অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -১৩

0
1651

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১৩

সেদিনের পর কেটে গেছে আরও চারটি দিন,

জনাব এরশাদ মিসেস মুমতাহিনাকে ডাকছেন রাস্তার অপজিট সাইটে যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে যাওয়ার জন্য।মিসেস মুমতাহিনাও আসছি বলে রাস্তা পার হতে গেলেন।রাস্তায় প্রচুর গাড়িঘোড়া চলছে।সহজে পার হওয়ার কোনো কুদরতই নেই।তাও তিনি পার হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।হঠাৎ সুযোগ পেয়ে তিনি দ্রুতপদে হেঁটে পার হতে লাগলেন।কিন্তু তিনি খেয়াল করেন নি যে উল্টোদিক হতে দ্রুতগামী একটি যাত্রীবাহি বাস এগিয়ে আসছে।

বিপদ আসন্ন দেখে জনাব এরশাদ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন,তাকে যেন কেউ সম্মোহন করে ফেলেছে, নিজের কোনো জ্ঞানে নেই তিনি।এদিকে বাসটিও খুব দ্রুত মিসেস মুমতাহিনার কাছে এসে গেছে।আর একটু এগোলেই তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত।ইতিমধ্যে রাস্তার লোকজনও জড় হয়ে গেছে,সবাই চেঁচামেচি করছে ঠিকই কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না ওনাকে বাঁচাতে।জনাব এরশাদের হঠাৎ সৎবিৎ ফিরে আসতেই তিনি গলা ফাটিয়ে মুম বলে চিৎকার করে উঠলেন।

ততক্ষণে মিসেস মুমতাহিনাও সবকিছু টের পেয়ে গেছেন,কিন্তু তিনি আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাসের দিকে,সরার মতো শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই।বাসটিও ব্রেক কষার চেষ্টা করছে কিন্তু এই গতিকে এভাবে হুট করে থামানো পুরোপুরি অসম্ভব বলা চলে।শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি!

চোখের পলকে বাসটি এসে ওনাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল।কেউ কিছুই করতে পারলো না।এমন ঘটনায় দর্শকরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছে।মিসেস মুমতাহিনা গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছেন।মাথা থেঁতলে যাচ্ছেতাই অবস্থা।সারা রাস্তা জুড়ে টকটকে লাল রক্ত ভেসে যাচ্ছে।প্রাণপাখি ছটফট করছে দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য।প্রাণপ্রিয়া স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে মি.এরশাদ পাগলের মতো কেঁদে ফেললেন।তাঁর আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠলো।
_______________________

“আম্মুউউ”,,,

ধরফর করে ঘুম থেকে ওঠে বসলো আরাফাত।হাত যে ভাঙা তার তোয়াক্কাই করলো না সে।ফলস্বরূপ হাতে প্রচন্ড ব্যথা পেল।আরাফাতের এমন করায় ঠাস করে ঘুম ভেঙে গেছে মাহার।সেও দ্রুত উঠে বসলো।আরাফাত ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে পুরো।হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে।মাহা তড়িঘড়ি করে টেবিল ল্যাম্প অন করে এক গ্লাস পানি হাতে আরাফাতের নিকট এগিয়ে এসে তার মুখের সামনে পানি ধরে বললো,’রিল্যাক্স,পানি খাও,কিছু হয় নি তো!এই নাও পানি খাও!’

আরাফাতেরও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে অলরেডি।তাই তার সামনে গ্লাস ধরা মাত্রই ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানি এক শ্বাসে শেষ করে ফেললো সে।প্রচুর ভয় পেয়েছে আরাফাত।এখনও দুঃস্বপ্নের রেশটা চোখের পাতায় রয়ে গেছে তার।এটা কেমনতর বাজে স্বপ্ন?যেখানে সেও ঠিকই উপস্থিত ছিলো কিন্তু আত্মার মতো অস্পর্শনীয়!কেউ তার চিৎকার চেঁচামেচি ও আর্তনাদ শুনেনি।যেন তার হাত পা সব বেঁধে রেখেছিলো কোনো এক অদৃশ্য শক্তি!সে শুধু এই ভয়াবহ দৃশ্যটা স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করেছে,এতটাই বাস্তব ছিলো স্বপ্নটা যে এখনও ঘোর থেকে বেরোতে পারে নি আরাফাত।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো সে,’আম,আম…আম্মু ক,কোথ,কোথায়?আম..আম্মু!’

হাসফাঁস করে উঠলো সে।বুকের খাঁচায় হৃৎপিণ্ডটা প্রচন্ড রকমের লাফালাফি করছে যেন এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে!মাহা বুঝতে পারলো যে আরাফাত কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে মাকে নিয়ে।তবে তার মাথায় এটা এলো না যে আরাফাত কথা বলছে,যা তাদের জন্য অনেক বড় একটা গুডনিউজ।মাহা আরাফাতকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,’মামণি ঠিক আছে,তিনি তো তার রুমে ঘুমাচ্ছেন!’

আরাফাত হাতের ব্যথা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে।উত্তেজনা একটু কমতেই ব্যথাটা এখন ভালো মতো টের পাচ্ছে সে।সাথে গলায় প্রচন্ড রকমের ব্যথা করছে।মনে হচ্ছে গলার ভেতরটা ছুঁলে গেছে তার।একটা দুঃস্বপ্ন দেখেই তার মুখে বুলি ফুটে গেছে,যা সত্যিই মিরাকল!কারণ কণ্ঠনালিতে একটু সাময়িক প্রবলেম ছিলো।রাহাত বলেছিলো ঠিক হতে একটু সময় লাগতে পারে।আসলে,আল্লাহ চাইলে কী না সম্ভব!মানুষ মৃত্যুর পথ থেকেও বেঁচে ফিরতে পারে এক আল্লাহ তায়া’লার ইশারায়!

মাহা কোনোমতেই আরাফাতকে শান্ত করতে পারছে না।তাই বাধ্য হয়ে ফোন হাতে নিয়ে কল লাগালো মিসেস মুমতাহিনার মোবাইলে।সময় তখন মধ্যরাত!

কয়েকবার রিং হওয়ার পর মিসেস মুমতাহিনা ফোন রিসিভ করে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন,’হ্যালো!কে?’

মাহা বুঝতে পারলো যে তিনি ফোনের স্ক্রিন না দেখেই রিসিভ করেছেন।মাহা জবাব দিয়ে বললো,’মামণি,আমি মাহা বলছি!’

মিসেস মুমতাহিনার চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেল মনে হয় কথাটা শুনে।দ্রুত শোয়া থেকে ওঠে বসে ব্যগ্র হয়ে বললেন,’মাহা,তুই এত রাতে কল দিয়েছিস কেন?কোনো সমস্যা হয়েছে কী?আমার আরাফাত ঠিক আছে তো?’

একসাথে অনেকগুলো প্রশ্নের ধাক্কা সামলিয়ে মাহা জবাব দিলো,’আমাদের রুমে একবার আসতে পারবে মামণি?দরকার ছিলো একটু!’

মাহার কথা শুনে জবাব দিতে দেরী হলো না তাঁর।হড়বড়িয়ে বললেন,’এক্ষুনি আসছি আমি,দাঁড়া!’
ওনার কথা শুনে ততক্ষণে জনাব এরশাদেরও ঘুম ভেঙে গেছে।স্ত্রীর কথা অল্প কানে এসেছে তাঁর,মিসেস মুমতাহিনা ফোন কেটে বিছানা থেকে নেমে পায়ে চপ্পল পড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন তাড়াতাড়ি।জনাব এরশাদ কিছু জিজ্ঞেস করারই সুযোগ পেলেন না।তাই তিনিও কৌতুহল বশত শোয়া থেকে ওঠে বউয়ের পিছন পিছন ছুটলেন।

আরাফাত মোটেও শান্ত হচ্ছে না।শুধু আম্মু আম্মু করছে।মাহা এখনো আরাফাত যে কথা বলছে সে বিষয়টি ধরতে পারলো না।একমিনিটও মনে হয় পার হয় নি।তৎক্ষনাৎ দরজায় টকটক আওয়াজ পেল মাহা।মাহা তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে রুমের লাইট জ্বেলে তারপর দরজার লক ও ছিটকিনি খুলে দিয়ে দরজার কবাট মেলে মিসেস মুমতাহিনাকে ঢোকার সুযোগ করে দিলো।

মিসেস মুমতাহিনা ঝড়ের গতিতে রুমে ঢুকে বললেন,’কী হয়েছে মাহা?আমার আরাফাতের কী হয়েছে?’

মাহা চিন্তিত সুরে জবাব দিলো,’মামণি আরাফাত ভাইয়া তো তখন থেকে তোমায় খুঁজছে খালি।মোটেই শান্ত হচ্ছে না।মনে হয় তোমায় নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছে!’

মিসেস মুমতাহিনা দ্রুত বিছানার কাছে গিয়ে আরাফাতের সামনে বসলেন।মি.এরশাদও পিছন পিছন রুমের ভেতর এসে ঢুকেছেন।আরাফাত তার মাকে দেখতে পেয়েই ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।তিনি তো পুরাই অবাক।আরাফাত খুবই ক্ষীণ কন্ঠে আম্মু আম্মু বলে ডাকছে।আরাফাতের কথা শুনে ওনি পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।মাহার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে ওনি বললেন,’মাহা,শুনছিস!আমার ছেলে কথা বলছে!আমার ছেলে…!’

খুশিতে ওনার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।জনাব এরশাদের চোখ কপালে ওঠে গেছে আরাফাতের কন্ঠ শুনে।তিনি ভাবতেই পারেন নি যে তার ছেলে এত জলদি কথা বলতে পারবে।তিনি এগিয়ে আসলেন তাদের কাছে।তাকে দেখে মিসেস মুমতাহিনা খুশিতে চোখের জল ফেলে বললেন,’ওগো,শুনছো তুমি!আমার ছেলে কথা বলছে!আমাকে আম্মু বলে ডাকছে!’

মাহা তো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে।এতক্ষণ সে মোটেও তা খেয়াল করে নি।সে সব স্বাভাবিকই মনে করেছিলো।আরাফাত থরথর করে কাঁপছে।ব্যথায়,কষ্টে,ভয়ে সবকিছু মিলিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার ঘটেছে তার মন মস্তিষ্কে।জনাব এরশাদ এসে একপাশ থেকে আগলে ধরলেন আরাফাতকে।আরাফাত আস্তে ধীরে একটু স্বাভাবিক হলো ঠিকই কিন্তু মাকে ছাড়লো না।মিসেস মুমতাহিনা ছেলের সাথে নরম কন্ঠে কথা বলছেন।তাকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।জনাব এরশাদও তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আস্তে আস্তে।মাহা তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ আরাফাত হাতের ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠলো।তার মৃদু কন্ঠে আর্তনাদ শুনে তিনজনই ব্যস্ত হয়ে গেছেন।মাহা দ্রুত আরাফাতের হাতের বেল্ট টেবিলের ওপর থেকে নিয়ে এলো।তারপর তাদের একটু সরিয়ে দিয়ে রাহাত যেভাবে হাতে লাগিয়ে দেয়,সেভাবে লাগিয়ে দিলো।তবে তার আগে হাতে মলম মালিশ করতে ভুললো না।তারপর বক্স থেকে ব্যথার ঔষধ বের করে খাইয়ে দিলো সে।আরাফাত মায়ের বুকে মাথা রেখে তাঁকে একহাত দিয়ে যতটুকু জোরে জড়িয়ে ধরা সম্ভব ধরে বসে আছে চুপচাপ।আর কোনো কথা বলছে না সে।গলায়ও ব্যথা করছে তার।

মাহা আরাফাতের অবস্থা দেখে মিসেস মুমতাহিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,’মামণি আজকে আরাফাত ভাইয়ার সাথে তুমি থেকে যাও।আমি অন্য রুমে ঘুমাবো নে।আজকে ওনার অবস্থা যা দেখছি তাতে তুমি চলে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।’

মিসেস মুমতাহিনা চিন্তিত সুরে জবাব দিলেন,’হ্যা তাই তো দেখছি।ছেলেটা মনে হয় সাংঘাতিক কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে।যার জন্য কন্ঠ ফিরে এসেছে,নিজে থেকে ওঠেও বসে গেছে।যাক,আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন।আমার বাচ্চাটা আস্তে ধীরে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে।’

-‘হুম,তুমি আর বাবাই আজকের রাতটা ওনার সাথেই কাটিয়ে দাও তবে।কষ্ট হবে না তোমাদের, বিছানা অনেক বড় আছে ঘুমাতে পারবে তিনজন অনায়াসে।’

মাহার কথার বিপরীতে জনাব এরশাদ বলেন,’তা নাহয় বুঝলাম।কিন্তু তুই কোথায় থাকবি মা?একা রুমে থাকলে ভয় পাবি না?’

মাহা নিঃশব্দে হেসে জবাব দিলো,’আমি তোমাদের রুমে ঘুমাবো আজ।তোমরা এখানে থাকো।এখন মামণির এখানে থাকাটা অনেক জরুরি।আর হ্যা আমি একা ঘুমাতে পারি,ভয় পাই না।তোমরা চিন্তা করো না।থাকো আমি যাচ্ছি।’

-‘আচ্ছা মা তবে যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।আমরা আছি এখানে।কিছুর দরকার লাগলে বলিস।’

-‘ওকে মামণি।দরজা লক করে ঘুমিয়ে পড়ো।আমি যাচ্ছি।’এই বলে মাহা নিজের ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।সোজা গিয়ে তার মামণি বাবাইয়ের রুমের বিছানায় শুয়ে পড়লো।

মিসেস মুমতাহিনাও ছেলেকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিয়ে জনাব এরশাদকেও বললেন ঘুমিয়ে পড়তে।তিনিও স্ত্রীর কথামতোন একপাশে শুয়ে পড়লেন।মিসেস মুমতাহিনা আরাফাতকে একহাত দিয়ে আগলে ধরে রেখে চুপচাপ শুয়ে পড়লেন।আরাফাতও শান্ত ছেলের মতোন ঘুমিয়ে গেল।মাকে অক্ষত দেখে সে নিশ্চিত যে তার আম্মুর কিছু হয় নি।সে বুঝতে পারলো সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে।মগজের ধূসর কোষগুলো সব সতেজ হয়ে ওঠছে ধীরে ধীরে।এক্সিডেন্টের ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে সে।তবে লামিয়ার ধোঁকাবাজির প্লটটা মনে আসে না কেন জানি।তা কিছুটা ধোঁয়াশার মতো রয়ে গেছে।

ঘুমিয়ে গেছে সবাই নিশ্চিন্তে।আরাফাতও শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।আরাফাত ছোটবেলায় যেভাবে মা বাবার মাঝখানে ঘুমাতো আজও তেমনটা ঘুমাচ্ছে।বাবা মায়ের কাছে তার সন্তানরা কখনো বড় হয় না।আজীবন ছোটই থেকে যায়।মিসেস মুমতাহিনা ও জনাব এরশাদেরও কাছেও আরাফাত,সাইফ,লিসা,নিসা এখনো ছোট্টটি রয়েছে,বড় হয় নি।

_________

পরদিন ভোর ৫ টা বাজে প্রায়,
বাসার ছাদে একমনে হাঁটছে মাহা।নামাজ পড়েই সোজা ছাদে চলে এসেছে সে।বাসার সবাই এখনো বেদম ঘুমে ব্যস্ত।এই বাসার ছাদটা তার বাসার ছাদের মতো শৌখিন ভাবে সাজানো নয়।ছাদের এককোনায় বড় একটা ড্রামের মধ্যে মেহেদী গাছ তার ডালপালা মেলেছে।ছোটখাটো আরেকটা ড্রামে মনে হয় ইশানী টমেটোর খোসা টোসা ফেলেছে যার ফলে ওখানে একটা টমেটোর চারাগাছ গজিয়েছে।আর আরেকপ্রান্তে বড়ই গাছের একটা বিরাট প্রশ্বস্ত ডাল ছাদের মাটি ছুঁইছুঁই করছে।তাছাড়া আছে কাপড় রোদে শুকানোর কয়েকটি আড়াআড়িভাবে টাঙানো চিকন নাইলনের রশি।এসব ব্যতিত আর কিচ্ছুটি নেই ছাদে উপভোগ করার মতো।এজন্য এই খোলা ছাদটা তার তেমন একটা ভালো লাগে না।তাও এসেছে ভোরের অপরূপ প্রকৃতিকে একদম কাছ থেকে দেখতে।

মাহা বুঝতে পারছে,আরাফাত তাকে নিজ জীবনে এত সহজে মেনে নেবে না।তারপরও চেষ্টার কোনো কমতি রাখবে না সে আরাফাতের মনে জায়গা করে নেয়ার জন্য।এই চারটিদিন আরাফাতের যত্নের কোনো ত্রুটি রাখে নি মাহা।যখন যা করা প্রয়োজন তাই করেছে।ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে খাওয়ানো,শরীর মুছিয়ে দেয়া সব করেছে সে।বাসার সকলে তার ওপর খুশি,তাদের বাড়ির ছেলেকে মাহা যেভাবে ট্রিট করছে অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো এতটাও করতো না।আর আজ আরাফাতের দ্রুত সুস্থতার কারণে মাহা বেজায় খুশি।যাক,অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে তার,এটাই অনেক!

কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নিচে নেমে আসে সে।ততক্ষণে মিসেস মুমতাহিনা ও ইশানী ঘুম থেকে ওঠে গেছেন।মাহাকে দেখে মিসেস মুমতাহিনা বললেন নাশতা করতে।মাহাও বাধ্য মেয়ের মতো ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে ব্রেকফাস্ট করতে লাগলো।

জনাব এরশাদ ঘুম থেকে ওঠে নিজের রুমে চলে যেতেই মাহা ওই রুমে প্রবেশ করে আরাফাতের কাছে গিয়ে বসলো।আরাফাত এখনও ঘুমোচ্ছে।মাহা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।ইচ্ছে করে এই কিউট চেহারা খানায় হাজার খানেক চুমু খেতে,কিন্তু নাহ এখন নাহ।নিজেকে বহুত কষ্টে কন্ট্রোল করে মাহা আরাফাতের কপালে ও থুতনিতে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে সরে এলো।ততক্ষণে আরাফাতেরও ঘুম ভেঙে গেছে।চোখ পিটপিটিয়ে চাইলো সে।এদিক সেদিক চোখ বুলাতেই মাহার দিকে দৃষ্টি আটকালো তার।মাহাও তার মুখ পানে তাকিয়ে আছে।আরাফাত ভাঙা ভাঙা কন্ঠে মাহাকে জিজ্ঞেস করল,’তু..তুমি.. এখানে কী.. কর.?’

স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছে না আরাফাত।মুখে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।তারপরও মাহা বুঝতে পারলো আরাফাত ঠিক কী বলতে চাচ্ছে।সে আরাফাতের ভালো যে হাত সেটা নিজের দু’হাতের মধ্যে নিয়ে মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিলো,’৭ দিন পূর্বে আমাদের বিয়ে হয়েছিলো ভুলে গেছো?সেই জন্য আমি তোমার রুমে আছি তোমার বউ হিসেবে!’

আরাফাত যেন আকাশ থেকে পড়লো কথাটি শুনে।তার একটুও মনে আসছে না যে কোনদিন তার বিয়ে হয়েছে!আবছা আবছা চোখের সামনে ভাসছে শুধু মাহা বেনারসি শাড়ি পড়ে তার পাশে বসে ছিলো।তারমানে কী সেদিনই বিয়ে হয়ে গেছে?আরাফাত কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিলো,’আ..আমি মা.নি না!আমি তু তোমাকে বউ হিসেবে চা চাই না,চাই না!মিথ্যা সব!তু..তুমি আমায়..আমায়..’,,বাকি কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না সে।

আরাফাতের ক্ষীণ কন্ঠে বলা জড়ানো কথা গুলো তীরের বেগে আঘাত করলো মাহার মনে।তারপরও মুখ থেকে হাসি মুছলো না তার।বরং সেই হাসি আরও প্রশস্ত করে তাকে অভয় দিয়ে বললো,’রিল্যাক্স আরাফাত ভাইয়া!ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।আমি তোমার কাছ থেকে কোনোদিনও স্বামীর অধিকার চাইবো না,এই বিশ্বাস তুমি আমার ওপর রাখতে পারো।তোমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিয়েছি আমি,এটলিস্ট সেই দায়িত্বটা তুমি আমাকে সুষ্ঠু ভাবে পালন করতে দাও!ট্রাস্ট মি তুমি সুস্থ হয়ে গেলে আমি আমার বাসায় চলে যাবো।তারপর সোজা এই দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া!ব্যস!আমাকে স্ত্রী হিসেবে তোমার কষ্ট করে মেনে নিতে হবে না।আমি শুধু কিছুদিনের অতিথি মাত্র তোমাদের বাসায়।আশা করি বুঝতে পেরেছো!’

মাহার কথা অনুধাবন করতে পেরে আরাফাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।সে মোটেও মাহাকে নিজের স্ত্রী রূপে মেনে নিতে পারবে না।এটা জাস্ট ইম্পসিবল!ফিসফিস কন্ঠে বললো আরাফাত,’তাহলে,ঠিক আছে!’

মাহা কতটা কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলেছে তা একমাত্র সে এবং স্বয়ং আল্লাহ জানেন।আরাফাত সেই কষ্ট কখনোই বুঝতে পারবে না।আর মাহা চায়ও না সে বুঝুক।ভালোবাসা মানেই ভালোবাসার মানুষকে জোর করে পেতে চাওয়া নয়,যদিও সে চাইছিলো।কিন্তু এখন খুব ভালো করে বুঝতে পারলো যে, সে যাকে ভালোবাসে তার মনে নিজের জন্য বিন্দুমাত্র কোনো অনুভূতি নেই।একতরফা ভালোবাসা কখনোই সফল হয় না আজ তা হারে হারে টের পেল মাহা।প্রথমে আরাফাতকে জোর করে ছিনিয়ে নেয়ার চিন্তা থাকলেও এখন সেটা গায়েব হয়ে গেছে।মনে মনে চিন্তা করলো আরাফাতকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলে হাইয়ার স্টাডি কমপ্লিট করার জন্য বিদেশ চলে যাবে সে।

সমস্ত চিন্তাভাবনা একপাশে রেখে মাহা আরাফাতকে ধরে ধরে তোলে বসালো।আরাফাতও স্বাভাবিক ভাবে তার সাহায্য গ্রহণ করছে।তারপর তাকে নিয়ে ওয়াশরুমে গেল মাহা।আরাফাত এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।একটা দুঃস্বপ্নই ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে।

মাহা আরাফাতের দাঁত ব্রাশ করে দিচ্ছে সযত্নে।তারপর ভালোভাবে মুখটা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিলো।ওয়াশরুমের কাজ সম্পন্ন করে তাকে শক্ত হাতে ধরে ধরে হুইলচেয়ারের ওপর বসিয়ে দিলো সে।তারপর যত্নসহকারে তোয়ালে দিয়ে আলতো ভাবে মুখটা মুছিয়ে দিয়ে কপালের ক্ষত জায়গায় মলম লাগিয়ে দিলো।ক্ষত প্রায় শুকিয়ে গেছে,এখন শুধু দাগগুলো মিশে যাওয়ার জন্য ইউজ করতে হয়।আরাফাত চুপচাপ বসে আছে,কিছু বলছে না।

মাহা আরাফাতকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই সাইফ,লিসা,নিসা ইশানী সকলে তাকে ঘেরাও করে ফেললো।লিসা নিসা তো খুশিতে বাক বাকুম করছে তাদের ভাই কথা বলছে দেখে।আরাফাতও তাদের সাথে হাসছে,ক্ষীণ স্বরে কথা বলছে।তাদের সবার মধ্যেই খুশির মেলা বয়ে যাচ্ছে।মাহা তাদের সবার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে আছে।মিসেস মুমতাহিনা মাহার হাতে আরাফাতের নাশতার প্লেট তুলে দিয়ে আবারও রান্নাঘরে চলে গেছেন।মাহা একপাশে বসে চুপচাপ খাইয়ে দিচ্ছে তাকে।আরাফাতও বিনাবাক্য ব্যয়ে টপাটপ মুখে পুরে নিচ্ছে।

আজকে রাহাত আসবে বলেছে সাইফকে।আরাফাতের সুস্থতার অগ্রগতির খবর তার কাছেও পৌঁছে দিয়েছে সাইফ।জনাব আতিকও মনে হয় আসবেন সাথে।রাহাতের মূলত আরাফাতকে চেক-আপ করার জন্যই আসতে হবে।কারণ আরাফাতের সমস্ত মেডিকেল হিস্ট্রি তার কাছেই আছে।
_____________

দুপুরের পর পরই রাহাত হসপিটাল থেকে সোজা আরাফাতদের বাসায় এসে হাজির।জনাব আতিক আরও আগে এসেছেন।রাহাত হাসিমুখে আরাফাতের সাথে কথা বলছে,সাথে চেক-আপ ও করছে।রাহাত বলেছে পুরোপুরি সাবলীলভাবে কথা বলতে আরেকটু সময়ের প্রয়োজন।তাও ভালো জলদি জলদি রিকোভার করছে সে।

মাহা একদম নিরব হয়ে গেছে।আগে যেমন চইচই করতো এখন তা আর করছে না।অবচেতন মনে এই চিন্তাটা খুব গাঢ় করে বসে গেছে তার,যে এই জীবনে আরাফাত তার হবে না।আর আরাফাতের মতের বাইরে সে তার স্ত্রী হয়েও থাকতে চায় না,কারণ যত যাইহোক না কেন,মাহার আত্মসম্মান খুব বেশি।আত্মসম্মানের বাইরে গিয়ে বেহায়ার মতো কিছু করতে চায় না সে
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে