অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -১৯

0
1879

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১৯

এভাবেই ফুরুৎ করেই উড়ে চলে গেছে আরও দুটো দিন।তৃতীয় তম দিনে যথাসময়ে সকালেই মাহার পরিবারের সকলে এসে হাজির।সাথে অবশ্যই মাহার জানে জিগার আনিশাও আছে।আনিশাকে দিতে ওর মা প্রথমে রাজী ছিলেন না কিন্তু পরে মাহার এত এত রিকোয়েস্ট ফেলতে না পেরে রাজী হয়েছেন।মাহাকেও তিনি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন,তাই তো সে বলায় তিনি তার কথা উপেক্ষা করতে পারেন নি।

মাহা আর আনিশা দুজন শালিকের জোড়ার মতো একসাথে ছাদে বসে মজা করে আইসক্রিম খেয়ে আড্ডা দিচ্ছে।বাকিরা সবাই নিচে।এমনকি আরাফাতকেও নিচে রেখে এসেছে সে।কলিজার বান্ধবীকে পেয়ে এতদিন পেটে জমিয়ে রাখা সমস্ত গোপন কথা একেবারে উগলে দিচ্ছে মাহা।আনিশাও মনযোগ দিয়ে সব শুনছে।লিপির কাহিনি খুলে বলতেই দুই বান্ধবী সমস্বরে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লো।

আরাফাত নিচে সবার সাথে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু তার চোখ বারবার আশেপাশে তাকিয়ে মাহাকে খুঁজে যাচ্ছে।মাহাকে এতক্ষণ ধরে না দেখে মনটা অস্থির হয়ে গেছে তার।রাহাত, সাইফ, রবি, রিয়াজ, রাফি, জনাব এরশাদ ও জনাব আতিক তাঁরা সকলে ড্রয়িং রুম জুড়ে আলোচনা সভা বসিয়েছে।আবার তাদের সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছে আরাফাত।

আবার এদিকে,
লিসা, নিসা, নওশিন, ইরা, ইশানী, লিপি, মিসেস মুমতাহিনা, রাফির মা – বউ মুন্নি ও মিসেস মিনারা ওরা সবাই লিসা নিসার বেডরুমে বসে আড্ডা গেঁড়েছেন।গল্পগুজবে পুরোপুরি মত্ত।সাথে চলছে চা বিস্কুট আরও কতকি!জাওয়াদ রিহাদ ও পিয়াসকে পেয়ে খেলা জমিয়েছে, এ রুম থেকে ও রুম শুধু হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে ছোটাছুটি করছে তিনজনে।লিপি তাদের গল্পে এই আছে তো এই নেই, সে বেশিরভাগ ফোন ঘেঁটেই সময় পার করছে, মাঝেমধ্যে হুট করে একটা কথা বলে আবার নাই হয়ে যায় সে।

মাহা আর আনিশা অনেকটা সময় পার করে ছাঁদ থেকে নেমে আসে।তাও কথা বলা ফুরোচ্ছে না দুজনের কারও।পেটে অনেক কথা জমে আছে, সেগুলো তো শেষ করতে হবে তাই না?নিচে নেমে আসার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু আরাফাতের তাকে দরকার পড়তে পারে সেজন্যই চলে এলো।

আরাফাত তাদের মাঝখান থেকে ওঠে ততক্ষণে নিজের রুমে চলে গেছে।তার অস্বস্তি লাগছে ভীষণ।শরীর ঘামছে শুধু।গোসল করতে হবে।মাহার অপেক্ষা করতে না পেরে সে নিজে থেকেই পরনের গেঞ্জি টেনেটুনে খোলার চেষ্টা করতে লাগলো একহাত দিয়ে।অন্যহাত নাড়াতে পারে ঠিকই কিন্তু খুবই সাবধানে আর আস্তে নাড়াতে হয়।নয়তো প্রচন্ড ব্যথা করে ওঠে।

মাহা আনিশাকে লিসা নিসার রুমে ছেড়ে দিয়ে সে নিজেদের রুমে চলে আসে।এসে দেখে আরাফাত পরনের গেঞ্জি নিয়ে টানাটানি করছে।দ্রুত এগিয়ে এসে আরাফাতের কাঁধে হাত রাখলো সে,জিজ্ঞেস করলো,

-‘কী হয়েছে তোমার?এমন করছো কেন?’
-‘অস্বস্তি লাগছে ভীষণ!গেঞ্জিটা খুলে দাও প্লিজ!’
-‘ওয়েট দিচ্ছি!’

মাহা আরাফাতের পরনের গেঞ্জিটা খুলে বিছানার ওপর রাখলো।আরাফাত এবার মাহার কোমড় জড়িয়ে ধরে তার পেটে মাথা রাখলো।মাহা এক ভালোলাগার বিহ্বলতায় আটকে গেল যেন।নিজেও আরাফাতকে ধরলো আলগোছে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো,

-‘কী হয়েছে?মন খারাপ নাকি তোমার?কেউ কী কিছু বলেছে তোমায়?’
-‘নাহ কেউ কিছু বলে নি।এমনিতেই মুড অফ লাগছে!ভালো লাগছে না কিছু!’ চোখ বন্ধ করে বললো আরাফাত।

-‘ওহহ!তাহলে মুডটা অন করে দেই কী বলো?’ মাহার মুখে অন্যরকম হাসির ঝলক।আরাফাত মাথা তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।বললো,

-‘কীভাবে?’
-‘ওয়েট দেখাচ্ছি!’
মাহা রুমের দরজা লক করে এলো।আরাফাত কৌতুহলী দৃষ্টিতে মাহাকে লক্ষ্য করছে।মাহা এসে আরাফাতের পাশে বসলো।আরাফাতও মাহার দিকে ঘুরে বসলো।সে বুঝতে পারছে না আসলে মাহা ঠিক কী করতে চাইছে!মাহা আশেপাশে একবার তাকিয়ে সোজা আরাফাতের মাদকতায় ভরপুর চোখের দিকে তাকালো।আরাফাতের চোখের মাঝে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পারছে মাহা।

আচমকা আরাফাতকে অবাক করে দিয়ে মাহা তাকে নিজের আরও কাছে টেনে তার ওষ্ঠের সাথে নিজের অধর জোড়া পুরোপুরি মিশিয়ে ফেললো।আরাফাত তো হতভম্ব।মাহা দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে পরপর চুমু খেয়ে যাচ্ছে।দুই মুহূর্ত পর আরাফাত নিজের ধ্যানে ফিরে আসে।সে উল্টো মাহার খোলা চুলের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে আঁকড়ে ধরে তার সাথে সাড়া দিতে লাগলো।দুজন দুজনার মোহে ডুবে গেছে পুরো তরে।

তাদের পাশের বাসায় কেউ লাউড স্পিকার দিয়ে গান বাজাচ্ছে।এতোটাও লাউড নয় যে কারও অসুবিধা হবে।আর মাহা-আরাফাতের রুম থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে গান।যা তাদের দুজনের মনের গভীর অনুভূতিটাকে প্রকাশ করতে সাহায্য করছে।

“তুমছে মোহাব্বাত হ্যায় হা
তুমছে মোহাব্বাত হ্যায় হা,,
বাস তুমছে হা,,তুমছে হি হা,
তুমছে মোহাব্বাত হ্যায় হা!”

আরাফাতের মুড সত্যি সত্যিই অন হয়ে গেছে।তার এই মুহুর্তটাকে স্মৃতির পাতায় বাঁধাই করে রাখতে ইচ্ছে করছে।এত ভালো লাগছে তার যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।মাহাকে যে সে এতদিনে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে তা সঠিক উপলব্ধি করতে না পারলেও এটা বুঝতে পারে যে তার মাহাকে ছাড়া চলবে না।একটুও চলবে না!

মিনিট পাঁচেক পর মাহা আরাফাতকে ছাড়লো।আরাফাত তাও ছাড়তে নারাজ।সে মাহার নেশায় ডুবে গেছে পুরো।আরাফাত আবারও মাহাকে চুমু খেতে চাইলে মাহা তার মুখে হাত চেপে ধরে আটকে ফেললো।আরাফাত কাতর দৃষ্টিতে তাকালে মাহা ফিসফিসিয়ে বললো,

-‘আজ আর নয়!যথেষ্ট হয়েছে।বিকেলে আমাদের বাগান বাড়িতে রওনা দিতে হবে।এখন আসো তোমায় গোসল করিয়ে দিবো।’

আরাফাতের মাহার মধ্যে ডুব দেয়ার ইচ্ছে ছিল।কিন্তু কী আর করার।নিজেকে বহুত কষ্টে সামলে নিয়ে কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলো।মনে অভিমান জমেছে তার।যদিও সেটা প্রকাশ করতে চাইছে না সে।মাহা বুঝতে পারছে সব,তারও মন চায় আরাফাতকে নিজের সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিতে।কিন্তু সে যে নিরুপায়।আরাফাতকে পুরোপুরি নিজের করতে হলে সাময়িক দূরত্ব গ্রহণ করতেই হবে।কিছু করার নেই।

মাহা আরাফাতকে যত্নের সহিত গোসল করিয়ে দিলো।নিজেও গোসল সেড়ে এলো।আরাফাতের হাত পায়ে তেল মালিশ করে দিয়ে গেঞ্জি পড়িয়ে দিলো।আরাফাত মাহার দিকে মোটেও তাকাচ্ছে না।রাগ হচ্ছে তার মাহার ওপর।মাহা বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো শুধু।
___________

দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ সবার।সারা বাড়ি মুখরিত তাদের গল্প গুজবে।কারও মুখ এক সেকেন্ডের জন্যেও বন্ধ হচ্ছে না।আরাফাতকে খাইয়ে দিয়ে মাহা রুমে গিয়ে ছোটখাটো একটা ব্যাগে তাদের প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় ও জিনিসপত্র ভরছে।আর পাশে বসে আনিশা কত কথা বলছে তাকে।আনিশা দুটো প্রপোজাল পেয়েছে সেসব নিয়েই অনবরত কথা বলছে সে।মাহা কাপড় গোছাচ্ছে আর হাসছে।

সবাই সবকিছু গোছানো শেষে তৈরী হয়ে নিলো সিরাজগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে।মাহা আরাফাতকে নিয়ে ধরে ধরে গাড়িতে তুলে নিজেও তার পাশে উঠে বসলো।ব্যাগটা গাড়ির পেছনের ডিকিতে রেখে এসেছে অন্যদের ব্যাগের সাথে।জনাব এরশাদ ও সাইফ বাসার সবকিছু চেক করলেন ভালোমতোন।তারপর বাসার দরজা জানালা সব লক করে বাসার সদরদরজা তালা দিলেন।বাইরে সিকিউরিটি গার্ড আছে বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য।বাড়ি দেখে রাখার জন্য একজন পরিচিত কেয়ারটেকারকেও বলে রেখেছেন আগে থেকে।কেয়ারটেকার তাঁকে নিশ্চিত করলে তিনি এসে বড়দের জন্য বরাদ্দকৃত প্রথম গাড়িটাতে ওঠে বসলেন।মাহা রা অন্য গাড়িতে বসেছে।সাইফ,রাফি,রাহাত তারা তাদের বউ বাচ্চাদের নিয়ে অন্য গাড়িতে উঠেছে।

লিপি আরাফাতের পাশে বসতে চাইছিলো কিন্তু মাহার জন্য পারলো না।যেই মাহা,যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখে সে আরাফাতকে।লিপিকে সে আরাফাতের কাছে ঘেঁষতে দেবে সেটা ভাবাও অন্যায়।

গাড়িতে উঠার কয়েক মুহূর্ত পরই আরাফাত মাহার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছে।গোসল করায় আসলে শরীর হালকা হয়েছে তাই এত সহজে আরামের ঘুম নেমে এলো চোখদ্বয়ে।মাহা আরাফাতকে দু’হাতে আগলে ধরে রেখেছে নিজের সাথে।যদি তাদের সম্পর্কটা পুরোপুরি স্বাভাবিক হতো তবে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতো কলিজাটাকে।মনে মনে বিরবিরায় মাহা,”আমার ভালোবাসা!”

গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে।মাহা একধ্যানে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।আরাফাত ঘুমে।লিপি কানে ইয়ারফোন ঠেকিয়ে গান শুনছে।রবি ফোন স্ক্রল করছে।লিসা নিসা দুজন আনিশার সাথে গল্পে মত্ত।ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভ করছে একমনে।একঘেয়েমি কাটানোর জন্য গাড়ির স্পিকারে রোমান্টিক গান ছাড়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ যেতে প্রায় তিন-চার ঘন্টা সময় লাগে।এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।মাহা আরাফাতের জন্য বাসা থেকে হাতে বানানো দুটো স্যান্ডউইচ আর কেক পিস নিয়ে এসেছে,শুধু তাকে এগুলো খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে হবে এজন্য।গাড়ি থামিয়ে অবশ্য ফাস্টফুডের দোকান থেকে কতকিছু কেনা হয়েছে খাওয়ার জন্য।তবে বাহিরের সেসব খাওয়া আরাফাতের জন্য ঠিক হবে না,তাই এই ব্যবস্থা।

মাহা আরাফাতকে সজাগ করালো।তারপর তাকে সেসব খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাওয়ালো।আরাফাতের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে ভীষণ।হালকা জ্বর জ্বর অনুভব হচ্ছে।মাহা পাশের লুকিং গ্লাসটা বন্ধ করে ফেললো।কারণ হু হু করে বাতাস ঢুকছে।যদি আরাফাতের শরীর খারাপ করে তাই।সে অবশ্য জানেও না যে আরাফাতের অলরেডি জ্বর চলে আসছে।

আরাফাত মাহাকে একহাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেললো।তার চোখ মেলে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না।আরাফাত মাহাকে জড়িয়ে ধরেছে দেখে লিপি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে মুখ ঝামটা মেরে বললো,

-‘এসব কী?তোমাদের যখন এতই এসব করার ইচ্ছা তবে তোমরা বাসায় পৌঁছানোর পর বেডরুমে গিয়েও করতে পারো!তবে এই পাবলিক প্লেসে এসব কী আজিব?’

মাহা একটা কড়া কথা শুনিয়ে দেয়ার জন্য মুখ খুললো।কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই আরাফাত মাথা তুলে চোখ রাঙানি দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে শাসিয়ে বললো,

-‘ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট লিপি!তোমাকে কিছু বলি না বলে মনে করো না মাথায় ওঠে নাচবে।তুমি সবসময় আমাদের দুজনের পিছনে লেগে থাকো কেন বারবার?তোমার কী আর কোনো কাজ নেই?আমরা কখন কী করি না করি সব কিছুর কী তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?আর একবার আমার ও হানির ব্যাপারে নাক গলাতে আসলে থাপড়িয়ে গাল ফাটিয়ে দিবো একদম বলে রাখলাম।আমার মেজাজ গরম করে নিজের কপালে দুঃখ টেনে এনো না।আমি ভালোর ভালো, খারাপের যম।মাইন্ড ইট।’

আরাফাতের রাগান্বিত কথা গুলো শুনে লিপি ভয়ে মুখ বন্ধ করে ফেললো।আর টু শব্দও বেড়োলো না তার মুখ দিয়ে।আরাফাতের রাগ সম্পর্কে সবাই অবহিত।সে সহজে কখনোই রাগে না,কিন্তু যখন রেগে যায় তখন তাকে কেউ শান্ত করতে পারে না।
আরাফাত কথাগুলো বলে আবারও মাহার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো।গাড়ির পরিবেশ শান্ত হয়ে গেছে পুরোপুরি।মাহা কুটিল হাসি হাসলো লিপির দিকে তাকিয়ে।এত বেইজ্জতি হওয়ার পরেও কথা বলে কোন মুখে আল্লাহই ভালো জানেন।এই দুনিয়ায় এমন মানুষ অনেক আছে।যাদেরকে এক কথায় ছ্যাঁছড়া পাবলিক বলে।

সাড়ে তিন ঘন্টার জার্নি করে অবশেষে তারা তাদের বাগানবাড়িতে গিয়ে পৌঁছালো।এই বাগানবাড়িতে তারা সকলে প্রায়ই বেড়াতে অকেশন কাটাতে।বিস্তর জায়গা জুড়ে করা হয়েছে এই বাড়িটা।বাগানবাড়ি ডাকার কারণ হলো এই বাসার চারপাশে গাছগাছালিতে সবুজের সমারোহ হয়ে গেছে।সাথে আছে হরেকরকমের ফুলের গাছ।যাকে এই বাসার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সে মাহার মতো আবার গাছের পাগলা।লোকটা জনাব এরশাদের কাছ থেকে গাছ কেনার টাকা বাসার এনে এখানে ওখানে তা লাগিয়ে বাসার সৌন্দর্য বর্ধন করে।এতে জনাব এরশাদ খুবই খুশি হোন।বাসার পরিবেশটাই বাগান বাড়ির মতো হয়ে গেছে এখন।এখানে এলেই সকলের দিল খুশ হয়ে যায়।

সাইফ এসে আরাফাতকে ধরে নিয়ে বাসার ভেতর চলে গেছে।মাহা বাইরে দাঁড়িয়ে তার ভাবী ও আনিশার সাথে কথা বলছে।বাড়ির কেয়ারটেকার সবার ব্যাগ একে একে বাসার ভেতরে নিয়ে গিয়ে রেখে আসছে।

ভাবী চলে যেতেই আনিশা মাহার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,

-‘যা দেখলাম,আরাফাত ভাইয়া তো তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে রে দোস্ত!আজকে ওই লিপি ডাইনিটাকে যা দিলো না,আমার তো বেশ লেগেছে!’

মাহাও পাল্টা জবাব দিয়ে বললো,

-‘ওই লিপি ডাইনিকে তো কেউই সহ্য করতে পারে না।মামণি শুধু আপন বোনঝি দেখে কিছু বলে না,নয়তো তিনিও ওকে উচিৎ শিক্ষা দিতেন।আরাফাত তো আরও বেশি সহ্য করতে পারে না।এজন্যই আজ দিয়েছে ভালোমতোন।আর আমার প্রেমে সে অনেক আগেই ডুবে গেছে।লাস্ট চালটা দিলেই সুরসুর করে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলে দেবে!’ শেষের কথা রহস্যময় কন্ঠে বললো মাহা।

-‘খুব ভালো হবে তাহলে।তুই তো আবার সঠিক সময়ের আগে কিছু বলবি না জানি।তারপরও বলবো,বি কেয়ারফুল।উল্টাপাল্টা কিছু করতে যাস না যেন।যেটা ভালো হবে সেটাই করিস।’

আনিশার কথা শুনে মাহা মৃদু হেসে জবাব দিলো,

-‘ভয় পাস না!উল্টাপাল্টা কিছুই করবো না আমি।যা করা প্রয়োজন শুধু সেটাই করবো।আরাফাতকে তো বুঝতে দিতে হবে যে সে আমাকে সত্যিই অনেক বেশি ভালোবাসে।’

-‘হুম!চিন্তা করিস না সব হবে!’

-‘এই তোরা এখানে দাঁড়িয়ে কী নিয়ে ফুসুরফাসুর করছিস রে?’ মিসেস মুমতাহিনার ডাকে চমকে তাকায় দুজনে।ওরা নিজেদের কথা বার্তা নিয়েই মত্ত হয়ে ছিলো।তাই আর কারও কথা মাথায় আসে নি।

আনিশা হড়বড়ে কন্ঠে জবাব দিলো,’না আন্টি,এমনিতেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম আমরা।’

-‘হ্যা তা তো দেখতেই পাচ্ছি।সারাদিন থেকেই দুইটা একসাথে ফিসফাস করিস,আর নিজেরা নিজেরা হেসে কুটিকুটি হস।কী যে তোদের এত কথা আল্লাহ মাবুদ জানেন।এখন যা দুইটা বাসার ভেতর যা।এখানে এত রাতে একা থাকা ঠিক হবে না।’

-‘হ্যা মামণি যাচ্ছি।’ মাহা মেকি হেসে আনিশাকে নিয়ে ঝটপট এই জায়গা ছেড়ে প্রস্থান করলো।
____________

আরাফাতের গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে।কথাটা কানে আসতেই মাহা কারও তোয়াক্কা না করে একদৌড় দিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেছে।রুমে ঢুকে দেখলো রাহাত আরাফাতের মুখে থার্মোমিটার ঢুকিয়ে জ্বর কত ডিগ্রী তা চেক করছে।একটু আগেই তো ভালো ছিলো হুট করে জ্বর ওঠলো কীভাবে তা নিয়েই কথা বলছে সাইফ আর ইশানী।মাহা দ্রুত আরাফাতের পাশে এসে দাঁড়ালো।রাহাত মাহার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললো,

-‘ওর মনে হয় বেশি ঘাম হয়েছিলো,ঘাম মেবি শরীরে শুকিয়ে গিয়ে ঠান্ডা লেগে গেছে।’

-‘হ্যা ভাইয়া,ওনি ঘামে বেশি।আজকেও প্রচুর ঘেমেছে,তাই গোসল করিয়ে দিয়েছিলাম।’ মাহা দাঁতে নখ কেটে চিন্তিত সুরে জবাব দিলো।

-‘ওহহ,যাইহোক,গুরুতর কিছু নয়।চিন্তার কোনো কারণ নেই।ভালো হয়ে যাবে।সিজনাল জ্বর হয়েছে জাস্ট।আর কিছু না।তবে খেয়াল রাখতে হবে,বেশি ঘামলে সমস্যা!’

-‘আচ্ছা ভাইয়া!আমি খেয়াল রাখবো সব!’ মাহা বললো।

-‘এই তুই দাঁত কেন কামড়াচ্ছিস রে?একারণেই তো রোগজীবাণু আক্রমণ করে!’ রাহাত ধমকে ওঠে মাহাকে।মাহা ঝট করে মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেললো।রাহাত আরাফাতকে দেখে চলে গেল।সাথে সাইফ আর ইশানীও চলে গেল।আর কেউ এখনো অবধি জানে না যে আরাফাতের জ্বর।

মাহা আরাফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তার গায়ে পাতলা একটা চাদর বিছিয়ে দিলো।আরাফাত গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে।হালকা ভোল্টেজে ফ্যান চলছে রুমে।মাহা লাইট নিভিয়ে ডিম লাইট অন করে দিয়ে নিজেও তার কাছে এসে বসলো।মানুষটার শরীর অনেক দূর্বল এজন্যই শুধু বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে।মাহা খুবই আদুরে ভাবে আরাফাতের মাথার চুলে আঙ্গুল চালাচ্ছে।আরাফাত আরাম পেয়ে আরও গুটিশুটি মেরে মাহার গা ঘেঁষে ঘুমাচ্ছে।
_________

আজকে সবার ওপরই অনেক ধকল গেছে।তাই সকাল সকাল খেয়ে যে যার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।রাহাত, সাইফ, মাহা ওরা কাউকেই বলে নি আরাফাতের জ্বরের কথা।মিসেস মুমতাহিনা আরাফাতের কথা জিজ্ঞেস করলে ইশানী বলেছে আরাফাত জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে তাই রুমে ঘুমাচ্ছে।এজন্য তিনি আর কিছু সন্দেহ করেন নি।

মাহাও রুম থেকে আর বেরোয় নি।ইশানী তাদের হোটেল থেকে কিনে আনা রাতের খাবার মাহাকে রুমে এসে দিয়ে গেল।মাহা জোর করে আরাফাতকে কয়েক লোকমা খাইয়ে তারপর ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে।নিজেও খুব কম খেলো সে।স্বামীর অসুস্থ অবস্থায় কোনো স্ত্রীই খাবার খেতে পারে না।মাহাও তাই।তার কলিজা অসুস্থ সে কীভাবে পেটপুরে খেতে পারবে?

আরাফাত প্রতিদিনকার ন্যায় মাহার বুকে মাথা রেখে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।শরীর তার জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।তার শরীরের গরম তাপ মাহার শরীরেও আগুন ধরিয়ে দিয়েছে যেন।তাও সহ্য করে চুপচাপ আধশোয়া হয়ে বসে আছে মাহা।একটু আগে জলপট্টি দিয়েছে কপালে।পরে প্রয়োজনে আরও কয়েকবার দিবে।পরদিন শরীর মুছিয়ে ঔষধ খাওয়ালেই জ্বর সেড়ে যাবে আশা করা যায়।বেড়াতে আসতে না আসতেই জ্বরের প্রকোপে পড়তে হয়েছে তাকে।

সারাটারাত ঘুমাতে পারে নি মাহা।নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে।আরাফাত শুধু অশান্তি করেছে,নিজেও ঘুমাতে পারে নি মাহাকেও ঘুমাতে দেয় নি।কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ওঠতেই মাহা ফ্যান অফ করে আলমারি ঘেটে পুরাতন লেপ একটা নিয়ে এসে আরাফাতকে মুড়িয়ে দিয়েছে,তাও তার কাঁপুনি কমে না।শেষে নিজে লেপের ভেতর ঢুকে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলো দাঁতে দাঁত চেপে।গরম লাগলেও উপায় ছিলো না কোনো।অনেকক্ষন পর আরাফাতের কাঁপুনি কমতেই লেপটা সরিয়ে দিয়েছে সে।ঘাম দিয়ে জ্বর কমলো মধ্যরাতের দিকে।মাহা তড়িঘড়ি করে তোয়ালে দ্বারা শরীরের ঘাম মুছে দিয়েছে।সারাটারাত আরাফাতের সেবা করেই কাটিয়ে দিয়েছে, দু চোখের পাতা আর এক করতে পারে নি।

সকাল ৬ টার দিকে মাহার চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো।আরাফাতের গায়ে একহাত রেখে সে ঘুমিয়ে গেছে।সারারাত সজাগ থাকার দখল শরীর নিতে পারে নি তাই এখন দু চোখ ভেঙে ঘুম নেমে এসেছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে