অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -২০

0
1869

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_২০

নাম জানা-না জানা পাখিদের কিচির মিচির সহ সংমিলিত শব্দে আরাফাতের তন্দ্রা টুটে গেল।মাথা অনেক ভার হয়ে আছে তার।গতরাতে জ্বরের প্রকোপে হিতাহিত জ্ঞান ছিলো না।সারাটারাত অশান্তিতে কেটেছে।জ্বর আসলে কেমন যেন মিইয়ে যায় শরীর ও মন।আগে জ্বর আসলে মা আরাফাতের কাছে থাকতেন সর্বক্ষণ।এবার এই প্রথম মিসেস মুমতাহিনা জানেনই না তার আদরের ছেলেটা যে জ্বরে পড়ে ভুগে কাহিল হয়ে গেছে।

আরাফাতের চোখজোড়া মনে হচ্ছে পাঁচ মণ ভারী হয়ে আছে।চোখের পাতা মেলতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ।তাও জোর করে খুললো সে।চোখ ভালো করে কচলে ঝাপসা ভাব দূর করে কোনোমতে তাকালো।দৃষ্টি আটকে গেল এলোমেলো অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকা রমণীর পানে।কী মায়াবী মুখখানা তাহার!আহা!দেখেই কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে আরাফাতের।

মাহার চুলের খোঁপা খুলে চুল এলোমেলো হয়ে গালে মুখে গলায় লেপ্টে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ফ্যান বন্ধ তাই কিছুটা গরমের কারণে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে থুতনিতে,নাকে আর ঠোঁটের ওপরের ভাঁজে।এ এক স্বর্গীয় দৃশ্য আরাফাতের জন্য।সে ফাঁকা ঢোক গিলে চোখ পিটপিটিয়ে আবারও চাইলো।এত মোহনীয় লাগছে কেন মেয়েটাকে?কী আছে ওর মধ্যে যা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে?জানা নেই তার।

মাহার মুখের ওপর থেকে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কানের পিছে গুঁজে দিলো সে সযত্নে।হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা মুখের অংশে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে দিলো।কয়েক পলক তাকিয়ে থাকলো মাহার মায়াময় ঐ মুখের দিকে,ডুবে রইলো এক আদুরে আবহের মধ্যে।সেখান থেকে বেরিয়ে আসার আপাতত কোনো ইচ্ছাই নেই তার।কিন্তু আবেগের মধ্যে থাকতে দিলো না প্রস্রাবের বেগ।ছটফটিয়ে ওঠে বসতেই ঠাস করে সজাগ হয়ে গেল মাহা।আরাফাত ছুঁচোর মতো মুখ করে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে।একরাতের জ্বরেই তাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।চেহারা শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে।তাকানো যাচ্ছে না মুখের দিকে।

মাহা দ্রুত শোয়া থেকে ওঠে বসে আরাফাতের কপালে গলায় হাত বুলিয়ে জ্বর আছে কী না চেক করতে করতে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’শরীর কী বেশি খারাপ লাগছে তোমার?এভাবে উঠলে কেন?কিছু প্রয়োজন লাগলে আমায় বলো!’

আরাফাত ঢুলেঢুলে দূর্বল কন্ঠে জবাব দিলো,’আসলে ওয়াশরুম যাওয়ার দরকার ছিল।মাথাটাও ভনভন করে ঘুরছে।দূর্বল লাগছে শরীরটা খুব।’

-‘আগে বলবে না আমায়!ওয়েট আমি নিয়ে যাচ্ছি!’

মাহা দ্রুতহাতে চুল প্যাচিয়ে হাত খোঁপা বেঁধে বিছানায় বসা থেকে নামলো।তারপর দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আরাফাতকে বিছানা থেকে নামালো।মাহার ওপর ভার ছেড়ে দিয়ে মাহার পাশাপাশি এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে আরাফাত।মাহা দক্ষ হাতে তাকে সামলাচ্ছে।আরাফাত জানে মাহার গায়েগতরে যথেষ্ট শক্তি আছে।মেয়েদের মধ্যে কদাচিৎ একজন দুজন এমন তাগড়া যুবতী থাকে,যারা দেখতে শুকনো হলেও গায়ে প্রচুর শক্তি বিরাজমান।মাহাও ঠিক তেমন।প্রত্যহ পুষ্টিকর খাবার খেতে তার কোনো আলস্য নেই।ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি ভারী ভারী কাজ এসব করে অভ্যস্ত বিধায় আরাফাতের এমন সেবাযত্ন করা তার কাছে ডালভাত বই আর কিছুই না।

মাহা আরাফাতকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে তার প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ করে দিলো।আরাফাতের মুখ ধুয়ে ফ্রেশ করিয়ে দিলো যত্নের সহিত।নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিলো দ্রুত।এখন অনেকটা হালকা লাগছে আরাফাতের শরীর।গায়ের ম্যাজম্যাজানো ভাবটা একটু দূর হয়েছে।আরাফাতকে সোফায় হেলান দিয়ে বসিয়ে রেখে মাহা বিছানা গোছালো,তারপর তাকে বিছানার ওপর বসিয়ে রেখে আরাফাতের পরনের কাপড় পাল্টে নতুন পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে বিছানার ওপর আধশোয়া করে আরামে বসিয়ে দিলো।আরাফাত শুধু দেখে যাচ্ছে মাহাকে।

‘হানিটা এত্ত কেয়ারিং একটা মেয়ে!না জানি কার ভাগ্যে লেখা আছে!’ মনে মনে ভাবছে আরাফাত।পরক্ষণেই হুট করে মাথায় এলো,’আরে আজব তো!কীসব ভাবছি আমি?হানি তো আমারই বউ!আর কার ভাগ্যে লেখা থাকবে?’ বলে নিজের মাথায় নিজেই নিজে চাটি মারলো আরাফাত।মাহা আরাফাতের এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড দেখে ভ্রুকুটি করে তাকালো।জিজ্ঞেস করলো,’কী হয়েছে?এমন অদ্ভুত কাজ করছো কেন?’

আরাফাত বুঝতে পেরে আমতা আমতা করে জবাব দিলো,’না এমনিই ইয়ে করলাম।মাথায় কীসব হাবিজাবি কথা ঘুরছে!’

-‘কীসের হাবিজাবি কথা?’ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায় মাহা।আরাফাত কথা কাটিয়ে বললো,’নাহ,কিছু না।ক্ষিদে পেয়েছে!’

আরাফাতের ক্ষিদে লেগেছে শুনে মাহা আর কথা বাড়ায় না।তাকে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল সে রান্নাঘরের দিকে।
__________

-‘কীই?কীভাবে এমন হলো?আমার ছেলের জ্বর ওঠেছে,আর তোরা কেউ আমাকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করলি না!’

মিসেস মুমতাহিনা হাইপার হয়ে গেছেন ইশানী আর মাহার মুখ থেকে আরাফাতের জ্বর সংক্রান্ত কথাবার্তা শুনে।ওরা দুজন এমনি টুকটাক কথা বলছিলো এবং তা ওনার কানে চলে গেছে।ইশানী তাকে কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করতেই তিনি ধমক দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দ্রুত চলে গেলেন আরাফাতের কাছে।মাহা হাসলো শুধু কিছু বললো না।ইশানী ধমক খেয়ে চুপচাপ শ্বাশুড়ির পিছু পিছু ছুটলো।মাহা আরাফাতের পছন্দের নাশতা তৈরিতে মনোনিবেশ করলো।

এদিকে,
-‘কী হয়েছে বাবা তোর?শরীর বেশি খারাপ করছে দেখি?’

হা হা করে ছুটে এলেন মিসেস মুমতাহিনা।ইশানীও পিছনে ছিলো।তাদের সাথে মিসেস মিনারাও এসে হাজির হলেন।আরাফাতের জ্বর আছে এখনও।শরীর অনেকখানি দূর্বল।বিছানায় শুয়ে আছে রোগীদের ন্যায়।মাকে দেখে ওঠে বসতে চাইলো,কিন্তু মিসেস মুমতাহিনা উঠতে দিলেন না।বললেন,’থাক বাবা উঠিস না!শুয়ে থাক।জ্বর কীভাবে আসলো?কালকেও তো সুস্থ ছিলি!’

মায়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে মৃদু হেসে জবাব দিলো আরাফাত,’জানি না আম্মু।এখানে আসার সময় শরীরটা খারাপ লাগছিলো।তারপর তো রাতে জ্বরও ওঠে গেল।এখন অবশ্য আগের তুলনায় বেটার ফিল করছি।’

মিসেস মিনারা আরাফাতের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে আদুরে কন্ঠে বললেন,’তোর কিছু হলে আমাদের চিন্তার শেষ থাকে না রে বাপ!যেদিন তুই পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে যাবি,সেদিনই আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবো।’

-‘ইনশাআল্লাহ আমার ছেলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে!’
মিসেস মুমতাহিনা আরাফাতের গালে হাত রেখে বললেন উক্ত কথাটি।

একে একে সকলে এসে আরাফাতকে দেখে গেল।রাহাত আরাফাতের জ্বর মাপলো আবারও।তারপর মাহাকে ডেকে বললো আরাফাতকে ভারী কিছু খাওয়াতে।মাহা আজ আরাফাতের জন্য সিম্পলের মধ্যে ডিমের পরোটা আর আলু,গাজর,টমেটো,শিম,বেগুন সব সবজি মিক্সচারে একটা রসরসে ভাজি বানিয়েছে।আর আগের ছিলো গরুর মাংসের তরকারি।সব সাজিয়ে নিয়ে এসে মিসেস মুমতাহিনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’মামণি আজ তোমার ছেলেকে বরং তুমিই খাওয়াও।আমি একটু ঘুরে আসি বাইরে থেকে।’

মিসেস মুমতাহিনা হেসে সায় দিতেই মাহা ল্যাগব্যাগ করতে করতে চলে গেল বাইরের দিকে।আরাফাত তাকিয়ে আছে মাহার যাওয়ার পানে।মনখারাপ হয়ে গেছে তার।তার কথা হলো,মাহা তাকে রেখে অন্য কোথাও না যাক।তার সাথেই থাকুক সর্বক্ষণ ছায়ার মতো।
মিসেস মিনারা মিসেস মুমতাহিনার দিকে তাকিয়ে বললেন,’বুঝলে আপা,মেয়েটা আমার আর বড় হলো না।এত দূরন্তপনা করতে কতবার মানা করেছি।কিন্তু কে শুনে কার কথা!মেয়েটা বাচ্চাই রয়ে গেছে।’

-‘করুক বাচ্চামো,মাহা গম্ভীর হলে তাকে মোটেও মানাবে না।এমনই থাকুক সবসময় মেয়েটা।ও আসার পর থেকে তো আমার টেনশন দূর হয়ে গেছে।আমার ছেলেটাও এখন সুস্থ হওয়ার পথে।দক্ষ হাতে স্বামীর সংসার করছে মেয়েটা।ইশুর মতো সেও আমার ঘর আলো করে এসেছে।আমার সংসার এখন ভরপুর।সব সোনায় সোহাগা!’

মিসেস মুমতাহিনা মিসেস মিনারার সাথে কথা বলে বলে আরাফাতকে ভাজি পরোটা খাওয়াচ্ছেন।আরাফাত নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে।কোনো কথা বলছে না।মন খালি মাহার কাছে যাওয়ার জন্য আকুপাকু করছে।এই মনটা এত লাগামহীন কবে থেকে হলো জানে না সে।তাও মানতে চায় না আরাফাত সে যে মাহাকে ভালোবেসে ফেলেছে।মনটা বড্ড দোটানায় ভুগছে।
__________

বাগানবাড়ি নামটা সার্থক,প্রায় ১৫ শতক জায়গার ওপর ৭ টি রুম,হলরুম,ডাইনিং রুম,বাথরুম,বেলকনি বিশিষ্ট একতলা বাড়ি সাথে খালি জায়গা গুলোতে অসংখ্য বড় বড় গাছগাছালি গর্বের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।বাড়িটা জনাব এরশাদ ওনার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য কিনেছিলেন যখন সাইফ মাত্র ৫ বছর বয়সের শিশু ছিলো।

আমগাছ,জামগাছ,কাঁঠালগাছ,বরইগাছ,সুপারি গাছ,নারিকেল গাছ,কৃষ্ণচূড়ার গাছ,জামরুল গাছ,পেয়ারা গাছ,পেঁপে গাছ এই গাছগুলো সারা বাড়ির কোণায় কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।জনাব এরশাদ যখন জায়গাটা কেনেন তখনও এই গাছগুলো ছিলো।শুধু ঘর যেখানে তোলা হয়েছে সেখানের বড় বড় তিনটা গাছ কাটিয়েছেন।নয়তো বাকি সবগুলো রয়েছে,কাটবার আর প্রয়োজন পড়ে নি।

মাহা,আনিশা,লিসা,নিসা ওরা চারজন পুরাতন বরই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে পাথর দ্বারা ঢিল ছুঁড়ছে বরই পাড়ার জন্য।আধাপাকা বরইয়ের জন্য গাছের পাতা দেখা দায়।মাহা কোথা থেকে একটা চিকন বাঁশের কোঠা নিয়ে এলো।তারপর গাছের ডালে দিলো এক বারি।বৃষ্টির মতো ঝড়ে পড়লো বেশ কতগুলো বরই।লিসা,নিসা,আনিশা খুশিমনে তা টুকিয়ে নিচ্ছে মাটি থেকে।মাহা আর পাড়লো না।যতটুকু পড়েছে ততটুকুই এনাফ।আর লাগবে না।গাছের ডালের সাথে ঠেস দিয়ে বাঁশের কোঠা রেখে হাত ঝেড়ে আনিশার কাছে এলো সে।লিসাকে আদেশ করে বললো ঘর থেকে লবন মরিচ নিয়ে আসতে।লিসা দৌড় দিলো বাসার ভেতর লবন মরিচ আনতে।

মাহা বরই খেতে খেতে বললো,’আহ,খুব স্বাদ তো!ভীষণ মজা লাগছে খেতে!’

আনিশা টিপ্পনী কেটে মুখ চেপে হেসে বললো,’তা লাগবে না,তোমার তো আবার শ্বশুর বাড়ির বরই বলে কথা।তিতা হলেও তো মজা লাগবে কী বলো নিসা!’

-‘একদম!’ নিসা হেসে বললো।মাহা চোখ রাঙানি দিয়ে বললো,’বেশি পেকে গেছিস দুটো!তোদেরকে দ্রুত বিয়ে দিতে হবে দেখা যাচ্ছে।এত পাকা কথা কীভাবে বলিস!’

-‘ওওওও হ্যালো মিসেস আরাফাত,আমরা ছোট নই বুঝতে পেরেছো!এখন বিয়ে দিলে পরের বছর বাচ্চা জন্ম দেয়ার ক্ষমতা রাখি আমরা!কী বলো নিসা?’

আনিশার কথায় দাঁত কেলিয়ে হাসছে নিসা।হাসতে হাসতেই সায় জানিয়ে জবাব দিলো সে,’সত্যিই তো বলছো আপু!’

-‘নিসার বাচ্চা!ওই বলদের কথায় সায় দিচ্ছিস কেন বারবার?চুপচাপ বরই খা!’ ধমক লাগালো মাহা।নিসা চুপসে গেল।লিসা তড়বড় করে দৌড়ে আসছে লবণ মরিচ হাতে।ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,’মাহা আপু!আম্মু বলেছেন তুমি কিছুসময় পর ভাইয়ার কাছে চলে যেতে।ভাইয়া বোরিং ফিল করছে।একা হয়তো ভালো লাগছে না তাঁর।’

মাহা বরই কয়েকটা আনিশার কাছ থেকে নিয়ে লবন মরিচ সামান্য হাতে নিয়ে বললো,’ওকে তবে তোরা থাক!আমি তোদের ভাইয়ের কাছে যাই।পরে সময় করে একসাথে আড্ডা দিবো নে!’

ওরা এখানেই থাকলো।মাহা চলে গেছে বাসার ভেতর।আরাফাত চুপচাপ আধশোয়া হয়ে বসে আছে।মাহা রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেল লিপি বসে আছে আরাফাতের পাশে।মানে এত্ত বেহায়া কেউ হতে পারে,কেমনে কী ভাই?এরকম চেহারা কালো করে কেউ কিছু বললে মাহা পরবর্তীতে তার ছায়াও মারায় না,সেখানে লিপিকে এত বেইজ্জতি করার পরও কীভাবে ও আবারও ঘেঁষাঘেঁষি করতে পারে?চরম বিরক্তিতে ছেয়ে গেল মাহার মুখ।লিপি যদি বেয়াদব,অহংকারী ও শয়তান টাইপের না হতো তবে মাহার তার সাথে কোনো শত্রুতা থাকতো না।মাহা যেচে কখনো কারও সাথে লাগতে যায় না যদি না তাকে কেউ খোঁচায়।

আরাফাত যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মাহাকে দেখতে পেয়ে।উজ্জ্বল দৃষ্টি মেলে মাহার দিকে তাকালো সে।মাহা আরাফাতের কাছে গিয়ে লিপিকে উদ্দেশ্য করে বললো,’এখন আপনি যেতে পারেন!আমি ওর সাথে একটু প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করবো।’

লিপি কিছু বলতে পারলো না।আরাফাতের কালকের ধমকের কথা এখনো মনে আছে তার।পাল্টা ধমক খেতে চায় না তাই বিনাবাক্যব্যয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

মাহা আরাফাতের সাথে বসে বসে গল্প করতে লাগলো।আরাফাতের বোরিংনেস যেন নিমিষেই হারিয়ে গেছে।একরাশ ভালোলাগা নিয়ে হাসিমুখে কথা বলছে আরাফাত।
___________

সারাটাদিন এভাবেই কেটে গেল।আজকে তেমন একটা আড্ডা হয় নি কারও মাঝে।আরাফাতের জ্বরের কারণে সব আনন্দ প্রায় ভেস্তে গেছে।

আরাফাত সারাদিন মাহার বুকে মাথা গুঁজে কাটিয়েছে।মাহাও রুম থেকে তেমন একটা বেরোয় নি প্রয়োজন ছাড়া।আরাফাতকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে সারাটা সময়।সন্ধ্যার পর আবার আস্তে আস্তে জ্বর ফিরে এসেছিলো আরাফাতের।তখন মাহা তাকে পরম ভালোবেসে আগলে রেখেছে।সেবাযত্নের কোনো কমতি রাখে নি।আরাফাত শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছে মাহাকে জড়িয়ে ধরে।

পরদিন,
আরাফাতের জ্বর বলতে গেলে ভালো হয়ে গেছে,শুধু শরীরটা খানিক দূর্বল।আজকে রাতে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করা হবে।তাই সকাল থেকেই এক অন্যরকম হাসিখুশির আমেজ সারা বাড়ি জুড়ে।ছেলেরা সবাই বাইরে উঠানে ঘাসের উপর মাদুর পেতে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।মেয়েরাও আছে।আজকে বাহিরে মাটির চুলায় দুপুরের সমস্ত রান্না করা হচ্ছে।মেয়েরা সেদিকেই ভীড় জমিয়েছে।

রিয়াজ বেচারা নওশিনকে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না একমুহূর্তের জন্য।বউকে নিয়ে তার টেনশনের শেষ নেই।নওশিনকে এদিকে যেতেও নিষেধ করে ওদিকে যেতেও নিষেধ করে,নওশিন তো পুরাই বিরক্ত।রিয়াজের এত্ত পসেসিভনেস দেখে মনে হয় বাচ্চা তার একাই হবে,আর কারও বাচ্চা নেই।রিয়াজের কথামতো বাহিরে একটা আর্মচেয়ারে চুপচাপ বসে আছে সে।তার পাশেই আছে রিয়াজ।বাকিরা সবাই গল্পে মত্ত।বড়রা সব পুরনো দিনের গল্প জুড়েছেন।তাই শুনছে বাকিরা।

মাহা বড় চিংড়ি মাছের শক্ত খোলস খুলছে চুলার একপাশে বসে।তাকে হেল্প করছে আনিশা।লিসা নিসা একটা একটা করে লাকড়ি সংগ্রহ করে এনে দিচ্ছে।ইশানী চুলার পাশে বসে সবার জন্য ডালের বড়া ভাঁজছে।তার সাথে আছে মুন্নি।ইরা তার ছোট্ট মেয়েটার জন্য তাদেরকে কোনো কাজে সাহায্য করতে পারছে না।লিপিকে মিসেস মুমতাহিনা ধনেপাতার ডাটা ফেলার কথা বলেছিলেন।সে মাত্র কয়েকটা ডাটা ফেলে ফোনে কথা বলার দোহাই দিয়ে পালিয়ে গেছে।আস্ত একটা কামচোর।

মিসেস মিনারা তরকারি কুটছেন বসে বসে।রিহাদ,পিয়াস আর জাওয়াদ এসে বারবার জিজ্ঞেস করে,’ও দাদি এটা কী?ও দাদি ওটা কী?’ ওদের এটা ওটার জবাব দিতে দিতে তিনি কাহিল।সবার মাঝেই এক অন্যরকম আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।পরিবারের সকলে একসাথে,এভাবে আড্ডা দিচ্ছে কথা বলছে,গল্প করছে এর চাইতে আনন্দের আর কী হতে পারে বলা যায়?

-‘এই যে নাও সবাই গরম গরম ডালের বড়া খাও সস দিয়ে!’ ইশানী বড় একটা বাটি নিয়ে এসে ছেলেদের আসরের মাঝখানে দিয়ে চলে গেল।সবাই হামলে পড়েছে বড়ার ওপর।আরাফাত সবার সাথে নির্নিমেষ কথা বলে যাচ্ছে।মনটা ভীষণ ফুরফুরে লাগছে তার।

মাহা পুরো গিন্নিদের মতো কাজ করছে।আরাফাত চোখ ফেরাতে ভুলে গেছে যেন।মাহার পরনে সাধারণ ডিজাইনের সেলোয়ার-কামিজ,ওড়না শরীরে জড়িয়ে গিট্টু বেঁধে কাজ করছে সে।তারপরও আরাফাতের চোখে সে অসাধারণ নারী,সরলতার প্রতিমা!সবাই আড্ডায় মেতে উঠলেও এখন আরাফাত ব্যস্ত আছে নিজের স্ত্রীকে দেখায়!এই দেখার শুরু আছে কিন্তু কোনো শেষ নেই।

আজকে সকলে বাইরেই দুপুরের খাবার সারলো। একসাথে বসে এমন একটা পরিবেশে মাটির চুলায় রান্না করা খাবার খাওয়ার মজাটাই আলাদা।এ এক অন্যরকম অনুভূতি।আরাফাতকে মাহাই গালে তুলে খাবার খাইয়ে দিয়েছে।ভাঙা হাত দ্বারা খাবার খাওয়াটা বড্ড অসুবিধাজনক।যার হাত ভাঙ্গে সেই বুঝে।

বিকালে রবি আর রাফি বাহিরে গিয়ে বারবিকিউর জন্য নানরুটি,মুরগী ১০ কেজি,বারবিকিউ সস,প্রয়োজনীয় সবকিছু বাজার সদাই করে নিয়ে এলো।বাসায় বাহিরে সাইফ আর রাহাত সবকিছু রেডি করছে।রবিরা বাজার সদাই নিয়ে আসলেই আসল কাজ শুরু হবে।

মাহার কোলে মাথা রেখে আরাফাত ঘুমিয়ে আছে।মাহা পলকহীন চোখে তার প্রিয়তম ভালোবাসাকে দেখে যাচ্ছে।এত দেখে তাও যেন তৃষ্ণা মেটে না।ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়!আরাফাতের মাথার চুলের ওপর আলতো একটা চুমু খেলো মাহা।আরাফাত শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।ঘুম নেই মাহার চোখে।সে আরাফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে।বারবিকিউর আয়োজনকৃত সব দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।রাহাত আর সাইফ দুজনেই ভীষণ ব্যস্ত।তাদেরকে সাহায্য করছে তাদের স্ত্রীরা।বাকিরাও আছে বাইরে,তবে তারা কাজের বদলে গল্প করছেন আরকি।

রবিরা সদাই করে নিয়ে এলো।সাইফ বসে বসে মুরগী বাছাই করছে।পাঁচটা মুরগী রেখে বাকিগুলো জেনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো কেটে পরিষ্কার করে ফ্রিজে রেখে দিতে।রাহাত বাজারের ব্যাগ থেকে একে একে সব বের করে দেখছে ঠিকঠাক সবকিছু নিয়ে এসেছে কি না।

আরাফাত ঘুম থেকে ওঠে গেলে মাহা তাকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করে, অতঃপর তাকে নিয়ে বাইরে চলে আসে।সকলে আবারও জড় হয়েছে সকালের মতো।রাফি আর সাইফ মিলে মুরগী কাটছে।জনাব এরশাদ বসে বসে টমেটো, পেয়াজ কাটছেন।সকল ছেলেরাই এসব কাজে ব্যস্ত একমাত্র আরাফাত ব্যতিত।আরাফাত একটা চেয়ারে বসে বসে সব দেখছে।কাজে সামিল হতে না পারলেও আনন্দে সামিল হতে পারছে সে।

লিসা, নিসা, লিপি, রবি ওরা গান ধরেছে।রাতের এই পরিবেশটাতে এমন খোলা কন্ঠে গান শুনতে বেশ লাগছে।সাইফ,রাহাত ওরা কাজে ব্যস্ত।ভাতিজা তিনটা দৌড়াদৌড়ি খেলা করছে অন্যপাশে।সবাই খুশি আনন্দে মশগুল।হাসাহাসি গল্প গুজব সাথে গান গাওয়া সব চলছে।ফ্যামিলি গেট টুগেদার যাকে বলে আরকি।

অনেক আড্ডা আর হাসি আনন্দের মধ্য দিয়ে বারবিকিউ পার্টি শেষ হলো।খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যে যার রুমে চলে গেছে সভা ভঙ্গ করে।অনেক রাত হয়ে গেছে।প্রায় বারোটা বেজে গেছে।আরাফাত আর চোখ খোলা রাখতে পারছে না।মাহা তাকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে এসেছে।

দুজন শুয়ে পড়লো বিছানায়।আরাফাত প্রচুর ক্লান্ত,তাই চোখ বন্ধ করতেই ঘুমিয়ে গেছে সে।অবশ্যই মাহাকে জড়িয়ে ধরে।নাহলে যে তার ঘুম আসবে না।এটা বলতে গেলে এমন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে এই অভ্যাস ছাড়া থাকাটাই মুশকিল।মাহা ঠোঁট দ্বারা আরাফাতের কপালে গভীরভাবে স্পর্শ করলো।পরম আবেশে তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো সে।গভীর নিদ্রায় ডুবে গেল কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে