অপূর্ণ অভিলাষ পর্ব-০১

0
2824

গল্পঃ #অপূর্ণ_অভিলাষ (প্রথম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

বিয়ে করার এক বছরেও নাকি নিজের বউয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়নি আমার ভাই। এতদিন ভাবতাম ভাবী বুঝি মিছামিছি দুষ্টামি করে এসব উদ্ভট কথা বলে।
কিন্তু আজকে ভাবীর পাঠানো ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে আমাদের সব ভ্রান্ত ধারণা বদলে গেলো। সেখানে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন ভাইয়ার অন্যত্র সম্পর্ক থাকার জন্য তিনি স্ত্রীকে প্রাপ্য মর্যাদা দিচ্ছেন না। তাই তিনি তাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

কাগজে এসব দেখার পর থেকে আম্মুর বিলাপ থামছেনা। বলতেছে এতো ভালো মেয়েটা শুধু ভাইয়ার দোষে চলে গেলো, আব্বু বাসায় ফিরলে ভাইকে সোজা ঘর থেকে বের করে দিবে। এমন কুলাঙ্গার ছেলের এই বাড়িতে কোনো ঠাঁই নেই।

এদিকে আমি সেই তখন থেকে আমি ফুঁপিয়ে কান্না করছি। কারো দিকেই ভাইয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পুরো আধ ঘন্টা ধরে তিনি ভাত খাচ্ছেন৷ উনার বউ উনাকে ছেড়ে চলে গেছে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা। খাওয়া শেষ হওয়ার পরে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে তিনি আমাকে পাশ কাটানোর সময় বলে,
___বিন্দিয়া কাঁদছিস কেন?

আমি কান্নাভেজা চোখেই রেগে তাকালাম। আর জোরে ভাঙা গলায় বললাম,
___ কিছু জানোনা তুমি? আরে তোমার বউ চলে গেছে এবার খুশি তুমি? দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। যাও যাও এবার কোন প্রেমিকা নাকি আছে, তাকে নিয়ে কোথাও চলে যাও। এই বাড়িতে আসবা না। বাবাকে বলে দিবো তোমাকে আজীবনের জন্য এই বাড়ি নিষিদ্ধ করে দিতে৷

ভাই স্বাভাবিকভাবে বলে,
___আরে বউ গেলে আমার গেছে। তোদের কি তাতে? ন্যাকা কান্না এবার থামা, মা’কে নিয়ে খেয়ে নে।

বলেই উমি হনহন করে চলে গেলো। আমি ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে এবার হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে বারবার শোকের গভীরতা প্রকাশ করছেন। ভাবছে আমি সঙ্গীবিহীন হয়ে গেলাম তাই হয়তো এভাবে কাঁদতেছি। তাছাড়া আমার ভাবী ছিল রূপেগুণে একদম নজরকাড়া। এক বছরে সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। ঈদ কাটাতে বাবার বাড়ি গিয়ে যে আর আসবেন না সেটা আমরা কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি সব দোষ ভাইয়ার। তিনি এটা করতে বাধ্য করেছেন।
আমি ভাবীর জন্য কাঁদছি কথা ঠিক কিন্তু তার সাথে আরেকটা কারণ রয়েছে। যেটার সাথে আমার জীবনটাই আষ্টেপৃষ্টে সম্পৃক্ত!

আমার ভাই বিয়ে করার সময়েই কেমন যেন উদাস ছিল। কিন্তু আমার বাবা মা উনাকে অসংখ্যবার জিজ্ঞাসা করেছে উনার পছন্দের কেউ আছে কিনা, সেই মেয়ে যদি দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট কেউও হয় তাহলেও মেনে নিবেন। কারণ ভাইয়াকে এর কয়েকবছর আগে থেকেই বিয়ের জন্য প্যারা দিচ্ছিলেন কিন্তু উনি কিছুতেই কান দিতেন না এমনকি রাজীও হতেন না। তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের সবার পছন্দে বিয়ে ঠিক করেছিলেন।
কিন্তু ভাই শুধরালোনা। শেষ পর্যন্ত ভাবীকে চলে যেতে বাধ্য করলো।
কিন্তু এসসবকিছু যাই হোক, কষ্ট হলেও আমি মেনে নিতাম, যেহেতু জোর করে সম্পর্ক হয়না। কিন্তু এখন যে এই সম্পর্কের সাথে আমার জীবনও জড়িয়ে আছে, এখন আমার কি হবে!?
আমার চোখ ঝাপসা , সেখানে বারবার ভাসছে সেই সোনালী সময়গুলো।


বিয়ের আগেরদিনের ঘটনা..

গায়ে হলুদের যাবতীয় আয়োজন নিয়ে আমার সমবয়সী চাচাতো, ফুফাতো, আর মামাতো বোনকে দিয়ে আমাকে ভাবীদের বাড়িতে পাঠানো হলো। আমার সাথে ছিল বিন্তি, রাহমি, আর প্রিয়ন্তী।
আব্বু আমাদের চারজনকে পাঠিয়েছে এগুলো পোঁছেই আবার চলে আসতে। অন্যদিকে আমাদের গাড়ী মেইন রাস্তা পেরিয়ে আর ঢুকতে পারছিলোনা। সকালে প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভেতরের মাটির রাস্তাটা কাদায় একাকার ছিল।
সেদিন মারাত্মক বিরক্তি নিয়ে গাড়ী থেকে নামতেই দেখলাম একটু দূরে চোখ থেকে সানগ্লাস নামাতে নামাতে চুল ঠিক করছে একটা ছেলে। মুখটা ভালোভাবে উপরে তুলতেই রাহমির দিকে তাকিয়ে আমি চোখ বড় করে নিজের মুখ চেপে ধরলাম।
তারাও চোখ ড্যাবড্যাব করছে। বিন্তি একটু জোরেসোরে বলেই ফেললো,
___আরে এ তো ইথিলা ভাবী, মানে আমাদের হবু ভাবী এটা। ছেলের ছদ্মবেশে এসেছে।

আমি বিন্তির কাঁধে হাত রেখে বললাম,
___ ভাবীর জমজ ভাই আছে শুনেছিলি তুই? ইয়াজিদ না কি যেন নাম। শুনেছিলাম তারা একরকম দেখতে, তবে এতটা হবে ভাবিনি। উনিই সেই মানুষ, নয়তো উচ্চতা খেয়াল কর গাধী, মুখে আবার ছাপদাঁড়িও আছে৷ এটা উনিই কনফার্ম। চেহেরা আর গায়ের রঙ দেখে ভুল ভাবছিলি। উনি পরিক্ষার জন্য আগে আসেনি,তাই তারিখ হওয়ার সময়ও দেখিনি। আমাদেরকে এখন এগিয়ে নিতে এসেছে।

প্রিয়ন্তী আমার কানে এসে ফিসফিস করে বললো,
___ওরেএএ এই ছেলে কি হ্যান্ডসাম। ছোঁ মেরে নিয়ে উড়াল দিতে ইচ্ছে করছে।

আমি মাথায় জোরে চটকানা দিয়ে দেখালাম উনি ততক্ষণে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কাছাকাছি এসেই হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি মুখটা ত্যাড়া করে বললাম,
___আপনার সাথে হাত মিলাতে আমরা ইচ্ছুক নই।

তখনি খেয়াল করি প্রিয়ন্তী, রাহমি,বিন্তি তিনজনের হাতই সামনে ঝুঁকে আছে। এদিকে উনি কাউকে পাত্তা না দিয়ে আমাদের ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে সেখানে আরেকটা ব্যাগ রেখে পেছন ফিরেছেন।

প্রথমত হাত মিলানোর কথা বলে আমি লজ্জা পেলাম, আসলে হাত মেলাতে নয় ব্যাগ নিতে হাত বাড়িয়েছিল, দ্বিতীয়ত আমার কথা শুনে হাত মেলানোর আবেগ সামলাতে না পেরে আমার সাথের তিনজনই টক স্বাদের লজ্জা নিয়ে আর চোখ খুলে তাকাতে পারছেনা, মনে হচ্ছে ফাঁকফোকর পেলে এখনি এখান থেকে উধাও হয়ে যাবে।
ওদের তিনজনকে ধরে উনার উদ্দেশ্যে বললাম,
___আসলে ভাবীর হলুদের এই জিনিসপত্রগুলো পৌঁছাতেই এসেছি, তাহলে আর বাড়ির ভেতরে না যাই কেমন? চলে যাচ্ছি আমরা! আসলে অনেক কাআজ..

আমার কথা শেষ করার আগেই তিনি মাথা নেড়ে বললেন,
___আচ্ছা সাবধানে যাবেন।

আমি তখনও কাজ আছে কথাটা বলার জন্য হাঁ করেই আছি। কিন্তু উনি এটা বলেই পেছনে আর না তাকিয়ে পা টিপে টিপে কাদার উপর দিয়ে হাঁটা ধরেছে।

আমি শুকনো মুখ করে তাকিয়ে আছি, ওরা তিনজন কেঁদে ফেলার অবস্থা। আত্মীয়তা বুঝেনা কেমন বাড়িতে ভাইকে বিয়ে করাচ্ছি? আমি তো জাস্ট একটু ভাব নেওয়ার জন্য এমনভাবে বলেছি যে আমরা এখান থেকেই চলে যাবো,আমাদের কাজ আছে। আসলে ভেবেছি তাহলে আমাদেরকে বারবার বলে তারপর বাড়িতে নিবে। ভালো খাতিরযত্ন করবে। কিন্তু একবার না করাতে সত্যি সত্যি রাস্তা থেকে আমাদেরকে বিদায় করে দিবে, এটা কেমন মানুষ?
চারপাশে কতক্ষণ পায়চারি করে ভাইকে ফোন করে জানালাম এই তীব্র অপমানের কথা।
ভেবেছিলাম ভাই হয়তো শ্বশুর বাড়ির কাউকে ফোন করে ব্যপারটা জানাবে, আর কেউ ক্ষমা চেয়ে আমাদেরকে এখান থেকে সাদরে নিয়ে যাবে। কিন্তু এবারও উল্টো হলো, ভাই সুন্দর করে বললো, আমরা এখান থেকেই ফিরে যেতে।

একবুক হতাশা নিয়ে আমি উনার রেখে যাওয়া ব্যাগটা তুলে গাড়ীতে রাখলাম। আর আমরা রাস্তা থেকেই বাড়িতে ফিরে আসলাম। মনে মনে শপথ করলাম বরযাত্রীর সাথে এখানে আর আসবোই না। আমি জামাইয়ের একমাত্র বোন।আর যাই হোক আমার আলাদা ভাব আছে, সেখানে আজকেই কিনা অপমানিত হলাম!
প্রচন্ড জিদ হচ্ছিলো এই ছেলের উপর।

বাড়িতে এসে নিজের ভাবনামতো আনন্দও করা হলোনা। রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো। কিন্তু যাদের নিয়ে গেছিলাম তারা স্বাভাবিক ছিল। আবার পরেরদিন নাচতে নাচতে বরযাত্রী চলে গেছে। আর আমি অসুস্থ বাহানায় সারাদিন বিছানায় পড়ে রইলাম।

সন্ধ্যার পরে বউ আসলো, সারা বাড়িঘরে আনন্দের ধুম। কিন্তু আমার ভেতরটা এখনো চুপসানো। সেই অপমান কোনোভাবেই ভুলতে পারছিনা। পরেরদিন আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে ইয়াজিদ এসেছিলো। কিন্তু আমি আমার দেখা দেইনি। আড়ালে আড়ালে ছিলাম। সেদিনই ভাইয়া যখন শ্বশুরবাড়িতে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছেন, তখন সবাই আমাকে জোর করলো ভাইয়ার সাথে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি গেলাম না। এমনকি ভাবী আমার সাথে রাগ পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু আমি ভীষণ একগেঁয়ে, কেউই রাজী করাতে পারলোনা।

সেদিন সন্ধ্যার পরে হঠাৎ করেই আমাদের বাড়িতে ইয়াজিদ আবার আসলো। এসেই আমার মা’কে বললো আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে আবার পাঠানো হয়েছে। নয়তো উনার মা-বাবা ভীষণ রাগ করবে৷ মা ভালো করেই জানতেন আমি এখনো রাজী হবোনা। তাই উনাকে বললেন আমাকে রাজী করানোর চেষ্টা করতে।
এসব কথা আমি লুকিয়ে শুনে নিলাম। আর আমি নিজের রুমে গিয়ে আমাকে করা অপমান ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।

দরজার সামনে গিয়ে দুইবার উঁকি দিলাম আসছে কিনা। তারপর তৃতীয়বার ডানে বায়ে উঁকি দেওয়ার সময় সুযোগ খুঁজে কি করে যেন আমার পেছনে এসে দাঁড়ালো। এদিকে আমি হালকা পিছিয়ে ভেতরে যেতে চাইলেই বাঘ দেখার মতো লাফিয়ে উনাকেই জড়িয়ে ধরলাম, উনি সাথে সাথেই আমাকে সরিয়ে আচমকা বলে উঠলেন,
___ছেলে দেখলে হুশ থাকেনা?

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে