অতঃপর সন্ধি পর্ব-৯+১০

0
1535

#অতঃপর_সন্ধি (০৯)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

আশহাব শেখের কথায় দুই ভাইবোন একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। পুষ্পিতা ফারদিনের কলার ছেড়ে সোফার একপাশে গিয়ে বসল। আর ফারদিন অন্যপাশে।

আশহাব শেখ দুই ছেলেমেয়েকে দুইপাশে বগলদাবা করে বসিয়ে খবরের চ্যানেল ছেড়ে দিলেন। উনার অগোচরে পুষ্পিতা একবার ফারদিনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আরেকবার ফারদিন পুষ্পিতার দিকে।

তন্মধ্যে বেজে উঠলো কলিংবেল।

‘পুষ্পি দেখ কে এলো।’ রান্নাঘর থেকে হাঁক ছাড়লেন আফসানা হক।

আশহাব শেখের পাশ থেকে উঠতে পেরে পুষ্পিতা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দরজা খুলতেই চমকে উঠে সে।

তানজিফ বড় এক ব্যাগ নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সূঁচালো করে পা থেকে মাথা অব্দি তানজিফকে দেখতে লাগে পুষ্পিতা।

‘আমি নিশ্চয়ই বাইরে থাকার জন্য এখানে আসিনি?’

তানজিফের খুঁচা দিয়ে বলায় কথায় সম্বিত ফিরল পুষ্পিতার। চোখ মুখ কালো করে এক পাশ হয়ে তানজিফ কে জায়গা দিলো ভেতরে আসার জন্য।

‘আরে তানজিফ যে, কেমন আছো বাবা?’

হাতের ব্যাগটা রাখে তানজিফ। বিস্তীর্ণ হেসে জবাব দিল,

‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমরাও আলহামদুলিল্লাহ। আরে দাঁড়িয়ে না থেকে বসো।’

‘আপনার কলেজের খবর কি আঙ্কেল?’

হতাশ গলায় আশহাব শেখ বললেন,

‘আর বলো না আজকালকার পোলাপান এত দুষ্টু। পড়াশোনা নিয়ে একটুও সিরিয়াস না। সারাদিন শুধু মোবাইল আর মোবাইল। পরশু টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট পাবলিশ করবো। একটু চাপে আছি সেগুলো নিয়ে।’

‘মায়ের কাছে মাসির গল্প করছে বাবা।’ এক ভ্রু উঁচিয়ে বিড়বিড় করে বলল পুষ্পিতা।

আশহাব শেখের মুখে তানজিফের নাম শুনে রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে ড্রয়িং রুমে পা রাখলেন আফসানা হক।

‘শাহজাদা কি মনে করে এই রাতে আমাদের বাসায় এলেন?’

‘কেন আন্টি রাতে কি তোমাদের বাসায় মেহমান এলাউ না? নাকি রাতে মেহমান এলে খেতে দাও না?’

‘বাপ যেমন একটাও কথা মাটিতে পড়তে দেয় না ছেলেও কম না। উত্তর রেডি থাকে। হঠাৎ রাতে কি মনে করে?’

পুষ্পিতা নাক উঁচু করে আবারও বিড়বিড় করলো,
‘উন্নত মানের গাধা।’

‘গাধা’ শব্দটা তানজিফের কানে গিয়ে ঠেকল। ভ্রু কুঞ্চিত করে একবার পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। আফসানা হকের প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

‘আম্মু গ্রামে গিয়েছিল। সেখান বিভিন্ন সবজি, নারকেল আরো কি কি যেন নিয়ে এসেছে। এই ডেলিভারি বয়কে দিয়ে সেগুলোই পাঠালো।’

‘দেখতে ডেলিভারি বয়ের মতোই লাগে।’

কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেল তানজিফ। শুনেও স্বাভাবিক রইলো। পুষ্পিতার দিকে তাকালো না অব্দি।

আধঘন্টা থাকার পর চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে তানজিফ।

‘তুই খেয়ে যাবি ভেবে আমি আরো গরুর মাংস ফ্রিজ থেকে নামালাম।’ মুখটা কালো করে বলল আফসানা হক।

‘অন্য এক দিন দাওয়াত দিও কবজি ডুবিয়ে খাবো। কিন্তু আজ না। আজ আমাদের বন্ধুরা মিলে পার্টি করবো।’

চলে যাচ্ছে তানজিফ। দরজা বন্ধ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পিতা। সামনের দিকে কদম বাড়ানোর পা দিতে পুষ্পিতা সহসা বলে উঠলো,

‘আমাদের ট্যুরের ডেট কবে?

কদম দিতে গিয়েও দিলো না তানজিফ। পিছিয়ে এলো। তবে পুষ্পিতার দিকে তাকাল না। সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দিল,

‘আগামীকাল জানিয়ে দেওয়া হবে।’ বলে তড়িৎ গতিতে প্রস্থান করে।

‘হাত ভাঁজ করে তানজিফের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা।

‘বাব্বাহ্! ছ্যাচড়া বলছিলাম বলে আমার সাথে এটিটিউডের গোডাউন খুলে বসছে। মনে করেছে এমন ভাব দেখালে আমি পটে যাবো।’

মুখ ভেংচি দিয়ে ঠাস করে দরজা আটকে দিলো পুষ্পিতা।

তানজিফ একটা একটা করে সিঁড়ি অতিক্রম করছে আর তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। থেমে গেলো সে। মাথা উঁচু করে উপরের দিকে তাকাল।

‘আমার নিদ্রা হরনকারীনি, আজ রাতে যে আর নিদ্রা চক্ষু জোড়ায় ধরা দিবে না।’

_______________

‘আজ সারাদিন এতো কল দিলাম, মেসেজ দিলাম কল ব্যাকও করলেন না আর মেসেজের রিপ্লাইও দিলেন না। আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’
ফোন রিসিভ হতেই মায়ানকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই প্রশ্ন করে বসল পুষ্পিতা।

‘আপনার নিশ্চয়ই গলা শুকিয়ে গিয়েছে? আগে এক গ্লাস পানি খান।’

‘মজা করবেন না আপনি। জানেন কত টেনশনে ছিলাম আমি।’

‘আপনি নাকি আমায় চশমিশ বলেছেন? আমি নাকি বেশি গ্যাপ দেই? আমাকে নাকি বাদ দিয়ে দিবেন? নতুন বছরে নাকি নতুন টিচার দেখবেন?’

মায়ানের একটার পর একটা পাল্টা প্রশ্নে লজ্জায় মিইয়ে গেলো পুষ্পিতা। নিশ্চুপ, নিরুত্তর রইলো।

‘আমি জেনেছি বলে ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?’

পুষ্পিতা মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,

‘ভয় পাবো কেন?’

এইবার যেন মায়ানের গলার স্বর বড্ড ভারী শুনালো।

‘আচ্ছা ঠিক আছে নতুন বছর থেকে আমি আর পড়াবো না। নতুন টিচারের সন্ধান শুরু করে দিন।’

পুষ্পিতার লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া ধৃষ্টে হঠাৎ করে আঁধার ঘনীভূত হলো। একেবারে চুপসে গেলো মুখশ্রী। নত স্বরে বলল,

‘আপনি রাগ করলেন? আমি জাস্ট মজা করে বলেছি।আর কখনো বলবো না।স্যরি।’

বলেই একেবারে নিশ্চুপ, শব্দহীন,নির্বাক হয়ে গেলো। চোখের কোণে পানি জমছে একটু একটু করে। ধীরে ধীরে বাড়ছে নিঃশ্বাসের গতি।

আচমকা মায়ান হু হা শব্দযোগে হাসতে লাগে। মায়ানের হাসির শব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো পুষ্পিতা।

‘আপনি না ভয় পান না। একটু সিরিয়াস হয়ে কথায় বলায় তো অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো।’

কথা বলছে না পুষ্পিতা। নিঃশ্বাসের নিনাদ শুধু মায়ানের কর্ণে এসে ধাক্কা দিচ্ছে।

‘ভবিষ্যতে তো দেখছি কিছু বলা যাবে না। তার আগেই আমার ফুলবানু কেঁদেকেটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলবে।’

পুষ্পিতা তবুও কিছু বললো না। মায়ানও বলা বন্ধ করে দিল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মায়ান পুনরায় বলে উঠলো,

‘এভাবে চুপ করে থাকলে কিন্তু কল কেটে দিবো। সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম বলে একটুও কথা হয়নি। আর এখন এমন বাচ্চামো করতেছেন।’

পুষ্পিতা নাক টেনে জবাব দিল,

‘শুরুটা কে করেছে? আমি?’

শব্দযোগে হাসতে লাগে মায়ান।

‘না, আমিই শুরু করেছি। একটু ভিডিও কল দিন তো। দেখি কান্না করলে আপনাকে কেমন লাগে। পেত্নী নাকি হুরপরী?’

______________________

শীতের সন্ধ্যা! মাঝে মাঝে বয়ে যাওয়া হিম শীতল বাতাস শরীর কাঁপিয়ে তুলছে। ক্যাম্পাসের ভিতরে বাস দাঁড়িয়ে আছে। একে একে সবাই এসে দাঁড়াচ্ছে বাসের পাশে। কেউ এখনো আসেনি। আশহাব শেখ মাত্রই পুষ্পিতা কে নিয়ে ভিতরে এলেন। তারপরই ভাইয়ের সাথে এলো জারিন। বাস ছাড়বে আটটা বাজে। সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে অনেক। বাসের উঠার পালা। আশহাব শেখ এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজে চলেছেন।

‘বাবা? তুমি কি কাউকে খুঁজছো?’

‘হুম’ বলেই উনি সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন তানজিফকে নিয়ে।

‘দুইটা বাচ্চা মেয়েকে তোমার ভরসায় ট্যুরে যাওয়ার জন্য পারমিশন দিয়েছি। তুমি যেখানে যাবে সাথে করে নিয়ে যাবে। যেতে না চাইলে কান ধরে নিয়ে যাবে।’

‘আঙ্কেল আমি যখন ওয়াশরুমে যাবো তখনও সাথে করে নিয়ে যাবো। আপনি চিন্তা করবেন না একদম।’

‘ইয়াক ছিহ্!’ পুষ্পিতা নাক সিটকে বলল।

‘জারিন ধমকে বলল,

‘এগুলো কি ধরনের কথাবার্তা তানজিফ?’

চেহেরায় অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তানজিফ বলে উঠলো,

‘আঙ্কেলই তো বলল তোদের সব জায়গায় নিয়ে যেতে। তাই এনসিউর হয়ে নিলাম ওয়াশরুমে নিয়ে যাবো কিনা।’

এবার একটু স্বাভাবিক হয়ে আশ্বস্ত করে আশহাব শেখ আর জারিনের ভাইকে বলল,

‘চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই একসাথে থাকবো।’

আশহাব শেখ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

____________________

বাস ছাড়ার সময় হয়েছে। তানজিফ নিজের সীট ছেড়ে পুষ্পিতা আর জারিনের সীটের পাশে এসে দাঁড়াল।

‘তোরা ঠিকমতো বসেছিস তো?’

‘জারিন দেখ দেখ আমি ঝুলে আছি। এই দেখ আমি বাদুড়ের মতো ঝুলছি।’

জারিন মিটিমিটি হাসছে। তানজিফ মুখে বিরক্তির রেখা ফুটিয়ে তুলে।

‘জানালা খুলবি না কেউ। রিস্ক হয়ে যাবে। বড় ধরনের এক্সিডেন্টও হতে পারে।’

‘আমি নিজেই বাচ্চা। এই বাচ্চার উপর দুইটা দামড়া, ধিঙি মেয়ের দায়িত্ব দিয়ে গেল।’

বিড়বিড় করতে করতে নিজের সীটে গিয়ে বসল তানজিফ।

‘দেখলি কেমন ভাব দেখিয়ে চলে গেলো? আজকাল বড্ড ভাব নিচ্ছে। আমাকে দেখলে এমন একটা ভাব করছে যেন চিনেই না।’ নাক মুখ কুঁচকে বলল পুষ্পিতা।

জারিন পুষ্পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে বিরক্তির রেখা। তা দেখে কিঞ্চিৎ হাসলো জারিন। রগড় গলায় বলল,

‘সুদর্শন ছেলে এটিটিউড দেখাতেই পারে।’

‘আগে যখন আমার পিছু পিছু ঘুরতো তখন কই ছিলো এই এটিটিউড?’ বলে একেবারে নীরব রইলো।

‘সত্য বেরিয়ে গেলো তো মুখ দিয়ে। আগের করা ঝগড়াগুলো তুই খুব মিস করিস তাই না?’

জবাব দিলো না পুষ্পিতা। মাথা ঠেকিয়ে রাখলো জানালার কাঁচে। আচমকা বাস থেমে গেল। বাইরের দিকে তাকিয়ে আরো আঁতকে ওঠে পুষ্পিতা।

#চলবে

#অতঃপর_সন্ধি (১০)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

আচমকা বাস থেমে যাওয়ায় বাসে হইহট্টগোল পড়ে গেল। কেউ কেউ সামনে গেলো কি হয়েছে দেখার জন্য। তবে পুষ্পিতার ধ্যানজ্ঞান বাসে না বাসের বাইরে। কেউ একজন রাস্তার পাশে হুডি পড়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্পিতা চিনে ঐ একজন কে। মলিন আর বিবর্ণ আনন জুড়ে একখন্ড খুশির ঝলক দেখা দিলো। জানালার কাঁচ খুলে দিতে ঠান্ডা হাওয়া শরীর স্পর্শ করল তা। ঠান্ডা হাওয়ায় স্নিগ্ধ স্পর্শে চোখ বুঁজে নিলো সে। আর সাথে এক অন্তরীক্ষ সমান ভালো লাগা মনের মধ্যে বিচরণ করছে তার।

‘জারিন আমাকে একটু আড়াল কর তো।’

জারিন কথার মানে বুঝল না। প্রশ্নসূচক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো।

‘আহা! আমাকে একটু আড়াল কর। তাহলে বুঝবি কেন বলেছি।’

জারিন মাথা নাড়িয়ে বাঁকা হয়ে বসল। পুষ্পিতা ব্যাগের উপরের চেইন খুলে মোবাইল বের করল। কোনো একটা নাম্বারে ডায়াল করে কানে ধরল মোবাইল। কয়েক সেকেন্ড বাদে ফিসফিসিয়ে বলল

‘আপনি এখানে?’

‘আপনাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছিল।’ মায়ানের গলা স্পষ্টই শুনতে পেল জারিন। বাইরের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল মায়ান পুষ্পিতার জানালা বরাবর দাঁড়িয়ে।

আতংকিত চোখে এদিক ওদিক তাকালো পুষ্পিতা। পুনরায় ফিসফিসিয়ে বলল,

‘কোনো কারসাজি করে কি আপনি বাস থামিয়েছেন?’

পুষ্পিতার ছেলেমানুষী প্রশ্নে শব্দহীন হাসলো মায়ান।

‘না, বললাম না তোমায় দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছিলো। আর মেইন রোডে উঠতে হলে বাস এই রাস্তা দিয়েই যাবে। সেজন্য এখানে আধঘন্টা আগে দাঁড়িয়ে আছি।’

লজ্জা মিশ্রিত কোমল স্বরে মুচকি হেসে পুষ্পিতা আবারও বলল,

‘আপনি পাগল? এই শীতে এমন করে কেউ?’

‘হয়তো করে না। আবার এর থেকেও বেশি করে। তবে এখানে বাস থামা পুরো আনএক্সপেক্টেড ছিলো। আমার দাঁড়িয়ে থাকা সার্থক। লাক সবসময় আমার ফেভারে থাকে।’

‘আপনাদের মাথা।’

‘কথা বলবেন না প্লিজ। আপনাকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নেই।’

কান থেকে মোবাইল নামিয়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো পুষ্পিতা। বাইরে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেলো মায়ানের। এবারে যেন আরো মিইয়ে গেলো।

এতক্ষণ মায়ানের বলা প্রতিটা কথাই শুনতে পেয়েছে পুষ্পিতা। পুষ্পিতার ত্রপায় মুড়ানো মুখের দিকে তাকিয়ে বাইরে এক পলক তাকাল। মায়ান এইদিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে সে। চোখ বন্ধ করে সীটে মাথা এলিয়ে দিতে তানজিফ কর্কশ, রূঢ় কন্ঠে বলল,

‘এই যে শিশুরা, আপনাদের পানির বোতল, কেক আর বিস্কুটের প্যাকেট। আর এগুলো কিনার জন্যই এখন বাস থামিয়েছে।’

তানজিফের ঠেঁটানো কথায় চমকে উঠে জারিন আর পুষ্পিতা। দু’জনে ভয়ে থুথু দেয় বুকে।

‘গাধা এভাবে কেউ কথা বলে? আর একটু হলে হার্ট অ্যাটাক করতাম।’

‘আমি কি করে জানবো আপনাদের মাছের কলিজা।’

বলেই চলে গেলো সে। তানজিফ চলে যেতেই মুখ ভেঙালো পুষ্পিতা।

বাস ছেড়েছে। পুষ্পিতা জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখল মায়ানও তার দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইল বেজে উঠলো তার। রিসিভ করতে মায়ান বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘জানালা মাথা বের করবেন না ফুলবানু। দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা থাকে। জানালা আটকে গায়ে ভালো করে চাদর জড়িয়ে নিন। শীতের রাতে বাসের বাতাসে ঠান্ডা লেগে যাবে।’

বিস্তীর্ণ হাসলো পুষ্পিতা।

‘যথাআজ্ঞা মহারাজ।’

‘রাখছি তবে। নিজের যত্ন নিবেন ফুলবানু। যেমন হাসিখুশি যাচ্ছেন এর থেকেও বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে ফিরবেন।’

মোবাইল রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো পুষ্পিতা।

‘উনার এই নিরব ভালোবাসা আর কেয়ার গুলো আরো বেশি মুগ্ধ করে। দেখলি কেমন হুট করে সারপ্রাইজ দিয়ে দিল। সত্যি বলতে আমারও না উনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল।’

পুষ্পিতার কথায় চোখ বন্ধ করে হাসলো জারিন। কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল,

‘উনার নিরব ভালোবাসা আর কেয়ার দেখতে পেলি তবে তানজিফের ভালোবাসাটা কেন দেখলি না?’

ধপ করে চোখের পাতা মেলে তাকায় পুষ্পিতা। স্তম্ভিত চোখে দৃষ্টিপাত করলো জারিনের দিকে ।

‘উনি ঠিকই বলেছেন। লাক সবসময় উনার ফেভারেই থাকে। না হলে দেখ, কেউ একজন তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তোর পিছু পিছু কত বছর ধরে ঘুরছে আর উনি সেটা এসেই পেয়ে গেলো।’

চেহেরা জুড়ে থাকা হাসির ঝলকটা একেবারে উধাও হয়ে গেলো পুষ্পিতার। বিবর্ণমুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন।

_______________________

যতক্ষণে পুষ্পিতাদের বাস কক্সবাজার এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে অন্ধকারে নিমজ্জিত ধরনী সূর্যের মিষ্টি রোদে ঝলমলে করছে। বাসের সবাই ক্লান্ত লম্বা এই জার্নি করে। রুম বুক করা হলো হোটেল সী পেলেসে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো একরুমে চারজন করে থাকবে।

সবাই ফ্রেশ হয়ে আধঘন্টার মতো রেস্ট নিয়ে বিচে এসেছে। যে যার মতো সময় কাটাচ্ছে। পুষ্পিতা সোনালি রোদে চিক চিক করতে থাকা বালুর উপর বসে আঁকিবুঁকি করতে লাগে। মাঝে মাঝে সৈকতের শান্ত ঢেউ তার পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। এবার ঢেউয়ের একটা ছোট্ট ঝিনুক তার পায়ের কাছে এসে ঠেকল।
সে হাতে নিলো সযত্নে। ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ।

পুষ্পিতার পাশে ধপ করে বসে পড়ল জারিন।

‘কিরে বসে আছিস যে? মুড অফ?’

পুষ্পিতা জারিনের কাঁধে মাথা রাখল আলতোভাবে।

‘তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?’

‘না।’ বিরস মুখে বলল পুষ্পিতা।

‘তাহলে?’

‘ঘুম পেয়েছে ভীষণ। একটু না ঘুমালে বিকেলে হিমছড়ি যেতে পারবো না।’

‘তাহলে রুমে চল।’

______________________

দিবালোকের তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। হিমছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার এটাই মুখ্য সময়। তিনটে জিপ ভাড়া করা হয়েছে। মোটামুটি তিনটে জিপই হয়ে যাবে। একে একে সবাই জিপে উঠে বসল।

মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে হিমছড়ির উদ্দেশ্যে জিপ চলছে ক্ষিপ্র গতিতে। প্রতিটি জিপের সবাই হই-হল্লোড় করছে। রাস্তার একপাশে সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা উঁচু নিচু পাহাড়। কখনো কখনো দেখা মিলছে পাহাড়ের মাঝে থাকা ঝর্ণার। অন্যপাশে সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই। নানা রকম পাখির কলতানে সবাই বিমুগ্ধ। জিপের গতির সাথে সাথে সবাই সুরের ঝংকার তুলল,

‘দূর দ্বীপবাসিনী,
দূর দ্বীপবাসিনী,
চিনি তোমারে চিনি
দারচিনিরও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো
সুমন্দ ভাষিনী,,,,,’

সবার সাথে ঠোঁট নাড়ছে পুষ্পিতাও। গানের কথার সাথে মুখাবয়ব পরিবর্তন হচ্ছে৷ কখনো ঠোঁট বিস্তীর্ণ করে মিষ্টি হাসছে কখনো বা ভ্রু উঁচিয়ে তাল মেলাচ্ছে।

পুষ্পিতার দিকে তীক্ষ্ণ, প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানজিফ। অপলক, অনিমেষ। অকস্মাৎ চোখে চোখ পড়ল পুষ্পিতার। হকচকিয়ে গেল তানজিফ। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। পুষ্পিতাও গানে মনযোগ দিলো। পরপর কয়েকবার পুষ্পিতা তানজিফের দিকে তাকিয়েছে। তবে তানজিফ তাকায়নি একবারও। সে মনকে বুঝালো হয়তো এমনিতেই চোখাচোখি হয়েছে।

রাস্তায় দুপাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছকে পিছনে ফেলে জিপ এসে থামল হিমছড়ি পর্যটনকেন্দ্রের সামনে। টিকিট কেটে সবাই ভেতরে ঢুকল। পর্যটনকেন্দ্রে আরো পর্যটকদের আনাগোনা। কপালে হাত রেখে উপরের দিকে তাকাল পুষ্পিতা। অসহায় চিত্তে বলল,

‘এতো সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠবো কেমনে রে জারিন? আমার তো এখনই পা ভেঙে আসছে।’

পুষ্পিতাকে টানতে টানতে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে গেলো জারিন। প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে উৎফুল্ল গলায় বলল,

‘যাত্রা শুরু করার আগে ভেঙে পড়লে চলবে? একটু কষ্ট না করলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করবি কেমনে?’

একটা একটা সিঁড়ি ভেঙে উঠছে সবাই। কেউ কেউ ছবি তুলছে। কেউ একটু জিরিয়ে আবারও উপরে উঠছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য আর কয়েকটা সিঁড়ি বাকি ধপ করে বসে পড়ল পুষ্পিতা। সমানে হাঁপিয়ে চলেছে।

‘আমি আর পারছি না ইয়ার।’

‘আমিও আর পারছি না।’ ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে জারিনের গলা। সেও সমানে হাঁপিয়ে চলেছে।

পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ। তার চেহেরায় ক্লান্তির লেশমাত্র নেই।

‘তোদের রেস্ট নেওয়া হলো? আমি আধঘন্টা আগে চূড়ায় পৌঁছে যেতাম।’

‘ভাই তুই এতোগুলা সিঁড়ি বেয়ে এখনো স্বাভাবিক আছিস কি করে?’

‘তোদের জন্য আমাকেও পাঁচ মিনিট পর পর জিরিয়ে নিতে হয়েছে।’

‘তাহলে এতো পকরপকর না করে আরো একটু জিরিয়ে নে।’

তানজিফের কথায় দপ করে মাথায় রাগ চেপে গেলো পুষ্পিতার।কর্কশ গলায় বলল,

‘আমরা বলেছি আমাদের পিছু পিছু আসার জন্য? নিজে নিজে এসেছে এখন খোঁটা দিচ্ছে।’

‘কারন আমি আঙ্কেলকে কথা দিয়েছি দাঁতওয়ালা বাবুদের আগলে নেওয়ার জন্য।’

পুষ্পিতা দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ স্বরে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই জারিন ধমকে উঠলো।

‘এই তোরা চুপ করবি?’

_________________________

তিনশত সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। চূড়ার উপর উঠে সাগর আর পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করে এতোক্ষণের এতো কষ্ট যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।

সাগরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দু-হাত মেলে দিলো পুষ্পিতা। পাহাড়ের এই নির্মল বায়ু লম্বা নিঃশ্বাসের ভেতরে টেনে নিলো। চোখ বন্ধ করে এই পাহাড়ি পরিবেশ আর পাখির কিচিরমিচির অনুভব করার চেষ্টা করল।

‘তিনশত সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার কষ্ট সার্থক।’

তানজিফ পুষ্পিতা অজান্তে ক্যামেরা তাক করে তার দিকে। তন্মধ্যে জারিন এসে সামনে দাঁড়ায়। ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রয় তানজিফের দিকে। নির্জীব হেসে ক্যামেরা নামিয়ে নিতেই জারিন হাত ধরে ফেলে। জারিন মুচকি হেসে চোখের ইশারা করে ছবি তোলার জন্য।

মুক্ত বাতাস অনুভব করার বিশেষ মুহূর্ত তানজিফ তার ক্যামেরাবন্দি করেছিল হয়তো তা কখনো জানতে পারবে না পুষ্পিতা।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে