হিমি পর্ব-২০+২১

0
771

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

২০.

রিসেপশনের পরদিন‌ই স্বামীর সাথে বাপের বাড়িতে আসার কথা ছিলো অথৈর। তবে তারা একদিন পর এসেছে। দুটো দিন থেকে তবেই শ্বশুরবাড়ি ফিরবে বলে জানিয়ে দিয়েছে অথৈ। ইয়াসির‌ও ব‌উয়ের ইচ্ছের গুরুত্ব দিয়ে থেকে গেছে সাথে। এসব নিয়ে কারো কোনো সমস্যা নেই মিশ্মি ছাড়া। এক তরফা ভালোবেসে ভীষন ভাবে ফেঁসে গেছে সে। না পারছে পালিয়ে থাকতে আর না পারছে সামনে থাকতে। তবুও নিজের দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না মিশ্মি। দিনের সিংহভাগ সময় ঘরে দোর দিয়ে বসে থাকছে। তিন বেলা খাবারের সময় সবার সাথে এক টেবিলে বসলেও তার দৃষ্টি সর্বদা খাবারের প্লেইটেই থাকছে। অত্যধিক ব্যস্ততা দেখিয়ে অথৈর থেকে তার শ্বশুরবাড়ির আলাপ আলোচনা শুনছে না মিশ্মি। কখনো অনিচ্ছাকৃত ভাবে ইয়াসিরের মুখোমুখি হলেও মৃদু হেসে পাশ কাটাচ্ছে। মূল কথা, এই পৃথিবীতে ইয়াসির নামের কেউ নেই সেটাই বিশ্বাস করছে মিশ্মি। কিন্তু এসব কিছুই চোখ এড়ায় নি রোশন আরার। মেয়ের হুট করে আমূল পরিবর্তন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তাছাড়াও মিশ্মির চোখের নিচে বিস্তর জায়গা জুরে ডার্ক সার্কেল হয়েছে। মিশ্মির ব্যবহার, কথা বার্তা, একা থাকা সবকিছুতেই খটকা লাগে রোশন আরার। বাধ্য হয়েই হিমিকে ফোন লাগান তিনি। রিং হতে না হতেই ফোন উঠিয়ে কানে ঠেকায় সে। হিমির এই অভ্যাসটা ভীষন ভালো লাগে রোশন আরার। যে কেউ ফোন দিক না কেনো, রিং বাজার সাথে সাথেই রিসিভ করে নেয়।

‘কোথায় তুই?’

হিমিকে কিছু বলতে না দিয়েই আবার বললেন,

‘যেখানেই থাকিস না কেনো বাড়ি আয় এক্ষুনি। সোজা আমার ঘরে আসবি।’

‘আসছি।’

কথাটা বলেই ফোন কাটে হিমি। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি ভেঙে ছোট মামীর ঘরের দরজার টোকা দেয়। রোশন আরা ঘাড় বাঁকিয়ে হিমিকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বসা থেকে চটপট দাঁড়িয়ে যান। ভেতরে আসতে ইশারা করে বলেন,

‘এইটুকু সময়ের মধ্যে চলে এলি কি করে?’

হিমি শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে,

‘ঘরেই ছিলাম তো।’

‘আজ থাকবি?’

‘চলে যাবো?’

হিমির স্পষ্ট কথায় বিরক্তি প্রকাশ করেন রোশন আরা। নিজেকে শান্ত করে হিমিকে টেনে খাটে বসিয়ে বলেন,

‘আমি তোকে যা যা প্রশ্ন করবো ঠিক ঠিক উত্তর দিবি। একটাও মিথ্যে কথা বলবি না বা কথা ঘুরাবি না। বুঝলি?’

হিমি ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো। রোশন আরা সেসবে পাত্তা না দিয়ে বললেন,

‘মিশু তোকে কিছু বলেছে?’

হিমির কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া আরো খানিক কুঁচকে যায়। রোশন আরা উত্তরের অপেক্ষায় হিমির দিকে তাকিয়ে আছেন। হিমি চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। মনে করার চেষ্টা করলো মিশ্মি তাকে কিছু বলেছে কি না। অনেক চেষ্টার পর‌ও যখন কিছু মনে পরলো না তখন ঠোঁট উল্টে বললো,

‘কোন কথার কথা বলছো? কি বলবে ও? আমার তো কিছুই মনে পরছে না। হয়তো বলে নি।’

রোশন আরা জোর গলায় বললেন,

‘বলেছে। তোকে বলেছে আমি শিওর!’

হিমি ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে কাধে ফেলে দিয়ে বললো,

‘কি বলেছে সেটা তো বলবে!’

‘সেটা তো তুই বলবি। ও তোকে কি বলেছে না বলেছে সেসব আমি জানবো কি করে? এখন কথা না ঘুরিয়ে বল। কি বলেছে মিশু?কি হয়েছে ওর?’

হিমি গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘মিশু আমায় বলেছে যে, ওর একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছে। দুটোই খুব কিউট হয়েছে।’

রোশন আরা থম মেরে গেলেন। পরোক্ষনেই টের পেলেন হিমি দুষ্টুমি করে বলেছে। রোশন আরা চোখ বোজে শ্বাস টেনে নিয়ে বললেন,

‘একদম মজা ফজা করবি না হিমি।’

‘আমি কোথায় মজা করলাম? মজা তো তুমি করছো! ‌কি বিষয়ে জানতে চাইছো সোজা সাপ্টা বললেই হয়। এতো প্যাঁচাচ্ছো কেনো?’

‘মিশ্মি কাউকে ভালোবাসে?’

রোশন আরার গম্ভীর গলায় করা প্রশ্ন শুনে তটস্থ হলো হিমি। দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,

‘এসব আমি কি করে জানবো মামী? ওকেই জিজ্ঞেস করে নাও। আমি আসি। ঘুম পাচ্ছে।’

হিমি খাট থেকে উঠতে নিলেই শক্ত হাতে তাকে পাকড়াও করলেন রোশন আরা। আকুতি মেশানো গলায় বললেন,

‘আমি জানি তুই সব জানিস। বলে দে না সত্যিটা।’

হিমি প্রত্যুত্তর করলো না। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলো। রোশন আরা বললেন,

‘আমি মিশুর ওই বান্ধবীকে ফোন করেছিলাম। তন্নীকে। ওই মেয়েটাও কিচ্ছু জানে না জানিস! ‌ওই তো বললো মিশু অথৈ আর তোর সাথে সব শেয়ার করে। অথৈকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত হবে না। তাই তো তোকে করছি। হিমি! মিশু কাউকে ভালোবাসে না রে?’

হিমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে ডানে বায়ে মাথা নাড়লো। সব সময় ওই কেনো ফাঁসে এসবে? অদ্ভুত! রোশন আরা তাকে ছাড়ছেন না দেখে হিমি নিজেই শান্ত গলায় বললো,

‘মিশু কাউকে ভালোবাসে কি না সেটা ও‌ই ভালো বলতে পারবে। আমি কি করে জানবো?’

‘আমি তো জানি মিশু কাউকে ভালোবাসে!’

হিমি ফিচেল গলায় বললো,

‘তাহলে তো মিটেই গেলো! (ভ্রু উচিয়ে) কিন্তু তুমি জেনে শোনে কেনো আমায় প্রশ্ন করছো?’

রোশন আরা কাঠ কাঠ গলায় বললেন,

‘আমি মা হিমি। আমি বুঝতে পারি আমার মেয়ের মনের অবস্থা। এ কদিন ওকে দেখে যা বুঝেছি তাতে প্রমান হয় আমার মেয়েটা খুব কষ্টে আছে। ওর চোখের নিচে কালি পরেছে। রাতে ঘুমায় না হয়তো। সারাদিনে টেনে টুনে দু একবার ঘরের বাইরে আসে। আবার‌ও দোর দেয়। অথৈর সাথে সেই ছোট্টবেলা থেকে কতো মিলমিশ! ‌অথচ অথৈ দুদিন ধরে এবাড়িতে মিশুতো কথাই বলে নি আগ বাড়িয়ে। দুলাভাইদের সাথে শালীদের সম্পর্কের এক কোনাও মিশ্মির মধ্যে নেই। জামাই নিজে বললো মিশু ওর ক্লাসের‌ই স্টুডেন্ট। এদিকে মিশু ছেলেটার সামনে বের হয় না। আমার কি মনে হয় জানিস?’

হিমি ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোশন আরা চাপা স্বরে বললেন,

‘মিশু বোধ হয় জামাই কে ভালোবাসে।’

হিমির বুকের হৃদস্পন্দন তুমুল ধ্বনিতে ঢাক ঢোল পেটাচ্ছে। এবার কি বলবে সে? মামী কি করতে চাইছে? কিছু বুঝে উঠার আগেই মেঝেতে বসে পরেন রোশন আরা। মাথায় হাত চেপে চাপা আর্তনাদ করে কেঁদে বলে উঠেন,

‘এখন কি হবে? মিশু কি এখন উল্টা পাল্টা কিছু করবে? আমার মিশুর জন্য ওদের সম্পর্ক ভেঙে যাবে! ‌এই, এই হিমি? অথৈ জেনে গেছে সব? হে,,,, জামাই জানে না! এবার কি হবে? আমার মেয়েটা এতো নিচে নামলো কি করে?’

হিমি তাকে আশ্বস্ত করে বললো,

‘মামী শান্ত হ‌ও! এসব কিছু না। অথৈ আর ওর বর এসব কিছুই জানে না।’

রোশন আরার বুক থেকে পাথর নামে। দু হাতে চোখ মোছে বলেন,

‘মিশুর বিয়ে দিতে হবে। এই মেয়েকে আর এখানে রাখা যাবে না। কখন কি করে বসে!’

হিমি তব্দা খেয়ে যায় মামীর কথায়। রোশন আরা উঠে দাঁড়ান। শাড়ি, চুল ঠিক করে বাইরে যেতে নিলেই পথ আটকে দাঁড়ায় হিমি। আমতা আমতা করে বলে,

‘মামী তুমি মিশুকে কিছু বলো না প্লীজ! ‌ও নিজেকে সামলে নিয়েছে। ভবিষ্যতে‌ও সামলাবে। এখনি এমন কিছু করো না যার জন্য পরে পস্তাতে হয়!’

রোশন আরা মাথা নেড়ে বলেন,

‘না না। ওকে কিছু বলবো না। তুইও কাউকে কিছু বলিস না। আমি দেখলাম তো কতোটা সামলেছে নিজেকে। এখন সব ওর ওপর ছেড়ে রাখলে চলবে না। আমি ওর মা। আমায় ভাবতে হবে। নিজেকে একা ঘরে বন্দি করে রাখা মানেই সব ভুলে যাওয়া নয়। ওকে বেরুতে হবে। নতুন জীবন শুরু করতে হবে। আর তার জন্য বিয়ে হ‌ওয়াটা খুব জরুরি। আমি কাল সকালেই তোর ছোট মামার সাথে কথা বলছি। মেয়ে বড় হয়েছে। এখনো এতো বেখেয়ালি হয়ে চললে হবে না। কাজ আছে হিমি। আমি যাই। তুই‌ও যা ঘুমা গিয়ে। রাত‌ও হয়েছে বেশ। যা যা!’

হিমিকে হতভম্ব করে রেখেই বাইরে বেরুলেন রোশন আরা। হিমি মাথা চাপড়ে নিজের শোবার ঘরে গিয়ে ঢোকলো। কি হলো ব্যাপারটা কিছুই বুঝলো না। মামীর তো উচিত ছিলো মেয়ের কথা ভেবে কষ্ট পাওয়া। মেয়েকে সামলানো। তা না করে, মেয়েকে তাড়ানোর কথা ভাবছেন? মেয়ে যাতে অন্যের সংসার না নষ্ট করে তাই তাকে বিয়ে দিতে উঠে পরে লেগেছেন অথচ মেয়ের ব্যাপারটা ভেবে দেখছেন না কেনো? মিশ্মির দিকে তাকানো কি উচিত নয়?

________________

ব্ল্যাক কফিতে চুমুক বসিয়ে ল্যাপটপে চোখ বুলালো তাহির। ভোরের স্নিগ্ধ আলো সাদা পাঞ্জাবীতে পরে তাকে আরো স্বচ্ছ দেখাচ্ছে। গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সোনালি রঙের দেখাচ্ছে। কপালে ভাজ ফেলে আরো দু ঢোক কফি খেয়ে খালি কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো সে। কি বোর্ডের কয়েকটা বাটন চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্ক্রিনে তাকাতেই মুঠোফোন বেজে উঠলো তার। বেতের চেয়ারের পাশের টুলটাতেই রাখা ছিলো তাহিরের ফোন। হাত বাড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ভাসা নম্বরটির দিকে তাকালো সে। অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। উঠাবে না উঠাবে না করেও শেষমেষ তুলে নিলো। মৃদু গলায় হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে চেনা মিষ্টি গলার স্বর কানে এলো।

‘আপনি কখন আসবেন?’

তাহির কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বারটা দেখে নিলো আবার‌ও। ফোন কানে ঠেকিয়ে বললো,

‘কোথায়?’

‘চেম্বারে।’

‘দশটায়। কিন্তু আপনি কে?’

ওপাশ থেকে হতাশ গলায় ভেসে এলো,

‘হিমি।’

তাহির চমকালো। চমকে উঠা গলাতেই প্রশ্ন করলো,

‘আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’

হিমি দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

‘হাসপাতালের রিসেপশন থেকে নিয়েছি। কেনো? নেয়া যাবে না?’

‘আপনি হাসপাতালে?’

‘হ্যা। আপনার সাথে দেখা করতে এলাম।’

তাহির ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। কৌতুহলী গলায় বললো,

‘কোনো দরকার?’

‘হুম।’

তাহির ব্যস্ত গলায় বললো,

‘যা দরকার এখন‌ই বলুন। ফোনে। আমার আজ সময় নেই। প্রচুর কাজ আছে। গত দিনের এপোয়েনমেন্ট, কনফারেন্স, মিটিংস!’

হিমি অবাক হ‌ওয়া গলায় বললো,

‘তার মানে দেখা হবে না?’

তাহির শীতল গলায় বললো,

‘না।’

হিমি শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে বললো,

‘আচ্ছা। তবে আপনার প্রিয় জিনিসটা এখানেই রেখে যাবো?’

তাহির ডান কান থেকে ফোন সরিয়ে বাম কানে ঠেকালো। পুরু ভ্রু কুঁচকিয়ে বললো,

‘আমার প্রিয় জিনিস? আপনার কাছে আমার কোন প্রিয় জিনিস?’

‘‌মনে করুন!’

তাহির ভাবলো। যতদূর মনে পরে হিমিকে সে কখনোই নিজের কিছু দেয় নি। তার‌উপর প্রিয় জিনিস! না, কক্ষনো না। এই মেয়েটা নিশ্চয় মিথ্যে বলছে। কিন্তু মিথ্যে বলে তার কি লাভ? বেশ অনেকক্ষন নিরবতা কাটিয়ে তাহির বললো,

‘মনে পরছে না। আপনিই বলুন!’

হিমি হাসলো। হাসি মুখে বললো,

‘ঐদিন রাতে আমায় আপনার গাড়িতে করে ড্রপ করেছিলেন। মনে আছে?’

তাহির ছোট্ট করে বললো,

‘হু!’

‘রাস্তায় আমি আপনার অতি প্রয়োজনীয় আর কিছু প্রিয় জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলাম। আপনি বাধ্য হয়ে আমায় শান্ত করতে আমার হাতে,,,,’

হিমির কথা বলার মাঝপথেই তাহির স্তম্ভিত গলায় বললো,

‘আমার পিয়ানো!’

‘জি হ্যা। আপনার পিয়ানো। ওটা আমার কাছেই রয়ে গেছে। কেমন প্রিয় জিনিস বলুন তো, আপনার দেখি কিছু মনেই নেই। পিয়ানোটাকে মিস করেন নি?’

তাহির সেসবের জবাব না দিয়ে বললো,

‘কখন দেখা করবেন?’

‘আপনার যখন সময় হবে তখন। আপনি বললে আমি এখানেও রেখে যেতে পারি। আমার সমস্যা নেই।’

হিমি থামতেই তাহির বলে উঠলো,

‘নো। আই মিন, ওটা যেহেতু আমার জিনিস তাই আপনি আমাকেই দিবেন। অন্য কাউকে না। আমি সময় করে আপনাকে কল দেবো। কখন কোথায় আসতে হবে বলে দেবো।’

‘এজ ইউর উইশ! টাটা।’

ফোন কেটে দুলনি চালে হেঁটে হাসপাতালের বাইরে বেরুলো হিমি। এই লোকটার জন্য বার বার হাসপাতালে আসতে হচ্ছে তাকে। শুধু তাই নয়, বারংবার দেখাও হচ্ছে লোকটার সাথে। অচেনা কারো সাথে দু একবারের বেশি দেখা সাক্ষাত হ‌ওয়া উচিত নয়। কখনোই না। হিমিও মনে মনে ঠিক করে, আজকের পর কখনোই যেচে দেখা করবে না সে। আর না কথা বলবে। লোকটার সাথে দেখা হ‌ওয়ার পর থেকেই হিমির জীবনের সমস্যা গুলো পাখনা মেলেছে। কখন না সব সমস্যা একসাথে ঝাঁপিয়ে পরে। দূরে থাকতে হবে। এই লোকটার থেকে শত হাত দূরে থাকা বাঞ্চনীয়।

চলবে,,,,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

২১.

প্রখর রোদে মাঠের এক কোনে ঘাসের উপর বসে আছে সোহিনী, দোহা, মেঘ, ইমন আর সূর্য। কাধে তাদের ব্যাগ, হাতে কোকা কোলার বোতল। দুপুরের সময় হ‌ওয়ায় শিক্ষার্থীরা গিজগিজ করছে চারদিকে। ভাপ্সা গরমে অস্বস্তি লাগছে তাদের। দোহা ব‌ইয়ে ঠাসা ব্যাগ কোলের উপর নামিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। বললো,

‘এই রোদের মধ্যে বসে থাকার কোনো মানে হয়?’

‘তোর জন্য মহল তৈরি করবো না কি?’

ইমনের তাচ্ছিল্য মাখা কথায় মুখ ফুলায় দোহা। রাগি গলায় বলে,

‘আমি ছায়ায় বসার কথা বলছি।’

মেঘ কোকা কোলায় চুমুক বসিয়ে বললো,

‘ছায়া কোথায় পাবি এখন? ‌রাস্তার ওইদিকে যাওয়া বারণ আছে। কি সব কাজ হচ্ছে! এখানেই বসতে হবে।’

‘এখানে বসার থেকে ভালো লাইব্রেরি বা কমন রুমে,,,,,’

দোহার কথার মাঝেই সূর্য‌ বললো,

‘কমন রুমে আমি যামু না। আর ওই লাইব্রেরিতে? জনমেও না! ওই খচ্চর মহিলা খালি বকে। শান্তিতে কথাও ক‌ইতে দেয় না। মনটা চায়,,,, থাক ক‌ইলাম না।’

দোহা মুখ ফুলায়। সোহিনী শাড়ির আঁচলের কোনা দিয়ে নিজেকে বাতাস করে। কালো মুখটা রোদের তাপে আরো কালো দেখাচ্ছে। কপালের মাঝখানে লাগানো টিপটা ভ্রুয়ের কাছাকাছি নেমে এসেছে। নাকের ডগায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের উল্টো পিঠে মুছে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বললো,

‘এরপরের ক্লাসটা করা কি জ্বরুরী? না হলে, চলো বাড়ি যাই। এই গরম আর সহ্য হয় না।’

সূর্য রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,

‘ তুমি মামা রোজ রোজ শাড়ি পরো ক্যান? ঘটনা কি? আমাগো মেঘরে পটানো এতো সোজা না!’

মেঘ তড়িৎ গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী গলায় বললো,

‘আমার কথা উঠলো কেনো?’

‘তোমার কথা উঠবো না তো কার কথা উঠবো? দুইজনার চোখাচোখি, হাসাহাসি, ম্যাচিং কাপড় সব‌ই তো নজরে পরে না কি!’

সূর্য‌ থামতেই সোহিনী নিজের দিকে তাকালো। চোখ ফিরিয়ে মেঘকে দেখে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। ইমন ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

‘সত্যিই তো! তোরা দেখি এক রঙের পোশাক পরে আছিস। ব্যাপার কি?’

দোহা আয়েসি গলায় বললো,

‘এখানে ব্যাপারের কি আছে বুঝলাম না! ভাই বোন‌ও তো এক রঙের পোশাক পরে না কি? ওরা পরলে দোষের কি?’

সূর্য এগিয়ে গিয়ে দোহার মাথায় টোকা মারলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘কোথায় আমি ওদের প্রেমিক প্রেমিকা বানাতে চাইছি আর তুই ভাই বোনের ব্যাখ্যা দিস! গাধী!’

‘তোকে কে বলেছে আমাদের প্রেমিক প্রেমিকা বানাতে? না আমি বলেছি আর না মেঘ বলেছে। শুধু শুধু আজাইরা কাজ করিস কেনো?’

‘এটা আজাইরা কাজ না রে পাগলী, পূণ্যের কাজ। তুই বুঝবি না। আমার সিক্স‌থ সেন্স বলছে, অতি শিঘ্র‌ই মেঘ আর সোহিনীর জুনিয়র ভার্সন দুনিয়ায় আসবে।’

সূর্যের কথা বলার ভাব ভঙ্গীতে হাসি পেলেও শেষের কথায় আঁত্‌কে উঠলো সবাই। দোহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,

‘কি বাজে বকছিস সূর্য! ‌বিয়ে না করেই বাচ্চা?’

দোহাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সূর্য বলতে লাগলো,

‘এক্সেক্টলি! বাচ্চা যখন দুনিয়ায় আসবেই তাহলে তোদের উচিত বিয়ে করে নেয়া। বিয়ে ছাড়া বাচ্চা, সমাজ মানবে না। তোদের পরিবার‌ও না। আমার কথা শোন, চল এখন বেরিয়ে সোজা কাজি অফিসে যাই। তারপর রেজিস্ট্রি করে বাবা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়া। মেনে নিলে ধুমধাম করে সেলিব্রিশন হবে আর না মানলে ছোটখাট ট্রীট!’

মেঘ এবার দু হাতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো সূর্যকে। সূর্য ঘাসের উপর শুয়ে পরে চোখ রাঙিয়ে বললো,

‘দোস্ত, তোর সোহিনী ওইদিকে। আমারে সোহিনী মনে করে কিছু করতে আসিস না আবার! সবাই কি ভাববে! ছিহ!’

মেঘ এলোপাথারি মারতে লাগলো সূর্যকে। সূর্য‌ও নিজেকে বাঁচাতে মেঘকে কিল ঘুষি দিচ্ছে। ইমন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দোহা চোখ মুখ কুঁচকে এদের কান্ড কারখানা দেখছে। সোহিনী চেহারা অন্ধকার করে বসে র‌ইলো কিছুক্ষন। তারপর ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে তাতে সময় দেখলো। তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,

‘ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। তোরা কি খুন খারাবি করবি? করলে বল, আমরা যাই।’

সূর্য আর মেঘের হাতাহাতি থামলো। দুজনেই নিজেদের কলার, শার্ট, চুল ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। মেঘ শ্বাস টেনে টেনে বললো,

‘আর একদিন যদি এই ধরনের ফাউল কথা বলিস তাহলে নির্ঘাত তুই আমার হাতে খুন হবি।’

‘ওই দিনের অপেক্ষায় আছি। তবে তুই যাই বল না কেনো, আমার কথাগুলা ফাউল ছিলো না। ইন ফ্যাক্ট লজিকাল ছিলো।’

___________________

দিনের আলো নিভে গেছে। রাতের আঁধার ঘন হচ্ছে। নান্দনিক এক পার্কের বাইরের ফুটপাতে বাতাম চিবোচ্ছে হিমি। সাথে তার বাইক নেই আজ। তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় বাইক চালানো হলো না তার। আজ বিকেল থেকেই পা চালিয়ে সব জায়গায় যাচ্ছে হিমি। পকেটে কিছু খুচরো ছিলো। তা থেকেই দশটাকার বাদাম কিনেছে। বাকি কিছু চা খাওয়ার জন্য রাখা আছে। মাথা ব্যথার মহৌষধ যে চা তা হিমি সেই ছোটবেলা থেকেই জানে। ছোটবেলা থেকেই চা খেয়ে অভ্যস্ত হ‌ওয়ায় এখন চা ছাড়া চলে না তার। বাড়িতে স্বস্তি না পেলেও রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলোতে জম্পেশ আড্ডার সাথে কড়া চায় মেলে। বাদাম খেতে খেতেই পার্কের গেইটের কাছে পৌঁছালো হিমি। ঘাড় বাঁকিয়ে পার্কের ভেতরে চোখ বুলালো। রাতের অন্ধকার ছোঁয় নি পার্কের ভেতর। চারদিকে লাইট জ্বলছে। ভেতরে বুঝি কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে! হৈ হল্লুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পার্কের মতো নিরিবিলি জায়গায় অনুষ্ঠান করে চেঁচামেচি করার কি মানে খুঁজে পায় না হিমি। হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো সে। পাশ ফিরতে গিয়েই মুখোমুখি হলো কাঙ্খিত ব্যাক্তির। সকালের ইস্ত্রি করা কাপড়ের ভাজ নষ্ট হয়েছে খানিক। চুলগুলো এখনো পরিপাটি। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমায় ঢাকা পরেছে ঘন পল্লব। হিমিকে তার দিকে পলকহীন তাকাতে দেখে হাত উচিয়ে তুরি বাজালো তাহির। হিমির ধ্যান ভাঙলো। ঠোঙা থেকে আরো কয়েকটা বাদাম হাতে তোলে খোসা ছাড়ালো সে। হাতের তালুতে ফু দিয়ে খোসা গুলো উড়িয়ে দিলো বাতাসে। খোসা ছাড়ানো বাদাম মুখে দিয়ে ভ্রু নাচালো। তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে বললো,

‘আমার পিয়ানো?’

হিমি মুখ ভর্তি বাদাম চিবোতে চিবোতে তাহিরকে পাশ কাটিয়ে এগুলো। হিমির জবাব না দিয়ে চলে যাওয়া দেখে তাহির ভড়কে গেলো। হিমিকে ফলো করে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’

‘জাহান্নামে!’

‘বেশ। তবে যাওয়ার আগে পিয়ানো তো দিয়ে যান।’

হিমি থামলো। পেছন ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তাহিরের উদ্দেশ্যে বললো,

‘এতোই যখন প্রিয় তখন আগে আসা উচিত ছিলো। আমি কতক্ষন ধরে আপনার অপেক্ষা করছি কোনো আইডিয়া আছে?’

‘হাসপাতালের কাজ ফেলে হুট করে চলে আসা যায় না। অন্য একজনকে আমার শিডিউল দিয়ে তবেই এসেছি। একটু তো দেরি হবেই! আচ্ছা, আই এম এক্সট্রিমলি সরি। এবার তো দিন।’

তাহিরের অনুরোধ করে বলা কথাগুলো শোনে হিমির মন গললো। প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট পিয়ানো বের করে তাহিরের দিকে এগিয়ে দিতেই কারো ধাক্কা লাগলো। হিমির হাত ফসকে পিয়ানো পরে যেতে নিলে লুফে নিলো তাহির। পিয়ানো নিজ হাতে নিয়ে বুকের সাথে লাগিয়ে ঘন গাঢ় শ্বাস ফেললো। চোখ বোজে স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে বললো,

‘এক্ষুনি পরে ভেঙে যেতো! থ্যাঙ্ক গড!’

হিমি শান্ত গভীর চোখে দেখলো তাহিরকে। ফাঁকা ঠোঙা মুঠোয় নিয়ে মুচরে ছুড়ে ফেললো। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা বাদামের টুকরো জিব দিয়ে বের করে থু করে ফেলে দিলো দুরে। ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘আপনি এই পুরনো নষ্ট পিয়ানোকে এতো ভালোবাসেন কেনো?’

তাহির কৌতুহল নিয়ে বললো,

‘নষ্ট? ‌পিয়ানো নষ্ট হয়ে গেছে?’

হিমি মৃদু হাসলো। বললো,

‘উহু, আমি খালি দেখছিলাম। আপনার রিয়েকশন! আপনি জানেন না পিয়ানো নষ্ট না ঠিক? শেষ কবে চালিয়েছিলেন?’

তাহির আমতা আমতা করে বললো,

‘কখনো চালাই নি।’

‘চালান নি! কেনো?’

‘আমি চালাতে জানি না।’

‘তাহলে এটা নিজের কাছে রেখেছেন কেনো?’

‘আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ এটা আমায় দিয়েছিলেন। সে মানুষটা আমার কাছে নেই। তার স্মৃতি ভেবেই রেখে দিয়েছি।’

হিমি মাথা দুলালো। পকেটে দু হাত গুজে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে বললো

‘চলে যাবেন?’

তাহির জবাব দিলো না। পিয়ানো কোটের পকেটে রেখে কয়েক কদম এগুলো। হিমি‌ও পা মেলালো তার সাথে। কৌতুহলী গলায় বললো,

‘কোথায় যাচ্ছেন?’

তাহির ঘাড় কাত করে বললো,

‘হাসপাতালে।’

‘গাড়ি কোথায় আপনার? আনেন নি?’

তাহির হাঁটতে হাঁটতেই বললো,

‘না। সকালে গাড়ি সাথে করে নিয়ে যাই নি তাই রিকশা করেই আসা যাওয়া করছি। আপনি বাড়ি ফিরবেন না?’

‘ফিরবো। তবে চা খেয়ে।’

তাহির থমকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,

‘চা খেয়ে বাড়ি ফিরবেন! বাড়ি গিয়েও তো চা খেতে পারেন। না কি আমার মতো আপনাকে কেউ চা খেতে দেয় না?’

হিমি পাল্টা প্রশ্ন করলো,

‘আপনাকে চা খেতে দেয় না মানে? আপনি চা খান না?’

তাহির মাথা নেড়ে নাকচ করে আবার‌ও হাঁটায় মনোযোগী হলো। হিমি পায়ের গতি বাড়িয়ে চলতে লাগলো। তাহিরের পাশাপাশি পৌঁছে বললো,

‘চা না খেয়ে আপনি থাকেন কি করে? মাথা ব্যথা করে না?’

তাহির নিঃশব্দে হাসলো। ভ্রু চুলকে বললো,

‘মাথা ব্যথা করলে ব্ল্যাক কফি খাই। চেম্বারে একবার খেয়েছিলাম চা। ভালোই লেগেছে।’

হিমি মুখ বাঁকিয়ে বললো,

‘আপনার চেম্বারে খেয়েছেন?’

তাহির মাথা উপর নীচ করলো। হিমি তাচ্ছিল্য হেসে বললো,

‘ওটা কোনো চা হলো? আসল চা আমি আপনাকে খাওয়াবো। যেমন স্বাদ তেমন সুগন্ধ! আহা,,,, ভাবলেই মন শান্ত হয়ে যায়। মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়। আর বুকে প্রশান্তি নামে। আসুন আসুন!’

কথাটা বলেই তাহিরের এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো হিমি। তাহির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে এতে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,

‘আরে আমি চা খাবো না! ছাড়ুন। আমায় যেতে হবে। দেরি হয়ে যাবে তো! হিমি?’

‘ছাড়বো না। আগে চা খাবেন তারপর যাবেন। দেরি হবে না প্রমিস!’

‘কিন্তু আমি চা খেতে চাইছি না। বুঝার চেষ্টা করুন।’

হিমি তাহিরের দিকে ফিরলো। হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে ঠোঁট উল্টে বললো,

‘প্লিজ, এক কাপ! আমি আটকাবো না আর। সত্যি বলছি। মাথা ব্যথার সাথে সাথে আপনার দুশ্চিন্তাও গায়েব হয়ে যাবে। চলুন না!’

তাহির কথা বাড়ালো না আর। হিমি প্রশস্ত হেসে তাহিরকে নিয়ে এগুতে থাকলো। তাহির বাঁধা দিলো না। এতদিন শুধু বাচ্চাদের ঠোঁট উল্টাতে দেখেছে তাহির। আজ প্রথমবার বাচ্চা ছাড়াও অন্য কাউকে ঠোঁট উল্টাতে দেখলো। বাচ্চাদের তরুণী এক মেয়েকে রিকুয়েস্ট করতে দেখলো। তাহিরের মনে প্রশ্ন জাগলো, এই মেয়ে কি বাচ্চাদের মতোই দৌঁড়ঝাঁপ করে? কাঁদে? হাসে? প্রশ্নগুলো করা হয় না তার। সব প্রশ্ন করতে নেই। উত্তর‌ও খুঁজতে নেই। শুধু লুকিয়ে রাখতে হয়। প্রশ্নগুলো মনে খুব গোপনে থাকে। তাদের সেখানেই থাকতে দেয়া উচিত।

চলবে,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে