অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -১৫

0
1791

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১৫

আজ মাহা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে নি।হালকা পেটে ব্যথা করছে তার।নিষিদ্ধ সময় চলছে তাই নামাজ পড়ারও চাপ নেই।দুজন দুজনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে তারা।

বেলা ৮ টায় ঘুম ভাঙলো মাহার।চোখ পিটপিট করে আশেপাশে একঝলক তাকিয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।আরাফাতের ভালো একহাত একপা মাহার শরীরের ওপর রাখা।তার মুখও মাহার মুখের কাছে।ঔষধের প্রভাবে অনেক ঘু্মায় আরাফাত।হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোথায় রাখে তা নিজেও সঠিক বলতে পারবে না।

মাহা খুব সাবধানে আরাফাতের হাত নিজের ওপর থেকে সরাতে গেল,কিন্তু ভুলে হাতে একটু জোরে টান পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল আরাফাতেরও।চোখ পিটপিট করে ঘুমঘুম দৃষ্টিতে সর্বপ্রথম মাহার দিকে তাকালো সে।মাহাকে নিজের এত কাছে দেখতে পেয়ে মুহূর্তের মধ্যেই তার ঘুম হাওয়া হয়ে গেল।ধড়ফড়িয়ে উঠতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে আবারও আগের জায়গায় ঠাস করে শুয়ে পড়েছে আরাফাত।মাহা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝটকা মেরে তার হাত পা সরিয়ে দিয়ে ওঠে বসলো।আরাফাত মাহাকে জিজ্ঞেস করল,’তুমি কী আমার ঘুমের সুযোগ নাও হানি?এত কাছে কী করো আমার?বিষয়টা তো সুবিধার না!’

মাহার মেজাজ এবার সপ্তমে চড়ে বসেছে।রাগের বসে আচমকা পিছন ফিরে আরাফাতের টুঁটি চেপে ধরলো সে।হকচকিয়ে গেল আরাফাত।সে মাহার এমন রণমুর্তি ধারন করাকে এখন মোটেও আশা করে নি।আরাফাত ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললো,’কী করছো এসব হানি,ছাড়ো আমাকে!মেরে ফেলবে নাকি?’

ক্রোধান্বিত কন্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দিলো মাহা,’তোকে মেরে ফেললেই বোধহয় ভালো হবে।বদ ছেলে কোথাকার।’

‘ছি,তুমি আমাকে তুই তোকারি করছো কেন?বয়সে বড় হই আমি তোমার।সম্মান দিয়ে কথা বলো।’

আরাফাতের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে মাহা।রাগী কন্ঠে জবাব দিলো,’রাখো তোমার সম্মান।তোমার সম্মানের গুষ্টি কিলাই।সুযোগ আমি নই তুমি খুঁজো,রাতের বেলা লুচ্চাদের মতো এসে জড়িয়ে ধরে যে লুচ্চামি করো আমার সাথে সেসব বলে কখনো খোঁচা দিয়েছি আমি তোমায়?তুমি যে ফট করে আমায় জাজ্ করে ফেললে?নিজের মতো খবিশ পেয়েছো নাকি?’

মাহার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো যেন আরাফাত।অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে।বিস্মিত কন্ঠে বললো,’হোয়াট?আমি তোমায় জড়িয়ে ধরি?কবে কখন?মিথ্যা বলছো কেন?আমি ওমন ছেলেই না!এসব আমি কখনোই করতে পারি না।’

‘তোমার সাথে কথা বলাই বেকার।আজকে মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে রাখবো।বজ্জাত ছেলে নিজে এসে আমাকে কালার বানায়।থাকো তুমি আমি যাই,আজ নিজে নিজে ওয়াশরুমে যাও আমি পারবো না কিছু করতে,হুহ!’মাহা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে হাত খোঁপা বাঁধতে লাগলো।
আরাফাত তড়িঘড়ি করে বললো,’নাআ,হানি,প্লিজ!আচ্ছা যাও আমি মানছি আমি ঘুমের ঘোরে তোমার কাছে এসেছি।সব দোষ আমার আমি স্বীকার করলাম।তবুও প্লিজ আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে চলো,ভীষণ বেগ পেয়েছে।আর কখনো তোমায় এমন চেতাবো না!’

‘মনে থাকে যেন,আরেকবার আমার ওপর এমন ডাহামিথ্যে কিছু প্রয়োগ করলে সোজা মাথা ফাটিয়ে দিবো একদম এই বলে রাখলাম।’ সরাসরি হুমকি দিয়ে।

‘অবশ্যই মনে থাকবে।’ ভয়ে ভয়ে বললো আরাফাত।অজানা কারণে এই মেয়েটার রাগী চোখের দিকে তাকালেই ভয় করে আরাফাতের।কিছু কিছু মানুষ এমন থাকেই যাদের রাগী চোখের চাহনি দেখলেই ভয়ে আত্মার পানি শুকিয়ে যায়।
[আমার বান্ধবীকেও আমি এই কারণে ভয় পাই।😑]

মাহা এবার আরাফাতকে তুলে ধরে ধরে নিয়ে গেল ওয়াশরুমে।আরাফাতকে ওয়াশরুমে রেখে সে বেরিয়ে এলো।এসে বিছানা গোছালো,বারান্দা থেকে ঝাড়ু এনে ফ্লোর পরিষ্কার করলো।তারপর আরাফাত ডাকতেই তাকে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে নিয়ে এলো।
________

আজকে আরাফাতের সেই বজ্জাত বড় খালার মেয়ে লিপি আসবে বলে জানালেন মিসেস মুমতাহিনা।বোনের সাথে মন কষাকষি চললেও বোনঝির সাথে তো আর সেই জের ধরে সম্পর্ক নষ্ট করা যায় না।তাই সে ফোন দিয়ে আসতে বললেও মানা না করতে পারলেন না তিনি,বরং হাসিমুখে তাকে আসতে বললেন বাসায়।মেয়েটা বোধহয় তার চাচাতো ভাই রবিকে সাথে নিয়ে আসবে।থাকবে সপ্তাহে খানেক।মাহার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না কথাগুলো শুনে।সে তার মতো আছে।আরাফাত অবশ্য লিপির আসার কথা শুনে নাক কুঁচকালো।এই মেয়েটা খুব হাড় বজ্জাত।সাইফও তাকে পছন্দ করে না এতটাই বেয়াদব মেয়ে।তাই আরাফাত খুশি হতে পারলো না।

দুপুরের একটু আগেই আগমন ঘটে এ বাসায় লিপি নামক বেয়াদব রমণীর।সাথে তার কাজিন ছেলে রবি।লিপি বড় একটা লাগেজ সাথে নিয়ে এসেছে।মনে হচ্ছে না জানি কতদিন থাকার জন্য এসেছে,আসলে এখানে তার কাপড় চোপড়ের সাথে প্রচুর মেক-আপের জিনিসপত্র আছে তাই এত বড় ব্যাগ এনেছে।আরাফাতদের বাড়ির কাজের মেয়ে জেনি সদরদরজা খুলে দিয়ে রাক্ষসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কারণ লিপি এ বাসায় এলেই শুধু জেনিকে ফাইফরমাশ দিতে দিতে অতিষ্ঠ করে ফেলে।যার কারণে জেনি তাকে মোটেও পছন্দ করে না।বিরবির করে সে বললো,’আল্লাহর গজবডা না জানি কতদিন থাকতে আইছে এহানে,এগো আজরাইলেও ছোখে দেহে না।’

‘কিছু বললি তুই জেনি?’ভ্রুকুটি করে জানতে চাইলো লিপি।
‘না আফামনি।আমি কী কমু আবার?আফনে ভেতরে আইয়েন।’ মেকি হেসে সরে দাঁড়ায় জেনি।লিপি হুম বলে এটিটিউট নিয়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করে।
মাহা ডিমের অমলেট বানিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।আরাফাতের হঠাৎ খেতে মন চাইছিলো তাই বানাতে হলো।মাহা আরাফাতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো ঠিকই এমন সময় লিপিদের আগমন দেখে সে আরাফাতকে ডিমের অমলেট খাওয়াতে ভুলে গেছে।মুলত লিপির মেকআপ আর ড্রেসআপই নজর কেঁড়েছে তার।মেকআপ তো করেছে ব্রাইডাল টাইপের,আর ড্রেস ওয়েস্টার্ন!তাকে কেমন যে লাগছে দেখতে তা বোধ করি না বলাই বাহুল্য।

মিসেস মুমতাহিনা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন তৎক্ষনাৎ।হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন লিপিকে ও তার কাজিন রবিকে।রবি হলো বছর বাইশেকের টগবগে এক তরুণ।তার আচার আচরণেই বোঝা যায় যে সে খুবই স্টাইলিশ একটা ছেলে।শিরায় শিরায় তার এটিটিউটের চারা।মাহা ভ্রু কুঁচকে ছেলেটির দিকে তাকালো।তার কাছে এটিটিউটওয়ালা তো দূরের কথা,চামচিকার মতো লাগছে ছেলেটিকে।জাস্ট বিরক্তিকর।

লিপি মিসেস মুমতাহিনাকে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করলো।রবি হাসিমুখে মিসেস মুমতাহিনাকে বললো;

‘কেমন আছেন আন্টি?’

‘এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুই কেমন আছিস বাবা?’

‘জ্বি আন্টি ভালো আছি।’

লিপি তাদেরকে ছেড়ে একদৌড়ে আরাফাতের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল।মাহা দ্রুত ওমলেটের বাটি টেবিলের ওপর রেখে আরাফাতকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বাঁধা দিয়ে রুক্ষ কন্ঠে বললো,’এখন কোভিড টাইম।বাইরে থেকে এসে এভাবে অযথা কাউকে জড়িয়ে ধরা ঠিক নয়।আর অসুস্থ কাউকে তো মোটেই নয়।সো দূরত্ব বজায় রেখে কথা বললে খুশি হবো।’

মাহার কাঠকাঠ কথা শুনে ইশানী ফিক করে হেসে ফেলেছে।আর লিপি সরু চোখে তাকিয়েছে মাহার দিকে।দেখে মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই গিলে খাবে মাহাকে।বাট হু কেয়ার্স?মাহা মাছি তাড়ানোর মতো করে লিপিকে সরে যেতে ইশারা করলো।আরাফাত হা করে মাহার দিকে তাকিয়ে আছে।এ কোন মাহাকে দেখছে সে?মেয়েটা হঠাৎ এত পসেসিভ হলো কেন তাকে নিয়ে?কী জানি তার মাথায় কখন কি ঘুরপাক খায়!লিপি হেয় কন্ঠে বললো,’ওহ আই সি!তুমিই তাহলে সে যার সাথে আরাফাতের বিয়ে হয়েছে!বাহ,তা বিয়ে হতে না হতেই দেখছি স্বামীকে একদম কিনে নিয়েছো?তোমার থেকে আমার অধিকার বেশি এটা জানো তো?কজ আমি ওর কাজিন হই!’

এই মেয়েটাকে সে আগে থেকেই মোটেও পছন্দ করে না।মাহা মনে মনে ভেঙচিয়ে বললো,’বা* হস তুই হারামজাদি!’
মুখে বললো,’আমার স্বামী কাকে হাগ করবে না করবে সেটা আমি ডিসাইড করবো ওকে কারণ কাজিনের থেকে আমার অধিকার বেশি!এখন ওকে কিনে নিলেই কী না নিলেই কী!এনিওয়ে মেহমান হয়ে এসেছেন মেহমানের মতো থাকুন,রেস্ট নেন,খান ঘুমান।বাট আমার হাসবেন্ডের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখুন।বিকজ আমি ওসব পছন্দ করি না।’

লিপি তাকে কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিতে গেলে মিসেস মুমতাহিনা এসে আটকালেন।তিনি বুঝতে পারলেন অবস্থা বেগতিক দিকে যাচ্ছে তাই এখনই থামিয়ে দেয়া শ্রেয়।মিসেস মুমতাহিনা লিপিকে বললেন,’লিপি,এতদূর থেকে এসেছিস,নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত তুই!যা না যা,রুমে গিয়ে রেস্ট নে।তুই আসার আগে তোর জন্য আর রবির জন্য আমি গেস্ট রুম পরিষ্কার করে রেখেছি।যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় একসাথে লাঞ্চ করবো সবাই।’

‘হুম যাচ্ছি খালামণি।রবি আয়।’ কটমট দৃষ্টিতে মাহার দিকে তাকিয়ে লাগেজ হাতে গটগট শব্দে হেঁটে গেস্ট রুমের দিকে চলে গেল লিপি।লিপি যে মাহাকে এমন বিহেভিয়ার এর জন্য এত সহজে ছেড়ে দেবে না বুঝিয়ে দিলো।রবি কেমন মুগ্ধ চোখে মাহার দিকে তাকিয়েছিলো যা খুবই সুক্ষ্ম ভাবে আরাফাত লক্ষ্য করেছে।ভুরু কুঁচকে গেল তার অটোমেটিক।মাহা এসব খেয়াল করে নি মোটেও তাই তার চোখ এড়িয়ে গেল বিষয়টা।রবিও চললো বোনের পিছু পিছু।

‘নাও হা করো তো!’ মাহার ডাকে সংবিৎশক্তি ফিরে আসে আরাফাতের।এসব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে হা করে সে।মাহাও তাকে খাইয়ে দিতে লাগে অমলেট।মিসেস মুমতাহিনা আমতা আমতা করে মাহাকে বললেন,’ইয়ে বলছিলাম কী মা,লিপি যদি তোর সাথে উদ্ধত আচরণ করেও তাও তুই কিছু বলিস না ওকে প্লিজ।জানিসই তো কেমন ত্যাড়ামি করে সবসময়।তাও কিছু বলতে পারি না নিজের আপন বোনঝি বলে।বুঝতেই পারছিস আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি!’

মাহা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,’তোমার বোনঝি হলে হোক,এত তেল দিয়ে চলতে পারবো না আমি বলে রাখলাম।আমার সাথে ত্যাড়ামি চলবে না।আমি ইশানী ভাবী নই যে হাজারটা কটু কথা বললেও চুপচাপ সয়ে যাবো।আমি হলাম মাহা।মাহা কাউকে মিনমিন করে চলে না।তোমার বোনঝি যদি আমার সাথে কখনো লাগতে আসে,তবে একদম বুঝিয়ে ছেড়ে দেব মাহা কী চিজ!হুহ!’

মিসেস মুমতাহিনা আর কিছু বলার সাহস পেলেন না।লিপিকেও চেনেন আবার মাহাকেও চেনেন তিনি খুব ভালো করে।একটা চূড়ান্ত পর্যায়ের বেয়াদব আরেকটা মারাত্মক লেভেলের একরোখা।না জানি কখন বাসায় বোম্ব ব্লাস্ট হয়।তিনি চুপচাপ প্রস্থান করলেন মেইন হল থেকে।কারণ জানেন মাহাকে চুপ থাকার কথা বলেও লাভ নেই।ডিটারজেন্ট পাউডার ছাড়া ধুয়ে দেবে একদম।

তিনি চলে যেতেই ইশানী মাহার কাঁধে চাপড় দিয়ে বললো,’ব্রাভো মাহা,এতদিন আমি যা করতে পারি নি আজ তুমি তা করে ফেললে।মা এত ভালো মানুষ তাহলে ওনার বোন আর বোনের মেয়ে এত খারাপ কেন জানি না।এখানে আসলে তো ওরা আমায় জ্বালিয়ে খায়,এখন মনে হচ্ছে তা আর হবে না।কারণ তুমি আছো।’

ইশানীর কথা শুনে মুচকি হেসে জবাব দিলো মাহা,’চিন্তা করো না ভাবী।আমি থাকতে তোমায় কেউ আঙ্গুল দেখিয়েও কখনো কিছু বলতে পারবে না।ওই আঙ্গুলটাও কেটে দিবো আমি।এখন তুমি যাও গিয়ে রিহাদকে ডিমের অমলেট দুটো দিয়ে আসো।ও আমাকে বলেছিলো তার জন্য রাখতে।’

‘হুম যাচ্ছি।কষ্ট করে একটু চুলাটা অফ করে দিও ভাত হয়ে গেলে!’

‘আচ্ছা ভাবী!’

ইশানী চলে গেল।মাহা আরাফাতের পাশেই বসলো।জেনি কিছু বলতে চাইছিলো লিপির ব্যাপারে কিন্তু আরাফাতকে দেখে না বলেই চলে গেল।যদি আরাফাত কিছু মনে করে এই ভয়ে।তবে মাহার লিপিকে নাস্তানাবুদ করাটা তার বেশ ভালো লেগেছে।সে তো খুশিতে বাকবাকুম হয়ে আরাফাতদের জোয়ান ছেলে ড্রাইভার বশর অর্থাৎ তার লুকায়িত প্রেমিককে কথাটা বলতে গেল।
__________

দুপুরের খাবার খেতে বসেছে সবাই।লিপি আর রবিও আছে সাথে।লিপি এসেই বলা নেই কওয়া নেই আরাফাতের পাশের চেয়ারে বসে গেল।তার এমন গায়ে পড়া স্বভাব দেখে মাহার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।ইচ্ছে হচ্ছে এক থাপড়ান দিয়ে সবগুলো দাঁত ভেঙে ফেলতে।বেয়াদবের একসা।

মাহা ইশানীর সাথে হাতে হাতে সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে।জনাব এরশাদও এসেছেন বাসায় দুপুরের খাবার খেতে।তিনি হাসিমুখে আন্তরিকতার সহিত রবি আর লিপির সাথে কথা বলছেন।

লিপি আরাফাতের ভাঙা হাত দেখে আফসোস করে বললো,’আহারে তোমার দেখি ডান হাতটাই ভেঙে গেছে।ভাত খাও কী করে?কেমন যেন শুকিয়ে গেছে তোমার চেহারাটা।আচ্ছা আসো আজকে আমি তোমায় খাইয়ে দিই নিজের হাত দিয়ে।’

লিপির কথায় বাঁধা দিয়ে মিসেস মুমতাহিনা বললেন,’আরাফাতের জন্য তোর চিন্তা না করলেও হবে মা।ওর জন্য ওর বউ আছে।মাহা তাকে খাইয়ে দেবে,তুই বরং তোর খাবার খা।’

মাহা চুপচাপ তাদের কীর্তিকলাপ দেখে যাচ্ছে।কিছু বলছে না।মনে মনে বলছে,’দেখি কতদূর যেতে পারিস!’

‘আরে খালামণি,বউয়ের কথা বাদ দাও।এতদিন বউ খাইয়ে দিয়েছে আজকে থেকে যতদিন আছি ততদিন নাহয় আমিই খাইয়ে দিবো।কী বলো আরাফাত?খাবে না আমার হাতে?’

আরাফাত মেকি হেসে মাথা নেড়ে না বোঝালো।মানে সে খাবে না।লিপি ভ্রকুটি করে জানতে চাইলো,’কেন আমি খাওয়ালে কী সমস্যা?’

‘আমি আসলে হানির হাত ছাড়া কারও হাতে খাবো না।যা-তার হাতে খেয়ে অভ্যাস নেই আমার।এজন্য তোমার প্রস্তাব নাকচ করে দিলাম,সরি।’
অকপটে বলে উঠে আরাফাত।মাহা খিলখিল করে হেসে উঠে।বাকিরাও মুখ চেপে লুকিয়ে হাসছে।বেচারি লিপি বেশ বড় একটা ঘষা খেয়ে মুখ গোমড়া করে ফেলেছে।বেশি মাদার তেরেসাগিরি করতে গেলে এমনই হয়।মাহা কিছু বললো না আর।সে আরাফাতকে খাইয়ে দিতে লাগলো চেয়ারে বসে।আরাফাত না চাইতেও আরচোখে বারবার মাহাকে দেখছে।কেন দেখছে তা বলতে পারবে না।তবে মন বারংবার বলছে মাহার দিকে তাকাতে!আর সে তার মনের কথা উপেক্ষা করতে পারছে না।
__________

লিপির সাথে লিসা নিসার আবার কিছুটা ভালো সম্পর্ক আছে।কারণ লিপি তাদেরকে মেক-আপ করা শিখিয়ে দেয়,নতুন নতুন হেয়ারস্টাইলও শিখায়।এজন্যই একটু ভালো বন্ডিং আছে।যদিও লিপি তার উদ্ধতস্বভাবের জন্য বেশি কুখ্যাতি অর্জন করেছে সবখানে।লিসা নিসা লিপি আর রবি গল্প করছে ড্রয়িং রুম জুড়ে।আরাফাতেরও কিছু করার নেই তাই সেও তাদের কথাবার্তা শুনছে গালে হাত দিয়ে।লিপি আরাফাতের পাশেই বসে আছে।মাহা সবার জন্য সন্দেশ পিঠা তৈরি করছে রান্নাঘরে।তার হাতে অনেক ভালো সন্দেশ হয় তাই সেই ভাজছে চুলায়।ইশানি হাতে হাতে সাহায্য করছে তাকে।

সারাটাদিন এভাবেই কেটে গেছে।লিপি বারবার করে আরাফাতের কাছ ঘেঁষার সুযোগ খুঁজলো।কিন্তু মাহার জন্য পারলো না।মাহা সারাদিন যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছে আরাফাতকে।আরাফাত তো মাহার এমন আচরণ দেখে অবাক।একটুও কাছ ছাড়া করতে চায় নি তাকে।এমনকি সে যখন গোসল করতে যায় তখন আরাফাতকে রুমে বসিয়ে দরজা লক করে তারপর নিশ্চিত হয়ে গোসল করতে গিয়েছিলো মাহা।

এদিকে,রবি নিজের কিলিং স্মাইল দিয়ে মাহার সাথে খাতির জমাতে চেয়েছিলো যদিও পারে নি।মাহা যেন পাত্তাই দেয় নি তাকে।শুধু সৌজন্যতার খাতিরে দায়সারা জবাব দিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। রবিকে মাহার সাথে কথা বলতে দেখে আরাফাতের মগজে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে।কেন যে তখন এত রাগ হয়েছিলো তার তা সে নিজেও বলতে পারবে না।

মাহা খুব ভালো করে বুঝে গেছে যে, লিপির এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্যটাই হলো আরাফাতকে হাসিল করে নেয়া।এখানে এসেছে আরাফাতকে নিজের রূপ গুণ দেখিয়ে বশ করে নিতে।যদি আরাফাত পটে যায় তবে ঠিকই তাকে নিজের করে নেবে সে মাহাকে সরিয়ে দিয়ে।আরাফাতের সুস্থ হওয়ার খবর সে যেখান থেকেই হোক জোগাড় করে অতঃপর আটঘাট বেঁধে এখানে এসেছে নিজের কার্যোদ্ধার করতে।সবকিছু মাহার নিকট পানির মতো পরিষ্কার।এসব ভেবে বাঁকা হাসলো মাহা।মনে মনে বললো,’তুমি যদি চলো ডালে ডালে,আমি তবে চলি পাতায় পাতায়!আরাফাত আমার হবে না তো কারও হতে দিবো না।আগে হাল ছেড়ে দিলেও এখন আবারও হাল ধরলাম আমি।জিতে তবেই ছাড়বো।এই আমার ওয়াদা!’
___________

রাতে দুজন বিছানার দুপাশে শুয়ে আছে।মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে বর্ডার দেয়া।আজকে আরাফাতের ঘুম আসছে না।কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার।অন্যদিন যেমন আরামে ঘুমাতো আজ তার ছিটেফোঁটাও যেন নেই।এমন কেন হচ্ছে?মাহা আজ নিজের কাছে নেই বলে?এই অদ্ভুত অনুভূতিগুলোর মানে কী?কেন মাহাকে এখন এত ভালো লাগে?আগে যেমন বোনের নজরে দেখতো এখন সেরকম মোটেই ভাবতে পারে না।এখন ভাবতে গেলেই সবার আগে মনে হয় যে মাহা তার বউ।এটা কেমন ফিলিং?তার মানে কী এই ভাঙাচোরা মন দ্বিতীয়বার কারও প্রেমে পড়তে যাচ্ছে?উফফ আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না।তবে মাহাকে খুব করে জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে।তৃষ্ণার্ত এই বুকটা খা খা করছে শুধু মাহাকে একটু জড়িয়ে ধরার আশায়!

মাহা চোখ বন্ধ করে অন্যপাশ হয়ে শুয়ে আছে,কোনো নড়াচড়া ব্যতিত।আরাফাত মাহার পিঠপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এই কোলবালিশটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার।তাদের দুজনের এত দূরত্বের কারণ এই বলদ বালিশটা।আর সহ্য করতে না পেরে মাহাকে ডেকেই ফেললো সে।
“হানি!”

মাহা মুচকি হাসলো আরাফাতের ডাক শুনে।কারণ সে জানতো আরাফাত তাকে ডাকবেই।সে না ফিরেই বললো,’হু!’

‘এদিকে ফিরো না একটু?’

মাহা আস্তেধীরে এপাশ ফিরে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আরাফাতের দিকে তাকালো।বললো,’কোনো দরকার?’

‘ইয়ে মানে আমার ঘুম আসছে না।’ আমতা আমতা করে বললো আরাফাত।

‘তো আমি কী করতে পারি!’ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মাহা।

‘কাছে এসে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না প্লিজ!’ খুবই আহ্লাদিত কন্ঠে জবাব এলো।

মাহা খুবই শীতল কন্ঠে বললো,’আমি যেহেতু তোমার ঘুমের সুযোগ নেই,সেহেতু আমি তোমার কাছে না আসাটাই বেটার।দূরে থাকলে কেউ কারও কাছে আসবে না,কেউ কাউকে ইঙ্গিত করে খোঁচাও দিতে পারবে না।এটাই ভালো অপশন।’

আরাফাতের মন খারাপ হয়ে গেল কথাটা শুনে।আর কিছু বলতেও পারলো না নিজের ইগোর কারণে।চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো।মাহা সে তার মতো আছে।কোনো ভাবান্তর নেই তার।আরাফাতের ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ২ টা বেজে গেল।সহজে ঘুম আসতে চায় না মাহাকে ছাড়া।এতদিন ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বদভ্যাস হয়ে গেছে।এই অভ্যাস কবে যাবে কে জানে?

মাহা মুচকি হেসে বললো,’তুমি নিজেও জানো না কীভাবে যে আমার মায়ার জালে ফেঁসে গেছো!যতোই বলো তুমি আমাকে চাও না,দিনশেষে দেখা যাবে তুমিই পাগলের মতো আমার কাছে আসতে চাইবে।’

মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেল মাহা।সে বুঝতে পারছে আরাফাত তার মায়ায় জড়িয়ে গেছে।এই মায়া কিছুতেই ছুটবে না।ছুটতে দেবে না মাহা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে