অধিকার পর্ব-১০

0
3155

#অধিকার #দশম_প্রহর
#লিখাঃ #Yasira_Abisha (#Fatha)

আমি তো পিতা হতে পারবো না কোনোদিন।
কথাটা মনে মনে বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আকাশের পানে তাকিয়ে রইল ইরাদ। রাতের গভীরতা বাড়ছে সাথে কেন যেন মনের ব্যাথাটাও বারছে,, শরীরের বাইরে ব্যাথা পেলে তা ঠিক হয়ে যায় ঔষধ খেলে,, কিন্তু এই মনের ব্যাথা উপশমের কি কোনো উপায় আছে? থাকলেও হয়তো ইরাদের জানা নেই। রুহি ঘরে এসে দেখে ইরাদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
-ঘুমাবেন না?
ইরাদ বাইরের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো
-একটু পরে।
-ঘুম পাচ্ছেনা?
-না, আপনি ঘুমিয়ে পরুন।
-না একসাথে ঘুমাবো।
কথাটা বলেই রুহি বোকা হয়ে যায়।
তাই সাথে সাথে বলে
-আচ্ছা আসুন গল্প করি তাহলে।
-নামাজ পরবো একটু।
বলে ইরাদ ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
রুহি কিছু বুঝতে পারছেনা,, ইরাদ এমন করলো কেন? ও কি কোনো ভুল করলো? না এমন তো মনে হয়না,, সব তো স্বাভাবিকই ছিলো এতক্ষণ। হয়তো ইরাদ একটু সময় চাচ্ছে সব মেনে নিতে পারছেনা। তাই রুহি চুপ করে এসে শুয়ে পরলো। প্রায় ১০ মিনিট পর মনে হলো ইরাদ কি ওকে গ্রহণ করে নিতে চাইছে না? ও কি ইরাদের ওপরে নিজে চাপিয়ে দিচ্ছে?? এভাবে ইরাদের দিকে তাকিয়ে গানটা করায় তো ইরাদের বুঝার কথা ও ইরাদকে ভালোবাসে। তাহলে কি ও বুঝতে পেরেই নিজেকে দূর করতে চাইছে? হঠাৎ এটা মনে হয়ে কলিজার ভিতরটা একদম মোচড় দিয়ে উঠলো। ও তো ইরাদকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে,, এখন এই হৃদয় থেকে ইরাদ নামটা মুছে দেওয়া যে আর সম্ভব না। রুহির জীবনের প্রথম ভালোবাসাই তো এই ছেলেটা। এসব ভেবেই কান্না আসলো অনেক বেশি। চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরতে শুরু করলো। বালিশে মুখ গুজে রুহি খুব করে কাদলো। কিছুক্ষণ পরে ইরাদ ঘরে এসে দেখলো রুহি কান্না করছে। এমন কিছু দেখবে তা ও ভাবতেই পারেনি।
-কি হলো? কাদছেন কেন?
-…..
-বলুন আমাকে
-উহুম
-বলুন রুহি
ইরাদের খুব খারাপ লাগে রুহির কান্না দেখতে,, এটা ও সহ্য করতে পারেনা,,
-প্লিজ বলুন? আমি চেষ্টা করবো আপনার সমস্যা সলভ করার।
-আপনি আমার ওপরে রাগ?
– না তো।
-আমার তো মনে হচ্ছে,,
– না আমি আপনার ওপরে একদমই রাগ না।আমাকে আজকে সারাদিনে দেখে আপনার তাই লেগেছে?
– না লাগেনি
-তাহলে?
– কখনো রাগ করবেন না আমার সাথে,,
আমার খারাপ লাগে অনেক।
এই বলে রুহি করুণ নজরে ইরাদকে দেখছে,,
রুহির ওরকম বাচ্চাদের মত কথা বলায় একটা হাসি দিয়ে ইরাদ বললো,,
– না করবো না, এখন চোখ থেকে আর এক ফোটা পানিও যেন না পরে। হামহাম জলপ্রপাতে অনেক পানি আছে এক্সট্রা পানির আর দরকার নেই এখানে আর।
ইরাদের কথায় রুহি চোখ মুছে একটা হাসি দেয়।
-এবার ঘুমিয়ে পরুন অনেক রাত হয়েছে।
-হুম আপনিও আসুন।

শুয়ে থেকে কেউ ঘুমাচ্ছে না,,
-ঘুম পাচ্ছেনা?
-ইরাদ তেমন না,,
-তাহলে কিছু বলেন আমার ও তেমন ঘুম আসছে না,,
-আচ্ছা রুহি একটা কথা বলুন তো,, আপনার কি দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস আছে??
-না, কেন?
-তাহলে বাসায় থাকতে প্রতিদিন দুপুরে ঘুমাতেন যে?
-রাতে ঘুমোতে পারতাম না তাই।
ইরাদ চমকে যায়,
-কেন?
-আমি রাতে একা ঘুমাতে পারিনা, এইজন্য ভয় হয় তাই রাতে জেগে নামাজ আর কুরআন শরীফ তেলোয়াত করতাম।
-আই এম সো সরি।
-আপনি কেন সরি বলছেন?
-আগে জানলে আমি সাথে থাকতাম
রুহি কথাটা শুনে চোখ বড় বড় করে ইরাদের দিকে তাকালো।
ইরাদ এতক্ষনে বুঝতে পারলো ও কি বলে ফেলেছে।
– আজকে তো ঘুমাতে পারেন।
– হ্যাঁ গুড নাইট
বলেই রুহি ওপাশে ফিরে হাসে।

ইরাদ একটু লজ্জা পেয়েছে তা ওর বুঝতে বাকি নেই।
কিন্তু মজাই লাগছে,,
মানুষ বিয়ের আগে প্রেম করে কত শত কিছু করে আর এদিকে ও প্রেমে পরতে না পরতেই এই সুপুরুষটার সাথে আল্লাহ ওর বিয়ের ব্যাবস্থা করে দিলো। আল্লাহ কে প্রতি মুহুর্তে রুহি শুকরিয়া করতে ভুলে না। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে ইরাদ এত ফর্মাল আচরণ করে যে কিছু বলার মত রুহি পায় না,, এরকম থাকলে কিভাবে ওকে নিজের মনের কথা বুঝাবে? তাই বুঝে পায় না। নাকি আরো সময় নিবে?
হ্যাঁ আরো সময় নেওয়া দরকার।ঢাকা ফিরেই এই ব্যাপারে ইরাদকে ও বলবে এখন শুধু ইরাদের সাথে সময় কাটাবে। ইরাদকে একটু সময় দিতে হবে তো। ওর প্রেমে পরার। ওকে ভালো মত পর্যবেক্ষণ করার। সবাই কি ওর মত হুটহাট প্রেমে পরে? এই জিনিসটা রুহি ভালোই বুঝতে পারছে। আর ইরাদের জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। হয়তো ভালোবাসায় বিশ্বাস করতে ওর সময় লাগতে পারে, আর ওই মেয়েকে ইরাদ অনেক ভালোবাসতো আরিশার থেকে সবই শুনে নিয়েছে ও। এসব ভাবতে ভাবতে রুহি ঘুমিয়ে পরলো।

ইরাদ ভেবে নিয়েছে ঢাকা ফিরে ও রুহিকে বলবে ও ওর অক্ষমতার কথা। রুহি যদি চলে যেতে চায় ও নিজের ভালোবাসার কথা বলবেনা। কারণ সবার জীবনের একটা স্বাভাবিকতা আছে। ওকে আল্লাহ অক্ষম করেছে বলে এই মেয়েটাকে তো মা হওয়া থেকে ও বঞ্চিত করতে পারেনা। আর আপাতত সময়ের জন্য ও ভেবে নিলো কিছু ভালো মুহূর্ত কাটিয়ে নেই রুহির সাথে। সামনে ও নাও থাকতে পারে আমার পাশে। এই সময় গুলোই তখন আমার জীবন কাটানোর সংগী হবে।

ভোরের আলো ফুটে গেছে রুহি উঠে গোসল করে নিয়েছে নামাজ পরতে হবে, আজকে ইরাদের ঘুম ভাংছে না,, রুহি নামাজ শেষে ইরাদকে ডাক দিলো
-ইরাদ উঠুন,, নামাজ পরতে হবে।
-আরো একটু ঘুমাই।
-না না,, এখনই উঠতে হবে।
ইরাদ ঘুমের ঘোরে রুহিকে চোখ বন্ধ করেই টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে।
রুহি চোখ বন্ধ করে ফেলে,, ভালো লাগছে সকাল সকাল ইরাদের উষ্ণ ছোয়া।
রুহি বাধা দিচ্ছেনা,, এমন সময় দরজায় নক পরলো।
– কেউ এসেছে।
ইরাদ তো ঘুমিয়েই গেছে রুহি ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলতেই দেখে ছোট্ট রাশি এসেছে।
-ওরে বাবা,, আমার আম্মুটা উঠে গেছে?
-কোলে কোলে
রুহি সাথে সাথে রাশিকে কোলে তুলে নিলো।
বাচ্চাটার সাথে রুহির বেশ ভাব হয়েছে।
রাশিকে কোলে নিয়েই ও রান্না ঘরে গেলো
দেখে রাফিয়া ওর জন্য দুধ বানাচ্ছে।
-ভাবী আমাকে দাও
– না সোনা, তোমার কষ্ট করতে হবেনা। চাচিকে জালাচ্ছো কেন রাশি আম্মুর কোলে আসো?
– নাআআআ বলেই রাশি কান্না শুরু করে দিলো।
-ভাবী থাকুক আমার কাছে। এমনিতেই তো চলে যাবো আজ। আমাকে দাও খাইয়ে দেই।

রুহি ওকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে আসলো ।
কিছুক্ষন পরে ইরাদ চোখ খুলে দেখে সোফায় বসে রুহি আর রাশি খেলছে একদম মা মেয়ে মনে হচ্ছে দুইজন কে। রাশি বাচ্চাটা খুব মায়া লাগানোর মত একটা বাচ্চা। ইরাদকে উঠতে দেখে ওর কোলে চলে গেলো নেমে।
– চাচ্চু চাচ্চু কোলে
ইরাদ ওকে কোলে নিয়ে দুই গালে দুটো চুমু দিলো এরপর রুহির কোলে দিয়ে গোসল করে এসে নামাজ পরে নিলো।

সকালের নাস্তার পর ওরা সবাই বের হয়ে গেলো হোটেলে ফিরার জন্য।
পাহাড় থেকে নামতেই ইরাদ ওর ব্যাগটা পিয়ালের হাতে দিয়ে বললো ধর,,
রুহি আপাতত মাটির দিকে খুব গভীর ভাবে মনোযোগ দিয়ে রেখেছে কোনো জোক আবার পায়ের কাছে আসলো কি না সেটা দেখতেই ও ব্যাস্ত।
এমন সময় হুট করেই ইরাদ ওকে কোলে তুলে নিলো।
পিয়াল- আজকেও রোমাও জুলিয়েট এর শুরু হয়ে গেছে।
আরিশা- স্টপ ইট। নিজে তো এমন করবানা আবার ওদের পিছু লাগতেসো।
পিয়াল- সরি সরি।

হাটতে হাটতে কিছু চাকমাদের সাথে ওদের দেখা হলো। সবাই ওদের দেখে মিটিমিটি হাসছে।
ইরাদের এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
রুহির আজকে একটু বেশিই লজ্জা লাগছে।
ইরাদ এমনভাবে ওকে এসে কোলে তুলে নিলো যেন এটা ওর অধিকার। রুহি যেন ওরই। তাই এটা রুহিকে জিজ্ঞেস করার ও কোনো প্রয়োজন অনুভব করেনি ও।

জিপে বসে বসে ইরাদ গেমস খেলছে,,
আরিশা- খুদা পেয়েছে আসো সবাই খেয়ে নেই। ইরাদ ফোন রাখ।
ইরাদ- তোরা খা,, আমি একটু পরে খাবো।
সবাই চিপস নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।
রুহি প্যাকেট ছিড়ে একটা ইরাদের মুখের সামনে ধরলো
ইরাদ ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালো,
-খান,,
-আপনি?
-আমিও খাচ্ছি।
এরকম করে রুহি নিজেও খেলো ইরাদকেও খাইয়ে দিলো।
পিয়াল- দেখেন আমার মিসেস। ভাবী ওকে এভাবে যত্ন করে দেখেই যত্ন পায়।
আরিশা- হ্যাঁ হ্যাঁ থাক আমিও কম যত্ন করিনা তোমার। আর নতুন বিয়ে দেখেই ভাবী এরকম করে খাইয়ে দিচ্ছে বুঝলা?
তানি আর নিপন তেমন কিছু বলেনা ওরা শুধু হাসছে।
ইরাদ- না, উনি আগে থেকেই আমার খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুর প্রতি অনেক যত্নশীল।
ইরাদের কথায় রুহি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। এভাবে মানুষের সামনে বলে ওকে লজ্জা দেওয়ার কি আছে?
এবার সবাই একসাথেই হেসে দিলো।

হোটেলে ফিরতে ফিরতে ওদের রাত হয়ে গেলো,,
পিয়াল ইরাদকে একটা পানির বোতল দিয়ে বললো,, -ক্লান্ত লাগছে না? এটা খেয়ে নে।
-ইরাদ আর নিপন কথা বলছিলো সেই খেয়ালেই ইরাদ সব গুলো পানি গড-গড করে খেয়ে নেয়।

-আরিশা আজকে মনে হয় ইরাদ বলে দিতে পারবে ও ভাবীকে ভালোবাসে। যাস্ট ওয়েট ফর টু আওয়ারস।
– গুড জব মাই হাসবেন্ড।
এই কথা বলেই ওরা হাসাহাসি করতে থাকে।
সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে একসাথেই ডিনার করে নেয় রাত প্রায় ১০টা বাজে যার যার ঘরে চলে যায়।

রুহি খাটের ওপরে বসে আছে আর ইউটিউবে দেখছে
-কিভাবে বুঝা যায় একটা মানুষ আপনার প্রেমে পড়েছে কি না? এই বিষয়ে রুহি বেশ সিরিয়াস ও রিস্ক নিতে চাচ্ছেনা একদমই।
আর ইরাদ বারান্দায় বসে অফিসের একটা ডিলের জরুরি ফাইল দেখছে ল্যাপটপে। কিছুক্ষণ আগেই ইরাদের ম্যানেজার ওকে ফোন করে বলেছে ঠিক কাজ হচ্ছে কি না একবার দেখে দিতে তাই করছে ও।

সেই সময়ই দরজায় একটা নক পরে,,
ইরাদ বারান্দায় থাকায় রুহিই উঠে দরজা খুলে
দেখে হোটেল স্টাফ এসেছে।
-ম্যাম স্যারের সাথে একজন ভদ্রমহিলা দেখা করতে চাচ্ছেন।
-এত রাতে দেখা করা এলাইড?
– একচুয়ালি ম্যাম উনি এখানে আজকেই উঠেছেন।
-কি নাম?
– মিস মাহিরা নাজিম।
রুহি নামটা শুনে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর যেন পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে।
-এই সময়ে মাহিরা কেন এসেছে? ও কি চায় ইরাদের কাছে?
পিছন থেকে ইরাদ জিজ্ঞেস করলো।
– কে এসেছে?
রুহির গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেড় হচ্ছেনা।
শরীরে কোনো শক্তিও লাগছেনা।
রুহির আওয়াজ না পেয়ে ইরাদ উঠে আসে।

-জি বলুন?
– স্যার আপনার সাথে মিস মাহিরা নাজিম নামের একজন ভদ্র মহিলা দেখা করতে চাচ্ছে।
-কোথায় উনি?
– ৫০৯ তে আছেন
-আপনি যান আমি আসছি।
-রুহি দরজা লক করে রাখুন।
এই বলেই ইরাদ ওই অবস্থায় সাথে সাথে বেড় হয়ে গেলো।
রুহি দরজাটা লক করে ওখানেই মাটিতে বসে পরলো।
হাত পা একদম অবশ লাগছে৷ মনে হচ্ছে কেউ যেন কলিজাটা কেটে ফেলেছে।
ইরাদ কিভাবে পারলো ওকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে? শত হলেও তো রুহি ওর স্ত্রী।
একটা বার কি ওকে জিজ্ঞেস করা উচিত মনে হয়নি ইরাদের? এভাবে করে প্রাক্তনের কাছে রাতের বেলা চলে যাওয়ার কোনো মানে হয়? ইরাদ কি তাহলে রুহি কে চায় না একদমই? তাহলে এত যত্ন এত আদরের কি দরকার ছিলো? কেন এত মায়ায় ফেলে ওকে রেখে গেলো ইরাদ?
প্রায় ১০ মিনিট পরে ইরাদ ঘরে আসে
রুহি দরজা খুলতেই ওকে জড়িয়ে ধরে বলে
আজকে আমি অনেক বেশি খুশি…

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে