অতঃপর_তুমি পর্ব-১২

0
5210

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

অভ্র’র মায়ের রুমে পুনরায় যেতেই তিনি আমার হাতে খুব সুন্দর একটি নীল রঙের জামদানী শাড়ি দিয়ে পড়ে আসতে বললেন।আমি শাড়ি হাতে নিয়ে কাঁচুমাচু করতে লাগলাম।কারণ আমি শাড়ি পড়তে পারি না আর এই কথাটা তাকে বলতে আমার ভয় ভয় লাগছে।অভ্র’র মা আবার বললেন,
‘কি হলো যাও।’
আমি আমতা আমতা করে যাওয়ার জন্য পেছনে ঘুরতেই তিনি ডেকে গম্ভীর হয়ে বললেন,
‘তুমি শাড়ি পরতে পারো না?’

আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।অভ্র’র মা একটু বিরক্ত হয়ে তার রুমের দরজা বন্ধ করে বললেন,
‘এদিকে আসো।’

মা খুব সুন্দর করে আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে লাগলেন।শাড়ির কুঁচির উপরিভাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিচ দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে বললেন,
‘শাড়ি পড়াটা শিখে নেবে।নতুন বউদের মাঝে মাঝে শাড়ি পড়া দেখতে ভালো লাগে।এখনকার মেয়েরা তো শাড়ি পড়াটাকেই খ্যাত মনে করে।পড়তেই চায় না।অথচ মেয়েদের সবথেকে বেশি সুন্দর কিন্তু শাড়িতেই লাগে।নাকি তোমারও আবার শাড়ি পড়তে ভালো লাগে না?’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তার কথায় অস্বীকৃতি জানিয়ে বোঝালাম ভালো লাগে।শাড়ি পড়তে আমার সত্যিই ভালো লাগে।বাসায় অনেকবার মায়ের শাড়ি নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নার সামনে নিয়ে নিজের উপর মেলে দেখতাম।পড়তে পারতাম না বলে পড়া হতো না।মাকে পড়িয়ে দিতে বলতেও খুব লজ্জা করতো, তাই আর বলা হতো না।

আমার শাড়ি পরানো যখন একেবারে শেষের দিকে তখন অভ্র অফিস থেকে বাড়ি ফিরলো।অভ্র’র মা আমার শাড়ির আঁচল পাটে পাটে ভাঁজ করে পরিয়ে দিচ্ছিলেন ঠিক তখন অভ্র’র গাড়ির হর্ন শুনতে পাই।আমি চমকে উঠে বন্ধ দরজার দিকে তাকাই আর অভ্র’র মা খুশি হয়ে বলে উঠলেন,
‘অভ্র এসে পড়েছে।’

শাড়ি পরানো শেষ হওয়ার পরেও অভ্র’র মা আমাকে ছাড়লেন না।মাথার চুল আঁচড়ে দিলেন,চোখে একটু কাজল দিয়ে দিলেন আর কিছু সোনার গয়না পাতি পড়িয়ে দিলেন।

সবকিছু শেষে আমাকে ধরে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে খুব আস্তে বলে ফেললেন,
‘মাশাল্লাহ!’
উনি খুব আস্তে বললেও আমি তার মুখের কথাটা শুনে ফেলি।

১৭.
অভ্র’র রুমের দরজার কাছে এসে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।পা যেনো আর এগোচ্ছে না।অভ্র’র মা আমাকে ঠেলে অভ্র’র রুমে পাঠিয়ে দিয়েছেন।পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম অভ্র ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত থেকে ঘড়ি খুলছে।তার দৃষ্টিও সেখানেই নিবদ্ধ।জড়তা কাটিয়ে হাত দিয়ে পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই আবার কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম।হাত দিয়ে পর্দা সরানোর সময় হাতে থাকা চুড়ির মৃদু রিনিঝিনি শব্দে অভ্র আমার দিকে একটু বেখেয়ালী ভাবে তাকিয়ে চোখ সরাতেই আবার সাথে সাথে চোখ তুলে তাকালো।এবার লজ্জায় আমি আরো জড়সড় হয়ে গেলাম।চোখ তুলে তার দিকে আর তাকাতে পারছিলাম না।বুকের মধ্যে প্রচন্ড ধুকপুক করতে লাগলো।আজ আমার এতো লজ্জা লাগছে কেনো বুঝতে পারছি না।শাড়িই তো পড়েছি,শাড়ি কি মানুষ পড়ে না!
হয়তো হঠাৎ করে অভ্র’র সামনে শাড়ি পড়ে সেজেগুজে আসার জন্যই এই লজ্জার ভূত এসে আমার উপর ভর করেছে।তার উপর আবার সাজিয়ে দিয়েছে অভ্র’র মা নিজেই।
আমি একবার চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়েই আবার ঝট করে নামিয়ে ফেললাম।
অভ্র আমার দিকে সেই যে চোখ তুলে তাকিয়েছে আর দৃষ্টি ফেরায় নি।হাতের ঘড়ির ফিতা খোলা অবস্থায় আধো খুলে এখনো তাকিয়ে আছে।তা দেখে আমার লজ্জা যা ছিলো আরো দ্বিগুন হয়ে গেলো।হাত দিয়ে শাড়ির আঁচলের কোনা আঙ্গুলে পেঁচাতে লাগলাম।আমার মনে হতে লাগলো আর কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো আমি মরেই যাবো।

আমাকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিলো চম্পা।নিচ থেকে তার মাইক আলা গলা দিয়ে আমাকে ডেকে উঠলো দুপুরের খাবারের জন্য।আমি একপ্রকার দৌড়েই সেখান থেকে বেঁচে পালিয়ে আসলাম।

নিচে নেমে আসতেই অভ্র’র মা আমাকে এক সাইডে নিয়ে গিয়ে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘অভ্র রুমে ছিলো?’
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
‘তোমাকে শাড়ি পড়া দেখে কি করলো?
আমি নার্ভাসে মুখ ফসকে সত্যিটাই বলে ফেললাম,’তাকিয়ে ছিলো।’
অভ্র’র মা আরো উৎসাহিত হয়ে বললেন,
‘অনেকক্ষণ?’
তার প্রশ্নে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম।হয়তো তিনিও বুঝতে পারলেন উত্তেজিত হয়ে তিনি ছেলের বউকে কি বিব্রতকর প্রশ্ন করে ফেলেছেন।
কথা ঢাকতে তিনি আবার ঠিক হয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘খেতে আসো।’

অভ্র’র মা খেতে বসলেন না দেখে আমিও বসলাম না।তিনি মাঝের চেয়ারটি টেনে হাসি মুখে স্বামীর সাথে টুকটাক গল্প করে যাচ্ছেন।আজকে তাকে অনেক খুশি খুশি লাগছে।আমাকে খেতে বসতে হলে অভ্র’র সামনাসামনি মুখ করা চেয়ারটিতেই বসতে হবে বিশেষত সেই কারণেই এখন না খেতে বসা।অভ্র একটি হালকা সবুজ রঙের শার্ট পড়ে খেতে বসেছে।সম্ভবত তিনি গোসল করেছেন।তার সামনের চুলগুলো হালকা হালকা ভেজা।আমি যেই কারণের জন্য খেতে বসলাম না অভ্র’র মা আমাকে আরো বেশি সেই অবস্থায় ফেলে দিলো।আমি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।অভ্র’র মা আমাকে ডেকে বললেন অভ্রকে খাবার বেড়ে দিতে।
অভ্র’র পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই অভ্র আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার টেবিলের দিকে চোখ নিয়ে বলল,
‘আমি নিয়ে খেতে পারবো।তুমি গিয়ে খেতে বসো।’
‘না আমি পরে খাবো।’

আমি যতবারই বাসনপত্রের চামচ ধরে অভ্রকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলাম ততবারই আমার হাতের চুড়ির জন্য অনবরত মৃদু রিনরিনে শব্দ হতে লাগলো।এই শব্দের জন্যই হয়তো অভ্র’র চোখও বারবার আমার হাতের দিকে পড়ছে।
আমি উনাকে ঝাল মাংস বেড়ে দিতে গেলাম।দু পিস দিতেই তিনি আর দিতে না করলেন।কিন্তু শ্বাশুড়ি মার ইশারা অনুযায়ী আমি আবারো তাকে দিতেই লাগলাম।তাড়াহুড়োয় তিনি আমাকে থামাতে ঝট করে আমার হাত ধরে ফেললেন।হাত ধরে থতমত খেয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন।আমিও স্ট্যাচু হয়ে গিয়ে তার দিকে তাকালাম।অভ্র থতমত ভাব সামলিয়ে আমার হাত ছেড়ে দিলো।

বিকেল বেলায় আরিশা আপু আর দুলাভাই এ বাড়িতে বেড়াতে আসলেন।তুতুল নাকি খুব জেদ করছিলো নানু বাড়ি আসার জন্য।তুতুল এসেই আমার কোলে উঠে পড়লো।আমি একটি চকলেট নিয়ে এসে তুতুলের হাতে দিলাম।তুতুল আমার কোল থেকে আর নামতেই চাইছে না।আরিশা আপু এসে তুতুলকে আমার কোল থেকে নামিয়ে বলল,
‘তুতুল বাবা,নানু বাড়ি এসে মামানির কোলে বসে থাকলেই হবে!যাও নানা ভাইয়ের সাথে দেখা করে এসো।’
তুতুল চলে গেলে আরিশা আপু আমার মুখ ধরে বললেন,
‘বাহ!অরু তোমাকে দেখতে তো আজ খুব সুন্দর লাগছে।’
আমি লজ্জা পেয়ে মুচকি হেঁসে মাথা নিচু করলাম।
আরিশা আপু বলতে লাগলেন,
‘জানো অরু,অভ্র শাড়ি পড়া খুব পছন্দ করে।আগে আমি যখন কলেজে থাকতে মাঝে মধ্যে শাড়ি পড়তাম তখন ছোট্ট অভ্র এসে আমার শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতো।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখতো।আর আমাকে প্রতিদিনই বলতো আপা শাড়ি পড়ো,শাড়ি পড়ো।ছোটোবেলা থেকেই পাগল একটা!যেটা ভালো লাগবে সেটা লাগবেই।’

দুলাভাই আমাদের মাঝে এসে বললেন,
‘কি অবস্থা অরু?আমাদের শালা সাহেবকে পেয়ে তো আমাদের কথা ভুলেই গেছো।’

আমি হেঁসে বললাম,
‘কোথায় দুলাভাই?আপনারাই তো আমাদের কথা ভুলে গেছেন।কতদিন পর এবার আসলেন।’

‘আমরা আসি নি তো কি,তোমরা তো আমাদের বাসায় যেতে পারতে।’

অভ্র সোফায় বসে তুতুলকে কোলে নিয়ে ওর হাতের একটি পিস্তল নিয়ে খেলছিলো আর চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথাই শুনছিলো।দুলাভাই একবার অভ্র’র দিকে তাকিয়ে গলা উঁচু করে বললেন,
‘না এতে তো তোমার দোষ না।আমার শালা সাহেব না নিয়ে গেলে তুমি যাবে কিভাবে!এই অভ্র,এদিকে আয়।’

অভ্র দুলাভাইয়ের কথা অনুযায়ী কাছে এসে দাঁড়াতেই দুলাভাই অভ্র’র হাত ধরে টেনে এনে আমার সামনে দাঁড়া করিয়ে বললেন,
‘বল,অরুকে নিয়ে আমাদের বাসায় এখনো কেনো যাস নি?’

অভ্র আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
‘দুলাভাই ব্যস্ত থাকি।’
‘চুপ।আমার সাথে ব্যস্তগিরি দেখাস।কবে নিবি বল।’
‘নিবো একদিন।’
‘সেই একদিনটা যেনো তাড়াতাড়ি হয়।অরু,তুমি আমার ছেলেটার উপর কি যাদু করেছো কে জানে!সারাদিন শুধু মামানি মামানি করে।আমি তো ভয়ে আছি এই যাদুটা আবার আমার শালা সাহেবের উপর না হয়ে যায়!তুতুল তো তবুও ছোট সবার সামনে চেচাঁমেচি করে মামানির কাছে থাকার কথা বলতে পারে।কিন্তু আমার শালা সাহেবের এই অবস্থা হলে তার তো আর রক্ষে নেই!’

দুলাভাই তার স্বভাব মত মজা করে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লেন।আর এখানে আমি আর অভ্র আবারো অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে বিব্রত হয়ে পড়লাম।ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলে পারতো কিন্তু তা হলো না।আমাদের নিয়ে হাসাহাসি আর ঠাট্টা মজার পর আরিশা আপু আর দুলাভাই সরে পড়লো।আমি আর অভ্র তখনও ঐ একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।আমি সেখান থেকে সরে পড়ার জন্য পা আগাতে যাবো ঠিক তখনই তুতুল কোথা থেকে এসে আমাকে পেছন থেকে একটা ধাক্কা দিয়ে অভ্র’র গায়ে ফেলে দেয়।আমরা দুজনই ব্যালেন্স সামলাতে সামলাতে কোনো মতে পরে যাওয়া থেকে বেঁচে যাই।কি একটা অবস্থা,ভাবা যায়!

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে