অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-১২

0
1218

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (১২ তম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বলেই হাসিটা আর ধরে রাখতে পারলেন না। মুখ চেপে কান্না শুরু করে দিলেন।

উপস্থিত সবাই কাঁদছে, একটা খুশির সাথে আরেকটা কষ্টের মিশ্রণ যেন কষ্টগুলোকে আরো তীব্রতর করে দিচ্ছিলো। একদিকে পূর্ণতার আহাজারিতে মেতে উঠার কথা ছিল কিন্তু অপরদিকের অপূর্ণতা সেটাকে কলুষিত করে রেখেছে। থমথমে নিরবতার মাঝে একজন সেবিকা কিছু ঔষধপত্র হাতে প্রবেশ করলেন। আর সবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
___আপনারা উনার সাথে কষ্ট না পেয়ে প্লিজ বুঝানোর চেষ্টা করুন। এই পৃথিবীতে সবাই পূর্ণতা নিয়ে আসেনা। উনাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করুন। তবে এখন উনাকে ঘুমের একটা ঔষধ খাওয়াবো, উনার বিশ্রাম প্রয়োজন। আপনারা কেউ কোনো শব্দ করবেন না। আর এই বেডের পেসেন্টকে উনার কেবিনে নিয়ে যান।

ইয়াজ আর ভাইয়া উঠে আমাকে আমার কেবিনে নিলো। আমার তেমন জটিল সমস্যা না থাকলেও রাতে আরেকজন ডক্টরের শরণাপন্ন হয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পরিক্ষা সাথে এখন থেকে চালিয়ে যাওয়া ঔষধের প্রেসক্রিপশন নিতে হবে। রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও পূর্ব সচেতনতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পরেরদিন আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। মা অনুরোধ করছিলো এইসময় কয়দিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে। ইয়াজও রাজী হলো, আর মা-বাবার সাথে আমি বাড়িতে চলে গেলাম। ভাবীকে এর দুইদিন পরে ছাড়া হলো। ভাইয়াও ভাবীর সাথেই ছিল এইকয়দিন, এমনকি তিনি এখন ভাবীর সাথে ইয়াজদের বাড়িতেই আছেন।
সবাই ভাবীর খুব খেয়াল রাখছিলো। আর আমার প্রতিও আমার বাবা-মা ছিল ভীষণ যত্নশীল । কিছু অপূর্ণতার পরেও দুই পরিবার এক হতে পেরে সেখানে আনন্দের সীমা ছিলো না।

এর তিনদিন পরে ইয়াজ আমাকে নিতে আসলো। আমিও সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলাম,তাই ওর সাথে যেতে কোনো আপত্তি ছিল না। যাওয়ার পর পরেই ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিলো ভাবী যেহেতু এখন অনেকটাই সুস্থ ভাবীকেও বাড়িতে নিয়ে আসবেন।
তার আগে সবার পরামর্শে একজন ধর্মীয় অবিজ্ঞকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া হলো উনাদের বিবাহ বন্ধন অক্ষুণ্ণ আছে কিনা। আর এই ডিভোর্স কতটা গ্রহণযোগ্য? উনারা বললেন, শরীয়ত মতে এটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এরপরও এমন ভুল না করার জন্য তওবা করতে করে নিতে হবে।


আমি যাওয়ার একদিন পরেই ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে আমাদের বাড়ি চলে গেলো। এই একদিনে আমি স্পষ্ট দেখেছি ভাবীর শুকনো চোখে লুকানো কষ্ট, কাঁদতে কাঁদতে হয়তো চোখগুলোও এখন বিরক্ত হয়ে গেছে। তবে উনার চোখে তাকিয়ে বুঝেছি সেখানে অপূর্ণতার মোহ উনার সত্তাকে কতটা গ্রাস করে নিয়েছে। উনার এখন হাসতে ইচ্ছে করে না, কথা বলতে ইচ্ছে করে না, তাও নিজের সাথে যুদ্ধ করে হাসেন,বুঝান তিনি ঠিক আছেন!
কেন জানি এখন আমি নিজের জন্য খুশি হওয়ার আগেই ভাবীর মুখটা চোখে ভেসে উঠে, আর ভেসে উঠতেই আমার কলিজায় খুন অনূভব করি।

ইয়াজ আমার ভীষণ খেয়াল রাখে, নিজের কাজের পরে যখনি বাসায় থাকে আমাকে সবকাজে সাহায্য করে। আমার শাশুড়ী তো আমাকে রান্না করতেই দিতে চায়না। মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে বলে, সারাজীবন রান্না করার সুযোগ পাবা, এখন নিজের দিকে খেয়াল রাখো।

আমার ভাইও নিজের কর্মস্থল থেকে ফিরে যতটা সম্ভব ভাবীকে সময় দেন। উনার পাশে পাশে থাকেন।
তবে ভাবী নাকি রাস্তাঘাটে কোনো বাচ্চা দেখলে তাকিয়ে থাকেন, ইউটিউবে বাচ্চাদের ভিডিও ছাড়া আর কিছুই দেখেন না। এমনকি আমিও মাঝে মাঝে ফেইসবুকে উনার এক্টিভিটি দেখতে পাই বিভিন্ন বাচ্চার ছবিতে, ভিডিওতে। ইয়াজ এগুলো যখনি দেখে মন খারাপ করে বসে থাকে, মাঝে মাঝে আমার কাঁধে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করে।

দুঃখ কষ্ট, হাসি আনন্দ মিলিয়েই সময় চলে যাচ্ছিলো। তবে দিন যাওয়ার সাথে সাথে আমার শরীরের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। অতিরিক্ত অস্বস্তি লাগা, পিঠে কোমরে ব্যথা, ওজন বৃদ্ধি এসব নিয়ে ইয়াজও ভীষণ চিন্তিত ছিল।

তখন গর্ভধারনের দুইমাস প্রায়। ইয়াজ আর আমি সকালে একটু হাঁটতে বের হয়েছি। সারাদিন কাজকর্ম তেমন করা হয়না,এভাবে শুয়ে-বসে থেকেও ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তাই ইয়াজ ফজরের নামাজের পরে ইদানীং আমাকে নিয়ে একটু হাঁটতে বের হয়। তখন আশেপাশে তেমন লোকজনকেও দেখা যায় না।
এর মধ্যে আমাদের সন্তান ছেলে হবে কিনা মেয়ে হবে এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু সেদিন আমি আনমনেই বললাম,
___আমার কেন জানি মনে হয় অন্যদের থেকে আমার অবস্থাটা অন্য রকম। দুইমাসের পেট দেখে মানুষ নিঃসন্দেহে চারমাস বলবে, মনে হয় দুটো বাচ্চা এখানে।

ইয়াজ আমার হাত ধরে একটু এগিয়ে ছিলো। কিন্তু এটা শুনে উৎফুল্লের হাসিতে পেছনে এসে পেটে হাত দিয়ে বলে উঠলো,
___ সত্যি? চলো আজকেই সেটা পরিক্ষা করবো। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিচ্ছি, জমজ সন্তান কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুইমাস যথেষ্ট কিন্তু। তবে ছেলেমেয়ে কিনা সেটা বুঝতে আরো দেরি।

আমি ওর হাসিমুখে তাকিয়ে হাসলাম। তারপর ধিরে ধিরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
___ সত্যিই যদি হয় ভীষণ ভালো হবে তাইনা?
আর যদি একই রকম দেখতে দুইটা মেয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই। আমি দুইজনকে সবসময় এক রকম করে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবো। আমি চাই ওরা একদম ওদের ফুফির মতো হোক।

ইয়াজ মুচকি হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
___ তোমার মতো হোক চাও না কেন?

আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম,
___ তা তো জানিনা। তবে এটা এইজন্য চাই, রাস্তায় বের হলেই যাতে লোকে বলে ইয়াজের সন্তান এরা, যেন নিজ থেকে পরিচয় দিতে না হয়।

ইয়াজ বললো,
___আচ্ছা আজকে হাসপাতালে গিয়ে আগে নিশ্চিত হই। তারপর বাচ্চার জন্য এখন থেকেই জোড়ায় জোড়ায় সব কিনে রাখবো। আচ্ছা ওরা দুইজন আসলে, দুইজন থেকে একজন তোমাকে বেশি ভালোবাসবে আরেকজন আমাকে? না না দুইজনই আমাকে বেশি ভালোবাসবে৷ তুমি শুধু লালন পালন করবে! হেহেহে!

বলেই ইয়াজ হাসতে লাগলো। আমিও হাসলাম। সত্যিই ইয়াজ ভীষণ খুশি, আর দুটো সন্তান হলে সে আরো অনেকবেশি খুশি হবে। মনে মনে এটাই চাচ্ছিলাম যেন আমার এই ধারণাটা সঠিক হয়!

ডক্টরের চেম্বারে বসে ইয়াজ আর আমি দুজনেই হাসছি। ইতোমধ্যেই রিপোর্ট এসে গেছে সেখানে এটা স্পষ্ট হয়ে আমার গর্ভে দুটো সন্তান। আমার নিজের প্রতি আরো যত্নশীল হতে বললেন ডক্টর। ইয়াজকেও বলে দিলো সবসময় খেয়াল রাখতে। ইয়াজ সেখান থেকে বের হয়েই সংবাদটা ভাবীকে জানালো।
ভাবী এটা শুনেই বললো,
___আমি আজকে থেকে গুনে গুনে ৭-৮ মাস তোদের সাথে থাকবো। ইথিলার যাতে কোনো রকম অযত্ন না হয়।

সত্যি সত্যি সেদিনই ভাবী চলে আসলো। আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেন, মাথায় তেল দিয়ে দেন। গ্লাসে পানিটা পর্যন্ত ঢেলে দেন। ভাবী ভীষণ খুশি ছিল। তখন থেকে প্রতিটা সময় আমার কাছে ছিল অসহ্যকর সুন্দর। ভাবীর হাসি,ইয়াজের খুশি,মা-বাবার কৌতুহল আমাকে সাহস দিতো। আর আমি দুজন অতিথিকে নিয়ে নানারকম পূর্ণতার আঁকিবুঁকি আঁকতাম।
ভাইয়া প্রতি শুক্রবার চলে আসেন, এছাড়াও সময়ে অসময়ে ভাবীকে দেখার জন্য হুটহাট উপস্থিত হয়ে যান। সারাক্ষণ ফোনে কথা বলেন। ভাবী খেয়েছে কিনা, দিনে একবার ঘুমিয়েছে কিনা, এসবদিকে ভাইয়া ভীষণ খেয়াল রাখেন। ভাবীর চোখেমুখে আজকাল পূর্ণতার ছোঁয়া দেখতে পাই। তখন আমিও নিজেকে পরিপূর্ণ আর সার্থক মনে করি।

প্রায় সাড়ে তিনমাস পরে আমাদের সব ধারণাকে উল্টে দিয়ে রিপোর্ট আসলো আমার গর্ভে দুটো পুত্রসন্তান। মেয়ে সন্তানের প্রতি আমার বিশেষ ঝোঁক ছিল, কিন্তু এটা শুনেও খুশি না এমন নয়। ভীষণ খুশি,কারণ ছেলে থাকলে মেয়ে এমনি আসবে। আর মেয়ে হলে তো পরেরঘরে চলে যাবে! এটা বলেই নিজেকে বুঝ দিতাম।
আমার দিকে সকলের এখন কড়া দৃষ্টি। ভাবী তো ইয়াজ যতক্ষণ না থাকে আমার থেকে একটুও দূরে যান না। সবার ভালোবাসায় সব কষ্ট, অস্বস্তি, অতিরিক্ত ওজনের আধিক্যতা টের পেতাম না। নিজেকে মা রূপে কেমন করে গড়বো সেটাই ভাবতাম।

ধিরে ধিরে সময় ঘনিয়ে এলো। সিজারে যাওয়ার আগেরদিন রাতে ইয়াজ আমার পাশে বসে ভীষণ মন খারাপের সাথে বললো,
___একটা জিনিস চাইবো দিবে?

আমি মৃদু হেসে বললাম,
___আমার সবই তো আপনার, এখানে চাইবেন কেন?

ইয়াজ চোখ দুটো অন্যদিকে সরিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর স্বাভাবিক হয়ে আমার দিকে ফিরে বললো,
___ আল্লাহ রহমত করলে, দুটো সন্তান যদি সুস্থ অবস্থায় দুনিয়ায় আসে তাহলে আমরা একটা সন্তান ইথিলাকে দিয়ে দিবো। দিবে তো? এটা তোমার কাছে আমার প্রথম চাওয়া, প্লিজ না করো না।

আমি কেঁদে ফেললাম। পেটের উপর ডান হাত রেখে অনুভব করলাম দুজন সুন্দর করে একসাথে তাদের উপস্থিতি বিরাজ করছে। আসবেও একসাথে, আমি মা তাদের দুজনকে একসাথে একটু একটু করে বড় করে তোলার কতো স্বপ্ন ইতোমধ্যে দেখে ফেলেছি। কিন্তু এখন ইয়াজ আমার কাছে এটা কি চাইছে? না না আমি কোনোভাবেই আমার এক সন্তান কাউকে দিবোনা। ওরা দুজনই আমার! কিন্তু কথাগুলো মুখ ভেদ করে বাইরে আসছিলোনা। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো, কিন্তু চোখ থেকে শুধু অঝোর ধারাই বয়ে যাচ্ছে। ইয়াজ আমার ডান হাতটা উঠিয়ে সে হাত রেখে বললো,
___ বাবারা শুনতে পাচ্ছো? তোমাদের একজনকে যদি অন্য মা এনে দেই তোমরা বাবার উপর রাগ করবে? বিশ্বাস করো তোমাদের ওই মা আমাদের থেকেও বেশি ভালোবাসবে, অনেক যত্ন করে তোমাদেরকে মানুষ করবে। এই দেখো তোমাদের মা এটা শুনে কতো কান্না করছে, মাকে বুঝাও।

আমি ইয়াজের কপালে কপাল ঠেকিয়ে আরো বেশি কান্না শুরু করে দিলাম। ইয়াজ নিজেও কাঁদছে কিন্তু অনেকটাই সামলে রেখেছে। আমার মাথায় হাত রেখে বলছে,
___তুমি চাওনা দুটো পরিবার পূর্ণ হোক? আমাদের একটা সন্তান হলে কি আমরা মেনে নিতাম না? আর এটা তো আমাদেরই পরিবার, আমরা সবসময় তাকে দেখবো, তোমার যখন ইচ্ছে তাকে গিয়ে কোলে নিবে আদর করবে। শুধু ইথিলার অপূর্ণ জীবনটা পূর্ণ করে দাও। আমি আজীবন আর কিছু চাইবোনা তোমার কাছে। প্লিজ বিন্দিয়া!

আমি ইয়াজের হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম,
___ বেশ!

ইয়াজ কান্নার মাঝেও হেসে দিয়ে আমার কপালে একটা চুমু খেলো, ওর চোখের জলগুলো একাকার হয়ে আমার কপাল ভিজে গেলো।

পরেরদিন সকালে সবার থেকে দোয়া নিয়ে আমরা পরিবার নিয়ে হাসপাতাল গেলাম। প্রথম একটু ভয় ভয় লাগছিলো। কিন্তু সিজারে নেওয়ার পর ১০ মিনিটের মধ্যেই কানে দুটো বাচ্চার একত্রে কান্না স্পষ্ট শুনলাম। ডক্টর আমার চোখের সামনে বাচ্চাদুটো এক করে বললো, দুজন পুরো এক রকম! দুই ভাইয়ের স্বাস্থ্যও এক, নাক,চুল,ঠোঁট সব এক রকম। আমি শুকনো ঠোঁটে পূর্ণতার হাসি হাসলাম।
তবে পরক্ষণেই হাসিটা থেমে গেলো,অনূভব করলাম চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।…

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে