অতঃপর দুজনে একা পর্ব-১২

0
1260

#অতঃপর দুজনে একা – [১২]
লাবিবা ওয়াহিদ

———————–
মাহবিনের বাবার নাম সৈয়দ আহমেদ৷ মাহবিনের মা সোনিয়া হক। মা এবং বাবাকে নিয়ে মাহবিন ছিলো সবচেয়ে সুখী মানুষ। মাহবিনের মা সোনিয়া হক আলাদা কোম্পানিতে চাকরি করতো, সৈয়দ তাকে চাকরি করার জন্যে স্বাধীনতা দিয়েছেন, নিজের ধন-দৌলত থাকা সত্ত্বেও। মাহবিন যখন খুব ছোট, তখন থেকেই সোনিয়া পরকিয়ায় লিপ্ত হয়। মাহবিন বড়ো হতে হতে সৈয়দ সাহেবকে ডিভোর্সও দিয়ে দেয় এবং বর্তমানের শাকিলকে বিয়ে করে। শাকিল ছিলো সোনিয়ার অফিসের বস। সোনিয়ার সংসার হয়, ছেলে-মেয়ে হয়। সে ভুলে যায় মাহবিন এবং সৈয়দকে। সৈয়দ খুব ভালোবাসতো সোনিয়াকে। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন তিনি। তাই তার বিরহ সহ্য করতে না পেরে শাকিলের পা ধরে সোনিয়াকে একপ্রকার ভিক্ষা পর্যন্ত চেয়েছিলো। কিন্তু সোনিয়া বা শাকিল, কারো-ই মন গলেনি। ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর সৈয়দ আহমেদ তার ভাঙ্গা মন নিয়ে-ই ছেলেকে মানুষ করেন, ছেলেকে একবারের জন্যেও মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। মাহবিন বুঝতো তার মা তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু সে তো আর জানতো না ভেতরের কাহিনী গুলো। এইচএসসির পরপরই সৈয়দ আহমেদ মাহবিনকে কানাডা পাঠিয়ে দেন, তার স্টাডি কমপ্লিট করার জন্যে। স্টাডি কমপ্লিট করে দেশে ফিরতেই মাহবিন দেখে তার মা সোনিয়া, শাকিল তাদের ছেলে-মেয়েকে তাদের বাড়িতে অবস্থান করছে। মাহবিনের বাবা তখন মৃত্যু শয্যায়। এরকম দৃশ্য দেখে মাহবিন ছিলো হতবাক, স্তব্ধ, বিমূঢ়। তাঁর অসুস্থতার খবর কেউ জানায়নি মাহবিনকে। তাইতো মাহবিনের হাসি হাসি মুখটাকে নিমিষেই আঁধার গ্রাস করলো। সেদিন রাতেই সৈয়দ আহমেদ মারা যায়। তার মুখে হাসি লেপ্টে ছিলো কারণ, বিদায়বেলায় প্রিয় একমাত্র ছেলেটার মুখ দেখতে পেরেছে। তৃপ্তি সহকারে৷ এর চেয়ে শান্তির মৃত্যু কী হতে পারে? সেদিন মাহবিন বাবাকে হারিয়ে জোরালো ভাবে উপলব্ধি করে তার মা থাকতেও সে এতিম। ভেঙ্গে পরে মাহবিন। এই ফাঁকে মাহবিনকে সৈয়দ আহমেদের বিশ্বস্ত ম্যানেজার এতদিনের ঘটা সব ঘটনা বলে দেয়। চিনিয়ে দেয় তার মায়ের আসল চেহারা। তার বাবা হার্ট এট্যাক করেছিলো। তাকে হসপিটাল নিয়ে যায়নি তার মা সোনিয়া। বারবার সম্পত্তির জন্যে তাকে হেয় করছিলো, কথা শোনাচ্ছিলো। সৈয়দ আহমেদকে এক গ্লাস পানি অবধি এগিয়ে দেননি তিনি। ঠিক এই কারণেই তাঁরা বাড়িতে অধিকারত্ব ফলিয়েছে। সব শুনে মাহবিন নির্বাক হয়ে বসে ছিলো। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিলো একরাশ বিষ্ময়। টাকা-পয়সা, সম্পত্তির জন্যে ভালোবাসা হেরে গেলো তার কাছে? এতটা নিচে নামতে পারলো সে? মাহবিনের বাবা মারা যাওয়ার পর সোনিয়া এবং তার পুরো পরিবার এই বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। মাহবিন বাঁধা দেয়নি। কেন দেয়নি, তা মাহবিনের জানা নেই? মাহবিন সেদিনের পর থেকে অনেক চুপ হয়ে গেছে। ভেবেছিলো হয়তো বাবার এই বাড়িতে তার দিন শেষ। কিন্তু না, তার বাবা সকল সম্পত্তি মাহবিনের নামে লিখে গেছেন। এরকম একটা খবর শুনে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া মাহবিন যেন আস্তে ধীরে জোড়া লাগতে শুরু করলো। কিন্তু ঘা এর দাগ তার কাটেনি আজও। সোনিয়া চেয়েও মাহবিনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারে না। যতবারই সম্পত্তির কথা বলতে গিয়েছে, মাহবিন তাকে খুব করে অপমান করতো। সেই অপমানে চেয়েও সোনিয়া কিছু বলতে পারতো না। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতো।
———
ভোরের আলো ফুটেছে ধরণীতে। আঁধারকে কাটিয়ে নতুন দিনের সূচনা ঘটলো। পাখিরা জেগে উঠেছে। শুরু করেছে তাদের নিজস্ব গান, নিজেদের অস্তিত্ব প্রচারের গান। ঘুমন্ত শহর ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছে। মাহবিন রক্তিম চোখে কাঁচ ভেদ করে নীলাভ আকাশের পানে তাকালো। তাকে বড্ড এলোমেলো লাগছে। চুল উষ্কখুষ্ক, কপালে লেপ্টে আছে। গায়ের শার্ট ঠিক নেই, ফোল্ড করা হাতা ঠিক নেই। চোখ-মুখও অসম্ভব লাল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারা রাত ঘুমোয়নি। সারারাত অতীতের স্মৃতিচারণ করে কাটিয়ে দিয়েছে। কাটিয়ে দিয়েছে নির্ঘুম রাত। এই রাতে একরাশ চাপা আর্তনাদ, যন্ত্রণা, বিষণ্ণতা তাকে সঙ্গী করে নিয়েছিলো। তাদের সঙ্গদোষে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। উঠে দাঁড়ায় মাহবিন। বিছানায় গিয়ে ধপ করে গা এলিয়ে দিলো। যন্ত্রণা’রা তাকে ছেড়েছে৷ এখন তাকে ঘুমোতে হবে। ক্লান্তি কাটানোর ঘুম।

বেলা বারোটা নাগাদ মাহবিনের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম ভাঙ্গার কারণ বিরক্তিকর শব্দে বেজে ওঠা ফোনের রিংটোন। ঘুমন্ত অবস্থাতেই মাহবিনের কপালে ছোট বড়ো কয়েকটি ভাঁজ পরলো। চোখ বন্ধ অবস্থায় বেড বক্সে হাতঁড়ে ফোন হাতে নিলো। এক চোখ পিটপিট করে খুলে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। অতঃপর রিসিভ করে কানে ফোন গুঁজে আবারও বালিশে মাথা এলিয়ে নিলো। চোখও বুজে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে আওড়ায়,
–“বলো, সুজন।”

সুজনের বলা কথায় মাহবিনের বদ্ধ চোখজোড়া মেলে গেলো। ভ্রু কুচকে সোজা তাকিয়ে শুনলো কিছুক্ষণ। আলসেমি ছাড়িয়ে উঠে বসে মাহবিন। সুজন তার বলা শেষ করলে মাহবিন থমথমে গলায় শুধালো,
–“আসছি আমি। তুমি আমায় আপডেট দিও।”

সুজনের বলার অপেক্ষায় রইলো না মাহবিন। কল খট করে কেটে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফর্মাল সুট পরে তৈরি হয়ে নিলো মাহবিন। অতঃপর চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে হাতে ফোনটা নিয়ে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে গেলো। বাড়ি এখন কোলাহলমুক্ত। সোনিয়াদের রুমের কাছাকাছি আসতেই দেখলো সাদা দেয়ালে রক্তের দাগ। নিশ্চয়ই সোনিয়ার গতকাল পা কেটে রক্ত বের হয়েছিলো। তোয়াক্কা করলো না মাহবিন। নিচে নামতেই এক মধ্যবয়সী সার্ভেন্ট ব্যস্ত ভঙ্গিতে শুধালো,
–“বাবা, ব্রেকফাস্ট রেডি করবো?”

মাহবিন সদর দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,
–“নো। বেরোচ্ছি আমি।”
মহিলাও মাহবিনের পিছে ছুটলো, কিন্তু মাহবিনের পায়ের গতির সাথে চলতে পারলো না। নিরুপায় মহিলা উচ্চস্বরে মাহবিনকে হাঁক ছেড়ে বললো,
–“রাতেও তো কিছু খাও নাই বাবা।”
আফসোস, মাহবিনের কান অবধি সেই বাক্য পৌঁছালো না।

———-
–“রিয়ন ভাই, এই ছানার সন্দেশটা কোন দোকানের বলো তো? এত টেস্টি। মুখে যেন স্বাদ লেগে আছে।”
রিয়ন ম্লান হেসে বলে,
–“তোর জন্যে বেস্টটাই সবসময় আনবো আমি।”
–“তা বেশ বলেছো। আচ্ছা, খালামনি কেমন আছে?”
–“ভালো। তোর কথা জিজ্ঞেস করে তো আমাকে?”
–“তাই? খালামনির নাম্বারটা নেই, দিও তো একসময়। কথা বলে নিবো।”
–“কথা বলার কী প্রয়োজন? আমার সাথে আসিস, নিয়ে যাবো আমার বাসায়।”
–“আচ্ছা।”
–“নীলা কোথায়?”

আয়ন্তি সন্দেশ খেতে খেতে বলে,
–“ক্লাস করছে। আমাদের ডিপার্টমেন্টে একজন স্যার আসেনি দেখে ক্লাসটা গ্যাপ গেলো।”
–“ওহ্। আয়ন্তি, তোর সাথে কিছু কথা বলার ছিলো!”

আয়ন্তি খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে-ই বললো,
–“হ্যাঁ, বলো।”
–“একচুয়ালি, মাহ…”

রিয়নের হঠাৎ কল এলো। রিয়ন হাতের মিষ্টির প্যাকেটটি আয়ন্তির হাতে ধরিয়ে দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। রিয়ন কল রিসিভ করতেই শোনা গেলো মাহবিনের কর্কশ কন্ঠস্বর।
–“আপনার তো আজ থেকে জয়েন হওয়ার কথা ছিলো। আপনি প্রথমদিনেই এবসেন্ট করলেন মিস্টার রিয়ন?”

রিয়ন থতমত খেয়ে গেলো। ম্যানেজার তো বললো আগামী পরশু অর্থাৎ আগামীকাল থেকে রিয়নের জয়েন। তাহলে মাহবিনের এরূপ কথাবার্তার মানে কী? রিয়ন নিজেকে যথাসম্ভব সংগত করে বললো,
–“ম্যানেজার স্যার তো আগামীকাল থেকে বললো জয়েন। আজ থেকে তো বলেনি।”
–“কিছু ফাইলস দিয়ে ডিসকাশন করার কথা ছিলো আজ। যদি অফিসের কাজ-ই না বুঝেন তাহলে জয়েন করে লাভ কী? ইমিডিয়েটলি অফিসে আসুন এবং ম্যানেজারের থেকে সমস্ত কাজ বুঝে নিন। আগামীকাল থেকে কোনো ভুল আমি মেনে নিবো না। হোক সেটা স্ব-জ্ঞানে বা অনিচ্ছাকৃত।”

রিয়নকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না মাহবিন। কল কেটে দিলো। রিয়ন এক দু’বার হ্যালো, হ্যালো করলো। যখন বুঝলো ওপাশ থেকে কল কেটে গিয়েছে তখন কান থেকে ফোন নামালো। আয়ন্তি ততক্ষণে সন্দেশ খাওয়া ছেড়ে রিয়নের পানে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো। রিয়ন ফোন পকেটে ঢুকাতেই আয়ন্তি রিয়নের পানে পিটপিট করে তাকিয়ে বললো,
–“কে ছিলো রিয়ন ভাই? তোমায় কেমন যেন দেখাচ্ছে?”
–“এতকিছু বলার সময় নেই। শুন, আমি আসছি। অফিসে ইমার্জেন্সি যেতে হবে। কথা হবে নিশ্চয়ই, বাই।”

রিয়ন ব্যস্ত পায়ে চলে গেলো। আর আয়ন্তি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুসময় অতিবাহিত হতেই আয়ন্তি নিজেকে সামলে পিছে ঘুরে হাঁটতে নিলে কারো সাথে ধাক্কা খেলো। ধাক্কাটা ছিলো কাঁধ ঘেঁষে। যার ফলে আয়ন্তির হাত আলগা হয়ে মিষ্টির প্যাকেটটি রাস্তায় পরে গেলো। মিষ্টির প্যাকেট থেকে সন্দেশগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে একদম নষ্ট হয়ে গেলো। আয়ন্তি রাগে-দুঃখে কান্না পেতে শুরু করলো। কী হলো ব্যাপারটা? এরকম হওয়া কী খুবই প্রয়োজন ছিলো? আয়ন্তি ক্রোধে ফেটে পরে পিছে ফিরে অজানাকে কড়া কিছু বলতে নিতেই থমকালো। একী! স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি? সত্যি মাহবিন তার সামনে দাঁড়িয়ে? মাহবিন দ্রুত পায়ে আয়ন্তির সামনে এসে নোংরা হয়ে যাওয়া মিষ্টিগুলোর দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বললো,
–“আ’ম এক্সট্রেমলি সরি। আমি সত্যি দেখতে পাইনি তোমায়। এই ঘটনার জন্যেও প্রস্তুত ছিলাম না। ওয়ান্স এগেইন সরি।”

আয়ন্তি মাহবিনের চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে নিরবে তাকিয়ে ভরাট কন্ঠে বললো,
–“ইট’স ওকে!”
–“ক্ষতিপূরণ দিলে হবে আয়ন্তি? আমি সত্যি-ই বুঝতে পারিনি আমায় দ্বারা এই মিস্টেকটি হবে।”
–“আরে না, না। তার প্রয়োজন না। আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমি ঠিকাছি।”
–“নাহ! আমার জন্যে তোমার খাবার নষ্ট হলো, আসো আমরা মিষ্টির দোকানে যাই। তোমার যা পছন্দ তুমি নিও, কাম আয়ন্তি।”

————————-
~চলবে, ইনশাল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে