অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-০২

0
1569

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (২য় পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

লাফিয়ে উনাকেই জড়িয়ে ধরতেই উনি আমাকে সরিয়ে আচমকা বলে উঠলেন,
___ছেলে দেখলে হুশ থাকেনা?

কাচুমাচু করতে করতে আমি সরে গেলাম। দ্বিতীয়বারের মতো এমন অসহনীয় লজ্জা পেয়ে যা যা বলবো ভেবে রেখেছিলাম সব ভুলে গিয়েছি। ভীষন বিব্রতকর অবস্থায় আমার নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে করছিলো। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেছে আমি কি থেকে কি করে বসেছি নিজেই মিলাতে পারছিনা।

ইয়াজিদ ধির পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। বিছানায় বসে এমন একটা ভাব নিলো, যেন এটা তার বাড়ি, তার রুম। তারপর আমার দিকে ইশারা করে বললো,
___এই মেয়ে আমাকে চিনোতো? আমি হলাম ইথু মানে তোমার ভাবী ইথিলার ৫ মিনিটের ছোট এবং তার জমজভাই, আমার নাম ইয়াজিদ ইমতিয়াজ। যদিও সবাই আমাকে ইয়াজ বলে ডাকে। তবে তুমি ভাই বলে ডাকবে। এখন আসি বিশেষ কথায়, ইথিলা যে আমার ৫ মিনিটের বড় সেটা ছোট বেলা থেকেই মানিনা, তাই তোমার ভাইকে দুলাভাই বলে ডাকতেও আমার সংকোচ। ইথিলাকে বলেছি শ্বশুরবাড়ির সবাইকে যাতে বলে আমি তার বড়। আমি চাই স্নেহ পেরিয়ে সম্মান ব্যপারটা আমাকে সর্বদা ঘিরে থাকুক কেননা পুরো এক যুগ ধরে সেটাকে আমি মস্তিষ্কে ধারণ করেছি। আর সেখানে তোমার মতো পুঁচকে মেয়েরা আমাকে অসম্মান কিংবা মসকারা করার সাহস করা তো কল্পনার বাইরে। আমাকে সবসময় সম্মান করে কথা বলবে বুঝলে?

একনাগাড়ে এগুলো বলে একটু থেমে আবার বললো,

___আচ্ছা যাই হোক এতক্ষণ আমার ব্যপারে ঝকঝকে পরিষ্কার ধারণা দিলাম । এখন বলো আমাদের বাড়িতে যেতে চাও কিনা?

আমি দরজার পাশ থেকে মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললাম,
___না আমি যাবোনা।

ইয়াজ সুন্দর করে দাঁড়িয়ে বললো,
___তাহলে ঠিক আছে। বাবার অনুরোধে এসেছিলাম। বিকেলে তোমাকে না দেখেই মা-বাবা তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে বিরক্ত করে ফেলছিল, এমনিতেও আমার পক্ষে মেয়েটেয়ে সাথে নিয়ে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। এবার বাড়িতে গিয়ে বলবো আসতে রাজী হয়নি। ফোন দিলেও তার প্রমাণ পেয়ে যাবে ৷ তাহলে আমি যাচ্ছি!

বলেই আমাকে পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। কিছু একটা ভেবে আমি তৎক্ষনাৎ চোখনাক মুছতে মুছতে ডাক দিয়ে বললাম,
___ এই যে ড্রয়িং রুমে একটু বসুন। আমি ১০ মিনিটে আসছি।

আমার কথা শুনে ইয়াজ আড়চোখে তাকালো। তারপর ভ্রু কোঁচকায়ে চেহেরা ভাঁজ করে বিরবির করে কিছু একটা বলে ড্রয়িং রুমের দিকে এগুলো।

আমি যত দ্রুত সম্ভব তৈরি হয়ে বের হলাম। মা আমাকে এতো দ্রুত রাজী হয়ে যেতে দেখে কিছুটা অবাক হলো। যাওয়ার সময় ধিরে ধিরে আমার কাছে এসে বললো,
___বিন্দিয়া তুই তো যাবিনা বলেছিলি? তাছাড়া এমন উপযুক্ত ছেলের সাথে তুই সন্ধ্যা সময়ে যাবি ব্যপারটা আপত্তিকর কিন্তু ।

আমি মা’কে আস্বস্ত করে উনার ব্যপারে বললাম। এটাও বললাম উনি ফালতু আচরণ তো করবেইনা, উল্টো আমাকে সবকিছুতে শাসাবে। এসব শুনে মা না চাইতেও রাজী হলো।
কিন্তু আমার রাজী হওয়ার পেছনে ছিল এর ঠিক উল্টো কারণ। উনার এসব দেমাকি কথাবার্তা আমাকে ভীষণ হার্ট করেছে। দুনিয়ার সব বেয়াই বেয়াইনদের সম্পর্ক কতো রসিকতার হয়, সেখানে কিনা আমাকে বারবার অপমান করছে।
তখন মনে মনে বলেছিলাম, ইয়াজের ভাব আর গম্ভীরতার ১২ টা না বাজাতে পারলে আমিও বিন্দিয়া না!

ইয়াজ কোনো গাড়ী নিয়ে আসেনি। কারণ সে ভেবেছে আমি যাবোনা। সে একা একা কানে ইয়ারফোন গুঁজে নাচতে নাচতে অটো কিংবা সিএনজি চলে আসছে, এভাবেই ফিরে যাবে ভেবেছিলো।
কিন্তু এবার তার মুখ শুকনো। কোনো কথা না বলে একটা সিএনজি ডেকে তাদের বাজারের নাম বলে উঠে বসলো। আমার সাথে তখন একজন মহিলা ছিল, আর ইয়াজ সামনে বসা। একটু পর মহিলাটা নেমে গেলো। সেখানে ২৫-২৬ বয়সী একজন ছেলে উঠলো। কেমন যেন অন্য রকম লাগছিলো, গলায় মোটা স্টিলের চেইন, কানেও রিং পরা আছে। হাতে মেয়েদের চেয়েও মোটা বালা পরা। ভয় ভয় লাগছিলো আমার। এরপর আবার উঠেই বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে কর্কশ গলায় বসে বসলো,
___আচ্ছা আপনি কি অবিবাহিত?

আমি থতমত করে বিবাহিত কথাটা বলতে যাবো তখনি ইয়াজ সামনে থেকেই ঘাড় ফিরিয়ে বললো,
___ হ্যাঁ ভাই সে অবিবাহিত, তারপর আবার একদম সিঙ্গেল। আমরা ওর জন্য পাত্র খুঁজতেছি, আপনার কি পছন্দ হয়েছে? হলে আমার সাথে এ ব্যপারে কথা বলতে পারেন৷

লোকটা আমার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে লাজুকতার সাথে মিটমিট করে হাসলো। আমি বারবার পিছাচ্ছিলাম আর উনি একটু একটু ঘেঁষার চেষ্টা করছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বাজারে পৌঁছে গেলাম। সিএনজি থেকে নেমে ছেলেটা ভাড়া দিয়েই ইয়াজের সামনে গিয়ে লজ্জামাখা মুখে বললো,
__ভাই আপনার নাম্বারটা দিয়ে যাবেন প্লিজ। নইলে ওই আপার নাম্বার দিলেও চলবে। আসলে উনাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে, বিয়ে করতেও আপত্তি নাই।

এটা শুনে আমি রাগে পুরো আগুন হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ভয়ে কোনো কথা বলছিলাম না। এর মধ্যে আমাকে আরো রাগিয়ে ইয়াজ হাসতে হাসতে বললো,
___আরে আমরা যেহেতু পাত্র খুঁজতেছি, আপনাকে কষ্ট করে নিজে যোগাযোগ করতে হবে না। এমন পাত্র কীভাবে হাতছাড়া করবো বলুন? আপনার নাম্বার দেন, আমরাই শীগ্রই যোগাযোগ করবো।

বিজয়ের হাসি হেসে ছেলেটা নিজের নাম্বার দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো। আমি সেখান তারাহুরো করে হাঁটা ধরলাম। আমার পেছনে ভাবসাব নিয়ে ইয়াজ আসতেছে। তারপর একটু গিয়েই ইয়াজ বললো,
__ রিকশা ডাকবো? নাকি হেঁটে যেতে পারবে?

আমি রাগী গলায়ই বললাম,
___এই রাতে আপনার সাথে হেঁটে যাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই, তারাতাড়ি রিকশা ডাকুন।

এদিক ওদিক খুঁজে একটা রিকশা এনে আমাকে বসালো। তারপর আবারো এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। আমি বুঝলাম আরেকটা রিকশা খুঁজতেছে। সে আমার সাথে একসাথে যেতে ইচ্ছুক নয়। আমিও একদম মধ্যখানে বসে পা দোলাচ্ছিলাম। ১০ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে বললো,
___একটু সরো তো। আর রিকশা পাওয়া যাচ্ছেনা।

আমি রাগী চেহেরায় তাকিয়ে বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে অল্প সরলাম। সেই অল্প জায়গায় বসতে ইয়াজের কষ্ট হচ্ছিলো। তাও সে কিছুটা সরে থাকার চেষ্টা করছিলো। এটা দেখে যদিও আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো কিন্তু সেটা বুঝালাম না । সারা রাস্তায় জমানো ক্ষোভ থাকলেও এবার মনে মনে ভাবছিলাম বেটা চান্দু আমাকে এতো অপমান করে শেষ পর্যন্ত তো আমার সাথেই যেতে হচ্ছে। তাও এক পা রাখার মতো জায়গায় বসে। আর আমার সাথে এখানে একটু জায়গা পেতে তার অনুনয়ের মুখটা চোখে ভাসছিলো। এটা চোখে ভাসতেই নিজের উপর এবার একটা প্রশান্তি আসছে, কিন্তু মনে আসা এই ভাবটা মূহুর্তে আবার বদলে দিয়ে ইয়াজ নাকে হাত দিয়ে বললো,
___ উফফ! আমার বমি বমি পাচ্ছে! কয়দিন ধরে গোসল করো না?

এটা শোনার পরে আমার মুখটা মূহুর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। সাথে সাথে আমি সীটের একদম কর্ণার পর্যন্ত চেপে গেলাম। আমি তো আজকে গোসল করেছি, তার উপর গায়ে দামী পারফিউম মাখানো। সেখানে ইয়াজ এটা কি করে বললো?
হঠাৎ করে খেয়াল করি ইয়াজ এবার ঠিকঠাক মতো নিজের জায়গা নিয়ে বসেছে। তারপর মাথায় আসলো সে তাহলে জায়গা প্রশস্ত করতে আমাকে এই কথা বলেছে? যাতে করে আমি অযথা দখল করে রাখা জায়গাটা ছেড়ে দেই!? আর সে ভালো করে বসতে পারে!
এ খোদা! এই ছেলের সাথে আমি পারবোনা, ভীষণ ভীষণ জঘন্য রকম চালাক সে!

তাদের বাড়িতে পৌঁছাতেই ভাবী খুশিতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ইয়াজ কোনদিকে চলে গেছে খেয়ালই করিনি।
ভাবী আমার হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম। ভাবী নিজে থেকেই বললো ইয়াজ ছোট বেলা থেকেই নাকি অন্য রকম, অন্যদের মতো নিজের প্রতি খাপছাড়া নয়। ভীষণ জেদি আর আত্মসম্মানবোধ সম্পূর্ণ! পড়ালেখায় মনোযোগী আর বড় হওয়ার পরে নিজের রুমে সহজে কাউকে যেতে দেয়না। সে সবকিছুরে ছাড় দেয় কিন্তু সবার মতো ঝগড়াঝাটিতে নাই । এমনকি ভাবী আর সে ৫ মিনিটের ছোট বড় হওয়া সত্ত্বেও তারা তুমি করে সম্বোধন করে। তবে তারপরও নাকি ভাবীর জন্য তার পুরো হৃদয়টাই পাতানো। তার বোনকে কেউ কষ্ট দিলে সে সেটা সহ্য করতে পারে না!
কেন জানি ইয়াজের ব্যপারে শুনতে ভালো লাগছিলোনা। কারণ সে আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছে এবং রাগিয়েছে। ভাবি এসব বলার মধ্যেই আমি হুট করে বলে উঠলাম,
___আরে ভাবী আমার ভাই তো বিয়েই করতে চাইছিলো না। তোহ কেমন বুঝাপড়া হয়েছে তোমাদের?

আমার কথার সাথে ভাবীর চেহেরাটা অন্য রকম হয়ে গেলো, একটু আনমনা হয়েও স্বাভাবিক স্বরে হেসে বললো,
___ তোমার ভাইয়ের কথা আর বলোনা, সবার সামনে ভালোই কিন্তু এমনিতে আমাকে পাত্তা দেয়না। আচ্ছা বিয়ের আগে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক টম্পর্ক ছিল নাকি?

আমি ভাবীর এই কথাটাকে কেন জানি মজা ভেবে হাসির সাথেই উড়িয়ে দিলাম। কারণ আমি ভালো করেই জানি ভাইয়ের এমন কিছু ছিল না। এই টপিক বাদ দিয়ে বললাম,
___ উফফ! প্রচন্ড গরম। আচ্ছা ভাবী দেখো তো আমার শরীর থেকে ঘামের কোনো গন্ধ আসছে কিনা?

ভাবী না শুঁকেই বললো,
___আরে না, তুমি আসার পরে দূর থেকেই কি মিষ্টি একটা সুগন্ধ পাচ্ছিলাম। কাছ থেকে আরো ভালো লাগছে !

আমি অবাক হয়ে বললাম,
___সত্যি বলছো?

___আরে হ্যাঁ মিথ্যা কেন বলবো?

ভাবীর কথা শুনে মনে মনে ইয়াজের চৌদ্দ গোষ্ঠীকে বকতে আরম্ভ করে দিলাম। কতো বড় বেয়াদব! রিকশায় নাক চেপে কি অপমান করেই না কথাটা বললো ! গন্ধে নাকি ওর বমি পাচ্ছে! এটা শুনে রিকশাওয়ালাও তখন পেছন থেকে গামছাটা টেনে নাক বরাবর নিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো ইয়াজের কথা শুনে উনারও বমি বমি লাগছিলো।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে