অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৮+৯

0
268

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টম পর্ব

আজ শুক্রবার, ইংরেজিতে যাকে বলে ফ্রাইডে। মৃত্তিকা নিজের আশেপাশে এই শব্দটা শুনেই অভ্যস্ত। তার মামই তো শুক্রবার বলতো।

অফিসে আজ অর্ধদিবস কাজ করেছে সে। বাসায় চলে এসেছে তাড়াতাড়ি। ইতালির ঘড়িতে দুপুর একটা, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল মৃত্তিকা।

“শুক্রবারে সময় পেলে বেশি ইবাদত করবে। নফল নামাজ পড়বে, কোরআন পড়বে, দুরুদ পড়বে। এতে শ°য়°তা°ন তোমাকে সহজে কাবু করতে পারবে না।”
মামের কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টায় আছে মৃত্তিকা। প্রায়ই শুক্রবারে অর্ধদিবস কাজ করে সে।

বারবার কলিং বেল বাজতে থাকায় বেশ বি°র°ক্ত হয় সে। নামাজের সালাম ফিরিয়েই উঠে যায়। দরজা খুলে অবাক হয় সে, তার বাবা এসেছে।

“কেমন আছো, মিউকো?”

মৃত্তিকা দরজা লাগাতে নিলেও শরীফ দরজা ঠেলে ভিতরে আসে। মৃত্তিকা রেগে একটু দূরে সরে যায়।

“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“আমার মেয়েকে দেখতে আমি এসেছি।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলল,
“কে আপনার মেয়ে? আমি আপনার মেয়ে না। বের হন।”

শরীফ গিয়ে সোফায় বসলো,
“আমার পাশে এসে বসো।”

মৃত্তিকা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। শরীফ বলল,
“তুমি আমার সাথে থাকছো না কেন? চলো, দেশে ফিরে যাই।”
“যাবো না আমি কোথাও।”
রাগে কিড়মিড়িয়ে বলে মৃত্তিকা।

শরীফ আলতো হেসে বলে,
“তোমার মা আমাকে একা করে দিয়েছিল আর তুমিও আমাকে একা করে দিলে?”
“এটাই আপনার জন্য উচিত।”

মৃত্তিকার ঝটপট জবাবে শরীফ বেশ মন°ক্ষু°ন্ন হলো। কানের লতি চুলকাতে চুলকাতে বললেন,
“তোমরা মা-মেয়ে একা থাকার কষ্টটা বোঝো না।”

মৃত্তিকা দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“এতোদিন যেহেতু মামকে ছাড়া একা থেকেছি তাই একা থাকতে কেমন লাগে আমি জানি। আপনি যেতে পারেন।”

শরীফ বেরিয়ে গেল। মৃত্তিকা মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর আবারো এসে জায়নামাজে বসে পড়ে। দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে।
______________________________________

টিকটিক করতে থাকা ঘড়িটা জানান দিচ্ছে সন্ধ্যা ৭ টা। কিছুক্ষণ আগেই আহনাফের সাথে সারাহ্-র বিয়েটা হয়ে গেছে, আহনাফ কোনো বাধা দেয়নি। সারাহ্ এখন নিজের রুমে এসে বসেছে। মেহমানরা খাওয়া দাওয়া করছে। তারপরই সারাহ্-র বিদায়ের সময় চলে আসবে।

এখনো আহনাফের বলা কথাটার সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত সারাহ্। সামিহা এসে ওর পাশে বসলো।

“কিছু বলবি?”
“আপু, আজকেই তোকে নিয়ে যাবে।”

সারাহ্ একটু হেসে বলল,
“কলেজে ক্লাসের জন্য তো যেতেই হবে।”

সামিহা গালে হাত দিয়ে মাথা বাঁ°কিয়ে বলে,
“মানে ভাইয়াকে তুই আগেই দেখেছিস?”
“হুম। কেন তোরা সিভি দেখিসনি?”

সামিহা উলটো প্রশ্ন করলো,
“পছন্দ ছিল বুঝি?”

সামিহার দুষ্টুমিতে একটু লজ্জায় পড়লো সারাহ্। ছোটবোনকে আর যাই হোক, নিজের প্রথম দেখার প্রেমের কথা বলা যায় না।

“আপু, বলো না। ভাইয়াও তোমাকে পছন্দ করতো?”

এবারে সারাহ্ অন্যকথা ভাবলো। আহনাফ ওর সাথে মজা করেনি তো? এমনও তো হতে পারে ও যেভাবে আহনাফকে ভালোবেসেছে, আহনাফও সেভাবেই ওকে ভালোবাসছে।

সামিহাকে ধ°ম°ক দিয়ে বলল,
“পাকনামি করিস না, ভাগ এখান থেকে।”

একপ্রকার তাড়িয়ে দিলো সামিহাকে। সামিহা রাগ করে হয়ে বেরিয়ে আসলো। মায়ের রুমে গিয়ে তানজিমের নাম্বারে ডায়াল করলো।

“হ্যালো?”
“তানজিম, আন্টি কেমন আছেন এখন?”
“ভালো না রে, কেমন যেন চুপচাপ আর গু°মো°ট ভাবে আছে।”

সামিহা একটু চুপ করে থেকে বলল,
“ডক্টর শেষ পর্যন্ত কি বলেছে।”
“উনার সাথে কথা বলতে বলেছে আর ওষুধ কন্টিনিউ করতে। কিন্তু আম্মু তো কারো কথা শুনেনই না।”
“হয়তো শুনে, আমাকে কালকে তোদের বাসায় নিয়ে যাবি।”
“আচ্ছা।”

তানজিম ফোন রেখে মায়ের দিকে তাকালো। সবকিছু সামলে মায়ের যত্ন সে কিভাবে নিবে?

তানজিমের বাসায় এসেছে ওর মামা শাফিন সাহেব ও মামী দেলোয়ারা। মমতাজ বেগমের অসুস্থতার কারণেই এখানে আসা তাদের। দুইবোনের একমাত্র ভাই শাফিন, যে মমতাজ বেগমের ছোট আর রিপা বেগমের বড় ভাই।

শাফিন সাহেব ডাইনিং এ বসে আছে। লুৎফর রহমান উনার পাশে বসা।

শাফিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ছোটবোনটা চলে গেল আর বড়বোনের এ অবস্থা, কিভাবে ঠিক থাকি বলুন দুলাভাই? মিউকো তো দেশেই আসে না।”

লুৎফর রহমান চুপ করে রইলেন। প্রিয়তমা স্ত্রীকে কোনো ভালোবাসি না বললেও সেই ভালোবাসার পরিমানটা তো কম কিছু নয়। বর্তমান যুগের ঠুনকো প্রেম তো তাদের মাঝে ছিল না।

“মমতাজকে বোঝানোর জন্য কাউকে প্রয়োজন। ইমতিয়াজ, তানজিম চেষ্টা তো করছে কিন্তু ওরা তো আর মেয়ের মতো করে বোঝাতে পারে না। (একটু থেমে) যদি মমতাজ আর ঠিক না হয়?”

লুৎফর রহমানের কথায় ভ°য়টুকুর দেখা গেল। শাফিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুই করার নেই যে তার। তানজিম এসে উনাদের পাশে দাঁড়ালো। শাফিন সাহেব ভাগ্নের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক একটু হাসলেন।

ইমতিয়াজ ডাইনিং এ এসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম, মামা।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, ইমতিয়াজ। কেমন আছো?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ।”
“কোথাও যাচ্ছো নাকি?”
“বাসায় যাচ্ছি।”
“আচ্ছা, সাবধানে যেও।”

ইমতিয়াজ সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওর বাসা খুব একটা দূরে নয়। রিকশা করেই চলে যাওয়া যায়।

বাসায় পৌঁছে দেখে বাসার সামনে বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলল,
“কোনো সমস্যা, চাচা?”

ভদ্র ভাষার কথাটা শুনে বাড়িওয়ালা পান চিবুতে চিবুতে বলল,
“না, সমস্যা তেমন কিছু না। তবে তোমাকে বাসা ছাড়ার নোটিশ দিতে আসলাম।”

সিঁড়ির রেলিং-এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে ইমতিয়াজ বলল,
“কেন? হঠাৎ বাড়ি ছাড়ার নোটিশ কেন?”
“তুমি তো অন্য বাসার মহিলাকে ডিস্টার্ব করো। কমপেলেন পাইছি।”

ইমতিয়াজ পাশের ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকালো। ওই বাসার মহিলার স্বামী দেশের বাইরে থাকে, বেশ কিছুদিন হলো ইমতিয়াজকে উনি নিজে এটা সেটা বলেছে। ইমতিয়াজ এসবে বরাবরই প্রশ্রয় দেয় না। অন্যের স্ত্রীর দিকে তাকানো তো বহু পরের বিষয়।

“কে বলেছে এসব আপনাকে?”
“যেই বলুক। তুমি বাসা ছাইড়া দেও।”

ইমতিয়াজ একটু জোরে বলল,
“ছেড়ে দাও বললেই কি ছাড়া যায় নাকি? সময় দিতে হয়।”
“বড়জোর এই মাসটা সময় দিতে পারি, এর বেশি সম্ভব না।”

বাড়িওয়ালা চলে গেল। পাশের বাসার মহিলা এসে দরজা খুললো। ইমতিয়াজ কিছু না বলে নিজের বাসায় চলে গেল।

এই মহিলা ওকে অনেক বি°র°ক্ত করেছে কিন্তু আজকের ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত। এভাবে চরিত্রে আঙুল তুলে ইমতিয়াজের রাগটা আরো বাড়িয়েছে।
______________________________________

রাত ১১ টায় কুমিল্লা পৌঁছায় সবাই। সারাহ্কে মিষ্টিমুখ করিয়ে রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। বাসর ঘর সাজানো থাকে, ফুলের সৌরভ থাকে। সারাহ্ তো এতোদিন তাই জেনে এসেছে। কিন্তু এখানে তেমনটা নেই। পুরো বাসায় একটা গুমোট ভাব বিরাজ করছে আর এ রুমটা যেন তারই কেন্দ্রবিন্দু।

হঠাৎ সারাহ্ একটা কন্ঠস্বর শুনলো।

“বিয়ে করেছি। ব্যস, আর কোনো আবদার আমি রাখতে পারবো না। এখন বউকে কিভাবে বোঝাবে বোঝাও।”

আহনাফের কন্ঠস্বর, তারমানে সত্যিই ওর অমতে বিয়ে হয়েছে। সারাহ্ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

আফরোজা আহনাফের কাছে এসে নিচুস্বরে বলল,
“মেয়েটা মাত্রই বাসায় এসেছে এভাবে চেঁ°চা°মে°চি করিস না আহনাফ।”

আহনাফ আফরোজার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে চলে গেল। সারাহ্ দরজায় কান পেতেও আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। হঠাৎ আহনাফ এসে দরজা খুললে আহনাফের উপর পড়তে পড়তেও সরে এসেছে সে।

ভ°য়ে ভ°য়ে আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ বলল,
“বাসায় এসেই আড়িপাতা শুরু হয়ে গেছে? (একটু থেমে) শখের বশে ছোটখাটো কাজ করা ভালো, তবে বিয়ে না।”

সারাহ্ কিছুই বলল না। চুপ করে গিয়ে বসলো বিছানায়। আহনাফ ফ্রেশ হয়ে এসে রুমে একটা এয়ার ফ্রেশনার দিলো। তারপর সারাহ্-র স্বপ্ন, ইচ্ছাকে সমাধী দিয়ে এসে ঘুমাতে শুয়ে পড়লো।

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে সারাহ্কে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহনাফ উঠে বসে। আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব দেখে সারাহ্।

আহনাফ দাঁত খিঁ°চি°য়ে বলল,
“ঐশী, আপনাকে সুন্দর লাগছে।”

সারাহ্ ফিরে তাকালো। বাবা-মা তো সারাহ্ বলেই ডাকে, ঐশী নামটা রাখা হলেও সহজে কেউ ডাকে না। আহনাফের থেকে এই নামটা শুনতে সারাহ্-র ভালোই লাগলো।

আহনাফ ঠোঁট বাঁ°কিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“এটাই তো শুনতে চাচ্ছিলেন? শুনেছেন? এখন ঘুমাতে আসুন আর না ঘুমালেও লাইটটা অফ করুন।”

সারাহ্ ওয়াশরুমে চলে গেল। আহনাফের খোঁটা দেয়া কথাটা ভালোই বুঝেছে সে। একপ্রকার ঘ°ষে ঘ°ষে মুখের মেকআপ তুলতে থাকলো। কান্না চেপে রেখে নাক টে°নে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো সে।

আহনাফ বিছানায় শুয়ে ফোন টি°প°ছে৷ সারাহ্ এসে অন্যপাশে বসে পড়লো। আহনাফ ওর দিকে একবার তাকিয়ে বামহাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে বলল,
“কিছু বলবেন?”

সারাহ্ মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে কিছুই বলতে চায় না। আহনাফ নিজে থেকেই লাইট অফ করে দিয়ে বলল,
“আমি টায়ার্ড, ঘুমাবো।”
“আপনি কি আমার কথাগুলো একটু শুনবেন?”

আহনাফ সোজা হয়ে শুয়ে বলল,
“এইতো বললেন কিছুই বলবেন না। (একটু থেমে) ওকে, বলেন।”
“অন্য কাউকে ভালোবাসেন তবে আমাকে..”

সারাহ্-র কথার মাঝেই বলল,
“তবে আপনাকে কেন বিয়ে করেছি? এটাই তো বলবেন?”
“হুম।”

আহনাফ সারাহ্-র হাত ধরে টে°নে কাছে নিয়ে আসলো। আচমকা টানে আহনাফের উপরে এসে পড়লো সে, আহনাফের নিশ্বাস পড়লো ওর মুখের উপর। সারাহ্ সরতে চাইলো না, বাধা দিলো না। বরং লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে পড়লো।

“আমার ইচ্ছা হয়েছে বিয়ে করেছি, এখন ইচ্ছা হলে আরো অনেক কিছুই হবে। সো, আমার মেজাজ ভালো থাকতে দেন, এতেই আপনার ভালো।”

সারাহ্ কিছুই বলতে পারলো না, স্বরযন্ত্রটা যেন শক্ত হয়ে গেছে। শাড়ির ভাঁজ পেরিয়ে কোমড়ের কাছে আহনাফের হাতের স্পর্শ পেল। হালকা কেঁ°পে উঠতেই আহনাফ ওকে সরিয়ে দিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেল। সারাহ্ উঠে বসে, নিশ্বাসের হার বেড়েছে ওর।

আহনাফ চোখ বন্ধ করলো। বাবা আর বোনের কথা ভেবেই বিয়ে করেছে সে, কারণ নিষেধ করেও বিয়ে আটকানো কঠিন ছিল। সারাহ্-কে কখনো ভালোবাসতে পারবে কিনা তা সে জানে না, কিন্তু জেনেবুঝে সারাহ্-র জীবন নিয়ে খেলেছে সে।
______________________________________

ইমতিয়াজ কফি বানিয়ে রুমে গিয়ে বসলো। রাত গভীর হচ্ছে আর ওর একাকিত্ব বাড়ছে। এখন আবার বাসা খোঁজার জঞ্জাল শুরু হয়েছে।

ইমতিয়াজের ফোন বেজে উঠলো। আননোন নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কল এসেছে।

ইমতিয়াজ রিসিভ করে।
“হ্যালো, কে বলছেন?”

অপরপাশ থেকে কোনো কথা আসলো না। ইমতিয়াজ বলল,
“কাকে চাচ্ছেন?”

বেশ কিছুক্ষণ পর অপরপাশ থেকে বলল,
“কেমন আছেন?”

সুকন্ঠী নারী কন্ঠে ইমতিয়াজ চমকে উঠে। দ্বিধায় পড়ে বলল,
“ভালো, বাট আপনি কে?”
“মৃ..”

বলতেই কলটা কে°টে গেল। ইমতিয়াজ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মৃ থেকে মৃত্তিকা নয় তো? কপাল কুঁ°চকে চেয়ে রইলো সে।

এদিকে মৃত্তিকা ফোন খাটে ছুঁ°ড়ে ফেলে ফ্লোরে বসে পড়ে। আজ, এতোদিন পর কেন ও ইমতিয়াজকে কল করলো। কেন ইমতিয়াজকে ভুলতে পারছে না সে। কারণ জানা নেই ওর।
______________________________________

পরদিন,
ফজরের আযানে ঘুম ভা°ঙলো সারাহ্-র। আড়মোড়া দিতে গিয়েই খেয়াল হলো ঘুমের ঘোরে আহনাফের কাছে চলে এসেছে সে। ওর চোখের পাপড়িতে আহনাফের ঠোঁট ছুঁইয়ে আছে। সারাহ্ ধীরে ধীরে সরে আসলো।

শাড়িটা একটু ঠিকঠাক করে উঠে ফ্রেশ হতে গেল। ওযু করে এসে আহনাফকে ডাকলো।
“নামাজ পড়বেন, উঠেন।”

দুইবারের ডাকে আহনাফ চোখ খুললো। উঠে বসে বলল,
“আযান দিয়েছে?”
“হুম, আমি ওযু করে এসেছি।”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে সারাহ্-কে টেনে কাছে এনে ওর গলায় গভীর করে চুম্বন করলো। সারাহ্ অ°স্ফু°ট স্বরে বলল,
“সরুন, আমি নামাজ পড়বো।”

আহনাফ সরলো না। সারাহ্-কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“বিয়ের তো খুব শখ ছিল, তো এসবের ধারণা ছিল না?”

সারাহ্-কে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল আহনাফ। দরজাটা বেশ জোরে শব্দ করে বন্ধ করলো। সারাহ্ নিজের গলায় হাত দিলো। আহনাফের ছোঁয়ায় ভালোবাসা নয়, একপ্রকার রাগ খুঁজে পেল সে। অন্য একজনকে ভালোবেসেও ওকে কেন বিয়ে করলো, এখনো এই কথাটাই বুঝতে পারছে না সারাহ্। একজন ছেলের এমন কি দায়ভার থাকতে পারে?

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

নবম পর্ব

“আজ তো ক্লাস নেই?”

আফরোজার কথায় সারাহ্ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না।”

আফরোজা ঘড়িতে দেখে সকাল সাড়ে নয়টা। বলল,
“আহনাফ উঠেনি এখনো?”

সারাহ্ মাথানিচু করে হালকা নাড়ালো। হঠাৎ করে হয়ে যাওয়া এ বিয়েতে মত থাকলেও সংকোচ যে সহজে কাটে না। আফরোজা মুচকি হেসে কাজে মন দিলো। মূলত সে নাস্তা সাজাচ্ছে, সারাহ্ও হাতে হাতে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করছে।

আব্বাস সাহেব ডাইনিং-এ এসে বললেন,
“আহনাফ কোথায়? খেতে ডাকো।”

আফরোজা সারাহ্কে ইশারায় আহনাফকে নিয়ে আসতে বললে সারাহ্ রুমে চলে গেল। দরজা বুজিয়ে দিয়ে আহনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডাকতে নিয়েও থেমে গেল সে। ভোরের ঘটনার কথা মনে হয়ে গলায় হাতটা চলে গেল।

একটা ঢোক গিলে ডাকলো,
“খেতে আসুন।”

আহনাফ চোখ বন্ধ করেই বলল,
“খাবার আমার কাছে আসবে না?”

“পাগল নাকি?”

বিড়বিড় করে কথাটা বলে আহনাফকে হালকা ধা°ক্কা দিয়ে বলল,
“আপু ডাকছে।”
“আমাকে পাগল লাগছে তোমার?”

আহনাফ উঠে বসে। চুল ঠিক করতে করতে বলে,
“তোমাকে আমার পাগল মনে হয়। তারচেয়েও বেশি, ভ°য়া°ব°হ রকমের পাগল।”

ওর কথা আগের মতো লাগছে না। সারাহ্ প্র°তি°বাদ না করে চলে যেতে নিলে আহনাফ বলল,
“স্বামী সেবা না করে কোথায় যাচ্ছো?”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে তাকালো। বলল,
“কি সেবা?”
“স্বামী সেবা। এদিকে আসো।”
হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো।

সারাহ্ কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আহনাফ উলটো দিকে ঘুরে বসে বলল,
“কাঁধে একটু দ°লা°ই°ম°লাই করে দাও।”
“কি?”
“কানে কম শুনো?”

একটু অস্বাভাবিক লাগছে সারাহ্-র। লোকটার আচরণ এমন কেন?

সারাহ্-র দিকে ফিরে বসে বলল,
“কি? বিয়ের শখ মিটে নি।”
“শখ শখ করছেন কেন বারবার?”
জোর গলায় জবাব দিলো সারাহ্।

আহনাফ ওর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল,
“আওয়াজ নিচে।”

উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল আহনাফ। প্রতিনিয়ত সারাহ্ অবাক হচ্ছে, লোকটাকে তো প্রথম দেখায় ভালো ভেবেছিল। মেয়েদের সম্মান করে ভেবেছিল, অথচ নিজের স্ত্রীর সাথে এমন ব্যবহার কেন?
______________________________________

সামিহা আজকে তানজিমের বাসায় যাবে। সুন্দর মতো তৈরি হয়েছে সে। সুতির নতুন থ্রিপিজটা পড়েছে। কচুপাতা রঙের থ্রিপিজের সাথে হালকা মেকআপ আর ঘন চুলের বিনুনিতে বেশ মানিয়েছে।

বাসায় আগে থেকেই অনুমতি নেয়া ছিল। জাহাঙ্গীর সাহেব অনুমতি দিয়ে দেয়ায় খুব একটা অমত করেননি নার্গিস পারভিন।

সামিহা বেরিয়ে এসে মেইন গেইটের কাছেই তানজিমের দেখা পেলো। ওকে দেখে একটু হেসে বলল,
“এমন পে°ত্নী সেজেছিস কেন রে?”
“হোপ, ভদ্রভাবে কথা বল। আমি জানি আমাকে ভালো লাগছে।”
“কচুশাকের মতো লাগছে। মন চাচ্ছে ভাজি করে খেয়ে ফেলি।”

সামিহা গাল ফুলালে তানজিম হেসে ওর হাত ধরে। একটু এগিয়ে বড়রাস্তায় গিয়ে বাসে উঠে দুজনে। মতিঝিল থেকে কাকরাইল, রাস্তাটা দূর নয় তবে জ্যাম ভালোই পড়ে।

দুজনেই পাশাপাশি সিটে বসলো।
“তানজিম।”
“হুম।”

তানজিম সামিহার দিকে তাকালো। সামিহা হেসে বলল,
“এতো সিরিয়াস চেহারা করেছিস কেন? (একটু থেমে) লাস্ট ক্লাসের থিওরিগুলো একটু বুঝিয়ে দিস।”

তানজিম ভ্রূ উঁচিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”

সামিহা বাইরে তাকায়। তানজিম চেয়ে রইলো ওর চেহারার দিকে। সত্যি আজ ওকে অনেক সুন্দর লাগছে। ওর গালে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তানজিমের, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয় সে। নজর ঘুরিয়েও লাভ হয় না, সেই সামিহার চোখের পাপড়ির ছন্দেই হারায় সে।
______________________________________

টেবিলে থাকা পেপারওয়েটটা ঘুরাচ্ছে ইমতিয়াজ। অফিসে কাজ থাকলেও আপাতত কাজে মন নেই ওর। মনের ভেতর তো°লপাড় শুরু হয়েছে, যেন যু°দ্ধ। কারণ বিশ্লেষণ করতে পারলো না সে।

ফোন হাতে নিয়ে গতদিনের নাম্বারটা বের করলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সাত-পাঁচ না ভেবে ম্যাসেজ করলো, একটা ইমুজি পাঠিয়ে চেক করলো অনলাইনে আছে কিনা। তারপর কল করলো।

বেশ কয়েকবার কল করলেও রিসিভ হলো না। ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে একটু ভেবে আবারো কল দিলো। এবারে রিসিভ হলো, কিন্তু কেউ কথা বলছে না।

ইমতিয়াজ শান্ত গলায় সম্পূর্ণ আন্দাজে বলল,
“মৃত্তিকা?”

মৃত্তিকা একটু চুপ থেকে বলে,
“জি।”
“নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?”
“তানজিম দিয়েছে।”

ইমতিয়াজ কোনো জবাব দিলো না। মৃত্তিকা নিজে থেকে বলল,
“আপনি কি সত্যি ভালো আছেন?”

একটু অস্বাভাবিক লাগছে ইমতিয়াজের। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“হুম, ভালো আছি। হঠাৎ কেন কল দিয়েছেন?”
“কোনো কারণ নেই। শুধু…”

বলেই মৃত্তিকা থেমে যায়। ইমতিয়াজ বলল,
“শুধু কি?”

অপরপাশ থেকে মৃত্তিকার ভ°য়া°র্ত কন্ঠ ফেরত আসলো,
“কি করছেন এখানে? চলে যান।”
“মৃত্তিকা?”

ইমতিয়াজের ডাকের কোনো জবাব আসলো না। কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। ইমতিয়াজ একটু ঘা°ব°ড়ে গেল। আরো কয়েকবার ডাকলো মৃত্তিকাকে, কিন্তু এবারে আর কোনো সাড়াশব্দ পেল না। কলটা কেটে গেলে ইমতিয়াজ আবারো কল করলো এবারে রিসিভ হলো না, বরং নাম্বারটা অফলাইনে চলে গেল।
______________________________________

বাসায় এসে পৌঁছেছে সামিহা ও তানজিম। রাস্তার জ্যামের জন্য প্রায় ১২ টা বেজে গেছে। লুৎফর রহমান বাসায় নেই, শাফিন সাহেবও নেই।

দরজা খুললেন তানজিমের মামী দেলোয়ারা খাতুন। সামিহা মিষ্টি হেসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

তানজিম ভিতরে গিয়ে সামিহাকে বলল,
“আয়, বস। উনি আমার মামী (দেলোয়ারা খাতুনকে বলল) মামানী, ও সামিহা, আমার ফ্রেন্ড।”

দেলোয়ারা খাতুন মুচকি হেসে বললেন,
“কেমন আছো?”
“ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন আন্টি?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”

তানজিম রুমে চলে গেল। দেলোয়ারা খাতুন রান্নাঘরে গেলেন। সামিহা পুরোরুমে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। ড্রইং ও ডাইনিং এর জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই। ডাইনিং এর একপাশে জোড়া সোফা রাখা। ভিতরে যা আন্দাজ করলো ছোট ছোট তিনটা রুম থাকতে পারে।

তানজিম এসে বলে,
“চল, আম্মুর সাথে দেখা করবি।”
“হুম, আংকেল কোথায়?”
“দোকানে গেছে বোধহয়।”

সামিহা মাথানেড়ে উঠে তানজিমের পেছন পেছন ভিতরে গেল। মমতাজ বেগম খাটে বসে আছেন। সামিহা বলল,
“আসসালামু আলাইকুম।”

উনি তাকালেন কিন্তু জবাব দিলেন না। সামিহা গিয়ে উনার পাশে বসলো। বলল,
“আন্টি, কেমন আছেন? (একটু থেমে) আপনার ছেলেকে চলে যেতে বলুন না, আমরা একটু একা কথা বলি।”

মমতাজ বেগম ওর দিকে তাকালেন, সামিহা হেসে দিলো। ওর দুগালে হাত দিয়ে কপালে চুমো দিয়ে দিলেন। নিজের মেয়ে তাহসিনার মতোই চঞ্চল এই মেয়েটাকে তার পছন্দ হলো।

তানজিম দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। সামিহার কথায় মায়ের এইটুকু প্রতিক্রিয়াও তার সুখের কারণ।
______________________________________

বিকাল ৫ টা, সকালের খাবার খেয়েই আহনাফ বাইরে গেছে। এখনো ফেরেনি। কল করলেও রিসিভ করেনি।

বিকালে আফরোজা সারাহ্কে সাথে নিয়ে ছাদে এসেছে। সারাদিন সারাহ্কে চুপচাপ থাকতে দেখেছে ও। আফরোজা বলল,
“তুমি কি আমাকে ভ°য় পাও?”

সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে জো°র°পূর্বক একটু হেসে বলল,
“না।”

আফরোজা হাসলো। বলল,
“বিয়ের প্রথম প্রথম আমারো এমন লাগতো। জুহাইবের মায়ের সাথেও কথা বলতে পারতাম না। উনি খুবই ভালো মানুষ, তবুও আমার সংকোচ কাজ করতো।”

সারাহ্ চেয়ে রইলো আফরোজার দিকে। খাঁটি বাঙালি মেয়ে কিভাবে তুরস্কে বউ হয়ে গেল ঠিক মাথায় আসছে না সারাহ্-র। তবুও প্রশ্নটা করা হলো না তার।

আফরোজা নিজে থেকেই বলল,
“মাত্র ২০ বছর বয়সেই আমি বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিলাম। (একটু থেমে) স্কলারশিপ পেয়েছিলাম আমি, আঙ্কারা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স করতে চান্স পেয়ে গেলাম। আম্মুর অনেক ইচ্ছা ছিল আমি যেন বাইরে পড়তে যাই।”

তারপর একটু হাসলো, সারাহ্-ও হাসলো। সারাহ্ বলে,
“আপনার আম্মু?”

আফরোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আম্মু অনেক আগেই চলে গেছে। তখন আহনাফের বয়স ছিল নয় বছর আর আমার এগারো। আম্মু ছোট থেকেই বলতো আমাদের দেশের বাইরে পড়তে পাঠাবে।”

আফরোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আহনাফ প্রতিদিন স্কুল থেকে এসেই কান্না করতো, ওর ফ্রেন্ডদের মা নিয়ে যায় ওর মা নেই কেন? আমি বলতাম ওই আকাশ যতদূর আছে, আম্মুও ততদূর তোর সাথে আছে।”

সারাহ্ও আকাশের দিকে তাকালো। বাবা-মা দুজনই ওর জীবিত আছে। অথচ জীবনে কতবার বাবা-মায়ের বি°রু°দ্ধে গিয়ে কথা বলেছে ও, না জানি কতবার বে°য়া°দবি করেছে, কষ্ট দিয়েছে। না থাকলে মূল্য বোঝা যায়, থাকলে তাহা বড়ই দায়।
______________________________________

সন্ধ্যা ৭ টায় ইমতিয়াজ অফিস থেকে বেরিয়েছে। সেই সকাল থেকে এই পর্যন্ত অনবরত মৃত্তিকার নাম্বারে কল করে যাচ্ছে অথচ রিসিভ হচ্ছে না। ইতালিয়ান নাম্বারটাও নেই ওর কাছে।

শেষমেশ কিছু একটা ভেবে তানজিমকে কল করলো। সামিহাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তানজিম সবে ফিরতি পথ ধরেছে। ফোন সাইলেন্ট অবস্থায় পকেটে পড়ে আছে। ইমতিয়াজের বারবার দেয়া কলগুলো সম্পর্কে সে পুরোপুরি অ°জ্ঞা°ত।

ইমতিয়াজ রাগে রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরায় লা°থি দিলো। মৃত্তিকার সাথে কি হয়েছে? সকালে কে ছিল ওর বাসায়? কিছুই জানে না সে।

বাসায় চলে আসলো ইমতিয়াজ। গোসল করতে চলে গেলে মৃত্তিকার নাম্বার থেকে কল আসে। দুবার বেজে কেটে যায়।

গোসল শেষে রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে কলব্যাক করলো। একবার বাজতেই রিসিভ হলো, যেন মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে বসেছিল।

“মৃত্তিকা, কি হয়েছিল সকালে?”

ইমতিয়াজের চিন্তিত কন্ঠ আর উ°ত্তে°জ°নায় মৃত্তিকা হাসলো। বলল,
“বাবা এসেছিল।”
“বাবা?”
“হুম, মনে আছে আমার বাবাকে?”

একটু ভেবে বলল,
“বোধহয়। কি বলেছে? সারাদিনে কোথায় ছিলেন?”

মৃত্তিকা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
“আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে আপনার?”

ইমতিয়াজ ফোন রেখে দিলো। সত্যিই তো কেন এতো চিন্তা হচ্ছিল ওর। অন্য মেয়ের চিন্তা মনে আনা মানে তাহমিনার সাথে প্র°তা°র°ণা করা, এমনটাই মনে করছে সে। ওর মিনার সাথে ও প্র°তা°রণা করতে পারবে না। মৃত্তিকার নাম্বারটা ব্ল°ক°লিস্টে ফেলে দিলো। ভাববে না ও কাউকে নিয়ে, ভাবতে চায়ও না। রাগে ফোনটা ছুঁ°ড়ে ফেলতে নিয়েও ফেলে না। তার এসব রাগ যে তার মিনা পছন্দ করতো না।

হঠাৎ কল কে°টে যাওয়ায় মৃত্তিকা অবাক হলো না। ফোনটা টেবিলে রেখে আবারো কম্পিউটারে মন দিলো।

ভোরে নামাজের পর যখন ইমতিয়াজ কল দিয়েছিল তখন কথা বলতে বলতে মেইন গেইটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। তখন শরীফ এসে হাজির হয় ওর সামনে, আদর করে মেয়েকে ডাকলেও মৃত্তিকা রেগে যায়। লোকটাকে দেখলেই তো ওর রাগ হয়। ফুলের টব ছুঁ°ড়ে ফেলেছিল, আহত হয়েছে। যদিও এতে মৃত্তিকার ভ্রূক্ষেপ নেই।

তারপর অসাবধানতার জন্য ফোনটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। এখন মাত্র অন করে ইমতিয়াজের এতোগুলো কল দেখে সে। ইমতিয়াজ তাকে নিয়ে ভাবছে, ইমতিয়াজের ভাবনার ছোট অংশে ওর স্থান আছে।
______________________________________

আহনাফ মাত্রই বাসায় আসলো। সারাহ্ চা বানাচ্ছে, আফরোজা পাশে দাঁড়ানো। আহনাফ এসে রান্নাঘরে উঁকি দিলো।

আফরোজা ওকে দেখে বলে,
“কিরে? কোথায় ছিলি সারা বিকাল?”
“প্রিন্টার কিনতে গিয়েছিলাম।”
“প্রিন্টার?”
“হুম, এটা সেটা প্রিন্ট করে বাইরে যেতে হয়, তাই ভাবলাম ঘরেই নিয়ে আসি।”

ধ°ম°কের সুরে বলল,
“দুপুরে খেতে আসিসনি কেন?”
“খেয়েছি আমি।”

সারাহ্ আড়চোখে একবার আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ খেয়াল করলো সারাহ্-র দৃষ্টি, কিন্তু কিছুই বলল না। আফরোজা দুজনের দৃষ্টিই দেখেছে।

“চা নিয়ে আসো, আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”
সারাহ্ মাথা নাড়তেই আফরোজা বেরিয়ে গেল।

আহনাফ এসে সারাহ্-র পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করছে না?”

সারাহ্ তাকালো ওর দিকে। একেবারে পূর্ণদৃষ্টি, চোখে চোখ রাখলো। আহনাফ একবার দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বারান্দায় আছি, আমার চা ওখানে এসে দিও।”

সারাহ্ মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলো। আহনাফ বের হয়ে যাওয়ার সময় ফিরে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“তুমি নিজে আসবে।”
“আচ্ছা।”

আফরোজা এসে ড্রইংরুমে সবার জন্য চা নিলো আর আহনাফের জন্য চা নিয়ে বারান্দায় গেল সারাহ্। ফ্লোরে আহনাফ বসে আছে। সারাহ্কে দেখে পাশে বসতে ইশারা করলো। সারাহ্ তাই করলো।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আহনাফ বলল,
“সমস্তটা দিন কোথায় ছিলাম জানো?”
“প্রিন্টার..”

আহনাফের হাসিতে সারাহ্ থেমে গেল। আহনাফ বলল,
“ও তো আপুকে বলেছি। সবাই জানুক আমি ভালো আছি।”

সারাহ্ চুপ করে রইলো, কথার অর্থ গভীর যা সে বুঝলো না। আহনাফ বলল,
“আমি নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না। অন্যরা রেগে গেলে চেঁচায়, ভা°ঙ°চু°র করে। হাসি পেলে হাসে, কান্না পেলে কাঁদে। আমি এসব পারি না। নিজেকে অস্বাভাবিক লাগে।”

সারাহ্ মনোযোগী শ্রোতা। আহনাফ চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তারপর বলে,
“আপুর সাথে এবার বাবাও আঙ্কারা যাবে। এবারে আমাকে নিয়ে উনারা চিন্তিত থাকবে না, কারণ তুমি আছো।”
“আমি?”

আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুম, (একটু থেমে নরম সুরে) গতরাতের বিহেভিয়ারটা অনেক খারাপ হয়েছে। এভাবে তোমাকে হে°ন°স্তা করা উচিত হয়নি। সকালে যা করেছি তাও অনুচিত ছিল। সরি ফর দ্যাট।”

সারাহ্ কি বলবে আর, এখানে কি বলার থাকতে পারে?

“সারাদিন মসজিদে ছিলাম। একাকিত্বে রবই পথ দেখান। ভেবেছি আমি এসব নিয়ে, নিজেকে যথাসম্ভব বুঝিয়েছি। (একটু থেমে) তোমার সাথে যা করেছি তারজন্য সরি, ঐশী।”

সারাহ্ অন্যদিকে তাকালো। যতটা খারাপ তাকে ভেবেছিল, ততটা খারাপ নয়। তবে ওর আচরণ যে অন্য দশটা পুরুষের থেকে আলাদা তা সারাহ্ বুঝে গেছে।

আহনাফ বলেই যাচ্ছে,
“আমি জানি না তোমাকে কতটুকু বোঝাতে পারছি। আমাকে কেন যেন কেউ বুঝে না, আমিও বোঝাতে পারি না। তবে একজন আমাকে বুঝেছিল।”

সারাহ্ ফিরে তাকাতেই আহনাফ উঠে চলে গেল। ওই একজনের ব্যাপারে জানা হলো না সারাহ্-র।

সারাহ্ উঠে রুমে এলো। আহনাফ ড্রইংরুমে চলে গিয়েছে। পড়ার টেবিলের একটা চকলেট রাখা, সাথে একটা চিরকুট।

“সরি ঐশী, এভাবে রাগ দেখানোটা আমার ভুল ছিল।”

চিরকুট পড়ে সারাহ্ নিজে নিজেই বলল,
“এ কেমন রাগ? হে আল্লাহ্, এ মানুষটাকে একটু বোধবুদ্ধি দিও।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে