অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -১৬

0
2178

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১৬

চড়ুই পাখির ঝাঁক সব দলবেঁধে এসে নেমেছে আরাফাতদের বাড়ির খালি জায়গা গুলোতে।তাদের চুইই চুইই ডাকে মুখরিত হয়ে ওঠেছে সারা বাড়ি।সারা এলাকা নিরব নিথর, সবাই হয়তো এখনও ঘুমে নিমজ্জিত তাই চড়ুইদের ডাক কানে বাজছে বেশি।আর এদের এই চুইই চুইই ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেছে মাহার।

চোখ জোড়া পিটপিটিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকালো মাহা।ঘুমের রেশ এখনও কাটে নি তার।চোখ কচলে স্থির হতেই বুকের ওপর ভারী কোনো কিছু অনুভব করলো।বুকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেল আরাফাত তার বুকে মাথা রেখে ভালো একহাত একপা দ্বারা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।মাহা অবাক হয়ে মাথা তুলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেল অবহেলায় বিছানার এককোণে পড়ে আছে কোলবালিশটা।এটা নিশ্চিত আরাফাতের কাজ,কারণ মাহা কোলবালিশ সরায় নি।

মাহা খুব নিবিড়ভাবে আরাফাতকে লক্ষ্য করছে।এক্সিডেন্টের পর বেচারা অনেক শুকিয়ে গেছে।গায়ের রঙ ফকফকা ফর্সা থেকে কিছুটা মলিন হয়ে গেছে।হালকা খোঁচা খোঁচা চাপদাঁড়ি গালে বিদ্যমান।কপালের কোণায় গভীর ক্ষতের দাগ সেই ভয়াবহ এক্সিডেন্টের কথা মনে করিয়ে দেয়।এমন আরও অসংখ্য ক্ষতের দাগ তার শরীর জুড়ে আছে।আরাফাতের ঘুমন্ত চেহারা দেখে মাহা হাজার বারের মতো আজকে আবারও গভীর প্রেমে পড়লো।মত্ত হলো আরাফাতের মাঝে।

দু’হাতে পরম আবেশে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে নিলো তাকে নিজের সাথে।সময় নিয়ে অধর জোড়া ছোঁয়ালো তার কপালে।কপালে চুম্বন করা মানে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।যা মাহা প্রতিদিনই ঘটায়।আরাফাতকে চুমু খাওয়া তার নিত্যদিনের রুটিনের মধ্যেই পড়ে।কখনো ভাবে নি সে আরাফাত তার হবে!আর এভাবে কখনো তার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেবে সে!এককালের কিশোরী মনের কল্পনা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে!সুখের সাগরে ভেসে গেল মাহা,আবারও আরামের ঘুম এসে হানা দিলো চোখের পাতায়।

__________

বেলা নয়টা বেজে গেছে এতক্ষণে,
আরাফাত মাহা দুজনেই ঘুম থেকে ওঠে গেছে।আরাফাত আজকে মাহার বুকে নিজেকে আবিষ্কার করে মুখ ফুটে কিছুই বলে নি,যেন সব স্বাভাবিক।তবে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে সরি বলে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে মাহার বুক থেকে।আর মাহাও বিপরীতে পাল্টা কিছু বলে আরাফাতকে অস্বস্তিতে ফেলে নি।সুতরাং দুজনেই যথা স্বাভাবিক আছে।

মাহা আরাফাতের ক্ষতের দাগগুলোতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছিলো এমন সময় লিপি বিনা অনুমতিতে তাদের কক্ষে প্রবেশ করে।আরাফাতের বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গিয়েছে।মেয়েটির কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই,একজোড়া সদ্য বিবাহিত কাপলদের রুমে এভাবে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া কোনো ম্যানার্সের মধ্যে পড়ে না।মাহা এমনভাবে তাকালো লিপির দিকে যেন এক্ষুনি ওকে না চিবিয়ে গিলে খেয়ে নেবে।লিপি যেন তা কেয়ারই করলো না।মাহার জ্বলন্ত দৃষ্টি উপেক্ষা করে মিষ্টি হেসে আরাফাতের দিকে চেয়ে এগিয়ে এসে পাশে বসলো।আরাফাত নিজের অজান্তেই মাহার একহাত ধরে চুপচাপ বসে অন্যদিকে তাকালো।এই বেয়াদবটার চেহারা দেখারও রুচি হচ্ছে না তার।

‘আরাফাত তুমি ওদিকে তাকিয়ে আছো কেন?আমার দিকে তাকাও!অনেকদিন পর এখানে এসেছি।আগে আগে এলে তো তুমি কাজের ব্যস্ততায় সময়ই পেতে না কথা বলার।এখন তো আর ওসবের চাপ নেই।তো আসো এখন আমরা দুজন গল্প করি বসে।’ লিপি কথাগুলো বলে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে মাহার দিকে তাকালো।মাহার যে এখন কী পরিমাণ বিরক্ত লাগছে এই ছ্যাসড়া মেয়েটাকে তা তার চোখ দেখলেই বোঝা যাবে।

আরাফাত লিপির দিকে না তাকিয়েই বললো,’আমার এখন গল্প করার মুড নেই।তুমি বরং লিসা নিসার সাথে গল্প করো গিয়ে যাও।আমাকে জোর করো না।’

লিপি যেন কানেই নেয় নি আরাফাতের কথা।সে মাহার দিকে তাকিয়ে আদেশকৃত কন্ঠে বললো,’শুনো তুমি একটু রান্নাঘরে গিয়ে আমাদের দুজনের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসো প্লিজ।আমরা দুজন কফি খেতে খেতে কিছুক্ষণ কথা বলবো।আর আমাদেরকে একটু আলাদা স্পেস দিলে আরও ভালো হয়।’

মাহা মনে মনে বললো,’হ্যা শেয়ালের হাতে মুরগী বাগি দিয়ে যাই,তাই না!খাঁড়া,তোরে আজকে আমি নাকানি চুবানি খাইয়ে তবেই ছাড়বো।ওয়েট।’

‘আসলে আমরা নিউ ম্যারেড কাপল তো!এমন টাইমে আমরা কিছুক্ষণ ইটিস পিটিস সামথিং ইয়ে মানে একটু আধটু রোমান্স।বুঝতেই পারছেন আপনি কী বলতে চাচ্ছি!তো এখন আমাদেরকে এভাবে ডিস্টার্ব না করে একা ছেড়ে দিলেই বরং খুশি হবো আরকি।কফি খেতে ইচ্ছে করলে নিজে বানিয়ে খেতে পারেন।আমি নিজের জন্যেও কখনো রান্নাঘরে যাই না,বড়লোকের মেয়ে আমি বুঝলেন।যা-তার জন্য হাত নষ্ট করি না।’

মাহার শান্ত কন্ঠে বলা কথাগুলো যেন লিপির অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিলো।
রেগেমেগে আঙ্গুল তুলে কিছু বলতে নিলেই মাহা আঙ্গুলটা ধরে নামিয়ে দিয়ে বললো,’আঙ্গুল কাকে দেখাচ্ছেন শুনি?ফাজলামো করলে তুড়ি মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো।আগেও বলেছি এখনও বলছি আমার স্বামীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।অহেতুক আমাদের ডিস্টার্ব না করে প্লিজ রুম থেকে যান এবার।গো টু হেল।আর হ্যা নেক্সট টাইম নক না করে রুমে ঢুকলে খবর আছে,মাইন্ড ইট!

‘ইউ ব্লাডি বিচ,তোমাকে তো আমি পরে দেখে নেবো।আমার সাথে এভাবে কথা বলার শাস্তি তুমি অবশ্যই পাবে।বেশি উড়ো না যেন।এখানে নিজের স্থায়ী ঠিকানা গাড়তে এসেছি আমি।বিফল হয়ে ফিরে যাবো না।তখন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তোমায় এই বাসা থেকে বিদায় করবো আমি।এটা আমার প্রমিজ!’

শেষের কথা গুলো মাহার খুব নিকটে এসে ফিসফিস করে বললো লিপি।মাহা তাচ্ছিল্য হেসে জবাব দিলো,’দেখা যাবে কে কাকে কুকুরছানার মতো লাথি মেরে বিদায় করে।আমাকে এত সহজ মনে করলে মস্ত বড় বোকামি করবেন কিন্তু।যাকগে, গেট লস্ট ফ্রম মাই রুম ড্যাম ইট!’ প্রথমে লিপির মতো ফিসফিস করে বললেও শেষের লাইনটা খুব জোরে ধমক দিয়ে বললো মাহা।লিপি অপমানিত হয়ে চোখ রাঙিয়ে হনহনিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

আরাফাত এতক্ষণ হাবলার মতো ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলো।ওরা এমনভাবে কথা বলেছে যে শব্দ শোনা গেলেও কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যায় নি।তবে লিপি যে কিছু বলে হুমকি দিয়ে গেছে তা বুঝতে পারলো সে।মাহার চেহারা একদম স্বাভাবিক যেন কিছুই হয় নি এখন।আরাফাত নিরীহ কন্ঠে জানতে চাইলো,’ও কী বলে গেল তোমাকে হানি?’

মাহা শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো,’বললো আমি চলে যাওয়ার পর সে তোমায় বিয়ে করে তোমার স্ত্রী হয়ে এই সংসারে আসবে,রানীর হালে থাকবে।আমি আর কী-ই বা বলবো!ও যা বলে গেল তা তো সত্যিই।তুমি আর ক’দিনই বা চিরকুমার হয়ে থাকবে!আমি চলে যাওয়ার পর তুমি ঠিকই বিয়ে করে নেবে।আমি অসুন্দর একটা মেয়ে,শুধু তুমি কেন কোনো ছেলেই আমায় পছন্দ করবে না।সবাই চাইবে লিপির মতো সুন্দরী,শিক্ষিত,স্টাইলিশ ও স্মার্ট একটা মেয়েকে বিয়ে করতে।তো তুমি বাদ যাবে কেন?আমি চলে গেলে লিপিকে বিয়ে করে নিও।সুখে শান্তিতে ঘর করো এটাই চাইবো তখন দূর থেকে।’

মাহার কথা শুনে আরাফাতের মন পুরোপুরি রূপে বিষিয়ে গেছে।প্রচুর খারাপ লাগছে তার।মাহা কথাগুলো খুব সাবলীলভাবে বলে দিলেও আরাফাত তা সহজভাবে নিতে পারছে না।বুকে এক অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে তার।এই ব্যথার ঔষধ কী হতে পারে জানা নেই।মাহা বাইরে নিজেকে সেন্টিখোর প্রমাণ করলেও ভেতরে ভেতরে চতুর হাসি হাসছে।
‘ছেড়ে দেয়া এত সহজ নাকি?তবে তোমায় আমি একটু হলেও আমার পিছনে নাচাবো বুদ্ধু!আর ওই লিপিকে তো সাইজ পরে করবো আমি!’ মনে মনে ভাবলো সে।
__________

সোফার রুমে বসে মনে মনে ফুঁসছে লিপি।সাহস কতবড় এই মেয়ে আমায় থ্রেড দেয়!ওকে তো আমি এত সহজে ছাড়বো না।রাগের চোটে জোরে এক হাঁক ছেড়ে জেনিকে ডাকলো সে।জেনির আসতে একটু সময় লাগতেই খেঁকিয়ে উঠে লিপি।কর্কশ কন্ঠে ধমক দিয়ে বললো,’এই তোকে ডাকলে সাথে সাথে আসিস না কেন?দেমাগ বেড়ে গেছে বুঝি?কাজের মেয়ে কাজের মেয়ের মতো থাকবি,বেশি ভাব দেখাতে যাবি না।ইডিয়ট!’

জেনি অপমানবোধ করলো লিপির কথা শুনে।সে একমাত্র যতো দুর্ব্যবহার এই মেয়ের কাছ থেকেই পায় অন্য কেউ তার সাথে এমনভাবে কখনোই খারাপ ব্যবহার করে কথা বলে না।কী যে মনে করে নিজেকে আল্লাহ ভালো জানেন।নিজেকে কোনো রাজ্যের সম্রাজ্ঞী মনে করলেও অবাক হবো না।অথচ ব্যবহার ফকিন্নির মতো।এমনসময় ইশানী এসে জেনিকে বললো,’জেনি যাতো বোন,গিয়ে একটু রসুনের খোসা ছাড়িয়ে রাখ,ডাল রান্না করবো।’

জেনি ওদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে জবাবে জ্বী ভাবি বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।ইশানী এবার খুবই বরফশীতল কন্ঠে লিপিকে বললো,’জেনি হতে পারে আমাদের বাসায় কাজ করে,কাজের মেয়ে।কিন্তু সেও আমাদের পরিবারের একজন সদস্য,আমার বিয়ের আগে থেকে সে এখানে আছে।আমরা কখনোই তার মনে কষ্ট দিয়ে কোনো কথা বলি না।যেখানে আমরা তাকে নিজের বলে মনে করি সেখানে তুমি কে তাকে পদে পদে অপদস্ত করার?শুনো লিপি নিজের লিমিটের মধ্যে থাকো।আমি হওয়ায় তোমায় এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলছি,কিন্তু এসব মাহা দেখলে তোমায় এখনই বেইজ্জত করে ফেলতো।তোমার খালু,খালামণিও কিন্তু তাকে ভয় পায়,সো বুঝতেই পারছো!প্লিজ এভাবে কাউকে কটুকথা বলতে যেও না কখনো।’

‘ওহহ প্লিজ ভাবী!একদম আমায় ম্যানার্স শেখাতে এসো না।তোমার নীতিবাক্য নিজের কাছেই রাখো তুমি।এখন যাও নিজের কাজে যাও আমায় ডিস্টার্ব করো না।’ লিপির কথা শুনে ইশানী আর কিছুই বললো না।এই মেয়েটা খুবই দাম্ভিক।মানুষকে মানুষ মনে করে না যেন সে।নিজের মা বাবার সাথেও কেমন উগ্র আচরণ করে সবসময়।এজন্যই ওকে কেউই পছন্দ করে না।পছন্দ করার মতো মানুষই নয় ও।আস্ত একটা অমানুষ পয়দা হয়েছে।ইশানী বিরবির করে কঠিনতম গালি দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।

‘এত খবিশ কোনো মাইয়া হতে পারে,এরে না দেখলে কহনো জানতামই না আমি ভাবী!’ চাপা স্বরে কথাটি বললো জেনি ইশানীকে।ইশানী সবেমাত্র প্রবেশ করেছে রান্নাঘরে।জবাবে সে বললো,’হু,আমিও কখনো দেখি নি।এটাকে ওর বাপ মা কোনো শিক্ষা দিতে পারে নি তাই ওর এত অধ্বপতন হয়েছে।আল্লাহ হেদায়াত দিক ওই বদমাশকে।’

এই নিয়ে দুজনের মধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছিলো।এমন সময় মাহা প্রবেশ করে রান্নাঘরে।ইশানী তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো।মাহাই একমাত্র মেয়ে যার সাথে ইশানীর বনে ভালো।অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই তার মাঝে।জেনির সাথেও ওর খুব ভালো সম্পর্ক।মাহা দুজনের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,’হোয়াটসআপ গাইজ!কী করো!’

‘আফামনির আইজ্জা ঘুম থাইকা উঠতে লেইট হইলো কে রে?’ রসুনের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে জানতে চাইলো জেনি।

‘আর বলিস না,আজকে ঘুম ভেঙ্গেছিলো আমার সকালে,কিন্তু আলসির জ্বালায় উঠতে পারি নি।আর এখন তোর ভাইজানের হাতেপায়ে মালিশ করতে গিয়ে রুম থেকে বেরোতে লেট হয়ে গেছে।’ মাহা হাসিমুখে জবাব দিলো।

ইশানী বললো,’আরাফাতের নাশতা তৈরি করাই আছে।নিয়ে ওকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নাও গিয়ে যাও।’

‘আচ্ছা ভাবী!তোমরা খেয়েছো তো?’

‘হ্যা আমাদের খাওয়া শেষ।’

‘মামণি কই?’

‘আজ না শুক্রবার!বাবা বাসায় আছেন!মা বাবার পিঠে তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন দেখে এলাম।’

‘ও হ্যা ভুলেই গিয়েছিলাম।আচ্ছা আমি যাই।’

মাহা ডাইনিং রুমে চলে এলো।আরাফাত ড্রয়িং রুমে রিহাদের সাথে দুষ্টামি করছে।তখন আবারও লিপি এসে তার কাছ ঘেঁষে বসে পড়লো মাহাকে দেখিয়ে।মাহা কিছু না বলে টেবিলের ওপর নাশতার ট্রে রেখে গিয়ে আরাফাতের হাত ধরে উঠিয়ে অন্য সোফায় বসিয়ে দিলো।তারপর নিজে তার পাশে বসে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগলো।সেই একপ্লেট থেকে নিজেও খাচ্ছে।লিপি জ্বলে যাচ্ছে এসব দেখে।মাহা অবশ্য তাকে দেখানোর জন্যই একটু বেশি করে লুতুপুতু করছে।মাহা যে তার এত ক্লোজ হয়ে বসেছে এতে যেন আরাফাতের অনেক ভালো লাগছে।কেন লাগছে ডোন্ট নো!

‘দেখি হা করো।এই ডিমসেদ্ধ তোমায় খেতে হবে।না হলে শরীরের ঘাটতি পূরণ হবে না।’

‘ভালো লাগে না ডিমসেদ্ধ খেতে।’ নাক কুঁচকে জবাব দিলো আরাফাত।

‘এমন বললে হবে না,খেতে হবে।এই ডিমগুলি আমার মুরগীরা পেড়েছে বুঝেছো!তোমার না অনেক পছন্দ।’ মাহা ভ্রুক্ষেপ করে বললো।

‘সেটা তো ডিমের অমলেট।সেদ্ধ পছন্দ না।’

ওদের এই তর্কে লিপি বিরক্ত হয়ে আরাফাতের পক্ষে সাফাই গেয়ে মাহাকে বললো,’সে চাচ্ছে না খেতে এটা,তাহলে তুমি তাকে জোর করছো কেন?বউ হয়েছো স্বামীর পছন্দ অপছন্দ বুঝতে পারো নি, হাহ্ এ কেমন স্ত্রী?’

মাহা সাপের মতো শীতল চাউনিতে লিপির দিকে তাকালো।সবকিছুতে ওর নোংরা নাকটা গলানো চাই-ই চাই।এত অসভ্য কেন মেয়েটা।মাহা এবার আরাফাতের দিকে তাকিয়ে ঝাঁজ দেখিয়ে বললো,’তুমি খাবে কী খাবে না?তোমার জন্য আমি বাইরের মানুষের কথা সহ্য করবো না বলে রাখলাম।’

আরাফাত এবার বিনাবাক্যব্যয়ে চুপচাপ বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে নিলো ডিমটা।মাহা নিজেও খাওয়া শেষ করলো।তারপর আরাফাতের হাতে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে এঁটো থালাগুলো রান্নাঘরের সিংকে চুবিয়ে রেখে এলো।
________

আজকে বিকেলের দিকে মাহা শাড়ি পড়েছে।একদম নরমাল আটপৌরে সুতির একটা শাড়ি।মেরুন রঙের।চুলগুলো কাটি দিয়ে খোঁপা বেঁধে তাতে একটা কাঠগোলাপ ফুলের ক্লিপ গেঁড়ে দিয়েছে।এতেই তাকে অনেক মায়াবী লাগছে দেখতে।আরাফাতের চোখ সরছে না মাহার থেকে।শ্যামবর্ণের এই মেয়েটাকে এত সুন্দর কেন লাগছে তার চোখে?মাহাকে ঘিরে একটা মায়াময় আবহ সৃষ্টি হয়েছে যেন।নাকে একটা পাথরের নাকফুল,গলায় একদম পাতলা আর চিকন একটা চেইন,কানে দুল,আঙ্গুলে রিং,হাতে স্বর্ণের দুটো চুড়ি যা প্রকাশ করে সর্বদা সে একজন বিবাহিত নারী।আরাফাত পুরোপুরি মুগ্ধ মাহার রূপে।শাড়িতে মাহাকে অনেক মানায়।

আজকে ইশানীও শাড়ি পড়েছে।অবশ্য সাইফ বারবার বলেছে আজকে শাড়ি পড়ার কথা।শাড়ি পড়লে তার ফর্সা বউটাকে টুকটুকে লাল বউয়ের মতো লাগে।শুক্রবারেই বাসায় থাকতে পারে সে,নয়তো বউয়ের সাথে ভালোমন্দ সময় কাটানোর সুযোগ কোথায়?সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে আর রাতে থাকে ক্লান্ত।বউটাকে মোটেও সময় দেয়া হয় না।আর ইশানী তো খুবই চাপা স্বভাবের।মুখ ফুটে কখনো কিছু চায় না সাইফের কাছে।তাই সাইফ নিজেই বুঝে নেয় বউয়ের সমস্ত না বলা কথা ও অভিযোগ গুলো।

মাহা আরাফাতের হাত ধরে তাকে নিয়ে ছাদে চলে এলো।আরাফাত ক্রাচে ভর দিয়ে মাহার পাশে পাশে হাঁটছে।মাহা আরাফাতের একদম গা ঘেঁষে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে।আরাফাত চারিদিকে একবার তাকিয়ে শেষে মাহার দিকে তাকালো।মাহার গালে জ্বলজ্বল করছে ছোট্ট একটা তিল,যা আরাফাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বেশি।তার মনে এক অদ্ভুত ইচ্ছের উদয় হলো তিলটা দেখে।ইচ্ছে করছে এই তিল বরাবর ঠোঁট ডুবিয়ে একটা চুমু খেতে।আচ্ছা,খুব কী দোষের কিছু হবে এ কাজটা করলে?আরাফাত মাহার দিকে একটু ঝুঁকলো।তখনই মাহা তার দিকে তাকাতে মুহূর্তেই দুজনের চোখাচোখি ঘটলো।আরাফাত লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলেছে।চিন্তাটাও সাথে সাথে বাতিল করে ফেলেছে।

মাহা কপালের সামনে থাকা একগোছা চুল কানের পিছে গুঁজে বললো,’আচ্ছা তোমার কী এমন মনে হয় যে আমি তোমার টাকাপয়সা দেখে তোমাকে বিয়ে করেছি?’

আরাফাত একটু অবাক হয়ে মাহার দিকে তাকালো।সে বুঝতে পারলো না মাহা হঠাৎ এমন কথা বলছে কেন?মাহাকে তো সে কখনো লোভী ভাবে না।সে খুবই ভালো একটা মেয়ে।আরাফাত ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেস করল,’এমনটা মনে হওয়ার কারণ কী তোমার হানি?আমি কখনোই তোমাকে লোভী ভাবি না।তোমার বাবা ভাইয়েরও প্রচুর টাকা আছে,সামান্য টাকার জন্য তুমি আমাকে বিয়ে করতে যাবে কেন?যদিও আমি জানি না আমার মতোন এই ছ্যাঁকাখোর ল্যাংড়া একটা ছেলেকে বিয়ে করতে তুমি কেনই বা রাজি হলে?দয়া দেখাও নি তো!’ শেষের কথা সন্দিহান হয়ে বললো আরাফাত।

মাহা মুচকি হেসে জবাব দিলো,’জানো তো কাউকে দয়া দেখিয়ে এত কিছু করা যায় না,যা আমি তোমার জন্য করছি।আমি কখনোই তোমায় দয়া করে বিয়ে করি নি।বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন।এই বন্ধনটাকে নিয়ে এটলিস্ট ফাজলামো করার মতো মন মানসিকতা আমার নেই।আসলে আমি চেয়েছিলাম তোমাকে প্রকৃত ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে।তুমি মনপ্রাণ সব দিয়ে ভালোবেসেছো ঠিকই কিন্তু সেই খাঁটি ভালোবাসাটা অপাত্রে দান করেছো।আমি চাইছিলাম তোমার সেই ভাঙা মনের মৃত বাগানে আবারও ফুল ফোটাতে।নিজের সবটুকু উজাড় করে ভালোবাসতে,কিন্তু তা বোধহয় আর হবে না।তবে হ্যা এখান থেকে চলে গেলে তোমায় মিস করবো অনেক।হাজার হোক কিছু দিনের স্বামী ছিলে তুমি আমার।তবে আগে সুস্থ হয়ে যাও পুরোপুরি।তারপর আমার বাসায় চলে যাবো।আমার ইচ্ছে ছিল এবরোড গিয়ে পড়াশোনা করার।তা বোধহয় এবার পূরণ হবে।৫-৬ বছর এই দেশ থেকে দূরে থাকতে হবে তখন।’

মাহা কথাগুলো খুবই কষ্ট মিশিয়ে বলেছে।যা শুনে আরাফাতের মন নিমিষেই খারাপ হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে কোনো মূল্যবান কিছু হারিয়ে যাওয়ার ভয় দেখাচ্ছে মাহা তাকে।আরাফাত মাহার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে বললো,’প্লিজ এখন এসব কথা বাদ দাও।আমার ভালো লাগছে না।প্রসঙ্গ পাল্টাও।’

মাহা মনে মনে হাসছে আরাফাতের কথা শুনে।আরাফাত যে তার মায়ায় জড়িয়ে গেছে অলরেডি তা সে এখনো টেরই পায় নি।দুজন এই প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে লাগলো।

সন্ধার একটু আগে মাহা আরাফাতকে নিয়ে নিচে নেমে এলো।সন্ধ্যায় আজকে ফুচকা চটপটির আয়োজন করা হয়েছে।তাই পরিবারের সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে তা খাচ্ছে।মাহা নিজের সাথে আরাফাতের মুখেও যত্নসহকারে ফুচকা ভেঙে ভেঙে দিচ্ছে।তাদের এত মাখোমাখো সম্পর্ক দেখে লিপি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।রবির মাহাকে অনেক পছন্দ হয়েছে।সে সবসময় শুধু মাহার দিকে তাকায় আর মুচকি মুচকি হাসে।যা মোটেও চোখ এড়িয়ে যায় নি আরাফাতের।সে যদি এখন সুস্থ হতো তাহলে ঘুষি মেরে রবিকে কানা করে দিতো মাহার দিকে তাকানোর অপরাধে।সে কেন যে এত জেলাস ফিল করছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না।

মাহার পাশের টেবিলের ওপর তেঁতুলের বাটি রাখা ছিলো।তো মাহার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে রবি বললো,’এই তেঁতুল গোলা বাটিটা একটু আমাকে দিন মাহা।’

মাহা স্বাভাবিকভাবেই তেঁতুল গোলা বাটিটা হাতে নিলো রবিকে দিবে বলে কিন্তু তার হাত থেকে ছোঁ মেরে বাটিটা নিয়ে আরাফাত লিসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’লিসা ওটা রবিকে দে তো!’ লিসা বাটিটা নিয়ে রবির হাতে ধরিয়ে দিলো।রবির মুখ কালো হয়ে গেছে।মাহাও কিঞ্চিত অবাক হলো আরাফাতের কাজ দেখে।তবে আরাফাত নির্বিকার।যেন কিছুই হয় নি।
_________

রাতের খাবার অনেক আগেই সাড়া হয়ে গেছে সবার।আরাফাত মাহার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।আরাফাতের আজ মাথায় ব্যথা করছে।তাই মাহা খুবই সযতনে তার মাথায় কপালে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আরাফাতের আরামে চোখ জোড়া বুঁজে আসতে চাইছে।এই মেয়েটা তার এত কেয়ার করে কেন?সুবিধা অসুবিধা সব না বলতেই বুঝে যায় কী করে?যেন সবসময় তক্কে তক্কে থাকে আরাফাতের কখন কী প্রয়োজন পড়ে তার জন্য।এত এত আদর ভালোবাসা উপেক্ষা করা কার পক্ষে সম্ভব?আরাফাত নিজেই মাহার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

কিছুক্ষণ পর মাহা আরাফাতকে ধরে ধরে বিছানায় ঠিকভাবে শুইয়ে দিলো।মাহা লাইট নিভিয়ে বিছানায় ঘুমাতেই আরাফাত এসে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখে,যেন এই অপেক্ষায়ই সে ছিলো।এই বুকটায় খুবই শান্তিতে চোখ বন্ধ করে ঘুমানো যায়।আরাফাতের জন্য ভরসা যোগ্য স্থান।মাহাও আগলে নিলো তাকে নিজের সাথে।দোয়াদরুদ পড়ে তার শরীরে ফুঁকে দিলো।তারপর পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে