অতঃপর সন্ধি পর্ব-০৭+৮

0
1664

#অতঃপর_সন্ধি (০৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

গুটি গুটি পায়ে তিনশত পয়ষট্টি দিন পার হয়ে গেলো চোখের ইশারায় । এই তিনশত পয়ষট্টি দিনে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। গভীর থেকে গভীর হয়েছে পুষ্পিতা আর মায়ানের ভালোবাসা।

মোটা বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে মায়ান। এক লাইন পড়ছে তো আরেক লাইন মাথা থেকে ফুউউস করে বের হয়ে যাচ্ছে। একঘেয়েমি জেঁকে ধরলো তাকে আষ্টেপৃষ্টে। বইয়ে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে রইলো। ক্লান্তি আর টেনশনে চোখ লেগে গেলো তার। আতিকের ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে। চোখজোড়া লাল। হুট করে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।

‘ঘুমিয়ে গিয়েছিলি নাকি?’

চোখ পিটপিট করে নিঃশব্দে মাথা ঝাকায় সে।

‘তোর ফুলবানু সেই কখন থেকে কল করে যাচ্ছে।’

চোখের ঘুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো মায়ানের।তৎক্ষনাৎ পুষ্পিতার নম্বরে ফোন লাগালো। আতিক আহাম্মকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে।

‘আগে শুনতাম প্রেমিকা চুমু দিলে এনার্জি পাওয়া যায়। এখানের মামলাই তো অন্যরকম দেখছি। প্রেমিকার নাম নিতেই দেখি দূর্বল প্রেমিক চাঙা।’

চোখ রাঙানি দেয় মায়ান। আতিক আরো কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই মায়ান হাতে কাছে থাকা কলমটা ছুড়ে মা’রে তার উপর।

‘পড়ছিলেন বুঝি?’

ওপাশ থেকে পুষ্পিতার কন্ঠ শুনে স্বাভাবিক হলো মায়ান।

‘বই সামনে নিয়ে বসে আছি।’

পুষ্পিতা কোমল অনুরোধের সুর টানলো।

‘আপনার পরীক্ষার জন্য আমাদের মিট হয় না অনেকদিন। বিকেলে মিট করতে পারবেন? আমার চোখের তৃষ্ণাও মিটলো আর,,,,,,, ‘

কথা অসম্পূর্ণ রেখেই থেমে গেলো পুষ্পিতা। কপাল কুঁচকে মায়ান প্রশ্ন করলো,

‘আর কি?’

‘আমি নিজ হাতে বিরিয়ানি রান্না করেছি।’

‘আমার ফুলবানু বিরিয়ানি রান্না করেছে। সেটা খাওয়ার জন্য হলেও আমাকে মিট করতে হবে।’

_________________

বিগত দিনগুলোতে পুষ্পিতা আর মায়ান যতটা কাছে এসেছে এর থেকেও তিনগুণ দূরত্ব বেড়েছে পুষ্পিতা আর তানজিফের মাঝে। লাস্ট কবে তানজিফ পুষ্পিতাকে জ্বালিয়েছে মনে পড়ে না তার। ক্লাসের ফাঁকে দুজনের চোখাচোখি হলে এখন আর তানজিফ চোখ মা’রে না। বিষন্ন মুখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

পুষ্পিতার হাসোজ্জল ছবির দিকে নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো তানজিফ। কখনো জুম করে চোখ দুইটা দেখছে কখনো বা ঠোঁট। বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করছে। অদৃশ্য যন্ত্রণায় কেমন নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। পুষ্পিতার হাত দু’টো ধরে খুব করে বলতে ইচ্ছে করে,

‘আমায় একটু ভালো কেন বাসলি না? তোর দহনে আর শুন্যতায় আমি যে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি ভালো নেই। রোজ তোর সাথে অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমার একটু বিশ্রাম দরকার।’

তবে বলা হয় না। হয়তো আর কখনো বলা হবেও না।

‘আমি ঘুরতে যাবো ভাইয়া।’

অকস্মাৎ তিতিরের গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাবড়ে যায় তানজিফ। তিতির দেখার আগেই মোবাইল উল্টো করে ফেলল। একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালালো।

‘কি করবি তুই?’

‘ঘুরতে যাবো।’

বলে ঢং করে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করলো। তবে ছোট ছোট চুলগুলো আর কান অবদি গেলো না।

তিতিরের এমন ঢং দেখে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো তানজিফ।

‘ঢং করে লাভ নেই ওগুলো কানের পিছনে যাবে না।’

গাল ফুলালো তিতির।

‘আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাও।’

‘তুই ঘুরবি?’

প্রফুল্ল হেসে মাথা নাড়ে তিতির। বিলম্ব না করে তানজিফ তিতিরের একটা আঙ্গুল ধরে মাথার উপরে তুলল। আঙ্গুল ধরে কয়েকবার ঘুরিয়ে বলল,

‘ঘুরতে চেয়েছিস? কয়েকবার ঘুরিয়েছি। যা গিয়ে পড়তে বস।’

ধপাস করে শুয়ে পড়লো। বালিশ জড়িয়ে ঘুমো ঘুমো গলায় বলে উঠলো,

‘যাওয়ার আগে দরজা টেনে যাস।’

নাক ফুলাচ্ছে তিতির। চোখ দুইটা লাল হয়ে কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। রাগে, ক্ষোভে সে গরগর করতে লাগে। কাল বিলম্ব না করে এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে আম্মুউ বলে উঠলো।

______________

বাদামের খোসা ছাড়িয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে মুখে দিলো পুষ্পিতা। গম্ভীর স্বরে বলল,

‘তোর চশমিশ টিচার তো আজকাল বড্ড গ্যাপ দিচ্ছে। এমন করলে কিন্তু উনার কাছে আর তোকে পড়াবো না। সাফ সাফ বলে দিবি।’

ভ্রু কুঞ্চিত করে ফারদিন দৃষ্টিপাত করলো।

‘আমার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ ভুলে গিয়েছো? আর ভাইয়ারও পরীক্ষা চলছে।’

থতমত খেয়ে গেলো পুষ্পিতা। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,

‘ ত তো? মা তো তোকে বছরের শেষ সময়েও পড়ায়।’

ফারদিন রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই পুষ্পিতা নির্বোধ, অর্থহীন হাসলো।

‘মা, একটা বক্সে বিরিয়ানি দাও তো। জারিনের জন্য নিয়ে যাবো। ফাজিলটা বিশ্বাসই করছে না আমি যে রাঁধতে পারি।’

কোনো রকম ফারদিনের সামনে থেকে উঠে এলো।

_____________________

কালো বোরকায় মুখ ঢাকা পুষ্পিতার। ভয়ার্ত চোখে সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চেনা জানা মানুষ চোখ দেখলে চিনতে পারে।

বক্স থেকে এক চামচ মুখে পুরে নিলো মায়ান।

‘আজ এভাবে বোরকা টোরকা পড়ে এসেছেন, ঘটনা কি ফুলবানু?’

‘আমার এই ফুলবানু নামটা শুনলে কিন্তু খুব রাগ হয়।’

‘কিন্তু আমার যে ভালো লাগে ডাকতে। ফুলবানুউউউউউ।’

ক্রোধান্বিত চোখে তাকায় পুষ্পিতা।

‘এভাবে তাকাবেন না ফুলবানু। আপনার চাহনি আমার কলিজায় এসে লাগে।’

এবারে পুষ্পিতা চাহনি তীক্ষ্ণ হয়ে এলো।

‘আমি আপনাকে ফুলবানু বলেই ডাকবো। আপনি যতই রাগ করেন না কেন। এখন বলেন এভাবে কেন এসেছেন?’

‘মিথ্যে বলে বাসা থেকে বের হয়েছি। যদিও মিথ্যে না। আগে জারিনদের বাসায় গিয়েছি। সেখানে বোরকা পড়ে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। কেউ যদি আমাকে চিনে ফেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

‘এতো কষ্ট কার জন্য, ফুলবানু?’

‘শরীরে রং বেশি তাই।’

অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা।

‘নেকাবটা কি একটু খুলবেন?

জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকায় পুষ্পিতা।

অনুরক্ত, আবেগী স্বরে কন্ঠনালী দিয়ে নির্গত হলো,

‘আপনাকে খাইয়ে দিতাম।’

পুষ্পিতার তীক্ষ্ণ চাহনি এবার শীতল হয়ে এলো। কোমল, মোলায়েম স্বরে বলল,

‘আমি খেয়েছি।এটা আপনার জন্য এনেছি।আপনি বরং খান।’

‘তবে আপনি খাইয়ে দিন।’

পুষ্পিতা উত্তেজিত স্বরে বলল,

‘আসতাগফিরুল্লাহ্, এই পাবলিক প্লেসে অন্তত আমি পারবো না।’

‘কেউ তো আপনাকে চিনবে না।’ বলে পুষ্পিতার হাতটা ধরতেই সে মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো।

কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে মায়ানের। চিন্তাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করলো,

‘হাতে কি হয়েছে?’

‘কিছু না। আপনি খান।’

মায়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘কেন আমি দেখলে সমস্যা?’

‘না না সমস্যা কেন হবে? আসলে রান্নার সময়,,,,,’

‘যা পারেন না তা করতে যান কেন? আগে দূর থেকে দেখতে হয়। তারপর সবকিছু।’

‘মেয়ে হয়েছি হয়তো বা মা পড়াশোনার জন্য রান্নাবান্না বা কাটাকুটি করতে দেয় না। তবে রান্না মেয়েদের জীবনের সাথে জড়িত। শিখছি, এটা ব্যপার না। আমি এখন মাছ রান্না করতে পারি। তবে মাংস রান্না করতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যায়।’

‘আমার বলা প্রথম দিনের কথাগুলো জন্য তাই না?’

প্রসঙ্গ বদলানোর পুষ্পিতা বলল,

‘বিরিয়ানি কেমন হয়েছে সেটা বললেন না তো?’

‘যে মানুষটা হাত পুড়িয়ে আমার জন্য রান্না করে এনেছে সেই রান্না নিশ্চয়ই খারাপ হবে না? তাতে আবার স্পেশাল মশলা হিসেবে ভালোবাসা আছে। এটার টেস্টই এখন অন্যরকম।’

______________________

হাতে কোণ আইসক্রিম নিয়ে তিড়িংবিড়িং করে হেঁটে যাচ্ছে তিতির। চোখেমুখে উপচে পড়া আনন্দ তার। সারা বাড়ি মাথায় তুলে তানজিফের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে।

তিতিরের পিছনে পিছনে আসছে তানজিফ। বোনের আনন্দ দেখে পলকহীন তাকিয়ে আছে সেদিকে। মানসিক যন্ত্রণা থেকে একটুখানি স্বস্তি পাওয়ার জন্য হয়তো পরিবারের মানুষগুলোই যথেষ্ট।

সহসা ঘাড় বাঁকিয়ে উদ্যানের কোণায় নজর পড়তেই চোখ স্থির হয়ে গেলে তানজিফের। একটা মেয়ে আরেকটা ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে। তিতিরে হাতটা ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলো। ছেলেটাকে চিনে সে। পাশের মেয়েটার দিকে তাকাল। আপাদমস্তক বোরকায় আবৃত। চোখগুলোর দিকে তাকাতেই বুকটা ধক করে উঠলো তার। শ্বাস আঁটকে এলো। বুকটা কাঁপছে না পাওয়ার যন্ত্রণায়।

#চলবে

#অতঃপর_সন্ধি (০৮)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

মেসে এসে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই চোখ চরাক গাছ মায়ানের। দৈবাৎ হাত বের করে দেখলো এক হাজার টাকার দুটো চকচকে নোট। অখুশি, বিরক্তি চোখে নোট দুইটার দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইল বের করে কল লিস্টে গিয়ে পুষ্পিতার নাম্বারে কল লাগালো। একবার, দুইবার, তিনবার রিং হলো কিন্তু রিসিভ হলো না। তিরিক্ষি মেজাজে মোবাইল বিছানার উপর ছুঁড়ে মা’রে। নিজেও ধপাস করে বসে পড়ে বিছানার উপর। নোট দুইটা আবারও চোখের সামনে মেলে ধরে। হতাশার শ্বাস ফেলে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে।

_________________

‘ফোন দিয়েছিলেন?’

‘এমনটা করার কারন কি, ফুলবানু?’ নির্লিপ্ত, উদাসীন গলায় ফিরতি প্রশ্ন করে মায়ান।

নিশ্চুপ, নিসাড়া রইলো পুষ্পিতা।

‘আমি একটা প্রশ্ন করেছি আপনাকে, ফুলবানু। চুপ না থেকে উত্তর দিন।’

ভয়ার্ত, সাহসশূন্য গলায় জবাব দিলো,

‘আসলে,,,,,,’

‘আসলে কি?’

‘আসলে বছরের শেষ তো। আপনার তো এখন কোনো টিউশন নেই। চলতে কষ্ট হবে তাই।’

‘তাই দয়া করেছেন আমার উপর?’

মায়ানের কথা শুনে মুখটা চুপসে গেলো পুষ্পিতার।

‘আপনি এভাবে কেন রিয়েক্ট করছেন?’

রাগান্বিত স্বরে মায়ানের কন্ঠনালী দিয়ে উচ্চারিত হলো,

‘আমি আপনাকে বলেছি কখনো আমার চলতে কষ্ট হচ্ছে? কাজটা করে আমাকে আমার কাছে ছোট করে ফেললেন ফুলবানু। প্রেমিকার কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলার মানসিকতা আমার না।’

‘আমি আপনাকে ছোট করার জন্য দেইনি। এই মাসটা যেন আপনার চাপে থাকতে না হয় সেজন্য দিয়েছি। হাই ইন্টারেস্টে ধার দিয়েছি আপনাকে। বিয়ের পর প্রতি মাসে সুদেআসলে উসুল করে নিবো।’

__________________

মায়ানের সাথে কথা শেষ করে ফেসবুক স্ক্রল করছে পুষ্পিতা। হঠাৎ করে চোখ আর হাত দু’টোই স্থির হয়ে গেলো তার। সপ্তাহ খানিক আগে প্রোফাইল পিকচার আপডেট করেছে তানজিফ। হাতে গিটার, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর সজারুর মতো চুল। চোখ আঁটকে যাওয়ার মতো লুক। তবে চোখ দু’টিতে আকুল আকাঙ্ক্ষা, ব্যগ্রতা, না পাওয়ার তৃষ্ণা। তানজিফের ছবিটার দিকে নিমেষহীন চোখে তাকিয়ে কিয়ৎক্ষণ কি ভেবে মেসেজ অপশনটায় ক্লিক করে আগের মেসেজ গুলো পড়তে লাগলো। কখনো তানজিফ তাকে রাগানোর জন্য মেসেজ করেছে কখনো বা করেছে পাগলামো। পুরোনো মেসেজ গুলো পড়ে ওষ্ঠাধর বিস্তীর্ণ হলো পুষ্পিতার। লাস্ট মেসেজ একবছর আগের দেখে মুহুর্তেই মুখটা মলিন,চুপসে গেলো তার। রিলেশনের ব্যপারটা জানার পরে তাকে আর কখনো মেসেজ বা কল দেয়নি তানজিফ। হুট করে অনুভব করল কিছু একটা তার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে নেই কিছু একটা নেই। আজ কেন জানি খুব চাইছে আইডির মালিক তাকে একটু জ্বালাতন করুক। একটু বিরক্ত করুক। এখন আর হুটহাট কেউ বউ ডেকে, মিসেস তানজিফ নওশাদ ডেকে ভড়কে দেয় না। অপ্রস্তুত করে না।

কি ভাবছে সে? ব্যপার বুঝতেই নিজেকে তড়িৎ গতিতে সামলে নিলো । তাড়াতাড়ি করে মেসেজ বক্স থেকে বের হয়ে মোবাইলই অফ করে দিলো। সে মায়ানের সাথে মিশে গিয়েছে খুব নিবিড়ভাবে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে ওই সাধারনের মাঝে অসাধারণ মানুষটার সাথে।

___________________

মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে তানজিফ। মনে হচ্ছে বুকের উপর বড়সড় পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে কেউ। চোখ বন্ধ করলেই সেই দৃশ্যটা চোখে ভাসছে। কতদিন হয়ে গেলো পুষ্পিতাকে জ্বালায় না বিরক্ত করে না। ঠিকঠাক কথাও বলে না। তাহলে মায়া কেন কমছে না? একান্ত, নিবিড়ভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কেন কমছে না? কেন তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে? ভালোবাসা কমছে না, মায়া কমছে না। তবে একটা জিনিস কেবল দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তা হলো হাহাকার আর শূন্যতা। আর আজ যেন সেই দৃশ্য ছিলো আগুনে ঘি ঢালার মতো। বুকের উপর হাত দুইটা রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো তানজিফ। নিজের মতো কল্পনা করতে ব্যস্ত সে।

পাশাপাশি বসে আছে সে আর পুষ্পিতা। পুষ্পিতা আঙুলের ফাঁকে হাত গলিয়ে দিয়ে কাঁধে মাথা রাখল। সে ও একহাতে জড়িয়ে ধরলো দৃঢ়রূপে, নিবিড়ভাবে।

‘এভাবে আমাকে সারাজীবন আগলে রাখবি তো তানজিফ?’

‘তুই চাইলেও ছাড়বো না।’

চোখে বুঁজে পরিতৃপ্ত হাসলো তানজিফ। মৃদুস্বরে ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে আওড়াল,

‘মানুষ তার স্বীয় কল্পনায় সবচেয়ে বেশি সুখী। না থাকে কারো হস্তক্ষেপ আর না দিতে পারে কেউ কোনো কাজে বাঁধা। যা হয় সম্পূর্ণ আমাদের ইচ্ছেমতো। যেমন আমরা চাই ঠিক তেমনটাই। বাস্তবে না হউক কল্পনায় তুই শুধু আমার।

___________________

কপালে সমানতালে হাত ঘষে চলেছে পুষ্পিতা আর তানজিফ। অতর্কিত ধাক্কায় দু’জনেই টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে।

‘চোখ কপালে নিয়ে চলিস? আর কি খাস,,,,,, ‘

মুখোমুখি তানজিফকে দেখে স্ফীত হয়ে গেলো পুষ্পিতা মুখমণ্ডল।

মাথা নুইয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে তানজিফ নীরস স্বরে বলল,

‘দৌড়ে আসছিলাম তো তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।’

আজ আর পূষ্পিতার চোখে চোখ রাখল না তানজিফ। দৃষ্টি নত ছিলো তার।

উঠে দাঁড়িয়ে তানজিফ চিৎকার করে বলল,

‘গায়েস, আমাদের ক্যান্সেল হওয়া ট্যুরটা আবার হবেএএএএএএএ।’

কান চেপে ধরে পুষ্পিতা। জারিনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাগত স্বরে বলল,

‘আমাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিছে। বুঝি না মনে করেছে।’

‘তা তোর হঠাৎ কেন মনে হলো এমন?’

‘মানুষের স্বভাব কখনো বদলায় না।’

ক্লাসের সবাই উল্লাসে নিমজ্জিত। আর তাদের মধ্যমনি তানজিফ। জারিন সেইদিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,

‘এক বছর আগের তানজিফ আর আজকের তানজিফের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। সেটা তুইও জানিস আমিও জানি।’

আকস্মিক তানজিফ এক মুঠ রং এনে জারিনের গালে লেপ্টে দিলো। পুষ্পিতার দিকে এগিয়ে যেতেই সে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।

মিনিট পাঁচেক পরে চোখ মেলে তাকায় সে। গাল ঝেড়ে বলল,

‘আমি বলেছিলাম না মানুষের স্বভাব কখনো বদলায় না। দেখলি তো? জানে এসব রং নিয়ে খেলা আমি মোটেও পছন্দ করি না। তারপরও লাগিয়ে দিলো।’

জারিন সূঁচালো দৃষ্টিতে পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পিতা জারিনের দিকে তাকাল।

‘এভাবে ঈগলের মতো তাকিয়ে আছিস কেন?’

জারিন রগড় গলায় বলল,

‘আবোলতাবোল পাগলের মতো বকলে তাকিয়ে থাকবো না?’

‘মানে?’

‘তানজিফ তো তোকে কোনো রংই দেয়নি। তাহলে গাল থেকে কি ঝেড়ে ফেললি?’

হাতের দিকে তাকালো সে।রঙের চিহ্ন মাত্র নেই।

‘রঙ দেয়নি দেখলি তো।’

পুষ্পিতার মুখটা কেমন চুপসে বিবর্ণ আকার ধারন করল। নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।

জারিন পুষ্পিতার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠে সে।

‘তানজিফ তোর আর তার মাঝে দূরত্ব অনেক আগেই তৈরি করে নিয়েছে। আমি এতোবছর ধরে যে তানজিফকে চিনতাম সেই তানজিফ আর এই তানজিফের মাঝে বিস্তর ফারাক। গত একটা বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে।’

‘কফি খাবি? মাথা ধরেছে ভীষণ।’

‘এড়িয়ে যাচ্ছিস?’

‘ওই ছেলেটাকে আমি প্রথম থেকেই এড়িয়ে চলছি। আজ আর নতুন করে কি এড়াবো।’

‘এড়াতে এড়াতেই তো নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছিস।সেটা বুঝতে পারছিস না তুই। বুকে হাত রেখে বলতে পারবি তানজিফের পাগলামি তুই মিস করিস না?’

‘ওই ছেলেকে নিয়ে ভাবার সময় আছে নাকি আমার?’

পুষ্পিতার কথায় হাসলো জারিন।

‘আমরা যেগুলোকে বিরক্ত মনে করি একটা সময় পর সেগুলো আমাদের অস্তিত্ব হয়ে দাঁড়ায়।’

________________________

রাতের রান্না করছেন আফসানা হক। ড্রয়িংরুমে টিভির রিমোট নিয়ে তুমুল লড়াই করছে পুষ্পিতা আর ফারদিন। পুষ্পিতা ফারদিনের কলার টেনে বলল,

‘রিমোট দে ফারদিন। টিভি কি তোর বাপের?’

‘টিভি তোর বাপেরও না।’

রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন আফসানা হক।

‘দুই মিনিটের মাঝে দুই ভাইবোনের চিৎকার বন্ধ হলে কিভাবে বন্ধ করতে হবে আমার জানা আছে।’

আফসানা হকের কথাকে তেমন একটা পাত্তা দিলো না দুই ভাইবোন।

‘টিভি কারোর বাপের না। কারন তোদের দুইজন কে আমি হাসপাতালের করিডোর থেকে এনেছি।’

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে