অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -১৮

0
1915

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১৮

লিপি গুনে গুনে তিন দিন পর প্রায় সুস্থ হয়েছে।ওর অবস্থা এতটাই বেগতিক ছিলো।মিসেস মুমতাহিনা তাকে পরদিনই হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ডক্টর দেখিয়ে এসেছেন।তারপর ডক্টরের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক ঔষধ খেয়ে অতঃপর আজ মোটামুটি সুস্থ সে।তবে তার শরীর ভীষণ দূর্বল রয়ে গেছে।

মাহা বিন্দাস আছে।শত্রুকে অপদস্ত করতে পেরে সে বেজায় খুশি।বেচারির এমন হাল করেছে মাহা যে বেশ কয়েকদিন আর জ্বালাতন করতে পারবে না।শান্তি আর শান্তি!

এই তিনদিনে আরাফাতের হাতেপায়ের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন না ঘটলেও এতদিনে বেশ ভালোই উন্নতি হয়েছে।একটা ক্রাচে ভর করে একা একাই চলাফেরা করতে পারে সে।আগে যেমন মাটিতে পা রাখলে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতো এখন তা এতোটাও হয় না।আর একটা মাস পুরো রেস্টে থাকলে হয়তো পুরোপুরি ভালো হয়ে যেতে পারে।তবে পুরোপুরি রূপে সুস্থ হয়ে গেলেও ভবিষ্যতে এই ভাঙা হাত পায়ে কখনো চাপ পড়লে বিপাকে পড়তে হবে।বেশি ভারী কাজ করতে গেলে বা অতিরিক্ত হাঁটতে গেলে ভাঙা স্থানের জোড়া ছুটে যেতে পারে।এমনটাই বলেছে রাহাত।

এদিকে,ধীরে ধীরে আরাফাত মাহাসক্ত হয়ে পড়ছে।এখন এতোটাই আসক্তি জন্মে গেছে যে মাহাকে একপলক না দেখলে সে অস্থির হয়ে যায়।মাহার শরীরের মিষ্টি নোনতা স্মেলে মিশে থাকতে মন চায়।যেকোনো বাহানায় হোক মাহাকে কাছে চাই তার।মনটা শুধু হানি হানি করে!
ইশশ,এই ভেঙে যাওয়া উদাসীন মনটা এখন বড্ড আওয়ারা হয়ে গেছে!নতুন বসন্তের আগমন ঘটেছে হৃদয়ে!
__________

-‘দেখি হা করো!ভাত খেয়ে ঔষধ খেতে হবে তো!’
মাহার জোরাজুরিতে হা করলো আরাফাত।তার আজ কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু মাহা তো নাছোড়বান্দা!না খাইয়ে মোটেই ছাড়বে না।

আরাফাত মাহার কোমড় জড়িয়ে ধরে ভাত খাচ্ছে।মাহা নড়েচড়ে বসে তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’এভাবে হুট করে কোমড় জড়িয়ে ধরো কেন বলো তো?আমার বুঝি অস্বস্তি হয় না?বুঝো না তুমি একজন পুরুষ মানুষ!তোমার ছোঁয়ায় আমার হেজিটেট ফিল হতে পারে!’

মাহার কথার বিপরীতে পাল্টা কিছু বললো না আরাফাত।চুপটি করে বসে খাবার খাচ্ছে সে।আসলে তার কাছে জবাব দেয়ার মতো কোনো উত্তরই নেই।তাই সে চুপ।
সারা রুম জুড়ে একপ্রকার নিরবতা নেমে এলো।কারও মুখে কোনো শব্দ নেই।শুধু আরাফাতের খাবার চিবানোর শব্দ ব্যতিত।কয়েক মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর আরাফাত হঠাৎ মাহাকে প্রশ্ন করে,

-‘আচ্ছা আমার গাড়ি,আগের ফোন ও ল্যাপটপ এসব কোথায়?জানো তুমি?’

মাহা সোজাসাপটা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,’তোমার গাড়ি এক্সিডেন্ট স্পটেই ইন্না-লিল্লাহ হয়ে গেছে।তাই বাবাই সেটাকে জাংক ইয়ার্ডে বিক্রি করে দিয়েছেন।গাড়ির সাথে ফোনও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে।আর ল্যাপটপটা আমি বিক্রয় ডট কমে বেঁচে দিয়েছি!’

মাহার মুখে ল্যাপটপ বিক্রির কথা শুনে আরাফাতের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।সে জিজ্ঞেস করল,’কেন? বিক্রি করলে কেন? ওটাতে তো আমার অফিসের ও ব্যবসায়ের সমস্ত জরুরি ডকুমেন্টস গুলো ছিলো।ইশ একি করলে?’ বেশ আফসোস করছে আরাফাত।

-‘বোকার হদ্দ ভাবো নাকি তুমি আমায়?জরুরি সব ডকুমেন্টস আমি ভালো মতো চেক করে সেসব একটা পেনড্রাইভে ট্রান্সফার করে রেখেছি।মূর্খের মতো কাজ কেন করতে যাবো?তোমার ল্যাপটপে ওই কালনাগিনীর ছবি,ভিডিও ওসবে ভরপুর ছিলো,দেখেই আমার মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে,তারপর ছবি সব ডিলিট করে ল্যাপটপ বিক্রি করে দিলাম।ব্যস সব মিটমাট!’

আরাফাত একটু অবাক হলো মাহার জেলাসি দেখে।সে হিংসাত্মক স্বভাবের না হলে এমনটা করতো না।আরাফাত আগে থেকেই খেয়াল করে দেখেছে যে তার রুমের কোথাও লামিয়ার স্মৃতির ছিটেফোঁটাও নেই।সব কারসাজি যে মাহার তা ধরতে বেশিক্ষণ লাগে নি।

আরাফাত কোমড় আরেকটু চেপে ধরে বললো,’যাক,ভালো কাজ করেছো।ওসব ছাতার মাথা স্মৃতি তুমি ডিলিট না করলে আমিই সুস্থ হয়ে একটাসময় সব ডিলিট করতাম!’
মাহা একটু নড়েচড়ে বসে আরাফাতকে বললো,’সব বুঝলাম।এখন আমার কোমড়টা ছেড়ে দাও আরাফাত ভাইয়া!আমার অস্বস্তি লাগছে।’

-‘হোয়াট ননসেন্স!ভাইয়া ডাকছো কাকে তুমি?কোন এঙ্গেল থেকে আমি তোমার ভাইয়া হই?’

আরাফাতের রাগান্বিত কন্ঠ শুনে একপ্রকার চমকে উঠে মাহা।বিস্মিত হয়ে জবাব দেয় সে,’ওমা এটা আবার কেমন কথা?জন্মের পর থেকেই তো তোমায় আমি ভাইয়া বলে ডেকে আসছি!তখন তো তুমিও খুব খুশি হতে ভাইয়া ডাক শুনলে। তাহলে এখন ভাইয়া ডাকতে এত গায়ে লাগছে কেন তোমার?আজব তো!’

আরাফাত নিজেও বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছে।মাহার কথাগুলো তো মোটেও মিথ্যে নয়।সত্যিই তো মাহা কথা বলা শেখার পর থেকে আরাফাতকে মুখ ভরে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকতো।এতে আরাফাতও ভীষণ খুশি হতো।তাহলে আজ কেন এত বিরক্ত লাগছে মাহার মুখ থেকে ভাইয়া ডাক শুনে।মনে হচ্ছে ভাইয়া ডাকটার মধ্যে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছে।মাহার মুখে ভাইয়া ডাকটা বড্ড বেমানান লাগছে কেন?তবে কী এই বিয়েটা সে মন থেকে মেনে নিয়েছে?
দ্বিধাদ্বন্দে মুখ থেকে আর বুলি ফুটছে না আরাফাতের।একদম চুপ করে গেল সে।বলার মতো কোনো শব্দ মনের ডিকশনারিতে আঁতিপাঁতি করে হাতড়েও খুঁজে পাচ্ছে না।

মাহা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।সে আরাফাতের হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।আরাফাত হয়তো মাহার ঠোঁটের কোণের সূক্ষ্ম হাসিটা খেয়াল করে নি।সে তো মাহার যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এই মেয়েটাকে এককালে আরাফাত বোনের নজর ছাড়া অন্য নজরে দেখার জন্য কল্পনাও করতো না,আর এখন তাকে বউ ছাড়া বোন মানতে কলজে হিম হয়ে যায় তার।এ কেমন ট্রান্সফরমেশন সিস্টেম!একটা মন যে কয়বার পাল্টি খেতে পারে তা জানা নেই আরাফাতের!

পানি পান করে গ্লাসটা যথাস্থানে রেখে ক্রাচটা নিজের দিকে টেনে আনলো আরাফাত।তারপর বগলের নিচে ক্রাচ ধরে বসা থেকে ওঠে রুম থেকে বেরিয়ে ধীরলয়ে হেঁটে মেইন হলে চলে আসলো।মাহা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ইশানীর সাথে কথা বলছিলো।আরাফাতকে দেখে ইশানীর সাথে কথা শেষ করে তার দিকে এগিয়ে এলো সে।আরাফাতের কাছে এসে তার দিকে তাকিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে বললো,’আজকে যাবে কোথাও ঘুরতে?’

আরাফাত ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করল,’কোথায় যাবো?’

-‘অনেক দূরে কোথাও।যেমন ধরো তোমার পছন্দের কোনো নদীর পাড়ে।তাহলে দুজনের মাইন্ডটা একটু রিফ্রেশ হবে।অনেকদিন হলো কোথাও যাই না।’

-‘একা যাবো নাকি?’
-‘হ্যা!’
-‘আমার এই অবস্থায় তুমি আমাকে সামলে একা যাবে কী করে?রিকশায়ও তো ওঠতে পারবো না।’

-‘বাসায় যে কার আছে সেটা নিয়ে যাবো।ড্রাইভার ভাই নিয়ে যাবেন আমাদের।আবার আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসবেন,কোনো সমস্যা হবে না।’

মাহার কথাগুলো উল্টেপাল্টে দেখলো আরাফাত।সে তো একপায়ে রাজী।সত্যিই অনেকদিন হলো কোথাও যাওয়া হয় না তার।আর নদীর পাড় তো আরাফাতের ভীষণ পছন্দের জায়গা।সুতরাং প্রস্তাব নাকচ করার প্রশ্নই আসে না।তাই সাথে সাথে হ্যা বলে দিলো সে।বললো,

-‘আচ্ছা তাহলে চলো যাই।’ আবার হঠাৎ কী মনে হতে থমকে গিয়ে বললো সে,’কিন্তু কেউ যদি আমাদের সাথে যেতে চায় তখন কী করবে?এসব জায়গায় গেলে নিরিবিলি থাকতে মন চায় আমার।আমাদের সাথে অন্য কেউ গেলে তো সেটা সম্ভব হবে না।’

-‘আরে দূর,অত চিন্তা করছো কেন?লিসা নিসার বিকেলে প্রাইভেট কোচিং আছে।লিপি অসুস্থ।রবি কোথায় জানি গিয়েছে কার সাথে দেখা করতে আসতে রাত হবে তার।মামণি ঘুমাবেন এই সময়ে,ভাবীও কোথাও যাবে না এখন,কারণ রিহাদ বাবুর কাশি হয়েছে।সবাই ব্যস্ত যে যার মতো।কেউ ঘুরতে যাওয়ার মতো মুডে নেই এখন আমাদের মতো।সো প্যারা নাই চিল,ওকে!’

আরাফাত হেসে ফেললো মাহার বলার ধরন দেখে।হাসিমুখে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো সে।মাহাও মুচকি হেসে আরাফাতকে ধরে নিজেদের রুমে নিয়ে গেল দুজনে মিলে তৈরি হবে বলে।
_________

গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে।সামনে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে আর পিছনের দিকটায় আরাফাত ও মাহা বসে বসে জানালা দিয়ে চারপাশ দেখছে।মাঝেমধ্যে টুকটাক কথাও বলছে দুজন।আরাফাত মাহার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।দুজন একদম গা ঘেঁষে বসে আছে।ড্রাইভার খুব আস্তে ধীরে গাড়ি ড্রাইভ করছেন।নয়তো ঝাঁকি খেলে আরাফাতের ব্যথা লাগবে।

প্রায় মিনিট বিশেক পর একটা নদীর ধারে পৌঁছে গেলো ওরা।এই জায়গাটা আরাফাতের ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা।প্রায়সময়ই সে একা আসতো এখানে।লামিয়া এরকম জায়গা তেমন একটা পছন্দ করে না বিধায় তাকে নিয়ে এখানে আসতো না।

মাহা আরাফাতকে ধরে ধরে গাড়ি থেকে নামালো।গাড়ির ভেতর থেকে ক্রাচটা বের করে আরাফাতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে বললো চলে যেতে।ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল।মাহা আরাফাতের পিছনে হাত নিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে।আরাফাতও আস্তে আস্তে মাহার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছে পাশাপাশি।পড়ন্ত বিকেলের মনোরম পরিবেশের নদীর পাড়ের অপূর্ব দৃশ্য দেখে তাদের নয়ন জুড়িয়ে গেল।সূর্যের আবছা তীর্যক রশ্মি এসে দুজনের গায়ে ছিটকে পড়েছে।শুধু আরাফাত-মাহা নয়,তাদের মতো আরও বেশ কয়েকজোড়া কপোত-কপোতী আজকের এই সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করতে এখানে এসেছে।এছাড়াও আরও কয়েকজন আছে।তবে আজকে তেমন একটা ভীর নেই।সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে যার মতো আছে।

মাহা আর আরাফাত দুজন ধীরলয়ে হেঁটে হেঁটে নদীর তীরে এসে দাঁড়ালো।আরাফাত চোখ ভরে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করছে।মাহা আরাফাতের চোখে তৃপ্তির রেশ দেখতে পেয়ে মৃদু হাসলো।তার হিজাবের কোণ নদীর বিপরীত দিক থেকে আসা বাতাসে ফরফর করে উড়ছে।আরাফাতের চুলও উড়ছে হালকা।আরাফাত ক্রাচে ভর দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।নজর তার নদীর বুকে বয়ে চলা একটা স্টিমার ও একটা ডিঙি নৌকার দিকে।স্টিমারের শব্দ এখানে পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে।অনেকদূরে তাকালে একটা ফেরিকে বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে।উফফ মনটাই ভীষণ প্রফুল্ল হয়ে গেল!

এমন একটা পরিবেশ দেখে গান গাওয়ার লোভ সামলাতে পারলো না মাহা।সে খুবই আস্তে কন্ঠে যাতে শুধু আরাফাত শুনতে পায় এমনভাবে গুনগুনিয়ে গান ধরলো,

কিছু কথার পিঠে কথা
তুমি ছুঁয়ে দিলে মুখরতা,
হাসি বিনিময় চোখে চোখে
মনে মনে রয় ব্যাকুলতা।

আমায় ডেকো একা বিকেলে
কখনো কোনো ব্যথা পেলে,
আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে
যখনই মন কেমন করে!

কোনো এক রূপকথার জগতে
তুমি তো এসেছো আমারই হতে,
কোনো এক রূপকথার জগতে
তুমি চিরসাথী আমার জীবনে,
এই পথে!

আরাফাত মুগ্ধ হয়ে গেছে পুরো।হয়তো মাহা পুরোপুরি গায়িকাদের মতো করে গানটা গাইতে পারে নি,তবে এতোটা মন্দও হয় নি।এই সুন্দর পরিবেশটার সাথে খোলা কন্ঠে গুনগুন করে গাওয়া এই গানটা আরাফাতের মন কেঁড়ে নিয়েছে।এত ভালো লেগেছে তার যা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না।মাহার দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকালো আরাফাত।মাহাও তার দিকে তাকিয়ে ছিলো।দুজনের চোখাচোখি হতেই মাহা হাসলো শুধু।আরাফাত মাহার দিকে তাকিয়ে বিমোহিত কন্ঠে বললো,

‘ট্রাস্ট মি হানি,অনেক সুন্দর করে গেয়েছো তুমি!আমার ভীষণ, ভীষণ ভালো লেগেছে!এরকম পরিবেশে এই গানটাই একদম মানানসই।আই লাভ ইট!’

আরাফাতের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় কিছুটা লজ্জা লাগলো মাহার।তবে লজ্জার থেকে ভালো লাগাটা ঘিরে রেখেছে তাকে।ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা পেলে সকল প্রেমিকাই একদম মাখনের মতো গলে যায়।মাহাও তার ব্যতিক্রম হয়নি।বরং মনের মধ্যে লাড্ডু ফুটছে তার।

মাহা প্রতুত্তরে কিছু বলতে পারলো না।শুধু আরাফাতের দিকে স্বপ্নীল চোখে তাকালো।মনে মনে বললো,’তোমার ভালো লাগার জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা আমি করতে পারবো না।অনেক ভালোবাসি তোমায়।অনেক!’

-‘চলো ঐ দিকটায় হাঁটি আমরা।’ আরাফাতের কথা শুনে ধ্যানভঙ্গ হলো মাহার।ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,’হ্যা চলো!’

দুজনে তালে তাল মিলিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।মৃদুমন্দ বাতাসের বেগ এসে ঝাপটা মারছে তাদেরকে।ফলে পরনের কাপড়ের কোণ হাওয়ায় উড়ছে অবাধ্যের মতো।আরাফাত কথায় কথায় মাহাকে জিজ্ঞেস করল,

-‘আচ্ছা হানি,তুমি কী কখনো কাউকে ভালোবেসেছিলে?’

মাহা আরাফাতের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকালো।ঠান্ডা কন্ঠে জবাব দিলো,

-‘শুধু ভালোবেসেছিলাম না,ইভেন এখনও বাসি!আমার শয়নেস্বপনে শুধুই সে।আমার মনে সবসময় তারই বসবাস।এই মনে সে ব্যতিত অন্য কাউকে জায়গা দেয়া সম্ভব নয়।কারণ সবকিছু একমাত্র তার নামেই দলিল করে দিয়েছি আমি।’

মাহার কথা শুনে আরাফাতের হার্টবিট যেন থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য।মাহার বলা কথা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে জানতে চাইলো,

-‘কে সে?যাকে তুমি এখনও ভালোবাসো?’
-‘সময় এলেই জানতে পারবে!’ মাহার সোজাসাপটা নির্লিপ্ত জবাব।
-‘তবে তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষ রেখে আমাকে কেন বিয়ে করলে?করুনা করেছো বুঝি আমায়?’ বিষন্ন স্বরে জানতে চাইলো আরাফাত।

মাহা শান্ত দৃষ্টিতে আরাফাতের দিকে তাকিয়ে আবারও বললো,’তোমার সাথে আমার করুনার কোনো সম্পর্ক নেই।তোমায় সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপহার দিতে বিয়ে করেছি।বাকিটা একদিন তুমি জানতে পারবে।সেই একদিনটা তুমি সুস্থ হওয়ার পর।তখন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর তুমি পেয়ে যাবে।বুঝতে পারবে তখন, আমি কাকে ভালোবাসি!এখন এত সুন্দর মুহূর্তটা এসব জানতে চেয়ে নষ্ট করো না।ফিল দিস মোমেন্ট!’

আরাফাত চুপ করে গেল।সেও মাহার স্বভাব সম্পর্কে অবগত।সময়ের আগে যে মেরে ফেললেও মুখ থেকে একটা কথা বেরোবে না তা জানে আরাফাত।তাই আর জানার জন্য চাপাচাপি করলো না।হতাশ নয়নে অন্য দিকে চোখ ফেরালো সে।তার গোবেচারা মুখভঙ্গি দেখে মাহা মনে মনে হাসলো।

-‘চলো এখানটায় বসি!’ বড় একটা গাছ দেখিয়ে মাহা শুধালো আরাফাতকে।গাছটা বিরাট বড়।সেখানে বসার জন্য সিমেন্ট দিয়ে ভরাট করা হয়েছে গাছের চারপাশ,অনেকটা বেঞ্চের সিস্টেমে।আরাফাতও সায় দিলো।মাহা আরাফাতকে ওখানে বসতে বলে সে অপরদিকে দূরে বসা চানাচুরওয়ালার কাছে গেল ঝালমুড়ি কিনে আনতে।

আরাফাত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে।ওদিকে তাকালেও মন তার পড়ে রয়েছে মাহার ভালোবাসার মানুষ কে তা জানার উদ্দেশ্যে।সে ভীষণ চিন্তিত।মনে এক অদ্ভুত ভয় ঢুকেছে মাহাকে নিয়ে।সে মনকে একদিকে বোঝায় যে সে মাহাকে মোটেও ভালোবাসে না।আবার অন্যদিকে মন তাকে উল্টো বোঝায় যে মাহাই তার জীবনের সব।মাহাকে হারিয়ে ফেললে সেও জীবনের মানে হারিয়ে ফেলবে।’উফফ,কেন সঠিক উত্তর পাই না আমি,কেন কেন?’ একহাত মাথার চুলে ডুবিয়ে আঁকড়ে ধরে সে।

মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এলো মাহা।আরাফাতের দিকে তাকিয়ে সে মিষ্টি হাসলো।অনেক বড় একটা ঠোঙাতে করে ঝালমুড়ি নিয়ে এসেছে সে।এসে আরাফাতের পাশে বসে বললো,’মুখটা অমন প্যাঁচার মতো করে রেখেছো কেন শুনি?মনখুলে একটা হাসি দাও দেখবে সবকিছু ভালো লাগবে।ফুরফুরে লাগবে!’

আরাফাতও মাহার কথা মতো সমস্ত চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে দাঁত বের করে একটা ঝলমলে হাসি উপহার দিলো।প্রতুত্তরে মাহাও হেসে তার মুখে একটু ঝালমুড়ি ঢুকিয়ে দিলো।দুজনে মিলে গল্প করে ঝালমুড়ি খেয়ে শেষ করলো।মুহূর্তেই আরাফাতের মন উৎফুল্লতায় ছেয়ে গেল।

সন্ধ্যার দিকে গাড়ি এলো তাদেরকে নিতে।সারাটা বিকেল তাদের অনেক ভালো কেটেছে।ড্রাইভারকে আগেই বলে রেখেছিলো মাহা যে সন্ধ্যার দিকে চলে আসতে।মাহা আরাফাতকে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ওঠে বসলো।ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে চালাতে লাগলো।আরাফাতের চোখে ঘুম নেমে আসছে যেন।কেন জানি ক্লান্ত লাগছে শরীরটা তার।তাই সে মাহার দিকে গা এলিয়ে দিয়ে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।মাহাও জড়িয়ে ধরেছে তাকে দু’হাতে।
____________

কিছু মুহূর্ত পূর্বে বাসায় পৌঁছে গেছে ওরা দুজন।আরাফাত সোফায় তার মায়ের পাশে বসে আছে। বাসায় আসতেই চোখ থেকে ঘুম উড়ে চলে গেছে তার।সবাই বসে সন্ধ্যার নাশতা করছে এখন লিভিং রুমে।লিপিও আছে।এই অসুস্থতার মধ্যেও শয়তানী ছাড়ার নাম নেই তার।আরাফাতের পাশে বসে কথা বলছে বেহায়ার মতো।মাহা অন্য দিকে বসে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চা পান করছে।আর শান্ত চোখে লিপিকে প্রত্যক্ষ করছে।অন্য দিকে রবি তাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে।বারবার চুলে হাত দিয়ে ঠিক করছে,পরনের গেঞ্জি টেনেটুনে ঠিক করছে।যা দেখে আরাফাত ফুঁসে ওঠলো।

লিপি মাহার দিকে তাকিয়ে অভিযোগ করে বললো,’তোমরা নিজেদের মতে মতে বেড়াতে গেলে,একবার মুখ দিয়েও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করো নি আমাদেরকে।এত স্বার্থপর কেন তুমি?আমাদেরকে সাথে নিলে কী এমন ক্ষতি হতো?’

মাহা মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে বললো,’অনেক ক্ষতি হতো।আমরা নিউ ম্যারেড কাপল বেড়াতে গিয়েছি নিজেদের মতো করে একা কিছু সময় কাটানোর জন্য।সেখানে এক্সট্রা কাউকে সাথে নেয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিলো না।যেখানে আর কারও অভিযোগ নেই সেখানে তুমি কে আমাকে পোক করার?’

মাহার কথায় লিপি অপমানিত বোধ করলো।ইশানী,লিসা,নিসা দাঁত কেলিয়ে হাসছে।লিপি তাদের দিকে তাকিয়ে ধমকে ওঠে বললো,’হাসছো কেন তোমরা?হাসির কী হয়েছে এখানে?’

লিপির মুখ থেকে কথা কেঁড়ে নিয়ে মাহা বললো,’আজব তো!ওদের মুখ আছে ওরা হাসবে।তার জন্য তোমার কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে নাকি?এসব খোঁচাখুঁচি বাদ দিয়ে ভালো কোনো কথা বলো!’

আরাফাত মিটমিট করে হাসছে মাহার কাঠকাঠ কথা শুনে।লিপির চেহারা দেখার মতো হয়েছে।রবি তো মাহার ঠাসঠাস কথা শুনে তার প্রেমে আছাড় খেয়ে পড়লো।মিসেস মুমতাহিনা তাদের কথা শুনে হাসছেন আর আরাফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

মাহার ফোনে তার বাবা কল করলেন।মাহা লিভিং রুমে সবার সামনে বসেই কথা বলছে।এ কথায় সে কথায় তিনি জানালেন ৩ দিন পর ওনারা এখানে আসছেন কয়েকদিন থাকার জন্য।সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন তিনি।এজন্য মিসেস মুমতাহিনার সাথে খেজুরে আলাপ শুরু করে দিলেন।তিনিও ভীষণ খুশি।অনেকদিন হলো ফ্যামিলি গেট টুগেদার করা হয় না।তাই সবার চেহারাই ঝলমল করছে বেড়াতে যাওয়ার নাম শুনে।লিসা নিসা ও রিহাদ তো খুশিতে থইথই করছে।

কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কাটলেন তিনি।বিস্তারিত আলোচনা জনাব আতিক জনাব এরশাদের সাথে করবেন বলেছেন।এই ক’দিন রাহাতেরও হলিডে।কারণ তার বদলে অন্য ডক্টর তার দায়িত্ব সামলাবেন।সে টানা ডিউটি করে করে হাঁপিয়ে গেছে।কিছুদিন তার রেস্ট দরকার।

রাতে জনাব এরশাদ ও সাইফ বাসায় আসার পর রাতের খাবার খেতে বসে বিস্তারিত সব জানা গেল।মাহার পরিবারের সবাই এখানে আসলে দুই পরিবারের সবাই মিলে আরাফাতদের বাগান বাড়ি সিরাজগঞ্জে বেড়াতে যাবে তিন-চার দিনের জন্য।এই ক’দিন সবাই মিলে প্রচুর ঘুরবে ফিরবে।তারপর মন ফ্রেশ করে বাসায় চলে যাবে।সকলেই ভীষণ উৎফুল্ল ঘুরতে যাওয়া নিয়ে।সবাই একসাথে হলে রাতে বারবিকিউ পার্টি আর দিনে পিকনিক সব জমে ক্ষীর হয়ে যায়।

ঘুরাঘুরি মাহারও অনেক পছন্দের।সেও অনেক খুশি সবার মতো।পরিবারের সাথে কাটানো সময় গুলো বেস্ট হয়।মাহা এবার আনিশাকেও তাদের সাথে যাওয়ার জন্য রাজি করাবে ভাবলো।অনেকদিন হলো কলিজার বান্ধবী আনিশাকে দেখে না সে।আগের মতো সময় কাটানোও হয় না।এবার সব হবে!

খাওয়া দাওয়া সেড়ে আরও কিছুক্ষণ বসলো সবাই ড্রয়িং রুমে।টুকটাক অনেক কথা বার্তা হলো।এদিকে আরাফাতের চোখ পড়ে যাচ্ছে ঘুমের কারণে।তা বুঝতে পেরে মাহা তাদেরকে গুডনাইট জানিয়ে আরাফাতকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে এলো।আরাফাতকে ঔষধ খাইয়ে ঘুমানোর আগের জরুরি কাজসব শেষ করে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে।মাহা নিজের মাথার চুল ভালো করে আঁচড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে পরনের কাপড় পাল্টে পাতলা একটা লেডিজ গেঞ্জি গায়ে জড়িয়ে ঘুমাতে এলো।

লাইট নিভিয়ে বিছানার ওপর এসে শুতেই নিত্যদিনকার মতো আরাফাত এসে মাহাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে তার বুকের ওপর মাথা রাখলো।মাহা এই ঘটনায় এমন অভ্যস্ত হয়েছে যে আরাফাতকে নিজের সাথে জড়িয়ে না ধরলে তারও ঘুম আসে না।দুজন দুজনের জন্য পাগল।কিন্তু কেউ স্বীকার করতে বাধ্য নয়।দুজনের মনের মধ্যেই সমস্ত অনুভূতি জমিয়ে রাখা।একটাসময় তা ঠিকই প্রকাশ পাবে।

আরাফাত ঘুমিয়ে যেতেই মাহা তার কপালে ও মাথায় গাঢ় চুমু এঁকে দিলো।তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বিরবিরিয়ে বললো,’মৃত্যু ব্যতিত তোমার থেকে আলাদা হবো না আমি।হয়তো তোমাকে বোঝানোর জন্য সাময়িক একটু দূরে যাবো।তারপর তুমি নিজেই আমার কাছে পাগলের মতো ছুটে আসবে।আমার ভালোবাসা কখনো হারবে না!কখনোই না!’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে