অনুভবে ২ পর্ব-৪২+৪৩

0
550

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

অবশেষে সভ্য থামে। সে ইনারার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে কাছে টানে। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, এখনও। সভ্য তার দিকে ঝুঁকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “ভালোবাসি, আমার মহারাণী।”

ইনারা তাকায় সভ্যের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য যেন তার হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যায়। স্থির হয়ে যায় সে। সভ্য মুখ তুলে তাকাতেই সে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো সভ্যের দিকে।

সভ্য আলতো করে হাত রাখল ইনারার গালে। তার কপালে চুমু খেল। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো ইনারা। অনুভব করল সভ্যর প্রেমের গভীর স্পর্শ। আবারও বলল, “ভালোবাসি প্রণয়ী…”
ইনারা চোখ খুলে। তাকায় সভ্যর দিকে। তার মনে পড়ে কয়েকবছর পূর্বে সভ্য একবার তাকে বলেছিলো সে গান হলে সভ্য সে গানের নাম রাখতো প্রণয়ী। সভ্য কী আসলে তখন তাকে ইঙ্গিত দিচ্ছিলো ভালোবাসার?
সভ্য আবার জানাল, “তোমার মুখের এই চমক দেখার জন্যই কিছুক্ষণ পূর্বে কষ্ট দিতে হয়েছিল তোমাকে৷ ক্ষমা করে দেও।”
ইনারার ঘোর ভাঙ্গে৷ সে সভ্যের মোহ থেকে বেরিয়ে আসে। সাথে সাথে পিছনে সরে যায়। হাত দুটো আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, “এসবও কী বিয়ের মতো ফর্মালিটির জন্য করছেন? প্রয়োজন নেই। আমার সামনে আপনার এতো ফর্মালিটি করতে হবে না।”
ভেংচি কেটে ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার ওড়না ধরে নেয়। থেমে যায় ইনারা, “ওড়না ছাড়ুন।”
“প্রথম তুমি অভিমান ছেড়ে দেও, আমি ওড়না ছেড়ে দিব।”
“কীসের অভিমান? অভিমান করার অধিকার তো শুধু আপনার আছে। আমি কি অভিমান করার দুঃসাহস করতে পারি।”

সামি, সুরভি, ঐশি এবং ইরফান লুকিয়ে জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখছিল। আর বহু কষ্টে তাদের কথোপকথন শোনার ব্যার্থ চেষ্টা করছিল। সামি সভ্যকে এভাবে ইনারাকে জড়িয়ে ধরতে দেখে তার দুইপাশে দাঁড়ানো সুরভি এবং ঐশির চোখের উপর হাত রেখে বলে, “তোমাদের এমন রোমেন্টিক সিন দেখা ঠিক না। জলদি চোখ বন্ধ করো।”
এই কথায় ঐশি মার দেয় তাকে। বিরক্তিকর সুরে বলে, “এইখানে কেবল তুই একমাত্র আজীবন ধরে সিঙ্গেল ব্যক্তি। এ কথা তোর মুখে আনিস কীভাবে?”
“সিঙ্গেল বলে কী এভাবে বলবি?”
“একশোবার বলব। চুপচাপ সিনটা দেখ, নাহলে লাত্থি দিয়ে জানালা থেকে ফেলে দিব।”

সভ্য হাসে। ইনারার দিকে এগিয়ে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “রাগ ছেড়ে দেও না মহারাণী, তখন তোমাকে নিজের খুশি দেখালে এই মুহূর্তটা উপহার কীভাবে দিতে পারতাম বলো?”
সভ্য ইনারাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার কোমরে হাত আবদ্ধ করে। আবার বলে, “এই পরিকল্পনাটা তো তোমার বিয়ের কথা বলার পর থেকেই করছি। সেদিন যখন তোমার চিঠি পেলাম ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু ওই মুহূর্তটা আমার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত ছিলো। যে মুহূর্তে আমি জেনেছি আমাদের প্রেম কাহিনী কখনো একতরফা ছিলো না।”
“তাই?” ইনারা তার হাত দুটো সভ্যর কাঁধে রাখে, “তাহলে আমাকে এত জ্বালালেন কেন?”
“তোমাকে জ্বালাতে বেশ ভালো লাগে তাই।”
ইনারা ক্ষেপে যেয়ে সভ্যের বুকে মারল, “অসভ্য!”
সভ্য শব্দ করে হাসে। ইনারাকে কাছে টেনে তার কপালে আরেকটি চুমু খায়, “এই অসভ্যকেই তো ভালোবাসো।”
“তাই চিন্তা করি কি দেখে যে ভালোবাসলাম!” আফসোসের সুরে বলল ইনারা।
সভ্য চোখ দুটো বড় করে নেয়, “আমাকে ভালোবেসে তোমার আফসোস হয়?”
ইনারা খিলখিল করে হেসে উঠে। পা’য়ের পাতায় ভার দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ায়। সভ্যর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে, “আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি।”
“সত্যি?”
“সত্যি, সত্যি, একদম সত্যি।”
সভ্য খুশিতে কোলে তুলে নেয় তাকে, “তোমার থেকে মুখের থেকে ভালোবাসা শব্দটা শুনে অন্যরকম লাগছে মহারাণী। অন্যরকম খুশি লাগছে।”

সভ্য ইনারাকে নিয়ে যায় স্টেজে। তাকে স্টেজের ঠিক মাঝখানে যেয়ে দাঁড় করায়। তার পকেট থেকে একটি আংটি বের করে। ইনারার হাত নিজের হাতে হাত নিয়ে বলে,
“তোমায় ছাড়া শূন্য আমার পৃথিবী,
তোমায় ছাড়া জীবন যেন রঙ বিহীন চিত্র জানো?
এমন করে কেউ কারো জীবনে আসে?
এমন করে ভালোবাসে?
যেন জীবনটার উপর অন্যকারো অধিকার হয়ে আসে,
আজ এই মুহূর্তকে সাক্ষী রেখে আমার জীবন তোমার নামে লিখে দিলাম প্রিয়….”

সভ্য রিং পরায় ইনারাকে। ইনারা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রয় সভ্যের দিকে। হঠাৎ তার চোখ ভিজে যায়। এই মুহূর্তটা স্বপ্নের মতো। এই স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখতো। কখনো এই স্বপ্নটাও পূরণ হতে পারে এই কল্পনা সে করে নি। সে নিজেও নিচে বসল। তার ব্যাগ থেকে সভ্যর জন্য আনা রিংটা বের করে সভ্যর আঙুলে পরাল।
সভ্য বলল, “ভালোবাসি…”
ইনারা হেসে তাকায় সভ্যের দিকে, “আবার বলেন।”
“ভালোবাসি মহারাণী।”
ইনারা সভ্যের কপালে কপাল ঠেকায়। তার কান্না বাড়ে। সে চোখ বন্ধ করে বলে, “আবার বলেন। বারবার বলেন। আপনার মুখ থেকে এই শব্দটা শোনার জন্য আমি প্রচুর অপেক্ষা করেছি।”
“ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি মহারাণী।”

হঠাৎ করে শিস বাজানোর শব্দ এলো। দুইজন চমকে উঠে। তাকায় তাদের বাড়ির দিকে। সামি উঁচু স্বরে বলে, “অবশেষে আমাকে এত খাঁটানোর পর দুইজনে প্রেম স্বীকার করলি মনে হয়। এই খুশিতে আমার জন্যও কাওকে খুঁজে দে।”
সভ্যর রাগ উঠলো ভীষণ। এত সুন্দর মুহূর্তটা কেউ খারাপ করে এভাবে? সে ক্ষেপে যেয়ে বলে, “আমি ওখানে এলে খুঁজে খুঁজে একশোটা জুতার বাড়ি দিব।”
হুমকি শুনেই পালায় সামি। সভ্যের বকায় বাকি তিনজনও সেখান থেকে চলে যায়। সবার যাওয়ার পর সভ্য ও ইনারা একে অপরের দিকে তাকায় এবং ফিক করে হেসে দেয়।

“কিভাবে আমাকে হুমকি দিল দেখলি তোরা? অথচ দুই জনকে সারপ্রাইজ প্ল্যান পুরাই আমি করে দিলাম।” সামি অভিযোগের সুরে বলল, “একদিকে ইনারা সভ্যকে সারপ্রাইজ দিবে। অন্যদিকে সভ্য ইনারাকে। মাঝখানে দুজনে ধরলো আমাকে। একে অপরের স্যারপ্রাইজ এর কথা না জেনে যায় এমন ভাবে সবকিছু রেডি করে দিলাম এখন দুজনে আমাকে চেনে না। কী স্বার্থপর দুনিয়া রে ভাই।”
সামির এমন কথা শুনে টেবিলে বসা ঐশি পা দুলাতে দুলাতে বলে, “সেন্টি খাওয়ার দরজার নাই। দোষ সম্পূর্ণ তোর। এমন মোমেন্ট কেউ এভাবে নষ্ট করে? ছাগল।”
সুরভি হেসে দেয়। তাকে হাসতে দেখে ঐশি জিজ্ঞেস করে, “হাসছ যে?”
“প্রথমে আপনাদের দেখে ভাবতাম আপনারা এত বড় সেলিব্রিটি আমাদের সব আলাদা হবে। অথচ এখন দেখি আপনারা সবাই আমাদের মতোই।”
“অফকোর্স। আমরাও মানুষ, তোমরাও মানুষ। আমরা তো আর ভিন্ন দুনিয়ার প্রাণী না যে আলাদা হবো।”
সুরভি হাসে। এমন সময় তার ফোন বাজে। সে ফোন ধরে সালাম দেয়। পরের মুহূর্তের তার হাসি মুখটা মলিন হয়ে যায়। তার হাত থেকে ফোনটা পরে যায়।
ঐশি তাকে এমন অবস্থায় দেখে নিজেও চিন্তিত হয় এবং জিজ্ঞেস করে, “কী হলো সুরভী? সব ঠিক আছে তো? ”
উত্তর পাওয়ার আগেই তার ফোনটাও বেজে উঠে।

সভ্য ইনারার হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছিল। তারা বসা কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো দোলনার উপর। কিছুক্ষণ পরেই তারা মেহেদি অনুষ্ঠানে যাবে। কিন্তু সভ্য চায় সেই সবার পূর্বে ইনারার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিক। সে ইনারার হাতে লিখে দিলো তার নাম, ‘সভ্য’।

ইনারা সভ্যর কাঁধে মাথা রেখে বসেছিল। আর হাসিমুখে দেখছিল সভ্যের মেহেদি দেওয়াটা। উপভোগ করছিলো এই রাত, এই মুহূর্ত। তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর জন্মদিন পালন করল সে আজ। এই জন্মদিনের প্রতিটা মুহূর্ত তার স্মৃতির বাক্সে বন্দী থাকবে। সে প্রার্থনা করল, এই সুখের মুহূর্ত যেন কখনো শেষ না হয়।
ইনারা জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আমাকে আপনার কখন সবার প্রথম পছন্দ হয়?”
“জানি না। নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্ত দেখে তো আর ভালোবাসা হয় না।”
“পার্টনার বলেছিল আপনি আমাকে সে পার্টিতে দেখার পূর্ব থেকে পছন্দ করেন। এটা কী সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“কেন? তখন তো আমার মাঝে পছন্দ করার মতো কিছুই ছিলো না। আমি তখন তো মেয়েদের মতোই থাকতাম না।”
সভ্য হাসে। সে ইনারার দিকে তাকায়, “তোমার রূপে হাজারো পুরুষ পাগল হতে পারে, কিন্তু তোমার রূপ দেখে তো ভালোবাসি নি আমি। তোমাকে ভালোবেসেছি। তুমি যেমন হও, যেভাবে থাকো আমি তোমাকেই ভালোবাসবো।”
“এত কনফিডেন্স?”
“হবেই তো মহারাণী, এই অনুভবে আমি যে কেবল তোমাকেই পাই।”
ইনারা একগাল হাসে। আবার সভ্যের কাঁধে মাথা রাখতে যেয়ে দেখে সুরভি দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। তার পিছনে যাচ্ছে ঐশি ও সামিও। তাদের ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল। তাদের দেখে ইনারাও চিন্তিত হয়। সভ্যকে ব্যাপারটা দেখিয়ে এগিয়ে যায় দুইজন। তারা এগিয়ে যায়। ইরফানকে শেষে পেয়ে সভ্য জিজ্ঞেস করে,”কী হয়েছ? এভাবে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
“হাস্পাতালে।”
“হাস্পাতালে?” অবাক হয় সভ্য, “কেন?”
“ফোন এসেছিল। জোহান ও সাইদের ভয়ানক এক্সিডেন্ট হয়েছে। দুইজনে হাস্পাতালে ভর্তি।”
কথাটা শুনে চমকে উঠে ইনারা ও সভ্য। সভ্য এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু ইনারা সামলায় তাকে। ইনারা জিজ্ঞেস করে, “আপনি ঠিক আছেন?”
সে কিছু মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর কাঁপানো গলায় বলে, “আমিও হাস্পাতালে যাব।”
ইনারা সভ্যের অবস্থাটা বুঝতে পারছে। সাঈদ খুব কাছের মানুষ ছিলো সভ্যর জন্য। আর জোহান তো এককালে তার বন্ধু, পরিবার, সব ছিলো। জোহান তাদের জীবন থেকে অনেক কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে কিন্তু হয়তো সভ্যের হৃদয় থেকে তার প্রতি চিন্তাটা ছিনিয়ে নিতে পারে নি। সময়ের জন্য দুইজনের মধ্যে রাগ, অভিমান, ব্যবধান আসতে পারে কিন্তু বন্ধুত্বের অনুভূতি তো আর হারিয়ে যেতে পারে না।
.
.
হাসপাতালে পৌঁছাতে সময় লাগলো তাদের। সেখানে যেয়ে দেখে সাইদের পরিবার সেখানে উপস্থিত। রিধু খুব বাজে ভাবে কাঁদছে। সুরভী তাদের কাছে যেয়ে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “বাবা… মা ভাইয়ার কী হয়েছে? ঠিক আছে তো?”
“সাইদের বেশি লাগে নি। কেবল মাথায় লেগেছে এবং হাতেও সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে ঔষধের জন্য ঘুমে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে উঠে যাবে। তারপর দেখা করতে পারব।” সুরভির বাবা জানালেন।
“আর জোহান…জোহান ঠিক আছে?” সভ্য জিজ্ঞেস করে।
“ওর অবস্থা ক্রিটিকাল।”
কথাটা শুনে ঐশি শব্দ কান্না করে দেয়, “জোহান ভাইয়া… ভাইয়া ঠিক তো হয়ে যাবে?”
এর উওর এলো না সামনে থেকে।

সভ্য থপ করে সেখানে বসে পড়ে। তার হাঁটুর উপর কণুই রেখে হাতের তালু দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়।
ইনারা বসে তার পাশে। তার কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দেবার চেষ্টা করে।
সামি ও ইরফান ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হওয়ায় আইজাও। তাকে দেখে ভড়কে যায় সুরভী। রেগেমেগে বলে, “আপনি এখানে কী করছেন?”
“সাইদের ফোন থেকে আমাকে কল এসেছিলো। তাই দেখতে…”
“লজ্জা লাগে না আপনার? এত কিছু করার পরেও এখানে মুখ তুলে চলে এসেছেন। কী নিলজ্জ আপনি!”
“মুখ সামলে। আমি সাইদের জন্য এখানে এসেছি অন্যকারো জন্য নয়।”
“সাইদ ভাইয়ার স্ত্রী এখানে আছে। এখানে আপনার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“তাই? ওর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ওর ফোনে আমার নাম্বারই বিশেষ কন্টাক্ট লিস্টে আছে। তাই তো আমাকেই সবার পূর্বে কল দেওয়া হয়েছে। আর তোমার পরিবারকেও আমিই জানিয়েছি।”
সুরভী পিছনে ফিরে তার মা-বাবার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। তারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় কথাটায়।
আইজা বলে, “আমি এখানে কোন ঝগড়া করার জন্য আসি নি। সাইদের আমাকে প্রয়োজন। ওর জন্য এসেছি।”
সুরভি আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
ইনারা কেবল একপলক তাকাল আইজার দিকে। কিছু একটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ নামিয়ে নিলো।

কিছুক্ষণ পর খবর এলো সাইদের হুঁশ এসেছে। জোহানের বিশেষ খবর নেই। সাইদের পরিবারকে ভেতরে ডাকা হলে আইজা ভেতরে যেতে চায়। কিন্তু সুরভি তাকে বাঁধা দিয়ে বলে, “ভাইয়ার পরিবারকে যেতে বলেছে। আপনি তার পরিবার না।”
আইজার রাগ উঠে কথাটা শুনে। সে সুরভির সাথে তর্ক না করে নার্সকেই বলে, “ভেতরের রোগীকে বলুন আইজা এসেছে। উনি যাকে বলে তাকে ভেতরে নিয়ে চলুন।”
নার্স সবাইকে থামিয়ে আবার ভেতরে যায়। বাহিরে এসে বলে, “পেসেন্ট বলেছে তার মা, বাবা, বোন এবং তার স্ত্রীকে ভেতরে যেতে।”
আইজা এগিয়ে যেয়েও থেমে গেল। সে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। সে এই মুহূর্তে এই স্থানে থাকা সত্ত্বেও সাইদ তাকে বাছাই করেনি, এই কথাটা অবিশ্বাস্য লাগল তার কাছে। সে রাগান্বিত সুরে বলে, “আপনি বলেছেন আমি এসেছি? আইজা এসেছে?”
“প্রথমত এটা হাস্পাতাল। তাই নিজের কন্ঠস্বর নিচে রাখুন। দ্বিতীয়ত আপনার কথা উনাকে বলায় উনি জানিয়েছে আপনাকে যেন তার সাথে দেখা করতে না দেয়া হয়। উনি আপনার চেহেরাও দেখতে চায় না।”
আইজার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। সাইদ তাকে এমনটা বলতেই পারে না। সে দেখল এক এক করে সাইদের পরিবারের সকলে ভেতরে ঢুকছে। সুরভি কক্ষে ঢোকার পর তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হাসল। আর চলে গেল।

আইজা দ্রুত যেয়ে দরজাটা হাল্কা খুলে ভেতরে ঢুকতে চাইল। কিন্তু ভেতরের এক ঝলক দেখে সে আর এগোল না। সাইদ তার পরিবারকে দেখে খুশি ছিলো। আর সে তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে এমনভাবে তাকাল যেভাবে একসময় সে তার দিকে তাকাতো। মেয়েটির কান্না দেখে মৃদু হেসে তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ধরল মেয়েটির হাত। সাথে সাথেই আইজা দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তার বুকের ভেতরের হৃদয়টা যেন কেউ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। অনেক ব্যাথা করছে। যা অসহ্যকর। এমন সময় কেউ তার পিছনে এসে দাঁড়ায় ও বলে, “এই পরিস্থিতিটা তুমি নিজে তৈরি করেছ। বলেছিলাম না, তুমি নিজের হাতে নিজের সবটা শেষ করে দিচ্ছো?”
সে পিছনে তাকায়। ইনারা দাঁড়ানো। সে গম্ভীর গলায় বলে, “আমরা একটু আলাদাভাবে কথা বলতে পারি?”

ইনারা ও আইজা সেখান থেকে যাবার পর সামি দুটো লোক নিয়ে এলো। এরাই জোহান ও সাইদকে হাস্পাতালে এনেছিল। তারা জানাল দুইজনকে রাস্তায় পেয়েছিল তারা। তারা রাস্তা দিয়ে ট্রাক চালিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তায় পেয়ে দুইজনকে হাস্পাতালে নিয়ে এলো। সাইদ একটি গাড়ির সামনে আহত পড়ে ছিলো। তার কিছুটা দূরত্বেই জোহানের গাড়ি উলটে ছিলো। আর জোহান ছিলো গাড়ির ভেতরে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো। তার দেহের কিছু অংশে কাঁচও ঢুকে গিয়েছিল। যা দেখে তারা ভীষণ ভয়ও পায়। কথায় কথায় এই দুর্ঘটনা ঘটা জায়গাটার নামও বলে লোক দুইজন। জায়গাটার নাম শুনতেই চমকে উঠে সভ্য। সে এতক্ষণে তার মাথা তুলে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তাদের দিকে। ও বল, “এটা কয়টার ঘটনা?”
“রাত আটটা।”
“আজ তো আমার সন্ধ্যা সাতটায় সে রাস্তা দিয়ে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যাওয়া হয় নি।”

চলবে…

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সভ্য বিছানায় বসে গিটার বাজাচ্ছিলো। নীরব এক মহলে। হঠাৎ করেই জোহান সেখানে এসে লাফ দিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। আর সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “ব্রো হোয়াটস আপ?”
“তোকে না বলেছি আমার আশেপাশে এভাবে লাফালাফি করবি না।”
“আহা এমন রাগারাগি করছিস কেন? তাও আজ। কিছু ঘন্টা পর আমাদের প্রথম গান রিলিজ হবে। কোথায় তুই খুশিতে নাচানাচি করবি কিন্তু উল্টো মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস।”
“আমার মুখ এমনই।” সভ্য উঠে যেয়ে গিটারটা পাশে রাখে।
কিন্তু জোহান তার পিছু ছাড়ে না। উলটো সভ্যের কাঁধে চড়ে বসে। আর উৎসুকভাব নিয়ে বলে, “আমি তো জানি মুখেই যত্তসব গম্ভীর ভাব প্রকাশ করিস কিন্তু মন থেকে তুইও আমাদের মতো যত নার্ভাস ততই উৎসুক।”
“আমার মন পড়ার জন্য তো তুই পি এইচ ডি করে রেখেছিস। এখন ভালোয় ভালোয় নেমে পড় পিঠ থেকে, নাহলে ফেলে দিলে পরে কাঁদতে পারবি না।”
“আমি কাঁদবো? আমার মতো বলিষ্ঠ পুরুষ কাঁদবে? অসম্ভব।”
সভ্য এক ঝটকায় তার হাত ধরে টান দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। ব্যাথা পায় জোহান। কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে, “এভাবে কেউ ছুঁড়ে ফেলে না-কি?”
“আহারে আমার বলিষ্ঠ পুরুষ। ঢঙ শেষ হলে উঠে প্রাক্টিস কর। কয়দিন পর লাইভ গান গাইতে হবে।”
জোহান উঠে বসে। মেঝেতে বসেই হঠাৎ সে গম্ভীর গলায় বলে, “আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না অবশেষে আমরা আমাদের স্বপ্নপূরণ করছি। গানের পৃথিবীতে প্রবেশ করছি আমরা। গান দিয়ে সকলের জীবন সুন্দর করব, সকলের মন জয় করব। তোর কী মনে হয় সভ্য আমরা কী একবছর পর সাফল্য হতে পারব? পাঁচ বছর পর আমরা সকলের মন জয় করব? দশ বছর পরও কী আমরা এভাবে একসাথে গান গাইব?”
সভ্য বাঁকা হাসে। সে জোহানের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে বলে, ” প্রথম দুটোর উওর আমার কাছে না থাকলেও শেষটার আছে। আমরা কেবল দশবছর পর না, সারাজীবন এভাবেই একসাথে গান গাইবো।”
জোহান হেসে সভ্যর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। সভ্যের কাঁধে হাত রেখে বলে, “তা তো তোর গাইতেই হবে আমি সারাজীবন জোঁকের মতো তোর পিছে যে লেগে থাকব। হাজার বিরক্ত হলেও তোকে ছাড়বো না।”
“জানি তো সারাজীবন এভাবেই জ্বালাবি আমায়।”
সভ্য বিরক্ত ভাব নিয়ে এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে। জোহানও যায় তার পিছনে। মুখ ফুলিয়ে বলে, “এভাবে বলিস কেন? আমি তোকে কোথায় জ্বালাই?”

দশবছর পূর্বের সেই স্মৃতি উঁকি দিলো সভ্যের মস্তিষ্কে। দিনগুলো মনে করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সভ্য। কত ওয়াদা করেছিল একসাথে থাকার কিন্তু সময়ের স্রোতে সব ভেসে গেল। আজ এত বছর পর সে জোহানের পাশে আছে এত সময় ধরে। তবুও জোহানের এমন করুণ অবস্থায়। সভ্যর বুক ভারী হয়ে গেল। নিজে অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরল।
.
.
ইনারা ও আইজা বসে আছে করিডরের শেষ কোণায়। দুইজনে চুপ করে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। প্রথমে এই নীরবতা ভাঙলো আইজাই, “আমার উপর হাসার জন্য এখানে আলাদাভাবে ডেকে এনেছিস? তুই যা চাইতি তাই হয়েছে। আমার ক্যারিয়ার শেষ, আমার ভালোবাসা, পরিবার সব ছিনিয়ে নিয়েছিস তুই। তুই যা বলেছিস তাই করেছিস। আর কী করতে চাস তুই?”
ইনারা হাসে, “আমি কিছু করি নি, যা করেছ তুমিই করেছ। তোমার ক্যারিয়ার কখনো এই ফিল্ডে ছিলোই না, তুমি যা সাফল্য পেয়েছ তা হয়তো তোমার মামার সুপারিশে নয়তো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে।”
ইনারার মুখে এই কথা শুনে বিস্ময়ে তার দিকে তাকাল আইজা। ইনারা বলল, “তুমি কী ভেবেছ আমি জানি না? আমি সবই জানতাম। ভিডিও ছিলো আমার কাছে। আমি তো চাইলে সে কবেই তোমার সব শেষ করতে পারতাম। করি নি, কেন জানো? কারণ তুমি কত আগেই তোমার নিজেকে শেষ করে দিয়েছ। আমি জানি ফুফুর চাহিদা এবং তার কটু কথা সহ্য করতে না পেরে তুমি এই ফিল্ডে কাজ করতে এসেছিলে। যেখানে তোমার স্বপ্ন তো ছিলো সাধারণ এবং সুন্দর। শিক্ষক হয়ে অনেকের জীবন সুন্দর করে গড়ে তোলা। অথচ তুমি সবার জীবন নষ্ট করে দিলে। প্রিয়র মৃত্যুর কথা হয়তো তুমি ভাবো নি, কিন্তু তার সম্মানের মূল্য তুমি দেও নি। তার কথা ভাবো নি, তার পরিবারের কথা ভাবো নি। আর আমার সাথে হিংসা করে তুমি আমাকে বরবাদ করতে চেয়েছিলে? যে মেয়ে ছোট থেকে তোমাকে এত সম্মান করতো, এত ভালোবাসতো। যে সবসময় তোমাকে সুখে দেখতে চাইতো তাকে? লোভে পড়ে তুমি নিজের বাবাকে হারালে। এই জাঁকজমকপূর্ণ পৃথিবীতে থেকে তুমি বের হতে চাও নি তাই নিজের ভালোবাসাকেও বিসর্জন দিলে। তুমি সাইদ ভাইয়ার এত বছরের ভালোবাসার কদর করলে না তারপরও কীভাবে আশা করো সে নিজের স্ত্রীর পরিবর্তে তোমাকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিবে? আর আমি অন্যের কথা কী বলছি? তুমি নিজেরই তো সম্মান রাখতে পারো নি। বিলিয়ে বেরিয়েছ। কী জন্য? কেবল কিছু মিথ্যে খ্যাতির জন্য। একটি মেয়ের জন্য তো তার সম্মান, তার চরিত্র তার জীবন থেকেও প্রিয় তাই না? আমিও কাকে কি বলছি। যাই হোক, যা হারিয়ে ফেলেছ তা তো আর ফিরে পাবে না। তাই যা আছে তা অন্তত যত্ন করে রাখো। আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না, কিন্তু আমি এটাও চাই না তুমি আরও কষ্ট পাও।”
কথাগুলো বলে ইনারা উঠে যায়। যাবার পূর্বে বলে, “আমি চাই না আমাদের আর জীবনের পথে কখনো দেখা হোক। তোমাকে আমি চেয়েও ঘৃণা করতে পারি না তাই ভাবতে চাই আমার আপু পাঁচ বছর আগেই প্রিয়’র সাথে হারিয়ে গেছে। সে পাঁচ বছর পূর্বে আমাদের সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে রাখতে চাই। আশা করি এতকিছুর পর তুমি নিজের ভুল বুঝতে পারবে এবং নিজের বাকি জীবনটা আমার আগের আইজা আপু হয়ে কাটাবে। যে কাওকে কষ্ট দিতে জানতো না। কেবল ভালোবাসতে জানতো।”
শেষ কথাটা বলার সময় গলা কেঁপে উঠে ইনারার। সে আর এক মুহূর্তও থাকতে পারলো না। সেখান থেকে চলে গেল।

আর এদিকে আইজা তার অতীতের সব স্মৃতি মনে করতে থাকল। তার মা বাবার সাথের স্মৃতি, ইনারার সাথে কাটানো মূহুর্ত, সাইদের সাথে সাজানো স্বপ্ন, তার বন্ধুদের কথা। সব। সাথে তার চোখের সামনে ভাসলো নিজের খারাপ কর্ম। ঈর্ষা ও লোভে সে অন্ধ হয়ে কেবল নিজের আশেপাশের মানুষদের জীবনই নয়, নিজেকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। হঠাৎ করে খুব কান্না পেল তার। সে অঝোরে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু আজ তার আশেপাশে কেউ নেই। এখান থেকে বাসায় যেয়েও কাওকে পাবে না সে। সে নিজেকে আজ একা করে দিয়েছে, ইনারা থেকে সব ছিনিয়ে নিতে যেয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে নিয়েছে।
.
.
ইনারা আবার যেয়ে সভ্যর পাশে বসে। সুরভীও বের হয়ে গেছে। এখন সাইদের সাথে তার মা ও রিধু আছে। জোহানের রক্ত লাগতো। সভ্য এক দুই না ভেবে তাকে রক্ত দেয়। অতিরিক্ত রক্ত দেওয়ায় সভ্যের শরীরও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই তাকে একটি কেবিনে রাখা হয়। সামির সাথে সুরভি জোহানকে দেখে আসে। সুরভি এসে জানায় তাকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। হাতে, পা’য়ে, মুখে অনেক স্থানে ব্যান্ডেজ করা। কয়েক জায়গায় কাঁচের টুকরো ঢুকে গেছে। এসব জানিয়ে সুরভী বলে, “সবই তার কর্মের পরিণতি। ইনারা ও দুলাভাই তাকে ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু নিয়তি তো কারও পাপ মাফ করে না।”
কথাটা শুনে সামি সরু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “সুরভি মুখ সামলে।”
“মুখ সামলে? আমি ভুল কিছু বলেছি? আপনার থেকে ভালো তো কেউ জানে না যে জোহান কি করেছে? আপনি দুলাভাইয়ের সাথে সবসময় ছিলেন। আমি তো কখনো তাকে মাফ করতে পারব না ইনারার সাথে এমনটা করার জন্য। দুলাভাইয়ের সাথে এমন করার জন্য আপনি তাকে মাফ করতে পারবেন? ওহ হ্যাঁ সে তো আবার আপনার ভাই হয়।”
“সুরভি যা জানো না তা নিয়ে কথা বলো না।”
“আচ্ছা কি ভুল বললাম শুনি? সে মিথ্যা বলে সভ্য ভাইয়া এবং ইনারার সম্পর্ক ভাঙতে চায় নি? সে কি মিঃ হকের সাথে মোশতাক আহমেদের সঙ্গী ছিলো না? না’কি এতকিছুর পরও ইনারাকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের করার জন্য এত গুজব ছড়ায় নি? কোনটা ভুল বললাম আপনিই বলুন।”
সভ্য দুইজনের এমন তর্কাতর্কি শুনে বিরক্ত হয়ে বলে, “দুইজনে প্লিজ চুপ করো, নাহলে রুম থেকে বের হও।”
সামি বলল, “আমি কী করলাম? তোর শালীই যা তা বলে যাচ্ছে।”
“আবারও যা তা বলছি? আপনি আমাকে বলুন কোনটা ভুল বলেছি আমি। উনি এতকিছু করতে পারবে কিন্তু আমি সত্যিও বলতে পারব না? একটা কথা বলি? রাস্তার ক্ষুধার্ত কাওকে দেখলেও আমার কষ্ট লাগে। কিন্তু উনার এই অবস্থা দেখে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস হচ্ছে না। উনি এটা ডিসার্ভ করে। আমার দুইটা বন্ধুর জীবন নষ্ট করার জন্য উনিও দায়ী। আপনাদের পঞ্চসুর ভাঙার জন্যও কেবল উনিই দায়ী। আপনি বলুন দায়ী না? উনি এতকিছু না করলে হয়তো আমাদের সবার জীবন অন্যরকম থাকতো।”
সামি মাথা নিচু করে নেয়। তারপর হঠাৎ রুম থেকে বের হয়ে যায়। ইনারা থামায় তাকে, “কোথায় যাচ্ছো?”
“জোহানের কথা হয়তো এখনো মামী জানে না। তাকে দেখে আসি।” বলে সামি চলে যায়।
ইনারা সুরভিকে বলে, “কেন এইসব কথা এখন তুলতে গেলি?”
“কারণ উনার জানা উচিত উনি তোকে জোহানের বিরুদ্ধে কিছু না করার অনুরোধ করলেই জোহান তার শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না।”
সভ্য অবাক হয়, “সামি ইনারাকে অনুরোধ করেছে?”
“হ্যাঁ দুলাভাইয়া ঐশির বিয়ের দিন করেছিল। যেন ইনারা জোহানকে ক্ষমা করে দেয়। ইনারা তাকে হয়তো ছেড়ে দিয়েছে। আপনিও হয়তো নিজের পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে কিছু করেন নি। কিন্তু সব কর্মের পরিণতি আছে। ভালো কর্মের পরিণতি ভালো, আর খারাপের খারাপ।”
.
.
এক ঘন্টা পর এলো সামি। এসে সবার পূর্বে ইরফানের কাছ থেকে জোহানের কথা জেনে সভ্যের রুমে এলো। ভেতরে ঢুকে দেখে ইনারা ও সুরভি এখনো সভ্যের সাথে। সভ্যকে জুস পান করাচ্ছে ইনারা। তাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে ইনারা জিজ্ঞেস করল, “সৌমিতা আন্টি কেমন আছে?”
“মামী জোহানের খবরটা জানে না। আমিও তাকে জানাই নি। মামীর মন এমনিতেই নরম। খবরটা শুনে সে অসুস্থ হয়ে পরলে সমস্যা।”
“ঠিক করেছ।”
সামি সভ্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোরও তো আজ ঐ রাস্তা দিয়ে যাবার কথা ছিলো তাই না? পরে যাস নি কেন?”
“কনসার্টের ব্যাপারে মিটিং ছিলো। লাস্ট মোমেন্ট ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছিলো।”
“ওহ।” সামি এসে বসে সভ্যের পাশে। ইনারার হাতে একটি নীল রঙের পুরাতন ডায়েরি দিয়ে বলে, “পার্টনার এটা একটু পড়ে শুনাও।”
“আমি? কী আছে এখানে?”
“ডায়েরি খুলে দেখ এবং শব্দ করে পড়, যেন সবাই শুনতে পারে।”
ইনারা তার হাতের গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে ডায়েরিটা হাতে নিলো। ডায়েরি খুলে প্রথম পৃষ্ঠায় দেখল লেখা, ‘জোহানের জাহান’।
সে অবাক হয়ে সামির দিকে তাকায়, “এটা তো জোহানের ডায়েরি।”
“প্রথম থেকে পড়তে শুরু করো।”

ইনারা শব্দ করে পড়তে শুরু করে-

পৃষ্ঠা-১ঃ আমরা ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি এক মাস হবে। এখানে স্কুলে অনেক বন্ধু হয়েছে আমার। আমি আগামীকাল থেকে নতুন মিউজিক ক্লাসে যাব। বড় হয়ে যে অনেক বড় গায়ক হয়ে বাবাকে গর্বিত করতে হবে। এই উপলক্ষে মা আমাকে এই ডাইরিটা উপহার দিয়েছে।
পৃষ্ঠা-২ঃ আজ প্রথম মিউজিক ক্লাসে গিয়েছি। অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়েছে আমার। ক্লাসের সবাই আমার সাথে অনেক কথা বলেছে। একটি ছেলে ছাড়া। সে না’কি কারও সাথে কথা বলে না। ছেলেটা অদ্ভুত, কিন্তু ট্যালেন্টেড। সে ছেলেও না-কি আমার দেশ থেকে এসেছে। তার নাম সভ্য।
পৃষ্ঠা-৩ঃ অনেক মাস পর ডায়েরি নিয়ে বসলাম। আমার ডায়েরি লিখতে ভালো লাগেনা। তাও আজ লিখতে বসলাম। সভ্যের সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে। ও বাসায় এসেছিল। তাকে দেখে ঐশী হা করে তাকিয়ে ছিলো। সভ্যকে দেখে বেশির ভাগ মেয়েরাই ভাবে তাকিয়ে থাকে।
পৃষ্ঠা-৪ঃ আজ আটমাস হলো আমরা অস্ট্রেলিয়াতে এসেছি বাবা একটিবারও দেখা করতে এলো না। আমি জানি সে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু তার কথা অনেক মনে পড়ে।
এভাবেই কিছু পৃষ্ঠা পড়ে ইনারা। আবার অনেক পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে আসে পৃষ্ঠা-৫৬ঃ আজ আমি অনেক খুশি। আজ আমরা ‘ফিফথ মেলোডি’ অর্থাৎ পঞ্চসুরের গান রেকর্ড করেছি। অবশেষে আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো পঞ্চসুরে সবাই আমার আপনজন। আমার বোন ঐশী, আমার কাজিন সামি, আর আমার ভাই সভ্য, সবাই আছে। ইরফান ছেলেটা নতুন। কিন্তু ওকেও জলদি আপন করে নিব।
পৃষ্ঠা ৫৭ঃ আজ মায়ের সাথে শ্রীমঙ্গল থেকে আসলাম। তার এক বান্ধবীর মেয়ের সাথে দেখা হলো। ও তো আমার গান শুনেই আমার ফ্যান হয়ে গেল। আমার প্রথম ফ্যান। শুনতেই কী ভালো লাগছে! আশা করি কয়েক মাস পর এমন হাজারো ফ্যান হবে আমাদের, পঞ্চসুরের।
পৃষ্ঠা-৫৮ঃ আজ আমাদের প্রথম গান রিলিজ পেয়েছে। অনেক নার্ভাস ছিলাম। আমি কেন সকলে ভীষণ অস্থির হয়ে আছি। কিন্তু সভ্য মোটেও চিন্তিত না। ও এতো শান্ত থাকে কীভাবে তা বুঝি না। আমারও মাঝেমধ্যে ওর মতো হতে ইচ্ছা করে। সভ্য বেস্ট।
পৃষ্ঠা ৫৯ঃ আমাদের গান প্রথমদিনেই ট্রেন্ডিং এ এসে পড়েছ। অবাক কান্ড। এমন প্রথম কোনো ব্যান্ডের সাথে হলো।
পৃষ্ঠা-৭০ঃ বাবা আজ আমাকে বলল, আমার মতো ছেলে হওয়া থেকে না হওয়া হাজারো ভালো ছিলো। সে আমার জন্য এত কষ্ট করে কোম্পানি শুরু করেছিলেন অথচ এই ব্যান্ডে আমার থেকে বেশি সভ্য জনপ্রিয় হয়ে গেছে। এটা তো ভালো কথা তাই না? ও এত ভালো গান গায়, বাদ্যযন্ত্র বাজায়, সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে ওরই তো সবার প্রিয় হওয়া উচিত। আমি ওর জন্য অনেক খুশি কিন্তু বাবা এমন রুক্ষ ব্যবহার করছে কেন? শুধু আমার সাথে নয়, মা এবং ঐশির সাথেও।
পৃষ্ঠা-৭১ঃ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুই ভালো লাগছে না। বাবা আমার সাথে নারাজ। প্রতিদিনই থাকে। আমি ভেবেছিলাম যখন আমি গায়ক হবো তখন তিনি আমার উপর গর্ব করবেন। কিন্তু উল্টো তিনি আমাকে অনেক কথা শোনালেন। সভ্যের থেকে এগিয়ে যেতে বললেন। সভ্যের নামে অনেক বাজে কথাও শোনালেন যা আমার ভালো লাগে নি। মা’কেও মারলেন। আমার সামনে। আমার চোখের সামন। অথচ আমি কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যন্ত্রের মতো।
পৃষ্ঠা-৭২ঃ বাবা বললেন আমাকে পঞ্চসুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় সদস্য হবার জন্য তার কথা মতো চলতে হবে। মডেলিং করতে হবে, এডস করতে হবে, জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রীর সাথে সম্পর্কের নাটক করতে হবে। এতে আমার জনপ্রিয়তা বাড়বে। কিন্তু আমার কোন কিছু করার ইচ্ছা নেই। আমি কেবল গান গাইতে চাই। আর কিছু না।
পৃষ্ঠা-৭৩ঃ সভ্য, সভ্য, সভ্য। যেখানে যাই সেখানে সভ্য ছাড়া কোন কথা নেই। আমার আর ভালো লাগে না। কেবল ওর জন্য আমার বাবার কাছ থেকে এতকিছু শুনতে হচ্ছে। ও না থাকলে বাবা আমার থেকে এত বেশি আশা তো রাখতো না। আজ ওর জন্য বাবার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। বাবা আমাকে এতকিছু শোনাচ্ছে যা আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি আর হাসতে পারি না, মজা করতে পারি না, কাঁদতেও পারি না। দিনরাত আমার কাজ করতে হয়। কাজ না করলে প্রাক্টিস করতে হয় যেন আমি সভ্যর থেকে ভালো হতে পারি। আমি ঐ মুহূর্ত নিয়ে আফসোস করছি যখন সভ্যর সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম আমি।

ইনারা পড়া থামাল। সে সভ্যের দিকে তাকাল এক মুহূর্তের জন্য। সভ্য চোখ নিচু করে আছে। সামি বলল, “সামনে পড়ো। এই ডায়েরিতে জোহানের সব মনের কথা লেখা।”
সুরভি জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু এই ডায়েরি এখন পড়ার কী দরকার?”
“দরকার আছে। পার্টনার পড়ো।”

ইনারা সামনের কিছু পৃষ্ঠা এসব নিয়েই পড়লো। জোহান তার বাবা এবং সভ্যকে নিয়েই লিখেছে। এক পৃষ্ঠায় এসে চোখ আটকে গেল তার,
পৃষ্ঠা-৮৫ঃ আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এটা এই শরীরের মাঝে আমি আর নিজেকে অনুভব করতে পারি না। এটা কে? আমি? গত সাপ্তাহে আমি একটি মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছি। মৌ তার নাম। বড় এক নায়িকা। কিন্তু অনেক ভালো। তার সাথে মিথ্যে প্রেমের অভিনয় করতে করতে ভালোবেসে ফেলেছি তাকে। অথচ আজ বাবা বলল তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে। এভাবে মেয়েটার মন আমি ভাঙতে পারি? ওকে ওয়াদা করেছি আমি। ওকে ভালোবাসি আমি। কিন্তু বাবার কথা মানতে হবে, নাহয় ঘরে আবার আতঙ্ক ছড়াবে। আর বাবা ঐশিকে গান গাইতে দিবে না কারণ তার মতে মেয়েরা ক্যারিয়ার গড়ার যোগ্য নয়।
পৃষ্ঠা-৮৬ঃ মৌ এর নামে খুব খারাপ খবর ছড়িয়েছে সব জায়গায়। আমি জানি এটা বাবা করিয়েছে। এর জন্য দোষী আমি। আমার ওর প্রেমে পড়া উচিত হয় নি।
পৃষ্ঠা-৮৭ঃ আজ দুইমাস পর আমার পঞ্চসুরের সাথে দেখা হয় আর প্রথম সভ্যের সাথে ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে এমন অবস্থায় চলে যায় যে আমি ওর উপর হাত তুলি। দোষ ওর, ওর কেন সবকিছুতে বেস্ট হতে হবে? ওর সাথে তুলনা না করলে হয়তো বাবাও আমার উপর গর্ব করতো। সবাই ওর স্থানে আমাকে ভালোবাসতো। আমার ছোট থেকে দুটোই স্বপ্ন ছিলো। গান গেয়ে সবাই মনে রাজ করা এবং আমার বাবাকে গর্বিত করা। ও কেবল আমার থেকে আমার স্বপ্ন ছিনিয়ে নেয় নি। আমার মা, বোন, আমার কাজিন সবাইকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছে। ওরা আমার থেকে ওকে বেশি আপন মনে করে। বাবা ঠিক বলে, সভ্য আমার বন্ধু নয়, শত্রু। আমার সব ছিনিয়ে নিতে চায় ও। ওর নাম থেকেও ঘৃণা হতে শুরু করেছে আমার। ও যা করতে পারে সব আমিও তো করতে পারি তাহলে কেন ওঁকে সবাই ভালোবাসে?
পৃষ্ঠা-৮৮ঃ সভ্যর সাথে ঝগড়া হয়েছে তিনমাস হলো। ও প্রতিদিন আমাকে বেহায়ার মতো কল দেয়, কথা বলার চেষ্টা করে। ও বুঝে না আমি ওকে ঘৃণা করি?

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে