হিমি পর্ব-৩০+৩১

0
787

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩০.

সুদীর্ঘ সময় ধরে হানিফ শরীফ আর অনাহিতা নাহারের ঝগড়া চলছে। ঝগড়ার মূল কারন এখনো উদঘাটন করা যায় নি। তবে ধরা যায় হানিফ শরীফ ভাইঝি মিশ্মির বিয়ে নিহানের সাথে দেয়ার ব্যাপারে কথা বলাতেই অনাহিতা ফুলে ফেঁপে একাকার। যদিও ঝগড়ার সুচনা থেকে এখন অব্দি ঝগড়া এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অনাহিতা তবে হানিফ শরীফ‌ও ছেড়ে দিচ্ছেন না। মাঝে মাঝে নরম স্বরে স্ত্রীকে থামানোর চেষ্টা করেছেন বৈ, লাভ হয় নি। ছাদ থেকে আনা কাপড় ভাজ করে আলমারিতে তুলতে তুলতেই ঝাঁঝ নিয়ে বললেন অনাহিতা,

‘ভাগ্নী ভাগ্নী করে সর্বস্বান্ত হতে চাও না কি?’

হানিফ শরীফের বোন এবং ভাগ্নী সংক্রান্ত কথাগুলো কখনোই হজম হয় না। এবার‌ও হলো না। কপট রাগ নিয়ে বললেন,

‘আবার আমার ভাগ্নীকে টানছো? কি এমন করেছি ওর জন্য যে আমায় সর্বস্বান্ত হতে হবে?’

‘কি করো নি সেটা বলো!’

‘কি করেছি সেটা তো তুমি বলবে।’

অনাহিতা জবাব দিলেন না। মনে মনে হিমির বাবার চৌদ্দগোষ্ঠীর সাথে সাথে মাকেও ধুয়ে দিলেন। হানিফ শরীফ পরিবেশ শান্ত করার তাগিদে আবার‌ও নরম গলায় কথা বলা শুরু করলেন।

‘অনু? আমরা যে কথা বলছিলাম তা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। আবার‌ও সেই কথায় ফিরে যাওয়া উচিত।’

অনাহিতা তেতে উঠে বললেন,

‘কোথায় ফিরে যাওয়া উচিত? একবার না বলেছি কথা শেষ মানে শেষ। ওই বাড়িতে মিশুর বিয়ে হবে না। কোথায় ওই বাড়ির সাথে সমস্ত সম্পর্ক চ্যুত করবে তা না করে আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছো!’

‘সম্পর্ক কেনো চ্যুত করবো বলতে পারো? যার কারনে ওদের সাথে দ্বন্দ ছিলো সেই তো নেই। আমার বোনটা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছে। তার মেয়ের জন্য হলেও আমাদের ওদের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। এখন যখন আরো একটা সুযোগ পাচ্ছি তখন,,,,,,,’

আলমারির পাল্লাটা ধরাম করে লাগিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালেন অনাহিতা। ফুঁসে উঠে বললেন,

‘কোনো সুযোগের দরকার নেই। তোমার বোন মরে গিয়ে তার উচ্ছৃঙ্খল বাজে মেয়েটা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে গেছে। তাকে সামলাতেই হিমশিম খেতে হয় আবার তার গোষ্ঠীর সাথে নতুন সম্পর্ক! মেজাজ খারাপ হয়ে যায় একদম।’

‘অনু! যাচ্ছেতাই কথা বলবে না বলে দিচ্ছি। হিমিকে সামলাতে কেনো হিমশিম খেতে হবে? আর খাচ্ছেই বা কে? আমি তো কাউকে হিমিকে নিয়ে চিন্তা করতে দেখি নি! হ্যা, দেখেছি তোমায়। সারাক্ষন চিন্তায় থাকো হিমিকে কি করে এ বাড়ি থেকে বিদায় করা যায়!’

‘তা তো করবোই। আমার বাড়ি। আমার ছেলে মেয়ে আমার সংসার এখানে অন্য একজনের ঠাঁই কেনো হবে? তাও তো এতো বছর ধরে কিছু বলি নি। এখন বলবো। ওই আপদ কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বিদায় করবো দেখে নিও।’

‘সারাক্ষন খালি আমার বোন আর ভাগ্নীর পেছনে পরে আছে। ওরা তোমার কি ক্ষতি করেছে অনু?’

‘অনেক ক্ষতি করেছে। যেখানে তোমার বাবা মেয়েকে মেনে নেন নি তাড়িয়ে দিয়েছেন সেখানে তুমি কেনো ওর মেয়েকে ঘরে এনে তুলবে? পায়ের উপর পা তুলে দিব্যি তো খাচ্ছে আমার টাকায়!’

হানিফ শরীফের ধৈর্যের বাধ ভাঙছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

‘আমার ভাগ্নী আমার টাকায় খাচ্ছে। তোমার টাকায় না। হিমির জন্য দরকার পরলে আমি আমার সব দিয়ে দেবো। বুঝেছো তুমি?’

অনাহিতা তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,

‘সেই কথাই বলছি। তুমি পারলে আজ‌ই সব নিলামে উঠাও। কৈ, তোমার ছোটভাই তো এমন নয়। সে তার কাজ কর্ম, ব‌উ বাচ্চা নিয়েই আছে। হিমির জন্য তার দরদ তো উতলে উঠে না! তুমি এতো উতলা কেনো?’

‘হাশিম বুড়ো হয়ে গেলেও বয়স আর চিন্তা চেতনায় আমার চেয়ে ছোট থাকবে। বরাবর‌ই বাবার কথায় উঠবস করেছে। ওনার মৃত্যুর পর যে বদলে যাবে এমনটা নয়। তার উপর সাদাসিধে। ব‌উ ভাবি যা বলবে তা যে তার জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যি সেটা মানতেও দ্বিধা নেই। আমি হরফ করে বলতে পারি, হাশিম হিমিকে মেয়ের মতো স্নেহ করে শুধু প্রকাশ করতে পারে না। তা বলে আমিও যে প্রকাশ করবো না তা তো হয় না অনু।’

কথাগুলো বেশ শান্ত শীতল শুনালো। অনাহিতা ঘন ঘন শ্বাস ফেলছেন। অপমানিত বোধ করছেন তিনি। হানিফ শরীফ জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললেন,

‘এক কাজ করা যাক। মিশুর ব্যাপারটা ওর বাবা মায়ের উপর ছেড়ে দেই আমরা। যা সিদ্ধান্ত নেয়ার ওরাই নিক। আমরা নিরব দর্শক হয়ে দেখবো। হবে?’

অনাহিতা নিজেকে সংযত করে বললেন,

‘এই কথাটাই তো বলেছিলাম সকালে। শুনলে এতক্ষন চেঁচামেচি হতো না।’

হানিফ শরীফ ঠান্ডা গলায় বললেন,

‘তুমি তো বলেছিলে তুমি নিজ দায়িত্বে ছোট ব‌উয়ের সাথে কথা বলে তাকে আবোল তাবোল বুঝিয়ে মেয়েকে ধরে বেধে অন্যথায় বিয়ে দেবে। আর আমি বললাম সম্পূর্ণ দায়ভার তাদের। দুটো তো এক হলো না অনু।’

অনাহিতা বিস্মিত গলায় বললেন,

‘এসব কথা আমি আবার কখন বললাম?’

‘বলেছো। মনে মনে। মুখে আমার বলা কথাটাই বলেছো তবে মনে মনে ওইসব বলেছো। আমি জানি। তোমাকে আঠাশ বছর ধরে চিনি। তোমার মনে কি চলছে তা বুঝতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। আমি এমনি বুঝে যাই।’

অনাহিতাকে বিস্মিত, রাগান্বিত রেখেই ঘরের বাইরে পা রাখলেন হানিফ শরীফ। রোশন আরা রান্নাঘর থেকেই তাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনছিলেন। তবে সবটা বুঝতে পারেন নি। হানিফ শরীফ রান্নাঘরের পাশ কেটে বাইরের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে বলে উঠেন,

‘অনু যেনো মিশুর ব্যাপারে নাক না গলায়।’

রোশন আরা কৌতুহলী দৃষ্টিতে ভাসুরের চলে যাওয়া দেখলেন। কিছু বললেন না। একদিকে রাতের পর রাত মেয়ে ঘুমের ঔষধ খাচ্ছে অন্যদিকে অথৈ তার স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছে। রোশন আরা কান্নায় ভেঙে পরতে গিয়েও সামলে নেন নিজেকে। সবার সত্যিটা জানার আগেই যা করার করতে হবে।

_____________________

মৃদু বাতাস ব‌ইছে চারদিকে। রাতের আধার ঘন হচ্ছে। আকাশে চাঁদ নেই। লক্ষাধিক তারা আছে। মিটিমিটি করে জ্বলছে সেসব। ব্যস্ত রাস্তায় এখনো যান চলাচল রয়েছে। তবে দিনের পরিমাণ নগন‌্য। পরিবেশ মোটেও নিরিবিলি নয়। তবুও নিরবতায় ছেয়ে ছিলো যেনো। হিমি নিরবতা ভেঙে বললো,

‘বললেন না তো আমার বাবাকে কি করে চিনেন?’

তাহির সফট ড্রিঙ্কের ক্যানে চুমুক বসিয়ে বললো,

‘আমার বাবার কলিগ ছিলেন।’

হিমি সরু চোখে তাকিয়ে বললো,

‘আপনি কি করে বুঝলেন আপনি যার কথা বলছেন তিনি আমার বাবা? আই মিন, আপনার বাবার কলিগ যে আমার বাবা সেটা কখন কি ভাবে জানলেন? ‌আমার সাথে কখনো বাবাকে দেখেছেন?’

তাহির মাথা নাড়লো। বললো,

‘না। আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করতে গিয়ে আপনার বাড়িটা দেখে চিনেছি।’

‘কি চিনেছেন?’

‘বাড়িটা চিনেছি।’

‘বুঝলাম না!’

‘বুঝার কথাও না। আসলে, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন বাবার সাথে মাঝে মাঝেই মুহিব আঙ্কেলের বাড়ি যেতাম। সেই বাড়ি, মুহিব আঙ্কেল আর কিছু কিছু স্মৃতি এখনো মনে আছে। তাই সেদিন ওই বাড়িটা দেখেই মনে হচ্ছিলো আমি সেখানে আগে কখনো গিয়েছি। অনেক ভাবনার পর তবে মনে পরলো। তোমার বলা গল্পটাও মেলাচ্ছিলাম। তা থেকেই বুঝলাম তুমি মুহিব আঙ্কেলের মেয়ে।’

হিমি অবাক হয়ে শুনলো। বললো,

‘বাবার সাথে আপনার যোগাযোগ আছে এখনো?’

‘উহু, বাবার সাথে সম্পর্ক শেষ হতেই ওনার সাথে জড়িত সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছিলো। আমি তো মুহিব আঙ্কেলকে ভুলেই গেছিলাম। নয়তো সেই কবেই যোগাযোগ করতাম।’

‘কেনো?’

হিমির প্রশ্নের উত্তরে তাহির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,

‘আমার একটা কাজ করে দেবেন হিমি?’

হিমি ভ্রু কুঁচকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাহিরের দিকে তাকালো। তাহির খালি ক্যানটা দূরে কোথায় ছুড়ে ফেলে বললো,

‘আমার বাবার সাথে কেনো আমরা থাকছি না সেসব অন্য একদিন আপনাকে বলবো। এখন এ বিষয়ে জানতে চাইবেন না প্লিজ। শুধু এটুকু জেনে রাখুন বাবা নিজ ইচ্ছায় আমাদের থেকে দূরে গেছেন। আপাতত বাবার সাথে যোগাযোগ করা আমার জন্য ভীষন জ্বরুরী হয়ে পরছে। ওনাকে খুঁজে পাওয়াটা খুব প্রয়োজন।’

হিমি বিস্মিত গলায় বললো,

‘আপনি কি আমায় আপনার বাবাকে খুঁজতে বলছেন?’

তাহিরের স্পষ্ট জবাব,

‘হ্যা।’

‘কিন্তু আমি কি করে খুঁজবো?’

‘আঙ্কেলের থেকে আমার বাবার ঠিকানা যোগার করে।’

হিমি মৃদু গলায় বললো,

‘বাবার কাছে আঙ্কেলের ঠিকানা থাকবে?’

‘যেহেতু ওনারা কলিগ ছিলেন। একসাথেই কাজ করতেন। তাই মনে হলো।’

‘করতেন এখন তো করছেন না।’

‘হয়তো এখনো করেন!’

হিমি মাথা নাড়লো। শুকনো হেসে বললো,

‘দাদু যখন বাবাকে ত্যাজ্য পুত্র হিসেবে ঘোষনা করেন তখন থেকেই বিজন্যাসের হাল বেহাল হয়ে গেছিলো। কয়েক মাসের মাথাতেই বড় লস হয়ে যায়। ব্যবসায় ধ্বস নামতে পেরে ভেবে আগে ভাগেই দাদু তা নিলাম করে দিয়েছিলেন। চাচামনি তখন‌ও ব্যবসায় ঢুকেন নি আর জেঠু মনি এসবে অভ্যস্ত ছিলেন না। ফলস্বরুপ আবার‌ও ব্যবসা দাঁড় করানো যায় নি। বাবা তখন ছোটখাট এক ইলেক্ট্রনিক্সের কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মা চলে যাওয়ার পর বিদেশে জীবন চালানোর তাগিদে কাপড়ের শো রুমে জব করতেন। দেশে ফেরার দু বছরের মধ্যেই মাইনর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো। তারপর থেকেই আর কাজ করেন নি। মাঝখানে আবার‌ও কোনো চাকরির আশায় ইন্টার্ভিউ দিতে চাইছিলেন। দাদু মানেন নি। ডক্টররাও বলেছিলেন হার্টে প্রেশার না দিতে। ব্যস! বিগত তেরো চৌদ্দ বছর ধরে বাড়িতেই আছেন তিনি। আপনার বাবার সাথে যোগাযোগ থাকতে পারে বলে মনে হয় না। এতগুলো বছরে বাবাকে কখনোই তার বন্ধুদের সম্বোন্ধে কথা বলতে শুনি নি।’

তাহির মুখ কালো করে দাঁড়ালো। কপালে অজান্তেই ভাজ পরলো। মুহিব রহমানের ব্যক্তিগত অবস্থা শুনে আশাহত হলো সে। খানিক পরই বলে উঠলো,

‘আঙ্কেলের পুরনো প্রয়োজনীয় ফাইল ডকুমেন্টস ঘেটেও কি পাওয়া যাবে না? এমনটাও তো হতে পারে আঙ্কেলের সাথে বাবার যোগাযোগ আছে। আপনারা হয়তো জানেন না।’

হিমি কিছু একটা ভাবলো। ক্যানে নখ বাজাতে বাজাতে বললো,

‘এভাবে আন্দাজে তীর ছুড়ে লাভ নেই। আমি বরং বাবার থেকেই জানবো।’

‘আপনি সোজা সাপ্টা জিজ্ঞেস করতে পারবেন?’

‘চেষ্টা করে দেখিই না কি হয়!’

তাহির প্রশান্ত হৃদয়ে হাসলো। হিমি বললো,

‘আঙ্কেলের নামটা কি? মানে বাবাকে কি জিজ্ঞেস করবো সেটা তো জানতে হবে!’

তাহির শীতল গলায় বললো,

‘তৌসিফ মাহমুদ।’

চলবে,,,,,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩১.

ঘর পরিষ্কারের বাহানায় মুহিব রহমানের ঘরে ঢোকেন আমিনা বেগম। হাতের পাতলা কাপড় দিয়ে আসবাব ঝাড়তে ঝাড়তে বলেন,

-তৌসিফ ভাইকে তোমার মনে আছে মুহিব ভাই?

মুহিব রহমান বারান্দার চেয়ারে ব‌ই হাতে বসেছিলেন। আমিনা বেগমের কথায় চোখ তোলে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকালেন। জিজ্ঞাসু গলায় বললেন,

-তৌসিফ?

আমিনা বেগম জোর গলায় বললেন,

-হ্যা তৌসিফ ভাই। তোমার সাথে কাজ করতেন। আগে তো ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেও আসতেন। কতো বছর কেটে গেছে। ওনার কোনো খবর পেলাম না। তোমার সাথে যোগাযোগ আছে না কি?

মুহিব রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-না ভাবি। সেই কবেকার কথা বলছো, এসব ঠিক ঠাক মনেও নেই আমার। শেষ কখন তার সাথে দেখা হয়েছে মনে করতে পারছি না। বিয়ের পর থেকেই আর দেখা সাক্ষাত হয় নি আমাদের। হঠাৎ তোমার ওর কথা মনে পরলো কেনো?

আমিনা বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। জোরপূর্বক হেসে বললেন,

-স্টোর রুম পরিষ্কার করছিলাম তো পুরনো এলবাম পেলাম। সেখানে ওনার একটা ছবি আছে। প্রথমে চিনি নি পরে মনে পরলো। তাই ভাবলাম জিজ্ঞেস করি। হয়তো তোমাদের বন্ধুত্ব কেনো এখনো আছে!

-তৌসিফের সাথে বন্ধুত্ব কোনো কালেই ছিলো না। একে অপরের কাজে সাহায্য করা, সাথে থাকা, প্রজেক্ট সামলানো। এই যা। যদিও আমি তাকে ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। এখন যে কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানি না।

আমিনা বেগম উসখুস করে বললেন,

-ওনার আগের ফোন নাম্বার, ঠিকানা কিছুই নেই?

-উহু। কাজের সম্পর্ক ছিলো তাই কখনো সেরকম দরকার পরে নি, রাখিও নি। ও‌ই তো মাঝে মাঝে আসতো এ বাড়ি। আর তাছাড়া তৌসিফ কখনোই মোবাইল ইউজ করে নি।

আমিনা বেগম মুখ ছোট করে বললেন,

-ওহ।

বড় ভাবি কিছু বলতে পারেন ভেবে মুহিব রহমান অপেক্ষা করলেন। আমিনা বেগম কোনো কথা বললেন না। টুকটাক কাজ করে বেরিয়ে গেলেন। মুহিব রহমান ব‌ই মেলে ধরলেন মুখের সামনে। চশমা পরা চোখে তীক্ষ্ণ নজরে একের পর এক লাইন পড়তে লাগলেন। কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না যদিও তবুও তার চেহারায় অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিলো। আমিনা ঘর থেকে বেরিয়েই মুখোমুখি হলেন হিমির। সে এতক্ষন দরজার বাইরে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে ছিলো। ভেতরের কথোপকথন কিছুটা শুনেছে সে। তবুও সন্দেহ দূর করতে ভ্রু নাচালো। আমিনা বেগম মাথা নাড়লেন। হতাশ গলায় বললেন,

-তৌসিফ ভাইয়ের সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছে সেটাও তোর বাবার মনে নেই। ফোন নাম্বার ঠিকানা এসব‌ আগেও ছিলো না এখনো নেই। আমি আগেই বলেছিলাম, জিজ্ঞেস করে লাভ নেই।

হিমি ঠোঁট উল্টালো। শ্বশুরের ডাক কানে যেতেই আমিনা বেগম ছুট লাগালেন। হিমি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে শোবার ঘরের দিকে গেলো। মোবাইল বের করে সময় দেখলো। এই সময় তাহির ফ্রি থাকবে? থাকতে পারে। আবার ব্যস্ত‌ও থাকতে পারে। তবে হিমির কল দেখলে নিশ্চয় রিসিভ করবে। হিমি তাহিরের নাম্বারে ডায়াল করলো। কয়েক সেকেন্ড রিং হ‌ওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো।

ফোন কানে ঠেকিয়ে ঘন নিঃশ্বাস টানলো তাহির। বললো,

-কিছু জানতে পারলেন?

-বাবার কাছে ওনার কোনো তথ্য নেই ডাক্তার।

তাহির মৃদু শ্বাস টেনে বললো,

-আচ্ছা।

হিমি ভেবেছিলো তার কথার পরিবর্তে তাহির হতাশ হবে। বেশি কিছু না হলেও শুকনো গলায় কথা বলবে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হবে। কিন্তু তাহির স্বাভাবিক। যেনো এমনটাই হ‌ওয়ার ছিলো।

হিমিকে চুপ করে থাকতে দেখে তাহির সন্দিহান গলায় বললো,

-কলে আছেন?

হিমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। বললো,

-হ্যা। বলুন।

-কিছু না। রাখছি।

-আঙ্কেলকে খুঁজায় আমি কি আর কোনো সাহায্য করতে পারি?

তাহির শুকনো হেসে বললো,

-উনিশ বছর ধরে খুঁজছি। পাই নি। আদৌ কখনো পাবো কি না সন্দেহ। খুঁজার আর কোনো রাস্তা আছে কি না সেটাও অনিশ্চিত। কি করে বলি সাহায্য করতে পারবেন কি না!

-আজ না বললেও হবে। পরে যখন দরকার পরবে তখন বলবেন। বলবেন?

তাহির হাসলো। ছোট্ট করে বললো,

-হুম বলবো।

হিমি বিভ্রান্তি নিয়ে বললো,

-আমাদের আর কবে দেখা হবে?

-যখন আপনার থেকে কিছু জানার থাকবে আর আমার আপনাকে কিছু জানানোর থাকবে তখন।

হিমি বিস্ময়মাখা গলায় বললো,

-আমার থেকে কি জানার আছে আপনার?

-অনেক কিছু। এখন বলা যাবে না। সময় সময় কল করে ডেকে নেবো। তারপর কোনো এক নিরিবিলি জায়গায় বসে চা খেতে খেতে বলবো।

কথাটা বলে এক মুহুর্ত দেরি করলো না তাহির। ফট করে কল কেটে প্যাশেন্ট দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। হিমি বিস্ময় নিয়েই খাটে বসলো। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে খাটে আধশোয়া হতেই চেঁচামেচির আওয়াজ কানে এলো। হিমি তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো। এবাড়িতে চেঁচামেচি হয় না খুব একটা। সবাই শান্ত স্বভাবের। আজ হঠাৎ কি হলো বুঝলো না হিমি। দৌড়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। চেঁচামেচির আওয়াজ অনুসরণ করে আবিষ্কার করলো মতিউর রহমানের ঘরে পরিবারের সবাই রয়েছেন। খটকা লাগছে। দাদু কি রেগে আছে কারো উপর? কার উপর? বাবা? না কি বড় মা? নিহানের উপর‌ও রেগে থাকতে পারে। গতকাল নিহান মুখের উপর কথা বলেছিলো ওনার। এখন নিশ্চয় সে বিষয় নিয়েই চেঁচানো চলছে।

কথাগুলো আপন মনে ভেবেই মতিউর রহমানের ঘরে ঢোকলো হিমি। এই ঘরটা অন্যসব ঘর থেকে আলাদা। বেশ বড়। ঘরে অতিরিক্ত কোনো আসবাব নেই। সব‌ই নিত্য প্রয়োজনীয়। খাট, আলনা, একটা ছোট্ট কেবিনেট মতো। দু একটা ফ্লাওয়ার ভাস। তাতে ফুল নেই। এমনি সাজিয়ে রাখা। একটা সকেস আছে। প্রায় খালি। উপরের তাকে তসবি, আতর, মাথার টুপি, আর আগরবাতি রাখা। দুই নম্বর তাকে কয়েকটা পুরাতন ডিজাইনের গ্লাস, কাপ পিরিচ আর প্লেইট। তার নিচের তাকটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। সকেসের উপরে হলদে রঙের কাপড় বিছানো। তার উপর একটা টর্চ লাইট, চার্জার, জায়নামাজ, চাদর রাখা। জানালা দরজার পর্দাগুলো সাদা রঙের। ঘরের দেয়ালেও সাদা রঙ। বিছানার চাদর হালকা, অনুজ্জ্বল রঙের। ঘরময় আগরবাতির সুবাস। স্নিগ্ধতা। এই স্নিগ্ধতাকে ম্লান করে দিচ্ছে এতো জনের গিজগিজ আর মতিউর রহমানের উত্তেজিত গলায় বলা কথা।

সকাল থেকেই সুস্থ বোধ করছিলেন না তিনি। থেকে থেকে কাঁপুনি উঠছিলো শরীর জুরে। মাথা ঝিমঝিম করছিলো। এখন শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। তীব্র শ্বাস কষ্ট। সেই সাথে হাড় কাঁপুনি শীত অনুভব হচ্ছে ওনার। কাঁথা কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রাখার পর‌ও উনার কাঁপুনি থামছে না। শ্বাস টানতে টানতে তবুও কথা বলছেন তিনি। ওনার মনে হচ্ছে উনি মরে যাবেন। বয়স অনেক হয়ে গেছে। এত বয়স অব্দি ওনার পরিচিত কেউ বেঁচে ছিলো না। ওনা‌র‌ও বাঁচার কথা নয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই হয়তো চিরতরে চোখ বোজবেন। নিঃশ্বাস আটকে যাবে। তাই এই শেষ সময়ে শেষ বারের মতো যা যা মনে এবং মুখে আসছে তাই বলে চলেছেন তিনি। জায়গা জমি তেমন নেই বলে বাড়িটাই তিন ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছেন অর্ধ চেতন অবস্থায়। মুহিব রহমান আর নেহাল রহমান সমানে বাবাকে বুঝাচ্ছেন। ওনাকে বেঁচে থাকার আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু এতে মতিউর রহমান থামলেন না। বরং তাদেরকে উপেক্ষা করে চোখের পানি ঝরিয়ে মৃত স্ত্রীর সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমিনা বেগমের কান্না থামছে না। রাদিবার চোখে মুখে অসহায়ত্ব, ভয়। নিহান মতিউর রহমানের পায়ের কাছটায় বসে আছে নিশ্চুপ। হিমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছে। দাদুর সামনে যাওয়া উচিত কি না বুঝছে না। এর মধ্যেই মতিউর রহমান হিমির নাম ধরে ডাকলেন। হিমি চমকালো। আমিনা বেগম উচ্চস্বরে বললেন,

-হিমি? এদিকে আয়। বাবা ডাকছেন তোকে।

হিমি গুটি গুটি পায়ে এগুলো। মতিউর রহমান কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

-এই যে মেয়ে। এ জীবনে তোমাকে ভালো হতে দেখলাম না। সারাজীবন তো আমাকে বদ মেজাজি ভেবে গেলে। এবার চলে যাচ্ছি শান্তিতে থাকো। আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে একটু ভালো হ‌ও। মেয়েদের মতো থাকো। বিয়ে তো দিতে হবে, না? কে জানে কার হাতে পরবে আর কি হাল হবে! আমায় বুঝলে না, এখন টের পাবে। আমি মরে গেলে একটু দোয়া করিস আমার জন্য। বুঝলি? তোর দাদীজিকে দেখতে পাচ্ছি আমি। বেশি সময় নেই। কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। পরে চোখ বন্ধ হয়ে গেলে আর বলার সুযোগ পাবি না।

শেষের কথাটা বলে নিজেই কেঁদে উঠলেন মতিউর রহমান। হিমির বুক হু হু করে উঠলো। সত্যিই কি দাদু চলে যাবে?

চলবে,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে