অপূর্ণতা পর্ব-১+২+৩

0
2708

#গল্প_অপূর্ণতা
#Ritu_Bonna
#পর্ব_১_৩

আজ বিশ বারের মতো আমাকে পাএপক্ষ দেখতে আসবে, কথাটি শুনে নিশ্চয়ই আপনারা অবাক হবেন।আর অবাক হওয়ারই কথা। পাএপক্ষ আসবে তাই তার প্রস্তুতি চলছে।বাড়ি-ঘর সুন্দর করে গুছানো হচ্ছে, বিভিন্ন রকমের রান্নার আয়োজন করা হয়েছে।এই সব কিছু করতে করতে দুপুর হয়ে গেছে আর পাএপক্ষ চলে এসেছে।আমার মা আর বোন আমাকে সাজিয়ে পাএপক্ষের সাথে কথা বলতে চলে গেছে। আমি একা একা ঘরে বসে আছি।সবাই তো ব্যস্ত তাদের আপ্যায়ন করতে তাই।

আব্বু তো তাদের সামনে একটা একটা করে আমার গুণ বলতে লাগলো।আমার অদ্রিতা মা রান্না থেকে শুরু করে সেলাইয়ের কাজ সব করতে পারে। পড়াশুনাও ভালো। আর ও অনেক নম্ন,ভদ্র আপনারা তাকে যেই ভাবে বলবেন সে সেই ভাবেই চলবে।কথা বার্তার মাঝখানে পাএের মা আমাকে নিয়ে আসতে বলে।আমার মা আর বোন আমাকে নিয়ে যায় পাএপক্ষের সামনে।

আমাকে দেখেই তাদের মুখ কালো হয়ে যায়। সবাই একদম চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষন চুপ থেকে পাএের মা বলেই ফেলে এত গুণবতী মেয়ে আমাদের লাগবে না। কালো মেয়েকে আমি আমার ছেলের বউ করতে পারবো না।এই বলে তারা চলে যায়।

তাদের এই আচরণে আমার খারাপ লাগেনি। কিন্তু মা-বাবার অনেক খারাপ লেগেছে। কেউ আমাকে অপমান করলে তারা তা সহ্য করতে পারে না।এখন আমার নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে না কষ্ট হচ্ছে আমার পরিবারের জন্য তারা আমাকে এতো ভালোবাসে অথচ আমার জন্য তাদের অপমানিত হতে হয়। কিন্তু আমিই বা কি করবো আমার হাতে তো কিছু নেই।কারণ এখন তো মানুষের যোগ্যতা নির্ভর করে গায়ের রঙের উপর তার গুণাবলির উপর নয়।

কথায় কথায় তো আমার পরিচয়তাই দেওয়া হয়নি। আপনারা তো আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না।আমার নাম তাসরিন জাহান অদ্রিতা। আমরা দুই বোন এক ভাই। ভাই এইবার ইন্টার পরিক্ষা দিত কিন্তু করোনার জন্য প্রথমে পরিক্ষা স্থগিত করা হয় আর এখন তো ঘোষণাই দিয়ে দিয়েছে যে আর পরিক্ষা হবে না। জি.এস. সি আর এস.এস. সি এর ভিত্তিতে রেজাল্ট দিবে। আর বোন ১০ ম শ্রেণীতে পড়ে। আমি এইবার অর্নাস ৩য় বর্ষে পড়ি। আমার এখন বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ছিল না। ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কিন্তু মা- বাবা যেন আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে -পড়ে লাগছে।তাদের কথায় কোন রকম বাধ্য হয়েই আমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।

তাছাড়া মা- বাবাই বা কি করতো কারো বাড়িতে যদি বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে থাকে তবে তো তার পরিবারের থেকে যেন পাড়া- প্রতিবেশীদের চিন্তা একটু বেশি থাকে। কথায় আছেনা মার চেয়ে মাসীর দরদ বেশি ঠিক তেমনিই।তারা বলাবলি করে আমি নাকি বুড়ী হয়ে যাচ্ছি এমনেই কালো তার পরে আবার বুড়ি এমন মেয়েকে কে বিয়ে করবে। আরও কত কি,,,,

তাই মা- বাবা আমার বিয়ের জন্য এতো চেষ্টা করছে।

এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখে পানি এসে পরেছে তা খেয়ালই করি নি।এমন সময় দরজায় কারো নক করার আওয়াজ শুনে জিজ্ঞেস করবো কে তার আগেই বললো আপু আসতে পারি??

আয়……

আপু তুমি কষ্ট পাওনি তো???

কষ্ট কেন পাব, কষ্ট পাওয়ার মতো তো কিছু হয়নি। তুই বস আমি আসছি???

কোথায় যাচ্ছ???

তুই বস, আমি আসলেই বুঝতে পারবি।
আমি আলমারি থেকে দুই হাজার টাকা বের করে এনে ভাইকে দিলাম।দুই দিন পরে তো পিকনিকে যাবি তো এই টাকাটা রাখ এখন মা-বাবার মন খারাপ তাদের কাছে চাইতে হবে না।

লাগবে না আপু, আমি কোথাও যাব না।

যাবি না মানে এত দিন ধরে তো যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ছিলি এখন কি হলো।আমার জন্য এত চিন্তা করতে হবে না।ঘুরে আয় আর এখন যা আমি একটু একা থাকতে চাই।

১ সপ্তাহ পরে………
কলেজ থেকে এসে রেস্ট নিতে মাত্র ঘরে গিয়েছি এমন সময় আব্বু ডাক দিল,”অদ্রিতা মা এদিকে আয়।” আব্বুর কথা শুনে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে আব্বুর কাছে গেলাম।আব্বু তুমি ডাকছিলে…??

হুমম….. কাল কলেজে যাওয়ার কোন দরকার নাই। কাল পাএপক্ষ তোকে দেখতে আসবে।

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি করে সেখান থেকে চলে আসি।

তাছাড়া আর আমি কি করতাম। আব্বুর মুখের উপর তো আর না করতে পারি না।
তাদেরকে বলতেও পারছি না যে আমি আর কারো সামনে সং সেজে বসে থাকতে চাই না।চাই না আবারও অপমানিত হতে। আমি তোমাদের কাছে কি এতটাই বুঝা হয়ে গেছি যে আমাকে বিদায় করার জন্য এতো তাড়াহুড়ো করছে।মনে মনেই কথা গুলো ভাবছি…. চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।নিজেকে কোন ভাবেই শান্ত করতে পারছি না…… পারছি না নিয়তি ভেবে এই সব কিছু মেনে নিতে।।রাতে মা খাওয়ার জন্য অনেক ক্ষন
ধরে ডাক দেওয়ার পরেও যখন কোন কথা বলি নি। তখন মা চলে যায়… মনে করে হয়তো আমি ঘুমিয়ে গেছি। কিন্তু আমার চোখে ঘুম আসছে না আর আমি চাচ্ছিলাম না এই অবস্থায় তাদের সামনে যাই।আমাকে দেখেই বুঝতে পারতো আমি কাঁদছিলাম।আমি চাই না আমার জন্য তারা আর কষ্ট পাক।

পরের দিন সকালে তারা আবার সেই আগের কাজ করতে লাগলো। সেই ঘর সুন্দর করে সাজানো, ভালো রান্না-বান্না করা এইসব।এইসব দেখে আমার বিরক্ত লাগছে তাই মাকে বললাম কি দরকার এত টাকা নষ্ট করার।এই টাকা গুলো তো জমিয়ে রাখতে পারো পরে রোহিত আর মাহিরার পড়াশোনার কাজে লাগবে।অযথা প্রত্যেকবার এত টাকা নষ্ট করার কোন মানে হয় নাকি।

আমার কথা শুনে মা হেসে বললো,” শুনো মেয়ের কথা। তোর এত চিন্তা করতে হবে না যা গিয়ে ফ্রেস হয়ে খেয়ে নে।”

আমি রাগ করে আর কিছু না বলে সেখান থেকে রুমে
এসে ফ্রেস হয়ে নিলাম।কাল রাতে কিছু খায়নি তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে খেয়ে নিলাম।

দুপুরের দিকে পাএপক্ষ চলে আসে। আব্বু আবার সেই আগের মতোন আমার প্রশংসা করতে লাগলেন।কিছুক্ষন পরে আমাকে পাএপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়।আমাকে নিয়ে আসলেই আমি সামনের দিকে চেয়ে সবাইকে এক নজর দেখে নেই।পাএকে দেখে তো আমি পুরোই অবাক।ওনি দেখতে অনেক সুন্দর তাছাড়া মা বলেছে ছেলে নাকি ভালো চাকরি করে তাদের পরিবার ও নাকি আমাদের থেকে অনেক ধনী।
মনে মনে তো ধরেই নিয়েছি এখনি না করে চলে যাবেন সবাই………

আমাকে দেখে সবাই কিছুক্ষন চুপ থাকে। পরে হঠাৎই পাএের বাবা বলেন যে তিনি আমার সাথে কিছু কথা বলতে চান।তাই আব্বু বললো অদ্রিতা মা ওনাকে ওই রুমে নিয়ে যা।আমি কিছু না বলে আব্বু কথা মতো ওনাকে আমার রুমে নিয়ে গেলাম।

রুমে গিয়ে তিনি বললেন মা,”আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?”

আমি তো পুরোই অবাক হয়ে গেলাম।এই প্রথম আমার বাবা ছাড়া অন্য কেউ আমাকে মা ডাকলো।ওনার মুখে এই মা ডাকটা শুনে মনের ভিতর যেন অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করলো।তাই কিছুটা অবাক হয়েই বললাম,” আমি আপনার অনেক ছোট।
আপনি আমাকে যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন। আমার থেকে অনুমতি নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।”

ওনী আমাকে কিছু প্রশ্ন করেন এবং আমিও তার উওর সঠিক ভাবে দেওয়া চেষ্টা করি। কিন্তু আমি জানি না দেওয়া উত্তর গুলো ওনার কাছে কতোটুকু ঠিক বলে মনে হয়েছে।
আমার কথা শুনে তিনি রুম থেকে বের হয়ে সবার মাঝে গিয়ে মুখ গম্ভীর করে কিছুক্ষন বসে থাকেন।
তার পর যা বললেন তা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলাম।

মোঃ রফিক চৌধুরী( পাত্রের বাবা) তিনি বললেন মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে তাদের ঘরের বউ করে নিতে চান।তাই ৭ দিন পরে বিয়ের দিন ঠিক করলেন।

সবাই অনেক খুশি হলো কিন্তু ৭ দিন পরে বিয়ের তারিখ হওয়ার কাজে অনেক ব্যস্ত হয়ে পরে। অনেক কাজ বাকি এত অল্প সময়ে এত কাজ কিভাবে শেষ করবে তা ভাবছে।বিয়ে অনেক কিনা- কাটা করার আছে, আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেওয়া, বাড়ি সাজানো,বিয়েতে কে কি পরবে আরও অনেক কিছু।
সব কাজ করতে করতে কিভাবে যে ১ সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল তা বুঝতেই পারি নি।

আজ আমার গায়ের হলুদ, খুব সাধাসিধা ভাবেই তা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে।ছেলের বাড়ি থেকে কয়েক জন এসে হলুদ সহ যা লাগে তা দিয়ে গেছে। সাথে সবার জন্য ভালো সাড়ি আরও অনেক কিছু।

কাল আমার বিয়ে। বাড়িতে মেহমান, আত্মীয় – স্বজন সবাই গমগম করছে।সবাই অনেক খুশি। আমাকে নিয়ে রসিকতা করছে সবাই।

রাত অনেক হয়ে গেছে কালকে বিয়ে তাই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কালকেই চলে যাব একটা অপরিচিত পরিবারে।তাদেরকে আপন করে নিতে হবে।যারা আমার আপনজন, যাদের ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারি না।যেটা আমার নিজের বাড়ি একদিন পরেই এই বাড়িতে আমি অতিথি হয়ে আসবো ভাবতেই কান্না আসছে। এখন খুব মনে পরছে এই বাড়িতে কাটানো দিনগুলো। ছোট ভাই ও বোনের সাথে ঝগড়া খুনশুতিময় সময় গুলো।তাদের সাথে আর আগের মতো মজা করতে পারবো না।আমার এখন অনেক কান্না পাচ্ছে। এখন আমার বলতে ইচ্ছে করছে এই বিয়ে আমি করবো না, আমি থাকতে পারবো না তোমাদের ছাড়া কিন্তু তা আর সম্ভব নয়।

এইসব ভাবতে ভাবতে রাতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি তা মনে নেই। সকালে রোদের আলো চোখে পরতেই ঘুম ভেঙে যায়।সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। আমাকে কিভাবে সাজাবে, কিভাবে সুন্দর লাগবে আরও কত কি।আগে এই বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতাম কিন্তু আজ বিষন্নতা আমায় গিরে ধরেছে। ইচ্ছে করছে জোরে কান্না করি কিন্তু তাও সম্ভব নয়।আমাকে সাজানো হয়ে গেছে।সবাই আমাকে নিয়ে রসিকতা করছে এমন সময় কে যেন বললো বর এসেছে….. আমার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠলো।

ইসলামিক ভাবেই আমার আর আরিয়ানের বিয়েটা হয়ে গেল।আরিয়ান চৌধুরী হলো মোঃ রফিক চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। পড়ালেখা শেষ অনেক আগেই এখন AR Group of Company te ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করে।

বিয়ের সব কাজ শেষ হলে আমার শ্বশুর বলেন বেয়াইন এখন আমাদের যেতে হবে নয়তো পরে অনেক দেরি হয়ে যাবে।গাড়িতে বসেই আমি নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারলাম না। কান্না করলাম।গাড়ির থেকে মুখ বাহির করে দেখি মাও কান্না করছে।গাড়ি ছেড়ে দিছে আমি বাহিরে তাকিয়ে আছি যতদূর পর্যন্ত তাদের দেখা যায় দেখছি,,,,,
.
.
.
চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে