হৃদয়াক্ষী পর্ব-১২

0
1007

#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_১২
#সারিফা_তাহরিম

‘কিছু অনুভূতি প্রকাশের কোনো মাধ্যম হয় না। বলার মতো কোনো ভাষা হয় না। অনুভূতিগুলো অপ্রকাশিতই বেশ সুন্দর। শুধু অনুভব করতে হয় হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে।’

কথাগুলো বলে অরিত্র তাকাল পূর্ণতার দিকে। মেয়েটা তার বুকের বাঁ পাশে মাথা রেখে বেশ আয়েশ করে ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। নাকের নাকফুলটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। এক গাছি চুল অবাধ্য হয়ে কপাল ছাড়িয়ে মুখে এসে পড়েছে। মৃদুমন্দ বাতাসে হালকা হালকা কেঁপে উঠছে সে ৷ অরিত্র মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া শাড়ির বাড়তি আঁচলটুকু দিয়ে পূর্ণতাকে ভালোভাবে ঢেকে দিল। তারপর নিজের দিকে আরেকটু কাছে এনে জড়িয়ে ধরল। ঘুমন্ত মেয়েটা তারই স্ত্রী। কথাটা ভাবতেই অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করল মনে। অরিত্র মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে চোখের পাতা মিলিত করল।

____

রৌদ্রালোকের দেখা মিলেছে বেশ কিছুদিন পর। বৃষ্টিমুখর অন্ধকার কাটিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারপাশ। বৃষ্টিকালীন সুমিষ্ট শীতল হাওয়ার দাপট এখনো কিছুটা থেকে যাওয়ার কারণে গরমটা ঠিকঠাক জায়গা করে নিতে পারেনি। পূর্ণতা, মিফতা আর দিনা ক্লাসের এক কোণে বসে গল্প করছে। টিচার আসেননি আজ তাই এই ক্লাসটা হবে না। অনেকে বেরিয়ে গেছে। আবার অনেকে পূর্ণতাদের মতো ক্লাসে বসে গল্প করছে। রি মুহূর্তে তাদের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো অরিত্র। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে অরিত্রের বাহুবন্ধনীতে আবিষ্কার করেছিল। লজ্জা আর মধুর অনুভূতি নিয়ে অল্প কিছু সময় কাটালো। সকালে খাওয়া দাওয়া করার পর আসাদের পরিবারকে বিদায় জানিয়ে তারা চলে এলো। পূর্ণতাকে তার বাসায় দিয়ে এসে অরিত্র নিজেও অফিসে চলে গিয়েছিল। এরপর থেকে পাঁচদিন কেটে গেছে, তাদের দুজনের দেখা হয়নি। ফোনে টুকটাক কথা হয়। এতদিন ভারি বর্ষনের কারণে পূর্ণতা ভার্সিটিতে আসতে পারেনি। আজ ভার্সিটিতে আসার পর গল্প করতে করতে মিফতা অরিত্রের কথা জিজ্ঞেস করতেই পূর্ণতা লাজুক স্বরে সবটা খুলে বলল। পুরো ঘটনা শুনে মিফতা আর দিনা যেন আকাশ থেকে পড়ল। পূর্ণতার এত পরিবর্তনে তার চরম বিস্ময়ে পৌঁছে গেছে। দিনা বিস্ফোরিত চোখে বলল,

‘কিরে ভাই তুই না অরিত্র ভাইয়াকে দুই চোখে সহ্য করতে পারতি না? এখন হুট করে সুপারসনিক স্পিডে প্রেম এসে গেল কিভাবে? ‘

পূর্ণতা হালকা চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘দিব দুইটা থাপ্পড়। প্রেম কোত্থেকে দেখলি? সৌজন্যতা বজায় রেখে চলেছি আমি। আর কিছু না। যেকোনো কিছুতে দুই চামচ বেশি বোঝা তো তোর মুদ্রাদোষ।’

মিফতা ঠোঁট বাঁকিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল,

‘ওরে আমার সৌজন্যতা রে! কোনো ছেলের বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখা যে সৌজন্যতার মধ্যে পড়ে তা কোন সংবিধানে লিখা আছে?’

তারপর স্বাভাবিক সুরে বলল,

‘দিনা তো ঠিকই বলসে। তোর যে প্রেম ট্রেম হয়ে গেসে সেটা স্বীকার করোস না ক্যান? তার উপর বৃষ্টিবিলাস টাইপ সময় কাটানোর আবদারও করসোস। এটা শুনার পরও তুই অস্বীকার করবি?’

পূর্ণতা ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো কাচুমাচু করে নিম্ন স্বরে বলল,

‘ আবদার করতেই পারি। উনি আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। আমার অধিকার আছে তার উপর।’

পূর্ণতার কথায় মিফতা আর দিনা ‘ওহো~’ বলে সুর তুলল। তারপর দুজনে দুপাশ থেকে খোঁচা মারল। মিফতা দাঁত কেলিয়ে বলল,

‘একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ! তার উপর অধিকার! আহা! কি প্রেম! তুমি তো অরিত্র আহসানের প্রেমে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছো গো পূর্ণতা বেবি।’

দিনা বলল,

‘যাক অবশেষে সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে। আমাদেরও খুব খুশি লাগছে। কী বলিস মিফতা?’

‘হ্যাঁ, আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। এই পূর্ণতা, এখন তো ক্লাস নেই, ভাইয়াকে কল দে।’

‘যাহ, কী বলিস এগুলো? মাথা ঠিক আছে? আমি নিজ থেকে উনাকে কখনো কল করিনি। আমার লজ্জা লাগে। সময় হলে উনি নিজেই কল করে।’

দিনা বলল,

‘প্রেমালাপ করতে লজ্জা লাগে না, শুধু কল করতেই লজ্জা লাগে তাই না? মাইর চিনোস তুই?’

‘আরে দোস্ত বুঝতে পারছিস না কেন, উনি তো এখন ব্যস্ত থাকতে পারে। কত কাজ অফিসে! এই টাইমে কল দেওয়াটা… ‘

মিফতা ফোড়ন কেটে বলল,

‘কোনো কথা শুনতে চাই না। ভাইয়ার কাছে তোর কলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। কল দে তুই। নাহলে আমরা ভাইয়াকে কল করে বলব তুই উনার সাথে দেখা করার জন্য কান্নাকাটি করছিস। এবার বাকি সিদ্ধান্ত তোর। তুই কল দিবি নাকি আমরা দিব?’

পূর্ণতা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘তোদের মতো ফাজিল বান্ধবী যে কি করে আমার কপালে জুটলো আল্লাহ জানে! আমিই দিচ্ছি কল।’

পূর্ণতা অরিত্রের নাম্বারে ডায়াল করল। দুবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কল কেটে দিল। পূর্ণতা ভাবলো অরিত্র হয়তো ব্যস্ত আছে তাই কল কেটে দিয়েছে। মনে মনে খুশিই হলো সে। অরিত্রের সাথে কথা বলার পর থেকে তার বান্ধবীরা আরও বেশি ফাজলামো করবে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে ওপাশ থেকে কল এলো। হ্যাঁ, অরিত্র কল করেছে। মিফতা আর দিনার মুখে দুষ্টুমির হাসি। মিফতা বলল,

‘লাউড স্পিকারে দিয়েন। আমরাও একটু শুনি আপনাদের মধুর প্রেমালাপ।’

পূর্ণতা চোখ ছোট ছোট করে কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিয়ে বলল,

‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন মিসেস অরিত্র আহসান? ‘

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। হঠাৎ এই সময়ে কল দিলে যে? আজ ভার্সিটি গিয়েছ না? কোনো সমস্যা হয়েছে?’

‘জ্বি, ভার্সিটিতে এসেছি। কোনো সমস্যা হয়নি। স্যার আসেনি তাই এই ক্লাসটা হবে না। আবার আধা ঘণ্টা পরে ক্লাস আছে। আপনি কি ব্যস্ত?’

‘না ম্যাডাম, আমি ফ্রি আছি। আর ব্যস্ত থাকলেও আপনার জন্য সবসময় আমি ফ্রি। আপনার আবদার সকল ব্যস্ততার ঊর্ধ্বে। এবার বলুন কোন আবদারে কল করেছেন?’

‘না এমনিই কল করেছি। কোনো আবদার নেই।’

অরিত্র হালকা হেসে বলল,

‘ করে ফেলুন সেদিনের মতো মোহময় আবদার। আপনার আবদার পূরণে এই ব্যক্তি সবসময় প্রস্তুত। অবশ্য আপনার আবদারে আমারই সুবিধা হবে। অনুমতির সাথে একটু সম্মোহনী মুহূর্ত কাটানো মন্দ হবে না কি বলেন মহারাণী?’

পূর্ণতা লজ্জায় পড়ে গেল। তার সামনে বসে থাকা মানবী দুজন আবারও ‘ওহো~’ বলে সুর তুলল। সুরটুকু বোধহয় মোবাইলের পর্দা ভেদ করে ওপারেও পৌঁছাল। অরিত্র কৌতুহলী কণ্ঠে বলল,

‘এই তাহলে ব্যাপার? আমার শালিকাদের আবদার রাখতে বুঝি আপনি আমায় কল দিয়েছেন?’

পূর্ণতা বুঝতে পারল আর বেশিক্ষণ কথা বললে তার আর বেঁচে থাকার মতো অবস্থা থাকবে না। এই মেয়ে দুটো তাকে সত্যিই লজ্জায় ফেলে মেরে ফেলবে। তাই তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বলল,

‘আ..আমার একটু কাজ আছে। পরে কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ।’

অরিত্রকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে তড়িৎ গতিতে কল কেটে দিল পূর্ণতা। মিফতা আর দিনা সশব্দে হেসে উঠলো। পূর্ণতা তাদের দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মিফতা নিজেকে সামলে বলল,

‘মিসেস অরিত্র আহসান, তুমি যা ই বলো না কেন, আমাদের জিজু কিন্তু সেই লেভেলের রোমান্টিক। তাই না রে দিনা?’

দিনাও তাল মিলিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ রে ঠিকই বলেছিস। কত রোমান্টিক রোমান্টিক কথা বলে! আমার তো মিস্টার এন্ড মিসেস নাটকের মোটুর মতো করে বলতে ইচ্ছে করছে, আল্লাহ তুমি আমাকে এমন একটা রোমান্টিক জামাই দাও। এখনই দাও। তাড়াতাড়ি দাও। কুইক।’

মিফতা দিনার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

‘তুই না কয়দিন আগে মিংগেল হইলি? এই দোয়া তো আমার করা দরকার। তোদের একটার কপালে রোমান্টিক জামাই জুটসে আরেকটার কপালে রোমান্টিক বফ। আমি পোড়াকপালির ভাগ্যে কোনো রোমান্টিক মানুষ জুটে না ক্যান! সারাজীবন সিংগেলই রয়ে গেলাম। ধুর!’

দিনা হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ইশ! আমি তো আমার তার কথা একদম ভুলে গেছি। দুদিন কথাও হয়নি। আজ ভার্সিটিতে এসে খুঁজব ভেবেছি। কিন্তু গল্পের পাল্লায় পড়ে খেয়ালই ছিল না। যাই আমার সেই মানুষটাকে খুঁজে আসি। না জানি কোথায় হারিয়ে গেছে!’

কথাগুলো বলতে বলতে দিনা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার উদ্দেশ্য ইরাফকে খুঁজে বের করা। ‘ভালোবাসি’ না বলেও দুজনের মধ্যে একটা প্রেম প্রেম ভাব হয়ে গেছে। ইরাফ সামনে আসার পর দিনা তার প্রশ্নের জবাব না দিলেও তার আচরণে ইতিবাচক মনোভাব বুঝতে পেরেছিল ইরাফ। এরপর থেকে অল্প অল্প করে কথা বলা শুরু, অল্প অল্প সময় কাটানো, আর ধীরে ধীরে অল্প অল্প অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ! দিনা এই মানুষটার চিরকুটের সাথে সাথে তার মাধুর্যেও বিমোহিত। দুদিন কথা না হওয়ায় কেমন এক অস্থিরতা জেঁকে বসেছিল, যা ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিল। পরক্ষণে মনে পড়তেই মনটা আবারও চাতক পাখির মতো অস্থির হয়ে উঠেছে। সে ইরাফদের ক্লাসে ঘুরে এলো। না, ইরাফ সেখানে নেই। তবে কি সে ক্যান্টিনে আছে? ক্যান্টিনের দিকে গেল দিনা। তার ধারণাই সত্যি হলো। ইরাফ ক্যান্টিনে বসে আছে। তবে একা। পেছন ফিরে বসার কারণে দিনাকে দেখতে পায়নি সে। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। ইরাফকে দেখে উৎফুল্ল হলো। ইরাফের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনতে পেল ইরাফ আওড়াচ্ছে,

‘তারা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে