অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১৩

0
1172

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১৩ তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

আমি শুকনো ঠোঁটে পূর্ণতার হাসি হাসলাম।
তবে পরক্ষণেই হাসিটা থেমে গেলো,অনূভব করলাম চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

দুইজন সেবিকা দুটো বাচ্চার ওজন মাপলো,তারপর চলে গেলো বাইরে। তারপর ডক্টর তার বাকি কাজগুলো করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো।

আমাকে আমার কেবিনে আনা হলো। আমি চোখ ঘুরিয়ে প্রথমেই খেয়াল করলাম ইথিলা ভাবীকে। তাকিয়েই দেখলাম ভাবীর ঠোঁটে কি এক অমায়িক হাসির রেশ! দুইজনকে নিজ হাতে নরম কাপড় দিয়ে আরো পরিষ্কার করে বারবার দুই মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবীর দিকে তাকিয়েই রইলাম। ভাবী ওদের দুইজনের দুইহাতের আঙুল ধরে বললো,
___তোমাদের তো কোনো চিহ্নও নেই, বড়মা তোমাদের দুজনকে আলাদা করে কি করে চিনবে?

এটা শুনে আমি চোখ বন্ধ একটু হাসলাম। তখনি ইয়াজ আমার হাত ধরে বসলো। আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___কার মতো হয়েছে দুজন? আপনার মতো তো?

ইয়াজ মাথায় হাত রেখে বললো,
___ আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে হোক না যার মতো হওয়ার। তুমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো, তোমার প্রচুর বিশ্রাম প্রয়োজন। এখানে ইথিলা আছে, তোমার আমার মা আছে, ওদের ভীষণ খেয়াল রাখবে।

কথাগুলো বলার মাঝেই একজন সেবিকা প্রবেশ করলো, আগে থেকে আনিয়ে রাখা বক্স থেকে একটা স্যালাইন বের করে হাতে আবার সেটা ঝুলিয়ে দিলো, আর বললো,
___একদম কথা বলবেন না। চুপ করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। ভাবীকে ডেকে বললাম,
___দুজনকে আমার কাছে আনবে প্লিজ, আমি ওদেরকে আরো করে দেখতে চাই।

ভাবী মুচকি হেসে ইয়াজকে ডেকে একজনকে তার কোলে দিলো,আরেকজনকে উনি কোলে নিয়ে আমার কাছে এনে দেখালেন। আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবী আর ইয়াজের দিকে তাকাচ্ছি। আবারও দেখে ওদের দিকে তাকাচ্ছি। একজন চোখ বন্ধ করে রেখেছে, মনে হয় ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আরেকজন চোখ খুলে রেখেছে। নাকের দিকে তাকিয়ে এখনি বুঝা যাচ্ছে সেটা আমার মতো হবে। ওদের বাবার নাক কিছুটা চাপা হলেও আমার নাক খাড়া। চোখের ধরণও আমার মতো লাগছে, ভ্রুগুলোর ধরণ আবার তাদের বাবার মতো দেখা যাচ্ছে। কান,হাত,কপাল এসবই ইয়াজের মতো। সবকিছু তেমন একটা বুঝা না গেলেও তাই তাই হবে বলে মনে হচ্ছে , ছোট বাচ্চারা তো দিনে দিনে অনেক পরিবর্তন হয়। কেন জানি আমার এগুলো দেখে স্পষ্ট মনে হচ্ছে তাদের চোখ আর নাক ছাড়া তারা সম্পূর্ণ তাদের বাবার মতো দেখতে হবে। ইয়াজ তার কোলে যেজন আছে তাকে ইশারা করে বললো,
___ দেখো তোমাদের মা নিজেও চমক খেয়ে গেছে, হয়তো ভাবছে সেও তোমাদের দুজনকে আলাদা করে চিনতে পারবেনা। হাহাহাহা!

ভাবীও হাসি জুড়ে দিলো। আমার মা বাবা আর শ্বশুর,শাশুড়ী দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। ওদের হাসিতে আমিও হাসছি। ডান হাতে স্যালাইন, তাই খুব কষ্টে বা হাত দিয়ে ওদের গাল ছুঁয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইয়াজকে বললাম,
___আমি চিনতে পারবো। আপনি দুজনকে একটু পরে অদলবদল করে সামনে এনে জিজ্ঞাসা করিয়েন, আমি বলে দিবো এখন যে আপনার কোলে আছে সে কোনজন, আর যে ভাবীর কোলে আছে সে কোনজন!

ইয়াজ চোখটা একটু অন্য রকম করে বললো,
___ সত্যি পারবে?

আমি হেসে বললাম,
___হ্যাঁ!

ইয়াজ তারপর দুজনের দিকে তাকালো। আর আমার সাথে দেখাদেখিতে চ্যালেঞ্জ করে বলে বসলো,
___আমিও পারবো। তুমি মা পারবে, আর তাদের বাবা পারবেনা, কি করে হয়!?

ভাবী তাচ্ছিল্য করে বললো,
___ইয়াজ চাপা কম করো। তুমি পারবেনা।

ইয়াজ জোর গলায় বললো,
___ইথিলা আমি পারবো।

___বেশ তাহলে বাইরে থেকে খাবার আনো, আনার পরে সেটা পরিক্ষা হয়ে যাবে। কে পারে!

সেসময় আমার ভাইয়া রুমে প্রবেশ করলো। এতক্ষণ উনি আসতে পারেনি কারণ ছুটি নিতে পারেননি। ভাইয়া রুমে এসে প্রথমেই আমার কাছে বসে জিজ্ঞাসা করলেন,
___এখন কেমন লাগছে বিন্দিয়া?

আমি আস্তে আস্তে বললাম,
___বুঝতে পারছিনা, কোমরের নিচে তো এখনো অবশ। কিন্তু ভালো লাগছে ওদেরকে দেখে। দেখোনা তুমিও অবাক হয়ে যাবে!

ভাইয়া তারপর ইথিলা ভাবী আর ইয়াজের কোলের দিকে তাকালো। অনেক্ষণ তাকালো, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___কিরে তোর আর আমার মধ্যে যেই দুইটা মিল সেটা ওদের দুজনের মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি, আর কেউ কি খেয়াল করেছে? আর বাকিসব তো ইথিলা আর ইয়াজের মতো লাগছে।

আমার মা পাশ থেকে হেসে বললো,
___ হ্যাঁ ওরা দুজন যদি যেকোনো এক জায়গায় থাকে কিংবা দুই জায়গায় থাকে তারা বিশ্বাস করে নিবে তাদের মা-বাবা ঠিক। ইথিলা আর ইয়াজ তো এক রকমই, আর বাদল বিন্দিয়ার মিলটুকুও ওদের মধ্যে আছে! কি ভীষণ আশ্চর্য নিয়ে আসলো ওরা!
আচ্ছা ওদের নাম কি রাখা হবে কেউ ঠিক করে রেখেছো তো?

আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে বললাম,
___এখনো কিন্তু নাম বের করেননি। এই দায়িত্ব আপনার ছিল!

ইয়াজ ইথিলার ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললো,
___এই দায়িত্ব আমি ইথিলাকে দিয়ে দিয়েছি।

ইথিলা ভাবী ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
___এই দায়িত্ব আপনার!

ভাইয়া আমার মা বাবা আর শ্বশুর, শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বললো,
___না না এই দায়িত্ব উনাদের। নাতিদের নাম ওরা ঠিক করবে।

এই অবস্থায় সবাই আবারও হেসে উঠলো। একজন শুধু আরেকজনকে ঠেলছে।

তখনি ইয়াজ আমাকে ইশারা করলো কম কথা বলতে। আর ভাবী ইয়াজকে বললো শুকনো খাবারসহ সবার জন্য অন্যান্য আরো খাবার নিয়ে আসতে। আমার বাবা, শ্বশুর আর ভাইয়া মনে হয় চলে যাবে। আবার কাল আসবে। এখানে আমার সাথে ইয়াজ ভাবী, আর দুই মা থাকবে।
ইয়াজ বের হয়ে চলে গেলো খাবার আনতে। ভাবী আমাকে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে বললো। আর বললো একটু পরে আমাদের দুজনকেই সেই পরিক্ষাটা করবে যেটা আমরা ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জ করেছি। আমরা বেবিকে আলাদা করে চিনি কিনা! আমি কেন জানি নিশ্চিন্ত ছিলাম চিনবো। তাই চুপ করে চোখ বন্ধ শুয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ লেগে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখি ইয়াজ বসে আছে, আমাকে চোখ খুলতে দেখে বললো,
___এখনো কি পা অবশ লাগছে?

আমি পা একটু নাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
___না এখন তেমন লাগছেনা। ওরা দুজন কোথায়? কি খেয়েছে? ওদের খিদে পায়নি? কান্না করেছিলো?

ভাবী এগিয়ে এসে বললো,
___এতো চিন্তা করো না। আমরা আছি তো! আর ইয়াজ এদিকে এসে বলোতো তখন তোমার কোলে কে ছিল? আর আমার কোলে কে ছিল? খুব তো বলেছিলে চিনবে!

আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
___ভাবী আমার কাছে আনো, আমার সামনে বলবে!

ভাবী আমার শাশুড়ীর কোলে একজনকে দিলো, আর দুজন দুজনকে নিয়ে আমার বেডে আসলো।
আসার পরে ভাবী আমাকে বললো,
___বিন্দিয়া তুমি আগে বললে হবে না। আগে ইয়াজ বলবে। ইয়াজ বলো তুমি!

ইয়াজ খুব ভালো দেখছিলো। তারপর কিছু বুঝতে না পেরে বললো,
___দুজনের ফতোয়া বদলে ফেলার কি দরকার ছিল ইথিলা? এখন তো কেমন, না না আমি বলতে পারবো।

বলেই ইয়াজ চোখ ঘুরাচ্ছিলো। ভালো করে পরখ করেও সে ভুল বলতে আঙুল নিচ্ছিলো, তখনি আমার দিকে ইয়াজের চোখ পড়লো। আমি চোখ দিয়ে ইশারা করে মানা করলাম। ইয়াজ সেদিক থেকে আঙুল সরিয়ে বললো,
___ও না, এই যে সে আমার কাছে যে ছিল। আর সে তোমার কাছে ছিল ইথিলা!

ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
___বিন্দিয়া বলো!

আমি ইয়াজের দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসিতে ভুলজনের দিকে আঙুল দেখালাম।
ভাবী সাথে সাথে ইয়াজের কান টেনে বললো,
___কি করে বুঝলে তুমি? নিশ্চয়ই কোনো চালাকি করেছো! কোনো চিহ্ন রেখে যাওয়ারও কথা না, আমি নিজ হাতে দুজনকে এক রকম থেকে আরো এক রকম করার চেষ্টা করলাম। আর তুমি কিনা বুঝেই গেলে! আর ইথিলা বুঝলো না?

ইয়াজ একহাতে কলার টেনে ভাবসাব নেওয়ার চেষ্টা করলেও আমার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। কারণ সে জানে আমি ইচ্ছে করে তাকে জিতিয়েছি! আর এটাও জানে সে জিতলেই আমি আমি খুশি! তবে এতে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছে আমি কি করে চিনলাম!

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে