আমার প্রথম সকাল পর্ব-১২

0
73

#আমার_প্রথম_সকাল (১২)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
একজন মানুষ কতটা অসহায় হলে হাউমাউ করে কাঁদার মতো পরিস্থিতিতে উপনীত হয় তা আমার চেয়ে ভালো বোধহয় দু’জন জানে না। জুনাইদের পেছন পেছন গিয়ে দাঁড়াতে জুনাইদ আমাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। শুনেছি পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই। সেদিক থেকে জুনাইদ নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। যাদের জন্য নিজের সবটা উজাড় করে দিল তারা আজ তাকে এবং তার অর্ধাঙ্গীনিকে অপমান করে দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিল যার দরুন সেও দমিয়ে রাখতে না পেরে বাচ্চাদের ন্যায় কেঁদে দিল। সবচেয়ে আশ্চর্য হতে বাধ্য হলাম যখন জুনাইদ আমায় বলে উঠল, ” সকাল আমায় ক্ষমা করে দিও। ”
জুনাইদের ক্ষমা চাওয়ার কারণ জানতে জিজ্ঞেস করলাম, ” শান্ত হোন! আর ক্ষমা কেন চাইছেন? ”
” আমি তোমাকে চরমভাবে ঠকিয়েছি সকাল। যা ক্ষমার অযোগ্য। আমার জন্য আজও তোমাকে কতগুলো কথা শুনতে হলো। ”
” আমি কিছু মনে করিনি। তাছাড়া এগুলোতে এখন আর কিছু যায় আসে না আমার। আপনার ওপর তো অভিযোগের প্রশ্নই আসে না। আমার কষ্ট একটাতেই। তারা আপনার বাবা মা হয়েও আপনাকে বুঝল না। ”
সকল দূরত্ব গুছিয়ে জুনাইদকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেছি। লোকটার দুর্দিনে পরবর্তী দিনগুলোতে এভাবেই পাশে থাকব বলে নিজে নিজের সাথে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। জুনাইদ হালকাবোধ করল কিনা জানি না তবে আমার নিজেকে বেশ হালকা মনে হলো।

আস্তে আস্তে আমাদের অভাবের দিনগুলো কাটতে লাগল। শুনেছি অভাব যখন দরজায় কড়া নাড়ে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। কিন্তু না কথাটা সর্বক্ষেত্রে সমান তালে প্রযোজ্য নয়। বরং এই অভাবটাই জুনাইদের সাথে আমার বৈবাহিক জীবনটাকে আরো মজবুত করে তুলেছে। সব ভুলে দু’জন নিজেদের মতো বাঁচতে শুরু করলাম। আগে পিছে কে আছে ভাবা বাদ দিলাম। জুনাইদ এবং তার সকাল, দু’জন নিজেদের জন্য বাঁচবে বলে সিন্ধান্ত নিল। সেদিনের পর থেকে ওদিকে চেয়ে দেখাটাও আমার জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। জুনাইদ স্বয়ং নিজেই বলেছে ওদিকটায় ফিরেও তাকানোর দরকার নেই। যেখানে গেলে আমাদের এতোটা ছোট হতে হবে সেখানে না গেলে আমরা কেউ মরে যাবো না৷ বরং গেলেই নিজেদের আত্মসম্মানের অপমৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়।

এতো কিছুর মাঝেও শ্বশুর মাঝে মাঝে আসেন এদিকটায়। ছেলের খোঁজ খবর নেন। টাকা পয়সা দিতে চান। কিন্তু জুনাইদ সেসবে ঘোর বিরোধিতা জানায়। সে এই বয়সে এসে বাবার থেকে কোনো টাকা নেবে না। শ্বশুর বোঝান, ‘এ টাকায় তার যথেষ্ট হক আছে। টাকা তো তার কামাই করা থেকে এসেছে। ‘ জুনাইদ তাতেও অস্বীকার জানায়। বোঝায়, ” রেখে দেন বাবা। আমি এখন যথেষ্ট সুস্থ সবল আছি। একটা না একটা ঠিক ব্যবস্থা করে নেবো। আপনারা অসুস্থ হলে এ টাকা তখন আপনাদেরই আগে লাগবে। ‘” শ্বাশুড়ি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। জানলে হয়তো তুলকালাম ঘটাতে দ্বিতীয়বার ভাববেন না। তবে শ্বশুর যে শ্বাশুড়ির এবং তার ছোট ছেলে ও ছেলের বউয়ের ওপর নারাজ সেটা বোঝা যায়।

জুনাইদ সুস্থ হয়ে উঠেছে। মফস্বলে পড়ে থাকলে ভালো কোনো চাকরির ব্যবস্থা হবে না বিধায় সে সিন্ধান্ত নিল ঢাকায় যাবে। এবার আর বিদেশে পাড়ি জমানোর কোনো ইচ্ছে তার নেই। সে জানে সে চলে গেলে আমি একদম একা হয়ে যাবো। আমার যেমন সে ছাড়া কেউ নেই তারও এখন আর সকাল ছাড়া কেউ নেই। জুনাইদের কাছে সকাল এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় মত্ত হওয়ার চেয়ে জরুরী আর কিছুই নয়। যেহেতু সে একজন শিক্ষিত এবং কর্মঠ পুরুষ মানুষ, ঢাকায় গিয়ে ভালো দেখে কোনো চাকরি নেবে। হয়তো বিদেশের মতো ভালো আয় রোজকার আসবে না সংসারে। তবে সুখী হতে হলে দু’জনের মধ্যকার দূরত্বটা অন্তত গুছবে।

জুনাইদ ঢাকায় যাবে বলে ব্যাগ গোছাচ্ছিল। আমি একে একে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে দিচ্ছিলাম। আমার মন জুড়ে আঁকড়ে ধরেছে একাকিত্ব। একা একা থাকব কি করে আমি এ বাড়িতে? জুনাইদ থাকতে ঘর থেকে আমাকে কোথাও বের হতে হয়নি। কেবল রান্নাঘর, কলপাড় এবং পুকুর ঘাট অব্ধি সীমাবদ্ধ থেকেছি৷ গত কয়েকদিন দুজনে যতটা সম্ভব বেশ ভালো সময় কাটিয়েছি। যার দরুন আমার সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে আসতে বাধ্য করিয়েছে জুনাইদ। হোক না সে খুব বেশি দূরে নেই। চাকরিটা হয়ে গেলে সপ্তাহে সপ্তাহে আসবে হয়তো। কিন্তু তবুও আমার নিকট এটাকেই অনেকটা দূরে বলে মনে হচ্ছে। আমাকে অন্যমনস্ক হতে দেখে জুনাইদ বলল, ” কি হয়েছে সকাল? কি ভাবছ? ”
” ভাবছিলাম এখানে একা একা কিভাবে থাকব? তুমি নেই চারপাশ জুড়ে কেবল শূন্যতায় ভরপুর। ”
জুনাইদ টিপ্পনী কাঁটল, ” বাহ্ আমাকে এখন থেকে মিস করা শুরু করে দিয়েছ দেখছি। ”
আমি লাজুক হাসলাম। পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে বললাম, ” আচ্ছা আমাকে নিয়ে গেলে হয় না? ”
” যাবো। তোমাকে নিয়েই যাবো। তবে এখন না। এখন নিলে কোথায় থাকব খাবো নিজেরই ঠিক নেই। তাই আগে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করে নেই। তারপর তোমাকে এসে নিয়ে যাবো। ”
শুনে মনটা আমার খুশিতে নেচে উঠল। আমার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখতে পেয়ে জুনাইদ বলল,
” আরেকটা ভালো খবর দেই তোমায়। ”
” কি খবর? ”
” জামাকাপড় গুছিয়ে নেও। তোমাকে মায়ের কাছে রেখে আসি আমানতস্বরূপ। সেই যে এলে আর তো যাওয়াই হলো না তোমার। তারা মা মেয়েও আমাকে দেখতে এলেন না আর। আমি নাহয় তাদের দেখতে যাব সঙ্গে তোমাকেও রেখে আসব। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে। ”
.

.
জুনাইদের কথা মতো পরদিন আমিও তৈরি হয়ে নিলাম মায়ের কাছে যাবো এই উদ্দেশ্যে। জুনাইদ ঠিক করল সে ঢাকা থেকে ফেরা অব্ধি থাকা হবে ওখানে। বাড়ি থেকে বের হব পথিমধ্যে শোনা গেল ওঘর থেকে শ্বাশুড়ির চিৎকার চেচামেচি। সোমা এবং শ্বাশুড়ির মধ্যে খুব রকমের তর্কাতর্কি চলছে। দুজনের কথার ধরনে বোঝা গেল সোমার বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে শ্বাশুড়ির সাথে তার যত বিপত্তি বাধছে। সোমা শ্বাশুড়িকে বলছে,
” নিয়ম মতো ছয়মাস হলে মেয়েরা বাপের বাড়ি যায়। আমার সাত মাস চলতেছে। এই সময় তো সব মেয়েরা বাপের বাড়িতেই থাকে। তাতে আপনার এতো আপত্তি কিসের? যেখানে আপনার ছেলে মানতেছে?”

সোমার কথার জবাবে শ্বাশুড়ি রাগের মাথায়ও তাকে স্নেহসূলভ শাসনের সহিত বললেন,
” তোমার পেটে আমার বংশের প্রথম বংশধর। আমি আমার কাছে রাখব তারে। তুমি কোথাও যাইতে পারবা না এই কইলাম। ”

তাতেই সোমা রেগেমেগে আগুন। চেচিয়ে বলল,” আপনারে কি আল্লাহ একটাই ছেলে দিছে? ছেলে তো আপনার আরেকটাও আছে। যান তার কাছে যান। তারাও তো যাচ্ছে। গিয়ে তাদেরকে আটকান। আমার এইখানে কি? ”

” তার কাছে যাবো মানে? এই বাড়ি আমার, এই বাড়ির সিন্ধান্ত সব আমার। আমি কই থাকব না থাকব সেটা কি তোমারে বলতে হইব? ”
” আমারে বলবেন না তো কারে বলবেন? খাচ্ছেনটা কার? আমার জামাইরটা খান আবার আমারে ধমক দেন কোন আক্কেলে? ”
শ্বাশুড়িও এবার সমান তালে চেচিয়ে উঠলেন, ” ওই তুমি আমারে খোটা দেও হ্যাঁ? আমি খাই আমার ছেলেরটা আর আমার জামাইরটা। তোমার বাপের বাড়ি থেকে তো আর আনো না। ”
” আমার বাপেরবাড়ি থেকে কম আনছি? কম গিলছেন? আমি আসার আগেই আমার বাপ মায় কত কিছু পাঠাই দিল। সেসবের কোনো দাম নাই? না-কি পেটে চালান দিতে পাইরাই সব ভুইলা গেছেন? ”
” হ তোমার বাপের বাড়ি থেইকা এমন কি দিছে? দেওয়ার ভয়ে মেয়ে বিদায় করছে আবার বড় বড় কথা কও। ছোটলোকের জাত কোনহানকার! ”
” ছোটলোক আমি না ছোটলোক হইলেন গিয়া আপনারা। খাওয়ার পরপর সব ভুলে গেছেন। অকৃতজ্ঞ, হিংসুক বেটি মানুষ। আপনার ছেলেও তো কম দেয় না। এখন নাহয় আমার বাপের বাড়ি থেকে দেয় না৷ এখন খান কারটা। আরেকজনও তো আছে। কই তার কাছে তো যাইতে পারেন না। ”
” ওই এত খোটা দেও কার ছেলেরটা খাই? তোমার জামাই হওয়ার আগে সে আমার ছেলে মনে রাইখ। বাপ মা কিছু শিখাই পাঠায় নাই কেমনে বড়দের সাথে কথা বলা লাগে? বেয়াদব, কম আক্কেল। ”
” আপনারে শিখায় নাই? আপনারে তো খালি শিখাইছে কেমনে ছেলের বউদের জ্বালাইতে হয় সেসব। একজনরে তো ঘর থেকে পার করছেন। এখন আমার পিছে লাগছেন। ”
” আজকে আসুক জামিল৷ যদি এর একটা বিহিত ওর না করে না? ”
” হ যান যান। আমিও দেখবোনে কে কার বিহিত করে। ”

শ্বাশুড়ি এবং বউমা কেউ কারোর চেয়ে কম না। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন তারা। যা আসছে একজন আরেকজনকে বলে যাচ্ছে,আশেপাশের পরিবেশ বিবেচনা না করেই। শ্বাশুড়ির মেয়ে তুল্য বউমা কয়দিনের মাথায় হয়ে গেল ছোটলোকের জাত। সোমাও কম না। বড়ছোট কিছু মানছে না একাধারে শ্বাশুড়িকে সেও বলে যাচ্ছে। আমি যতটুকু সহ্য করেছি সোমার মাঝে তার বিন্দু মাত্র ধৈর্যটুকুও নেই। বিয়ের মাসখানেকের মাঝে জুনাইদ চলে যাওয়ার পরপরই শুরু হয় আমার ওপর শ্বাশুড়ির চক্ষুশূলের ন্যায় আচরণ। যত যাই বলত রাগ উঠলেও কিছু বলতে পারতাম না। কারণ একটাই। আমার বাবা বাড়ির অবস্থান ততটা স্বচ্ছল না। মায়ের কাছে নালিশ গেলে তিনি সব সময় নত হতেন এবং সব জেনেও আমাকে তর্ক করতে নিষেধ করে দিতেন। তাই আমার হয়ে লড়বার মতো দুকূল জুড়ে কেউ নেই। তারপরেও আমার দোষের কোনো শেষ ছিল না শ্বাশুড়ির কাছে। স্বামী যাও দু চারটে আমার হয়ে বলত তাও ছিল আমার জন্য বহুত। তাতেও শ্বাশুড়ি সারাক্ষণ খোঁটার ওপর রাখতেন, আমি নাকি তার ছেলেকে তাবিজ কবজ করে বশ করে রাখছি।

জুনাইদ আর আমি ঘর থেকে দুজনের সব কথা শুনছিলাম। জুনাইদের মধ্যে কোনো প্রকার হেলদোল দেখা গেল না। রওয়ানা দেওয়ার জন্য তাড়া দিতে বলল, ” চল সকাল। আমাদের এসব শুনে কাজ নেই। এসব যার যার নিজস্ব ব্যাপার। আমি না আসা পর্যন্ত তুমিও এখানে আসিও না। নাহলে সোমার কিছু হয়ে গেলে তোমাকে ভুগতে হতে পারে। ”

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে