অনূভুতি পর্ব-০১

0
2731

#গল্পের_নাম_অনূভুতি
#লেখনীতে_Alisha_Rahman_Fiza
পর্বঃ১

~মা আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করবো।আর যদি তা না হয় তাহলে আমার কানের কাছে আর কোনোদিন বিয়ে বিয়ে করে ঘ্যানঘ্যান করতে পারবে না।

আবরার একনাগাড়ে কথা গুলো বলে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো আর তার মায়ের দিকে তাকালো।আবরারের মা জাবেদা বেগম তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আবরার এতে ভীষণ বিরক্ত হলো।বিয়ের কথাই তো বলেছে সে তাহলে এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে টা কী?আবরার তার মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে হাতে থাকা খামটি বিছানার পাশের টেবিলে রেখে বললো,
~সময় হলে এই খামটি খুলে দেখো।
এতটুকু বলে আবরার আর এক মূর্হুত সেখানে দাড়ালো না দ্রুত পা চালিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলো সে।আসলে তার এখন লজ্জা লাগছে নিজের বিয়ের কথা নিজে বলতে তার অস্তত্বি লাগছিল।কিন্তু মনের সাথে সে আজ লড়তে পারলোনা নিজের মনের কথা আজ মায়ের সামনে বলে দিলো।

অন্যদিকে জাবেদা বেগম ছেলের কথা শুনে অন্য জগতে চলে গেছে।সে ভাবছে যে ছেলে কখনো মা ছাড়া কিছু করেনি সে আজ নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে ঠিক করে ফেললো।জাবেদা বেগম বিছানার পাশে থাকা টেবিলটি থেকে খামটা নিয়ে তা খুলে দেখলো একটা যুবতী মেয়ের ছবি মেয়েটার মায়া চেহারা দেখে তার মনটা নিমিষেই গলে গেল।ফর্সা না হলেও মেয়েটার চেহারার ধরণটা অনেকটাই সুন্দর শাড়ি পরা অবস্থায় মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে।জাবেদা বেগম মেয়েটাকে খুব ভালো করে পরোক্ষ করলো ছবিটা হয়তো মেয়েটার
অগোচরে তোলা খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।
ছবির পিছনটা ঘুরিয়ে দেখলে তাতে মেয়ের নাম-পরিচয় সবই আছে।ছেলে তার পাক্কা খেলোয়াড় সব কিছু জেনেশুনে তারপর মেয়েটার কথা বলেছে।
জাবেদা বেগম সযত্নে ছবিটা খামের ভেতর রেখে আলমারি খুলে রেখে দিলেন তার ছেলে যদি এই মেয়েকে পছন্দ করেই থাকে তাহলে সেভাবেই সব কিছু হবে।

আবরার রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে ল্যাপটপে বসেছে সে।অফিসের অনেক কাজ পরে আছে তাই সম্পূর্ণ করতে বসেছে সে।ইদানিং তার কাজে মন বসে না তার প্রেয়সীর চেহারাটা তার সামনে ভেসে উঠে গত ৩মাস একটা মেয়েকে কতোটা আপন করে নিয়েছে সে।আচ্ছা মেয়েটা কী তার মনের অবস্থা বুঝবে?এতটুকু ভাবতেই আবরারের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে আসে মেয়েটা যে তার মনের অন্তর স্থলে এতোটা গভীর ভাবে মিশে যাবে তা সে জানতোনা।তিনমাস আগে তার অফিসেই মেয়েটার সাথে দেখা হয় মেয়েটি তার কলিগেরই বোন সেই সাক্ষাৎই যে আবরারের জীবনকে পাল্টে রেখে দিবে তা সে জানতো না।এতসব চিন্তার মাঝেও সে খুশি কারণ তার সকল চিন্তা তার প্রেয়সীকে ঘিরে।

বারান্দায় দাড়িয়ে ফুলের টপে পানি দিচ্ছে আর আকাশপাণে তাকাচ্ছে এক যুবতী।শাড়ির আঁচলটা ফ্লোর ছুঁইছুঁই অবস্থা ঘন কালো চুল গুলো খোলা অবস্থায় বাতাসে উড়ছে। ফুলগুলোতে পানি দিয়ে আলতো হাতে ছুয়ে দিলো ।মুচকি হেসে আকাশপাণে তাকিয়ে থাকলো যুবতী বিকেলের আকাশটা তার বরাবরই অনেক পছন্দ নীল আকাশটা দেখতে তখন ভারী সুন্দর লাগে।যুবতী যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ব্যস্ত তখনই পিছন থেকে একজন মেয়েলিকন্ঠে বলে উঠলো,
~আরফি,মা তোমায় ডাকছে।
এমন কথা শুনে যুবতী আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে পিছন ঘুরে তাকালো সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে তার ভীষণ ভালো লাগলো সম্পর্কে তারা ভাবি-ননদ কিন্তু ভালোবাসা তাদের মধ্যে বোনদের মতো।
আরফি হেসে বললো,
~কী ভাবি আজ মা আমায় ডাকতে তোমাকে পাঠালো কেন?
আরফির এমন সন্দিহান কথায় ভড়কে উঠলো আরফির ভাবি রুকাইয়া তবুও আরফিকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
~আরফি তুমি না দিন দিন বড্ড দুষ্ট হয়ে যাচ্ছো।মা তোমাকে এভাবেই নিচে ডেকেছে আর শোন আমার লক্ষ্মীটি মাথায় শাড়ির আঁচলটা সুন্দর করে নিবে।
রুকাইয়ার কথা শুনে আরফির বুঝতে বাকি রইলোনা তার মা আজও কোনো ঘটকের খোঁজ পেয়েছে তাকে নিয়েই বাসায় উপস্থিত হয়েছে।আরফি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুকাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
~তুমি যাও ভাবি।আমি আসছি
রুকাইয়া আর দেরি করে না সে রুম থেকে বের হয়ে নিচে চলে আসে।

আরফি আয়নার সামনে দাড়িয়ে মাথায় কাপড় দিলো।আর মনে মনে বললো,
~মা সবসময় তার বিয়ে নিয়ে এতো চিন্তিত থাকে কেন?সে তো ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে না সবেমাত্র কলেজের গন্ডিতে পা রেখেছি আর এখনই নাহ বাবাকে বিষয়টা বলতে হবে।
আরফি নিজেকে ঠিকঠাক করে নিচে নেমে আসলো। হলরুমের কাছাকাছি পৌছেই আরফির কানে তার মায়ের গলার কন্ঠ শুনতে পেলে।হলরুমে প্রবেশ করে দেখতে পায় একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বসে আছে মুখে পান দিয়ে আরফি এতে আরো বিরক্ত।আরফির মা সায়েদা খানম মেয়েকে দেখে বললেন,
~এই তো আমার আরফি এসে পরেছে।
আরফি মায়ের কথা শুনে সামনে এগিয়ে মহিলাটিকে সালাম দিলো।ঘটক মহিলা বললেন,
~আপা মেয়ে তো ঠিকঠাক আছে তা আমার হাতে কিছু ভালা পোলা আছে আপনি চাইলে
আরফি আর শুনতে চায়না তাই সায়েদা খানমের দিকে তাকিয়ে বললো,
~আমি রুমে যাচ্ছি।
বলেই গটগট করে রুমে চলে আসলো আর ধিরিম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো জেদের বসে শাড়ি খুলে কামিজ পরে নিলো চুলগুলো হাত খোপা করে পড়ার টেবিলে বসে পরলো।

সন্ধ্যা নেমে আসছে আবরার নিজের সমস্ত কাজ শেষ করে। রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে আসলো এক গ্লাস পানি পান করে সে আবার নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো।আবরার দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো আর সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে মুচকি হেসে বললো,
~কীরে বোনু আজ এতো দেরি হলো যে?
আবরারে ছোট বোন অবনি ভাইয়ের কথা শুনে ক্লান্তি ভরা মুখ নিয়ে বললো,
~আজ ভার্সিটি তে অনেক কাজ ছিলো তাই লেট হয়ে গেছি।
আবরার বললো,
~ভিতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।
অবনি মাথা নেড়ে ভিতরে প্রবেশ করলো তারপর সোফায় বসে বললো,
~তুমি এসময় বাড়িতে অফিস নেই?
অবনির কথায় আবরার বললো,
~আজ হাফ ডে করেছি বাকি কাজ বাসা থেকে করবো।
ভাইয়ের কথায় অবনি একটু অবাক হয় তার ভাই তো কাজের প্রতি অনেক কেয়ারফুল অফিস তো মিস করে না। তাহলে আজ এমন কী হলো যে হাফ ডে করে বাসায় চলে আসলো।অবনি আবরারকে নিয়ে আর ভাবলোনা শরীরটা তার ক্লান্ত তাই সে ধীর পায়ে হেঁটে তার রুমের দিকে চলে যায়।
অবনি চলে যেতেই আবরার মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ায়। মা যে তার একমাত্র ভরসা বাবাকে হারিয়েছে সেই ছোটবেলায় তখন থেকে মাকে ছাড়া সে এক কদম চলে নি। আবরার জানে তার মা খুশি হবে তার প্রেয়সীর ছবি দেখে আর মাকে ছাড়া সে তার প্রেয়সীকে বিয়ে করতে পারবে না।

আরফি তার বাবার সামনে মাথানিচু করে দাড়িয়ে আছে।আরফির বাবা কবির আহমেদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে কিছু বলতে চাইছে তার মেয়েটা কিন্তু জড়তার কারণে বলতে পারছেনা।কবির আহমেদ মাত্র ফিরেছে তার দোকান থেকে এসেই মেয়ের সাথে দেখা হয় তার।কবির আহমেদ আলতো করে বললো,
~আরফি কিছু বলতে চাও?
আরফি এবার মাথা তুলে তাকালো বাবার দিকে আরফির লজ্জা লাগছে কিন্তু তার যে বলতেই হবে তাই আরফি একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
~বাবা,মা আমার বিয়ে কেন দিতে চাইছে?আমি তো মাত্র কলেজের গন্ডিতে পা রাখলাম।
কবির আহমেদ মেয়ের এমন অভিযোগ শুনে অনেকটাই বিচলিত।সে তো ছেলের মতো মেয়ে কেও উচ্চশিক্ষিত করতে চায় যেটা তার সহধর্মিণীও জানে তাহলে এমন কেন করছে?
কবির আহমেদ আরফির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
~আমি ব্যাপার টা দেখছি তুমি যাও দেখো তোমার ভাই ফিরেছে কি না?
আরফি বাবার কথা শুনে গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলো।আরফি চলে আসলো তার ভাবির কাছে রুকাইয়া শরবত বানাচ্ছে আরফি রুকাইয়ার পিছে দাড়িয়ে বললো,
~ভাবি,মা কোথায়?
আরফির কথা শুনে রুকাইয়া হাতের চামচ টা ছেড়ে দিলো আরফির দিকে ফিরে বললো,
~আরে মা তো ৩য় তলায় গিয়েছে আন্টির সাথে দেখা করতে।
আরফি তার ভাবির পাণে তাকিয়ে বললো,
~ভাইয়া কখন আসবে?
রুকাইয়া মিহি কন্ঠে জবাব দিলো,
~এই তো এসে পরবে।
আরফি মুচকি হাসে তার ভাবির লজ্জা এই ১ বছরেও কাটেনি এখনও সে ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে এমনই লজ্জা লজ্জা ভাবে জবাব দেয়।

রুকাইয়ার সাথে কথা চলছে আরফির তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো।রুকাইয়া কলিংবেলের শব্দ শুনে কেঁপে উঠলো তা দেখে আরফি হেসে বললো,
~যাও তোমার প্রাণ প্রিয় স্বামী এসে পরেছে।এখন আর এই তুচ্ছ ননদিকে মনে করতে হবে না।
রুকাইয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বললো,
~তুমিও না দিন দিন দুষ্ট হচ্ছো।
এতটুকু বলে রুকাইয়া দৌড়ে চলে যায় আর আরফি খিলখিল করে হেসে উঠলো।
রুকাইয়া দরজা খুলে দেখতে পেলো তার স্বামী সাহেব আরফান ক্লান্ত শরীর নিয়ে দাড়িয়ে আছে।আরফান রুকাইয়াকে দেখে হেসে বললো,
~আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলে বুঝি?
রুকাইয়া মুখ বাকিয়ে বললো,
~আপনার জন্য অপেক্ষা করতে আমার বয়েই গেছে।
আরফান ফিচেল হেসে ভিতরে এসে পরলো রুকাইয়া তার সামনে দাড়িয়ে বললো,
~ফ্রেশ হয়ে আসেন শরবত দিচ্ছি।
আরফান রুকাইয়ার এক গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে রুমে চলে গেলো।রুকাইয়া লজ্জা পেয়ে রান্নাঘরে চলে আসলো।

আরফির পরিবার একসাথে রাতের খাবার খেতে বসেছে।তখনই কবির আহমেদ তার সহধর্মিণী সায়েদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
~আরফির বিয়ে নিয়ে ভাবতে কে বলেছে তোমায়?
সায়েদা একটু অবাক হলো স্বামীর কথা শুনে তবুও নিজেকে ঠিক রেখে বললেন,
~আমি আরফির মা ওর কথা আমিই তো ভাববো।
কবির আহমেদ আর সায়েদা খানমের কথা শুনে আরফান বলে উঠলো,
~মা আরফির বিয়ের কথা কে ভাবতে বলেছে তোমায়?এখনও আরফি ছোট
ছেলের কথা শুনে সায়েদা খানম আরো রেগে উঠলেন আর বললেন,
~আরফান তোকে এসবে পরতে হবে না।
আরফান বললো,
~আরফি আমার বোন মা আর
পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে সায়েদা খানম বললেন,
~আমি আর তোর বাবা মরে গেলে কী আরফিকে ততোটাই আগলে রাখবি তুই?তখন তো দূরদূর করে তাড়িয়ে দিবি যেমন তোর মামা আমার সাথে করেছে।আমার মেয়েকে আমি কারো ভরসায় ছেড়ে যেতে চাইনা।একনাগাড়ে কথা গুলো বলে সায়েদা খানম উঠে পরলেন।কবির আহমেদও সহধর্মিণীর পিছে চলে আসলেন।পুরো ঘটনায় আরফি আর রুকাইয়া নিশ্চুপ আরফান এখন স্তব্ধ তার মা যে তাকে সেই মামার সাথে তুলনা করেছেন যাকে মামা ডাকতেও তার ঘৃণা হয়।আরফান একবার আরফির দিকে তাকিয়ে প্লেট ঠেলে উঠে পরলো তার আর খাওয়ার শখ নেই।
রুকাইয়া আর আরফি কোনো কথা বললো না তারা তাদের কাজ করে রুমে চলে গেলো।আরফি বিছানায় শুয়ে সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে তার চোখের কোণ বেয়ে পানি পরছে তার ভাই যে তাকে কতোটা ভালোবাসে তা সে জানে।রাতটা আরফি সজাগ হয়েই কাটিয়ে দিলো নানান ধরনেক দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরেছে।

অন্যদিকে আবরারও সজাগ হয়ে আছে তার মা যে প্রেয়সীকে দেখতে চেয়েছে কালই তারা যাবে প্রেয়সীর বাসায়।উফফ এই রাতটা কেন কাটছেনা আজ একবারও সে তার প্রেয়সীকে দেখতে পাইনি।মনটা কেমন আনচান করছে তার।আগে যদি জানতো এমন হবে তাহলে মাকে নিয়ে সেইসময়ই চলে যেতো।
একদিকে আরফি নিজের দুঃখের কথা ভেবে ভেবে কাঁদছে আর রাত কাটাচ্ছে আর আবরার তার প্রেয়সীকে মনে করে ভালোবাসার রঙ্গিন পৃথিবী সাজাচ্ছে কে জানে তাদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে