অন্যরকম অনুভূতি পর্ব-১৭

0
1813

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১৭

পরদিন,
একটু পর দুপুর হয়ে যাবে।সকালের নাশতা অনেক আগেই সম্পন্ন করে ফেলেছে দুজন।মাহা তার বাবা মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছে।আরাফাত তো মাহা যেখানে সেও সেখানে সর্বদা।মাহাও তাকে একা ছেড়ে কোথাও যায় না।কবুতরের জোড়ার মতো একসাথেই থাকে দুজন।

আরাফাত এককালে খুবই কাজপাগল একটা ছেলে ছিলো।কিন্তু যেই তার জীবনে লামিয়া নামক রাক্ষসীর আগমন ঘটলো তখন থেকেই তার কাজটাজ থেকে মন ওঠে গেছে।বাধ্য হয়ে একপ্রকার অফিসের কাজগুলো করতো।আর ব্যবসায় তো চলছিলো যেমন তেমন।এখন অবশ্য এক্সিডেন্ট করায় বাসায় থাকতে হচ্ছে নয়তো কাজকর্ম আর পেন্ডিংয়ে রাখতো না।

মাহা সারা রুম জুড়ে পায়চারি করে করে কথা বলছে।আর আরাফাত গালে হাত রেখে চুপচাপ বসে মাহার গতিবিধি লক্ষ্য করছে।

‘কালকে আসো না সবাই আম্মু!অনেকদিন হলো তোমাদের দেখি না।’

ওপাশ থেকে মাহার কথার কি জবাব দিলেন মিসেস মিনারা, তা শুনতে পেল না আরাফাত।

‘ওহহ,আচ্ছা দেখো অদ্য আসতে পারো কী না!আসার সময় আনুকেও নিয়ে আসবা।এই বলদটা আমায় দেখতে আসে না এখন,অথচ আগে পদে পদে বাসায় আসতো।’

ওপাশ থেকে কী বললেন শোনা গেল না।সবশেষে মাহা কথার উপসংহার টেনে বললো,’আচ্ছা আম্মু,তাহলে এখন রাখছি আমি।পরে কথা বলবো।হুম,রাখি।’

আরাফাত ব্যঙ্গ করে জোরে একটা শ্বাস ফেলে বললো,’ওউফ,অবশেষে মহারাণীর ফোনে কথা বলার সমাপ্তি ঘটলো।’

মাহা ভ্রুকুটি করে তাকালো আরাফাতের দিকে।ফোন চার্জে লাগিয়ে দিয়ে বললো,’কেন?আমার ফোনে কথা বলার সাথে তোমার কী সম্পর্ক?’

‘না নাহ,কিছু না।এমনি বললাম আরকি।এখন আমাকে গোসল করতে একটু সাহায্য করো প্লিজ।শরীর চটচটে হয়ে গেছে ঘামে।’

‘ওয়েট,আমি তোমার কাপড় গুলো নিয়ে নিই তারপর তোমায় ওয়াশরুমে নিয়ে যাচ্ছি।’

খানিকক্ষণ পরে মাহা আরাফাতকে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল গোসল করাতে।আরাফাতকে গোসল করিয়ে সেও গোসল করে আসবে।মাহা জানতেও পারলো না তার কাপড়ে আগে থেকে সুযোগসমেত কুকাজ করে রেখেছে লিপি।

আরাফাতকে গোসল করানো শেষে তাকে রুমে রেখে সে আবারও সেখানে ঢুকলো।শরীরে পানি ঢালা সম্পন্ন করে যেই না কাপড় হাতে নিলো পড়ার জন্য ঠিক তখনই তার নাকে অদ্ভুত একটা গন্ধ এসে ধাক্কা মারলো কাপড় থেকে।সাথে যে হাত দিয়ে ধরেছে সেই স্থানে হালকা চুলকানি অনুভব হলো।মাহার অতি বুদ্ধিমান সতর্ক মস্তিষ্ক বিষয়টা ধরে ফেলতে বেশি সময় নিলো না।ঠিকই বুঝে গিয়েছে যে তার কাপড়ে চুলকানির পাউডার বা স্প্রে এমন কিছু দেয়া হয়েছে যাতে সে পড়ামাত্রই শরীরে চুলকানি শুরু হয়ে যায়।আর এই কাজটা কে করেছে তাও তৎক্ষনাৎ এক লহমায় বুঝে গেছে মাহা।

এজন্যই মাহা যখন আরাফাতকে নিয়ে নাশতা করতে ডাইনিং এ গিয়েছিল তখন লিপিকে দেখতে পায় নি যা অত্যন্ত সন্দেহজনক ছিলো।নয়তো অন্যদিন আরাফাতকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে দিতো।
মাহা খুবই সাবধানে কাপড় গুলো তোয়ালেসহ বালতিতে ভিজিয়ে রাখলো।অতঃপর আগের ব্যবহৃত জামার আধভেজা ওড়নাটা শুধু শরীরে শাড়ির মতো জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আরাফাত হা করে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে।সে নিজের চোখ সরাতে ভুলে গেছে যেন।মাহা লক্ষ্য করলো সেটা।কিন্তু কিছুই বললো না।কিছু বলার মতো মোডে নেই ও আপাতত।মেজাজটা অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো হয়ে আছে বর্তমানে,কিছু বলতে গেলেই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত শুরু হবে।মাহা ভেতরে ভেতরে লিপিকে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কোপাচ্ছে।এই মেয়েকে সে এমন শিক্ষা দিবে,এমন শিক্ষা দিবে যে নাকের পানি চোখের পানি মিশে একাকার হয়ে যাবে কেঁদে কেটেও কোনো কুল পাবে না।লিপি চুলকানির ঔষধ দিয়েছে,মাহা তাকে বিছুটি পাতা দিয়ে ভাঁজবে।তখন খবিশটা বুঝতে পারবে মাহার সাথে লাগতে আসার ফল ঠিক কতোটা ভয়াবহ হতে পারে।

ভেতরে মহাপ্রলয় সংঘটিত হলেও মাহা বাহিরে খুবই শান্ত হয়ে আছে,খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওয়ারড্রব থেকে নতুন একসেট সেলোয়ার-কামিজ বের করে আবারও ওয়াশরুমে গিয়ে পরিধান করে এলো।আর এদিকে আরাফাত এখনও স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে।মাহাকে ভেজা শরীরে খালি ওড়নায় দেখে তার মাথা হ্যাং হয়ে গেছে পুরোপুরি।এই প্রথম সে মাহাকে এত আবেদনময়ী রূপে দেখতে পেল।আরাফাত গোসল করেও আবার ঘেমে জবজবে হয়ে গেছে।আজ প্রথম আরাফাতের মনে এমন চিন্তার উদয় হলো যে,”হানিকে একটাদিন খুব কাছে পেলে মন্দ হয় না।মন ভরে আদর করতে পারবো।” অতঃপর নিজের এমন লেইম চিন্তায় নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো।শ’খানেক গালি দিলো এই বেয়ারা মনটাকে।

মাহা আরাফাতের চোখের সামনে এসে দু’আঙ্গুল দিয়ে চুটকি বাজালো।চুটকির শব্দে আরাফাতের ধ্যান ভাঙে।হকচকিয়ে তাকায় সে মাহার দিকে।মাহা এক ভুরু উপরে তুলে বললো,’কী এমন চিন্তা করছো?’

‘ন,নাহ কিছু না!’ আমতা আমতা করে জবাব দেয় আরাফাত।বেচারা এখন মাহার পানে চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা পাচ্ছে।মনে হচ্ছে মাহা তার মনের অদ্ভুত চিন্তাভাবনাগুলো বুঝে ফেলবে সহসা।যদিও তার ভয়টা অহেতুক,মাহা এমনকিছুই ভাবছে না।সে বিপদে পড়ে এভাবে বেরিয়ে এসেছে কারণ আরাফাতকে বললে সে চাইলেও উঠে গিয়ে তাকে আলমারি থেকে কাপড় এনে দিতে পারবে না।

মাহা আরাফাতের শরীরে ডক্টরের সাজেস্ট করা লোশন মাখিয়ে দিতে লাগলো।মাহার মুখ ভেজাই রয়ে গেছে,ফোঁটা ফোঁটা পানি গালে, কপালে, চোখের পাপড়িতে, থুতনিতে, গলায় লেপ্টে রয়েছে যা দেখে আরাফাত ফাঁকা ঢোক গিললো।তার খুব ইচ্ছে করছে এই ভেজা প্রস্ফুটিত ফুলের ন্যায় গাল ও ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিতে।এত আকর্ষণ অনুভব করছে কেন?মেয়ে তো নয় যেন আস্ত একটা চুম্বক।শুধু তার নিজের দিকে টানছে চুম্বকপাথরের ন্যায়।

একপ্রকার ঘোরের মধ্যেই আরাফাত মাহার কোমড় জড়িয়ে ধরে।মাহা হকচকিয়ে গেল হঠাৎ এমন করায়।আচমকা আরাফাত মাহাকে একহাতে টেনে এনে বিছানার ওপর ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিলো।ধপ করে চিৎ হয়ে বিছানার ওপর পড়লো মাহা।কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেল তার ঠোঁট জোড়ার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে কেউ।সেই কেউটা আর কেউ নয়,আরাফাত।মাহা জীবনের প্রথম এমনতর স্পর্শ পেয়ে জমে বরফ হয়ে গেছে।তার কেমন রিয়েক্ট করা উচিৎ বুঝতে পারছে না সে।আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো মাহা।দুজনেই এখন অন্য জগতে বিচরণ করছে।আরাফাত মাহাকে কাছে পেয়ে তার মনে হচ্ছে সে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিদের পেয়ে গেছে।এই মুহূর্তটা এত মধুর কেন মনে হচ্ছে?দুজনের কাছেই এমন আনকোরা অনুভূতি একদম প্রথম।

এদিকে, শয়তানী হাসি হেসে লিপি আরাফাতের রুমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে,ওই ড্রেস পরে মাহা কীরকম নাচাকোঁদা করছে তা দেখার লোভ সামলাতে পারে নি সে।এতক্ষণে হয়তো চুলকাতে-চুলকাতে পাগল হয়ে গেছে মাহা।এসব ভেবেই মনে মনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে লিপি।চুপিচুপি আরাফাতের রুমের দরজার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো,রুমের দরজা লক নয় ভিড়িয়ে রাখা ছিলো।

লিপি খুবই সন্তর্পণে দরজা হালকা মেলে দরজার কবাটের ফাঁকে চোখ রাখলো মাহাকে দেখার জন্যে।তবে যেটা আশা করেছিলো সেটা না দেখে চোখে পড়লো কিছু অপ্রীতিকর দৃশ্য।যা দেখে সে আহাম্মক বনে গেছে পুরো।মাহার যে পোষাকে সে চুলকানি পাউডার লাগিয়ে রেখেছিলো আজ মাহা সেটা পড়েই নি।ইশশ ভুল হয়েছে,সবগুলোতে লাগিয়ে রাখা দরকার ছিল।তবেই এখন প্ল্যানটা সাকসেসফুল হতো।

প্ল্যান মাঠে মারা গেছে দেখে লিপি রাগে ফাটতে ফাটতে মনে হচ্ছে ব্লাস্টই হয়ে যাবে।আবার ওদের রোমান্স দেখে মাথায় আগুন ধরে গেছে লিপির।যা চাইছিলো সেসব কিছু তো হলোই না উল্টো তাদেরকে এত ক্লোজ দেখে লিপির মেজাজ বিগড়ে গেল।রাগের চোটে গটগট শব্দে হেঁটে এখান থেকে প্রস্থান করলো সে।
_________

আরাফাত মাহার ঠোঁটজোড়া ছেড়ে গালে,থুতনিতে,গলায় চুমুর বন্যা বইয়ে দিচ্ছে।মাহা আরাফাতের মাথার চুল আঁকড়ে ধরে হাসফাঁস করছে খালি।শরীরে আলাদা এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার বারেবারে।কাঁপুনি ওঠে গেছে প্রায়।তাও আরাফাতের ছাড়ার নাম নেই।আরাফাত আজ মাহার নেশায় বুদ হয়ে গেছে পুরোপুরি।

মাহা আরাফাতকে নিজের থেকে সরানোর জন্য বুদ্ধি করে বললো,’তুমি না আমাকে স্ত্রী হিসেবে চাও না, তবে আজ আমার সতিত্বে হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছো কেন?ছেড়ে দাও আমায়,ক’দিন পর তুমি সুস্থ হলে চলে যাবো তোমার বাসা থেকে,তোমার জীবন থেকে।এখন আমাকে এভাবে দূর্বল করে ফেলো না প্লিজ!পরে আমার একা থাকতে ভীষণ কষ্ট হবে!’

মাহার কন্ঠে কিছু তো একটা ছিলো যা আরাফাতকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।আরাফাত থমকে গেল যেন।অপলক তাকিয়ে রইলো মাহার ওই কুচকুচে কালো মণিওয়ালা চোখের দিকে।ছেড়ে যাওয়ার কথা বলতেই মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল তার।তাই জেদের বশে আবারও মাহার ভেজা ঠোঁটের ভাঁজে স্বীয় ঠোঁট জোড়া মিলিয়ে দিলো।

মিনিট দুয়েক পর ছেড়ে দিয়ে বললো,’সরি,আর ছুঁবো না তোমায়।আমি আসলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি।সরি,ক্ষমা করো আমায়!’
এই বলে আরাফাত ভালো হাতে ভর দিয়ে কোনোমতে ওঠে বসলো।মাহা ঘনঘন শ্বাস নিয়ে কয়েক মুহূর্ত পর ওঠে বসলো।দুজন পাশাপাশি বসে আছে,কিন্তু কারও মুখে কোনো রা নেই।মাহা নিজেকে সামলালো।নিচু কন্ঠে বললো,’তোমার ভাত খাওয়ার সময় হয়ে গেছে প্রায়।ডাইনিং এ চলো খেতে হবে।’

‘হুম!’

মাহা আরাফাতকে ক্রাচ এনে দিলে আরাফাত তাতে ভর দিয়ে ওঠে দাঁড়ালো।এখন আর হুইলচেয়ারের প্রয়োজন হয় না তার,ক্রাচে ভর করেই প্রায় একা চলাফেরা করতে পারে।তবুও মাহা চোখে চোখে রাখে।যদি পড়ে যায়!এই ভয়েতে।

লিপি গোমড়া মুখে বসে বসে ফোন টিপছে।লিসা নিসা সোফায় বসে পরম উৎসাহে মডেলিংয়ের ম্যাগাজিন ঘাটছে।আজকে আরাফাতের পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করছেন মিসেস মুমতাহিনা।বিরিয়ানির সুগন্ধে সারা বাড়ি মঁ মঁ করছে।আরাফাত যেদিন এক্সিডেন্ট করে সেদিনও তিনি বানিয়েছিলেন,কিন্তু ওই বিরিয়ানি কারও মুখে রুচে নি।

মাহা আরাফাতকে সোফায় বসিয়ে দিয়েছে।আজ সবাই লিভিং রুমেই লাঞ্চ সারবে।রবি মাহার দিকে বিমোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তা দেখে আরাফাত জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।রবি কেন তার বউকে দেখবে?এটা সে মোটেও সহ্য করতে পারছে না।

এদিকে লিপি হাল ছাড়ে নাই।সে আরাফাতের পাশে এসে বসে তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টায় মত্ত।

মাহা আড়ালে লিপির দিকে তাকিয়ে শয়তানী হাসি দিয়ে তার কোকাকোলার ক্যানে কয়েকটা ট্যাবলেট গুঁড়া করে মিশিয়ে দিয়েছে।জনাব এরশাদের কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ আছে,তো ওনার কোষ্ঠ পরিষ্কার করার জন্য আলাদা সিরাপ আর ট্যাবলেটও আছে।মাহা সেখান থেকেই গুনে গুনে ৪ টা ট্যাবলেট নিয়ে এসেছে লিপিকে খাওয়ানোর জন্য।এসব ট্যাবলেট একটা অথবা দুইটা খেলেই কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীর কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়ে যায়,সেখানে সুস্থ একজন মানুষের একটা খেলেই তো হালুয়া টাইট হয়ে যাওয়ার কথা।আজকে খেলা হবে,লিপির অবস্থা টাইট করে দিলেই শান্তি মিলবে মনে।হারামজাদির একটা শিক্ষা হবে।

মাহা সবার জন্য কোকাকোলার ক্যান নিয়ে এসেছে ট্রে তে করে।লিপিরটা আলাদা চিহ্ন দেয়া আছে।সবারটার ক্যানই ক্যান ওপেনার দিয়ে খুলে দিয়েছে মাহা তাই সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।মাহা ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে সবার সামনে একটা একটা করে ক্যান রাখলো।জেনি আর ইশানী একটা একটা করে বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে আসছে ডাইনিং রুমের টেবিল থেকে।মাহা আরাফাত আর নিজের জন্য একটা প্লেট নিয়েছে।

লিপি গোগ্রাসে গিলছে।সাথে একটু পর পর কোকের ক্যানে চুমুক বসাচ্ছে।মাহা শয়তানী মার্কা এক হাসি দিলো।আজকে লিপির হবে রে!রবি বারেবারে মাহার দিকে তাকাচ্ছে দেখে আরাফাত একহাত দিয়ে মাহার ওড়না ভালো করে মেলে সারাশরীরসহ মাথা ঢেকে দিলো।মাহা আজকে শুধু অবাকই হচ্ছে আরাফাতের এসব হঠাৎ হঠাৎ কাজ দেখে।কী জানি কী চলছে তার মনে!

আরাফাত মাহাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যাতে রবি তাকে ভালো মতো দেখতেই না পায়।বেচারা রবি আর সুযোগই পেল না মাহাকে দেখার।লিপি আরাফাতকে বারবার বিরক্ত করছে এটাসেটা বলে।আরাফাত অতিষ্ঠ হয়ে গেছে পুরো।সে মাহার কোমড় একপাশ থেকে শক্ত করে ধরে রাখলো।মাহা কিছুই বলছে না,সে অপেক্ষায় আছে লিপির পরবর্তী রিয়াকশন দেখার জন্য।কত সময় আর বিরক্ত করবে?বড়জোর আধাঘণ্টা।হাহা!

সবাই টুকটাক গল্প গুজব করে কোকের সাথে বিরিয়ানি খাচ্ছে।সাথে আছে গরুর মাংসের কালাভুনা,সালাদ,ডিম ও মুরগির রোস্ট।জনাব এরশাদও চলে এসেছেন ততক্ষণে।সবাই মিলে একসাথে জম্পেশ একটা আড্ডা দিয়ে দুপুরের খাবার সারলেন।

হাত ধুয়ে এসে বসেও সারতে পারলো না লিপি ঠিকমতো, তার পেটে হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠলো।এমন মোচড় মেরেছে যে এক্ষুনি বাথরুমে না গেলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।সে এক্সকিউজ মি বলে দ্রুত লিভিং রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

‘খেলাটা তো তুই শুরু করেছিস তাই না?এর শেষ আমিই করবো!ওকে বাই বাবুটা,হ্যাপি বাথরুমিং!’
মনে মনে কথাগুলো বলে পৈশাচিক এক হাসি দিলো মাহা।আজকেই যদি শিক্ষা হয়ে যায় তবে খেল খতম।নয়তো এই মাহা কী চিজ তা সে পরবর্তীতে হারে হারে টের পাবে।

মাহা আরাফাতকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।আসার আগে নিজেদের রুম লক করে এসেছে সেইফটির জন্য।যদিও মাহা অহেতুক সতর্কতা অবলম্বন করেছে,লিপি এখন কিছু করার মতো অবস্থায় নেই।সে একনাগাড়ে রুম আর ওয়াশরুম করতে করতে হাঁপিয়ে গেছে পুরোপুরি।আজকে আরাফাতকে হাতে পায়ের ব্যায়াম করাবে মাহা।রাহাত ফোন করে মাহাকে ব্যায়ামের কথা বলে দিয়েছিলো অনেক আগে।সেজন্যই কয়েকদিন পর পর তাকে ব্যায়াম করায় সে।

আরাফাত ক্রাচ ছাড়া মাহার কাঁধে ভর দিয়ে ভাঙা পা দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে।পা মাটিতে লাগাতে পারে ঠিকই কিন্তু ভর দিতে পারে না।ভর দিলেই হাড্ডিতে মনে হয় খিচ ধরে যায়।তারপরও মাহার চেষ্টায় আজকে অনেকটা হাঁটতে পারলো।আরাফাতের মনে সুস্থ হওয়ার এক অদম্য মনোবল সৃষ্টি হয়েছে।মাহা তাকে বারবার উৎসাহ দেয়,সবসময় একটা কথাই বলে,”ডোন্ট লুস ইউর হোপ!” ‘থেমো না বরং চেষ্টা চালিয়ে যাও, তবেই তুমি খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে।’

মাহা তাকে প্রায় দু ঘন্টার মতো শুধু ব্যায়ামই করালো।ডক্টরের বোন বলে কথা,এসব কাজে সে খুবই পারদর্শী।ব্যায়াম শেষে আরাফাতের হাতে পায়ে ভাঙা স্থানে ডক্টরের সাজেস্ট করা তৈল মালিশ করে দিলো সে।এটা হাড্ডি জোড়া লাগতে সাহায্য করবে।

সূর্য ততক্ষণে পূর্ব দিক প্রদক্ষিণ করে পশ্চিম দিকে চলে গেছে।দুপুরের শেষ ভাগ এখন।সোনারোদের আলোয় ঝকমক করছে চারপাশ।সাথে বইছে উথাল-পাতাল হাওয়া।পরিবেশটা খুবই সুন্দর আর মনোরম।বেশ ভাল্লাগছে আরাফাতের এখানে থাকতে।এমনসময় রবিও এখানে এসে উপস্থিত।

‘কী করছেন মাহা?’ হাসিমুখে প্রশ্ন করলো রবি।
মাহা জবাব দেয়ার আগেই আরাফাত বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে বললো,’রবি মাহা তোমার ভাবী হয়!তাই রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলো!ওকে নাম ধরে না ডেকে ভাবী বলে ডাকবে,বুঝেছো?’

রবি বিরসবদনে জবাব দিলো,’জ্বী ভাইয়া বুঝেছি।’

‘গুড!’
আরাফাত মাহার সাথে কথা বলতে লাগলো।এ কথা সেকথা দ্বারা মাহাকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে সে যাতে রবি মাহার সাথে কথা বলার কোনো স্কোপই না পায়।আরাফাত নিজের এহেন পরিবর্তনে প্রচন্ড অবাক।সে ভাবেও নি কখনো মাহার প্রতি তার কোনো অনুভূতি সৃষ্টি হবে।লামিয়ার কথা এখন আর মনে আসে না বললেই চলে।ভুলেই গেছে প্রায় এমন ফালতু অতীতের কথা।
________

রাত ৭ টা বাজে,
আরাফাত বিছানার ওপর বসে বসে ল্যাপটপের মাধ্যমে কাজ করছে।বিগত দিনগুলোর ব্যবসায়ের সব ডকুমেন্টস ঘেটে ঘেটে দেখছে সে মনযোগ সহকারে।আর পাশেই মাহা কানে ইয়ারকড লাগিয়ে গান শুনছে।মনে আনন্দের ঢেউ তা তা তৈ তৈ করে নাচছে তার।একটু আগে লিসা জানিয়ে গেল যে লিপির ডায়রিয়া হয়ে গেছে।বেচারি বাথরুমে আর রুমে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে শহীদ।হাগতে হাগতে জীবন যায় তার।লিসা যাওয়ার পর মাহা হাসতে হাসতে শেষ।ভাগ্যিস আরাফাত তাকে হাসতে দেখে নি,নয়তো শুধু প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করতো।যাক,উচিৎ শিক্ষা হয়েছে বেয়াদবটার।লাজ-শরম বলে কিছু থাকলে আর জীবনেও এমন বেয়াদবী দেখাতে আসবে না।
____________

মিসেস মুমতাহিনা লিপিকে সেলাইন গুলে খাইয়েছেন কয়েকদফা।রবি ফার্মেসী থেকে ঔষধ কিনে নিয়ে এসেছে তার জন্য।এতকিছু খাওয়ার পরও লিপি খালি বাথরুমে যাচ্ছে।কাজ করছে না কোনো ঔষধেই।পেট একদম খালি তাও একটু পর পরই বাথরুমে দৌড়াচ্ছে।মিসেস মুমতাহিনা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন অনেক।ভাবছেন মেয়েটা কী এমন খেলো যে এই অবস্থা হয়েছে!লিপির চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।পুরোপুরি বিধ্বস্ত লাগছে তাকে দেখতে।

রবি সাইফের পরামর্শে আবারও ফার্মেসীতে গিয়ে কড়া ডোজের ঔষধ কিনে নিয়ে এলো।ডায়রিয়ার জন্য হাই পাওয়ারের ঔষধগুলো এনে লিপিকে খাওয়ানো হলো।
রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে ততক্ষণে।এরপর একটু রিলিফ পেল লিপি।মিসেস মুমতাহিনা দু নলা ভাত খাওয়াতে পারলেন তাকে কোনোমতে।এরপর বেশি ক্লান্ত থাকায় সে ঘুমিয়ে পড়লো।

মাহা একবার এসে দেখে গেছে লিপিকে।কিছুক্ষণ আফসোস করে সে আবারও নিজের রুমে চলে গেল।আজকে রুমে বসেই আরাফাত ও মাহা রাতের খাবার সম্পন্ন করেছে।
________

বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে মাহা।আর আরাফাত মাহার গলায় মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে গেছে।আরাফাতের কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে তাকে দু’হাতে আগলে রাখলো নিজের সাথে।প্রায় ফিসফিস কন্ঠে বললো,
“ভালোবাসি,আমার অনুভূতির সঞ্চারককে।অনেক ভালোবাসি!”
ঘুমের মধ্যেই আরাফাত মুচকে হাসলো যেন।সুখস্বপ্নে বিভোর সে।মাহার ফিসফিসিয়ে বলা কথাটা কানে যায় নি তার।তবে দুজনের মনের মধ্যে এক আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।এই অনুভূতি গুলো আমরণ থেকে যাবে।ফুরিয়ে যাবে না কখনো!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে