অনুভবে ২ পর্ব-৪৪+৪৫

0
534

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা তাকাল সভ্যের দিকে। ঘৃণা শব্দটা শুনে তার এই মুহূর্তে সভ্যের মনের অবস্থা জানতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সভ্যের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও পড়তে শুরু করল,
পৃষ্ঠা-৮৯ঃ গতকাল তিনমাস পর বলেই দিয়েছি সভ্যকে যে ওকে আমি কতটা ঘৃণা করি। ওকে আমার সহ্য হয় না। ওর সাথে থাকতে দম আটকে আসে আমার। আরও অনেক কথা শুনিয়েছি যে ওর কারণে কীভাবে আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। ওর মুখে বিস্ময় ও পীড়া স্পষ্ট দেখতে পারলাম আমি। কিন্তু ও কিছু বলল না। চুপচাপ শুনলো। রাগ উঠার কারণও আছে আমার। অযথা জ্ঞান দিতে এসেছিল। আমি যা করছি তা ভুল। আজকাল সারাক্ষণ এই কথাই কানের কাছে এসে বিড়বিড় করে। বাবার হয়তো ঠিকই বলতো, সভ্য আমার ভালো দেখতে পারে না, নাহলে আমার এত উন্নতি দেখে ও খুশি হতো না? ওকে এত জ্ঞান দিতে কে বলেছে? আমার বাবার থেকে তো ও আমার বেশি ভালো বুঝবে না তাই না?
কিন্তু কেন যেন ওকে এভাবে কষ্টতে দেখে আমারও কষ্ট হচ্ছে। ওকে তো আমি এখন আর বন্ধু মনে করি না, তাহলে ওর মন খারাপে আমার কি আসে যায়?
পৃষ্ঠা-৯০ঃ সেদিন সভ্যকে আমার মনের কথা বলার পর সে আর আমার সাথে কথা বলে নি। আমাকে আসলে বন্ধু ভাবলে এমনটা করতে পারতো ও? এসে কথা বলার তো চেষ্টা করতো। ও কখনো একটা ভালো বন্ধু ছিলোই না। অন্তত ও ভাবে নি।
পৃষ্ঠা-৯১ঃ আমাদের দুইজনের মধ্যে আজ ঝগড়া হয়েছে, মারামারিও হয়েছে। কারণটা বড় ছিলো না। গানের লিরিক্স নিয়ে ঝগড়াটা হলো। আসলে ঠিক তা না, গানের লিরিক্স তো এক বাহানা ছিলো। আমরা একে অপরের উপর নিজেদের রাগ, ক্ষোভ বের করছিলাম।
পৃষ্ঠা-৯২ঃ রাধিকাও একজন গায়িকা। ওর সাথে নতুন সম্পর্কে আছি। এই এক বছরে কতজনের সাথে এমন সম্পর্কে আছি জানি না। সব বাবার বাছাই করা। এখন আর কারও প্রতি ফিলিংস আসে না। আমার অনুভূতি অনেক আগেই মরে গেছে। কিন্তু মেয়েটা অন্যের সম্মান করতে জানে না। আমার কী? মেয়েরা সুন্দর হলেই চলে। তারা সুন্দর থাকলেই যেকেউ তাদের প্রেমে পড়ে যায়। আর একটি সুন্দর মেয়ে সাথে থাকলে আর কি লাগে। সবাই তোমাকে দেখে হিংসা করবে, জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আমি এই মুহূর্তে ব্যালকনিতে বসে ডায়েরি লিখছি আর সিগারেট খাচ্ছি। রাধিকা বিছানা থেকে উঠে তৈরি হচ্ছে। এখন চলে যাবে। তারপর হয়তো অন্য কাওকে ডেকে নিব বাড়িতে, নাহলে কোথাও যেয়ে বসবো। আর আমি কোথাও গেলে মানুষের অভাব হয় না আমাকে ঘিরে রাখার জন্য। আর আমার একা থাকা পছন্দ না।

ইনারা কয়েক পৃষ্ঠাবাদ দিয়ে গেল ১৭৬ নং পৃষ্ঠায়।
পৃষ্ঠা-১৭৬ঃ এই মুহূর্তে আমি এই বাড়িতে একা। এই স্থানে আমি একাই থাকি। বাসায় যেতে অশান্তি লাগে।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। কান্না পাচ্ছে খুব। কিন্তু আমার কান্না মুছার জন্য কেউ নেই। এই জীবন তো আমি চাই নি। কখনো চাই নি। আমি চেয়েছিলাম সারাজীবন আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে হাসিখুশি থাকতে। কিন্তু আজ আমার জন্মদিনেও আমার পাশে কেউ নেই। না পরিবার, না বন্ধুরা। আর ভালোবাসা তো আমার জন্য কেবল খেলা মাত্র। আমার সামনে কেবল একটি জন্মদিনের কেক রাখা। আর কোলে গিটার। এখন আর সিকিউরিটির জন্য ঘর থেকে বের হওয়া মুশকিল। কাজ থেকে ঘর এবং ঘর থেকে কাজ। এই রুটিনেই বাঁচছি। আমার তো মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় আসলে বেঁচে আছি আমি? সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। কেন হয়েছে আমি জানি না। কিন্তু আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। মা’য়ের জন্য আমার বাবার সব প্রত্যাশা পূরণ করতে হয়। আমি যত চেষ্টা করি তার প্রত্যাশা আরও বাড়ে। এতটা আমি নিতে পারছি না। আর কী করব আমি? আমার আদরের ছোট বোন আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। আমার বন্ধুদের আগের মতো আর আপন মনে হয় না। তাদের থেক ভিন্ন লাগে নিজেকে, ফ্যানদের জন্য নিজেক পার্ফেক্ট সাজাতে সাজাতে আমি ক্লান্ত, হেটার্সদের কথা শুনে মনে হয় আসলেই আমি নিজের স্বপ্ন গড়তে ব্যর্থ। আমি সব হারিয়েছি কেবল, কিন্তু অর্জন করতে পারি নি। আচ্ছা মরে গেলে কি এসবের সমাপ্তি ঘটবে?
পৃষ্ঠা -১৮০ঃ জানি না আমার কি হয়েছিল। নিজেকে মেরে ফেলে ফেলতে চেয়েছিলাম। বাবা আবারও তার নিরাশা ব্যক্ত করলেন, আমার মতো অযোগ্য ছেলে কেন তার কপালেই জুটল! এই কথা সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সারাদিন বাসায় থেকে জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করলাম। অবশেষে রাতে হঠাৎ করে কিছু না বুঝেশুনে অনেকগুলো স্লিপিং পিল খেয়ে নিয়েছিলাম। সামি হঠাৎ এসেছিল। ও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ব্যাপারটা কেউ জানে না। বাবা ও সামি ছাড়া। বাবা আমাকে কেয়ার দেখানোর পরিবর্তে ধমক দিলেন এবং এই কথা কারো কানে না যায় তার ব্যবস্থা করলেন। এরপর মানসিক ডাক্তারের কাছে সামি নিয়ে গেল আমায়। কারণ এমনটা প্রথমবার নয়। যখনই আমি চিন্তায় বা কষ্টে থাকি। আমার এমন এট্যাক আসে। আর আমি নিজের জীবন নিয়ে সব শেষ করার চেষ্টা করি।

ইনারা আবারও ডায়েরি পড়তে শুরু করে। সামনের কি লেখা তা জানার জন্য মনের কৌতুহল জাগছে। এরপর কিছু খালি পাতা পায়। তারপর কয়েকপৃষ্ঠা পর লেখা থাকে,
পৃষ্ঠা-১৮১ঃ আজ অনেক বছর পর ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম। এ কয় বছরের জীবনে অনেক কিছু হয়েছে, কিন্তু ডায়েরি লেখার ইচ্ছা জাগে নি। আজ বিশেষ এক দিন। তাই ডাইরিতে বিশেষ এক ঘটনা লিখতে বসলাম। একটি মেয়ে আছে, নাম ইনারা। সাধারণ একটি মেয়ে। সাধারণ বললে ভুল হবে, মেয়েটা অসাধারণ। ওকে দেখেছিলাম বহুদিন আগে। মেয়েটা আমার জন্য পাগল ছিলো। সারাক্ষণ আশেপাশে ঘুরত। আমি তাকে পাত্তা দিতাম না। বিরক্ত লাগত আমার। মেয়েটা থাকতও ছেলেদের মতো। মেয়েদের এমন রূপ আমার কাছে বিরক্তিকর। কিন্তু এরপর কেন যেন ও হঠাৎ পরিবর্তন হতে শুরু করে। আমি জানতে পারি সভ্য মেয়েটাকে পছন্দ করে। আর কি লাগে আমার, অপছন্দের থাকা সত্ত্বেও মেয়েটার পিছে ছুটি আমি।

এক স্বপ্নচারিণীকে কনসার্টে দেখেছিলাম আমি। তাকে সেখানেই নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এত সুন্দর মানুষ হয়? মানুষ বললে ভুল হবে। ওকে পরীর মতো দেখাচ্ছিলো। সদ্য মেঘ চিরে আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো পরী দেখাচ্ছিলো। প্রথম নজরে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এর তাকে যেন আমি প্রায় স্বপ্নে দেখতাম। মেয়েটি ইনারাই ছিলো। সে ছেলেদের মতো পোশাক পরিধান করা ইনারা। তাকে এক পার্টিতে দেখে চিনতে পারি আবার। এখন ওকে আমার লাগতোই। কারণ হোক আমার স্বপ্নচারিণীকে পাওয়া, নাহয় সভ্যর কাছ থেকে ওর সব ছিনিয়ে নেওয়ার বাহানা। কিন্তু আজ আমি আর ওকে ওর সৌন্দর্যের জন্য পেতে চাই না। আজ ও ছেলেদের মতো থাকলেও আমার কিছু আসে যায় না। কারণ আজ আমি ওকে চাই। ওকে ভালোবাসি। আজ যখন মা’কে নিথর অবস্থায় দেখে আমি আবারও নিজের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম তখন ও আমার কাছে এলো, নিজের চিন্তা না করে আমার পাশে বসল। সযত্নে আমার হাতের কাঁচটি বের করে দিলো। আমি তাকিয়ে রইলার তার দিকে। ঠিক সে মুহূর্তে হঠাৎ আমার মনে হলো আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছে। হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেছে। ইনারাকে নিজ অজান্তেই খুব আপন মনে হতে শুরু করলো। এই প্রথম আমার মনে হলো আমার পাশে বসা মেয়েটাকে সারাজীবন এভাবে দেখে গেলেও তার দৃষ্টি ক্লান্ত হবে না। আমি এভাবে কারও জন্য অনুভব করি নি। কারও জন্য না। এবার ওকে আমার নিজের করে লাগতোই, আজ আর সভ্যকে হারানোর জন্য ওকে চাই না। ওকে ভালোবাসি বলে চাই। আজ ওর জন্য আমার যা আছে সব হারাতেও রাজি আমি।
পৃষ্ঠা-১৮২ঃ সভ্য অস্ট্রেলিয়াতে আছে। আর তার অপেক্ষায় তপস্যা করছে আমার ভালোবাসার মানুষটা। ওর অভিনেত্রী হবার ইচ্ছা। বাবার কথায় আমিও অভিনয়ে যাচ্ছি এই সুযোগে ওর কাছে আসার, ওর সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করছি। কী লাভ? ও তো ভালোবাসে অন্যকাওকে। আমার সাথেই এমন কেন হয়? আমি যা ভালোবাসি, যাকে ভালোবাসি, সব ও সবাই সভ্যের কপালে জুটে?
পৃষ্ঠা-১৮৩ঃ আমি থাকতে পারব না ইনারাকে ছাড়া। যেভাবেই হোক, ওকে ছাড়া আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ওকে আমার করেই ছাড়ব। যেভাবে হোক।
পৃষ্ঠা-১৮৪ঃ আজ সভ্য বাংলাদেশে এসেছিল। কোম্পানি থেকে জানতে পারি। ওর বাসায় এসে দেখি বাসা সাজানো। ইনারাকে প্রাপোজ করতো। কিন্তু ইনারাকে তো এখানে আসতে দেওয়া সম্ভব না। একবার ও সভ্যর মনের কথা জানলে ও কখনো আমার হতে পারবে না। ইনারার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই আমি। সেখানে ইনারা ছিলো না, সে ছিলো একটা ফিল্মের অডিশনে। কিন্তু ফোনের মাধ্যমে ঐশি ও ইনারার কথাকে এভাবে শুনালাম সভ্যকে যে ও বিশ্বাস করতে বাধ্য ছিলো ইনারা আমাকে ভালোবাসে। ওকে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার দোহাই দিয়ে সব ছেড়ে দিতে বললাম। ও দিলোও। ওর এত সুন্দর মতো গড়া ক্যারিয়ার ফেলে চলে গেল! আমি ঠিক করেছি তাই না? আই মিন ভালোবাসা ও যুদ্ধে সব সঠিক, তাই না?
পৃষ্ঠা-১৮৫ঃ আচ্ছা আমি কী সভ্যর সাথে ঠিক করেছি? আমি কেবল আমার ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলাম, ওর ক্যারিয়ার শেষ করতে চাই নি।
পৃষ্ঠা-১৮৬ঃ আমি ভেবেছিলাম সভ্য আমাদের জীবন থেকে চলে গেলেই ইনারাকে আমি পাব। অথচ চারমাস হয়ে গেল, এখনও ও আমাদের বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলেনি। উল্টো অন্যরকম হয়ে গেছে ও, এ তো সে ইনারা না যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম।
পৃষ্ঠা-১৮৭ঃ আজ আমি অনেক খুশি। আজ ছয়পাস পর ইনারা আমার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।
পৃষ্ঠা-১৮৮ঃ আজ, এত বছর পর, আমি বুঝতে পারছি সমস্যা সভ্যের ছিলো না, সমস্যা আমার ছিলো। এতটা বছর আমি আমার নিজের জীবন ধ্বংস করেছে। নিজের বন্ধু-বান্ধব, নিজের পরিবার, নিজের সুখ সব হারিয়েছি। কেবল আমার বাবার প্রত্যাশা পূরণ করতে। সে সবসময় বলতো, সে যা করছে আমার ভালোর জন্য করছে। না, সে আমার জন্য কিছুই করছে না। নিজের জন্য করছে। আমি তো কেবল তার হাতের পুতুল, যাকে সে যেভাবে মন চায় সেভাবে নাচাতে পারে। আমি তার ছেলে না, কেবল সে কাঠের পুতুল। নাহলে নিজের ছেলের খুশি কিছু সম্পত্তির লোভে এভাবে বিসর্জন দেয় কেউ? আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় পাড় করছিলাম আমি। ইনারা আমার সাথে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। এর থেকে সুখের আমার কাছে কি হতে পারে? অথচ বাবা আমাকে ডেকে এমন কিছু করতে বলল যা আমি কল্পনাও করতে পারি না। সে আমাকে বলল আমার আইজার সাথে মিথ্যা সম্পর্কে যেতে ভবে। আমি হতবাক। কিছুদিন পর ওর বোনের সাথে আমার বিয়ে আর আমি এই মিথ্যে সম্পর্কে জড়াব? অসম্ভব! কিন্তু ব্যাপারটা আমার চিন্তা থেকে অধিক কঠিন ছিলো। তারা বড় কিছু পরিকল্পনা করছিলো। সম্পূর্ণ ব্যাপার আমি জানতাম না। কিন্তু আজ আমি প্রথম নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। এই প্রথম বাবার বিরোধে কথা বলেছি আমি। কিন্তু আমায় আশ্চর্য করে বাবা আমায় বলল আমি তাদের কথানুযায়ী না চললে তারা ইনারাকে খুন করে ফেলবে। তাদের কথায় বিশেষ ধ্যান দেই নি। অথচ সত্যিই সন্ধ্যায় ইনারা জানায় আজ তার এক্সিডেন্ট হতে নিয়েছিল। অল্পর জন্য বেঁচে গেছে। কাজটা বাবা করিয়েছে। আমি বাবাকে অনেক অনুরোধ করেছি এসবে না জড়াতে। তার পা’য়ে ধরে ভিক্ষাও চেয়েছি। লাভ হয় নি। মানুষের মন গলে, পাষাণের না।
পৃষ্ঠা-১৮৯ঃ আজ শুরু হয়ে গেছে ছলনার আয়োজন। আর আজও আমার কিছু করার নেই। এ কয়দিন রাত জেগে কেবল ভেবেই গেছি কি করব। অবশেষে সামিকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি সভ্যকে। যাকে ইনারার থেকে দূর করার জন্য এতকিছু করেছি। অথচ আজ আমিই ইনারাকে তার কাছে পাঠাচ্ছি।হয়তো নিয়তিতে এটাই ছিলো। ইনারা কখনো আমার হবারই ছিলো না। সে তো সভ্যের কপালে লেখা ছিলো। আমি চেয়েও সে লেখা মেটাতে পারি নি। এবার সভ্য সময়ে আসলেই হলো। আমি ইনারা থেকে দূরে থাকতে পারব কিন্তু ওর ক্ষতি হতে দেখতে পারব না। ওর জানের বিনিময়ে আবারও বাবার কাঠের পুতুল হতে রাজি হয়েছি।
পৃষ্ঠা-১৯০ঃ আজ সব হয়ে শেষ হয়ে গেছে। ইনারাও চলে গেছে। আজকের দিনটি ইতিহাসের কালোরাতের মধ্যে একটি। আজ একটি নির্দোষ প্রাণ গেল, আমার ইনারার সম্মান নিয়ে সকলে প্রশ্ন তুলছে। আর আমি আজও চুপ করে আছি। আমার সামনে যখন ইনারা আহত অবস্থায় পড়ে ছিলো তখনো চুপ করে ছিলাম। ওর রক্ত দেখে আমার বুকেতে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও যাবার সময় বলছিল ও সবার থেকে প্রতিশোধ নিবে। আমি চাই ও আমাকে শেষ করে দিক। আমি এরই যোগ্য। যে পুরুষ তার ভালোবাসার মানুষটিকে রক্ষা করতে পারে না, যে নিজের মা ও বোনের জন্য স্টান্ড নিতে পারে না, যে নিজের ভাইয়ের মতো বন্ধুকে এতবছর ধরে কষ্ট দিয়ে এসেছে কেবল ঈর্ষা করে তার আবার বেঁচে থাকার হক আছে?
অবশেষে ও চলে গেছে সভ্যর সাথে। আমি ওর পিছু গিয়েছিলাম। আমার চোখের সামনে সভ্য তাকে কোলে তুলে নিলো। ওকে নিয়ে চলে গেল।

ইনারা কেঁপে উঠে। ডায়েরির এই পৃষ্ঠায় রক্তের মাখামাখি।

চলবে…

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা কেঁপে উঠে, ডায়েরির এই পৃষ্ঠায় রক্তের মাখামাখি দেখে। হঠাৎ তার চোখ ভিজে যায়। সে চোখের জল এক ফোঁটা যেয়ে পড়ে ডায়েরিটার উপর। সে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, “আমার জন্য জোহানের এতকিছু সহ্য করতে হয়েছে অথচ আমি না জেনে ওকে কত খারাপ কথা শুনিয়েছি।”
সামি জানায়, “ও যখন আমাকে মোশতাক এবং মামার কথা জানায়। তখন আমার বিশ্বাস-ই ইচ্ছিল না। তারপর আমি প্রিয় আর তোমার খবর নিউজে দেখি। আর সভ্যকে জানাই।” সামি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “জোহানকে আমি এখন মামার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেখছি। মামা এখন আর মামী বা ঐশীর উপর হাত তুলতে পারে না। জোহানও আগের বাসায় চলে গেছে। যদিও ঐশীকে আবার ওর ক্যারিয়ারের গড়তে দেওয়ার জন্য মামাকে মানাতে পারে নি কিন্তু ইরফানের সাথে ওর কথাতেই বিয়ে হয়েছে। যদিও এর জন্য ওঁকে মিঃ হকের জন্য দিনরাত খাটতে হয়েছে। তারপরও জোহান কেবল ইরফানকে বিয়ের আগে এতটুকু বলেছ যেন সে ঐশীর স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করে। ইনফ্যাক্ট ইনারা জোহান তোমাকে এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের হবার জন্য এতবার বলেছ কারণ ও তোমার চিন্তা করতো। কিন্তু পরে তোমাকে এতটা স্ট্রং দেখে তোমার জন্য খুশিও ছিলো। আর এটা সত্যি যে আজমল সাহেবের ব্যাপারটা জোহান মিডিয়াতে পৌঁছিয়েছে। সৌমিতা আন্টি ওকে জানিয়েছিল তোমার পরিবারের ব্যাপারে। ও চাইতো তুমি তোমার পরিবারকে ফিরে পাও।”
কথাগুলো শুনে ইনারার আরও খারাপ লাগে। সে ডায়েরিটা বিছানাতেই রেখে দেয়। আর পড়তে পারবে না সে।

সুরভি ডায়েরিটা উঠায়। নিজে পড়তে শুরু করে,
পৃষ্ঠা- ১৯১ঃ আজ আমার জীবনে কেউ নেই। এর দায়ী আমি। কিন্তু আবার নিজের জীবনটা সাজানোর দায়িত্বটাও আমার। আমি আবার নিজের জীবনকে সুন্দর করার চেষ্টা করব। কিন্তু আফসোস! এই জীবনে আর সভ্য ও ইনারা থাকব না। ওরা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাশে না থাকলেও সবসময় আমার সাথে থাকবে ওরা।
ঈর্ষা মানুষকে ধ্বংস করতে পারে, এটা কেবল শুনেছিলাম। দেখেও নিয়েছি। আইজাকে কেবল আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে বোন ওকে এত ভালোবাসে তার সাথে এমনটা কীভাবে করল সে?
আইজা উওর দিয়েছিল, কারণ তাকে বাধ্য করা হয়েছে। তার সাথে ইনারার তুলনা করে। তার মা, আমি এবং অনেক মানুষ তাকে বাধ্য করেছি। আমি হতবাক। তারপর আইজা জানায় যখন সে আমাকে প্রথম দেখে অনেক খুশি ছিলো ও। কিন্তু আমাকে তার রূপরঙ নিয়ে মজা উড়াতে শুনে। ইনারার সাথে তুলনা করতে শুনে। তখন থেকেই ওর মনে ইনারার প্রতি ঈর্ষা জাগ্রত হয়। আইজা তখন সুন্দর ছিলো, কিন্তু সে সৌন্দর্য চেনার ক্ষমতা আমার ছিলো না। আমি এখন বুঝতে পারছি, বাহিরের রূপ কেবল দৃষ্টিকে মুগ্ধ করে। আর মনের সৌন্দর্য জীবনকে পরিপূর্ণ করে।
আর আমি আইজার কথা বলার কে? ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে নিজের জীবন নিজেই নষ্ট করেছি আমি। নিজের ঈর্ষার জন্য আমি আমার ভাইয়ের মতো বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। সভ্য তুই যেখানেই আছিস না কেন আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিস। আমি তোর অপরাধী। এই জীবনে অনেক ভুল করেছি। ইনারা, সভ্য, মা, মৌ, আরও কতজনের সাথে। আমি কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় আফসোস হলো এই ভুলের জন্য সবার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে পারলাম না। আমার এই ভুল বুঝতে অনেক সময় লেগে গেল। একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে।

কিছু পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ইনারা যাবার পরের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। আর ইনারাকে এতবছর পর দেখে তার প্রতিক্রিয়া। সে পৃষ্ঠাগুলো বাদ দিয়ে সুরভি সভ্য ও ইনারার সাথে জড়িত পৃষ্ঠা পড়ল,
পৃষ্ঠা-২৩৫ঃ বাবা ইনারাকে জনগণের চোখে নিচু করার জন্য জঘন্য এক খেলা খেলল। সভ্যের নাম নিয়ে তাকে অন্যের ঘৃণার পাত্র করে তুলল। আমি তার উদ্দেশ্য জানতে পারার পর মলে গিয়েছিলাম, ওর সাহায্য করার জন্য। কিন্তু আমার এগিয়ে যাওয়ার পূর্বেই সভ্য ওকে এসে বাঁচিয়ে নিলো। আর মজার ব্যাপার হলো আমি আজ প্রথম জানতে পারতাম ওরা দুইজনে বিয়ে করে নিয়েছে। সামি আমাকে ব্যাপারটা জানায় নি। যাই হোক, আমি ওদের জন্য খুশি।

আসলে না, আমি ওদের জন্য খুশি না। ওদের একসাথে দেখে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করছিল। কষ্ট হচ্ছিল। দুইজনকে একসাথে একে অপরের কাছে দেখাটা আমার জন্য কঠিন ছিলো। কিন্তু এমন তো না যে ইনারাকে আমি আর কখনো নিজের করে পেতে পারব। তাই ওরা দুইজনই সুখে থাক।

পৃষ্ঠা-২৩৬ঃ কোম্পানি বন্ধ হওয়ার পর থেকে বাবা বাসাতেই থাকে প্রায়ই। কিন্তু এই দুইদিন খুব বাহিরে যাচ্ছে। কারণটা জানার জন্য তার রুমে ঢুকতে যেয়ে শুনতে পাই সে সভ্যের সাথে ভুল কিছু করার জন্য তাকে ডেকেছে এক কোম্পানির অফিসে। সে কোম্পানির লোকগুলো বাবার কথায় কাজ করছে। আমি বাবার সাথে সরাসরি এই বিষয়ে কথা বললে সে জানায়, এসব সে আমার জন্যই তো করছে। তার পরর তো এসব আমারই থাকবে। সভ্য আমার সব ছিনিয়ে নিয়েছে। আর সভ্য থাকতে আর কিছু আমি ফেরত পাব না। তাই ওর মরতে হবে। আমি কি করব বুঝতে পারছি না।

অনেকক্ষণ ধরে এই বিষয়ে ভেবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি এসব আমার কারণে হয় তাহলে সভ্যর স্থানে যা হয়, আমার হবে। সভ্যের স্থানে আমি যাব। অন্তত ওর জন্য একটা কিছু করতে তো পারব। সাইদকে বলেছি ওই কোম্পানিতে কল করে, হুমকি দিয়ে হলেও সভ্যর মিটিং ক্যান্সেল করতে। আমি আর কারও ক্ষতি হতে দিব না। যদি এই ক্ষতির কারণ আমি হই, তাহলে এই কারণ না থাকাই ভালো। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি, অপরাধ করেছি। যদি এই ভুলের মাশুল এভাবে দিতে হয়, তাতেও আমি রাজি।

সুরভি ডায়েরি বন্ধ করে নিলো। আর কিছু লেখা নেই এই ডায়েরিতে। এই মুহূর্তে কক্ষে সবাই নীরব। চুপচাপ। হঠাৎ ইনারা কান্না করে উঠে। মুখ হাত দিয়ে ঢেকে। সভ্যর পাশেই সে বসা ছিলো। সে ইনারার কাঁধে হাত রেখে তাকে বুকে ভরে নেয়।
.
.
সকাল আটটায় হুঁশে আসে জোহান। ঐশী সারারাত জেগে থাকার কারণে সে মুহূর্তে ঘুমিয়ে ছিলো। তাই কেবল সভ্য, ইনারা, সামি ও সুরভীই এলো জোহানের কক্ষে। তাদের দেখে জোহান চমকে উঠে। কক্ষে সবাই নীরব ছিলো। হঠাৎ সামি বলে উঠে, “তুই এই মুহূর্তে হাস্পাতালের বেডে এভাবে না থাকলে তোর কান্ডের জন্য এই মাইর দিতাম যে সারাজীবন মনে রাখতি।”
জোহান জোরপূর্বক হাসে। ইনারা ও সভ্যকে দেখে তার খানিকটা অস্বস্তি লাগছে। ইনারা আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করে, “এখন কেমন লাগছে তোমার?”
সামি মুখ বানায়, “হাস্পাতালের বেডে শুয়ে আছে, এক্সিডেন্ট করে। কেমন লাগতে পারে? এ কেমন প্রশ্ন?”
ইনারা সরু দৃষ্টিতে তাকায় সামির দিকে, “তুমি চাইলে তোমারও সেইম অবস্থা করে পাশের কেবিনে ভর্তি করাতে পারি।”
সামি সাথে সাথে সভ্যের পিছনে লুকায়। বিড়বিড় করে বলে, “জামাই বউ দুইটাই ডেঞ্জারাস।”
সভ্য কথাটা শুনে আড়চোখে তাকায় সামির দিকে। সাথে সাথে সামি বলে উঠে, “ইনারা আমরা বাহিরে যাই চলো।”
“কিন্তু… ”
“আমরা আবার পরে দেখা করতে আসবো। এখনের জন্য বাহিরে আসো।” সামি ইশারা করে বলে। ইনারা বুঝতে পারে সামি এমনটা সভ্য ও জোহানের একা কিছু কথোপকথনের জন্য বলছে। তাই সে রাজি হয়। তারা সবাই বেরিয়ে যায়। সভ্য ছাড়া।

সভ্য যেয়ে বসে জোহানের বেডের পাশের টুলে, “তুই একটা গাঁধা।”
সভ্যর মুখে প্রথম কথা এটা শুনে থতমত খেয়ে যায় জোহান। সে চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, “আমার এই অবস্থা দেখে তোর এই কথাটাই সবার আগে মাথায় এলো?”
“কোনো গাঁধা ছাড়া এভাবে কেউ নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে। তোর যদি কিছু হয়ে যেত?”
“তুই কীভাবে… ”
সভ্য জোহানের ডায়েরিটা তার পাশে রাখল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নম্র দৃষ্টিতে তাকাল জোহানের দিকে, “অন্তত একটা কিছু করতে চেয়েছিলি? তোর জন্য বছরের পর বছর আমি হেসেছি। তুই আমাকে ভিন্ন দেশে পরিবার দিয়েছিলি, তোর জন্য আমি এত ভালো বন্ধু পেয়েছি, তোর জন্যই আমি এই গানের জগৎ এ এসেছি, আর তোর জন্যই আমি…. ইনারাকে পেয়েছি।”
“তোদের আলাদাও তো আমিই করেছিলাম।”
এ কথা শুনে সভ্য চুপ করে যায়। জোহান বলে, “তুই নিজের রাগ আমার উপর বের করতে পারিস। আমি এরই যোগ্য।”
“তোর উপর রাগ তো আমার এজন্য যে তুই আমাকে কখনো আসলে বন্ধু ভাবিসই নি। এইজন্য কথাটা বলছি না যে তুই আমার সাথে এতবছর কথা বলিস নি অথবা আমার সাথে ঝগড়া করেছিস। এইজন্য বলেছি যে তোর জীবনে এত সমস্যা হয়েছে অথচ একটিবারও আমার সাথে এসে কথা বলার চেষ্টা করিস নি। প্রথমদিকে আমার সাথে এসে কথা বললে হয়তো আজ সব ঠিক ঠাকতো। যাই হোক, জীবনে আমাদের আবারও সুযোগ দিয়েছে। ফ্রেন্ডস?”
সভ্য হাত বাড়িয়ে দেয়। জোহান তাকায় তার হাতের দিকে। তার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। সেও এভাবে সভ্যের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সে সময়। হঠাৎ তার কান্না পেয়ে যায়। সে কাঁপানো গলায় বলে, “আমি তোর বন্ধুত্বের যোগ্য না। একটুও যোগ্য না কারো বন্ধুত্বেরও যোগ্য না। আমি তোর জীবন নষ্ট করার চেষ্টা করেছি। তুই কীভাবে আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াস?”
সভ্য উঠে যায় জোহানের কাছে। তার মাথায় হাত রেখে বলল,”তুই পাগল? এভাবে ভাবতে পারিস কীভাবে তুই? আমার জীবনে হাজারো মানুষ আসুক, তোর জায়গা আজ পর্যন্ত কেউ নিতে পারে নি। আমি জানি সময়ের সাথে সাথে আমাদের সম্পর্কে ফাঁটল পড়েছে কিন্তু আজও আমাদের হৃদয়ে একে অপরের জন্য আগের মতোই জায়গা আছে। তাইতো আজ এক দুই না ভেবে তুই আমার পরিবর্তে নিজে গিয়েছিলি। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।”
.
.
সাইদ বলে, “জোহান উঠেছে, আমি ওকে দেখে আসি।”
সুরভি বাঁধা দেয় তাকে, “এখন না ভাইয়া। একতো ডাক্তার তোমাকে রেস্ট নিতে বলেছে। আর জোহান আপাতত বিজি।” সে আবার সামির দিকে তাকিয়ে বলল, “সরি, আমি না বুঝে তার ব্যাপারে এতকিছু বলে ফেললাম।”
সামি মাথা নাড়ায়, “তুমি এতকিছু না বললে হয়তো আমি ডায়েরিটা আনতাম না। আর না তোমরা সব জানতে পারতে। ভালোই হয়েছে বলেছ।”
ইনারা জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা সামি তুমি আমাকে তো সবার আগে জানাতে পারতে তাই না? তাহলে সবকিছু আরও কত সহজ হয়ে যেত।”
“কী করব পার্টনার বলো? জোহান কসম নিয়েছিল আমার কাছ থেকে। কিন্তু সাইদ ভাইয়া আপনি এক্সিডেন্ট স্পটে কীভাবে গেলেন?”
“আসলে জোহান আমাকে একটা কোম্পানিতে কল করে কিছু কথা বলতে বলেছিল। ওকে ভীষণ রাগী দেখাচ্ছিলো। আর ফোনে কথা বলেও পরিস্থিতিটা ভীষণ অকপটে লাগলো তাই আমিও গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখি জোহানের গাড়ি এক স্থানে দাঁড়ানো। তার দিকে একটি বড় ট্রাক আসছিল। কিন্তু গাড়ি সরানোর চেষ্টাও করল না। আমি গাড়ি থেকে নেমে ওর সাহায্য করতে চেয়েছিলাম কিন্তু এরপর এক্সিডেন্টটা হলো। আমি বোধহয় এর মাঝেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমার আর কিছু মনে নেই।”

বাহির থেকে অনেক শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দ গুলো শুনে সামি, ইনারা ও সুরভি ক্যাবিন থেকে বের হয়। দেখে মিস্টার হক সাঈদ এর বাবার সাথে ঝগড়া করছেন। ইনারাকে রুম থেকে বের হতে দেখে সে রাগে ইনারার দিক ছুটে এলেন, “তুই…তুই আমার ছেলের এই অবস্থার জন্য দায়ী তাই না?”
“মামা শান্ত হন। ইনারা কিছু করে নি।” সামি বলল।
কিন্তু মিস্টার হক যেন কিছু শুনতে রাজি নয়।
“তোকে আমি ছাড়ব না। তুই আর সভ্য প্রতিশোধের জন্য আমার ছেলের জীবন নিয়ে খেলা করেছিস।”
মিস্টার হক ইনারার উপর হাত তুলতে নিলেই ইনারা তার হাত ধরে নেয়। কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় মিস্টার হকের দিকে, “আমি অথবা সভ্য আপনাদের মতো নই যে কারও জীবন নেবার চিন্তাও করব। আপনার ছেলের এই অবস্থার জন্য দায়ী কে জানেন? আপনি। কেবল আপনি। আপনি কি ট্রাককে সভ্যের এক্সিডেন্ট করার জন্য পাঠিয়েছিলেন, সে ট্রাক সভ্যের পরিবর্তে জোহানের গাড়িকে আক্রমণ করেছ। তো জোহানের এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী।”
“আ…আমি? জোহান আমার…” হতবাক হয়ে বলল্রন মিস্টার হক।
“হ্যাঁ আপনার জন্য জোহানের এই অবস্থা।” ইনারা বলে, ইনফ্যাক্ট আপনি কি নিজের ছেলের জন্য চিন্তায় আছন, না’কি নিজের টাকা ছাপা মেশিনের জন্য চিন্তায় আছন?”
“আমি আমার ছেলের কাছে যাচ্ছি। তোদের এসে দেখব।”
ইনারা মিস্টার হকের হাত সজোরে মোচড় দেয়, “কন্ঠ নিচু করে কথা বলুন, নাহলে এই কণ্ঠনালী একবারে টেনে আনব। আপনাকে জোহানকে দেখতে দেওয়া তো দূরের কথা, ওর আশেপাশেও যেতে দিব না। আর আপনি তো প্রস্তুতি নিন। জলদিই নিজের বন্ধুর কাছে জেলে যাচ্ছেন আপনি।”
ইনারা তাকে ধাক্কা দিয়ে হাত ছেড়ে দেয়।
মিস্টার হক ইনারার দিকে তাকিয়ে রয় রাগান্বিত দৃষ্টিতে। তারপর তাকে এড়িয়ে জোহানের কেবিনের দিকে যাওয়ার সময় সামি এসে দাঁড়ায় মাঝ রাস্তায়। মিস্টার হক আদেশ করেন তাকে, “সামি যেতে দে।”
“না মামা। অনেক হয়েছে। আর না। আপনি আর কোনোভাবে জোহানকে ব্যবহার করতে পারবেন না। এখন আর ও একা না, ওর সাথে ওর সকল বন্ধুরা আছে। আপনার যাওয়া উচিত।”
“ও আমার ছেলে।”
“যাকে আপনি কখনো ছেলের মতো ট্রিটই করেন নি। ও কেবল আপনার জন্য কাঠের পুতুল ছিলো। যাকে আপনি যেভাবে মন চেয়েছে সেভাবে নাচিয়েছেন। কিন্তু আর না মামা। আর না।”
মিস্টার হক রাগে সামিকে দেখলেন। আবার ইনারাকে দেখে সেখান থেকে চলে গেলেন।
.
.
“তোর না আজ বিয়ে তাহলে এখানে কি করছিস?”
জোহান জিজ্ঞেস করে সভ্যকে। কিছু সময় কথা বলার পর দুইজনের মাঝে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সভ্য বলে, “তোর এই অবস্থায় কী আমি বিয়ের অনুষ্ঠান করব না’কি? তুই সুস্থ হো তারপর অনুষ্ঠান করা যাবে।”
“আমি সুস্থ হলে? মানে তোর ইচ্ছা আমি যে মেয়েকে পছন্দ করতাম তাকে আমার বন্ধুর সাথে বিয়ে হতে দেখব? না, আমার এতো ভালো বন্ধুত্বও দরকার নাই।”
“ভালো কথা বলেছিস তো, এখন তো তুই বিয়েতে থাকলেই অনুষ্ঠানটা হবে।”
“আই গেস আমি আগামী পঞ্চাশ বছর এই হাস্পাতালেই থাকছি।”
সভ্য আর জোহান একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। জোহান বলল, “আজকের দিনটা কেবল তোর জন্যই না, ইনারা ও তোদের পরিবারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমার কারণে এই দিনটা নষ্ট করিস না, নাহলে আমি আরও বেশি কষ্ট পাব। আর তুই নিশ্চিন্তে যা, ঐশী ও ইরফান আমার সাথে থাকবে।”
“কিন্তু… ”
“কোনো কিন্তু না। ইনারা ও তুই এই দিনটির জন্য অনেক স্বপ্ন সাজিয়েছিস। আমার জন্য তোদের এই দিনটি নষ্ট হলে আরেকটি আফসোস থেকে যাবে আমার জীবনে।”
“আচ্ছা আমি তোর কথা মানব। কিন্তু একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”
“তুই আমাদের সাথে সেখানে থাকবি। তা হোক ফোন কলে।”
“তাহলে আমারও এক শর্ত আছে।”
“আর তা কী?”
“আমি জীবনেও ইনারাকে ভাবি বলে ডাকতে না।”
সভ্য জোরপূর্বক হেসে বলে, “আমি তোর বন্ধু মানে ইনারা তোর ভাবিই হবে।”
“দেখ এসব বললে এই বন্ধুত্ব আর রাখব না।”
“তাই না?” সভ্য জোহানকে দুষ্টুমি করে মারতে গেলে আসলেই জোহানের ক্ষত স্থানে লেগে যায়। জোহান শব্দ করে বলে, “উফফ জান বের হয়ে গেল।”
“সরি দোস্ত, সরি।”
এমন সময় দরজা খুলে ঢুকলো সামি ও ইনারা। ইনারা আতঙ্কিত সুরর বলল, ” শব্দ শুনেছিলাম। সব ঠিক আছে?”
জোহান সভ্যকে মৃদু কন্ঠে বলে, “দোস্ত দেখ জান বের হয়ে গেলেও ওকে আমি ভাবি ডাকব না।”
সভ্য সরু দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে। তারপর হঠাৎ দুইজনে হেসে দেয়।

ইনারা ও সামি হতভম্ব। ঠিক কি হলো তারা বুঝতে পারছে না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে