হৃদয়াক্ষী পর্ব-০৩

0
1232

#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_০৩
#সারিফা_তাহরিম

“আজ তোমাদের বাসায় যাব। আমার রাগী বউটার পাহাড়সম রাগ গলানোর জন্য কী করতে হবে বলো।”

পূর্ণতা যেন এবার একটা সুযোগ পেল। বারান্দা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বলল,

” এতই যখন রাগ ভাঙানোর শখ, তখন আপনি না আসলেই পারেন। আপনার উপস্থিতি আমার সহ্য হয় না। রাগ ভাঙাতে আসলে উল্টো রাগটা বেড়ে যাবে। তাই বৃথা চেষ্টা না করে অন্তত আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দিন প্লিজ।”

“বেশ! তবে তাই হোক। আপনার হুকুম শিরোধার্য পূর্ণতারাণী।”
একটু থেমে শ্বাস ফেলে বলল,

“এখন রাখছি তাহলে। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ। ”

পূর্ণতা বিদায়বাণী না জানিয়েই ফোন রেখে দিল। পড়ার টেবিলে বসে বইয়ে মুখ গুজল। সামনে পরীক্ষা তাই পড়ায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করল। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। ঘুরে ফিরে বাবা মায়ের কঠোর ব্যবহারের কথা মনে পড়ছে। বাবা মা এমন কেন করছে তার জানা নেই। সেদিন বাবা কোন ছেলের কথা বলেছিলেন তাও জানে না পূর্ণতা। সে শুধু এটুকুই জানে তার জীবনে হুট করেই এই নতুন রূপী ঋতুর আবহাওয়া তার ভালো লাগছে না।
____

এদিকে পূর্ণতা ফোন রাখতেই অরিত্র রিভলভিং চেয়ারটায় মাথা এলিয়ে দিল। টাইয়ের নটটা হালকা ঢিলে করলো। প্রেয়সীর রাগের উত্তাপে এই এসি রুমের মধ্যে থেকেও ঘেমে সিক্ত হয়ে উঠেছে অরিত্র। নিজের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট একটা মেয়ের এতখানি রাগে অবাক হয় অরিত্র। এইতো সবে নতুন জীবন শুরু হলো। এমন রাগেতপ্ত প্রেয়সীর রাগের আগুনে বরফ পানির মতো শীতল অরিত্র না আবার বাষ্প হয়ে যায়! নিজের ভাবনায় আনমনেই হাসলো অরিত্র। এই মেয়েটাকে দেখার পর থেকে তার অদ্ভুত অসুখ হয়েছে। যেখানে সেখানে পূর্ণতাকে দেখতে পায় সে। রংতুলিরা হুটহাট হৃদয় ক্যানভাসে সেই মেয়েটার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলে। তার যেন হৃদয় নামক তৃতীয় নয়ন উৎসর্গ হয়েছে মেয়েটিকে দেখার জন্যে। তাই তো তার তুষার রাঙা অর্ধাঙ্গিনীর নাম,

‘হৃদয়াক্ষী’

অরিত্রের সেই দিনটা ভীষণ মনে পড়ে যেদিন সে পূর্ণতাকে প্রথম দেখেছিল। দিনটার কথা ভাবতেই অরিত্রের মনে প্রশান্তি ছুঁয়ে যায়। কারণ এখন সেই রমণী তার অর্ধাঙ্গিনী। মেয়েটাকে রাজি করাতে বেশ কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল তার কোনো ইয়াত্তা নেই। মঈনুল হাসানও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন পূর্ণতাকে সে কিভাবে চিনে। কিন্তু অরিত্র সেই প্রশ্ন সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যায়। রুমের দরজায় নক পড়তেই অরিত্রের ভাবনার সুতো ছিড়ে। সোজা হয়ে বসে বলল, ‘আসুন’। তখন একজন পিয়ন এসে কিছু ফাইল দিয়ে গেল টেবিলে। সেই সাথে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। পিয়ন যেতেই অরিত্র চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে ফাইলে মনোনিবেশ করল। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার র‍্যাঙ্কে নিয়োজিত আছে। পরিবারের সব কাজের মতো অফিসের সকল কাজের ক্ষেত্রেও বেশ মনোযোগী আর দায়িত্বশীল। এজন্যই হয়তো সকলের পছন্দের পাত্র হয়ে উঠেছে সে।

______

বিকেল গড়িয়ে আসতেই সূর্য খানিকটা পশ্চিম আকাশে নেতিয়ে পড়েছে। বারান্দার মেঝেতে নরম সূর্যালোক এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। এই মুহূর্তে পূর্ণতার ঘরে শীতলতা বিরাজ করছে। সে আয়নার সামনে বসে আছে। পড়নে বেগুনি রঙের একটা শাড়ি। কিছুক্ষণ আগে মা এসে তাকে শাড়িটা পড়িয়ে দিয়ে গেছেন। সেই ফাঁকে পূর্ণতা খানিকটা ভাব জমাতে চাইলো মায়ের সাথে। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। নাজিবা হাসান একটা কথাও বললেন না মেয়ের সাথে। সকাল থেকে মঈনুল হাসানও তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এসব কথা ভাবতেই দুচোখ ভিজে উঠল। নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিল পূর্ণতা কিছুক্ষণের মধ্যেই অরিত্রের পরিবার চলে আসবে। কিন্তু পূর্ণতার মধ্যে একটা চাপা ভয় ইয়াজ করছে। সে তো মুখের উপর অরিত্রকে আসতে নিষেধ করলো ঠিকই, কিন্তু না সার কারণ জানতে চাইলে সে যদি তার পরিবারকে সত্যি কথা বলে দেয় তাহলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে। পূর্ণতা আর তার পরিবার ছোট হয়ে যাবে তাদের সামনে। এই মুহূর্তে পূর্ণতা নিজের করা কাজের জন্য পস্তাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরে মৌনতা এসে বলল অরিত্রের পরিবারের সবাই চলে এসেছে। পূর্ণতা একটু অস্বস্তিতে জড়িয়ে গেল। মৌনতা তাকে বসার ঘরে নিয়ে গেল। এক পাশের সোফায় অরিত্রের মা বাবা আর অবন্তী বসে আছে। আরেকটা সিংগেল সোফায় মঈনুল হাসান বসে আছেন। তার ঠিক পেছনে নাজিবা হাসান দাঁড়িয়ে আছেন। পূর্ণতা সালাম দিল। মৌনতা তাকে সোফায় বসিয়ে দিল। অরিত্রের বাবা মা প্রসন্ন হেসে সালাম নিলেন। অরিত্রের মা আনিকা ইসলাম পুত্রবধূর পাশে এসে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“কেমন আছো আম্মু?”
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে ঘরের বউ করার পর কি কেউ খারাপ থাকতে পারে? তবে এখন থেকে আন্টি ডাকলে চলবে না। মা ডাকতে হবে। অবন্তী যেমন আমার মেয়ে তুমিও তো আমার মেয়ে। তাই আন্টি ডাকলে হবে না। বুঝলে আম্মু?”

পূর্ণতার হালকা লাজুক হেসে বলল,

“জ্বি আম্মু।”
মঈনুল হাসান জিজ্ঞেস করলেন,

” অরিত্র বাবা আসেনি যে?”

আনিকা ইসলাম বললেন,

“আর বলবেন না ভাই। এই ছেলেকে নিয়ে আমি আর পারি না। গতকাল মাত্র বিয়ে হলো। আমি বললাম আজ এখানে আসার পরে কোথাও ঘুরতে বের হতে। সে বলল অফিসের কাজ সেরে আসবে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে বলল হুট করে নাকি কিসের মিটিং পড়ে গেছে। তাই আসতে পারবে না। কাজের ক্ষেত্রে হেলাফেলা করা এই ছেলে একদমই পছন্দ করে না। আপনারা কিছু মনে করবেন না ভাই।

মঈনুল হাসানের মুখ উজ্জ্বল হলো। তিনি বললেন,

“আরে না না আপা কী মনে করব। অরিত্র বাবা একজন দায়িত্বশীল মানুষ। ব্যাপারটা শুনে তো আমার আরও ভালো লাগছে। আর পূর্ণতাকে নিয়ে নাহয় অন্য একদিন সময় করে বের হবে।”

আনিকা ইসলাম পূর্ণতাকে বললেন,

“তুমি করো না আম্মু। অরিত্র বাসায় এলে আমি ওকে বকে দিব। নতুন নতুন বিয়ে হলো এখনই তো ঘোরাঘুরির সময়। আমি অরিত্রকে বলবো অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে।”

পূর্ণতা এবার লজ্জা পেল। অপ্রস্তুত মুখে একটু হাসার চেষ্টা করল। তার মাথায় এখন একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। অরিত্র তাহলে মিথ্যা বলেছে? কিন্তু কেন? পূর্ণতার দিকটা বিবেচনা করে নাকি সত্যিই মিটিং আছে? সবাই বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। শাড়ি পড়ে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে পূর্ণতার। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আনিকা ইসলাম তা লক্ষ্য করে বললেন,

“আম্মু তুমি তো ঘেমে গেছ। শাড়ি পড়ে কষ্ট হচ্ছে মনে হয়। খারাপ লাগলে শাড়ি পড়তে হবে না, থ্রি পিছ পড়ে এসো। এখানে তো আমরা ঘরের মানুষই। তোমার এত আঁটসাঁট হয়ে থাকতে হবে না। যাও তুমি জামা পালটে এসো।”

আনিকা ইসলামের কথায় স্বস্তি পেল পূর্ণতা। এতক্ষণ ধরে হাসফাস লাগছিল তার। আনিকা ইসলামের কথায় সায় দিয়ে সে রুমের দিকে পা বাড়াল। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল। আসলেই মানুষগুলো ভীষণ ভালো। রুমে এসে বসতেই ফোন বেজে উঠলো। অরিত্র ফোন করেছে। পূর্ণতা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো। ফোন রিসিভ করে কিছু বলল না। অরিত্র বলল,

” ম্যাডামের রাগ কমেছে?”

পূর্ণতা সেই কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” আপনি মিথ্যে বললেন কেন?”

“কোন ব্যাপারে মিথ্যা বললাম?”

” এখানে না আসার কারণ সম্পর্কে মিথ্যে বললেন কেন?”

অরিত্র স্মিত হেসে বলল,

“আমি ওতোটাও শ্রেষ্ঠ মানুষ না যে একটাও মিথ্যা কথা বলি না। ক্ষেত্রবিশেষে খুব বেশি প্রয়োজন হলে আমারও মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। আর এই ব্যাপারে মিথ্যা বলার দুটো কারণ আছে। প্রথমত, সত্যিটা জানলে আমার বাবা মায়ের তুমি ও তোমার বাবা মা ছোট হয়ে যেতে। দ্বিতীয়ত, আমরা এখন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ। এই সম্পর্কে কোনো সময় রাগ থাকবে কখনো ভালোবাসা কখনো অভিমান। এগুলো আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটাকেই আমি ভালো মনে করি।”

অরিত্রের কথা শুনে একটা শ্বাস ফেলল পূর্ণতা। কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কেউ তাকে ঝাপটে ধরতেই সে চমকে উঠলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে