অনুভবে ২ পর্ব-৪৬ এবং শেষ পর্ব

0
662

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

অন্ধকার আকাশে তারাবাজি হচ্ছে। কৃষ্ণবর্ণ মেঘলা আকাশে রঙিন আলোর চমক দেখা যাচ্ছে। সুরভি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে উৎসুক গলায় ইনারাকে বলে, “ইনু উৎসব শুরু হয়ে গেছে। তারাবাজি হচ্ছে, গান চলছে, হৈ-হুল্লোড় হচ্ছে। নিচে দেখি দাদাজানও নাচছেন। দাদীজানকে হাত ধরে আনতে চাইলে সে তাড়িয়ে দিলেন।”
ইনারা শব্দ করে হাসে। তাকে সাজানো হচ্ছে। দুই তিনজন মিলে তাকে সাজাচ্ছে। কেউ চুল স্টাইল করে দিচ্ছে তো কেউ মেকাপ করেছে। আবার কেউ গহনা পরিয়ে দিচ্ছে।

তাদের হাস্পাতাল থেকে আসতে আসতে সন্ধ্যা হলো। ঠিক এ কারণেই এতটা দেরি। এতক্ষণে তাদের অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা ছিলো অথচ এখনো সে তৈরি-ই হয় নি।
সে সুরভীকে বলল, “যা দেখছিস লাইভ বলতে থাক। যেন আমি কিছু মিস না করি।”
“বাহিরে অনেক মানুষ দাঁড়ানো। তোর আর সভ্যের নাম চেঁচাচ্ছে। তোদের বিয়ের ভ্যানুউও খুঁজে নিলো। বাহ! এই দেখ প্রিয়’র বোন এসেছে। আন্টিকে নিয়ে।”
ইনারা অবাক হয়, “আমি ভাবি নি তারা আসবে।”
“তুই নিজে যেয়ে তাকে অনুরোধ করেছিলি আসতে। এখনো নিজের অতীতের জন্য অনুতপ্ত সে, একারণে সেদিন তোর সাথে ঠিকভাবে কথা বলে নি। কিন্তু সেও জানে এতে প্রিয়’র আত্না একটু হলেও শান্তি পাবে। এ’কি!”
শেষে সুরভির আঁতকে উঠা কন্ঠ শুনে ইনারা চমকে যায়, “কী হলো?”
“হঠাৎ এক বিশাল গাড়ি এসে থেমেছে ঠিক তাদের সামনে। এ কী ধরনের অভদ্রতা!”
“তুই নিচে যেয়ে তাদের নিয়ে আয় তো। আর জলদি আমার কাছে এসে পরিস।”
সুরভি তাই করে। সে নিচে যায়। নিচে নামতে যেয়ে তার ডাক পড়ে। ডাকটা দেয় সাঈদ, “সুরভি আমার হাতটা ব্যাথা করছে। কাওকে দিয়ে একটু মলম আর গরম পানি করে আন তো।”
সুরভি এবার বিরক্ত হয়। আজ আসার পর থেকেই সাইদ বারবার তাকে এভাবে ডেকে বিরক্ত করছে। তার মোটেও বেশি ব্যাথা লাগে নি। ডাক্তাররাও বলেছে সে অনেকটা সুস্থ। তবুও তাকে হাস্পাতালে থাকতে বলেছিল সুরভি। কিন্তু সে ইচ্ছা করে এখানে এলো। এখন এসে তাকে বিরক্ত করছে। সে বিরক্তির সুরে বলল, “ভাইয়া তোমার হাতে কিছু হয় নি। ডাক্তাররা পরিষ্কার বলেছে। তোমার পা’য়ে আর মাথায় একটু লেগেছে। তুমি অকারণে যদি আরেকবার আমাকে ডাকছ তাহলে এবার উঠায় একেবারে হাস্পাতালে ফিক্কা মারব। চুপ করে বসে বিয়ে দেখ।”
সুরভি রাগে বিড়বিড় করতে করতে বের হলো। আহনাফও গতকাল থেকে কল ধরছে না। কেবল মেসেজ দিয়ে বলল সে ব্যস্ত। গতরাতে ঘুম না হবার কারণে তার মেজাজ চওড়া। সব মিলিয়ে আজকের দিনটা তার কাছে বিরক্তিকর।
আশেপাশে সবাই নাচছিলো। এর মাঝে বের হতে তার কষ্টই হলো বটে। এর উপর তাকে একজন ধাক্কা দিতে নিলো। সরে এগোতে যেয়ে আরেকজনের ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ল সে। এমনিতেই তার মেজাজটা খারাপ। এর উপর পড়ে যাওয়ায় বিরক্তির স্বরে বলে, “এই কোন ছাগল না দেখে হাঁটছে রে?”
সুরভী তার হাত ঝেরে মুখ তুলে তাকায়। উঁচু লম্বা সুপুরুষ দাঁড়ানো। লোকটা তাকে পরে যেতে দেখে একবার সরিও বলল না। অথবা হাত বাড়াল না উঠানোর জন্য। শেরোয়ানির পকেটে হাত গুঁজে ঠাই দাঁড়িয়ে রইল। তার শেরোয়ানির দ্বিতীয় বোতম থেকে পকেট পর্যন্ত একটি স্বর্ণের চেইন চকচক করছে। তার পাশে দাঁড়ানো একটি লোক। সে পাঞ্জাবি পড়া। মাথায় সোনালী কাজ করা সাদা রঙের টুপি। মুখভর্তি পান। সে পান চিবোতে চিবোতে বললেন, “আমার নাম ফজলু মিয়া, আপনে আমার অভ্র ভাইরে অভদ্র কইসেন আপনার সাহস তো কম না?”
সুরভির মনেই হচ্ছিল সে আগে কোথাও দেখেছে। নাম শুনতে তার মনে পড়ল। বিরক্ত হলো সে। হোক সে সভ্যর ভাই। কিন্তু ইনারার সাথে তার শেষ দেখার ব্যবহারের কথা সে জানে। এছাড়া তার রাজনীতি করা মানুষেরা ভীষণ অপছন্দের। সে আরও বিরক্ত হয়ে তাদের পিছনে বডিগার্ডদের দেখে। আর বলে, “এইমাত্র যে গাড়ি এসেছে দাঁড়িয়েছে তা আপনার?”
“ফজলু মিয়া কয় কথা হাছা, গাড়িটা না একদম খাসা।”
“খাসারে মাসা বানিয়ে উড়িয়ে দিব। ফাজলামো করেন? একটি বৃদ্ধ মহিলা সি এন জি থেকে নামছিল। তাদের সামনে এনে গাড়ি থামালন। সেখানে এত লোক ছিলো তাদের কিছু হয়ে গেলে কী হতো? টাকা এবং ক্ষমতা আছে বলে নিজের মন মর্জি মতো সব করবেন?”
ফজলু মিয়া এবার ক্ষেপে যায়, “আপা মুখ সামলে কথা কন, আপনি জানেন সে কে?”
“জানি। একজন অনৈতিক নেতা। আপনার যদি মনে হয় আমি আপনাদের থেকে ভয় পেয়ে অন্যকিছু বলব আর তার আগেপিছে ঘুরবো তাহলে এমনটা একদম হচ্ছে না। আমিও এক টিভি চ্যানেলে কাজ করছি। এর মধ্যে অনেক গুপ্ত খবর পাই আপনাদের যা আপনারা টাকা দিয়ে দাবানোর চেষ্টা করেন। ইনফ্যাক্ট ইনারাকে সাহায্যর নামে যে আপনি নিজের কাজ সেরেছন তাও আমি জানি। তাই মোটেও সম্মানের আশা করবেন না। কারণ আপনারা সম্মানের যোগ্য না।”,
” ভাই আপনি চুপ কেন এই মাইয়ার র কথা শুনছেন কেন? কিছু তো…” অভ্র ফজলু মিয়াকে হাতের ইশারায় থামতে বলে। আর সুরভিকে নম্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তোমার নাম কী? আর কোন চ্যানেলে কাজ করো?”
“কেন? আমাকে চাকরি থেকে বের করবেন? করুন। কিন্তু নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য নিজেই খুঁজে বের করেন।” সুরভি ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে সেখান থেক বেরিয়ে গেল।

অভ্র তার যাওয়ার দিকে তাকায়। ফজলু মিয়া বলে, “ভাই আপনি ওই মাইয়ারে কিছু কন নাই কে? মাইয়া তো আপনার ইজ্জত ধুঁইয়া দিলো।”
“মেয়েটা ইন্টারেস্টিং আছে। আজ পর্যন্ত বড় বড় নেতা আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারে নি আর ও প্রথম দেখায় বলল। ফজলু…”
“জ্বি ভাই?”
“ওর তথ্য বের করো।”
“যো হুকুম ভাই।”
অভ্র ভেতরে ঢুকলো। তাকে দেখে তার পরিবারের সকলে যেন খুশির জোয়ারে বইছিল।তারা ভেবেছিল অভ্র আজ আসবেই না। হঠাৎ তার আসাটা সবার এই অনুষ্ঠানের খুশি দ্বিগুণ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
.
.
ইনারা তৈরী অনুষ্ঠানের জন্য। এই মুহূর্তে সে রুমে একা। মেকাপ আর্টিস্টরা নিচে চলে গেছে। সে সুরভিকে বলেছিল প্রিয়’র পরিবারকে ভেতরে এনে তার কাছে আসতে। কিন্তু তার তো খবর নেই। ইনারার একা একা ভালো লাগছে না এখানে। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ভয় ভয় লাগছে তার। সে শুনেছে সব মেয়েদেরই বিয়ের পূর্বে এমনটা হয়। কিন্তু তার বিষয়টা তো ভিন্ন। তার বিয়ে হয়েছে দুই বছর হবে। এটা তো কেবল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের পরেও সব একই রকম থাকবে। তাহলে এত ভয় লাগছে কেন তার?

ইনারা উঠে নিজের আলমিরা থেকে একটি ফটো ফ্রেম বের করল। ছবিটা সে তখন চাচার কাছ থেকে নিয়েছে। তার মা-বাবার ছবি। ছবিটাতে হাত বুলায় সে। তার বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। সে কল্পনা করে এই মুহূর্তে তার মা বাবা সাথে থাকলে বধূবেশে তাকে দেখে কতই না খুশি হতো, তার মাথায় হাত বুলাত, তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতো। কিন্তু এই মুহূর্তটা তাদের দেখা হলো না। হয়তো তার জন্মের পর তারা দুইজন এই দিনটি নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনেছিল। কিন্তু তা অপূর্ণ রয়ে গেল।
কথাগুলো মনে করে আপনি তো চোখ ভিজে গেল। সে কাঁপানো গলায় বলল, “মা, বাবা তোমরা আজ আমার সাথে থাকলে অনেক খুশি হতে তাই না? আমি জানি, অনেক খুশি হতে। হয়তো আবেগে ভেসে কাঁদতেও। হয়তো তোমরা আমার সাথে নেই কিন্তু এই বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে তোমাদের স্মৃতি জড়িত। এই বাড়িতে আমার জন্ম হয়েছিল। সেটা তোমাদের জন্য নিশ্চয়ই সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিলো। আজ এই বাড়ি থেকে আমি বিদায় নিব। আমার স্বপ্নের রাজকুমারের সাথে। আমি জানি, আজও তোমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন হতো। আজ তোমাদের খুব মনে পড়ছে।”
ইনারার অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। আর চোখ মুছতে মুছতে বলে, “কিন্তু মা, বাবা তোমরা মোটেও চিন্তা করো না, সভ্য আছে না ও আমার অনেক খেয়াল রাখবে। ও আমাকে অনেক ভালোবাসে।”

দরজায় টোকা পড়ে। শব্দ শুন ইনারা ছবিটা আগের স্থানে রেখে দরজা খুলে। সে দেখতে পায় সভ্যকে। তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। তার তো এখানে আসার কথা নয়।
“আপনি এখানে কী করছেন?”
সভ্য কক্ষে প্রবেশ করে বলল, “আমার বউকে দেখতে এসেছি।”
“বউকে দেখবেন ভালো কথা। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর মন মতো দেখেন। এখন বের হন। কেউ দেখে নিলো তো সমস্যা।”
সভ্য দরজা লাগিয়ে দেয়। আর ইনারার দিকে ফিরে তার কোমর ধরে কাছে টেনে নেয়, “কার কী সমস্যা? আমার বিয়ে করা বউকে দেখতে এসেছি, অপরাধ তো করছি না।”
সভ্য দেখতে পায় ইনারার গাল ভেজা। তার চোখদুটো দেখেও মনে হচ্ছে সে কান্না করেছে। সে ইনারার গালে হাত রেখে আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠে, “তুমি কান্না করছিলে? কান্না করছিলে কেন? তুমি ঠিক আছো তো?”
“হ্যাঁ আমার কী হবে? আজ মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছিলো। কিন্তু আমি ঠিক আছি। তারা সবসময় তো আমার সাথে থাকে। এখানে।”
ইনারা তার বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলল।
সভ্য ইনারার দিকে তাকায় নম্র দৃষ্টিতে। মৃদুকন্ঠে বলে, “তুমি কী সুন্দর করে তোমার দুঃখগুলো মিশিয়ে নেও খুশির মাঝে। তোমার এই আন্দাজেই তো নিজের হৃদয় হেরে বসে আছি।” সভ্য ঝুঁকে ইনারার ভেজা গালে আলতো করে চুমু খেল।
কেঁপে উঠে ইনারা। সে লজ্জামাখা চোখে তাকায় সভ্যের দিকে। তার গলায় হাত দুটো আবদ্ধ করে বলে, “তাই বুঝি? তাহলে আমার আর কি গুণে আপনি ফিদা শুনি।”
“তোমার কথাবার্তা মাঝেমধ্যে খুব বাচ্চামো লাগে, কিন্তু আবার তুমি নিজের লড়াই নিজে করার ক্ষমতা রাখো। তুমি আমার বাহুতে এসে লজ্জায় ডুবে যাও, অথচ অন্যকেউ তোমাকে হাত লাগানোর চেষ্টা করলেও তাকে উচিত শিক্ষা দিতে জানো। আরও কত কি! তোমার সবকিছুই আমায় মুগ্ধ করে। তোমার এমন মিষ্টি স্বভাবও, আর তোমার জংলী স্বভাবও।”
জংলী শব্দটা শুনে ইনারা সভ্যর বুকে আঘাত করে বলে, “অসভ্য!”

সভ্য হাসে। তাকে নিয়ে ব্যলকনিতে যেয়ে দাঁড়ায়। তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখে এবং বলে, “দেখো, আজ এতগুলো মানুষ আমাদের বিয়ের সাক্ষী হতে এসেছে। সবাই নাচছে, গাইছে, হৈ-হুল্লোড় করছে। কত খুশি সবাই।”
“সবাইকে এত খুশি দেখে আমিও অনেক খুশি। সব যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। আর কখনো ভাবি নি, এই স্বপ্নও সত্যি হবে।”
সভ্য তার হাত ধরে উপরে তুলে, “সবটা তো সত্যি হলো না। তোমার কত ইচ্ছা ছিলো বিয়েতে হাতভরা মেহেদী দেবার। কিন্তু তা আর হলো না।”
ইনারা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে, “কিন্তু মেহেদী তো দেওয়া হয়েছে। আপনার নামের মেহেদী। শুনেছি যে মেয়ের বিয়ের মেহেদীর রঙ যত গাঢ় হয় তার স্বামী তাকে ততই ভালোবাসে,” ইনারা পিছনে ফিরে তাকায় সভ্যের দিকে। তার হাতটা দেখিয়ে আবার বলে, “দেখুন কী সুন্দর রঙ হয়েছে! আপনি আসলেই আমাকে অনেক ভালোবাসেন।”
সভ্য তার কোমরে হাত রেখে হঠাৎ কাছে টেনে নেয়, “কোনো সন্দেহ আছে মহারাণী?”
আর চুমু খায় তার কপালে, এরপর চোখের পাতায়, আর গালে, অবশেষে ঠোঁটে চুমু খেতে নিতেই দরজায় টোকা পড়ে। সুরভির কন্ঠ, “ইনু…ও ইনু তুই দরজা বন্ধ করে রেখেছিস কেন? খুল জলদি।”
সভ্য বিরক্তির সুরে বলে, “এই জালিম দুনিয়া আমাকে মন মতো রোমেন্সও করতে দেয় না।”
ইনারা হেসে ফেলে। সে সভ্য থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যেয়ে দরজা খুলে। সুরভি জিজ্ঞেস করে, “তুই দরজা বন্ধ করে কি করছিলি?”
এমন সময় নজর পড়ে সভ্যর উপর। সভ্যকে দেখে সে টেনে বলে, “ও…. তাহলে এই ব্যাপার। দুলাভাই বিয়ের তো আর কিছুক্ষণই বাকি। আরেকটু অপেক্ষা করতে পারলেন না আমার বান্ধবীর জন্য। তারপর তো আপনার সাথেই থাকবে।”
সভ্য হাসে, “কি করব শালী সাহেবা আপনার বান্ধবীকে বধূবেশে দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না।”
সুরভি ইনারার কাঁধে হাত রাখে, “তো কেমন লাগছে বলুন তো।”
সভ্য মোহিত দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “লাল টুকটুকে পুতুল বউয়ের মতো।”
“আমার বান্ধবী তো সবচেয়ে সুন্দরই। আর আজকের দিনে যেন হুরপরী লাগছে ইনুকে। কিন্তু আপনাকেও কম হ্যান্ডসাম লাগছে না দুলাভাই। এক মিনিট আপনারা দুইজন ম্যাচিং করে পরেছেন আজ? ইনারার লেহেঙ্গা লালের উপর সোনালী কাজ করা আর আপনার শেরোয়ানিতে সোনালীর উপর লাল কাজ করা। উফফ যা লাগছে আপনাদের। একদম মেড ফর ইচ আদার। তবে দুলাভাই এখন আমার আপনার বউকে নিচে নিয়ে যেতে হবে। সবাই এসে পড়েছে।”
সুরভি ইনারাকে নিয়ে যেতে নেওয়ার পূর্বেই সভ্য তাকে থামায়, “একমিনিট সুরভি। আমার বউকে আমি নিজে নিয়ে যাচ্ছি।”
সভ্য ইনারার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে এবং হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, “মহারাণী আপনি আমার হাত ধরে জীবনের এই নতুন পর্বে এগোবেন?”
ইনারা একগাল হাসে। সভ্যের হাতে হাত রেখে মাথা নাড়ায়।

অন্যদিকে সুরভি তার বুকে হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “ইশশ এই দৃশ্যটা এত কিউট কেন? কারও নজর না লাগুক আপনাদের। দুলাভাই যদি আপনার কোনো ছোট ভাই থাকতো তাহলে এখনই তাকে প্রাপোজ করে দিতাম। কী রোমেন্টিক আপনি!”
“ছোট তো না কিন্তু বড় ভাই আছে। তাও সিঙ্গেল। বললে সেটিং করাতে পারি।”
কথাটা শুনে মুখ বানায় সুরভি, “না থাক। এই নেতা টেতাদের আমার দুইচোখে সহ্য হয় না। আচ্ছা আপনারা আসুন, আমি নিচে যেয়ে এনাউন্স করছি।”

সুরভি দৌড়ে নিচে যায়। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে মাইক নিয়ে বলে, “দয়া করে সবাই এদিকে ধ্যান দিন এবং নিজের হৃদয় কাবুতে রাখার চেষ্টা করুন। কারণ এখন সবার হৃদয়ের স্পন্দন বাড়াতে এইখানে প্রবেশ করছে সভ্য ও ইনারা।”
সকলে হাততালি দিলো। বাগানে থাকা লোকগুলোও ভেতরে চলে এলো। গান বাজনার শব্দ বাড়লো। এর মধ্যে সামি চিৎকার করে বলে, “ভাই কোলে তুলে নে।”
সভ্য ইনারার হাত ধরে তাকে নিয়ে নিচে নামছিলো। সামির কথা শুনে এক মুহূর্তও না ভেবে সে ইনারাকে কোলে তুলে নিলো।

ইনারা হতভম্ব। হঠাৎ সভ্য সবার সামনে এমন কিছু করবে সে ভাবে নি। চমকে সে সভ্যের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সভ্য চোখ টিপ মারল তার দিকে তাকিয়ে ।

ইনারার তো লজ্জায় মাখা মাখা অবস্থা। সে অন্যদিকে তাকাতেও পারছিল না। এর উপর সামি, সুরভি, মিনু তাদের জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছিল। সবার থেকে লুকানোর জন্য সভ্যের বুকটার তার কাছে সেরা স্থান মনে হলো। সে মুখ লুকাল সভ্যর বুকেতে। সভ্য হাসে, “আমার জংলী মহারাণীটা বাঘিনী থেকে আজ ভেজা বেড়াল হয়ে গেল কীভাবে?”
ইনারা মুখ তুলে না। তবে রাগান্বিত সুরে বলে, “এভাবে আমায় লজ্জা দিলে কী করব আমি? আপনি এত অসভ্য কেন বলুন তো।”
“তোমার সাথে অসভ্যতা করার মজাই আলাদা।”
“একবার বিয়ে হোক সব মজা বের করব আপনার। অসভ্য একটা!”
“হুমকি দিচ্ছো?”
“আপনার ভবিষ্যত বলছি।”
“তাহলে এটাও বলে দেও দাদাজান, দাদীজান কবে তাদের নাতি নাতনীর মুখ দেখবে?”
আকস্মিকভাবে কথাটা শুনে ইনারা মুখ তুলে তাকায় সভ্যের দিকে। লজ্জায় তার মুখটা লাল হয়ে গেছে। তা দেখে সভ্য ফিক করে হেসে দেয়, “লজ্জায় লাল হয়ে কী অবস্থা তোমার? একদম টমাটোর মতো লাগছে।”
“যাহ অসভ্য!”
নিচে এসে পরায় সে নেমে যায় সভ্যের কোলের থেকে। সভ্যের মা এসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “বধূ বেশে কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায় মাশাল্লাহ! কারো নজর না লাগুক।” বলে চুমু খেলেন তার মাথায়।
সভ্য নিরাশাজনক গলায় বলে, “ইনারা বলো তো তুমি মা’য়ের উপর কি জাদু করেছ তোমাকে পেয়ে তো আমার দিকে তাকায়ও না।”
মা হেসে মার দেয় তাকে। আর তার কপালেও চুমু খেয়ে বলে, “তোমাকে আজ রাজকুমারের মতো লাগছে।”
“আগে তো কেবল ইনারাকে বলেছিলে। ওকে পেয়ে তো আমাকে মনেও করো না।”
“কেন হিংসা হয়?” ইনারা ভেংচি কেটে সভ্যকে কথাটা বলে এবং মা’য়ের একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা এখন আমাকে আপনার থেকেও বেশি ভালোবাসে।” আর জিহ্বা বের করে ভেঙায় তাকে।

দাদীজান তাদের এই অবস্থা দেখে হেসে বলে, “আজ দুইজনের বিয়ে অথচ আজও তারা বাচ্চামো শুরু করে দিলো। ইনারার আসার পর সভ্য কত বদলে গেছে। কত খুশি থাকে আজকাল। এখন তুইও একটা বিয়ে করে নে। এভাবে আর কতদিন?”
অভ্র দাদীজানের পাশেই বসেছিলো। দাদীজানের কথা শুনে সে বিরক্ত হয়ে বলল, “দাদীজান প্লিজ। আপনাকে আগেও বলেছি। এসব বিয়ে নিয়ে আমার সাথে কথা বলবেন না। যদি বিয়ে দ্বারা কখনো আমার লাভ হয় তাহলে আমি করে নিব।”
“বিয়ে তো লাভ ক্ষতির জন্য হয় না। বিয়ে এক মনের সম্পর্ক দিয়ে হয়, যা সারাজীবনের জন্য মানুষ পালন করে।”
“আমার জন্য নিজের লাভ ছাড়া অন্যকিছু বা অন্যকেউ মেটার করে না দাদীজান। আর আপনি এই বিষয়ে আরেকটা কথা বললে আমি এইখান থেকে চলে যাব।”
“আচ্ছা আচ্ছা আর বলব না। এখন নিজের ভাইয়ের সাথে একবার দেখা তো করে আয়।”

অভ্র বিরক্তি নিয়েই উঠে। সে সভ্যের কাছে যায়। সভ্য তাকে দেখতেই খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে, “ভাইয়া তুমি এসেছ। আমি ভাবি নি তুমি বিয়েতে আসবে। তুমি এসেছ বলে আমি অনেক খুশি হয়েছি। আজকের এই দিনে আমার সম্পূর্ণ পরিবার আমার সাথে আছে এর’চেয়ে বড় কিছু হতেই পারে না।”
অভ্র গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল, “আমার কাজ জলদি শেষ হয়েছে বলে এসেছি, নাহলে আসার পরিকল্পনা ছিলো না।”
“যেভাবেই এসেছ আমি অনেক খুশি হয়েছি।”
ফজলু মিয়া বলল, “ভাই ভুল কন কে? আপনে তো কাম ছেড়ে আইসেন।”
“চুপ করো ফজলু। বেশি কথা বলো না।” অভ্র ধমক দেয়। কিন্তু সভ্য কথাটা শুনে খুশিতে আবারও জড়িয়ে ধরে।
এমন সময় অভ্রর নজর পড়ে একটু আগে তাকে যে মেয়েটা কথা শুনিয়েছিল তার উপর। সে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “এই মেয়েটা কে?”
“হঠাৎ ওর কথা জিজ্ঞেস করছ যে? ও তো ইনারার বেস্ট ফ্রেন্ড সুরভি।”

সুরভির ফোনে আহনাফের মেসেজ আসে, “তোমাকে গোলাপি রঙের লেহেঙ্গায় খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে।”
সুরভি অবাক হয়। সে তো আহনাফকে তার কোনো ছবি পাঠায় নি। তাহলে সে জানল কীভাবে যে সে গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা পরেছে? সুরভি আশেপাশে তাকায়। চোখ বুলিয়ে সে দেখতে পায় আহনাফকে। আহনাফ তার দিকে তাকিয়েছিল। মুহূর্তে তার মনটা উড়ু উড়ু হয়ে যায়। সে দৌড়ে যায় আহনাফের কাছে। উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি এখানে? আপনি তো বলেছিলেন আপনি আসবেন না।”
“আসতাম না। কিন্তু তুমি মন খারাপ করেছিলে বলে সব ছেড়ে চলে এলাম।”
সুরভি আরও খুশি হয়ে উঠে তার কথাটা শুনে।

তাদের দুইজনকে দূর থেকে দেখছিল অভ্র। তার পাশে দাঁড়ানো ফজলু মিয়া তার কানের কাছে যেয়ে বললেন, “ভাই এটা তো সেই টিভি চ্যানেলে প্রধান কর্মী যে চ্যানেলে এই মাসে আপনার ইন্টারভিউ আসবে।”
“তাই? ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং।”

ইনারা তার ফুফার সাথে দেখা করে যায় প্রিয়’র মা’য়ের কাছে, “আন্টি আপনি এসেছেন বলে অনেক খুশি হয়েছি আমি।”
প্রিয়’র মা ও বোন তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ইনারা বলে, “আরে উঠছেন কেন? বসুন।”
“তোমারে ওইদিন ভালা মতন শুকরিয়া করতে পারি নাই। লজ্জায় তোমারে মুখ দেখাইতে পারতাসিলাম না। কিন্তু তোমার ঋণী আমরা। যে কাম সাহস করে আমরা, প্রিয়র পরিবার করতে পারলাম না। তা তুমি করলা। ওরে ন্যায় দেয়াই ছাড়লা। আমরা তো উলটা ওরে ভুল বুইঝা…” প্রিয়’র মা কান্না করে দিলেন। ইনারা থামাল তাকে, “আন্টি এসব কথা বলেন না। এটা আমার কর্তব্য ছিলো। আপনি কান্না করেন না।”
“এইটা নেও…” প্রিয়’র মা তার হাতে একটা বক্স দিয়ে বলল, “এখানে একজোড়া স্বর্ণের কানের দুল আছে। বড় দেওয়ার তো আমগো সামর্থ্য নাই। তাই ছোট একটা দিলাম।”
“আন্টি এসবের প্রয়োজন নেই।”
ইনারা তা ফেরত দিতে নিলে প্রিয়’র মা জানায়, “এটা আমার পক্ষ থেইকা না। প্রিয়’তোমার আর সুরভির বিয়ার উপহারের লাইগা টাকা জমাইছিল। ওই ভেবেছিল পরে আরও টাকা জমাইয়া ভালা কিছু দিব কিন্তু এর আগেই….। যাই হোক ওই টাকা দিয়া তোমার আর সুরভীর লাইগা একরকম কানেরদুল কিইনা রাখছি। তোমগো বিয়ার লাইগা। ওর শেষ স্মৃতি ভাইবা রাইখা দেও। খুইলা দেখ কেমন লাগে।”
ইনারা বাক্সটা খুলে। কানেরদুলটা দেখে তার প্রিয় ও সুরভির সাথে স্কুল, কলেজের সকল স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সে মৃদু হাসে। প্রিয় প্রায়ই বলতো, “তুই একটু মেয়েদের মতো সাজগোজ বা গহনা পরতে পারিস না। তোকে দেখে আমিই মাঝমধ্যে দ্বিধায় পড়ে যায় তোকে আমি বোন বানাব, না ভাই?”
আজ সে ইনারাই বধূ সেজে আছে।
.
.
“আপনি একদমই আমার মা হবার চেষ্টা করবেন না। আপনি আমার মা না, কেবল এক লোভী মহিলা যে টাকার জন্য নিজের বাবার বয়সী লোককেও ছাড়েন নাই। আমার বাবার জীবনে এসে তো আমাদের এত সুন্দর সংসার ভাঙলেন। এখন আমার জীবনকে জাহান্নাম করে তুলতে চাচ্ছেন? ” আইজা কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কথাগুলো বলছে তার সদ্য বিয়ে করা স্বামীর মেয়ে। যার বয়স হবে সতেরো। এইটুকু মেয়ের মুখ থেকে তার এইসব কথা শুনতে হবে সে কল্পনাও করতে পারে নি। সে কাঁপানো গলায় বলল, “তু-তুমি এসব কী বলছ? আমি তো কেবল তোমাকে এত রাতে বাহিরে যেতে মানা করলাম। তোমার চিন্তা করি….”
“চিন্তা? আপনার আমার চিন্তা করা লাগবে না। অনেক চিন্তা করে উদ্ধার করেছেন। খবরদার আমার জীবনে ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করবেন না।”
বলে মেয়েটি তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে চলে গেল।

আইজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেয়ে বসে সোফায়। এ বাসায় সে এসেছে দুইমাস হবে। প্রায় ছয় মাস পূর্বেই তার স্বামীর প্রথম স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়। তখন সে লোকটাকে চিনত না। অথচ সবাই ভাবে সেই এ ডিভোর্সের কারণ। সকলে খুব খারাপ ব্যবহার করে তার সাথে। সে তো কেবল সব নতুন সম্পর্কগুলোকে আপন করতে চাইছে।

আইজা ফোন দেয় তার স্বামীকে। তার স্বামী ফোনটা ধরেই বলল, “কী সমস্যা? এতবার ফোন দেওয়ার কি হলো?”
“কখন আসবেন জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন দিয়েছি।”
“আসতে দেরি হবে কাজে আছি। কাজ শেষেই চোখ আসব। আর খেয়ে নিও। আমি ডিনার করে আসব।”
“হুম।” আইজা মন খারাপ করে ফোনটা রাখতে নিলে একটি মেয়ের কন্ঠ শুনতে পায়। সে অবাক হয় না। লোকটার চরিত্র খারাপ তার জানা আছে। দুইদিন পর পর তার জীবনে নতুন মেয়ে আসে। এসব জেনেই সে বিয়েটা করেছে। কারণ তার প্রয়োজন ছিলো। মামা ও তার মা জেলে যাবার পর তার কাছে আর কোনো রাস্তা ছিলো না এই লোককে বিয়ে করা ছাড়া। তবুও তার মনে হয় কেউ তার বুকের ভেতরটা চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে। চোখ ভিজে যায় তার। পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করে সে। সাইদ কত যত্ন নিতো তার! আজ হয়তো সাইদের সাথে বিয়ে করলে তার জীবনটা এমন হতো না। অথবা আপন কেউ তার পাশে থাকলেও তার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু কেউ তার পাশে নেই। তার দোষী একমাত্র সে নিজে।
.
.
সামি ইনারাকে ডাক দেয়। ইনারা কথা বলছিল তার দাদী ও চাচার সাথে। তাকে অনেক খুশী দেখাচ্ছে। দাদি আজ অনেকসময় ধরে তাকে মনে রেখেছেন। সে তাদেরকে বলে সামির কাছে আসলো। সে দেখল ঐশী এবং ইরফানের সাথে জোহানও ভিডিও কলে আছে। ঐশী ইনারাকে দেখে বলল, “ইনারা তোমাকে দেখি অনেক সুন্দর লাগছে। আমি এর থেকে সুন্দর বউ আর দেখি নি।”
“দেখতে হবে না ভাবি কার?”
“তোদের খুব মিস করছি। সেখানে থাকলে কত মজা করতে পারতাম।”
ঐশী কথা বলতে বলতে পাশে তাকিয়ে দেখে ইরফান হা করে তাকিয়ে আছে ইনারার দিকে। সে ইরফানের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “লজ্জা করো তোমার ভাবি হয় এভাবে আর তাকিয়ে থাকলে এই হাস্পাতালের অপরেশন করা জিনিস দিয়ে চোখ তুলে নিব।”
কথাটা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে ইনারা।

জোহান তার দিকেই তাকিয়েছিল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে। সে ইনারাকে বলে, “তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। স্বপ্নে আসা কোনো পরীর মতো।”
জোহানের মুখে থেকে কথাটা শুনে প্রথমে ইনারার একটু অস্বস্তি লাগলেও পরক্ষণে একগাল হেসে তাকায় জোহানের দিকে। বলে, “থ্যাঙ্কিউ। সবকিছুর জন্য থ্যাঙ্কিউ।”

হঠাৎ করে গিটারের সুর শুনতে পাওয়া যায়। সামি ইনারাকে বলে, “পার্টনার তোমার বরের অপেক্ষার আজ বসান ঘটল। তোমার জন্য লেখা পাঁচ বছর পূর্বের গানটা আজ শুনাতে পারবে সে নিজের বউকে।”
ইনারা অবাক হয়ে পিছনে তাকায়। দেখে সভ্য গিটার নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে তার গানের সুর ধরছে।

“চোখের পাতায়, স্বপ্ন জাগায়,
কেবল তুমি তুমি তুমিতে মন হারাতে চায়।
মাতাল হাওয়ায়, মন জুড়ে যায়,
তুমি তুমি তুমিতে এই মন যে হারায়।
তুমি আছো বলে আমার হৃদয় সুখ ছড়ায়
তুমিবিহীন আমি বাঁচি কী করে?
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি প্রণয়ী…
ভালোবাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি প্রণয়ী…

প্রেমের উষ্ণ হাওয়ায় মাতাল তুমি আর আমি
তোমার আঁখি নীল সমুদ্র তোমাতেই আমি;
আমি ডুবে যাব ডুবে যাব তোমার মাঝে, ও প্রণয়ী
ভালোবাসি তোমাকেই শুনছ না’কি?

তুমিতে তুমিতে হারাই বারে বারে আমি
তোমারেই ভালোবাসি কীভাবে বলি আমি?
বুঝ না একটু মনের কথা
মেঘ যে ডাকে এই অবেলা
মেঘেঢাকা দিনে তোমাকে চায় এই মন
তুমি কী করে দিবে বারণ?
তুমিবিহীন আমি বাঁচি কী করে?
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি প্রণয়ী…
ভালোবাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি প্রণয়ী…

সকলে হৈ-হুল্লোড় শুরু করে গানটা শুনে। ইনারা আবেগী হয়ে পড়ে। তার মনে পড়তে থাকে সভ্যের সাথে কাটানো মিষ্টি মুহূর্তগুলো। সে মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সভ্যের দিকে। এই জীবনের সব কষ্টর বিনিময়ে সুখ হিসেবে যেন এই পুরুষটাকে পেয়েছে সে।

সভ্য স্টেজে উঠে গিটারটা দিলো সামির হাতে এবং নিজে ইনারার হাত ধরে হলের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে কপালে কপাল ঠেকিয়ে শেষ পঙক্তিটা গাইল, “ভালোবাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি, প্রণয়ী।”
ইনারা তার পা’য়ের পাতা উঁচু করে সভ্যের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে মৃদু স্বরে ছোট করে উওর দিলো, “আমিও ভালোবাসি।”
.
.
পঞ্চসুর….পঞ্চসুর….পঞ্চসুর…

তিনমাস পর সভ্য কোম্পানির দ্বারা দেশের সবচেয়ে বড় কনসার্টে গান করছে পঞ্চসুর। অর্থাৎ ফিফথ মেলোডি। দেশ বিদেশ থেকে বড় বড় তারকা আসা সত্ত্বেও তাদের জন্য যেমন আনন্দধ্বনির গর্জন হচ্ছে তা আর কারও জন্য হয় নি। হবেই বা না কেন। আজ পঞ্চসুরের দশবছর পূর্ণ হয়েছ এবং তাদের সকলের একসাথে পাঁচ বছর পর প্রথম গান গাওয়া।

“ঝুমঝুমে বৃষ্টি নামে মনের কিনারায়
রাত জেগে আকাশ ডাকে কোন সে ইশারায়
মেঘডুবি কথা বলো চাও কী আমায়?
প্রেমজোয়ারে আসো ভেসে যাই
অনুভবের পৃথিবীতে হারিয়ে যাই
অনুভবে, অনুভবে, তুমি আমার অনুভবে,
অনুভবে, অনুভবে, তুমি আমার অনুভবে রবে….”

সভ্য ও জোহান একসাথে গান গাইছিল। কিন্তু এইবার আর আগের মতো তাদের মাঝে দ্বন্দ নেই। তাদের বন্ধুত্ব দেখে ভক্তদের মাঝের উৎসুকতা, আনন্দ শতগুণ বেড়ে গেছে। সকলের হৈ-হুল্লোড় অন্য পর্যায়ে। পার্ফোরমেন্সের শেষের দিকে সকলে একে অপরের দিকে তাকাল। আর হাসল। সকলের চোখে এই মুহূর্তে আবেগ ভাসছে। পুরনো স্মৃতিতে ভেসে যাচ্ছে তারা। পার্ফোরমেন্স শেষে অডিয়েন্সরা উচ্চ সুরে চিৎকার করে। সভ্য তাদের খুশি দেখে নিজেও হাসে। তার কাঁধে একটা হাত এসে রাখে কেউ। সে পাশে তাকাতেই জোহানকে দেখতে পায়। তার হাসি আরও গাঢ় হয়। সে পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে জোহানকে। কিছুক্ষণের মধ্যে সামি, ঐশি ও ইরফানও এসে তাদের জড়িয়ে ধরে। পঞ্চসুর একসাথ হয় আবারও।

তাদের প্রদর্শন শেষে জোহানের একটা পার্ফোরমেন্স আছে। মিঃহকের কোম্পানির অবসান ঘটয়ার পর এবং তার জেলে যাবার পর সে একটি নতুন কোম্পানি জয়েন করেছে। অভিনয় বাদ দিয়ে এখন সে কেবল তার স্বপ্ন, তার গানের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। আর এতেই সে খুশি। তার পরে শেষ পার্ফোরমেন্সটা হবে ইনারা ও সভ্যের। এই আইডিয়াটা জোহানেরই। তাদের ভক্তরা প্রথমবার তাদের একসাথে স্টেজে দেখতে চায়। এর থেকে বেশি সুন্দর উপহার তাদের জন্য কী হবে?

ইনারা খুব চিন্তিত। এরপূর্বে সে কখনো এতো বড় স্টেজ, এতো মানুষের সামনে পার্ফোরমেন্স দেয় নি। খুবই নার্ভাস লাগছে তার। সে তৈরী হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর প্রার্থনা করছে যেন সব ঠিক যায়। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠে সে। ভয় পায়। পিছনে তাকিয়ে সভ্যকে বলে, “এভাবে কেউ না বলে আসে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তো।”
সভ্য তার কোর্ট পরতে পরতে ভিতরে ঢুকছিল। তাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই সে নিজেই এলো ইনারাকে নিতে। কিন্তু ভেতরে এসে ইনারাকে দেখে যেন তার নিশ্বাস আটকে আসার মতো অবস্থা। হৃদয়ের স্পন্দন তো থেমেই গেছে যেন। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইনারার দিকে। ইনারা সভ্যকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে ভালো দেখাচ্ছে না?”

সভ্য তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। সে হাল্কা নীল রঙের একটি গাউন পরেছে। যেখানে হাল্কা গোলাপি রঙে কাজ করা। যা তার নীলাভ চোখের মণির সাথে মিল খাচ্ছে। তার স্বর্ণাজ্জ্বল চুল একই রঙের মুক্তার মালা দিয়ে বাঁধা। সভ্য নিজের বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলল, “আমাকে কী এভাবে খুন করাটা অপরাধ বলে গণ্য হবে না?”
“মানে?”
“মানে তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে আমার হার্টবিট বন্ধ হবার অবস্থা।”
ইনারা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়, “তাই?”
সভ্য তার গালে হাত রাখে। তার মুখ তুলে বলে, “দৃষ্টি নামিও না। তোমার চোখের মায়ায় ডুবতে মন চাচ্ছে।”
“আমার চোখ এত প্রিয় আপনার?”
“তোমার চোখের মায়ায় ডুবে নীল রঙটাই আমার প্রিয় হয়ে গেছে। আমার ভালোবাসার রঙটা নীল হয়ে গেছে।”
ইনারা হাসে, “তাই আপনি নীল পরেছেন বুঝি।”
“বলতে পারো। আর তাই তোমার জন্যও এই গাউনটা বাছাই করেছি।”
ইনারা সভ্যের চোখে চোখ রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আমি জানতাম না আমার চোখ এত পছন্দ আপনার।”
সভ্য তার পকেট থেকে বের করে ইনারার সাথে তার প্রথম দেখা হবার পর রেখে যাওয়া চুড়িটা। সে চুড়িটা বের করে সে পরাল ইনারার হাতে। হয়তো ইনারার এই চুড়িটার কথা মনে নেই। তবুও সে পরাচ্ছে। সে ইনারার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার চোখের মায়ায় ডুবে মরতেও আমি রাজি।”

“এই ডুবে মরামরি পরে করিস। আগে কনসার্টের পর আমার কাছ থেকে চল্লিশার মেন্যুউ কনফার্ম করে নিবি। জোহানের গান শেষ। তোদের এখন স্টেজে যেতে হবে।”
সভ্য পিছনে তাকিয়ে দেখে দরজায় সামি ও সুরভি দাঁড়ানো। সুরভি ইনারাকে বলে, “অল দ্যা বেস্ট জান।”
“আমার কী যাওয়াই লাগবে? আমার না খুব চিন্তা হচ্ছে। যদি কিছু ভুল করে ফেলি?”
সভ্য ইনারার দুই গালে হাত রেখে কপালে চুমু খায়, “চিন্তা করো না আমি তোমার সাথে আছি, সবসময় থাকব।”

ইনারা সভ্যের হাত ধরে স্টেজে যায়। এতগুলো মানুষ একসাথে দেখ ঘাবড়ে যায় সে। স্টেজে যাবার সময় তাদের পাশ কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছিল জোহান। যে তাকে দেখে একগাল হাসে। ইনারাও হাসি ফিরিয়ে দেয়।

স্টেজে যেয়ে ইনারা ভিড়ের কোলাহল শুনতে পায়। সভ্য তার হাত আরও শক্ত করে ধরে। ইনারা তার দিকে তাকায়। সভ্য তাকে একটি মাইক দিয়ে বলে, “কিছু বলতে চাও?

ইনারা অবাক হয়। তার তো কিছু বলার কথা ছিলো না। তবে সভ্য তাকে এমনটা বলছে কেন? কিছু মুহূর্তের জন্য ভিড়ের কোলাহল কমে। ইনারা কাঁপা-কাঁপা হাতে মাইকটা নেয়। সভ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। সভ্য তাকে আশ্বাস দেয় চোখের ইশারায়। ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাইকটা ঠোঁটের কাছে নিয়ে বলে, “আজকের প্রদর্শনীটা তাদের ডেডিকেট করলাম যারা আজ আমাদের মাঝে নেই। আমার মা সাইয়ারা বেগম এবং বাবা ইমতিয়াজ চৌধুরী।”
কোলাহল যেন দশগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু এবার ইনারার অস্বস্তি লাগছে না। উল্টো খুশি লাগছ। সে মাইকটা রেখে বসে স্টেজে সাজানো একটি পাথরে। তাদের নাচের থিমটা সমুদ্রের সাথে মেলানো। পিছনে সমুদ্রের স্ক্রিন ভেসে উঠে। ইনারার আশেপাশে বালি ও শামুক ছড়ানো।এই মুহূর্তে তাকে যেন জলকন্যা দেখাচ্ছে।

সভ্য তার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে তার হাতটা নিজের হাতে নেয়। তার স্বপ্নের রাজকুমারের মতো। গান শুরু হয়,

চোখের পাতায়, স্বপ্ন জাগায়,
কেবল তুমি তুমি তুমিতে মন হারাতে চায়।
মাতাল হাওয়ায়, মন জুড়ে যায়,
তুমি তুমি তুমিতে এই মন যে হারায়।
তুমি আছো বলে আমার হৃদয় সুখ ছড়ায়
তুমিবিহীন আমি বাঁচি কী করে?
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি প্রণয়ী…
ভালোবাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি প্রণয়ী…

ইনারা সভ্যের বাহুডোরে আবদ্ধ। গানের তালে নাচছে তারা। কয়েক বছর পূর্বে তার সভ্যের প্রতি প্রথম অনুভূতি হয়েছিল এমনই এক নাচের সময়। তখন সভ্য তার কেউ ছিলো না, আজ সভ্য জুড়েই তার পৃথিবী। তার ভালোবাসার অনুভূতিটা আজ গাঢ়। এই ভালোবাসার রঙ সে তার জীবন থেক মুছতে চায় না। তার মন চায়, তারা দু’জনে হারিয়ে যাক, এই ভালোবাসার অনুভবে…..

সমাপ্ত।

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

লেখকের কথাঃ এই গল্পকে আপনারা অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন। এত যে আমি কল্পনা করি নি। এইটা যেন একটা গল্প না, যাত্রা ছিলো। যে যাত্রায় আপনারা আমার সাথে ছিলেন। এই গল্পের অন্য এক বা একাধিক চরিত্র নিয়ে সিকুয়াল ভবিষ্যতে পেতে পারেন। তাদের জীবনের গল্প নিয়ে। তবে এখন না। যখন ইনারা ও সভ্যকে একটু একটু ভুলে যাবেন তখন হুট করে দিব।
আশা করি এই গল্পের যাত্রাটা আপনাদের ভালো লেগেছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে