অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -১৪

0
1764

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১৪

রাহাতরা খাওয়া দাওয়া শেষে চলে গেছে দুপুরের শেষভাগেই।মাহা আরাফাতকে ডাইনিং টেবিলে সবার সাথে খাবার খাইয়ে তারপর তাকে নিয়ে সোজা রুমে চলে এসেছে।আরাফাত কিছুটা অবাক হয়েই মাঝেমধ্যে আরচোখে তাকায় মাহার দিকে।সে বুঝতে পারে না মাহার মতিগতি।তার সুস্থ হওয়ার সাথে মাহার কী সম্পর্ক জানা নেই তার।মেয়েটা কেন-ই বা তার এত সেবা করছে এতে ওর লাভটা কী সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না আরাফাত।বেশি চাপও দিতে পারছে না মস্তিষ্কে,বেশি চাপ নিলে মাথায় চক্কর কাটে।সব ঝাপসা হয়ে যায় তখন।

মাহা যেন আরাফাতের মন পড়তে পারলো।সে তাচ্ছিল্য হেসে জবাব দিলো,’তোমাকে সুস্থ করার পিছনে আমার একটা কারণ ছিলো আগে ঠিকই,তবে সেই কারণটা আমি নিজে থেকেই বাতিল করে দিয়েছি।প্লিজ,কারণটা জানতে চেয়ে আমায় লজ্জা দিও না।আমি বলতে পারবো না।তবে এখন শুধুই তোমাকে সুস্থ করে তোলার পণ করেছি আমি।আর কিছুই নয়,দ্যাট’স ইট!

আরাফাত পাল্টা কিছু বলতে পারলো না মাহাকে প্রতিত্তোরে।সে অন্যদিকে মুখ ফেরালো।আরাফাত এখন খুবই আস্তে আস্তে নিজের সেন্সে ফিরে আসছে।আগে একধ্যানে সবার দিকে তাকিয়ে থাকার মানে ছিলো তার আশেপাশে ঘটতে থাকা কোনোকিছুই তার মাথায় ঢুকে নি,অর্থাৎ কোনোকিছু বোধগম্য হয় নি।সে কারও কথা শোনার বা বোঝার পরিস্থিতিতেই ছিলো না।একপ্রকার জিন্দালাশ হয়ে বেঁচে ছিলো।মাথার আঘাত এত ভয়াবহ হতে পারে তার ধারণা ছিলো না কারও!তাও ভালো স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায় নি তার!

মাহা চুপচাপ ঔষধ বের করে আরাফাতকে তা পানি দ্বারা খাইয়ে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলো।আরাফাতের শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে ততক্ষণে।ঘুমে চোখ জোড়া ঢুলুঢুলু করছে।তাই মাহা তাকে ধরে ধরে বিছানার ওপর শুইয়ে দিলো।আরাফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’তুমি ঘুমাও,আমি গোসল করে আসি।’

আরাফাতও চোখ বন্ধ করে ফেলে ঘুমানোর জন্যে।মাহা একটা উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল সাড়তে।মনটা ভার হয়ে গেছে তার।ভালো লাগে না কোনোকিছু।

শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে চুপচাপ অশ্রুপাত করছে মাহা।যার জন্য এতকিছু সেই তো কোনো পাত্তা দেয় না।এত এত ভালোবাসা কীভাবে পায়ে ঠেলে দেয় মানুষ তা বুঝতে পারে না সে।হীরার টুকরো ছেড়ে কাঁচের পিছনে ছুটে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেও শান্ত হয় নি আরাফাত।তার আরও একটা কাঁচের টুকরো প্রয়োজন।মাহা নিজেকে বোঝালো,”আর বেহায়া হওয়া যাবে না,ভালো না বাসলে নাই!নিজেকে নিজেই ভালোবাসতে জানি আমি।আমার জন্য একমাত্র আমিই যথেষ্ট,আর কারও প্রয়োজন নেই।”

গোসল সেড়ে বের হলো মাহা,ততক্ষণে আরাফাত তলিয়ে গেছে ঘুমের অতলে।মাহা চুল মুছে আরাফাতের কাছে গিয়ে বসে তার মুখপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আলতো হাতে তার কপোল ছুঁয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,’তুমি আমাকে কখনো বুঝলে না আরাফাত!জানো খুব কষ্ট হয় আমার এখানটায়,’ বাম বুকে ইশারা করে,,

-‘তুমি কেন আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে চাও না বলতে পারো?আমার গায়ের রঙ মান্দা বলে?আমার মধ্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু নেই বলে?নাকি আমি লামিয়ার মতো এত ফ্যাশনেবল,স্টাইলিশ ও স্মার্ট নই বলে?কোনটা?কীসের কমতি আছে আমার মধ্যে?কেন এত কষ্ট দিচ্ছো আমায়?তোমার জন্য এত এত ভালোবাসা এই মনের মণিকোঠায় সাজিয়ে রেখেছি শুধুমাত্র তোমাকে উজাড় করে দিবো বলে, কিন্তু তুমি?..যাকগে,তোমার সুখটাই আমার কাছে মুখ্য,তুমি সবসময় ভালো থাকো এটাই আমি চাই।একটা সময় হুট করে চলে যাবো তোমার জীবন থেকে,আর ফিরবো না।তখন আফসোস করেও কোনো লাভ হবে না।’

বুকে পাথর চাপা দিয়ে অনেক কষ্টে কথাগুলো বললো মাহা।চোখ থেকে টুপ টুপ করে দুর্ভেদ্য দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে।দ্রুত চোখের পানি মুছে বসা থেকে ওঠে চলে গেল বারান্দায়।সেখানে গিয়ে ইজিচেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে বাহিরের কাঠফাটা রোদের প্রখরতা পরিমাপ করতে লাগলো সে।একটাসময় এভাবেই চোখের পাতায় তন্দ্রা নেমে আসে তার।
____________________

সময় বহমান।সে তার আপনগতিতে চলতে আছে।একঘন্টা একঘন্টা করে সময় যেতে যেতে কবে যে আরও একটা সপ্তাহ কেটে গেছে টেরই পেল না কেউ।

বিয়ের পর থেকেই মাহা নিজের সর্বস্ব দিয়ে আরাফাতের সেবাযত্ন করেছে।বিন্দুপরিমাণ অবহেলা নেই কোনো কাজে।আরাফাতের এখন মাহাকে কাছে পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।বরং মাহা কাছে না থাকলেই খালি খালি লাগে তার।আরাফাতের শরীরের সব ক্ষতও শুকিয়ে গেছে প্রায়।তবে গাঢ় ক্ষতগুলোর দাগ রয়ে গেছে।এখন কিছুটা সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে সে।এত এত ট্রিটমেন্ট তো বিফলে যাওয়ার কথা না।সাথে মাহা ও মিসেস মুমতাহিনার এত পরিমাণ সেবাযত্ন, সুস্থ না হয়ে উপায় নাই।আরাফাত আগে এমনিতেই মাহার সাথে প্রচুর ফ্রেন্ডলি ছিলো,এখন তো আরও বেশি গাঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে।

আরাফাতের হাত পায়ের ভাঙা স্থান এখনও জোড়া লাগে নি।তাই এখন হুইলচেয়ারের পাশাপাশি ক্রাচে ভর দিয়েও হাঁটার চেষ্টা করে সে।এবং তার হেল্পলাইন হলো গিয়ে মাহা।প্রতিদিন হাতে পায়ে ডক্টরের সাজেস্ট করা তেল ও মলম মালিশ করে ডিপ টিস্যু ম্যাসাজ করে দেয় সে।এতে অনেক আরাম বোধ করে আরাফাত।বাথরুমে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে তার যাবতীয় সকল কাজের একমাত্র ভরসা হলো মাহা।মাহার ওপর ছেলের সমস্ত দায়িত্ব সঁপে দিয়ে মিসেস মুমতাহিনাও পুরোপুরি নিশ্চিত।

আজকে আরাফাতকে গোসল করিয়ে দেয়ার জন্য তাকে ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেছে মাহা।২ দিন পর পর গোসল করানো হয় তাকে।গরমের সময় এখন,গোসল না করলে ঘা চটচটে হয়ে যায় ঘামের জন্য।পরে শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়।যা আরাফাত মোটেও সহ্য করতে পারে না।

আরাফাতের প্রথম প্রথম লজ্জা লাগতো সবকিছুতে মাহাকে লাগতো বলে,তবে মাহাই তাকে ফ্রি হতে হেল্প করেছে।হাজার হোক স্বামী স্ত্রীর মধ্যে লজ্জা বিষয়টা শোভা পায় না।

মাহা আরাফাতকে শাওয়ারের নিচে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে।আরাফাত ভিজে চুপসে গেছে পুরোপুরি।মাহা আরচোখে তাকাচ্ছে বারবার আরাফাতের দিকে।ভেজা অবস্থায় তাকে ভীষণ হট লাগছে দেখতে।আরাফাত তা লক্ষ্য করে গলা খাঁকারি দিয়ে জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’এভাবে কী দেখো?’

মাহা শরীর ঘষানোর ছোট তোয়ালে তে শাওয়ার জেল নিয়ে আরাফাতের হাত ঘষতে ঘষতে জবাব দিলো,’কাকে আবার দেখবো,আমার সো কলড জামাই ছাড়া?’

আরাফাত চোখ জোড়া ছোট ছোট করে মাহার দিকে তাকিয়ে বললো,’এভাবে অপমান করছো কেন?আর সো কলড বলার মানে কী?’

-‘সো কলড মানে আমাদের নামমাত্র বিয়ে হয়েছে শুধু,আমরা রিয়েল হাসবেন্ড ওয়াইফ নই!দ্যাট’স হোয়াই,এটাই বলেছি।’হাত ছেড়ে আরাফাতের বুক গলা ঘষামাজা করতে করতে দায়সারাভাবে বললো মাহা।

আরাফাত আর কিছু বললো না প্রতুত্তোরে।চুপ করে গেল।মাহা একমনে তার কাজ করে যাচ্ছে।আরাফাত এবার পুর্নদৃষ্টিতে মাহার দিকে তাকালো।আরাফাতের সাথে সেও ভিজে গেছে পুরোপুরি।চুল কাটি দিয়ে খোঁপা বাঁধা ছিলো।পানি পড়ে খোঁপাও ভিজে একসা হয়ে গেছে।শাওয়ারের পানি তার মাথা থেকে কপাল গাল বেয়ে বেয়ে গলা দিয়ে গড়িয়ে নামছে স্রোতের মতো।আরাফাতের কাছে দৃশ্যটা খুবই মোহনীয় লাগছে।মাহার চেহারা ভীষণ মায়াবী।আরাফাত এই মায়ার মোহনজালে আটকাতে চায় না কোনোমতেই।কিন্তু তারপরও এই বেহায়া চোখ জোড়া তার দিকেই চলে যায়।

আরাফাতকে ভালো মতো গোসল করিয়ে দিয়ে রুমে রেখে এসে তারপর নিজে গোসল সম্পন্ন করে বের হলো মাহা।আরাফাত শর্ট টাওজার পড়ে খালি গায়ে বসে আছে বিছানার ওপর।মাহা এসে আরাফাতের শরীরে বডি লোশন মাখিয়ে পাতলা একটা গেঞ্জি পড়িয়ে দিলো।নিজেও হালকা একটু লোশন মেখে নিলো হাতে পায়ে।লিসা এসে তাদের দরজায় কড়া নাড়লো।মাহা দরজা খুলে দিতেই লিসা বাইরে থেকে বললো,’আম্মু বলেছে তোমরা দুজন খাবার খেতে আসতে।তারপর আমরা একটু বাইরে গলিতে ও পার্কে হাঁটতে যাবো ভাইয়াকে নিয়ে।’

-‘আচ্ছা তুই যা আমি ওনাকে নিয়ে আসছি।’ শান্তকন্ঠে জবাব দিলো মাহা।

লিসা মাথা ঝাঁকিয়ে আচ্ছা বলে চলে গেল।মাহা আরাফাতকে ক্রাচ দুটো এনে দেয়।আরাফাত সেগুলো নিয়ে তাতে ভর করে কষ্টেসৃষ্টে বিছানা থেকে ওঠে দাঁড়ায়।মাহার সাহায্যে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এলো সে।মিসেস মুমতাহিনা কাজের মেয়ের সাহায্যে টেবিলের ওপর তরি তরকারির বাটি সাজিয়ে রাখছেন।কোত্থেকে রিহাদ দৌড়ে এসে আরাফাতকে জড়িয়ে ধরে বললো,’বাবাই জানো,আজকে আমরা হাঁটতে যাবো বাইরে!’

আরাফাত হাসিমুখে রিহাদের গাল টেনে দিয়ে ভাঙা কন্ঠে বললো,’ওলে বাবা,তাই নাকি?’

-‘হ্যা বাবাই।জানো আমি অনেক খুশি।আমি আজ অনেক হাঁটবো।’
রিহাদ হাত মেলে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে।আরাফাত হেসে দিয়ে রিহাদের চুল এলোমেলো করে দেয়।রিহাদ তার বাবাইর পাশের চেয়ারে বসে পড়ে।আরাফাতের হাত থেকে ক্রাচ নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখলো মাহা।তারপর তাকে বসিয়ে প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে হাত দিয়ে মাখিয়ে আরাফাতের গালে একনলা ভাত পুরে দিলো।আরাফাতের ডান হাত ভাঙা তাই তো নিজের হাতে খেতে পারে না।এমনসময় জনাব এরশাদ বাসায় চলে এলেন।ওনি প্রতিদিনই দুপুরের খাবার বাসায় এসে খান।এসময় শুধু সাইফ আসে না।সে অফিসেই নিজের লাঞ্চ সেড়ে নেয়।

মিনিট পাঁচেক পর তাদের সাথে জনাব এরশাদও এসে বসে পড়েন খাবার খেতে।আজ বহুদিন পর আরাফাত তার বিজনেসের কথা জানতে চাইলো তার বাবার কাছে।জনাব এরশাদ লাউয়ের তরকারি নিজের প্লেটে নিতে নিতে জবাব দিলেন,’ব্যবসা চলছে তার নিজের মতোই।বেশি লাভও হচ্ছে না আবার লসও হতে দিচ্ছি না।তোমার ম্যানেজার,সেক্রেটারি এবং আমি যতটুকু পারি সামলে রাখছি।তবুও তোমার মতো কিছু করতে পারছি না।এই আরকি!’

-‘ওহহ,হাত পা একটু ভালো হলে তো যেতে পারতাম কর্মস্থলে।এখন দেখি ঘরে বসেই ল্যাপটপের মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে আমার।’ ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলে আরাফাত।

জনাব এরশাদ আবারও বলে উঠেন,’ওও হ্যা বলতে ভুলে গেছি,তুমি যে ইন্জিনিয়ারিং ফার্মে পার্টটাইম জব করতে সেটায় তোমার পদে অন্য একজনকে ৩ মাসের জন্য নিয়োগ দিয়েছে তারা।তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলে দিয়েছে।’

-‘হুম তা করবো নে!’ মাহার দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে আরাফাত।আরও টুকটাক কথা বার্তা চলে তাদের মাঝে।কথা বলতে বলতে মুখ ফসকে জনাব এরশাদ লামিয়ার কথা বলে ফেললেন,’জানো মুম,লামিয়াকে ও আলভীকে হাইকোর্ট সবদিক বিবেচনা করে ৫ বছর করে জেল দিয়েছে।ওই যে আশফা নামক মেয়েটার কথা বললো না সাইফ,ওই মেয়েটাই সবকিছু করেছে, আমাদের আর কষ্ট করে এক্সট্রা কিছু করতে হয় নি।’

জনাব এরশাদ ভুলে গেছিলেন একমুহূর্তের জন্য যে এখানে আরাফাত আছে।যখন তার সৎবিৎ ফিরলো তখন তিনি জিভে কামড় দিয়ে মাথা নিচু করে ফেললেন।আরাফাত স্তব্ধ দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।মিসেস মুমতাহিনা যেন চোখ দ্বারা গিলে খাবেন নিজের স্বামীকে।লামিয়ার কথা কেউ ভুলেও উচ্চারণ করে না আরাফাতের সামনে কিন্তু আজ জনাব এরশাদ ভুলে সবকিছু বলে ফেললেন।আরাফাতের গলায় যেন খাবার আটকে গেছে,সে যতোটা না অবাক হয়েছে তার বাবার কথা শুনে তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছে এটা ভেবে যে তার সাথে হওয়া ঘটনা সবাই কীভাবে জানলো?সে তো কিছু বলে নি বা বলার পরিস্থিতিতেই ছিলো না।তাহলে বিস্তারিত সবকিছু কেমন করে জানলো সবাই?আর এই আলভী, আশফাই বা কে?সবকিছু চরকির ন্যায় মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে আরাফাতের।মগজ তন্নতন্ন করে হাতরেও কোনো কাঙ্ক্ষিত জবাব পেল না।

প্লেটের অর্ধেক খাবার মাত্র শেষ হয়েছে আরাফাতের।জনাব এরশাদের কথা শুনেই তার খাওয়ার মুডের বারোটা বেজে গেছে।মাহার দিকে তাকিয়ে বললো,’আর খাবো না।ভালো লাগে না।’

ওর কথা শুনে মাহা চোখ রাঙানি দিয়ে বললো,’ফাজলামো রাখো।এখন চুপচাপ খাবারগুলো শেষ করবা।কোনো কথা হবে না।বাবাই কোনো ভুল কথা বলে নি।ওই মেয়ে তোমাকে ঠকানোর শাস্তি পাচ্ছে এখন।ওর জন্য এভাবে অনশন করতে গেলে গলা টিপে একবারে মেরে ফেলবো বলে রাখলাম।অসহ্য!’

মাহা এমনই একটা মেয়ে সে হাজারও দুষ্টামি করলেও যখন সে পুরোপুরি সিরিয়াস হয়ে যায় তখন তাকে বয়স্করাও ভয় পেতে বাধ্য।যেমন এখন আরাফাত থেকে শুরু করে রিহাদ আর মিসেস মুমতাহিনাও ভয়ে চুপসে গেছেন।লিসা নিসা সহ সবাই চুপ।মেয়েটা যখন চোখ রাঙায় তখন তাকে দেখতে যমের মতো লাগে।আরাফাতও টু শব্দ না করে চুপচাপ গিলতে থাকে।মাহার রাগ সম্পর্কে সে অবহিত।

খাওয়া দাওয়া শেষ সবার।খাবার টেবিলে এরপর আর একটা কথাও হয় নি।সবাই চুপচাপ শুধু খেয়েই গেছে।জনাব এরশাদ খাওয়া শেষে নিজের অফিসে ছুটলেন।

রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ পর রেস্ট করে মাহা আরাফাতকে বাহিরে বেরোনোর উপযোগী কাপড় পড়িয়ে দিলো।মাথায় চুল গজিয়েছে অনেক।সেগুলো চিরুনি চালিয়ে আঁচড়ে দিলো।তারপর নিজেও তৈরি হয়ে তাকে নিয়ে নিচে চলে এলো।

আরাফাত একটা ক্রাচে ভর দিয়ে অন্যহাত দিয়ে মাহার কোমড় জড়িয়ে ধরে হাঁটছে।মাহা আরাফাতের কাঁধ বরাবর লম্বা।দুজনকে বেশ মানিয়েছেও।সামনে ইশানী,রিহাদ,লিসা,নিসা ও মিসেস মুমতাহিনা গল্প করে করে হাঁটছেন।তাদের এলাকায় ছোটখাটো একটা পার্কের মতোন মনোরম পরিবেশ আছে।বিকেলের এই সময়টায় অনেক মানুষ হাঁটতে বেরোয়,পার্কে বাচ্চারা খেলাধুলা করে।বয়স্করা হাঁটেন অথবা বেঞ্চে বসে গল্পে মেতে উঠেন।পার্কের পাশেই একটা লেক আছে।লেকটা খুব সুন্দর।স্বচ্ছ টলটলে সবুজাভ পানি লেকের।যখন পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে লেকে পড়ে তখন পানি পান্নার মতো চকচক করে ওঠে।

মাহার মন ফুরফুরে হয়ে গেছে।আরাফাতেরও খুব ভালো লাগছে এখানে এসে।মাহা তাকে ধরে ধরে আস্তে ধীরে হাঁটছে।আরাফাতও মাহার চেষ্টায় যথেষ্ট হাঁটতে পারছে।যদিও ভাঙা পা মাটিতে ফেললে গ্যাচ্ করে ব্যথা জেগে ওঠে,তাই ওই পা মাটিতে না লাগিয়ে ক্রাচের মাধ্যমে অন্য পা দ্বারা ধীরে ধীরে হাঁটছে সে।তাদের মতো আরও কত কাপল হাঁটতে বেরিয়েছে।

বাকিরা আশেপাশে ঘুরছে।মাহা আরাফাতকে নিয়ে লেকের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো।আরাফাতও মনযোগ দিয়ে লেকের পানি দেখছে।দুজনের মধ্যেই প্রকট নিরবতা নেমে এলো।হঠাৎ নিরবতা ভেঙে আরাফাত বললো,’জানো হানি,আমি না লামিয়াকে কখনো কম ভালোবাসি নি।একজন আদর্শ প্রেমিক হতে যা যা লাগে সব গুনই আমার মধ্যে ছিলো।তারপরও কেন এমনটা করলো ও আমার সাথে বলতে পারো?কীসে কমতি রেখেছিলাম তার?টাকা-পয়সা,ফ্ল্যাট,দামী কাপড় চোপড়,দামী রেস্টুরেন্টের খাবার থেকে শুরু করে সময় কিছুতেই তো কোনো কমতি রাখি নি।কিছু চাওয়ার আগেই এনে দিয়েছি।নিজের অফিসের কাজ কামাই করে তাকে সময় দিয়েছি।তারপরও আমি ঠকে গেলাম খুব বাজে ভাবে!’

মাহা আরাফাতের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো।কিন্তু আরাফাত তার দিকে তাকালো না।সে আবারও বললো,’তবে,তোমরা হয়তো মনে করেছিলে আমি ওর বিরহে পাগল হয়ে ডিপ্রেশ্ড হয়ে এক্সিডেন্ট করেছি।আসলে ঘটনা তা না।ঘটনা হলো আমি তাকে রিয়েল লাভ করেছিলাম,কিন্তু সে করে নি,সেটা জানার পর আমি অনেক কান্না করি।ইভেন কান্না করে গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম তাই চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়ায় সামনে বাস না ট্রাক সঠিক বলতে পারি না কী ছিলো,তো সেটা এসে আমার গাড়িকে অনেক জোরে ধাক্কা দেয়।যদি চোখ ঝাপসা না হতো তাহলে হয়তো আজ আমি সুস্থ থাকতাম।হ্যা মানছি লামিয়া আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।তাই বলে এমন না যে ওর কারণে আমি দেবদাস হয়ে বসে থাকবো,অথবা সুইসাইড করতে যাবো।আমার যথেষ্ট আত্মসম্মানবোধ আছে।’

এবার মাহা বলে উঠে,’সব নাহয় বুঝলাম,কিন্তু আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পছন্দ না করার একটা কারণ অন্তত আমাকে দেখাও যে,এই কারণে আমি তোমায় বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবো না!জাস্ট একটা কারণ বলো!’

আরাফাত এবার অপরাধী কন্ঠে বললো,’হানি তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে।তোমায় অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই এখানে।আসলে আমি চাচ্ছি না এমন সম্পর্কে জড়িয়ে থাকতে।আমি নিজের লাইফটাকে একা একা ইনজয় করতে চাই।লামিয়ার এই ঘটনার পর অন্য কাউকে আমার এই মনে জায়গা দেয়াটা সম্ভব না।একটু বুঝতে চেষ্টা করো।আমি চাই না তোমার মায়ায় জড়াতে।তুমি আমার ফ্রেন্ড হিসেবে আছো,ফ্রেন্ড হিসেবেই থাকো।আমার কোনো সমস্যা নেই।’

মাহা চুপ করে গেল।আরাফাতের কথার বিপরীতে আর একটা কথাও বললো না।তবে মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,”রাতে যখন আমার বুকে মাথা রেখে মুখ গুঁজে ঘুমাও,তখন মনে থাকে না আমি তোমার ফ্রেন্ডের মতো।আমাদের মধ্যে এখনও স্বামী স্ত্রীর গভীর সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও রাতে তুমি আমার সাথে তাই করো যা একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে করে থাকে।তখন তোমার মনে থাকে না আমি তোমার কে হই?রাতে ঘুমের ঘোরে গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে দিনের বেলায় বলো তুমি আমার কাছে ফ্রেন্ড ছাড়া আর কিছুই না।হাহ,তোমার থেকে এর বেশি কিছু আমি আশাও করি না।যাই করো,এমন একটা সময় আসবে যখন তুমি আমি বলতে পাগল থাকবে।আমার সংস্পর্শে থাকার পাঁয়তারা খুঁজবে তুমি।এটা আমার চ্যালেন্জ।”

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চললো দুজনের মধ্যে।আরাফাত লামিয়ার কথা জানতে চাইলো মাহার কাছে।আলভী আর আশফা কে তাও জানতে চাইলো।মাহা কিছুটা রাখডাক করে সব খুলে বলে আরাফাতকে।তবে এসবকিছু যে মাহা নিজেই তদন্ত করে বের করেছে তা গোপন রাখলো।আরাফাত সব জেনে বিস্মিত হয়ে গেছে পুরোপুরি।সে ভাবেও নি কোনোদিন লামিয়া নামের মেয়েটা একটা প্রতারক ছিলো।ভালোবাসার এত নিখুঁত অভিনয় কীভাবে করলো সে?ভাবতে গিয়ে মাথা ধরে গেল আরাফাতের।মাহা এসব প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো দ্রুত।কারণ বেশি ভাবতে গেলে আরাফাতের মস্তিষ্কে এর বাজে প্রভাব পড়বে।ফলে অসুস্থ হয়ে যাবে সে।

মাহা আরাফাতকে নিয়ে এদিক ওদিক অনেক হাঁটলো।তারপর দুজনে মিলে ঝালমুড়ি ও চটপটি খেলো।ফুচকা চিবোতে গেলে প্রবলেম হবে আরাফাতের তাই সেটা আনলো না মাহা।তাদের সাথে লিসা নিসারাও খেয়েছে।সবাই অনেক আনন্দ ফুর্তি করলো এই সময়টাতে।কখন যে সন্ধ্যা নেমে এলো ধরনীর বুকে কেউ টেরই পেল না।আরাফাতও যথেষ্ট টায়ার্ড হয়ে গেছে।তাই সবাই বাসার উদ্দেশ্যে ফিরতি পথ ধরলো।

_____

রাত বাজে সাড়ে এগারোটা,
সবাই যার যার রুমে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।কেউ কেউ হয়তো ঘুমিয়েও গেছে।তেমনই আরাফাতও ঘুমিয়ে কাঁদা।সে ঘুমের ঘোরেই মাহাকে জড়িয়ে ধরে তার গলায় মুখ গুঁজেছে।মাহা আরাফাতকে দু’হাতে আগলে ধরে ডিম লাইটের আলোয় সিলিংয়ের ঘুর্নায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে।এসির বদলে ফ্যান ছেড়েছে সে,কারণ এসির চাইতে ফ্যানের বাতাস অনেক আরামদায়ক।

আরাফাত একটু নড়েচড়ে আবারও মাহাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছে।মাহা শুধু অনুভব করছে মুহূর্তটা।ভালোবাসার মানুষটা তার এত কাছে,তাও তাকে ছোঁয়া মানা।আরাফাত রাতে ঘুমের ঘোরে যতই তার কাছে আসুক না কেন ,মাহা তাকে এভোয়েড করে চলে।সে নিজে থেকে কখনো তাকে আদুরে স্পর্শ করতে যায় না।দূর থেকেও কিন্তু ভালোবাসা যায়।সাতপাঁচ অনেক কিছু ভাবতে ভাবতেই মাহা হারিয়ে গেল ঘুমের দেশে।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে