সোনার কন্যা পর্ব-০৮

0
240

#সোনার_কন্যা
#পর্ব৮
#রাউফুন

শনিবার সন্ধ্যার কথা। নুরিশা সন্ধ্যার পর সবে বই সামনে নিয়ে বসেছে। তম্বন্ধে তার চাচাতো ভাই আর বোন এসে হাজির হলো। একজনের নাম নীতি আর একজনের নাম নুহাশ! নীতি ক্লাস নাইনে পড়ে, আর নুহাশ ক্লাস সেভেনে। ওরা দুজনেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে উত্তেজিত হয়ে জড়িয়ে ধরলো।

‘ইয়েএএ আমি আগে ধরেছি, আমি আগে ধরেছি আমার ডার্লিংকে!’

‘নুহাইশ্যা তুই না আমি আগে ধরেছি!’

‘ডার্লিং বলো তো, তোমায় কে আগে জড়িয়ে ধরেছে?’

‘তোরা কেউই না।’ নুরিশা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো! নুরিশা জানে এরা কতটা বিচ্ছু। দেখা গেলো এটাকে কেন্দ্র করেই ঝগড়া বাঁধিয়ে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। নীতি নুরিশাকে আবার জাপটে ধরলো। আদুরে ভঙ্গিতে বললো,

‘নুরি আপা, কেমন আছো?’

‘এই ছাড়, ছাড় আমার গলায় লাগছে তো! আস্তে ধরবি তো নাকি?’

‘আস্তেই ধরলাম তো। তোমার গলায় কি হয়েছে দেখি?’গলা থেকে হাত সরাতে সরাতে বললো নীতি।

‘কিছু না, তার আগে বল তোরা কখন এলি?’

‘সেকি! ডার্লিং তুমি জানো না কিছু?’ বললো নুহাশ।

‘না ভাই, বল না কি হয়েছে?’

‘আজ তোমাকে দেখতে এসেছে ডার্লিং।’ নুহাশ মুখ গোমড়া করে বললো।

‘কিহ? দেখতে এসেছে মানে?’

‘উম্ ওমনি না? তুমি বুঝতে পারছো না?’

‘না নীতি, তোরা এতো রহস্য না করে বল না কি হয়েছে?’

‘আজকে তোমাকে পাত্র পক্ষরা দেখতে এসেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে।’

‘দেখতে এলেই কি বিয়ে হয় নাকি? বাড়িতে এতো কিছু হয়ে গেছে আর আমাকে কেউ কিছুই বলেনি? এসবের মানে কি?’

‘শুধু তাই না আপা, যদি তোমায় পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে যায় আজ ই আকদ পড়িয়ে রাখবে। জেঠা খোঁজ নিয়েছে, ছেলে ভালো। আমি ছবি দেখেই আমি ক্রাশ খেয়ে ফেলছিলাম। বাস্তবে আরও কি যে সুন্দর বাপরে!’

‘তুই নাইনের পুচকি মেয়ে, ক্রাশের কি বুঝিস রে?’

‘আমাকে এতোটাও বাচ্চা ভেবো না নুরি আপা। আমাদের ক্লাসের মীরা কত গুলো প্রেম করে, তোমার কোনো আইডিয়া আছে?’

‘না নাই বোন। এখন যাহ তো আমার অনেক পড়া বাকি!’

‘পড়বে কি, এখন তো তোমাকে সাজাতে হবে। জেঠি আমাকে তোমায় রেডি করিয়ে দিতে বললো!’

‘সত্যিই পাত্রপক্ষ এসেছে আমাকে দেখতে?’

‘হ্যাঁ গো। এই নুহাশ যা তো আপার হবু বরের ছবি তুলে আন গিয়ে!’

‘আমার তো ঠেকা। তুই যা। আমাকে আমার ডার্লিং কে দেখতে দে। কতদিন পর দেখলাম। ডার্লিং তুমি যে কি সুন্দর হইছো! পাত্রপক্ষ তোমায় দেখলে ছেড়ে তো যাবেই না, খুটি গেড়ে বসবে। আমার কলিজায় আঘাত করবে আজকে এরা!’

‘এই পাজি, আপার হবু বর যদি শোনে তুই আপাকে ডার্লিং বলিস তোকে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস?’

‘এয়্যাহ আমি ছেড়ে দেবো ভাবছিস কেন? সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আমার ডার্লিং কে আমার থেকে আলাদা করতে চাইছে ওকে আমি ছেড়ে দেবো ভেবেছিস?’

‘ওরে আমার চিকনা আইছে রে। তোর তার সামনে দাঁড়ানোর মুরদ আছে কি না সেটা আগে ভাব। হাতি গেলো কত তল, মশা বলে কত জল!’

‘নীতির বাচ্চা, আর একটা কথা বললে তোরে আমি খামচি দিমু!’

‘দে দে খালি। আমিও আম্মাকে ডেকে আনবো।’

‘আম্মা তোর চাইতে আমাকে ভালোবাসে বেশি জানিস না? দোষ তোরই হবে, আম্মার ঝাড়িও তুই খাবি।’

‘হো আম্মা তো উপরে উপরে আমারে দেখতে পারে না। তুই তো জানিস না, তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিলো আব্বা! তুই ময়লার স্তুপে পড়ে ছিলি!’

‘তোকে কুড়িয়ে এনেছে। আমাকে না!’

নীতি রেগে গেলো। সে বাঘিনীর ন্যায় এগিয়ে গিয়ে নুহাশের চুল টেনে ধরলো।

‘তুই সব সময় আমার পেছনে কেন লাগিস? শয়তান একটা! জঘন্য! তুই ভাই হওয়ার যোগ্যতায় রাখিস না। বদমাশ!’

‘আর তুই, তুই তো খয়রাতি। তুই আমার আপা হলি কি করে? একটা হিংস্র সিংহী তুই!’

মুহুর্তের মধ্যেই নীতি আর নুহাশের মধ্যে চুল টানাটানি যুদ্ধ লেগে গেলো। কেউ কাউকে ছাড়ছে না। এদের ঝগড়া দেখে নুরিশা বিরক্ত হয়ে দুইজনকেই রাম ধমক দিলো, ‘এই তোরা থামবি….? মাথা খারাপ করে দিচ্ছিস আমার! এমনি আমার মাথা কাজ করছে না। বেরো আমার ঘর থেকে! দুইটার একটাও যদি ঘরে থাকিস, পি’টি’য়ে বের করবো! এমনি আমার মাথা কাজ করছে না কি করবো না করবো ভেবে পাচ্ছি। পাগল হয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে তোদের ঝগড়া!’

নীতি আর নুহাশ নুরিশাকে হাউমাউ করে কাঁন্না করতে দেখে দুইজনই মা’রামারি থামিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।

‘কি হয়েছে আপা, এই দেখো আমরা আর মারামারি করবো না৷ তুমি কেঁদো না প্লিজ!’

নুরিশা তাজফির কথা মাথায় আসতেই কাঁন্না করে দিয়েছে৷ এমন বিপর্যয় সে কিভাবে সামলে উঠবে? এদিকে তাজফির খোঁজ নেই গত দুই দিন থেকে।কোথায় গেছে লোকটা কে জানে? নুরিশা জানে ক’দিন পর পর লোকটার উঁধাও হওয়ার রোগ আছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার ঘটনার পর তো একবার খোঁজ নিতে পারতো তার? লোকটা এমন বেপরোয়া কেন? আর আজকের এই ঘটনা তো লোকটা জানতেও পারবে না। কিভাবে সামলাবে সে সবটা? সবটা ভেবেই সে ভেঙে পড়ছে।

‘আপা বলো না প্লিজ! কি হয়েছে? কাঁদো কেন? আমরা আর দুষ্টুমি করবো না তোমার সাথে! কেঁদো না প্লিজ!’

‘আমি এই জন্য কাঁদছি না। আমার ফাইনাল এক্সাম ও শেষ হতে দিচ্ছে না, এখনি আমার উপর চাপ প্রয়োগ করছে। বিয়ের জন্য পাত্র দেখছে! আমাকে মানসিক ভাবে ভেঙে, গুড়িয়ে দিচ্ছে! এসবের আগে একবারও আমার থেকে শুনলো না? না শুনেই নিজেরা নিজেরাই সবটা ডিসাইড করে ফেললো!’

‘তুমি কি কাউকে পছন্দ করো আপা?’

‘ডার্লিং আমায় বলো, আমি তোমার জন্য সব করবো!’

‘তোরা একটু আমাকে একা থাকতে দিবি?’

‘কেন তোমাকে একা কেন থাকতে দেওয়া হবে? এখনো রেডি হওনি তুমি?’ কথা বলতে বলতে রিক্তা ভেতরে প্রবেশ করলেন।

‘আম্মা এসব কি হচ্ছে? কাল আমার পরীক্ষা আছে ভুলে গেলে? আমার পরীক্ষার মধ্যে এসব শুরু করেছো তোমরা? এক ফোঁটাও কান্ডজ্ঞান নেই তোমাদের? এতে যে আমার উপর মানসিক ভাবে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে তা কি জানো?’

‘কিচ্ছু করার নেই। তোমার দাদীর শেষ ইচ্ছে, তোমার বিয়ে দেখতে চান তিনি!’

‘দাদির ইচ্ছের জন্য তো আমি আমার জীবন বিসর্জন দিতে পারবো না। আমি পাত্র পক্ষের সামনে যাবো না। ওদের বিদেয় করো এক্ষুনি যাও!’

রিক্তা মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন! মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে নীতি আর নুহাশকে ইশারায় চলে যেতে বললেন৷ নুরিশা আহ্লাদ পেয়ে শব্দ করে কাঁন্না করতে লাগলো।

‘কি হয়েছে মা? আমরা তো তোমার উপর চাপ প্রয়োগ করছি না। তোমার দাদী বৃদ্ধ মানুষ, তার কথা রাখতেই আমাদের এরকম পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। তাছাড়া তোমার বাবা, তোমার চাচা খোঁজ নিয়ে দেখেছে। ছেলেটা খুব ভালো। কোনো ব্যাড রেকর্ড নেই তার। যদি তাদের পছন্দ হয় তবে তোমাদের আজ রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করিয়ে রাখা হবে। তোমাকে তো আর আমরা আজ ই উঠিয়ে দিচ্ছি না। এক দুই বছর পর তোমাকে তুলে দেবো তাদের হাতে। এতে সবাই রাজি আছে!’

‘আম্মা, আমি এখনি বিয়ে করতে চাই না। আমার এই বিয়েতে মত নেই। আমাকে এখনি অন্যের উপর চাপিয়ে দিও না আম্মা। তোমাদের কাছে আমি বোঝা হয়ে গেছি এখনি? কেন করছো এসব আম্মা?’

‘তোমাকে এমন বিপর্যস্ত কেন লাগছে? তুমি কি কাউকে পছন্দ করো? নির্ভয়ে বলো! মা সবটা সামলে নিবো!’

নুরিশা কি যেনো ভাবলো। তার ছোট্ট মাথায় সেদিন সন্ধ্যার কথা মাথায় আসছে। সেদিনের কথা জানালে যদি বিয়েটা ভেঙে যায় তবে সে এই কথায় জানাবে তার মাকে। কিন্তু কিভাবে? সে তো একটা ভুল করেছে। এটা ভুল না শুধু, সে তার পরিবারের প্রতিটি মানুষের বিশ্বাস ভেঙে খাঁন খাঁন করে দিয়েছে। এরপর সে কোন মুখে মাকে বলবে এসব?

‘আম্মা, আ-আ-আমি আসলে!’

‘ভাবি, তাঁরা তো বসে আছে। আমাদের নুরিকে আনুন!’

‘বিভা তুমি যাও আমি ওকে তৈরি করে নিয়ে আসছি!’

‘আচ্ছা, ভাবি আসুন।’

বিভা চলে যাওয়ার আগে একবার নুরিশার দিকে তাকালেন। উনার কেমন অস্বাভাবিক লাগলো নুরিশাকে। তবুও বাইরে মেহমান বসিয়ে রেখে তিনি থাকতে পারলেন না। তারাহুরো করে চলে গেলেন।

‘আম্মা আমার ভয় করছে! আমি যাবো না।’

‘পাগলি মেয়ের কথা শোনো। সামনে তো যেতেই হবে। না হলে ওদের সামনে আমাদের নাক কা’টা যাবে। তুমি কি সেটাই চাও?’

‘আমার কথা ছিলো তোমার সঙ্গে!’

‘সব শুনবো। এখন এই নাও শাড়ীটা পড়ে নাও।’

নুরিশা বিষন্ন মনে শাড়ী হাতে নিয়ে অসহায় মুখে তাকালো মায়ের দিকে।

‘জলদি করো!’

রিক্তা নুরিশার কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

নুরিশা ধপ করে বিছানায় বসে অশ্রু ছেড়ে দিলো। কি করবে এখন সে? কিভাবে খবর পাঠাবে তাজফির কাছে। আজ যদি সত্যিই আকদ হয়ে যায়?

নুরিশা মায়ের তাড়া পেয়ে শাড়ী পড়ে নিলো। শাড়ী পড়া শেষে নুরিশা সামান্য চুল আঁচড়ে সামনে দিয়ে দিলো। ঘাড়ের দাগ টা দেখা যাচ্ছে। এটা তাজফি ভাইয়ের দেওয়া লাভ বাইটের চিহ্ন। এটা যদি কোনো ভাবে কারোর নজরে পড়ে যায়?

নুরিশাকে দেখে সবাই পছন্দ করে ফেললো। এমন সুন্দরী মেয়েকে দেখে কার সাধ্য আছে অপছন্দ করবে? ছেলেটার নাম সুবাশ। সুবাশের চোখ যেনো সরছে না নুরিশার দিক থেকে। এক ধ্যাঁনে তাকিয়ে রইলো সে।

‘তাহলে ভাই সাহেব, ছেলে আর মেয়ে একটু আলাদা কথা বলুক। ওদের ও তো কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন!’

‘হ্যাঁ তা তো প্রয়োজন আছে। যাও নুরিশা সুবাস বাবাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও! কথা বলে আসো দুইজনে।’

চাচা শফিউল্লাহর কথায় উঠে দাঁড়ালো নুরিশা। রাগে ক্ষোভে বিষিয়ে যাচ্ছে তার মন। এই লোকটার সঙ্গে এখন তাকে আলাদা কথা বলতে হবে? নুরিশা আগে আগে চলে গেলো। পেছন পেছন সুবাশও গেলো। রুমে ঢুকে নুরিশা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।

সুবাশ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো, ‘আপনার এই ক্ষোভের কারণ কি মিস? বলা যাবে?’

নুরিশা অবাক হলো। প্রথম কথায় এভাবে শুরু করলো? তাছাড়া সে রেগে আছে এই লোকটা বুঝলো কি করে?

‘আপনাকে কে বললো আমি রেগে আছি?’

‘আমি মানুষের মুখ দেখেই তার মনের কথা বুঝতে পারি! বলুন এই ক্ষোভ কেন?’

‘আপনাদের কি আক্কেল জ্ঞান নেই? আমার যে পরীক্ষা চলছে এইচএসসি তা সম্পর্কে কি আপনারা অবগত নন?’

‘আপনার পরীক্ষা চলছে? কই একবারও তো আপনার চাচা কথাটা বললো না!’

নুরিশা চুপ করে রইলো। চাচার এই বাড়াবাড়ি তার একদম সহ্য হচ্ছে না। একটি বারের জন্যও সে তাকালো না সুবাশের দিকে। দু চোখ দিয়ে তার যেনো আগুন ঝড়ছে।

‘আপনি এখনো বললেন না, এই বিরাগ কেন!’

‘বলবো না। কি করবেন?’

‘বলে দেখতে পারেন। আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি যদি!’

নুরিশা ভাবলো এই লোকটাকে সে তার পছন্দের কথা বলবে কি না। বললে যদি সে নিজেই বিয়ে ভেঙে দেই তাহলে তো আরও ভালো হবে।

‘আমার একজনকে পছন্দ। বলতে পারেন বয়ফ্রেন্ড আছে!’

‘এখন থেকে আর থাকবে না। কারণ আমিই আপনার ফিউচার হবো। আগে কে ছিলো তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। আজই আমি আপনাকে বিয়ে করবো। তৈরি হয়ে নিন।’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে