হিজিবিজি (৭ম পর্ব)

0
1070

গল্পঃ #হিজিবিজি (৭ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

লজ্জায় নিজের চোখ নিজেই ঢেকে ফেললাম। এতো বড় ধরা খেলাম জাবেরের কাছে। এখন আমি মুখ দেখাবো কিভাবে?

নিজের মাথায় নিজেরই চাপড়াইতে ইচ্ছে করছে। এমন গাধী আমি! সবগুলো কাজ খুব যত্ন করে করেছিলাম, এমনকি ফ্রেন্ডও হাইড করেছিলাম,কিন্তু এটা করতে ভুলে গেছি। এখন কি করবো আমি?
ঠিক সেসময় নোহা আমাকে ডাকলো, আমি জাবেরকে পেছন করে নোহার দিকে তাকালাম।
বাতাসে তার সারা চুল উড়ছে, হাত নাড়িয়ে আমাকে বলতেছে..
___ রিতাপু তোমরা দুজন দুদিকে কেন? ফুফি বলছে একসাথে হাঁটতে! তারাতাড়ি দুলাভাইয়ের কাছে যাও!

ও আল্লাহ যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যে হয়! আমি তো ওর দিকে এখন তাকাতেই পারবোনা।
এখন কি করি?

এতক্ষণ মুখোশ লাগানো ছিল না, একটা পিন করে মুখোশটা পরে জাবেরের দিকে তাকালাম।
সে এক হাত পেটের উপরে রেখে আরেকহাত সেটার উপরে ভর করে নিজের থুতনিতে হাত বুলাচ্ছে আর সামনে তাকিয়ে আছে। যাক আমি তাহলে আস্তে আস্তে উনার পেছনে যাই, নাহলে আম্মু বকা দিবে।
উনি যদি কিছু বলে, তাহলে শুনি নাই ভান করে থাকবো।

হাত দিয়ে একবার পরখ করে নিলাম মুখোশ লাগানো ঠিক আছে কিনা!
কিন্তু এভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে আরো বেশি লজ্জা লাগছে। এমনি এমনি ফোনটা কানে দিয়ে মিনমিন করে এগুচ্ছি, আসলে কিছু বলছিনা। জাবেরকেই বকতেছি।
তারপর যখন তার কাছে গেলাম, তার ডানপাশে দাঁড়ালাম,আর আমার ডানপাশের কানে মোবাইল ধরে আছি। এখন সে আমার কথা শুনতে পাবে তাই আমি জোরে জোরে ফোনে বলতে লাগলাম..
___ শুনোনা আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো! আর বাসায় গিয়ে ভিডিও কল দিবো বুঝছো৷ এখন আমার পাশে মানুষ আছে,তাই কথা বলতে পারছিনা।

তখনই জাবের ভ্রু তোলে আমার দিকে তাকালো, একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো..
___ অযথা কথা বন্ধ করে কলটা এখন রিসিভ করেন! কেউ ফোন দিচ্ছে!

আমি অবাক হয়ে ফোনে তাকালাম, দেখি আম্মু ফোন দিছে। ফোন ডানপাশে থাকার জন্য কলিং হওয়ার সাথে সাথে ব্রাইটনেস জাবের দেখতে পেয়েছে। এদিকে মোবাইল সাইলেন্ট হওয়ায় আমি টের পাইনি। ওহহহ নো! আবারো ধরা। এখনি আম্মুর ফোন আসতে হলো!
ফোন রিসিভ করলাম, আম্মু বলতেছে..
___ শুন তোর বাবা বাসায় একলা,আমরা চলে যাচ্ছি তুই আর জাবের ঘুরাঘুরি শেষে বাইরে নাস্তা করে সন্ধ্যার আগে বাসায় চলে আসিস।

___ মা আমরা এখনি চলে যাবো! মা শুনো শুনো।

ধ্যাত কেটে দিলো। আমার পক্ষে তার সাথে থাকা মোটেও সম্ভব না। সে এতো সুন্দর করে আমার সাথে কতগুলো গেইম খেললো। বিয়ের দিন আমাকে এতো প্রেসার দিয়েছে যে আমি বেহুশ হলাম। অথচ আমি কিছু করার আগেই ধরা খাই।
আমার মাথায় কি গোবর!
যা হবার হয়েছে, এখন থেকেযা করার খুব ভেবে চিন্তে করবো।
আর ধরা পড়া যাবেনা। কিন্তু এখন জাবেরকে কিছু একটা বলতে হবে, নাহলে কথা বলার অবস্থাটাও নেই আমার। গলা ঝাকিয়ে বললাম..
___ আসলে আগের কলটা কখন কেটে গেছে খেয়াল করিনি, এরপরই আম্মু ফোন দিয়েছে। আর আমি অযথা কথা বলবো কেন বলেন? আসলেই ফোন এসেছিল!

___ হুম অযথা ফেইসবুক আইডি খোলতে পারলে এমনি এমনি কথাও বলা যায়।

বলেই তার চোখে মুখে আমাকে লজ্জা দেওয়ার পৈশাচিক হাসি!

আমি মুখে হাত দিয়ে আবারো দেখলাম নেকাব ঠিক আছে কিনা! লজ্জাজনক মুখটা এই মূহুর্তে দেখছেনা ভেবে একটা শান্তি পাচ্ছি। ভাগ্যিস বোরকা পরে আসছি আজ।
তারপর দেখলাম একটা লোক পাড়ের দিকে নৌকা নিয়ে আসছে, আমাদের দেখেই বললো..
___ স্যার নৌকায় ঘুরবেন? প্রতি ঘন্টায় ১০০ টাকা।

___ না একা নৌকায় চড়তে ভালো লাগে না,আরেকদিন গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসবো। (জাবের জোরে জোরে কথাগুলো বললো)

___ আপনার পাশের ম্যাডাম তাহলে অন্য কেউ! আইচ্ছা তাইলে আরেকদিন আইসেন।

আমি জাবেরের দিকে রেগে তাকালাম, কিন্তু এদিকে তার খেয়াল নেই। আমি তখন মাঝিকে ডাকলাম..
___ এদিকে আসেন, আমি একা ঘুরবো।

আমার ঘুরার ইচ্ছে ছিল না, ওর এমন কথায় বাধ্য হয়েছি। আমি নৌকায় পা দেওয়ার পর নৌকাচালক আবারো জাবেরের দিকে তাকিয়ে বললো.
___ স্যার আইসা পড়েন।

___ আরে নাহ আপনি একাই চলেন, পরপুরুষের সাথে আমি যাবোনা। ( আমি মাঝিকে বললাম)

আমার এই কথা শেষ না হতেই জাবের ঢালু বেয়ে নেমে একদম নৌকায় এসে সুন্দর জায়গাটায় আসন পেতে বসে পড়েছে।
আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম..
___ এটা কি হলো?

জাবের আগে আগে ছাতাটাও দখল করে নিলো,এরপর বললো..
___ এটা আপনার নামে দলিল করা নৌকা না। পরপুরুষের সাথে না গেলে জামাই নিয়েই আসতে পারেন না! এখন আমার ইচ্ছে হয়েছে সো আমি ঘুরবো। আপনার ভালো না লাগলে চলে যেতে পারেন।

তার জাবের মাঝিকে লক্ষ্য করে বললো..
___ এই ভাই আপনি চালান। এসব মিচকুটাইপ মানুষদের পরবর্তীতে আর তুলবেন না। এদের সাথে কোনো কথাও বলতে নেই!

___ এই আমি আপনার আগে এসেছি ওকে? আপনাকে বলছিল কিন্তু আপনি আসেননি, আমি আসার পরে আসলেন কেন? আপনি তো বড় মিচকু!

___আরে আপনারা থামুন, এমন করলে আমি চালাবো কিভাবে? ( উচ্চস্বরে মাঝি বললো)

এখন দুজনেই চুপ। বিকেলের রোদের উত্তাপটা গায়ে লাগছেনা,কারণ এদিকে এমনিতেই প্রচুর বাতাস। এখন আবার চলমান অবস্থা, তাই আরো জোরালো ঝাপটা!
জাবেরকে পিছু করে আমি প্রকৃতি উপভোগ করছি, আজকে অন্য রকম একটা ভালোলাগা কাজ করছে।দুজনেই দুজনকে পছন্দ করি কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে দেইনা। শুধু শুধু ঝগড়া করছি।
করবো নাতো কি করবো,সেই তো ইচ্ছে করে করে আমার সাথে লাগছে। কিন্তু আমি তাকে এখনো একটা থাবড় দিতে পারলাম না। উল্টো ধরা খেয়ে নিজেই শরম পাই!

এক পর্যায়ে গিয়ে আমি মুখোশটা খোললাম।
হাত বাড়িয়ে পানি ছোঁয়ার চেষ্টা, ছোট ছোট ফেনাফুল ধরতে আরেকটু হাত দূরে হাত বাড়াচ্ছি। আরেকটু হলে ধরে ফেলবো একটা ফুলে তখনই পেছন থেকে আওয়াজ আসলো..
___রিতা আস্তে তুমি সাঁতার জানোনা।

আমি হাঁ করে ওর দিকে তাকালাম, নৌকার বৈটা ছেড়ে লোকটাও জাবেরের দিকে অবাক হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো..
___ আজকাল মানুষের মতিগতি বুঝিনা৷ স্যার ম্যাডামরে আগে থেকেই চিনেন অথচ এতক্ষণ ঝগড়া করলেন! আমি চিন্তা করছিলাম দুজন দুজনরে চিনেন না,যেভাবে ঝগড়া শুরু করছেন আমি বিপদে পড়ি কিনা! যাক নিশ্চিন্ত হলাম।

জাবের থতমত খেয়ে বসলো। মনে হচ্ছে সে অজান্তেই কথাটা বলে ফেলেছে,ভেবেছে আমি পড়ে যাবো কিনা!
আমি হেসে বললাম..
___ মামা আপনি পাড়ের দিকে যান, আমরা আর ঘুরবোনা। আর উনাকে বলেন আমাকে নিয়ে দরদ করতে হবে না। আমি ছোট বাচ্চা না যে পড়ে যাবো।

আমি টাকা না দিয়েই চুপচাপ নেমে গেলাম।
নেমে পাড়ে দাঁড়ালাম আর দেখলাম লোকটা জাবেরকে জিজ্ঞাসা করছে, উনি আপনার কি হয়?
জাবের কানের কাছে গিয়ে যেন কি বললো।
সেটা শুনতে পাইনি,কিন্তু আমরা চলে আসার সময় লোকটা পেছন থেকে জোরে বলতেছে..
___ স্যার, ম্যাডামের যেদিন রাগ থাকবেনা সেদিন আবার আইসেন।

বুঝতে পারলাম সে উনাকে আমার পরিচয় বউ হিসেবেই দিয়েছে।
একটা ক্যাফের দিকে যাচ্ছি দুজন। জাবের আমার সামনে সামনে যাচ্ছে। হঠাৎই মোবাইল বের করে ফোন লাগিয়ে বললো..
___ কিরে আহান তুই এদিকে আসছিস যেহেতু ক্যাফেতে চলে আয়। আমরা যাচ্ছি এখন।

জাবেরের কথাকে ফাউল ভেবে হেসে উড়িয়ে দিলাম। আমি জানি আমাকে বিভ্রান্ত করতে সে আহানের নাম ধরে উল্টা পাল্টা কথা বলছে।
আমরা দুজন এতো মিথ্যা কথা বলতে পারি আল্লাহ।

অতঃপর দুজন গেলাম, গিয়ে একটা টেবিলে বসে জাবেরকে খাবার অর্ডার দিতে বললাম। কিন্তু জাবের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
হঠাৎই চিৎকার করে বলে উঠলো.
___ওরএএএ বন্ধু তুই এসেছিস! কালকে তো রাত হয়েছিল বলে তোরা সবাই চলে গিয়েছিলি। যাক ভাবিনি আজ এভাবে দেখা হবে। আয় আয় বস। তোর অপেক্ষা করছিলাম বলেই এখনো খাবার অর্ডার করিনি।

আমি তাকিয়ে আছি শুধু, আহান সত্যি সত্যি এসে পড়েছে। ওহহো মাথা আবার ভনভন করেছে। সারাদিনের এতো সুন্দর অনূভুতি আমার এক মূহুর্তে বিষাদে রূপ নিয়েছে। আমাদের দুজনের মধ্যেই তো সবকিছু এখন ঠিকঠাক , জাস্ট সরাসরি বলা বাকি! তাহলে জাবের আজকেই কেন আমাদের মধ্যে আহানকে আনতে গেলো। এটা জাবেরের কেমন পরিকল্পনা?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে