স্বপ্ন?পর্ব_৩৭/৩৮/৩৯

0
714

স্বপ্ন?পর্ব_৩৭/৩৮/৩৯
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৩৭
.
.
.
রিসোর্টে ফিরে ওরা ছয়জন একসাথে একসাথে লাঞ্চ করে নিল । গরম ধোঁয়া উঠা ভাত, মুরগির মাংস, পাহাড়ি সবজি আর ডাল দিয়ে । মুরগির মাংসে ঝাল একটু বেশিই ছিল । এতে মাহির তেমন কোনো সমস্যা হলো না । কারণ ওর অভ্যাস আছে । নিশি অনুও একটু ঝাল লাগলেও ততটা সমস্যা হয় নি । বেকায়দায় পড়ছে আযান । আযানের চোখে পানি এসে পড়েছে । মুখ লাল হয়ে গেছে । কিন্তু আযান কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছিল । মাহি সেটা খেয়াল করে আযানের দিকে পানি এগিয়ে দিল । তারপর ভাত মাখতে মাখতে বললো,
—ওটা রেখে সবজি আর ডালটা খান । ওগুলোতে ঝাল কম ।
আযান মুখে হাসি টেনে বললো,
—না না প্রবলেম নেই ।
এর মধ্যে নিশি আযানের প্লেট টেনে নিয়ে গেল । বললো,
—তোর খাওয়ারই দরকার নেই । যা ভাগ ।
আযান নিশিকে বললো,
—নিশি দেখ ভালো হচ্ছে না কিন্তু । প্লেট দে বলছি ।
নিশি ভেঙ্গচি কেটে বললো,
—দিব না ।
নিশি আর আযানে আবার লেগে গেল । নিঝুম নির্বিকার চেয়ে দেখছে ওদের ঝগড়া । খাওয়ার মধ্যেই অনু এঁটো হাত নিয়ে উঠে পড়লো । পেছন থেকে নীল ডেকে উঠলো,
—অনু কোথায় যাচ্ছো?
নীলের ডাকে অনু পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো,
—আসছি ।
অনু গিয়ে ওর ব্যাগ থেকে চকোলেট নিয়ে এসে আযানকে দিয়ে বললো,
—হাত ধুয়ে ফেল আর চকোলেটটা খা ।
আযান আর কোনো কথা বাড়ালো না । চুপচাপ হাত ধুয়ে চকোলেট খেতে লাগলো ।
বিকালটা ওরা রেস্ট নিয়েই কাটালো । ঠিক করলো সন্ধ্যা একটু আগে বের হবে । সূর্যাস্ত দেখবে । কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে রাতের সাজেক দেখবে । তারপর রিসোর্টে ফিরে এসে সবাই মিলে আড্ডা দিবে ।
সন্ধ্যায় হওয়ার একটু আগেই বেরিয়ে পড়ে ওরা । হেলিপ্যাড-১ এর উপর উঠে সবাই সূর্যাস্ত দেখার জন্য । নিশিকে নিয়ে নিঝুম একটু দূরে দাড়ায় । পাহাড় থেকে সূর্যাস্তটা খুব ভালোভাবে দেখা যায় । সাজেকে হেলিপ্যাড-১ থেকে সূর্যাস্ত সবচেয়ে সুন্দর দেখা যায় । তাই ওরা হেলিপ্যাড-১ যায় । মেঘের মধ্যে থেকে সূর্য একটু একটু করে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে । আকাশ রং আস্তে আস্তে লাল কমলা হয়ে যাচ্ছে । পাহাড়ের সূর্যাস্ত হয় ভয়ংকর সুন্দর । দেখলে চোখ ফেরানো যায় না । এতবড় আকাশটা তো ঢাকায় দেখা যায় না । বিল্ডিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে একটুখানি করে দেখা যায় । তাতে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্যাদয়ের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না ।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশি । খুশিতে ওর চোখে পানি চলে আসছে । হাত পা ও কাঁপছে । নিঝুম নিশির থেকে একটু পেছনে দাঁড়িয়ে নিশির মুখপানে তাকিয়ে আছে । সূর্যাস্তের সৌন্দর্য জীবনে বহুবার দেখেছে । দেখা বাকি ছিল ওর স্বপ্নকন্যার মুখে আনন্দের ঝিলিক । আজ সেটা দেখার সুযোগ ওর হয়েছে তাই দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে ওর স্বপ্নকন্যাকে ।
নীল আর অনুকে একা থাকার সুযোগ করে দিয়ে মাহি আযানকে নিয়ে সরে আসে । আযান চুপ করে তাকিয়ে ছিল আকাশপানে তখন হঠাৎ বাহুতে কারো ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে মাহি । আযানকে ফিরে তাকাতে দেখে মাহি ইশারায় বললো, ওর সাথে যেতে । প্রথমে আযান অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল । কিছুই বুঝতে পারছিল না । সেটা দেখে মাহি কপালে হাত রাখে । অনেকটা এমন বোঝাচ্ছিল, “হায়রে!! ” তারপর নিজেই আযানের হাত ধরে টেনে সাইডে নিয়ে আসে । তারপর আযানের বিষ্ময়ভরা মুখ দেখে বললো,
—ভাইয়া আর অনু আপিকে একটু স্পেস দেয়া দরকার । তাই আপনাকে নিয়ে এলাম ।
আযান এতক্ষণে বুঝতে পারলো । হেসে বললো,
—বুঝতে পেরেছি ।
—আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?
—একটা প্রশ্ন তো করেই ফেলেছ ।
—হু করেছি । আরো কয়েটা করবো । আর আপনিও সেগুলোর উত্তর দিবেন ।
আযান হাসতে হাসতে বললো,
—পারমিশন দেই নি বলে একবারে অর্ডারই করছেন দেখি । আচ্ছা বলুন কি প্রশ্ন ।
মাহি একটু মুখ ভেঙ্গচি কেটে বললো,
—হুহ একদম ঠিক করেছি ।
আযান কিছু বললো না । শুধু একটুখানি হাসলো । মাহি চেয়ে চেয়ে আযানের হাসি দেখলো । হুট করেই বলে বসলো,
—আপনার হাসিটা অনেক সুন্দর আযান ।
চমকে উঠলো আযান । বিষ্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো মাহির দিকে । কথাটা বলে মাহিও বেশ অপ্রস্তত হয়ে গেল । তার উপর আযানকে এভাবে তাকাতে দেখে আরো অসস্থি লাগছে । ভুলবশত বেফাঁস হয়ে গেছে কথাটা । আযান মাহির অসস্থি বুঝতে পেরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য হো হো করে অট্টহাসি ফেটে পড়লো । আযানের হাসি দেখে মাহি একটু সস্থির ফিরে ফেলে । মনে মনে বলে,
—“যাক কিছু মনে করে নি । ”
.
” প্রিয়া-রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আঁখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি!
জুড়াল গো তার শত জনমের রৌদ্রদগ্ধ-কায়া–
এতদিনে পেল তার স্বপনের স্নিগ্ধ মেঘের ছায়া!
চেয়ে দেখো প্রিয়া, তোমার পরশ পেয়ে
গোলাপ দ্রাক্ষাকুঞ্জে মরুর বক্ষ গিয়াছে ছেয়ে!

গভীর নিশীথে, হে মোর মানসী, আমার কল্পলোকে
কবিতার রূপে চুপে চুপে তুমি বিরহ-করুণ চোখে
চাহিয়া থাকিতে মোর মুখ পানে ; আসিয়া হিয়ার মাঝে
বলিতে যেন গো – ‘হে মোর বিরহী, কোথায় বেদনা বাজে?’
আমি ভাবিতাম, আকাশের চাঁদ বুকে বুঝি এল নেমে
মোর বেদনায় বুকে বুক রাখি কাঁদিতে গভীর প্রেমে!
তব চাঁদ-মুখপানে চেয়ে আজ চমকিয়া উঠি আমি,
আমি চিনিয়াছি, সে চাঁদ এসেছে প্রিয়া-রূপ ধরে নামি!”

নীল অনুর পিছনে দাঁড়িয়ে দু’হাতে অনুর বাহু আঁকড়ে ধরে রেখে কানে কানে নিচু স্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো । অনু মুচকি হেসে সামনে তাকিয়ে আছে । আর শুনছে নীলের আবেগ ভরা কণ্ঠের আবৃত্তি….
.
.
.
চলবে?
(বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন ।)
.
#স্বপ্ন?
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৩৮
.
.
.
নীল অনুর পিছনে দাঁড়িয়ে দু’হাতে অনুর বাহু আঁকড়ে ধরে রেখে কানে কানে নিচু স্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো । অনু মুচকি হেসে সামনে তাকিয়ে আছে । আর শুনছে নীলের আবেগ ভরা কণ্ঠের আবৃত্তি । আচমকা নীল অনুর মাথায় ঠোঁট ছোঁয়ালো । চমকে উঠলো অনু । মাথা ঘুরিয়ে বড় বড় চোখ করে নীলের দিকে তাকালো । নীলের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো নীলের ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসি । সেই হাসি যেন ওর চোখেও ঝিলিক দিচ্ছে । কেমন ঘোর ঘোর লাগছে অনুর । নীল অনুর অবাক হওয়া দৃষ্টি দেখে ওকে আরো অবাক করে দিতে হুট করে আবার অনুর কপালেও চুমু দিল । কিন্তু এবার আর অনু অবাক হলো না । অবাক হলো নীল । কারণ অনু খুব আলতো করে নীলের বাম গালে হাত রাখলো । নীল অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো । ও কখন ভাবে নি যে অনু নিজে থেকে ওকে ছুঁয়ে দিবে । নীলের বাম গালের তিলের উপর হাত বুলালো অনু । দৃষ্টি স্থির সেখানেই । কিন্তু নীলের অস্থির, চঞ্চল দৃষ্টি তখন বিচরণ করছে অনুর পুরো মুখ জুড়ে । বুঝতে চেষ্টা করছিল এটা স্বপ্ন না সত্যি । ততক্ষণে অনুকে পেছন থেকেই নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়েছে নীল । অনু একবার নীলের চোখের দিকে তাকালো । তারপর পা একটুখানি উঁচু করে নীলের গালে গভীর ভাবে অধর ছোঁয়ালো । চোখ বন্ধ করে ফেললো নীল । মাত্র দুই সেকেন্ড মতো সময় অনু এভাবে কাছে ছিল নীলের । তারপর হুট করেই নীলের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেলে দূরে । আর নীল তখনো চোখ বুজে । অনুর যাওয়ার পর নীল চোখ খুললো । একটু আগে অনুর করা পাগলামি মনে করে মুচকি হাসলো । ধীরে ধীরে হাত তুলে যেখানটায় অনুর ভালোবাসার স্পর্শ দিয়েছে সেখানটায় হাত রাখলো । অনুভব করলো হৃদস্পন্দনের গতিটা । যেটা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে । আর সেখান থেকে যেন একটা কথা বারেবার আসছে । “ভালোবাসি অনু । ”
দেখতে দেখতে সূর্যটা লুকিয়ে গেছে আঁধারের মাঝে । পুরো আকাশে নেমে এসে অন্ধকার । কিন্তু তার মাঝে জ্বল জ্বল জ্বলতে থাকা কোটি কোটি তারার মেলা । কালচে নীল আকাশে মুক্তোর মতো জ্বলছে তাকরারাজি । যা দেখলে নিমিষেই জুড়িয়ে যায় প্রাণ । নিঝুম, নিশি, নীল, অনু, আযান, মাহি একসঙ্গে গোল হয়ে বসেছে । সবার দৃষ্টিই আকাশপানে । হঠাৎ মাহি একটু চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
—নিশি আপু অনু আপু ঐ দেখো মিল্কিওয়ে ।
আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো । মাহির ইশারা অনুযায়ী সেদিকে তাকালো সবাই । নিশি একলাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো । সেই সাথে অনুকেও টেনে দাঁড় করালো । বাচ্চাদের মতো অনুর গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়ালো । হঠাৎ করেই নিঝুম নিশির দিকে তাকাতেই দৃষ্টি গিয়ে আটকে গেল নিশিতে । নিশি চোখ একটু বড় করে ঠোঁটের কোণে সুন্দর একটা হাসি ফুটিয়ে একহাতে অনুর গলা জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । নিশির মুখ দেখে ওকে ঠিক ছোট্ট বাচ্চাদের মতো মনে হচ্ছে এখন । যার চোখে মুখে ঝিলিক দিচ্ছে খুশি ।
আরো অনেকক্ষণ হেলিপ্যাডে সময় কাটিয়ে ওরা রিসোর্টে ফিরে আসে । আসার আগে চা খায় বাহিরে । রিসোর্টে ফিরে সবাই রেস্ট নেয়ার জন্য যার যার রুমে যায় ।
অনু ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখে নিশি জানলা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে । অনু হাত থেকে টাওয়ালটা রেখে নিশির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় । নিশির দিকে তাকিয়ে দেখে নিশির গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে । বাহিরের আবছা আলোয় ওর চোখের পানিকে মুক্তো দানা মনে আছে । অনু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো । কিছু বললো না । নিশির চোখের পানির কারণটা অনুর জানা তাই চুপ করে থাকাটাই ওর ঠিক মনে হলো । নিশি অনুর উপস্থিতি টের পেলেও ওর দিকে না তাকিয়ে চুপ করেই রইলো । বেশ অনেক সময় পর বললো,
—অনু…
নিশির ডাকে ছোট্ট করে উত্তর দিল অনু,
—হু…
—নিঝুম আমাকে ভালোবাসে তাই না?
এবার অনু নিশির দিকে তাকালো । দেখলো নিশি দৃষ্টি সামনে রেখেই ওকে প্রশ্ন করেছে । এখনো সেভাবেই আছে । অনু অনেক ধীর কণ্ঠ উত্তর দিল,
—হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসে তোকে ।
—নিঝুমের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল ও আমাকে ভালোবাসে । কিন্তু যদি কখনো আমার জীবনের কালো অভিশপ্ত অপ্রিয় সেই সত্যিটা জানতে পারে তখন? তখনও কি এই ভালোবাসাটা থাকবে?
অনু চমকে উঠলো নিশির প্রশ্নে । কয়েক সেকেন্ডের জন্য নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রইলো নিশির দিকে । তারপর বললো,
—ভালোবাসটা যদি নিখাদ হয়, যদি তোর প্রতি ভাইয়ার অনুভূতিগুলো সত্যি হয় তাহলে সবটা জানার পরেও তোকে ভালোবাসবে ।
নিশি মুখ ঘুরিয়ে তাকালো অনুর দিকে । বললো,
—একটা মেয়ের জীবনের এতবড় একটা দাগ আছে জেনেও ভালোবাসবে বলছিস তুই?
—হ্যাঁ, বলছি । আজ যদি তুই জানতি নিঝুম ভাইয়ার জীবনেও এমন কোনো কষ্ট আছে তখন তুই কি করতি? ছেড়ে দিতি?
নিশি কিছু বললো না । চুপ করে অনুর কথা শুনতে লাগলো । একটু থেমে অনু আবার বললো,
—পারতি না রে আপু । বরং আরো শক্ত করে তার হাতটা ধরে রেখে পাশে থাকতি ।
—আমি নিঝুমকে সবটা খুলে বলবো ।
—আপি তুই এই ক…..
অনু সম্পূর্ণ কথা বলতে পারলো না । তার আগেই দরজায় টোকা পড়ে । অনু দরজার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিশির দিকে তাকায় । নিশি চট জলদি চোখের জল মুছে নিয়ে পানি খেয়ে নিজে স্বাভাবিক করে নেয় । তারপর গিয়ে অনু দরজা খুলে । দরজা খুলতেই দেখে মাহি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে । অনু দরজা খুলতেই মাহি অনুর হাত ধরে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
—সুইটি আর মিষ্টি শোনো এতক্ষণ দু’জন মিলে অনেক গল্প করেছ আমাকে রেখে । এখন আমার সাথে চলো ।
একথা বলে মাহি নিশির হাত ধরলো । নিশি বললো,
—এই কিছুক্ষণ আগেই তো এলাম । এখন আবার কোথায় যাবে তুতুলপাখি?
মাহি মুখ ভার করে বললো,
—আমার সাথে যেতে চাচ্ছ না তাই না? ডিস্টার্ব করলাম ।
—ইস্ রেহ্ পাখিটা ভুল বুঝছে ।
নিশি মাহির গাল টেনে বললো । নিশির কথা শেষ হতেই অনু মাহির নাক টেনে দিয়ে বললো,
—পাখিটার সাথে সারাদিনই কথা বলতে ইচ্ছে করে ।
মাহি একটা লাফ দিয়ে নিশি আর অনুকে জড়িয়ে ধরলো । দু’জনের গালে গাল ঘসে দিয়ে বললো,
—ইস তোমরা দু’জনই ডেসার্ট । তাই তো সুইটি আর মিষ্টি নাম দিয়েছি ।
নিশি আর অনু মাহির কথা শুনে একসাথে খিলখিল করে হেসে উঠলো । ওদের হাসি থামতেই মাহি বললো,
—অনেক হয়েছে হাসাহাসি । পরে আবার হেসো । এবার আমার সাথে চল ।
একথা বলে মাহি নিশি আর অনু দু’জনকে দু’পাশে নিয়ে যেতে লাগলো । বের হতে হতে জানলো রিসোর্টের বাহিরে নিঝুম, নীল আর আযান আছে । বাহিরে বসে নাকি সবাই মিলে তারাভরা আকাশ দেখবে আর আড্ডা দিবে । বাহিরে আসতেই দেখলো নিঝুম, নীল আর আযান অলরেডি বসে আড্ডা দিচ্ছে । নিশি, অনু, মাহি গিয়ে ওদের পাশে বসে পড়লো । নিঝুমের পাশে বসেছে নীল । তারপর অনু, তারপর নিশি, আযান, মাহি । এভাবে সার্কেল করে বসেছে ওরা । কি নিয়ে আড্ডা হবে জিজ্ঞেস করতেই মাহি একটা বোতল বের করে বললো,
—ট্যান ট্যানাআআ ট্রুথ অর ডেয়ার গেম খেলা হবে ।
নিঝুম বিরক্ত মুখে বললো,
—মাহু তোর কি এই এক গেম ছাড়া আর কিছু নেই? সিরিয়াসলি এই গেমে তুই কি পেয়েছিস আমি বুঝি না ।
মাহি মুখ বাঁকিয়ে বললো,
—দাভাই তোর একটা কথাও আমি শুনবো না । এই গেমই হবে আর এটাই ফাইনাল ।
তারপর বোতল ঘুরিয়ে দিয়ে বললো,
—স্টার্ট নাউ ।
বোতল ঘুরছে । ঘুরতে ঘুরতে বোতলের গতি কমে গেল । বোতল গিয়ে থামলো আযানের সামনে । নিশি খুশিতে একটা লাফ দিয়ে উঠলো । সেই সাথে মাহিও । ট্রুথ অর ডেয়ার জিজ্ঞাসা করলে আযান ট্রুথ নিল । নিশি বলে উঠলো,
—না না তোকে ডেয়ার নিতে হবে ।
—মাফ চাই আমার মাতা । ভুলেও আমি ডেয়ার নিমু না । তোর মতো শাকচুন্নি যেখানে আছে সেখানে ডেয়ার নেয়া মানে ইজ্জতের ফালুদা ।
নিশি রেগে গিয়ে বললো,
—আযাইন্নার বাচ্চা । কি বললি তুই?
—ঠিকই তো বলছি ।
নিশি আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহি বললো,
—ওকে ওকে স্টপ । আমি প্রশ্ন করছি ।
অনু বললো,
—আচ্ছা করো ।
আযান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—যাক বাঁচা গেল ।
নিশি রাগী চোখে আযানের দিকে তাকালো । কিন্তু আযান নিশিকে দেখেই নি এমন একটা ভাব নিল । নিশি আযানের দিকে তাকিয়ে থেকে কটমট করে মাহিকে বললো,
—তুতুলপাখি ওকে সিম্পল কোনো প্রশ্ন করবি না ।
মাহি হাসতে হাসতে বললো,
—আচ্ছা ।
তারপর আযানের দিকে তাকিয়ে বললো,
—আপনার লাইফের দুইটা টপ সিক্রেট বলুন যেটা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না ।
আযান চমকে মাহির দিকে তাকালো । আযানকে এভাবে চমকাতে দেখে মাহি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো । নিঝুম মাহির মাথায় টোকা মেরে বললো,
—তুই একটা চরম দুষ্টু ।
মাহি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,
—সঙ্গ দোষ দাভাই ।
তারপর মাহি আযানকে তাড়া দিয়ে বললো,
—কই চুপ কেন আপনি? বলা শুরু করুন ।
আযান গলা খাকানি দিয়ে বলা শুরু করলো,
—আমি যখন খুব ছোট তখনকার কাহিনী এটা । আমার ফ্যামেলি ছাড়া আর কেউ জানে না । কারণ…..
আযানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অনু বললো,
—ভুমিকা বাদ দিয়ে মেইন পয়েন্টে আয় ভাই ।
—বলবোই না যাহ্
—ওকে তাহলে দশবার কান ধরে উঠবস করতে হবে সবার সামনে । রাজি?
নিশি আযানের কান টেনে ধরে বললো । আযানে নিশির থেকে কান ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
—এই না না না । আমি বলছি ।
আযানের কথায় সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো । আযান মুখটা ভার করে বলতে লাগলো,
—যেটা বলছিলাম । আমার এক কাজিন ছিল । যে আমার থেকে প্রায় এগারো বছরের বড় । আমার যখন চার বছর বয়স তখন আপু আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল । একদিন আমাকে আমার প্রতিবেশি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল আপুকে আই লাভ ইউ বলতে । বললে নাকি আমাকে চকোলেট দিবে । তাই আমি চকোলেটের লোভে বাসার সবাই একসাথে বসেছিল ছিল তখন সবার সামনে আপুকে গিয়ে আই লাভ ইউ বলি । কিন্তু ছোট ছিলাম বিধায় কথাটা আই লাভ ইউ না আউলা বিউটি শোনা গিয়েছিল ।
আযান এতটুকু বলতেই সবাই খিলখিল করে হেসে উঠে । মাহি হাসতে হাসতে নিঝুমের উপর পড়ে যায় । তারপর কোনো মতে সবাই হাসি থামায় । তারপর আযান আবার বলতে শুরু করে,
—খালি এতটুকুই না । আরো বলেছিলাম, “আপ্পু আমি তুমাকে বিইয়ে করবু । ” আপু সেদিন অনেক লজ্জা পেয়েছিল । তারপর থেকে আপু আমার সাথে কথাই বলতো না বলতে গেলে । আর আমি সারাদিন আপুর পিছনে পড়ে থাকতাম । এমনকি আমার আম্মুর একটা লাল শাড়ি ছিল সেটা আম্মুকে পড়তে দিতাম না । বলতাম, “এটা আমার বউইয়ের । তুমি পুরবা না । ”
আযানের কথা শেষ হতেই সবাি আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো । হাসতে হাসতে সবার পেটে খিল ধরে যায় । অনু হাসতে হাসতে বললো,
— লাইক সিরিয়াসলি আযান?? তুই এমন করেছিলি??
আযান অসহায় মুখ করে বললো,
—হু । এটা নিয়ে আমাকে একনো বাসায় সবাই ক্ষেপায় ।
নীল আযানের কথা একটু কপি করে বললো,
—আযান তা শেষমেষ কি তোমার বিইয়ে হয় নি আপুটার সাথে??
আযান করুণ চোখে তাকালো নীলের দিকে । বললো,
—তোমরাও এখন শুরু করে দিলে??
মাহি হাসতে হাসতে বললো,
—ওকে ওকে এবার সেকেন্ডটা বলুন ।
আযান নিশি আর অনুর দিকে একবার ভয় ভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—আমি স্মোক করতাম ।
আযানের লাস্ট কথাটা শুনে নিশি আর অনু চমকে গিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকায় । দু’জন প্রায় একসাথে বলে উঠে,
—কিহহহ্!!!!
আযান মিনতি স্বরে বললো,
—করতাম দোস্ত । এখন আর করি না । প্লিজ অত্যাচারী রাণীদের মতো একন অত্যাচার করিস না ।
নিশি আযানের হাতে খামচি মেরে বললো,
—এতদিন বলিস নি কেন??
অনু নিশির হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,
—আপি ছেড়ে দে আপাতত । ফিরে গিয়ে ওর শাস্তি দিব ।
আযান এক ঢোক গিলে বললো,
—আল্লাহ রক্ষা কইলো এই অত্যা…
বাকিটুকু আর বলা হলো না আযানের । নিশি আর অনুর রাগী দৃষ্টি দেখে চুপ হয়ে গেল । মাহির হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ । কিছুতেই হাসি থামাতে পারছে না । তাই নিশি বোতল ঘুরালো । এবার বোতল গিয়ে থামলো নীলের দিকে । মাহি হৈ হৈ করে উঠলো । এবার নিঝুমও একটু এক্সাইটেড হলো । নীলকে জিজ্ঞেস করা হলো কি নিবে । নীল একটা হাসি দিয়ে বললো,
—আমি কি ভিতু নাকি । ডেয়ার নিব আমি ।
মাহি হেসে বললো,
—ওলে লে লে লে । আমাল সাহসী ভাইটা । তোকে আমি এমনিতেও ডেয়ারই দিতাম ।
নিঝুম মাহিকে বললো,
—নীলকে ডেয়ারটা আমি দিই?
মাহি তেড়ি চোখে তাকিয়ে বললো,
—না তুমি ইজি ডেয়ার দিবা ভাইকে আমি জানি ।
—না ইজি দিব না ।
—না আমি বিশ্বাস করি না ।
—আচ্ছা তোকে আমি কানে কানে বলি । যদি তোর পছন্দ না হয় তাহলে তুই দিস ।
নীল বাঁধা দিয়ে বললো,
—এই যে এটা ঠিক হচ্ছে না ।
মাহি নীলকে তামিয়ে দিয়ে বললো,
— অনেক ঠিক হচ্ছে ।
তারপর নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
—দাভাই তুই বল তো।
মাহি নিঝুমের দিকে কান বাড়িয়ে দিল । নিঝুম মাহির কানে কানে বললো। বলার পর মাহি নিঝুমের দিকে তাকিয়ে একটা বিশাল হাসি দিয়ে বললো,
—একদম ঝাক্কাস একটা ডেয়ার । আমি রাজি ।
—তাহলে বলি?
—হুম বল ।
বাকিরা এতক্ষণ শুধু তাকিয়ে ছিল নিঝুম আর মাহির দিকে । নিঝুম দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—নীলকে কাপল ডান্স করতে হবে অনুর সাথে ।
অনু এই কথা শুনে আঁতকে উঠে বলে,
—না না একদম না। আমি ডান্স করতে জানি না । নিশি আপি ভালো ডান্স পারে । সবসময় ডান্সে ও ফার্স্ট প্রাইজ আনে আপি । আপিকে নিয়েই ডান্স করুক ।
নিশি বলে উঠলো,
—ভুলেও না । তোকে বলেছে আমি কেন নাচবো । আমি নেই এইসবে।
মাহি নীলের দিকে তাকিয়ে বললো,
—ভাই তোর ডেয়ারই এটা অনু আপুকে রাজি করিয়ে আপুর সাথে কাপল ডান্স করতে হবে । আর গান দাভাই গাইবে ।
নিঝুম মাহির কথা শুনে বললো,
—এটা আবার কই থেকে আসলো??
—দাভাই বাহানা দিবি না। কোনো বাহানা চলবে না ।
আযান নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—সমস্যা কি ভাইয়া?? আমরা আমরাই তো ।
তারপর অনুর দিকে ফিরে বললো,
—অনু মিথ্যা বলাটা ঠিক হচ্ছে না । নিশি আর আমার কিন্তু অজানা না তুই নাচতে পারিস নাকি পারিস না। সো আর কোনো কথা হবে না ।
নিঝুমের দিকে ফিরে আযান আবার বললো,
—ভাই গিটার বাজাতে জানো তো?
মাহি বললো,
—জানে না মানে!! আপনি আপনার গিটারটা নিয়ে আসুন ।
—আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি ।
আযান উঠে গিয়ে গিটারটা নিয়ে আবার চট করেই ফিরে এলো । নিঝুমের হাতে গিটারটা দিয়ে নীলের দিকে ফিরে বললো,
—ভাই শুরু করে দাও ।
নীল উঠে দাড়ালো । ততক্ষণে নিঝুম গিটারের সুর তোলা শুরু করে দিয়েছে ।
………Aakhon mein teri
….Ajab si ajab si adayein hai
.
নিঝুম এই লাইনটা গাইতেই নিশি নিঝুমের দিকে তাকায় । নিঝুম মুচকি একটা হাসি দিয়ে আবার গাইলো,
.
……Hooo…aakhon mei teri
……Ajab si ajab si adayein hai
.
নীল অনুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল । অনুও কাঁপা কাঁপা হাত রাখলো নীলের হাতে।
.
…..Dil ko banade jo patang saans se
……Yeh teri woh haawaien hai
.
নীল অনুকে ধরে নিজের তাল অনুযায়ী নাচাতে লাগলো। অনু নীলের সাথে তাল মিলালো।
.
………Aakhon mein teri
…..Ajab si ajab si adayein hain
……Ho….aakhon mein teri
…..Ajab si ajab si adayein hain
…..Dil ko banade jo patang saanse se
……Yeh teri woh haawaien hai
.
গিটারে যখন মিউজিক দিচ্ছিল তখন নিশি আড়চোখে নিঝুমের দিকে তাকায় । কিন্তু নিঝুম একদম নিশির চোখের দিকে তাকিয়ে আবার গাইতে শুরু করলো,
.
…….Aai aise raat hai jo
….Bahut khushi nasseb hai
……Chahe jise doorse duniya
…..Woh mere kareeb hai
.
নিশি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
.
………………Kitna kuch kehna hai
……………..Phir bhi hai dil mein
……………..Saawal hai kahin
………..Sapno mein jo roj kaha hai
………Woh phir se kaha ya nahi
……….Aankhon mein teri
…..Ajab si ajab si adayein hain
.
অনুর দুই হাত নীলের বুকের উপরে । নীল অনুর কোমড়ে হাত রাখলো । শিউরে উঠে অনু । নিভু নিভু চোখে তাকায় নীলের দিকে । দেখলো নীলও গানের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে গাইছে । অনুকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো,
.
……Ho….aankhon mein teri
…..Ajab si ajab si adayein hain…..
….Dil ko banade jo patang saans se
…..Yeh teri woh haawaien hai…
.
.
………….Tere saath sath aisa
…………….Koi noor aaya hai
………Chand teri roshni ka
…Halka se ek saaya hai
.
নিশির মনে হচ্ছে নিঝুম যেন ওকে ডেডিকেট করেই গানটা গাইছে । এটা মনে হতেই লজ্জায় নুইয়ে পড়লো নিশি । পরক্ষণেই আবার নিজের অতীতের কথা মনে নাড়া দিয়ে উঠতেই ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল ।
.
…………Teri nazaron ne dil ka kiya
…………….jo hasar
…..Asar yeh hua
………aab in mein hi doob ke ho
……………jau paar
…..yehi hai dua
……….Aakhon mein teri
……Ajab si ajab si adayein hai
.
……Ho….aakhon mein teri
…….Ajab si ajab si adayein hai
…….Dil ko banade jo patang saans se
…..Yeh teri woh haawaien hai
.
পুরো গানটাতেই নীল অনু খুব সুন্দর করে নাচলো ।
নাচ শেষ হতেই সবাই হাততালি দিল । নাচ শেষ করে নীল আর অনু আবার নিজেদের জায়গায় বসে পড়লো…
.
.
.
চলবে??
(বিঃদ্রঃ মাঝে অনেক দিন গল্প দিতে পারি নি । সেইদিন দিয়েছি তাও অনেক ছোট পর্ব দিয়েছি । তাই আজকে বড় করে দিলাম।
আর সাইলেন্ট রিডারদের উদ্দেশ্য বলছি । হয় রেসপন্স করুন না হলে আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিন ।
দিন দিন গল্পের রেসপন্স কমছে । যদি খারাপ হয় সেটাও তো জানাতে পারেন । সত্যি খুব খারাপ লাগে আপনাদের এমন ব্যবহারে । আগ্রহটাই নষ্ট হয়ে যায় ।
.
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। )
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


#স্বপ্ন?
#অনামিকা_সিকদার_মুন
#পর্ব_৩৯
.
.
.
অনু লজ্জায় নীলের দিকে তাকাতে পারছিল না । নাকের ডগা লাল হয়ে ছিল ওর । আর নীল সেটা খুব বেশি উপভোগ করছিল ।
নিঝুম খেয়াল করে দেখলো নিশি একটু চুপচাপ হয়ে আছে । কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না । একটু আগেও তো নিশি হাসছিল মজা করছিল । তাহলে হুট করে ওর কি হয়ে গেল । আর নিশি অনেক ফর্সা হওয়ায় ও একটু চোখের পানি ফেললেই নাক আর চোখ লাল হয়ে যায় । অনেক বেশি সেনসিটিভ ওর স্কিন । তাই এমনটা হয় ।
নিশি নীল আর অনু যখন নাচছিল তখন ওর চোখে পানি এসে পড়েছিল । সবার চোখের আড়ালেই নিশি চোখ মুছে নেয় । নিশির টকটকে মুখটা অন্য কেউ খেয়াল না করলেও নিঝুম ঠিকই খেয়াল করে । মনে মনে বারবার একটা কথাই আওড়াতে লাগলো, “কি হয়েছে নিশির? ”
খেলা চললো প্রায় তিনঘন্টার মতো । তারপর সবাই রিসোর্টে ফিরে ডিনার করে নেয় । সাজেকে কখনো খাবার তৈরি করা থাকে না । অর্ডার দেয়ার পর রান্না করে পাঠানো হয় । রাতের খাবারে ঝাল কম দিয়ে রান্না করতে বলা হয়েছিল । কারণটা আযান । মাহি দুপুরেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল যে রাতের কম ঝাল খাবার আনাবে । সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে সবাই-ই ক্লান্ত হয়ে গেছে । আবার কাল সকালে জলদি উঠতে হবে । নাহলে সূর্যাদয় দেখাটা মিস হয়ে যাবে । তাই তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লো সবাই ।
.
রাত বারোটা ।
শুয়ে আছে সেই তখন থেকে কিন্তু নিশির চোখে একফোঁটা ঘুম নেই । এপাশ ওপাশ ফিরছে খালি । অনুটাও ঘুমিয়ে পড়েছে । নাহলে ওর সাথে গল্প করে দিব্যি সময় কেটে যেত । একবার ভেবেছিল অনুকে ডেকে তুলবে । কিন্তু পরক্ষণেই আবার সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল । নিজেকে একা একটু সময় দেয়া দরকার । কিন্তু অনু কখনো নিশিকে এক মুহুর্তের জন্য একা থাকতে দেয় না । ছায়ার মতো পাশে থাকে । আগলে রাখে নিশিকে । তাই এখন একা থাকার সুযোগটাকে হাত ছাড়া করতে ইচ্ছে হলো না । শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না । তাই উঠে পড়লো । জানলা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকালো । বিশাল এক চাঁদ উঠেছে । আর তারপাশে কোটি কোটি তারা মেলা । মন খারাপের মাঝেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো নিশির মুখে । মনে মনে ভাবলো, অনু যদি এখন জেগে থাকতো তাহলে এখন রবীন্দ্র সংগীত করতো । যখনই আকাশে সুন্দর ঐ চাঁদটা উঠে আর তখন সেটা যদি অনু দেখে তাহলে “চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে…… ” এই গানটা গায় । আর কণ্ঠে এমন সুর তোলে যে ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠে । শুনলে মনে হয় ওর সুরের মাঝে ডুবে যাচ্ছি । নিশি আর অনু যখন জেগে থাকে তখন নিশি অনুকে গান শোনানোর জন্য অস্থির করে তোলে । শুধু গান শোনা পর্যন্ত না । অনুর কোলে মাথা রেখে ও শোবে আর অনুকে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গান শোনাতে হবে । আবার মাঝে মাঝে কবিতা । নিশি সব জ্বালাতন অনু মুখ বুজে মেনে নেয় । যেই জ্বালাতনটা অনুর করার কথা সেটা করে নিশি । এসব ভেবেই পেছন ফিরে নিশি অনুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে । সেই হাসিটা কয়েক সেকেন্ড মাত্র স্থায়ী হতে পারে নিশির মুখে । তারপরে সেই হাসি ক্ষণিকেই মিলিয়ে যায় । আবার অসহ্য সেই যন্ত্রণা শুরু হয় নিশির মনে । দম বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করে নিশির । স্থির হয়ে থাকতে পারলো না আর । জানলার কাছ থেকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল দরজার কাছে । খুট করে দরজাটা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য একপা বাড়িয়ে আবার উল্টো ফিরে এসে অনুর কাছে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল । খুব ইচ্ছে করছিল অনুর কপালে একটা চুমু দিতে । কিন্তু দিল না । যদি অনুর ঘুম ভেঙ্গে যায় তাই । অনুর কাছ থেকে উঠে সোজা বেরিয়ে গেল রুম থেকে । রিসোর্টে রুমের সাথে করিডোরের মতো জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো । দাঁড়ানো সাথে সাথেই এক মুঠো শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল নিশির মন প্রাণ শরীর । ওড়নাটা আরেকটু ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে রেলিংয়ের মতো করে দেয়া কাঠটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো । কি মনে করে চুলের পাঞ্চ ক্লিপটা খুলে ফেললো । চুলগুলোকে মুক্তি পেয়ে থলথল করে ছড়িয়ে পড়লো নিশির কোমড় ঢেকে নিতম্ব পর্যন্ত । মেঘের মতো কালো চুলগুলো নিশিকে আড়াল করে দিল । নিশি চুপ করে রাতের নিরবতা আর মিষ্টি শীতল হাওয়া অনুভর করতে লাগলো । চোখ বন্ধ করে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস টেনে নিল । যেন এতক্ষণ শ্বাস নিতে না পেরে দাপড়াচ্ছিল । এক মিনিট… দুই মিনিট… তারপর কয়েক মিনিট সময় নিল নিশি । এরপর আর অপেক্ষা না করে চোখ খুলল নিশি । সাথে সাথে চোখ থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়লো অশ্রুধারা । আটকালো না নিশি । কোনো প্রকার চেষ্টাই করলো না থামার । মিথ্যে হাসির মাঝে অনেক আড়াল করে রেখেছে নিজেকে । আজ আর মিথ্যের হাসির ভীরে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না নিশির । ইচ্ছে তো করছে আজ মনের সব কষ্ট অশ্রু বিসর্জন দিয়ে তার সাথে ঝড়িয়ে ফেলতে । আর তাই করছে নিশি ।
—চাঁদ দেখছো?
হঠাৎ কারো কণ্ঠে চমকে উঠলো নিশি । পেচন ফিরে তাকালো না । কণ্ঠ শুনেই বুঝে গেছে কে দাঁড়িয়ে আছে । নিঝুম… । চোখের পানি মুছে নিলো । কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বললো,
—হুম ।
—এত রাতে? তাও একা?
এবার নিশি আর কোনো উত্তর দিল না । ওর সব কথা যেন গলায় এসে দলা পাকিয়ে আটকে গেছে । নিঝুম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশির দিকে । সূর্য যেমন মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে তেমনি এখন নিশিকে মনে হচ্ছে । ওর মেঘের মতো চুল দিয়ে নিজেকে আড়াল করে ফেলেছে । রহস্যময়ী যেন…
নিঝুম নিঃশব্দে নিশির পাশে এসে দাঁড়ালো । নিশি নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে । নিঝুম একপলক তাকালো নিশির দিকে । তারপর চোখ সরিয়ে নিল । দৃষ্টি মেলে দিল আকাশে । আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
—আজকে কেন আকাশে মেঘ জমেছে?? সব সময় তো সূর্যই হাসে ।
নিশি হুট করে নিঝুমের দিকে ফিরে তাকালো । একদম সামনে এসে দাঁড়ালো । চোখে চোখ রেখে বললো,
—জানতে চাও কেন আকাশে মেঘ জমেছে??
নিঝুম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুধু । নিশি চোখে জল নিয়ে মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—শোনার পর হয়তো এই মুখটা আর দেখতে চাইবে না ।
নিঝুম চমকালো না। মুখে কিছু বললোও না । ধীরে ধীরে নিশির হাতটা ধরলো শুধু । খুব শক্ত করে । শীতল দৃষ্টিতে তাকালো । নিশি দেখলো সেই দৃষ্টিতে কি যেন আছে । বলতে লাগলো,
—আজ থেকে সাত বছর আগে আমার….
.
.
.
চলবে??
(বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন ।)
.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে