#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দশম পর্ব
ফজরের নামাজের পর গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। ভোরের আলো পুরোপুরি ফুটেনি। গো°র°স্থান জুড়ে নিরবতা। এতো এতো মানুষ এখানে আছে অথচ ইমতিয়াজ ছাড়া আর কেউ নিশ্বাস নিচ্ছে না, কথা বলছে না।
তাহমিনার কবরের পাশে নিরবে বসে আছে সে। মনে তার একটাই কথা,
“আমাকে ক্ষমা করো মিনা, এ মনে তুমি ছাড়া আর কাউকে স্থান দেয়া ভুল। অপরাধ আমার। ক্ষমা করো তোমার সৌরভকে।”
কবরের মাটির উপর হাত বুলায়। চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে। ইমতিয়াজ চোখ মুছে না।
“কার কবর?”
নিরবতা ছি°ন্ন করে কারো কন্ঠ কানে আসলে ইমতিয়াজ চমকে উঠলো। চোখ মুছে নাক টেনে পাশে তাকিয়ে দেখে একজন মধ্যবয়স্ক নারী দাঁড়িয়ে আছে।
ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার স্ত্রীর।”
মহিলাটি একটু হাসলেন। কয়েকটা কবর পড়ে গিয়ে একটা কবরের পাশে গিয়ে বললেন,
“এটা আমার মেয়ের কবর। একদিন সকালে উঠে দেখি আমার মেয়ে নেই। রাতে ঘুমের মধ্যেই চিরকালের ঘুমে চলে গেছে সে।”
ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো মহিলাটির দিকে। একফোঁটা পানি নেই মহিলাটির চোখে, কেমন যেন শান্ত শীতল দৃষ্টি। মহিলাটি আবার বলল,
“পাশেরটা আমার ছেলে আর তার পাশেরটা আমার স্বামীর কবর। ওইযে বেলী গাছটা দেখছেন, আমি লাগিয়েছিলাম।”
মহিলাটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার সাহেব অসাধারণ মানুষ ছিলেন। খুব ভালোবাসতেন। জানো আমার ছেলে মেয়েরা বেঁচে থাকলে তোমার মতোই হতো।”
ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো অপলক। এ মহিলা জীবনে কত কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট জমে জমে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। এই শক্ত মানুষটাকে এখন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কোনো সৃষ্টির পক্ষে ভা°ঙা সম্ভব নয়।
______________________________________
সকাল সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। নাস্তা সেরে এসে দ্রুত তৈরি হচ্ছে আহনাফ। সারাহ্ রুমে আসলে আহনাফ বলল,
“কলেজে যাবে?”
সারাহ্ ওড়না আটকাতে আটকাতে বলল,
“জব ছেড়ে দিতে বলছেন?”
আহনাফ হাসলো।
“না, সেসব বলছি না। যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করছি।”
“হুম।”
আহনাফ আয়নার সামনে থেকে সরে ওকে জায়গা দিলো। সারাহ্ হিজাবটা বাঁধতে বাঁধতে আয়নায় আহনাফকে দেখছে।
কাল সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ করেই তার আচরণ বদলে গেল। প্রথমদিনের সেই রূ°ঢ় ভাষা আর অগোছালো আচরণটা নেই। যেন সে নিজের সৌন্দর্য বজায় রাখছে।
“একটা কথা বলি?”
সারাহ্-র কথায় আহনাফ ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলল,
“বলো।”
“সেদিন ওই ছাত্রীকে তো কিছু বললেন না, প্রেম প্রস্তাব দিলো কোনো প্র°তি°বাদ করলেন না। অথচ আমার সাথে..”
আহনাফ ওর দিকে এগিয়ে আসতেই থেমে গেল। আহনাফ বলল,
“হুম, তারপর?”
“ওই..”
সারাহ্ থেমে যায়। সারাহ্ নিজের গলায় হাত দিতেই আহনাফ হেসে ড্রেসিংটেবিল উপর থেকে ফোনটা নিয়ে সরে এসে বলল,
“মেয়েটা ছোট মানুষ, আবেগের বয়সে ঘুরছে, চোখে লাল চশমা। জীবন নিয়ে ধারণা হয়নি তাই বলিনি কিছু।”
ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“তুমি তো যথেষ্ট এ°ডা°ল্ট প্লাস ম্যাচিউর। (একটু থেমে) জলদি এসো।”
“হুম।”
বলে সারাহ্ মাথাটা আলতো নাড়ালো।
আহনাফ বেরিয়ে যাওয়ার সময় আফরোজা বলে উঠে,
“বিয়ের একদিন পেরোতে না পেরোতেই কলেজে যাচ্ছিস, মেয়েটাকে নিয়ে একটু ঘুরতে তো যেতে পারিস।”
জুহাইব ওকে সমর্থন করে বলল,
“ঠিক তো আহনাফ, এসব ঠিক নয়।”
সারাহ্ বেরিয়ে আসলো, জাবেরের গাল টে°নে আদর করছে সে। আহনাফ সারাহ্কে বলল,
“ঐশী, বউয়ের হ্যাঁ তে হ্যাঁ বললে বউ কি খুব খুশি হয়?”
সারাহ্ মুখ টি°পে হাসলো। আহনাফ আবারো বলে,
“তবে ঐশীর কথায়ই আমি কলেজে যাচ্ছি, বউ বলে কথা।”
সারাহ্-র হাত ধরে আহনাফ বেরিয়ে এলো। সারাহ্ চেয়ে আছে ওর দিকে। অবলীলায় বউ বলে চলে আসলো। বাসার বাইরে এসে হাত ছেড়ে দিলো আহনাফ।
একটা অটোতে উঠলো ওরা। সারাহ্ আহনাফের ব্যাগটার দিকে ইশারা করে বলল,
“এটাতে কি আছে?”
“ল্যাপটপ আর প্রশ্ন। আজকে পরীক্ষার প্রশ্ন জমা দিতে হবে।”
“ওহ, সিনিয়র টিচারদের কত কি দিতে হয়?”
আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে হাসলো। সিটে হেলান দিয়ে বলল,
“ভাবছি একটা গাড়ি কিনবো, শেয়ার নিবে?”
“মানে?”
আহনাফ বুঝিয়ে বলল
“দেখো ফিফটি ফিফটি ভাগ। আমি হাফ টাকা দিবো আর তুমি হাফ। ব্যস, দুজনেই চড়তে পারবো৷”
সারাহ্ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আইডিয়া ভালো, বাট এতো টাকা তো আমার এখন নেই।”
“ধীরে ধীরে দিও।”
“ওকে।”
দুজনে আর কোনো কথা বলল না। কলেজে পৌঁছে দুজনে দুই রাস্তায় চলে গেল। আহনাফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে একবার তাকালো সারাহ্-র দিকে। সারাহ্ ততক্ষণে টিচার্স রুমে চলে গেছে।
______________________________________
“ভালোবাসবো তোকে।”
এমন একটা চিরকুট পেয়ে বি°র°ক্ত হয়ে আছে সামিহা। একটা দুইটা না পর পর চারটা। ওকে নিশানা করে কেউ ছুঁ°ড়ে মে°রে°ছে।
তানজিম এসে বসতেই তানজিমকে কাগজগুলো দেখালো সামিহা। তানজিম দেখে বলল,
“ছি, ছি, সামি। তোকে আমি ভালো ফ্রেন্ড ছাড়া আর কিছু ভাবি না।”
সামিহা এমনিতেই রেগে ছিল তানজিমের কথায় আরো রেগে বলে,
“থা°প°ড়াবো তোকে। এগুলো আমাকে কে যেন দিয়েছে।”
তানজিম হো হো করে হেসে উঠে। উঠে দাঁড়িয়ে চেঁ°চিয়ে চেঁ°চিয়ে বলে,
“আমাদের মিস সামিহাকে কেউ প্রেমপত্র দিয়েছে। তোরা কে দেখবি রে, দেখতে আয়।”
চার-পাঁচ জন ছেলে-মেয়ে ঠিকই আসলো। সামিহা মুখের উপর হাত দিয়ে তানজিমকে বলল,
“থাম তুই, তানজিম।”
সবাই একে একে এসে বেশ জোরে জোরে চিঠিগুলো পড়তে থাকে। সামিহা রেগে উঠে বেরিয়ে যায়। তানজিম ওকে ডেকে বলে,
“সামি, দাঁড়া।”
সামিহার পেছন পেছন তানজিমও বেরিয়ে এলো। সামিহা দৌড়ে চলে যেতে নিলে তানজিম ওর হাত টে°নে বলল,
“থাম না, হইছে অনেক। যে দিছে, দিছে। সামনে এসে বলার সাহস নেই তো এমনই করবে। ক্লাসে আয়।”
সামিহা আঙুল তুলে বলল,
“হাসবি আর আমাকে নিয়ে?”
“হাসবো না, সত্যি।”
সামিহা একটু সরে এসে বলে,
“কান ধরে তিন সত্যি বল।”
তানজিম ওর কথা মতো কান ধরে তিন সত্যি বলল। পাশ থেকে যাওয়া দুইজন জুনিয়র মেয়ে ওকে দেখে হেসে দিলো।
সামিহা ওদেরকে ধ°ম°কে বলল,
“ওই ফার্স্টিয়ার, মা°ই°র খাবি।”
মেয়েগুলো চলে যেতেই তানজিমের একহাত জড়িয়ে ধরে ক্লাসে গেল সামিহা। ভালোবাসি যে যতই বলুক, সামিহার ভরসার জায়গা তো এই একটাই।
______________________________________
এক সপ্তাহ পর,
গতকালই আফরোজা, জুহাইবের সাথে আব্বাস সাহেব বাংলাদেশে ছেড়েছেন। আজকে পুরো বাসা ফাঁকা লাগছে সারাহ্-র কাছে। কেমন যেন নি°স্ত°ব্ধ।
মাত্রই কলেজ থেকে বাসায় ফিরেছে, এসেই রান্নাঘরে গেল সারাহ্। খাবার গরম করতে দিয়ে ফ্রেশ হতে গেল। ফিরে এসেই অবাক, আহনাফ ইতোমধ্যে খাবারের টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে।
সারাহ্-কে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“খেতে বসো।”
সারাহ্ মাথা নেড়ে টেবিলে বসতে বসতে বলল,
“ম্যাডামরা সবাই বিয়ের ব্যাপারে জেনে গেছে।”
আহনাফের তেমন একটা হেলদুল হলো না। সে নিজের মতো খাবার নিতে নিতে বলল,
“না জানার কথা?”
“সেটা বলছি না, উনারা ভাবছেন (একটু থেমে) লাভ ম্যারেজ।”
আহনাফ মুখের খাবারটুকু গিলে বলল,
“ঐশী, জানো তো এখন ভাইবোন রাস্তায় হাতধরে হাঁটলেও মানুষ ভাবে ওরা প্রেম করছে। মামা অথবা চাচা, আই মিন কোনো মাহরামকে নিয়ে হাঁটলেও, যদি উনার বয়স একটু কম হয় তখনও ভাবে প্রেমিক যুগল। (একটু থেমে) সেখানে আমাদের নিয়ে এসব ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়।”
সারাহ্ চুপ করে খেতে লাগলো। আহনাফের কথা যুক্তিযুক্ত। দেশের পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় চলে এসেছে যে এসব ভাবনা সহজেই মানুষের মনে বাসা বাঁধে।
খাওয়া শেষে দুজনে মিলে টেবিল গুছিয়ে ফেলে। তারপর আহনাফ চলে গেল পড়ার টেবিলে। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার খাতা চেক করছে। সারাহ্ এখন একা একা অনুভব করছে।
কি করবে ভেবে না পেয়ে ড্রইংরুমে বসে ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করতে থাকে। আহনাফ এসে কয়েকটা খাতা ওর সামনে দিয়ে বলে,
“নাম্বার গুণে আমাকে একটু হেল্প করো।”
সারাহ্ সোফায় আরাম করে বসে বলে,
“আমি কেন? আপনার খাতা, আপনি দেখেন। দায়িত্বটা আপনার। এতো কেয়ারলেস কেন?”
আহনাফ ওর দিয়ে ঝুঁ°কে সোফায় হাত দিয়ে বলল,
“যা বলেছি তাই করো। শুধু শুধু রাগাবে না আমাকে। আমার রাগ যে ভালো না তা তুমি জানো।”
সারাহ্ চোখ বড় বড় করে বলে,
“করবো না একবারও বলেছি নাকি? সরুন, গুণে দিচ্ছি।”
আহনাফ রুমে চলে আসলো। খাতা দেখতে বসে সারাহ্-র চেহারাটা মনে করে হাসতে থাকলো। মেয়েটা যে ওকে প্রচন্ড ভয় পায়।
হঠাৎ ওর মুখের হাসিটা উবে গেল। ওর রাগে তাহসিনা কি করতো। তাহসিনার হাসিতেই যে ওর রাগটা শেষ হয়ে যেত। তাহসিনা ওর গাল টেনে দিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে দিতো। ওর যে অনুভূতি কেউ বুঝে না সেটা তাহসিনা বুঝতো।
আহনাফ কলম ছুঁ°ড়ে ফেলে চেঁ°চিয়ে উঠে,
“তাহসিনা।”
সারাহ্ চমকে উঠে। মাত্রই সে একটা অচেনা নাম শুনেছি। তড়িঘড়ি করে উঠে রুমে গেল।
আহনাফ সারাহ্-র দিকে একটু তাকিয়ে টেবিলে মাথানিচু করে বসে পড়ে। সারাহ্ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
আহনাফ জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। বেশ কিছু সময় পর সারাহ্ এগিয়ে যায়। কলমগুলো তুলে টেবিলে রাখে। আহনাফ মাথা তুলে ওর দিকে তাকায়।
সারাহ্ খাতাগুলো গুছিয়ে রেখে বলে,
“এসব পরে দেখবেন, এখন একটু বিশ্রাম নিন।”
আহনাফের হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“শুয়ে পড়ুন।”
সারাহ্ চলে আসতে নিলে আহনাফ ডাকলো,
“ঐশী।”
“জি।”
সারাহ্ ফিরে তাকায়।
আহনাফ আর কিছু না বলে শুয়ে পড়লো৷ সারাহ্ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুমের বাইরে চলে আসে। ওর জানা হলো না তাহসিনাকে নিয়ে, তবে নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের নাম শোনাটা সত্যিই কষ্টের। ড্রইংরুমে গিয়ে আবারো আগের জায়গায় বসে পড়লো সে।
______________________________________
টিকেট কিনে বাসায় এসেছে মৃত্তিকা। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, বাসাটাও ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু দেশে ফেরার পালা। মামের স্মৃতি নিয়ে দেশে যাবে। এমনভাবে যেতে হবে যেন তার বাবা টের না পায়। এই লোকের হাত থেকে নি°স্তা°র চায় সে।
ডি°ভো°র্সের সময় সবচেয়ে বেশি ঝা°মেলা হয়েছিল ওকে নিয়েই। ওর বাবা চেয়েছিল ওকে নিজের কাছে রাখতে, রিপা বেগম চাননি। জোর করে নিয়ে এসেছিলেন মেয়েকে। পরে আদালতও একই আদেশ দিলে রাগে রিপা বেগমকে চ°ড় দিয়েছিল এই লোকটা।
ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মৃত্তিকা তানজিমকে কল করে। কয়েকবার কল বাজলেও রিসিভ হয় না। তারপর সে কল দেয় লুৎফর রহমানকে।
রিসিভ হলো,
“আসসালামু আলাইকুম, আংকেল।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো মা?”
“ভালো আছি, আংকেল। আসলে আংকেল (একটু থেমে) আমি দেশে আসবো। এই দুইদিন পরেই মানে মঙ্গলবার ফ্লাইট।”
লুৎফর সাহেব খুশি হলেন। বললেন,
“খুব ভালো তো। ইমতিয়াজকে বলে দিবো ও তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসবে।”
মৃত্তিকার হাসিমুখটা চুপসে যায়। একটা ঢোক গিলে বলল,
“আংকেল, উনাকে শুধু শুধু ব্যস্ত করবেন কেন? আপনি যদি আসতেন?”
মৃত্তিকা একটু ইতস্তত বোধ করছে। লুৎফর সাহেব বললেন,
“তোমার বড়মণির সেশন আছে ওই, তাই আমি তো হাসপাতালে থাকবো মা। ইমতিয়াজ যাবে কিনা আমি জিজ্ঞাসা করে জানাচ্ছি তোমাকে।”
মৃত্তিকা আর অমত করলো না। বড়দের মুখে মুখে এতো তর্ক সে করতে পারে না। উনারা ইমতিয়াজকে ভরসা করেন, করাটা স্বাভাবিক। সে ভরসার যোগ্য, কিন্তু মৃত্তিকা যে অন্য কোথাও আটকে যাচ্ছে বারবার।
মৃত্তিকা একটা ঢোক গিলে বলল,
“আংকেল আপনার কি কিছু সময় হবে? (একটু থেমে) কিছু কথা বলতাম।”
“বলো, মা।”
মৃত্তিকা একটু একটু করে ওর বাবার আচরণের পুরোটার জানালো লুৎফর রহমানকে। ওর বাবা ইতালি এসেছে, ওকে কি কি বলেছে এবং কিভাবে বি°র°ক্ত করেছে সব জানায় ও। কথা বলতে বলতে কান্না করে দেয়।
______________________________________
ইমতিয়াজ নতুন বাসায় চলে এসেছে পরশু। এবারে দুই আর ডাইনিং এর বাসা নিয়েছে। একটা রুম সাবলেট দেয়ার চিন্তাভাবনা আছে।
ঘড়িতে সন্ধ্যা ৭ টা, অফিস থেকে ফিরেই বাসা পরিষ্কার করছে সে। এমনসময় মিউ মিউ শব্দ শুনে তা অনুসরণ করে খাটের নিচে এক বিড়াল খুঁজে পায়। বিড়ালটাকে বের করে এনে দেখে পায়ে ক্ষ°ত।
“দেখে তো হাঁটবি নাকি?”
মায়া হলো তার, বিড়ালটাকে নিয়ে ছুটলো ভে°টের কাছে। পায়ে পরীক্ষা করে ওষুধ নিয়ে আসলো।
বাসায় এসে একটা ঝুড়িতে বিড়ালটার থাকার ব্যবস্থা করলো। ফ্রিজ থেকে মাছ নামিয়ে নিয়ে সিদ্ধ দিয়ে আসলো। বিড়ালটা এখনো ওকে একটু ভ°য় করছে বোধহয়।
ইমতিয়াজ পুরোনো কাঁথা দিয়ে গরম জায়গা বানাচ্ছে। এমনসময় ফোন বেজে উঠলো। তানজিমের নাম্বার দেখে রিসিভ করলো।
“হ্যাঁ, তানজিম।”
“ভাইয়া, একটা সমস্যা হয়েছে।”
সমস্যার কথায় ইমতিয়াজ ভয় পেল। বলল,
“কি সমস্যা? মা ঠিক আছে?”
ইমতিয়াজের উ°ত্তে°জনায় তানজিম শান্তভাবে বলল,
“আম্মু, ঠিক আছে। সমস্যাটা মিউকো আপুর।”
ইমতিয়াজের কপাল কুঁচকে গেল। মিউকো মানে মৃত্তিকার সমস্যার সমাধান ওর কাছে কিভাবে থাকবে?
তবুও বলল,
“কি হয়েছে?”
“আপু কল দিয়েছিল, উনার বাবা ইতালিতে গেছে। সেটা নিয়েই বাবার সাথে কান্নাকাটি করলো।”
“এখন আমি কি করতে পারি?”
“আপু মঙ্গলবার দেশে আসবে, তোমাকে শুধু এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসতে হবে।”
তানজিমের কাছ থেকে ফোনটা নিলো লুৎফর সাহেব। বলল,
“ইমতিয়াজ বাবা, মেয়েটা তো অনেকদিন হলো দেশে আসে না। তাই চিনে না রাস্তাঘাট। আমিও তো সেদিন তোমার মাকে…”
উনার কথার মাঝেই ইমতিয়াজ জবাব দিলো,
“ঠিক আছে। কয়টায় আসবে জানালেই হবে।”
ইমতিয়াজ ফোন রাখলো। তানজিমের নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজে খুলে দেখলো মৃত্তিকার নাম্বার পাঠিয়েছে। সাথে লেখা,
“ভাইয়া এটা আপুর নাম্বার, আপনি নক দিলেই টাইম জানিয়ে দিবে।”
রিপ্লাই না দিয়ে ফোন রেখে ইমতিয়াজ নিজের কাজে মন দিলো।
চলবে……
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
একাদশ পর্ব
“বকুলের মালা শুকাবে
রেখে দেবো তার সুরভি,
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে
মুছো না গো আমারই ছবি,
তুমি ভুলো না আমারই
না….ম।
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম।
এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম।”
রান্নাঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মিষ্টি কন্ঠে একটা গান শুনলো সামিহা। দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিলো, মার কন্ঠ। সামিহা মুচকি হাসলো। রাতে খাবার রান্না করছে আর সাথে গান গাইছেন।
কিছুক্ষণ পর জাহাঙ্গীর সাহেবের কন্ঠও শুনলো।
“আরে, এটা কোনো গান না। আমি একটা গান গাই।”
সামিহা দেয়াল ঘেষে দাঁড়ায়। বাবার গান না শুনে যাওয়া যায় নাকি। মায়ের গান কতই শুনেছে, বাবা কি আর সহজে গানে টান দেয়।
জাহাঙ্গীর সাহেব একটা কা°শি দিয়ে গান শুরু করলেন,
“লাল ফিতে, সাদা মোজা, স্কু-স্কুলের এর ইউনিফর্ম
ন’টার সাইরেন সংকেত, সিলেবাসে মনোযোগ কম।
পড়া ফেলে এক ছুট-ছুটে রাস্তার মোড়ে
দেখে সাইরেন মিস করা দোকানিরা দেয় ঘড়িতে দম।
এরপর একরা°শ কালো কালো ধোঁয়া
স্কুল বাসে করে তার দ্রুত চলে যাওয়া
এরপর বি°ষ°ণ্ন দিন, বাজে না মনবীণ
অবসাদে ঘিরে থাকা সে দীর্ঘ দিন, ওহ
হাজার কবিতা, বেকার সবই তা
হাজার কবিতা, বেকার সবই তা
তার কথা কেউ বলে না
সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা
সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা।”
“দ্যা°ত, কিসব গান গাও তুমি। মেয়ে শুনলে।”
নার্গিস পারভিনের কথায় সামিহা হেসে রুমে চলে গেল। এই মিষ্টি সম্পর্ক একসাথে ৩০ বছর পেরিয়ে এসেছে। উথালপাতাল ঢেউ আসলেও হাত যে একটিবারের জন্যও ছাড়েনি।
বিছানায় শুয়ে সামিহা সারাহ্-র নাম্বারে ভিডিও কল দেয়। সারাহ্ কল কেটে অডিও কল করে।
“আপু, তোমাকে দেখবো।”
সারাহ্ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“পরে দেখিস। (একটু থেমে) কি করিস এখন?”
“কিছু না।”
“পড়াশুনা নেই?”
“আছে তো। মাত্রই তো টিউশন থেকে ফিরলাম, এখনো খাইনি রাতের খাবার।”
“ঐশী।”
আহনাফের ডাক শুনে সারাহ্ বলে,
“এখন রাখছি, বাই।”
“সে তো রাখবাই, সোয়ামী ডাকতেছে।”
“চুপ।”
“রাখো।”
গাল ফুলিয়ে কথাটা বলল সামিহা। বাবার গানের কথা সারাহ্-কে বলা হলো না।
সারাহ্ ফোন রেখে রুমে গেল। আহনাফ টেবিলে বসে আছে এখনো। সেই খাতা দেখায় ব্যস্ত সে। ওকে দেখে বলল,
“এখানে এসো।”
সারাহ্ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আহনাফ সারাহ্-র হাতটা নিজের কপালে রেখে বলে,
“চুলগুলো টে°নে দাও, ঘুমাবো।”
সারাহ্ আস্তেধীরে মাথায় হাত বুলায়। আহনাফ বিরক্তি নিয়ে বলে,
“ভালো করে টা°নো একটু।”
জোরে চুল টে°নে দিতেই “এই আস্তে” বলে আহনাফ রেগে সোজা হয়। চোখ পা°কিয়ে তাকাতেই সারাহ্ হো হো করে হেসে উঠে। আহনাফের রাগ চলে যায়। মুখটা মলিন হয়ে উঠে।
“একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারো না।”
আহনাফের কথায় সারাহ্ হাসি থামালো। আহনাফ আবারো খাতায় নজর দেয়। সারাহ্ বলল,
“খাবেন না?”
“না।”
“আমি গুণে দিবো, এখন তো খাবেন?”
আহনাফ হাসলো। বলল,
“ঐশী, এসব গুণাগুণি আমি করতে পারি।”
“আমি খাইয়ে দিলে খাবেন?”
আহনাফ ওর দিকে তাকাতেই সারাহ্ মুখে হাত দিয়ে চলে যেতে নিলে আহনাফ ওর হাত ধরে।
“তুমি নাকি কথা কম বলো, তোমার বাবা তো এটাই বলেছিল। তো এখন এতো কথা কোথা থেকে আসছে?”
সারাহ্ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“সরি।”
আহনাফ ওর হাত ছেড়ে দিলো।
“সরিটরিতে কাজ নাই। বৃহস্পতিবারে আমরা ঢাকা যাচ্ছি, ওখানে তোমার বাবার সাথে বোঝাপড়া হবে।”
আহনাফ আবারো খাতা দেখতে থাকে। সারাহ্ নিজেই নিজেকে বলে,
“এই লোকটা নি°র্ঘা°ত মা°রবে আমাকে। মানে যা তা একটা।”
সারাহ্ বেরিয়ে যায়। আহনাফ আপন মনে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে একসময় কলমটা রেখে পেছনে ফিরে একবার দরজার দিকে তাকায়। যতটা ম্যাচিউর মেয়েটা হওয়া উচিত ছিল তার চেয়ে একটু কম।
______________________________________
সোমবার পেরিয়ে আজ মঙ্গলবার সকাল। বিকালে ঢাকায় আসবে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজের সাথে কোনো কথা হয়নি ওর, ইমতিয়াজও কল দেয়নি।
অফিস থেকে ইমতিয়াজ আজ ছুটি নিয়েছে। বাসা গুছিয়ে ওর কাছে রাখা সেই বিড়ালকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়।
ইমতিয়াজকে এখন আর বিড়ালটা ভয় পায় না। কোলে নিলেই গা ঘেষে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওর তুলতুলে দেহে হাত বুলায়। বিড়ালটা ওর গা চেটে দেয়।
“এখনো তোর একটা নাম রাখতে পারলাম না। কি নাম রাখা যায় বল তো?”
অপরদিক থেকে “মিউ” বলে একটা প্রতিক্রিয়া আসে। ইমতিয়াজ আলতো হাসে। গোরস্থানে গিয়ে তাহমিনার কবর পরিষ্কার করে৷ বিড়ালটাকে ছেড়ে দিয়েছে হাঁটাহাঁটির জন্য।
“মিনা, ওখানে দেখো আমার একাকিত্বের সঙ্গী৷ তুমি আবার ওকে দেখে হিং°সা করো না।”
কথাটা বলেই ও হাসে।
কবরের পাশে বসেই পুরো দিনটা কাটায় সে। দুপুরে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। বিড়ালের খাবার বাটিতে ঢেলে বলে,
“খেয়ে নিবি কিন্তু। আমি সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরবো।”
গতকালও অফিসে যাওয়ার সময় এভাবেই বিকালকে খাবার দিয়ে গিয়েছিল সে। বিড়ালটা একা থাকায় বড্ড অভিজ্ঞ বোধহয়। বাসায় খেলাধুলা আর খেয়েদেয়ে দিব্বি কা°টিয়ে দেয়। বাইরে যায় না, আবার রাতে ঠিকই ইমতিয়াজের গা ঘেষে শুয়ে থাকে।
ইমতিয়াজ রেডি হয়ে নেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। গাড়ি আগে থেকেই ভাড়া করা ছিল তাই বের হতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না।
এয়ারপোর্টের দুই নম্বর গেট দিয়ে মৃত্তিকার বের হওয়ার কথা। কিন্তু চারটার স্থলে পাঁচটা বেজে গেছে, এখনো মৃত্তিকাকে না দেখে ইমতিয়াজ ফোন বের করে মৃত্তিকার নাম্বারে কল দেয়।
এদিকে মৃত্তিকা বাইরে এসে ইমতিয়াজকে দেখছে। লম্বা, সুঠাম দেহী পুরুষটার চেহারায় এখনো বয়সের ছাপ নেই। কালো টি শার্ট, কালো প্যান্ট আর তার সাথে কালো স্ক্যাটসে একদম কালো হীরা লাগছে। যাকে বলে ব্ল্যাক ডায়মন্ড।
ফোনের ভাইব্রেশনে মৃত্তিকা চোখ সরায়। ফোন বের করে ইমতিয়াজের নাম্বার দেখে কল কেটে দেয়। ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“হাই।”
মিষ্টি কন্ঠে ইমতিয়াজ চমকে তাকায়। নিজের বি°ভ্রা°ন্ত চেহারা সামলে নিয়ে বলে,
“ওহ, এসে পড়েছেন?”
“জি।”
ইমতিয়াজ হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,
“তবে যাওয়া যাক?”
মৃত্তিকা মাথা নাড়ে।
গাড়িতে বসে ইমতিয়াজ সমানে ফোন দেখছে। কোনো একটা গেম সে খুব মনোযোগ দিয়ে খেলছে। সাধারণত সে গেম খেলেনা, তবে এখন মৃত্তিকার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেনা বলে এরকম ব্যবস্থা।
মৃত্তিকা বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। কথা বলার জন্য ছটফট করছে সে, অথচ ইমতিয়াজ একটাবারের জন্য ওর দিকে তাকায় না।
মৃত্তিকা নিজে থেকেই বলে,
“কেমন আছেন?”
ইমতিয়াজ ফোনের দিকে তাকিয়ে ছোট করে জবাব দেয়,
“ভালো।”
ইমতিয়াজের আগ্রহ নেই দেখে মৃত্তিকা আবারো বলে,
“আজ অফিস নেই?”
“আমি ছুটিতে আছি।”
“ছুটির কারণ কি আমি?”
এবারে ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকায়। মাথায় পেঁচানো স্কার্ফ পেরিয়ে সামনের কেটে রাখা লালচে সোনালী চুলগুলো মুখে এলোমেলো হয়ে পড়েছে। লম্বা ভ্রমণে ক্লা°ন্তির ছাপ স্পষ্ট। হালকা গোলাপি ঠোঁটের কোনায় ছোট একটা কা°টা দাগ, যেন কেউ অযত্নে কে°টে দিয়েছে। কপালের কোনায় ছোট একটা পো°ড়া ক্ষ°ত।
ইমতিয়াজ প্রশ্ন করে,
“এতো কাঁ°টা ছেঁ°ড়া দাগ কেন? মা°রা°মা°রি করেন নাকি?”
মৃত্তিকা হেসে দিলো। বলল,
“না, মা°রা°মা°রির কারণে এসব হয়নি।”
“তবে?”
ভ্রূ উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ইমতিয়াজ।
মৃত্তিকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, ঢাকা শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর রাস্তার ব্যবচ্ছেদে লাগানো কয়েকটা এলোমেলো গাছ দেখতে লাগলো। সৌন্দর্যহীন এই নগরীকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে।
ইমতিয়াজ আবারো ফোনে মনোযোগ দিলো। মৃত্তিকা বলে,
“আমাকে নিয়ে ঢাকার মেট্রোরেলে ঘুরাতে পারবেন?”
“তানজিমকে বললেই নিয়ে যাবে। আমার প্রয়োজন নেই।”
আগ্রহহীন ভাবে জবাব দিল ইমতিয়াজ।
“কিন্তু আমার তো আপনার সাথে ঘুরতে ইচ্ছা করে।”
কথাটা বলতে চেয়েও বলা হলো না মৃত্তিকার।
মনের কথা মনে রইলো। আনমনে হাত দিলো কা°টা ঠোঁটে। যে অ°ত্যা°চা°র ওর মাম সহ্য করেছে, তার কাছে এটুকু কিছুই না।
মৃত্তিকার অন্যমনস্ক ভাবটা ইমতিয়াজ খেয়াল করেছে, কিন্তু কিছুই বলেনা।
______________________________________
আহনাফ বাসায় নেই। সারাহ্ আসরের নামাজের পর থেকেই রান্নাঘর গোছাতে ব্যস্ত। সারাদিন সময় পায় না। এখন নিজের মতো করে গুছিয়ে রাখছে সবকিছু। যা যা রান্নাঘরে দরকার তা ওখানে রাখছে আর যা যা ডাইনিং এর দরকার তা ডাইনিং এ রাখছে।
এরমধ্যে আহনাফ বাসায় এসেছে। মেইন দরজা খোলা ছিল। ডোর হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ভিতরে এসেই দেখে ঘর এলোমেলো।
ড্রইংরুমের সোফার কভার বদলে ফেলা হয়েছে। টেবিলের উপরে ফুলদানিতে থাকা নকল ফুলগুলো বদলে সতেজ ফুল রাখা হয়েছে। ডাইনিং এখনো গোছানোর কাজ চলছে।
সারাহ্ ওকে দেখে বলল,
“এদিকে আসবেন না, আমি কাজ করছি।”
আহনাফ ঠোঁট উলটে ভ্রূ কুঁচকায়। বলে,
“এসব কাজ?”
ডাইনিং টেবিলের উপরের কাপড়টা সরাতে সরাতে সারাহ্ বলল,
“হ্যাঁ, এটা কাজ। নিজের সংসার নিজে গোছানো, কাজ নয়?”
আহনাফ থমকে যায়। সারাহ্-কে দেখে মনোযোগ দিয়ে। রাগের মাথায় বিয়ে করেছে সে, সেই রাগে প্রথমদিনই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।
সারাহ্ ওকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
“কি হলো? এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
আহনাফ মাথা নেড়ে বোঝায় কিছু না। প্লেটগুলো রাখতে রাখতে সারাহ্ বলে,
“তাহসিনা কে?”
ব°জ্র°পা°তের মতো কথাটা আছড়ে পড়ে আহনাফের কানে। সারাহ্ কাজ ফেলে এগিয়ে আসে। ভ°য়ং°কর একটা সাহস করেছে সে।
আহনাফ ওর দিকে তাকায়। সারাহ্-র চোখমুখে এখনো জানার আগ্রহ। সারাহ্ ওড়না দিয়ে নিজের হাত মুছতে মুছতে বলে,
“বলতে না চাইলে ঠিক আছে।”
সারাহ্-কে টা°ন দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে আহনাফ শান্তভাবে বলে,
“কেন জানতে চাইছো?”
সারাহ্ উঠে যেতে নিলে আহনাফ ওর দিকে ঝুঁকে বলে,
“উত্তর দাও।”
“আপনি ওইদিন এই নাম নিয়ে চিৎ..”
আহনাফ ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ওই ঠোঁটে স্পর্শ করতেই সারাহ্ থেমে যায়, ভ°য়ে কুঁচকে যায় সে। আহনাফ বলে,
“তাহসিনা এই স্পর্শে লজ্জা পেতো।”
সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কপাল কুঁ°চকে গলা ভারি করে বলে,
“ছি, নিজের বউয়ের কাছে এসব কি বলছেন?”
আহনাফ শার্ট ঝেরে আরেকটা চেয়ার টে°নে বসে বলল,
“বউ জানতে চাইলে আমার কি দোষ?”
“একটা ফালতু লোক আপনি। বাইরে একটা মেয়ের অসভ্যতা করেছেন, আবার ঘরে বউ নিয়ে এসেছেন। (একটু থেমে বিড়বিড় করে) না জানি মেয়েটা কেমন ছিল।”
আহনাফ কথাটা শুনেছে, এবারে সে বেশি রেগে যায়। তাহসিনাকে নিয়ে এধরনের মন্তব্য করা যে সারাহ্-র উচিত হয়নি। আহনাফ উঠে সারাহ্-র দিকে অ°গ্নি°দৃ°ষ্টি নিক্ষেপ করে সোজা বেরিয়ে যায়। সারাহ্ কিছু বলতে চেয়েও পারে না। এলোমেলো রুমটা আর গোছানো হলো না। কান্নার ভারি রেশে সে আর স্থির থাকতে পারলো না, ফ্লোরে বসে পড়লো।
______________________________________
সন্ধ্যা সাতটার দিকে তানজিমদের বাসায় আসে ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। মৃত্তিকা প্রথমেই চলে যায় মমতাজ বেগমের রুমে। ইমতিয়াজ সোফায় বসে।
মমতাজ বেগমের সাথে কথা বলে মৃত্তিকা বেরিয়ে আসে। তারপর ডাইনিং-এ চেয়ার টে°নে বসে সে। লুৎফর সাহেব এসে বলেন,
“মা মিউকো, ফ্রেশ হয়ে আসো।”
মৃত্তিকা উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আংকেল, বসেন।”
ইমতিয়াজের পাশে তানজিম বসে ছিল। ইমতিয়াজ তানজিমের কানের কাছে গিয়ে বলে,
“তোমার আপুর কপালে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করো তো।”
তানজিম একটু জোরে বলল,
“মিউকোপু, ইমতিয়াজ ভাইয়া জানতে চাইছে তোমার কপালে কি হইছে?”
মৃত্তিকা চমকে উঠে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো। ইমতিয়াজ মাথা নিচু করে ফেলে। কথাটা বলার পর তানজিম বুঝতে পারলো সে ভুল কিছু বলেছে।
লুৎফর সাহেব বলল,
“হ্যাঁ তো মিউকো, কি হইছে?”
মৃত্তিকা কপালে হাত দিয়ে বলে,
“বাবা, গতকাল বাসায় এসেছিল।”
মৃত্তিকা থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“সি°গা°রে°ট লাগিয়েছে। ধ°ম°ক দেয়ায় চ°ড়ও দিয়েছে। (একটু থেমে) মামের সাথে যে আচরণটা করেছিল সেটাই আমার সাথে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।”
ইমতিয়াজ চুপ থাকে না। হঠাৎ কি°ড়মি°ড়িয়ে বলে,
“আপনি উলটো একটা চ°ড় দিতে পারেননি?”
“বাবা হয় উনি।”
কথাটা বলে মৃত্তিকা ফুঁপিয়ে উঠে। লুৎফর সাহেব সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজছেন। কিন্তু বাবার কাছ থেকে এমন আচরণ পাওয়া মেয়েকে কি বলে সান্ত্বনা দিবেন উনি।
ইমতিয়াজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকার দিকে। মেয়েটার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। সং°গ্রামের চিহ্ন তার মুখে, কপালে।
কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা থামে। বলে,
“আমার আর সহ্য হচ্ছে না আংকেল। নিজের মৃ°ত্যু কামনা করা পা°প। অথচ আমার এই পা°প করতেই মন চায়।”
সামনে থাকা জগ থেকে পানি ঢেলে মৃত্তিকা একটু পান করে। তারপর বলে,
“মাম তো আরো কষ্ট স°হ্য করেছে। বারবার মনে হয় মামের মৃ°ত্যুর জন্য ওই লোকটাই দায়ী।”
ইমতিয়াজ বড় বড় চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। উপস্থিত বাকিরাও অবাক। রিপা বেগম তো একা মা°রা যাননি, সাথে তাহমিনা আর তাহসিনাও ছিল। এই দুর্ঘটনায় অপরপাশের মাইক্রোবাসের চালকও মা°রা যায়। তবে এটা পরিকল্পিত কিভাবে হতে পারে?
ইমতিয়াজের হাত মু°ষ্টি°বদ্ধ হয়। ওই লোকটার উপর রাগ হচ্ছে। যদিও রাগের কারণ নির্ধারিত নয়, মৃত্তিকার উপর অত্যাচার নাকি তাহমিনার মৃ°ত্যুর সন্দেহ?
চলবে……
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
দ্বাদশ পর্ব
রাত প্রায় এগারোটা, আহনাফ মাত্রই বাসায় ফিরেছে। দরজা এখনো খোলা, সে নিবরে ভিতরে আসে।
সারাহ্ সোফায় ঘুমাচ্ছে। পুরো ঘর একদম পরিষ্কার, গোছানো, সাজানো। আহনাফ পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে দেখে। যত জায়গায় নকল ফুল ছিল, সেসব জায়গায় এখন তাজা সতেজ ফুল। আহনাফ ফুলদানির ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে পানি দেয়া। সে হাসে।
ডাইনিং টেবিলের কাপড়টা সরিয়ে পুরো জায়গা মুছে ঝকঝকে করে ফেলেছে। টেবিলের ঠিক মাঝে আরেকটা ফুলদানি। রঙবেরঙের কিছু ফুল রাখা সেখানে। আহনাফ ভুল না করলে এই ফুলগুলোর নাম ক্যালিস্টেফাস।
“এখানে কোথায় পেল এগুলো?”
প্রশ্ন জাগে আহনাফের মনে।
বেডরুমে গিয়ে আরেকদফা অবাক হয় আহনাফ। সেলফ, টেবিল, বিছানা, ড্রেসিংটেবিল সবকিছু গোছানো। রুমে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। এরকম ঘ্রাণের কোনো পারফিউম ঘরে আছে বলে ওর জানা নেই। এতো কাজ একজন একা হাতে কিভাবে করলো?
আহনাফ তড়িঘড়ি করে এসে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম বসায়। এতো কাজ করে না খেয়েই ঘুমিয়েছে সারাহ্।
রুটি বানানো ছিল, আহনাফ সেগুলো সেঁ°কে নেয়। টেবিলে খাবার রেখে সারাহ্-র কাছে যায়। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়েছে, ডাক দিলে খারাপ লাগবে জেনেও আহনাফ ডাকে।
“ঐশী।”
“হুম।”
ঘুমের ঘোরে মিনমিনিয়ে বলে সারাহ্। আহনাফ হাসে। ছোট শিশুর মতো ব্যবহার ওর।
“ঐশী।”
সারাহ্ চোখ খুলে আহনাফকে দেখে লাফিয়ে উঠে। ঘড়িতে দেখে সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে।
“হায় আল্লাহ্, আমি এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি?”
আহনাফ শান্তভাবে বলল,
“খাবার রেডি, খাবে আসো।”
সারাহ্ তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। যে রাগ নিয়ে বিকেলে বেরিয়েছিল সেই রাগটা নেই। সারাহ্ দাঁড়িয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা এমন ঘটনায় বি°ব্র°ত হয় আহনাফ। সারাহ্ যে ওর বুকেই মাথা রেখেছে। আহনাফ ওকে স্পর্শ করে না, হাত পিছনে নিয়ে নেয়।
সারাহ্ বলে,
“সরি, তাহসিনাকে নিয়ে এসব বলা আমার ঠিক হয়নি।”
“ঠিক আছে, ছাড়ো।”
সারাহ্ সরে দাঁড়ায়। অতি আবেগে জড়িয়ে ধরেছে ঠিকই কিন্তু এখন আবারো ভ°য় লাগছে তার। দৃষ্টি মেলাতে পারলো না সে। চুপচাপ খেতে বসে পড়লো।
______________________________________
ইমতিয়াজ বাসায় এসেছে। দরজা খুলতেই বিড়ালটা এসে হাজির। পায়ের কাছে ঘুরে ফিরে গা ঘে°ষ°তে থাকে। ইমতিয়াজ তাকে কোলে নেয়।
“কিরে ক্ষুধা লাগেনি? আমি তো খেয়ে আসছি, আয় তোকে খাবার দেই।”
ক্যাটফুড খেতে দিয়ে ইমতিয়াজ বিছানা ঝে°ড়ে ঘুমানোর উপযুক্ত করতে ব্যস্ত হয়। এমনসময় ফোন বেজে উঠলো। মৃত্তিকার নাম্বার দেখে প্রথমদফা রেখে দিলেও দ্বিতীয় দফায় রিসিভ করে।
“জি, মৃত্তিকা।”
মৃত্তিকা একটু চুপ থেকে বলে,
“কি করছেন?”
“ঘুমাবো।”
ধ°ম°কের সুরে ইমতিয়াজের ঠা ঠা কথায় মৃত্তিকা ভ°য় পায় না। উলটো প্রশ্ন করে সে,
“আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিল? এই যে আজকে ক্ষ°তটা নিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন?”
ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। কলও কাটে না, ফোনটা লাউডস্পিকার চালু করে পাশে দেখে দেয়। নিজের কাজ করতে থাকে সে।
মৃত্তিকা বলে,
“জানেন, কাল বাবা আমাকে কি বলেছে? (একটু থেমে) বলেছে, আমি যদি উনার কাছে না যাই তবে উনি আমাকে উনার মতো একা করে দিবে। আমি তো এমনিতেই একা, আর কত একা করবে?”
ইমতিয়াজ কাজ থামিয়ে এসে ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“আপনি কেন বলেছিলেন এ°ক্সি°ডে°ন্টটার পেছনে আপনার বাবার হাত আছে?”
“মনে হয়, তাই বলেছি।”
“কোনো প্রুভ?”
মৃত্তিকা একটু ভেবে বলে,
“না, উনি বারবার আমাকে একা করে দিবে বলে। উনার একাকিত্বটা আমি বুঝি না বলে, তাই মনে হয়েছে।”
ইমতিয়াজ থেমে যায়। যদি সত্যি মৃত্তিকার মায়ের মৃ°ত্যুর জন্য ওর বাবা দায়ী হয়, তবে তো উনি আরো তিনটা মৃ°ত্যুর জন্য দায়ী। তাহসিনা, তাহমিনা আর সেই অনাগত নিষ্পাপ শিশুটার। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে ফেলে, আপাতত আর কিছু ভাবার জন্য সে প্রস্তুত নয়।
বিড়ালটা মেও মেও করে ওর কাছে আসে। মৃত্তিকা অপরপাশ থেকে বলল,
“আপনার বাসায় বিড়াল আছে?”
ইমতিয়াজ চোখ খুলে নিজের অবস্থা সামলে নিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আছে।”
“নাম কি?”
ইমতিয়াজ বিড়ালকে কোলে নিয়ে বলে,
“মিউকো, সারাদিন মিউ মিউ করে তো তাই।”
মৃত্তিকা শব্দ করে হেসে দেয়। বলল,
“আমার নামে বিড়াল পুষছেন?”
“সমস্যা কোনো?”
“না তো।”
“হলেও আমার তাতে কিছু আসে-যায় না।”
“আপনার কি করে আসবে-যাবে? আমার মনের খবর কি আর আপনি জানেন? এ হৃদয়ের খবর ওই সর্বশক্তিশালী রব ছাড়া কেউ জানে না।”
মৃত্তিকা মনে মনে ভাবতে থাকে। মুখ ফুটে একথা বলা হয়ে উঠে না।
ইমতিয়াজ বলল,
“রাখছি?”
মৃত্তিকা তাড়াহুড়ো করে বলে,
“একটু শুনুন।”
“জি।”
মৃত্তিকা আর কিছু বলতে পারে না। কলটা কেটে দেয়। ইমতিয়াজের কপাল কুঁচকে যায়। মেয়েটা যে তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে তা সে বুঝতে পারে, কিন্তু সে প্রশ্রয় দিবে না।
______________________________________
পরদিন,
আজ ভার্সিটিতে যাবে না তানজিম আর সামিহা। দুজনে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে আবারো চলে এসেছে তানজিমের বাসায়। সেদিনের পর থেকে একদিন পর পরই তানজিমের বাসায় আসে সামিহা। মমতাজ বেগমও ওকে খুবই পছন্দ করে। ও আসলে অনেক কথা শুনেন উনি, কথাও বলেন।
তানজিম বেল বাজালো। মৃত্তিকা এসে দরজা খুলে দেয়। সামিহাকে দেখে আলতো হেসে বলে,
“ভিতরে আসো।”
সামিহা ভিতরে আসতে আসতে তানজিমকে বলে,
“উনি কে?”
“মিউকোপু।”
“কি পু?”
কপাল কুঁচকে তানজিমকে বলে সামিহা।
মৃত্তিকা কথাটা শুনেছে। শব্দ করে হেসে দেয় সে৷ সামিহা সোফায় বসলে মৃত্তিকা ওর পাশে গিয়ে বসে বলে,
“আমি মৃত্তিকা, তানজিমের কাজিন।”
“ওহ।”
ছোট করে উত্তর দিয়ে সামিহা একটু এলোমেলো করে বলল,
“আগে দেখিনি? কোথা থেকে এসেছেন?”
কথা শেষে বোকাবনে গেল সে। তানজিম জিভে কা°ম°ড় দিয়ে ভিতরে চলে গেছে। এই মেয়ে উল্টাপাল্টা কথা প্রায়ই বলে।
মৃত্তিকা একটু হেসে বলল,
“আমি রোমে ছিলাম, তাই দেখোনি।”
সামিহা ঠোঁট উলটে বলে,
“রুমে থাকতেই পারেন, বারান্দায় থাকবেন নাকি?”
মৃত্তিকা এবারে হো হো করে হেসে উঠে। সামিহা বেশ মজার মানুষ। মৃত্তিকার ভালো লাগে ওকে।
“রুম না রোম, ইতালির রোম।”
মৃত্তিকা কথায় সামিহা দুচোখ খিঁ°চে বন্ধ করে। নিজের বোকামির জন্য রাগ হয় ওর, সাথে লজ্জাও পায়।
“বসো, আমি চা দেই।”
মৃত্তিকা উঠে গিয়ে চা বসায়।
সামিহা নিজের মাথায় নিজেই চ°ড় দিয়ে বলে,
“একটা কথা বুঝে তো বলবি। মেয়ে না তুই, আস্ত ছাগল।”
মৃত্তিকা এখনো হেসে যাচ্ছে। কি কিউট একটা মেয়ে। বাচ্চাবাচ্চা ভাব আর চেহারায় যুবতী বয়সের ছাপ।
তানজিম এসে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল,
“আপু, আমাকেও চা দিও।”
মৃত্তিকা ওকে ডেকে বলল,
“মেয়েটা কে রে?”
“আমার ক্লাসমেট।”
“সব ক্লাসমেট কে কি বাসায় আনিস?”
“আরে না।”
মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল তানজিম।
মৃত্তিকা মুচকি হাসলো।
“আচ্ছা যা, আমি চা আনছি।”
সামিহা ততক্ষণে মমতাজ বেগমের রুমে চলে গেছে। উনার সাথে এটা সেটা নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে সামিহা। মৃত্তিকা চা নিয়ে গেল।
সামিহা ওকে দেখে বলল,
“আপু চলো কোথাও হাঁটতে যাই। তোমার সময় হবে?”
মৃত্তিকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ হবে, কোথায় যাবে?”
“এই আশেপাশেই।”
মৃত্তিকা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
“এখানে আশেপাশে তেমন কোনো হাঁটার জায়গা নেই। দুই একটা শপিংমল থাকতে পারে। (একটু ভেবে) আর কাছে মেবি রমনা আছে, তবে ওখানে ভীড় থাকে।”
সামিহা একটু চুপসে গেছে। মৃত্তিকা বলল,
“আমরা হাঁটতে না গিয়ে, মেট্রোরেলে করে কোথাও ঘুরে আসি?”
“সেটা করা যেতে পারে।”
সামিহা খুশি মনে রাজি হলো। মৃত্তিকা বলল, “ঠিক আছে আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।”
তিনজনের সাথে মমতাজ বেগম বের হলেন। আজ অনেকদিন পর হাসপাতাল ছাড়া অন্যকিছুর উদ্দেশ্যে বের হলেন উনি।
বাইরে এসে ওরা রিকশা নিলো। কাওরানবাজার মেট্রোরেল স্টেশন থেকে ওরা যাত্রা শুরু করবে।
মৃত্তিকা আর মমতাজ বেগম এক রিকশায় উঠলো, তানজিম-সামিহা অন্যটায়।
মমতাজ বেগম বললেন,
“তোমার বাবা জানে তুমি ঢাকায়?”
মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“না, উনি এমনিতেই আমার জীবনটা ন°র°ক করে দিয়েছেন। এখন আর খারাপ কিছু হোক আমি চাই না।”
মমতাজ বেগম আর কোনো কথা বললেন না। নজর ঘুরিয়ে দ্রুত চলা রিকশার চাকায় চোখ রাখলেন।
______________________________________
ক্লাস শেষ করে আহনাফ টিচার্স রুমে যাচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ারের বি সেকশনে ক্লাস নিচ্ছে সারাহ্। শুধু ক্লাস না একপ্রকার চেঁ°চা°মে°চি করছে সে। ক্লাসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সারাহ্-কে ব°কাব°কি করতে দেখে আহনাফ দাঁড়ায়।
ব°কাব°কির কারণ আবিষ্কার হয় এক ছেলে সারাহ্-র ওড়নায় টা°ন দিয়েছে। আহনাফ ছেলেটাকে একবার দেখে কপাল কুঁচকে প্রস্থান করে।
একটু পরে সারাহ্ও বেরিয়ে আসে। রাগে এখনো শরীর জ্ব°লছে ওর।
“অ°সভ্য ছেলে, টিচারের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা জানে না। থা°ব°ড়া দিয়ে গাল লাল করে ফেলতে ইচ্ছা করে।”
বিড়বিড়িয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকে সারাহ্। ম্যাডামদের টিচার্স রুমে ঢুকার সময় সারাহ্ দেখে পাশ থেকে শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে আহনাফ কোথাও যাচ্ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে না যে ক্লাসে যাচ্ছে।
“আহনাফ?”
সারাহ্-র ডাকে ওর দিকে র°ক্ত°চ°ক্ষু নিক্ষেপ করে আহনাফ। সারাহ্ একটু ঘা°ব°ড়ে যায়। তবুও সে টিচার্স রুমে চলে যায়।
আহনাফ বি সেকশনে গিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“সবাই দাঁড়াও।”
সকলে একটু আতিপাতি করে হলেও দাঁড়ায়। আহনাফ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সকলের মুখ দেখতে দেখতে বলে,
“ম্যাডামদের ওড়না টা°ন দিতে ভালো লাগে?”
কয়েকজন মাথানিচু করে ফেলে। প্রথম বেঞ্চ থেকে একটা কলম নিয়ে বলে,
“উত্তর দাও।”
“উনার বউ বলে খুব গায়ে লাগছে?”
দুজন ছেলের ফিসফিসানি আহনাফ শুনে। কলমটা ছেলেটার দিকে ছুঁ°ড়ে ফেলে বলে,
“বের হয়ে এখানে আসো।”
ছেলেটা প্র°তি°বাদ না করে বের হয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। আরেকটা ছেলেকে বলে,
“তোমাদের কেমিস্ট্রির সারাহ্ ম্যাডামকে ডেকে আনো।”
ছেলেটি কথামতো বেরিয়ে যায়। ফিজিক্সের সূত্রের মতো এই স্যারও যে পেঁ°চিয়ে ধরে তা সবাই জানে।
টিচার্স রুমে গিয়ে ছেলেটি বলে,
“সারাহ্ ম্যাম, আপনাকে ফিজিক্স স্যার ডাকছে।”
“আমাকে?”
সারাহ্ একটু বি°ব্র°ত হয়। ফিজিক্স স্যার মানে আহনাফ ডাকছে, তাও একটা ছেলেকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে।
সারাহ্ তড়িঘড়ি করে উঠে যায়। ক্লাসের কাছে গিয়ে থেমে যায় সে। সেকশন দেখে বুঝেছে ক্লাসে ওর সাথে যা হয়েছে তা আহনাফ জানে।
সারাহ্ গিয়ে একবার উঁকি দেয়।
“স্যার?”
আহনাফ ওকে দেখে মাথা নাড়ে। বলে,
“আসেন, ম্যাডাম।”
সারাহ্ ভিতরে এসে আহনাফের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“আহনাফ, কি হচ্ছে এসব?”
“স্যার বলুন।”
“জি।”
সারাহ্ মাথা নাড়ে।
আহনাফ ছেলেটিকে ইশারা করে বলে,
“এই ছেলে?”
“হুম।”
সারাহ্ মাথা নেড়ে জবাব দেয়।
এরমধ্যে বায়োলজির স্যার মেহেদী হাসান ক্লাসে এসে উপস্থিত হয়। আহনাফ উনাকে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কি ব্যাপার স্যার?”
মেহেদী পুরো ক্লাসে চোখ বুলায়। আহনাফ বলে,
“সুন্দরী ম্যাডামের উপর ছাত্ররা ক্রা°শ খাচ্ছে। তাই ম্যাডাম বিচার করাতে আনলো আর কি।”
সারাহ্-র কপাল কুঁচকে গেল। ঠিক কখন আহনাফকে ও বিচারের জন্য এনেছে মাথায় আসলো না ওর।
“ওহ, এই ছেলে?”
মেহেদীর ডাকে ছেলেটি আড়চোখে তাকালো। আহনাফ বলে,
“ক্লাস নেন স্যার। আমি ওকে নিয়ে প্রিন্সিপালের কাছে যাচ্ছি। এইটুকু ছেলে এতো সাহস কোথায় পায় আমিও দেখবো।”
ক্লাস থেকে ছেলেটিকে নিয়ে বেরিয়ে আসে আহনাফ, সারাহ্ও পিছনে আসে। আহনাফ সারাহ্-কে বলে,
“আপনি যেতে পারেন।”
“আহনাফ?”
“স্যার।”
সারাহ্ একটু বড় নিশ্বাস ফেলে বলে,
“ওকে স্যার। দেখেন, এসব করে শুধু শুধু ছেলেটার উপর চাপ তৈরি করছেন।”
আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে তাকায়। সারাহ্ আবারো বলে,
“যা ব°কার আমি ব°কেছি, এখন আর বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই।”
“আমি কি আপনার কথায় চলবো, মিসেস সারাহ্ আহনাফ ফয়েজ?”
সারাহ্ কপাল কুঁচকে ফেললো। মুখের হাসিটা আসতে নিয়েও বাধা পেল। মিসেস সারাহ্ আহনাফ ফয়েজ, নামটা মন্দ নয়।
আহনাফ ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল। সারাহ্ মুখ টি°পে হেসে নিজে নিজেই বলল,
“ফিজিক্সের ফয়েজ স্যার, আমার মিস্টার।”
চলবে……