আমার প্রথম সকাল পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
77

#আমার_প্রথম_সকাল (১৩)
#অন্তিম_পর্ব
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
জন্মদাত্রী জননীর চিৎকার চেচামেচিতে সেদিন জুনাইদ ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে যায়নি কিংবা প্রয়োজন মনে করেনি। আমি ভেবেছিলাম হয়ত একবার হলেও যাবে সরাসরি না হোক আড়ালে গিয়ে হলেও মা’কে দেখবে। কিন্তু না আমার চিন্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন পূর্বক জুনাইদ আমাকে নিয়ে চলল নিজের গন্তব্যে। আমার মনে কৌতুহল জন্মাল জুনাইদের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে। যে ছেলে মায়ের একটা ইশারায় ওঠবস করত আজ সে এতো কিছু দেখেও একদম নিশ্চুপ। যেন সে আগে থেকেই জানত এসব হবে। আসার পথে কৌতুহল নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করেও বসেছি। ” আচ্ছা তুমি মা’কে দেখতে গেলে না যে? ”
জুনাইদ বলেছিল, ” মা’কে দেখতে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি। মা তার ছেলেকে নিয়ে ভালো আছেন। আমি গেলে সেখানে ব্যাপারটা খুব খারাপ হতো। এসব তাদের মধ্যকার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাদের মতো তৃতীয় ব্যক্তির আগমন মানে তাদের নিজেদের প্রাইভেসি নষ্ট হওয়া। ” কথাগুলো জুনাইদ অন্যপাশ ফিরে বলেছিল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কথাগুলো বলার সময় জুনাইদের কণ্ঠ কাপছিল, চোখ অশ্রুতে টলমল করছে।

” তোমার অন্তত বলে আসা উচিত ছিল। ”
” তাতে লাভ? ”
” লাভ কি জানি না ঠিক। তবে ছেলে হিসেবে এটা তোমার কর্তব্য। তোমাকে আমি কখনোই কর্তব্য পালনে অনীহা করতে দেখিনি। ”
জুনাইদ কিছু বলল না। আমার হাতটাকে শক্ত করে ধরে রেখে কেবল হাসল। পরক্ষণে বলে উঠল, ” তোমার প্রতি যে এতদিন অনীহা দেখালাম। সে বেলায় কিছু বললে না তো! ”
” কর্তব্য পালনের সুযোগ পাওনি বল। এখানে অনীহার প্রশ্নই আসে না। ”
.

.
জুনাইদ একদিন থেকে পরদিন ঢাকার উদ্দেশ্যে চলে গেল। আমার দিনগুলি চলতে থাকল জুনাইদ বিহীন, জুনাইদের অপেক্ষায় ওর আগমনের পথ চেয়ে। কখন আসবে একটা চাকরির সন্ধান নিয়ে? কবে এসে বলবে, চল আমরা দুজন নিজেদের গন্তব্যে পাড়ি জমাই, মিষ্টি স্বরে এসে কানের কাছে গুনগুন করে গান গাইবে, ‘ তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী বিকেল, ক্লান্ত দুপুরবেলা!’ কবে আসবে সে প্রতীক্ষিত সময়? অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে আমার দিনাতিপাত চলতে লাগল। এই বুঝি কোনো ভালো সংবাদ আসে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর জুনাইদের কল আসে। ক্লান্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সারাদিনকার ঘটনা উল্লেখ করে। এমনি করে কেটে গেল অনেকগুলো দিন। সময় আমার আর কাটছে না। এতোদিন কোনোভাবে কাটিয়ে দিতে পারলেও এখন আর যাচ্ছে না। হয়ত এরজন্যই কিনা জানা নেই, সকাল থেকে খেয়াল করলাম আমার শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। সেজন্য সারাটা দিন একনাগাড়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম। উঠে বসার মতো উপক্রম হচ্ছে না কোনোক্রমেই। কেবল মাথা ঘুরছে, অথচ গায়ে জ্বরের ছিটেফোঁটাও নেই। মা এসে বেশ কয়েকবার খেতে ডেকে গেলেন। খাবো না বলে জানিয়েছি। কিন্তু মা তো মা-ই। না খাওয়া অব্ধি তিনি সেধে গেলেন। এক পর্যায়ে জুনাইদের কাছে নালিশটা পর্যন্ত দিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বসলেন। অগত্যা আমাকে উঠে কষ্ট করে খেতে বসতে হলো। কিন্তু খুব একটা খেতে পারিনি, লোকমা দুয়েক মুখে তুলতে গড়গড় করে ভেতর থেকে সব বেরিয়ে এলো। মা নিরাশ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর ক্ষুদ্র করে শ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন। ছোটবোনটা সদ্য কলেজে পা রেখেছে। তার আবার পড়াশোনার প্রতি প্রবল ঝোঁক। তার আগ্রহ দেখে মা তাকে না পাঠিয়েও পারেন না। তবে বোনটা একটু দুষ্টু স্বভাবের আছে। কাজ করতে বললে সরাসরি বই হাতে দাঁড়িয়ে যায়। একাধারে পড়া শুরু করে দেয়। ভাব খানা এমন যেন তার কাছে পড়াশোনা ছাড়া পৃথিবীতে আর দু’টো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় না। তবে যতটুকু পড়ুক না কেন? মনোযোগী হওয়ায় এসএসসিতে স্কুলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। ও দেখতেও আমার চেয়ে ভালো। আজকাল প্রায়ই মায়ের কাছে ভালো ভালো সম্বন্ধ আসে। কিন্তু সে এখন বিয়ে করবে বলে সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। আমার অসুস্থতার সময় ছোটবোনটা বাড়িতে থাকলে মা’কে এত কষ্ট করে কাজ করতে হতো না। নতুবা আমার শরীরটা সামান্য ভালো হলেও চলত। মা’কে একা একা কষ্ট করতে দেখে নিজের কাছেই খারাপ লাগল।

আজ অনেকদিন পর আবার আমার খালা আমাদের বাড়ি এলেন। এসেই মায়ের কাছে নিজের ছেলের বউয়ের বদনাম গাইতে শুরু করে দিলেন। আপসোস করতে করতে এক সময় আমাকে নজরে পড়ে তার। বাড়িতে মেহমান এসেছে শুনে আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলাম ঘরের বাহিরে। অন্যথায় আমার যে খালা তাতে করে আমার মা’কে কথা শোনাতে তিনি এক চুলও ছাড় দেবেন না। তা হলেও যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা নামে। আমাকে দেখামাত্র তিনি হায় হায় করতে লাগলেন।
” কিরে সকাল! তুই এখনো বাপের বাড়ি পড়ে আছিস? যাস নাই? ”
” পড়ে থাকব কেন খালা? বেড়াতে এসেছি ক’দিনের জন্য।। ”
” বাহ্ রে সেদিন না বেড়িয়ে গেলি? ”
মা জবাবে খুশি মনে বললেন, ” তাতে কি হয়েছে। মায়ের মেয়ে মায়ের কাছে এসেছে। যতদিন আমি থাকব ততদিনই তো আসবে। ”
” তাই তো বলি। লোকে যে এত কথা বলে সেগুলো সত্যি না হয়ে কি আর পারে? ”
খালার কথা শুনে আশ্চর্য হলাম। ” মানে? কে কি বলে? ”
” তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তোরে নিয়ে যে ছিঃ ছিঃ করে জানস? ”
” ছিঃ ছিঃ করার কি হয়েছে খালা? বলবেন তো করেছিটা কি? ”
খালা আমার কথায় তোয়াক্কা না করে মায়ের কাছে নালিশ জুড়ে দিতে লাগল, ” বুবু তোমার মেয়েরে যে এখানে রাখছ জানো হের শ্বশুর শ্বাশুড়ির কি অবস্থা? মহিলা বাড়িতে একলা একলা কেঁদে বুক ভাসান। একটা ছেলের বউও নাকি বাড়িত নাই। পাড়াপ্রতিবেশি এসব বলে বলে কান ঝালাপালা করে দেয়। আমার কাছেও খবর আসছে। আমি আবার বলছিলাম আমার বোনঝি এমন না। একন দেখতেছি কথা তাহলে সত্যিই। ”

খালা নিজের ইচ্ছে মতো বানিয়ে বানিয়ে বলতে লাগলেন। খালার ননদের বাড়ি আবার আমার শ্বশুরবাড়ির সাথে। উনার ননদ এসে না-কি সেদিন খালাতে এসব বললেন। আমার শ্বাশুড়িকে নাকি তার বউয়েরা দেখতে পারে না। ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আরো নানান কথা। মা চুপচাপ সব কথা শুনে গেলেও আমি পারিনি চুপ করে থাকতে৷ খালাকে বললাম, ” খালা আপনাকে এতো খবর কে দেয়? এতো আজাইরা সময় আসে কই থেকে? ”
আমার কথায় খালা তেতে উঠলেন, ” হ আমারে জিগাস আমার এত আজাইরা সময় কই থেকে আসে? তুই যে এখনো বাপের বাড়ি পড়ি আছিস তর জামাই জানে? সত্যি কথা বল তো? ”
আমি কিছু বলার আগে খালা নিজে নিজেই বললেন, ” যেদিন ওর জামাই জানবে না বুবু? দেখবা তোমার সকালরে কেমনে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। তখন আবার বইল না হেরা খারাপ! আসল খারাপ তো হইলা গিয়া তুমি বুবু। একজনরে বিয়ে দিয়েও রাখছো নিজের কাছে। আরেকজনরে এখনো পড়াইতেছ। বলি বয়স তো আর কম হইল না এতো পড়াই কি জর্জ ব্যারিষ্টার বানাইবা নাকি? ”
“সেসব নিয়ে তোর এতো ভাবতে হবে না। জীবনেও দেখলাম না কোনোদিন খবর নিতে এখন এসব কথা তোর মুখ দিয়ে বের হয় কেমনে? লজ্জা লাগে না বলতে?আর সকালরে ওর জামাই-ই রেখে গেছে। তোর কথা শেষ হলে এবার তুই যা। ” মায়ের আর সহ্য হলো না। খালার ওপর রেগে গিয়ে তিনিও বলে দিলেন। খালা কথা বলে না পেরে সেদিন রেগেমেগে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলেন।
.

.
জুনাইদ তারপরদিন হুট করে চলে আসে ঢাকা থেকে। এসে আমার অসুস্থতার কথা জানতে পেরে কপট রাগ দেখায় তাকে কেন জানানো হয়নি? আমি বললাম, ” জানালে তুমি চিন্তা করতে যে! ”
এরপর আর কিছু বলেনি সে। জুনাইদ এই ক’দিনে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। হয়তো ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া হয়নি। অনেক দখল গেছে শরীরটার ওপর। প্রবাস থেকে যখন ফিরেছিল তখন তাকে দেখতে যতটা সুদর্শন যুবক বলে মনে হয়েছিল এখন সে সৌন্দর্য অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। চোখের নিচের কালো দাগ বেড়েছে। বোঝা গেছে লোকটা আমাকে আর নিজেকে ভালো রাখতে গিয়ে চিন্তায় গত কদিন ঘুমোয়নি পর্যন্ত৷ কিন্তু গত ক’দিনের তুলনায় আজকে তাকে সবচেয়ে হাসিখুশি বলে মনে হচ্ছে। জুনাইদ এসে, জানাল ওর চাকরি হয়েছে। সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করার দরুনে তার একটি ভালো পত্রিকা অফিসে চাকরি হয়েছে। শুনে নিজের খুশিটা ধরে রাখতে পারলাম না। দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। এতো খুশি বোধহয় গত কদিনে আর একটিবারের জন্যেও হইনি আমি। সেই সঙ্গে তাকে আরো একটা খুশির সংবাদ দিলাম। ছলছল নয়নে বললাম, ” জুনাইদ তুমি বাবা হতে চলেছ! ” আমার কথা শুনতে জুনাইদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। আজ একের পর এক খুশির সংবাদ পাবো হয়তো দুজনের কেউ জানতাম না। ❝ শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এত দিবেন, যে তুমি খুশি হয়ে যাবে। ❞ (সূরা আদ দুহা:৫) আয়াতটি আজ আবারো মিলে গেল।

সেদিন বিশ্রাম নিয়ে দুজনে ফিরে গেলাম বাড়ির পথে। এই ক’দিনে শ্বশুর নাকি কয়েকবার জুনাইদের কাছে খবর পাঠিয়েছেন কবে ফিরবে সে, কবে দু’জনে ফিরে যাবো নিজেদের ভিটায়। বাড়িতে যেতেই দেখলাম শ্বাশুড়ি রুগ্ন হয়ে বসে আছেন ঘরের দুয়ারে। শুরুতে বুঝিনি পরে শ্বশুরের কাছে শুনেছি, সোমা বাপের বাড়ি চলে গেছে আমরা যাওয়ার পরদিনই। জামিলও বাড়ি আসে না। অফিস করে শ্বশুর বাড়ি থেকে আবার শেষ হলে সে পথেই চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে গেছে সোমা সুস্থ না হওয়া অব্ধি এ বাড়িতে আসবে না। জামিলকে শ্বাশুড়ি ফোন করেন। জামিল সেটাও তুলে না। নিজের মতো ব্যস্ত সময় কাটায়। যদি তোলে তখন শ্বাশুড়ি কান্নাকাটি করেন, সোমা না আসুক সে যেন অন্তত আসে। যেন পরে যায়। কিন্তু জামিল সাফ সাফ জানিয়ে দেয় সে সোমাকে ছাড়া আসবে না। তার মায়ের জন্য সোমাকে সে এখানে এনে কষ্ট দিতে চায় না। সোমা নালিশ করেছে শ্বাশুড়ি মা তাকে অকট্য ভাষায় গালাগালি করেছে, তার বাবা মা তুলে গালি গালাজ করেছে। সে আর এখানে থাকবে না। শ্বশুর শ্বাশুড়ি যতদিন থাকবে সে ততদিন আসবেও না।

শ্বশুরের কথা শুনে জামিলের মায়া হলো বোধহয়। আমাকে বলল, ” সকাল চল মা’কে গিয়ে একবার দেখে আসি। ”
আমি না করতে পারিনি। তিনি যতই দূরে ঠেলে দেন না কেন? শত হলেও উনি তো জুনাইদের মা-ই। তাই দুজন মিলে শ্বাশুড়িকে দেখতে গেলাম। জুনাইদ ভেতরে গেলেও আমি আর গেলাম না, বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদে শ্বাশুড়িকে হাউমাউ করে কাঁদতে শোনা গেল। শুনলাম তিনি ডাকছেন বারবার, সকাল নাম ধরে। আমি এগিয়ে যেতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বারবার মাফ চাইতে লাগলেন। আকুতি ভরা কণ্ঠে বলেন, ” আমারে মাফ করে দিও মা। অনেক অন্যায় করছি তোমাদের সাথে। আমি বুঝতে পারি নাই মা। সোমা আর জামিল মিলে আমার চোখ খুলে দিছে। টাকা পয়সা সব সময় সুখ দেয় না রে মা। তোমাদের অভাব দেখে তারা চাইল আমরাও আলাদা করে দিলাম। তোমাদের নাই বলে তোমাদের কাছে যেতাম না৷ যেতামইবা কি করে বল, তোমাদের নিজেদের চলতে যেখানে কষ্ট হয়, সেখানে আমাদের খরচ দিবা কেমনে? আমার জুনাইদের টাকা থাকতেও সে আমারে ভুলে যায় নাই। অথচ যে ছেলের জন্য আমার হীরের টুকরো ধনটারে আলাদা করে দিছি সেই ছেলেটাই আমারে উল্টো বের করে দিছে। ”

শ্বাশুড়ি মায়ের আহাজারিতে মনের ভেতরটায় সোমা এবং জামিলের জন্য খারাপ লাগা জেগে উঠল। সোমা শ্বাশুড়ির থেকে যে যত্নটুকু পেয়েছিল এর কিঞ্চিৎ পরিমাণও যদি আমি পেতাম তবে উনাকে আমি আমার মাথায় করে রাখতাম। আমার বাবা নেই সেই হিসেবে শ্বশুরকে বসাতে পারতাম বাবার আসনে। কিন্তু আপসোস যে যেটা পায় সে সেটার কদর করতে জানে না। সোমা সেই যত্নটুকুর মর্যাদা রাখতে পারেনি। আর জামিল পারেনি নিজের জান্নাতটাকে নিশ্চিত করতে। উল্টো পায়ে ঠেলে দিয়েছে।

জুনাইদ এবং আমি শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিজেদের সাথে থাকতে বলে দিলাম। আজ থেকে আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করার সিন্ধান্ত নিলাম। শ্বাশুড়ি মাথা নত করে রইলেন কেবল। হ্যাঁ, না কোনো বাক্য ব্যয় করলেন না। চোখ থেকে টপটপ করে তার পানি পড়ছে। এমতাবস্থায় জুনাইদ যখন উনাদেরকে উনাদের বংশধর আসার সুসংবাদ দিল তখন তিনি আমার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন। দু’হাত তুলে দোয়া করলেন আমাদের জন্য। সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল এর চেয়ে সুখী মুহূর্ত বোধহয় আর দ্বিতীয়টি হয় না। সেই সঙ্গে তিনি কথা দিলেন, যে আসবে সে ছেলে মেয়ে যেই হোক। তাকে তারা অতি যত্নের সহিত কোলেপিঠে করে মানুষ করবেন।

ভালো এবং খারাপ সময় দু’য়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের দিনগুলো কাটতে লাগল। শ্বশুর শ্বাশুড়ি মফস্বলের বাড়িতে আর আমরা দু’জন ঢাকায়। এ করে সময়গুলো একে একে অতিবাহিত হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম শ্বাশুড়ি আপত্তি করবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জুনাইদকে পইপই করে বুঝিয়ে দিলেন, উনার বউমা এবং নতুন অতিথির খেয়াল রাখতে। আমাদের যদি কোনো সমস্যা হয় শুনেছেন তাহলে জুনাইদের খবর আছে। সোমার একটা ছেলে হয়েছে। শুরু থেকেই একটা নাতির সখ ছিল শ্বাশুড়ির। কিন্তু খবর পেয়েও শ্বশুর শ্বাশুড়ি তাকে দেখতে যাননি। এমনকি সেদিনের পর আর খবরও নেননি। জামিলের করা কাজের কথা মনে পড়লে তিনি দোয়া করতে বসে পড়েন আল্লাহর দরবারে। তাদেরও আল্লাহ ছেলে দিয়েছে সেও যেন বড় হয়ে তাদের সাথে এমনটি করে। তখন তারাও বুঝবে কি করেছে। জুনাইদের সাথে আজ আমার মফস্বলে ফিরে আসার কথা। শ্বশুর শ্বাশুড়ি যাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলেননি তবে তারাও চান আমি আমার এমন দিনে যেন শ্বাশুড়ির কাছে থাকি। আগেরবার সোমার ব্যবহারের দরুন থেকেই সাহস করেননি তারা বলার। তাই দু’জন মিলে তাদের না জানিয়ে চলে এসে চমকে দেই। আমার বাড়ন্ত পেট নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বিধায় জুনাইদ সরাসরি গাড়ি ঠিক করে বাড়ি পর্যন্ত আসে। গাড়ি থেকে নেমে বাকিটা পথে আমাকে আগলে রাখেন শ্বাশুড়ি মা। উনার চোখেমুখে খুশি যেন উপচে পড়ছে। এর প্রায় মাসখানেক বাদে একদিন আমাকে প্রসব বেদনায় কাতরাতে দেখে শ্বাশুড়ি সেদিন হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছেন। নীলার পরামর্শে সেদিন নীলা এবং তার স্বামীসহ আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। জুনাইদের আসার কথা আরো দুদিন বাদে। গত সপ্তাহে ডাক্তার ডেট দিলেও কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি।অগত্যা তাকে ছুটি পিছিয়ে এ সপ্তাহে আসার সিন্ধান্ত নিতে হয়। যাতে এসে দু’দিন বেশি থাকতে পারে। কিন্তু ডাক্তারের দেওয়া সময় থেকে সাতদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আসে সেদিন, যে দিনটার জন্য দু’জন তুমুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম অথচ আজ আমরা দু’জন দুই জায়গায়। এমনি সময়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের দু’জনের জীবনকে রাঙিয়ে দিতে আগমন ঘটল নতুন অতিথি হিসেবে আমাদের মেয়ের। কান্নারত অবস্থায় নার্স তাকে বাহিরে নিয়ে গিয়ে আমার মা বোন এবং শ্বশুর শ্বাশুড়িকে দেখান। শ্বাশুড়ি নাতনি হওয়া সত্ত্বেও আজ বেজায় খুশি। ওই উনার বংশের প্রদীপ। উনার আসল উত্তরাধিকারী। শ্বশুর নাতনিকে কোলে তুলে তার কানের কাছে আজান দেন। কান্না থেমে যায় ছোট্ট মেয়েটার। ডাগরডাগর চোখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে দাদার মুখ পানে। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে জুনাইদ তাৎক্ষণিক ঢাকা ছেড়ে ছুটে আসে। মেয়েকে কোলে তুলে মন ভরে আদর করে। ঘুমন্ত মেয়েকে আমার কোলে তুলে দেয়। আমি মেয়েটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা একদম হুবহু তার বাবার মতো হয়েছে। এই নিয়ে যতবার তাকে দেখেছি ততবার আমার মনে হতে লাগল আমি যেন ছোট্ট আরেকজন জুনাইদকে দেখছি। জুনাইদ আমায় জিজ্ঞেস করল, ” তারপর বল আমার প্রথম সকাল থেকে আমার সন্তানের মা রূপে নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরে কেমন বোধ করছ? ”
মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম” একই প্রশ্ন যদি আমি তোমায় করি? তুমি কেমন বোধ করছ বাবা হতে পেরে? ”
জুনাইদ আমার নিকটে এগিয়ে এলো। কপালে অধর ছুঁইয়ে বলল, ” এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় সকাল। আমাদের অভাবের জীবনে সুখের ছোঁয়ায় ভরপুর করতে নিজের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে আমার মা। যেদিন জানতে পারি বাবা হতে চলেছি সেদিনের চেয়ে অধিক সুখীবোধ করছি আজ ওকে ছুঁতে পেরে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার প্রথম সকাল, আমার মায়ের আম্মু। ”

______________সমাপ্ত_________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে