরলাম তখন আমার বয়স ঠিক ষোলো৷ শান্তিপুরে নিজেদের একতলা বাড়িতে থাকি৷ বাড়ির সামনে একচিলতে বাগান৷

তখন শীতকাল। বাগানে হলদে গাদার ছড়াছড়ি। একধারে লাল টকটকে ডালিয়া৷ বিকেলের মরে আসা রোদ আর মৃদু হাওয়ায় যারা বিষন্ন সুন্দর ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। সেরকমই এক বিকেলে আমি তাকে দেখি৷ সে সদ্য বিলেত ফেরত সুদর্শন এক ব্যক্তিত্ব। যাকে বলা যায় এলাকার ‘মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর’। সে কি চেহারা! একমাথা উঁচু, গায়ের তামাটে রঙ, খাড়া নাক, বড় বড় উজ্জ্বল চোখ আর সবচেয়ে দেখবার মতো তার ব্যক্তিত্ব৷ সাহেবদের মতো করে চলাফেরা শিখে এসেছে কি না!

টগর ভাই যখন লন্ডন যায় করে তখন আমার বয়স দশ কি বারো। তখন তাকে চিনলেও অনুভূতি তৈরি হবার সময় হয়নি। তবে সে সময়েও চাহিদা কম ছিল তেমন নয়৷ বোর্ড স্ট্যান্ড করা অসম্ভব ভালে ফুটবল খেলা সেই গুণী ছেলের বিদেশে পড়াশোনা না করলে গুণের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না বলেই হয়তো তার যাওয়া! আমাদের বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল না, তবে বাবার সাথে টগর ভাইয়ের বাবার ছিল দারুণ খাতির৷ সেই সুবাদেই আমাদের বাড়িতে সেই বিকেলের চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল বাবা ছেলের। আমি তখন সদ্য ক্লাস টেনে উঠেছি। ক্লাস নাইনে ঘাড়ে চেপে বসা সায়েন্সের ধাক্কা সইতে গিয়ে জীবনের রঙ অর্ধেক উড়ে গেছে৷ কেমিস্ট্রির জটিল বিক্রিয়ার সমতা টেনেটুনে শেষরক্ষা করা গেলেও উচ্চতর গণিতের নৌকা প্রায় ডুবে ডুবে ভেসে আছে, যাকে ফিজিক্সের ভাষায় বলা যায় আংশিক নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসতে থাকা! রেজাল্টের দিন বাবা বাড়ি ফিরে বলেছিলেন, “আর যাই করিস, মানসম্মানের কিছুটা যেন বাকি থাকে।” আমি তাই মন দিয়ে পড়ছি।

কিন্তু সেই মনটাই তার বিকেলের অতিথি এসে পুরোপুরি বিগড়ে দেবে তা কে জানত! আমি বাগানে বেতের চেয়ারে বসে তখন কোলাব্যাঙের বৈজ্ঞানিক নাম মুখস্থ করার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম৷ গেটে টোকা পড়ায় উঠে পড়লাম৷ গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে গেট খুলে দিলাম৷ খুলেই মুখটা কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল। ওপাড়ে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আমার বাড়ির সামনে না দেখে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলে বেশি মানানসই মনে হতো।

নেভি ব্লু জ্যাকেট আর ডেনিম, মুখে হালকা দাঁড়ির রেশ, হাতে মস্ত এক কালে ডায়ালের ঘড়ি আর তার অন্তর্ভেদী চাহনি, সব যেন গিলে ফেলেছিলাম এক ধাক্কায়।

বাবা গেট খোলার শব্দে বেরিয়ে এসে তাদের অভ্যর্থনা না জানালে আমি সেদিন হয়তো উল্টোপাল্টা কিছু বলে বা করে বসতাম!

বাবা চলে আসায় নিজের স্বাভাবিক বোধ খুঁজে পেলাম। বাবা পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ও হচ্ছে তোর সেই টগর ভাই। লন্ডন থেকে ফিরেছে গত সপ্তাহেই। খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আর এ হচ্ছে আমার মেয়ে শিলা। জানো তো টগর, তোমার গল্প বাড়িতে রোজই করি৷ মেয়েটা যাতে একটু পড়াশোনার ইন্সপিরেশন পায়।”

টগর ভাই আমাকে প্রথম যে কথাটা বলেছিল সেটা ছিল, “তোমার নাম শিলা? শিলা মানে কি পাথর? কোন শিলা তুমি? আগ্নেয় শিলা নাকি পাললিক শিলা?”

তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই না বুঝে চুপ করে রইলাম৷ বাবা তাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন৷ ভেতরে যাওয়ার পথে টগর ভাই ফিরে তাকাল৷ আমার দিকে নাকি আমাদের বাগানের ডালিয়া ফুলগুলোর দিকে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না৷ তবে মনে হলো, এই মানুষটাকে না পেলে আমি নির্ঘাত মরে যাব। মরে ভূত হয়ে এই ছেলের বাড়ির সামনে গাছে চড়ে বসে থাকব৷ তবুও একে ছেড়ে থাকা অসম্ভব!

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে