অতঃপর সন্ধি পর্ব-৫+৬

0
1854

#অতঃপর_সন্ধি (০৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

তানজিফ যেন স্তব্ধ, বিমূঢ়, স্তম্ভিত পুষ্পিতার কথা শুনে। জারিন আশেপাশে তাকাল। সবার দৃষ্টি তাদের দিকে।এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে যেন সার্কাস চলছে। জারিন পুষ্পিতার হাত চেপে ধরে অনুরোধের স্বরে বলল,

‘পুষ্পিতা অফ যা। সবাই দেখছে। মানসম্মানের ব্যপার।’

জারিনের দেখানো ভয়কে পরোয়া করলো না সে।

‘দেখুক, কেউ যেচে অপমানিত হতে আসলে এতে আমার কিছু করার নেই। আর তুই।’

আঙ্গুল তাক করলো তানজিফের দিকে,

‘আমাকে ফলো করিস তাই না? একবার বলেছি না তোকে আমার পছন্দ না। তারপরও বেহায়ার মতো পিছু পিছু ঘুরিস। লজ্জা করে না? তোর একটু সেল্ফ রেসপেক্ট নেই? ছেলে মানুষ বেহায়া না এদের থাকা লাগে তেজ।’

জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে পুষ্পিতা। মায়ানের সাথে মেয়েটাকে দেখে এমনি মন মেজাজ বিগড়ে আছে। তার ওপর তানজিফের এমন আদিখ্যেতা সব মিলিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি সে।

‘তুই দশ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি ক্যাশআউট করে আসছি।’

পুষ্পিতা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েছে দুই মিনিট। তানজিফ এখনো নিশ্চল, জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত তার জানা নেই। এতোদিনের এতো কথা হজম হলেও আজকের কথা গুলো হজম হচ্ছে না তার।

‘তানজিফ?’

জারিনের ডাকে নির্জীব চাহনি নিক্ষেপ করে সে।

‘ওর কথায়,,,,,

জারিনকে কথা শেষ করতে দিলো না। বিষন্ন, নিষ্প্রভ হাসলো সে।

‘কি মনে করবো বল? আমি তো এসব শুনতে শুনতে অভ্যস্ত। তবে কি এমন বললাম যে এভাবে রিয়েক্ট করলো?’

থামল তানজিফ।আশেপাশে আরেকবার নজর বুলালো। সবাই যে যার কাজে মনযোগ দিয়েছে। রেস্টুরেন্টে গুটিকয়েক মানুষ। তাদের সামনে আজ সে অপমানিত হয়েছে।

‘আসলেই আমি বেহায়া রে। না হলে এতো অপমান করার ওর পিছু পিছু ঘুরি বল? আমি ওরে বুঝাইতেই পারি না আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। ওর সঙ্গ আমার কতটা ভালো লাগে।’

মাথা নুইয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে গিয়েও হলো না সে। আবারও এসে জারিনের মুখোমুখি দাঁড়াল।

‘ওকে বলে দিস পুরুষ মানুষ সবাইকে তেজ দেখায় না। তেজ সবার সাথে যায় না। নির্দিষ্ট মানুষটার কাছে এলে সব পুরুষই বেহায়া হয়ে যায়।’

_________________

আজ আধঘন্টা লেট করে ফারদিন কে পড়াতে এসেছে মায়ান। ড্রয়িং রুমে চোখ বুলিয়ে পুষ্পিতা কে খুঁজলো সে। তবে তাকে দেখল না। ফারদিনকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে দরজার দিকেও খেয়াল রেখেছে। পুষ্পিতাকে একটু দেখার আশায়। সে গুড়ে বালি। আজ কোনো অজুহাতে পুষ্পিতা এইদিকে আসেনি। ফারদিনকে পুষ্পিতার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না মায়ান।

মায়ানের পড়ানো শেষ। ড্রয়িংরুমে পা দিতেই পুষ্পিতা মাত্র বাসায় আসলো। চোখমুখে রাগের আভা। নাকের ডগা কিঞ্চিৎ লাল। মায়ানের চোখে চোখ পড়তে মায়ান হাসলো।তবে মুখ ঘুরিয়ে নিলো পুষ্পিতা। মায়ানকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে সশব্দে দরজা বন্ধ দিলো।চমকে উঠলো মায়ান। কপালে ভাঁজ পড়ে চিন্তার।

রাস্তায় নেমে পুষ্পিতার নাম্বারে কল করলো। কল কেটে দিলো পুষ্পিতা। আবারও কল দিলো। এবারও কল কেটে দিলো পুষ্পিতা। মায়ান বুঝে নিলো যে পুষ্পিতা তার কল রিসিভ করবে না। উপায় না পেয়ে টেক্সট করলো,

‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’

উত্তরের আশায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো মায়ান।

দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে পুষ্পিতা। রাগ কোনোমতে কমছেই না। রাগটা কার উপর? মায়ান নাকি তানজিফের উপর বুঝে উঠতে পারছে না। দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকে দিতে ইচ্ছে করছে। পরপর দুইবার কলের মায়ানের মেসেজ দেখে মেজাজ যেন আরো খারাপ হয়ে গেলো। মোবাইল বিছানায় ছুঁড়ে মা’রে। গটগটিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। লম্বা শাওয়ার না নিলে মাথা ঠান্ডা হবে না।

মিনিট দশেক অতিক্রম হওয়ার পরও কোনো উত্তর পেলো না তখন ঘড়ির দিকে তাকাল। আরেকটা টিউশনির সময় হয়ে গিয়েছে। বিলম্ব না করে সেইদিকে হাঁটা শুরু করলো মায়ান।

___________________

অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটায় হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ কুঁচকে নিলো তানজিফ। চোখ দুইটা ভীষণ জ্বলছে। চোখ জোড়া পিটপিট করে তাকায় সে।

আলো জ্বালিয়ে তানজিফের শিউয়ের কাছে এসে বসলেন সুমনা এহমাদ। আহ্লাদী হয়ে তানজিফের কপালে হাত ঠেকিয়ে চমকে উঠেন তিনি। ত্রাসিত কন্ঠে বলল,

‘তোর তো জ্বর। আমাকে ডাকলি না কেন?’

মায়ের আতঙ্ক দেখে পীড়িত মুখে মলিন হাসলো সে।

‘তুমি মাথায় বুলিয়ে দাও দেখবে জ্বর সেরে গেছে। শারীরিক অসুস্থতায় মায়ের স্পর্শ এন্টিবায়োটিকের থেকেও দ্রুত কাজ করে।’ বলেই সুমনা এহমাদের কোলে মাথা রাখলো।

‘এসব মনগড়া কথা। আগে কয়েক লোকমা খেয়ে তারপর ঔষধ খাবি।’

কিয়ৎকাল চুপ থেকে তানজিফ নির্জীব স্বরে বলল,

‘যদি কেউ তোমার উপর বিরক্ত থাকে। তোমার উপস্থিতি যদি তার কাছে অসহ্যকর লাগে। নিশ্চয়ই তার থেকে দূরত্বে থাকা উচিত?’

‘যে মূল্য দিতে জানে না তার কাছে না যাওয়াই উত্তম।’

‘কিন্তু তোমার ছেলে যে মা চেয়েও পারছে না। দূরত্বের কথা মাথায় আসলে হৃদয়ে অদৃশ্য র’ক্ত’ক্ষরণ হয়।’

আলতো করে তানজিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন সুমনা এহমাদ।

‘তুই সব বললি আজও বললি না মেয়েটা কে। আমি ভেবেছিলাম আফসানার মেয়ের সাথে তোর বিয়ে পাকা করবো।’

‘অজানাই থাকুক। কিছু কিছু কথা অজানা থাকাই শ্রেয়। সম্পর্ক সুন্দর থাকে।’

চুপ করে মায়ের স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো। নিরবতা ভেঙে তানজিফ পুনশ্চ বলল,

‘মা? তোমার ছেলে কি দেখতে খুব বাজে?’

পরম মমতায় তানজিফের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালেন সুমনা এহমাদ।

‘কে বলেছে আমার ছেলে দেখতে খারাপ? আমার ছেলে তো লাখে একজন।’

‘তাহলে আমায় ভালো কেন বাসে না?’

‘কারন সেই মেয়ের চোখ খারাপ। আসল রত্ন চিনে না।’

‘মোটেও না। তার চোখ দু’টোর মায়ায় ডুবেছি আমি।’

সুমনা এহমাদ রঙ করে বললেন,

‘বাব্বাহ্! এখনই মায়ের বিরুদ্ধে যাচ্ছিস? বিয়ে করলে তো মনে হয় আমাকে,,,,, ‘

‘আরো বেশি ভালবাসবো মা।’ বলে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরলো।

_______________________

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে শুয়ে আছে পুষ্পিতা। অন্যদিন এইসময় মায়ানের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত থাকে সে। কয়েকবার মায়ান কল করেছে। পুষ্পিতা ফোন উঠায়নি। সে আর কোনোভাবে মায়ানের সাথে কথা বলতে আগ্রহী না। ভাবনার মাঝে আবারও মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইল উল্টিয়ে রাখলো সে। একের পর এক মোবাইল বেজেই চলেছে। বিরক্ত হয়ে ফোন উঠালো সে। কল রিসিভ করে চুপ রইলো। ওপাশেও নিরব। কয়েক সেকেন্ড নিরব থাকার ওপাশের মানুষটা নিরবতা ভাঙে।

‘আমার উপর রেগে আছেন?’

পুষ্পিতা কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই বলল,

‘আপনার যে গার্লফ্রেন্ড আছে বলেন নাই কেন?’

আহাম্মক হয়ে গেলো মায়ান।

‘কিসব ফালতু কথাবার্তা।’

‘লুকিয়ে লাভ নেই। আপনি ধরা পড়ে গেছেন। আজ শপিংমলে তো তার হাতেই খুব যত্ন সহকারে ঘড়ি পড়িয়ে দিচ্ছিলেন।’

‘তো এটা থেকে প্রমাণিত হয় সে আমার গার্লফ্রেন্ড?’

উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো পুষ্পিতা। আচমকা সে ফোঁপাতে শুরু করে।

‘আপনি কাদঁছেন?’

কাঁপা কাঁপা গলায় ভেঙে ভেঙে বলল,

‘আপনারা পুরুষ মানুষ সব বুঝেও না বুঝার ভান করেন। আপনি বুঝেন না আমি আপনাকে পছন্দ করি।আমার আপনাকে ভালো লাগে।’

ওপাশে থাকা মায়ান হাসলো।তবে হাসির নিনাদ পুষ্পিতার কান অব্দি এলো না।

‘তারপর?

‘কোনো মেয়ে কারন ছাড়া একটা ছেলের সাথে লং টাইম কথা বলে? আপনি সবকিছু বুঝেও কেন আমার আবেগ নিয়ে মজা করলেন? আপনার গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্বেও আমার সাথে কথা বলেছেন। আমার টেককেয়ার করেছেন এজ এ বয়ফ্রেন্ড।’

‘সময় এসেছে সব বলে দেওয়ার।’

পুষ্পিতা নাক টেনে বলল,

‘আর কিছু বলতে হবে না। যা দেখার আমি নিজের চোখে দেখে নিয়েছি।’

মায়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘কাল দেখা করতে পারবেন?’

‘কেন আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন?’

‘দিতেও পারি।’

‘আমার এতো বড় উপকার করার কোনো দরকার নাই।’

‘মাঝে মাঝে আমাদের চোখের দেখাও কিন্তু ভুল হতে পারে। যা আমরা ভাবি হয় তার উল্টো।

#চলবে

#অতঃপর_সন্ধি (০৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

সোনালী রোদে চিকচিক করছে বালি। জায়গাটা কয়দিন আগেই ভরাট করা হয়েছে। আগে এখানে এলে শীতলতায় মন ছেয়ে যেতো পানির ঠান্ডা হাওয়ায়। আর এখন ভ্যাপসা গরম। একটু ছায়া দেখে বসে আছে পুষ্পিতা। অপেক্ষা করছে মায়ানের জন্য। ক্লাস বাঙ্ক করেছে আর জারিনকেও বলেনি। চারপাশে মানুষের আনাগোনা খুব কম। এই সময় কেউ হাঁটতে বের হয় না।

কেউ পুষ্পিতার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল। সে ভয় পেয়ে এক লাফে দূরে সরে যায়।

‘আপনি এখানে? আর আমি পুরো জায়গাটা দুইবার রাউন্ড দিলাম।’

মায়ানকে দেখে বুকে থুথু দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো পুষ্পিতা।

‘ওহ্ আপনি?’

‘কেন আরো কেউ আসার কথা নাকি?’

‘আমি আপনার মতো নাকি যে গার্লফ্রেন্ড রেখে আরেক মেয়ের সাথে টাংকি মা’রবো।’

পুষ্পিতার ছেলেমানুষী কথায় সশব্দে হেসে উঠলো মায়ান। একটা বক্স পুষ্পিতার সামনে রাখল। বক্স দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল পুষ্পিতার। প্রশ্ন করে বসল,

‘এটা কি?’

‘বলছি, তবে আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।

জিজ্ঞাসাসূচক চাহনি নিক্ষেপ করে পুষ্পিতা। খানিক নিরব থেকে মায়ান বলা শুরু করলো,

‘মেয়েদের ইন্দ্রিয় খুব প্রখর হয়। কোনো ছেলে আড়চোখে তাকালেও এরা বুঝে যায়। ছেলেদের আবার উল্টো এদের বলে কয়ে বুঝানো লাগে। মাঝে মাঝে তো বলার পরও বুঝে না।’

কথাগুলো বলে হু হা হাসতে লাগে মায়ান। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা।

‘এগুলো আপনার কিছু কথা?’

হাসি মিলিয়ে গেলো মায়ানের।

‘না, আপনি আমাকে পছন্দ করেন। অবশ্য ভালোও বাসেন। আপনার চাহনি বা কথা বলার ধরন দেখে বুঝা যায়। বিশেষ করে গতকালকের জেলাসি।’

চিকচিক করতে থাকা বালুকণায় নিজের নাম লিখলো মায়ান। অতঃপর আবারও বলা শুরু করল,

‘আপনি উচ্চ মধ্যবিত্ত বাবার রাজকন্যা। জন্মের কখনো অভাব দেখেন নি। তবে আমি দেখেছি।স্কুলের ভর্তি হওয়ার পর খুব কমই আমি সকালের খাবার খেয়ে স্কুলে গিয়েছি। কারণ আমার বাবা নিম্নবিত্ত। নূন আনতে পান্তা ফুরায় আমাদের। আমার তিন বোন আর আমি। এক খন্ড জমি ছিলো বড় বোনের বিয়ের সময় সেটাও বিক্রি দিয়েছে বাবা। বাকি দুইবোন আমার ছোট। পড়াশোনায় একটু ভালো ছিলাম বলে এখনো চলছে। মানুষের দয়ায়।’

‘তো এসব আমাকে কেন বলছেন?’

‘কারন আমি আপনাকে ভালোবাসি।’ নির্লিপ্ত, উদাসীন স্বরে বলল মায়ান।

বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেলো। আশ্চর্যান্বিত, চমৎকৃত চোখে চেয়ে রইলো মায়ানের দিকে। অপ্রত্যাশিত কিছু শুনতে পেয়ে চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করলো পুষ্পিতার।

‘আর ঐ মেয়েটা?’

‘প্রেমিকা হওয়ার বাহিরে বন্ধুবান্ধব বলেও একটা শব্দ আছে।’

বক্সটা পুষ্পিতার হাতে দিয়ে পুনরায় বলল,

‘আপনার জন্য বার্থডে গিফট কিনতে আমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে শপিংমল গিয়েছিলাম।’

জানে পানি আসলো পুষ্পিতার। মায়ান আবারও বলতে লাগল,

‘আমি যাকে বিয়ে করবো তাকে গ্রামে থাকতে হবে। আমার বাবা মায়ের জন্য। তাকে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে। শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হবে। তাকে রাজরানী করে রাখার মতো ক্ষমতা আমার নাই। গ্রামের ঘরোয়া বউ হয়ে থাকতে হবে। আপনি হয়তো গ্রামের বউ হতে ইচ্ছুক নন? মাটির চুলোয় রান্নাও করতে পারবেন না। সেজন্য কিছু বলিনি আমি।’

‘ভালোবাসা এতো হিসাবনিকাশ করে হয়? প্রশ্ন করলো পুষ্পিতা।

‘এই চিন্তাটা বিয়ের আগ অবদি থাকে। বিয়ে হয়ে গেলে সবাই মানিয়ে নিতে পারে না। তখন হিসাবনিকাশের প্রয়োজন পড়ে। স্বামী স্ত্রীর দূরত্ব বাড়ে।’

‘ভালোবাসা’ এটা এমন একটা শব্দ এটার জন্য মানুষ সব করতে পারে সব। কিছুটা স্যাক্রিফাইস কিছুটা কম্প্রোমাইজ। মেনে নিতে হয় না হয় মানিয়ে নিতে হয়। কারণ লোভটা হচ্ছে ভালোবাসার মানুষের সাথে সারাজীবন কাটানোর। সুখে-দুঃখে তার পাশে থাকার।’

‘আবেগে অন্ধ হয়ে সব বলা যায়। কিন্তু প্রবলেম গুলো যখন ফেস করবেন তখন মনে হবে কতবড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনার আমাকে স্বার্থপর মনে হতে পারে। ডিরেক্ট বলে দিলাম বিয়ের পর গ্রামে থাকতে হবে। কারণ ওই মানুষ গুলো ছিলো বলে আজ আমি এখানে। তাদের মুখের হাসিটা আমার কাছে সবকিছু।’

‘কেন আপনি কি সারাজীবন স্টুডেন্ট থাকবেন? জীবনে কি কখনো প্রতিষ্ঠিত হবেন না? নাকি সারাজীবন অভাবের সাথে লড়াই করবেন?’ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো পুষ্পিতা।

‘আজকাল হাজার হাজার ছেলে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

মায়ানের কথাটা পাত্তা দিলো না পুষ্পিতা। বালিতে আঙুল দিয়ে লেখা মায়ানের নামের পাশে নিজের নাম লিখলো। মায়ানও সেইদিকে তাকিয়ে আছে। নাম লেখা শেষ করে পুষ্পিতা নিজের হাতটা মায়ানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

‘আপনার জীবনের সকল হীনতা, অভাব, ঘাটতি সারাজীবন আপনার পাশে থেকে পূরণ করে দিতে চাই। সন্ধি?’

হাতের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ান শান্ত স্বরে বলল,

‘ভেবে বলছেন তো? সারাজীবন কিন্তু স্যাক্রিফাইসই করতে হবে।’

‘ভালোবাসা ভেবেচিন্তে হয় না মিস্টার। জাস্ট হয়ে যায়। স্যাক্রিফাইস না হয় করলাম। আপনি না হয় পাশে থেকে একটু সাহস আর ভরসা দিয়েন।’

‘তবে হউক সন্ধি একসাথে থেকে সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার।’

_________________

পুষ্পিতার হাতের নতুন ঘড়িটা নেড়েচেড়ে দেখছে জারিন। মুখ কালো করে বলল,

‘ঘটনা ঘটার পর বলতে আসছিস কেন? একেবারে পুঁচকে টুচকে সাথে নিয়ে এসে বলতি?’

জারিনের গাল টানল পুষ্পিতা।

‘ওলে লে কিউটি রাগ করেছে?’

‘সিঙ্গেল থেকে ডাবল হয়ে সোজা গিফট সমেত এসে সব বলতেছে।’

‘আরে আমি তো ভেবেছিলাম অন্য কিছু। হয়ে গেল অন্যকিছু।’ বলতে বলতে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো পুষ্পিতা।

‘বান্ধবী আমার সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হয়ে গেলো আমিই,,,,,’

কথা শেষ করতে পারলো না এর আগেই একেবারে স্থির, নিশ্চুপ হয়ে হয়ে গেলো জারিন। মুখের হাসিটাও মিলিয়ে গেলো।

জড়বস্তুর মতো সামনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে পুষ্পিতাও জারিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল। বেঞ্চে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। পিছনে তানজিফ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গলা শুকিয়ে গেল তার। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে তানজিফ তাড়াতাড়ি করে আগলে নিলো। ব্যথা পাওয়ার ভয়ে পুষ্পিতাও তানজিফের শার্ট আঁকড়ে ধরে।

______________________

ঘাস বেষ্টিত ক্যাম্পাসের একপাশে বসে আছে তিনজন। সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তানজিফের মুখোমুখি মাথা নুইয়ে বসে আছে পুষ্পিতা।

‘সেই তো প্রেমে জড়ালি তবে আমার সাথে কেন নয়?’

নিরুত্তর রইলো পুষ্পিতা। এক পলক তানজিফের দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি নত করে ফেলে। তানজিফ পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,

‘আমার এতোদিনের পাগলামি, ভালোবাসা এসব কি সত্যি তোর চোখে পড়েনি? শত অপমান, অবহেলার পরও তো আমি তোর পিছনে পড়ে ছিলাম। আমার ঠিক কোন জায়গাটায় ঘাটতি আছে বলতে পারবি?’

‘তানজিফ দেখ,,,,,’

হাতের ইশারায় জারিনকে থামিয়ে দিলো তানজিফ।

‘উত্তরটা ওকেই দিতে দে।’

নিশ্চুপ পুষ্পিতা মাথা উঁচিয়ে তানজিফের চোখে চোখ রাখল। তানজিফ তখনো পুষ্পিতার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে ছিলো।

‘ভালোবাসা বস্তুটা আত্মিক, অনুভব করার। পিছনে পিছনে ঘুরলেই ভালোবাসা হয়ে যাবে এমন না। যাকে আমি মন থেকে অনুভব করতে পারি না তার সাথে সারাটা জীবন কিভাবে কাটাবো?’

‘হয়তো-বা আমার ভালোবাসাটা অনুভব করার বদলে বিরক্তিকর ছিলো। যাইহোক তোর রিলেশনশিপ এর জন্য শুভকামনা। দোয়া করি পূর্ণতা পাক। আমাদের ট্রিট দিতে ভুলিস না।’ বলেই উঠে দাঁড়াল তানজিফ। বিষন্ন, ভগ্নহৃদয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হতেই পুষ্পিতা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,

‘তুই প্লিজ আন্টি বা মাকে কিছু বলিস না।’

মলিন হাসলো তানজিফ।

‘অন্যের ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো এমন নিকৃষ্ট অন্তত আমি না।’

পুষ্পিতা মাথা নুইয়ে লজ্জিত স্বরে বলল,

‘সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি স্যরি। আসলে আমি একটু ডিস্টার্বড ছিলাম তাই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।’

‘কয়দিনের ব্যবহার জন্য স্যরি বলবি? সেই হিসাব করলে তো তোর বাকি জীবনটাই স্যরি বলতে বলতে পার হয়ে যাবে।’

অন্ধকার ঘনীভূত হলো পুষ্পিতার মুখ জুড়ে।

‘ডোন্ট বি আপসেট। আই’ম জাস্ট কিডিং। আমি কিছু মনে করিনি। আসলে ওমন ব্যবহার আমি সয়ে গিয়েছে তো তাই। আজকের পর আর কেউ তোকে বিরক্ত করবেও না। বিরক্তির কারণও হবে না।’

শেষের খুঁচা দেওয়া কথাটা ঠিকই বুঝতে পারলো পুষ্পিতা। তানজিফের চোখে চোখ রাখার মতো সাহস হলো না তার। আরো বি’স্ফো’রি’ত হলো তানজিফের শেষের কথাটা শুনে,

‘ তবে আমি তোর জন্য অপেক্ষা করবো। যতদিন পর্যন্ত তোকে পাওয়ার সুযোগ থাকবে আমি ততদিন অব্দি তোর অপেক্ষায় থাকবো।’

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে