অতঃপর_তুমি পর্ব-১৩

0
5016

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

‘অরু,তুমি কি জানো আজকে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।শাড়িতে কাউকে এতোটা সুন্দর লাগতে আমি আগে কখনো দেখি নি।’

অভ্র’র কথা শুনে আমি লজ্জা মাখা মুচকি হাসি দিয়ে সামনের অবাধ্য চুলগুলোকে কানে গুঁজে মাথা নিচু করলাম।তুতুল আরেকটা চকলেট খেতে চাওয়ায় আমি রুমে এসেছিলাম ও’র জন্য চকলেট নিতে।এসে দেখি অভ্র আগে থেকেই রুমে।সোফায় বসে ফোন টিপছিলো।ভেতরে ঢুকে পড়ায় তাকে এড়িয়ে আবার চলে যাওয়াটা ঠিক দেখায় না দেখে আমি চুপচাপ চকলেট বের করার জন্য আমার ব্যাগ খুঁজতে লাগলাম।খোলা জানালার ধারে একটি চেয়ারে ব্যাগটি রাখা।আমি ধীর পায়ে ব্যাগটি খুলে চকলেট বের করলাম।জানালা দিয়ে আসা পড়ন্ত বিকেলের লাল রশ্নির আভা একদম মুখে এসে পড়েছে।তার সাথে সেই উদ্যম বাতাস তো আছেই।চকলেট বের করে যাবার জন্য এক পা বাড়ানোর আগেই অভ্র আমাকে ডেকে কথাগুলো বলল।

‘দাঁড়াও তোমার একটা ছবি তুলে দেই।যখন বুড়ো হবে তখনে দেখবে শাড়িতে তোমাকে আগে ঠিক কতোটা সুন্দর লাগতো।’

কথাটা বলেই তিনি আলমারী থেকে তার ক্যামেরাটা বের করলেন।এবং আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার সেই অবস্থাতেই ক্যামেরার শাটার টিপে একটা ছবি তুলে ফেললেন।

ঠিক তখনই তুতুল রুমে আসলো আমার খোঁজে।অভ্র’র হাতে ক্যামেরা দেখে চট করে তার হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে এক ছুটে দৌড়ে পালালো ক্যামেরা নিয়ে।অভ্রও তার ক্যামেরার জন্য তুতুলের পেছনে ছুটতে লাগলো।আমিও তাদের অনুসরণেই রুম থেকে বেরোলাম।তুতুল ছুটতে ছুটতে তার বাবার সামনে গিয়ে পড়লো।দুলাভাই তুতুলকে ধরে ফেলে হাত থেকো ক্যামেরাটি নিয়ে বললেন,
‘তুতুল এভাবে বড়দের জিনিস ধরতে হয় না বাবা।বাহ!অভ্র,তোর ক্যামেরাটা তো দারুণ।এরকম আগের দিনের ক্যামেরাগুলো তো এখন দেখাই যায় না।এখন স্মার্ট ফোন বের হওয়ায় মানুষ তো ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলাই ভুলে গেছে।’

আরিশা আপু বললেন,
‘ঠিক বলেছো,আগে কতো সুন্দর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতাম তারপর প্রিন্ট করে এলব্যামে রেখে দিতাম।সেসব ছবিগুলো এখন দেখতে কতো ভালো লাগে।আর এখন মানুষ ফোনেই ঘন্টার পর ঘন্টা ছবি তোলে,সেলফি তোলে ঠিকই অথচ সেই ছবিগুলো কিন্তু আর প্রিন্ট করে বের করে রেখে দেওয়া হয় না।হুট করে হঠাৎ দেখা যায় ফোন থেকে ডিলিট হয়ে গেছে।তাই সেই সময়গুলোর আর কোনো চিহ্নও থাকে না।’

আরিশা আপু এরপর তার মার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়,আমরা সবাই মিলে আজ একটা ফ্যামেলি ফটো তুলি।আমাদের তো একসাথে এমন কোনো ছবিই নেই।কি বলো মা?’

মা বললেন,’ভালোই তো হয়।ঘরের মধ্যেই তুলবি?’

দুলাভাই বললেন,’ছবি তুললে চলো ছাঁদে যাই।সেখানে আলো আর ব্যাকগ্রাউন্ড দুটোই সুন্দর আসবে।’

আমরা সবাই ছাদে চলে আসলাম ফ্যামিলি ফটো তোলবার জন্য।বাবা মা দুজন চেয়ারে বসেছেন।তাদের ডান দিকে আরিশা আপু আর দুলাভাই তুতুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছে আর বাম সাইডে দাঁড়িয়েছি আমি আর অভ্র।মফিজ ভাইকে ডেকে আনা হয়েছে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য।কিন্তু মফিজ ভাই একটা ছবিও ভালো মতো তুলতে পারছেন না।সবাই একসাথে রেডি হতে না হতেই বাটনে চাপ দিয়ে দিচ্ছেন।যার ফলে একজনের চোখ বন্ধ আসছে আরেকজনের মুখ হা হয়ে আছে এমন ছবি উঠছে।অভ্র’র মা একদফা বকা দিয়ে ফেললো মফিজ ভাইকে।কারণ তার সব কটা ছবিতেই চোখ বন্ধ এসেছে।তিনি তা দেখে রেগেমেগে বললেন,
‘হতচ্ছাড়া!আমাকে কি সবার কাছে অন্ধ হিসেবে দেখাতে চাস?ভালো করে তোল না হলে তোর চাকরি আউট।’

এই অবস্থা দেখে দুলাভাই নিজে এসে প্রথমে ক্যামেরা চোখের কাছে ধরে সবার পজিশন ঠিক আছে কি না দেখলেন।হঠাৎ আমার আর অভ্র’র দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
‘অভ্র অরু,তোমরা এমন মাঝে আটলান্টিক মহাসাগর বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?আরেকটু কাছাকাছি আসো নয়তো ছবিতেই তো ঠিকমতো আসবে না।’

দুলাভাইয়ের তাগাদায় অভ্র একটু আমার কাছে এসে দাঁড়ালো।কিন্তু এতে দুলাভাইয়ের হলো না। তিনি আবারো বললেন,
‘আরে হয়নি তো!অভ্র তুই আরো একটু অরুর কাছে আয়।’

অভ্র একটু সঙ্কোচ করে আমার আরেকটু কাছে ঘেষে দাঁড়ালো।দুলাভাই পুনরায় ক্যামেরাটি চোখের সামনে ধরে বললেন,
‘নাহ!কেমন যেন মানাচ্ছে না।কি যেন খালি খালি লাগছে।অভ্র,তুই একটা কাজ কর।অরুর কাঁধে হাত রাখ।’

দুলাভাইয়ের কথা শুনেই আমরা দুজন লজ্জা পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।অভ্র আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আপত্তি করে বলল,
‘দুলাভাই,একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না!ফ্যামিলি ফটো কেউ এভাবে তোলে?’

অভ্র’র বাবা পেছনে মাথা ঘুরিয়ে অভ্রকে ধমক দিয়ে বললেন,
‘বেশি বেশি কি রে?যা বলছে তা করতে পারিস না!ছবিটা তো সুন্দর আসতে হবে নাকি!’

সবার জোরের মুখে পরে অভ্র খুব সঙ্কোচের সাথে আমতা আমতা করে আমার কাঁধে হাত রাখলো।আমার অবস্থাও একই।অভ্র’র আমার কাঁধে হাত রাখতেই মনে হলো পুরো শরীরে যেনো কিসের ঢেউ খেলে গেলো।দুলাভাই আর সময় নষ্ট না করে অতিবিলম্বে মফিজ ভাইয়ের হাতে ক্যামেরা দিয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলেন।আর মফিজ ভাইয়ের হাতের চাপ বাটনে পড়ে একটি সুন্দর স্মৃতি ক্যামেরার রিলে বন্দী হয়ে পড়লো।

চায়ের খালি ট্রে হাতে করে অভ্র’র মায়ের রুম থেকে বের হলাম।একটু আগেই রুমের মধ্যে থাকা আরিশা আপু আর মা’কে চা দিয়ে এসেছি।রুম থেকে বের হতেই থমকে দাঁড়ালাম ভেতরে শুরু হওয়া কথা শুনে।
আরিশা আপু বলে উঠলেন,
‘মা,তুমি অরুকে নিয়ে সেদিন ফোনে কি যেন বলছিলে?’
অভ্র’র মা বললেন,
‘বলছিলাম যে অরু মেয়েটা মনে হয় ভালোই।এই চার মাসে তো দেখলামই ভদ্র,শান্ত শিষ্ট।তাছাড়াও তোর বাবা বলছিলো অভ্র’র এভাবে ঠিক হওয়ার পেছনে হাত নাকি অরু’র।আমি তখন অতোটা বিশ্বাস করি নি।পরে ভেবে দেখলাম সত্যি হলেও হতে পারে।’

‘হুম ঠিকই বলেছো।বাবা আমাকেও এই কথা বলেছেন।ইরার ছোটো বোন বলেই আমি এতোদিন ওঁকে অতোটা ভালো নজরে দেখি নি।ভেবেছি অরুও হয়তো ও’র বড় বোনের মতোই।কিন্তু ইদানিং আমি ভেবে দেখলাম ইরা অন্যায় করেছে বলে তার ছোটো বোনও যে তার মতোই হবে এমন তো কোনো কথা নেই।অরুর সাথে আমরা কেমন ব্যবহার করি! ভালোমতো দুটো কথা অব্দিও বলি না।তবুও মেয়েটা আমাদের দেখলেই কিভাবে হাসিমুখে এগিয়ে আসে,কথা বলে।তুতুলকেও কতোটা আদর করে।অরু আর অভ্র’র বিয়েটা তো হয়েই গেছে।আমারও মনে হয় অরু অভ্র’র জন্য খারাপ হবে না।’

‘আমি তো শুধু চাই আমার ছেলেটা ভালো থাকুক।জীবনে সুখী হোক।অভ্র ও’র কষ্টটা ভুলে আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারুক।অরু যদি ভালো মেয়ে হয়েই থাকে তবে ওরা দুজন সুখে সংসার করুক।ওদের সংসারটা গোছানো দেখতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত হবো।’

‘মা,তুমি চিন্তা করো না।অরু ভালো মেয়েই।অভ্র দেখবে ঠিক ভালো থাকবে।’

‘হুম সেটাই।’

আড়ালে লুকিয়ে কারো কথা শোনার স্বভাব আমার একদমই নেই।কিন্তু আজ কোনো ভাবেই না শুনে যেতে পারছি না।অভ্র’র মা আমার উপর আর অসন্তুষ্ট নন শুনে খুব ভালো লাগলো।নিজের অজান্তেই চোখ ছলছল করে ঠোঁটের কোণায় একটি মৃদু হাসি ভেসে উঠলো।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে