আমার প্রথম সকাল পর্ব-১১

0
75

#আমার_প্রথম_সকাল (১১)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
নিয়তি বড্ড করুণ। যাদের জন্য উজার করে সব করা হয় খারাপ সময়ে সে মানুষগুলো সবার আগে পল্টি নেয়। পর তো পরই হয় কিন্তু আপনগুলো এর চেয়ে বেশি স্বার্থপর হয়। তবে রক্তের সম্পর্কের বাহিরেও একটা সম্পর্ক থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এমনটিও দেখা যায় রক্তের সম্পর্কের বাহিরের মানুষেরা আমাদের হয়ে যেসব করে সেসব রক্তের সম্পর্কের আপনজনেরাও করতে পারে না। জামিলের পড়াশোনা, চাকরির পূর্ববর্তী সময়ের সকল ভরণপোষণের দায়িত্বের ভার যে ভাইটি নিয়েছিল আজ সে ভাইকেই জামিল নিজের স্বার্থের জন্য ত্যাগ দিল। ছোট ছেলের কথার মতো শ্বশুর শ্বাশুড়ি পরদিন আমাদের সংসার আলাদা করে দিলেন৷ তিনি এসে যখন আলাদা হওয়ার জন্য বলছিলেন, তখন পুরোটা সময় আমি কেবল জুনাইদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম এরপর কি করবে জুনাইদ? কোনো প্রতিবাদ তো করলই না বরং পুরোটা সময় লোকটা মাথা নিচু করে স্তব্ধ হয়ে ছিল। শ্বাশুড়ি চলে যেতে সে মুখ তুলল। তখন তার বদনে ভেসে উঠেছিল ব্যর্থতা এবং একরাশ হতাশা।

আলাদা ঘর, আলাদা হাঁড়ি পাতিল, আসবাবপত্র নিয়ে আমাদের দিনগুলো একভাবে চলতে থাকল। সংসারে আমার ওপর বাড়তি চাপ নেই। দুটো মানুষের খাবার আর কতটুকুই বা লাগে! ভালো মন্দ নাহয় নাইবা খেলাম। ভাত, ডাল এবং ভর্তায় বেশিরভাগ দিনগুলো আমাদের কাটতে লাগল আর জুনাইদের জমানো সামান্য টাকাগুলোয় তার চিকিৎসার খরচ চলতে থাকল। শ্বাশুড়ির অযথা চিৎকার চেচামেচি, জা’য়ের সেবা করা থেকে রেহাই পেলেও রেহাই পেলাম না জুনাইদের হতাশাগ্রস্ত চেহারা দেখা থেকে৷ বাবা মা এবং বাকি সকল সদস্যকে নিয়ে আগে যে লোকটা সামান্য ভর্তা, ডাল, শাক সবজি খেয়েও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল, আজ সে লোকটার চেহারা জুড়ে প্রকাশ পাচ্ছে হতাশার লেশ। আমার কাছে প্রকাশ করতে চায় না সেসব কথা কিন্তু আমার সামনে থাকে বলেই কিনা জানা সম্ভব হয়। দিনকে দিন তার চেহারার লাবণ্য কমে গিয়ে চোখের নিচের কালো দাগগুলো ফুটে উঠতে দেখা যায়। শারীরিক দিক থেকে সেবা যত্ন করে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম হলেও আমি সক্ষম হচ্ছি না তাকে মনের দিক থেকে সবল করে তুলতে।

শ্বশুর প্রতিদিন নিয়ম করে দুই থেকে তিনবার এসে বড় ছেলের খোঁজ খবর নিয়ে যান৷ টাকা পয়সা কিংবা খরচাপাতির দরকার পড়লে যেন তাকে জানায় জুনাইদ সেসব ব্যাপারেও আশ্বাস দেন। জুনাইদের নিজের বাবা মা দু’জনের নামে করা দুটো দোকান আছে। এগুলো জুনাইদ অতি রঞ্জিত আবেগের বসে প্রথমবার চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরপর পাওয়া বেতনসমূহ জমিয়ে কিনেছিল। সেসব এখন ভাড়ায় চলে। মাস শেষে যে রোজকার আসে সেগুলো শ্বশুর নিজের কাছেই রাখেন। এদিকে শ্বাশুড়িকে প্রায় দেখা যায় ছোট বউয়ের গুণগান গান সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে। বড় ছেলের কি অবস্থা সেসব দিনে এসে একবার দেখে গেলেও তেমন কিছুই বলেন না। জুনাইদও মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে করুণ চোখে। মায়ের মন গলে না। ছেলেকে কখনো তিনি বলেন না, ” আয় বাবা আমার সাথে দু মুঠো ভাত খাবি! ”

জুনাইদ আমাকে প্রায় বলে, ” সকাল আমার বাবা মা বদলে গেছে সকাল। উনারা আগে মোটেও এমন ছিল না। তুমি উনাদের ভুল বুঝিও না। ”
আমি কেবল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকি জুনাইদের দিকে। সারাজীবন শুনে এসেছি ছেলেমেয়েদের শত অবহেলা সহ্য করেও বাবা মা কখনো নালিশ করে না। তাদের বদদোয়া, অভিশাপ দেন না। এদিক থেকে আমার সামনের ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত। জুনাইদ যত যাই হোক বাবা মা’কে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। জামিল তাকে আলাদা হতে বলেছে এ নিয়ে সে বিন্দুমাত্র রাও করল না আর না করল কোনো অভিযোগ। যেন সে আগেই জানত এমনটি হবেই। তার যত কষ্ট বাবা মাকে ঘিরে।

জুনাইদ এখন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ হলেও হাঁটতে সামান্য কষ্ট হয়। এরজন্য এখনো তাকে আমি বেশিদূর হাঁটতে যেতে দেই না। সব কাজ শেষ করে দু’জন একসাথে বাড়ির ভেতরটায় হাঁটাহাঁটি করি যাতে জুনাইদের হাঁটাটা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়।
রান্নাবান্না শেষ করে জুনাইদের কাছে আসলাম৷ কিছু লাগবে কি-না জিজ্ঞেস করতে। জুনাইদ আমাকে বলল, ” সকাল একটা কাজ করে দিতে পারবে? ”
” বলুন কি করতে হবে? ”
” তেমন কিছু না শুধু এতটুকু জেনে আসো বাবা মা আসলে জামিলের সাথে কেমন আছে, কেমন করে থাকছে? ”
জুনাইদের মুখের ওপর কিছু বলতে গিয়েও লোকটার চেহারা দেখে মায়া লাগল। থাক না। এতটুকু জেনে যদি তার আত্মতৃপ্তি বাড়ে তাহলে তাই হোক। অগত্যা আমাকে উঁকি মেরে দেখতে হলো ও ঘরের ভেতরটায়। কিন্তু ভেতরে উঁকি দিতে সোমার চোখে ধরা পড়ল সেটি। শ্বাশুড়ি সেসময় সোমার পাশে বসা ছিল। আমি দেখলাম তিনি বেশ প্রফুল্ল চিত্তে সোমাকে ফল কেটে দিচ্ছিলেন সাথে খোশগল্প করে তাকে যতটা পারছেন তাকেও প্রফুল্ল রাখছেন। আমাকে দেখে সোমা শ্বাশুড়ির সামনে বলে উঠল, ” ভাবী কি কিছু বলতে আসছেন? ”
সোমার কথা শুনে শ্বাশুড়ি এদিকে তাকালেন। বললেন, ” কী ব্যাপার সকাল? তুমি এখানে কি কর? ”
শ্বাশুড়ির প্রশ্নে কি বলব তাৎক্ষণিক ভেবে পেলাম না। তবুও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না যাওয়ার জন্য বললাম, ” আমি আসলে জানতে এসেছিলাম মা আপনারা কি দুপুরে খেয়েছেন? ”
” কেন ভাবী আপনার কি মনে হয় আমরা উনাদের না খাইয়ে রাখব? ” সোমার জবাব এলো।
” আমি সেটা বলিনি সোমা। খোঁজ খবর নেওয়া যেতেই পারে তাই না? ”
” খুব উদ্ধার করে ফেলছেন খোঁজ খবর নিয়ে ভাবী। খোঁজ খবরের নামে যে আপনি নজর রাখতে এসেছেন আমরা কি খাচ্ছি দাচ্ছি সেসবে। মনে হিংসা তো এখন আসবেই শত হলেও আমরা আপনাদের চেয়ে ভালো থাকছি, খাচ্ছি। বুঝি না মনে করছেন? ”
” বাদ দেও সোমা। ছোটলোকের জাতের আবার স্বভাব বড়োলোকি হবে আশা কর কেমনে? ”
সোমা শ্বাশুড়ির কথায় বেশ মজা পেল। শ্বাশুড়িকে সায় দিতে বলল, ” দেখেন ভাবী, আজকে যা করছেন, করছেন। আর যেন না দেখি আপনারে আমাদের আশেপাশে চোরের মতো এমনে ঘুরঘুর করতে। ”
শ্বাশুড়ি নাহয় মুরুব্বি মানুষ, জুনাইদের মা, তাকে কিছু নাই বলা যাবে। কিন্তু সোমাকে না বলে পারলাম না।
” দেখ সোমা তোমার জিনিসে নজর দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার কোনো কালেও ছিল না। যদি দেওয়ারই হতো তাহলে সে কবেই দিতে পারতাম। ”
সোমাকে বলেও ক্ষ্যান্ত দিতে পারিনি আজ। শ্বাশুড়িকেও কয়েকটি কথা বললাম। এরপর যা হবার পরে দেখা যাবে। ” আর মা আপনাকেও বলে রাখি আমি ছোটলোকের জাতের হলেও খারাপ উদ্দেশ্যে আপনাদের কাছে আসি নাই। খোঁজ খবর নেওয়া যদি ছোটলোকি হয় তাহলে সেটা আপনার কাছে হলেও হতে পারে। নাহলে কোনো মা নিজের ছেলের খারাপ দিনে তাকে এভাবে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে বলে আমার জানা ছিল না। ”

শ্বাশুড়ি আমার কথায় এবার রেগে গেলেন। তেড়ে এসে এবার যা খুশি তাই বলতে শুরু করলেন। ” বাঁজা মেয়ে মানুষের এতো কথা কিসের? নিজে তো পারলই না বাচ্চার মুখ দেখাইতে এখন আমার মেয়ের মতো লক্ষী বউটার দিকে নজর দেওয়া শুরু করছে। ওর বাচ্চার যদি কিছু হয় না হতচ্ছাড়ি? সবে তো ঘর ছাড়া করছি তোরে তখন বাড়ি ছাড়া করতেও সময় নিব না আমি! ”
উনার চেচামেচি শুনে বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেলেন। জুনাইদ পর্যন্ত পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সব শুনে সে স্তব্ধ হয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। তার অনুপস্থিততে আমাকে কত কিছু সহ্য করতে হয় বুঝতে এতটুকুও অবকাশ রইল না। সবার সামনে নিজের অর্ধাঙ্গীনিকে এভাবে অপমানিত হতে দেখে লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখল। অথচ তাকে দেখেও শ্বাশুড়ি চুপ করলেন না। বরং সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে নালিশ করা শুরু করে দিলেন, ” তোর বউরে ডাক দিয়ে দিস জুনাইদ। সোমার যদি কিছু হয় তাহলে কিন্তু ওর কপাল থেকে এ বাড়ির ভাত তো উঠবই সাথে তোর বউরে জেলের ঘানিটানাতেও কিন্তু আমি মানা করতাম না। ”
শ্বাশুড়ির সম্বোধনে জুনাইদ স্তব্ধ। আগে তাকে কতটা খাতির করতেন তিনি। কখনো তুমি, বাপ, আব্বা, বাবা ছাড়া ডাকতেন না। আজ তার টাকা কামাইয়ের সামর্থ্য নেই। তাই সেসব সম্বোধন কোথাও উবে গেছে। তার পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে তুইতোকারি। তুই করে ডাকার মাঝে সাধারণত দু’টো অর্থ বহমান৷ একটি আদরের ডাক যেটা সন্তানদের বাবা মা আত্মীয়স্বজন স্নেহভাজন স্বরুপ ডাকেন অন্যটা ডাকা হয় যাকে মানুষ অপছন্দ করেন তাকে। যারা তাদের চোখে নিন্মমানের মানুষ হিসেবে অধিক পরিচিত। জুনাইদের সে হিসেবে বুঝতে বাকি নেই। তার কঠিন দিনগুলো যেন আরো কঠিন হয়ে উঠছে। এতোদিন নিজেকে খুবই হতভাগিনী মনে হতো। বুঝি শ্বশুরবাড়ি সুখ আমার কপালে আল্লাহ রাখেননি৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার চেয়ে বড় হতভাগ্য জুনাইদের। যাকে তার জন্মদাত্রী জননী তিরস্কার করতে ছাড়েন না। সেখানে আমি কোথাকার কে? উনার থেকে ভালো আচরণ আশা করাটাও অন্যায় হবে বোধহয়।

জুনাইদ সব মিলিয়ে আজ চুপ করে থাকল না। মায়ের কথায় জানতে চাইল, ” মা আমার বউ কি করেছে, যার জন্য এতো চেচামেচি করে বাড়ি সুদ্ধ লোক তো জড়ো করলেনই আবার জেলে পাঠানোর হুমকি পর্যন্ত দিতে ছাড়লেন না? ”
” কি করে নাই তোর বউ? তোর বউরে গিয়াই জিগা পারলে.। দেখে শুনে ছোটলোক একটারে ঘরে তুলছি। ”

জুনাইদ আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিল৷ তার চোখে আমি স্পষ্ট পানি টলমল করতে দেখলাম। এই বুঝি তার কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু পুরুষদের তো কাঁদতে হয় না। তাই সেও নিজের দুর্বলতাকে লুকাতে চলে গেল ঘরের ভেতর। এতো অপমান আসলে সহ্য করাও যায় না। তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই ঠিকই কিন্তু তার পাশে থাকা স্ত্রী হিসেবে আমার প্রধান এবং অন্যতম কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। জুনাইদের পেছন পেছন আমিও ঘরের ভেতর চলে গেলাম। ঘরে যেতেই…..

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে