সোনার কন্যা পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
347

#সোনার_কন্যা
#পর্ব১১ (অন্তিম পর্ব)
#রাউফুন

‘আব্বা, আমার কাছে আসবেন না। আমার কাছে আসলে আমি নিজেকে এক্ষুনি শেষ করে দিবো! ভাবেন একবার, আপনি কি চান আমার জীবন না আপনার জেদকে বহাল তবিয়তে রাখতে চান? আমি তাজফি ভাইকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না, শুনে রাখেন কান খুলে। আমার রাগ আর জেদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনি অবগত আব্বা? আমি যা বলি তা করেই ছাড়ি। এখনো বলছি সময় আছে।’

মতিউর রহমানের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। একমাত্র কন্যা তার। এভাবে তো তার জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন না তিনি। তার সোনার কন্যার জন্য তিনি জীবনের সবটুকু জেদ জলাঞ্জলি দিয়ে দিতে পারেন। নুরিশা হাতের ছু’রিটা তখনও গলায় ধরে রেখেছে। মেয়ের এমন রাগ আর জেদ সম্পর্কে সবাই অবগত। তথাপি বেশি উচ্চবাচ্চ করতে পারলেন না কেউ-ই। রিক্তা এক পাশে মুখে আঁচল চেপে ডুকরে উঠে কাঁদছেন। বিভা নানা রকম ভাবে তাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন। ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে সকলে। নীতি আর নুহাশ ওদের আপার এমন কান্ডে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। বাবা আর বড় চাচার এমন ভয়াবহ রূপ তারা আগে কখনোই দেখেনি।

‘ভাইজান, নুরিশা আপনারে ভয় দেখাইতাছে। আপনি ভয় পাবেন না। নিজের জীবন নেওয়া এতো ইজি না।’

চাচার কথা শেষ হতে না হতেই নুরিশা হাতে চাকু বসিয়ে টেনে দিয়েছে৷ হাতের ফিংকি দিয়ে শিরশির করে রক্ত ফ্লোরে গড়িয়ে পড়লো৷ হাহুতাশ করে উঠলো উপস্থিত সকলে। বিশেষ করে মতিউর রহমান। তাজফিকে মেয়েটা এতোটা ভালোবাসে? মতিউর রহমান এর চোখে পানি। তবে কি তিনি অনেক বড় ভুল করে ফেললেন? মতিউর রহমান এগিয়ে আসতে নিলে হাতের উলটো পাশে আবার ছুড়ি বসালো নুরিশা। অনেক কষ্টে বললো,

‘আব্বা, আপনি আমাকে তাজফি ভাইয়ের সঙ্গে বিয়া দিবেন কি না বলুন? যদি রাজি না হোন, তাহলে আমি নিজেকে আরও আঘাত করবো। আপনি আমাকে হারাবেন। আর আমার কাছে আসবেন না। আমি তাহলে আরও হাত কা’ট’বো, না নাহ, এবারে আমি সোজা গলায় কা’ট’বো।’

এরকম একটা ঘটনায় হতভম্ব রিক্তা আর বিভা ছুটে আসতে চাইলেন, কিন্তু নুরিশা কম্পনরত গলায় আবারও বললো,’খবরদার আম্মা, তুমি যদি আমার কাছে আসো তবে আমি আরও আঘাত করবো নিজেকে।’

‘ছু’ড়ি ফেলে দাও। আমি রাজি তোমার কথায়!’

‘নাহ এভাবে হবে না। আপনি কথার খেলাফ করতে পারেন আব্বা। আপনি আমার মৃত দাদির নামে শ্বপথ করে বলুন আপনি আমার আর তাজফি ভাইয়ের বিয়ে দিবেন!’

মহা বিপাকে পড়ে গেলেন মতিউর রহমান। শফিউল্লাহ ভাইকে দেখে বুঝে গেছেন তার ভাই মেয়ের খারাপ অবস্থা সহ্য করতে না পেরে রাজি হয়ে যাবেন। তিনিও নুরিশাকে ভালোবাসেন নিজের সন্তানদের মতো। তাই তিনিও নুরিশার ক্ষতি চান না। মতিউর রহমান গম্ভীর মুখে বললেন,

‘ঠিক আছে, আমি আমার মৃত মায়ের নামে শ্বপথ করছি ঐ বেকার, মেরুদণ্ডহীন ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো। এবারে ছু’রি রাখো।’

নুরিশা কথাটা শোনার পর শুষ্ক ঠোঁট জোড়া বাকা করে হাসলো। মনে মনে বললো, ‘আপনি তো এই কসম দেওয়ার খেলাটা শুরু করেছেন আব্বা, আর আজ আমি সেটা শেষ করলাম আপনাকে মাত দিয়ে৷’

কিয়ৎক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সেখানেই লুটিয়ে পড়লো নুরিশা। তার হাতের অবস্থা ভয়াবহ। র’ক্তে রঞ্জিত হলো ফ্লোর। তার বন্ধ হওয়া চোখের পাতা গড়িয়ে অশ্রু কনারা ঝড়ে পরলো। বিভা আর রিক্তা দৌঁড়ে এলেন।

‘আমার মেয়েকে বাঁচাও তোমরা।’

রিক্তা বেগম চেঁচিয়ে উঠে জ্ঞান হারালেন। বিভা ব্যস্ত হতে পড়লেন তাকে নিয়ে। মতিউর আর শফিউল্লাহ্ কাছের হসপিটালে নিয়ে গেলেন নুরিশাকে। তার ভালো ভাবে চিকিৎসা করানো হলো। বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে অনেক বড় কিছু হতে পারতো যদি ক্ষ’তটা গভীর হতো।

সপ্তাহ খানেক পরের কথা। তাজফি তখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে নুরিশার বাড়ি আসছে। রাত সারে নয়টা বাজে। এতো দিনে নুরিশা জানতে পেরেছে তাজফির বয়স্ক দাদু আছেন, যিনি গ্রামে থাকেন। উনি কাল গ্রাম থেকে নাতীর বিয়েতে এটেন্ড করবেন। গ্রামে তাজফির দাদুর অনেক সায়-সম্পত্তি! তাছাড়া স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে তার কবর রেখে কোথাও যান না। সেখানেই তিনি সুখ খুঁজে পান। নুরিশা তাজফির ঠিকানা জোগাড় করে তার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলো। সেদিন তার মুখে দাদুর কথা শুনে গোল গোল চোখে তাকিয়ে ছিলো।

‘আপনার দাদু আছে, আর সেটা আজ জানতে পারছি? আপনি তো আগে সব সময় বলতেন আপনার তিন কুলে কেউ নাই!’

‘আমিও জানতাম না। আমার আব্বা, আম্মা বিয়ে করেছিলেন আমার দাদার অমতে। আমার দাদি মেনে নিতে পারেন নি তাদের। ছেলের এমন একটা কাজের জন্য তিনি সেসময় রেগে বলেছিলেন, “আমি ম’ই’রা যাওনের পর তুই তোর বউরে এই বাড়ির চৌকাঠে আইনা দাঁড় করাস। আমার নিঃশ্বাস থাইকতে তোর বউরে আমি মাইনা নিমু না। আর যদি এই বাড়িত আসোস তাইলে আমার ম’র’ন দেখবি!’’ আমার দাদা ছিলেন বউ ভক্ত। আমার আব্বার জন্য মন পুড়লেও তিনি তার বউর মুখের উপর কথা বলেন নাই। আব্বা আম্মাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। অনেক কষ্টে শহরের এসে নিজেদের সংসার গড়ে তুলেন। আব্বা যখন যে কাজ পেতেন সেটাই করতেন। আমি যখন আমার আম্মার গর্ভে তখন আব্বা ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষিত হয়ে মা’রা যান। দাদি নাকি নীরবে কাঁদতেন আব্বার জন্য। একটাই ছেলের সঙ্গে, তিনি এতোটা কঠোর না হলেও পারতেন। আফসোসে পুড়তেন সব সময়। আমি তখন অনেক ছোট, আমাকে নিয়ে আম্মা হলেন দিশেহারা। নানা নানির বাড়ি হলো আমাদের থাকার জায়গা। আম্মা ওখানে কাজের বুয়ার মতো খাটতেন৷ কারণ নানা নানিরাও মেনে নেন নি তাদের অমতে বিয়ে করায়। আমি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম সবটা, আম্মার কষ্ট আমার চোখে সহ্য হতো না। ঐ বাড়ির সবাই আম্মার সঙ্গে যে ব্যবহার টা করতো, বোধহয় একটা নে’ড়ে কুকুরের সঙ্গেও ওতো জঘন্য ব্যবহার করা হতো না।

আম্মা আমাকে সব সময় তাদের সব গল্প বলতেন। বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করে তিনি সব হারিয়েছেন। আমি যেনো এমন কিছু না করি। কিন্তু কখনোই তিনি দাদা দাদির গ্রামের বাড়ির কথা বলেন নি। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আম্মা নড়ে না। সুস্থ সবল মানুষ, সকালে উঠে নেই। বুঝলাম আম্মাও আমার একা করে চলে গেলেন। আম্মা তো সম্পুর্ন সুস্থ ছিলো জানো বালিকা? হঠাৎই আম্মার মৃ’ত্যুটা মানতে পারি নি। আমি দশ বছর বয়সের ছোট্ট ছোকরা। মামা, নানা, নানির অত্যাচার সইতে না পেরে আমি ঐ বাড়ি ছাড়ি। তাদের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেছিলো। আস্তে আস্তে নিজেই কাজ করতে থাকি, চায়ের দোকান, খবরের কাগজ বিক্রি করা, ফুটপাতে বসে ফুল বিক্রি করা, রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে কুলি গিড়ি করতাম। আর আমার স্কুলে ভর্তি হওয়া টা ছিলো অকল্পনীয়। আমাকে একজন হি’জ’ড়া স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। আমি তার কাছেও যাই। আমি এখন উনার কাছেই আছি। উনাকে আমি মিশু খালাম্মা বলে ডাকি ছোট থেকেই। কত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি আমি জানি। আমার অনার্সে ভর্তির পর দাদা আমার খোঁজ পান৷ আমার খোঁজ কিভাবে পেয়েছেন, কি করে পেয়েছেন আমি জানি না। দাদা কখনো বলেননি আমাকে। আমিও জিজ্ঞেস করিনি। মাঝে মধ্যে দাদা আমাকে কল দিতেন। সেদিন যখন হুরমুড়িয়ে তোমাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম,তখন আসলে আমার কাছে আমার দাদির মৃ’ত্যু’র খবর আসে। তাই ছুটে গেছিলাম। যতোই হোক র’ক্তের টান তো আছে। এরপর প্রায় ই আমি দাদার কাছে যেতাম। তবে দাদার থেকে আর্থিক সাহায্য নিতে আমার বাঁধতো। আমি মনে করি আমি বরাবরই একা, নিঃস্ব মানুষ।’

‘আমাকে জানালে কি হতো?’

‘এসব জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি, বুঝলে বালিকা? তা বলো, কেন ডেকেছো? আশেপাশে তোমার বজ্জাত, বাপ চাচা নাই তো?’

নুরিশার চোখে তখন পানি চিকচিক করছে। নুরিশা নিজেকে দমিয়ে সহাস্যে বললো,

‘আরে আপনার সাহস তো কম না। আপনি আমার সামনে বসে থেকে আমার আব্বা আর চাচাকে বজ্জাত বলছেন?’

‘তো বজ্জাত, নির্দয় না হলে কি তারা আমাকে ওভাবে মা’র খাওয়াতে পারতো? আমার পায়ের কি হাল হয়েছে দেখেছো?’

‘আব্বা বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছেন। আপনি এখন আব্বার কাছে যেতে পারেন।’

‘আরেব্বাস, এই অসম্ভব কে সম্ভব করলে কি করে?’

নুরিশা তাজফির কাছে সবটা বলতে বলতে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিলো। তাজফি আচানক সেদিন তাকে দুই হাতে জাপটে ধরেছিলো। নুরিশা লজ্জা পাচ্ছিলো সেদিনের কথা ভেবে।

তাজফির নুরিশার বাড়িতে পৌঁছাতে দশটা বেজে গেলো। কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এখন আর তাজফি ভয় পাচ্ছে না। সে এর আগেও দুদিন এসেছে। এসে মতিউর রহমানের মুখ ঝামটা সহ্য করেছে। তাকে দেখে তাজফি গা জ্বালানো হাসি দিয়েছে। নুরিশা দরজা খুললো, কপট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘আসতে এতো দেরি হলো?’

‘হাঁটতে ব্যাথা পাচ্ছিলাম তো।’

‘একটা রিকশা নিতে পারতেন!’

‘আমার কাছে একটা টাকাও নেই।’

নুরিশার চোখ আবারও ভিজে উঠলো। এই মানুষ টার সাথে সে কিভাবে সংসার করবে? এতো বেখায়ালি আর বেপরোয়া হলে চলে?

রোজকার মতোই মতিউর রহমান গম্ভীর মুখে এদিকে সেদিক তাকিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে রিক্তাকে বলে গেলেন চা দিতে। তাজফি আর নুরিশা পাশাপাশি বসলো।

‘এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আনো তো বালিকা।’

নুরিশা চলে গেলো পানি আনতে। রিক্তা বেগম এলেন তাজফির সঙ্গে কথা বলতে।

‘বাবা ভালো আছো?’

‘ভালো আছি আন্টি। আপনারা সবাই ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ, ভালো আছি। তোমার পায়ে এখনো ব্যাথা পাও?’

‘হ্যাঁ ব্যাথা লাগে!’

তাজফি মুখ গোমড়া করে বললো। রিক্তা বেগম মলিন মুখে চা নিয়ে চলে গেলেন স্বামীর রুমে।
চা দিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,’আজকে এখানে খেয়ে যেও৷ যেহেতু কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না তাই কাউকেই দাওয়াত দেওয়া হয়নি। তোমার দাদুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমরা সবাই। তুমি তো বললে উনি কাল আসবেন! তাই কালই বিয়ে হচ্ছে!’

তাজফি লজ্জা পেলো। রিক্তা বেগম বললেন,’তোমাকে কি চা দিবো বাবা?’

‘দিন!’

নুরিশা পানি নিয়ে এলো তখন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রিক্তা বেগম চলে গেলেন চা আনতে। মেয়েটার মধ্যে এখনো বাচ্চা সুলভ আচরন আছে অনেকটা। তা না হলে সপ্তাহ খানেক আগে কেউ ওমন ভয়াবহ কাজ করে? এতো ভালো মেয়েটার এমন মতিভ্রম কবে হলো?

‘আম্মা আপনাকে খেয়ে যেতে বলছেন?’

‘হ্যাঁ বলেছেন।’

‘আজও খাবেন না তাই না?’

‘খাবো!’

‘যাক খুশি হলাম শুনে। তা আজ খেতে রাজি হলেন যে?’

‘আজ আন্টির চোখ মুখে আমার জন্য গভীর মাতৃত্ব দেখেছি। আর তার কথা অগ্রাহ্য করার অধিকার আমার নেই। আচ্ছা, তোমার কি রঙের শাড়ী পছন্দ? আগেই বলে দিচ্ছি একটা সস্তার শাড়ী তোমার বিয়েতে দেবো। আমার যা সামর্থ্য আছে তাতেই একটা শাড়ী কিনেছি। বেনারসি শাড়ি, লাল রঙের মধ্যে সবুজ রঙের কারুকাজ। অনেক সুন্দর দেখতে।’

নুরিশার আবার চোখ ভিজে উঠছে। এতো খুশি কেন লাগছে? কাল থেকে এই মানুষ টা তার হবে, একান্তই তার। আর কোনো বাঁধা বিপত্তি নেই। দুনিয়ার কেউ তাদের দিকে আর বাকা চোখে তাকাতে পারবে না।

‘নুরিশা চা নিয়ে যাও!’

‘আমি চা আনছি বসুন!’

নুরিশা উঠে গেলো। তাজফি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো৷ বাড়িটা অসম্ভব সুন্দর। এতো সুন্দর বাড়ি এই তল্লাটে নেই। রেহান আর আনিকা কোথা থেকে যেনো এলো। আনিকা তাকে দেখে হেসে বললো,’আরে তাজফি ভাই, কি অবস্থা? আপনাকে তো দেখা যায় না।’

‘আমার অবস্থা দেখতেই পারছেন ভাবি। আপনারা কোথা থেকে এলেন?’

‘আমরা তো আমাদের বাড়ি গেছিলাম। আমার আম্মার জ্বর করেছে খুব তাই তাকে দেখতে গেছিলাম। আর কাল আমার এক মাত্র ননদিনীর বিয়ে তাই রাতেই চলে এলাম। আম্মা এখন কিছু টা সুস্থ আছেন।’

আনিকা আরও কিছুক্ষন গল্প করে চলে গেলো। রেহান আর তাজফি আড্ডা দিতে লাগলো। তাদের মাঝের বন্ধুত্ব ঠিক সেই আগের মতো। সেই প্রথম দিনের মতোই সে মনে করে নুরিশা তাজফির কাছে সবচেয়ে নিরাপদে থাকবে। তার বোন তাজফির কাছে যতটা ভালো থাকবে এমন কোথাও আর সে ভালো থাকবে না। তাই তো সে নিজে সুবাশ নামক ছেলেটাকে বারণ করে দিয়েছে নুরিশাকে বিয়ে দেবে না সেখানে। সুবাশ শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলেছিলো। রেহান স্পষ্ট দেখেছিলো সুবাশের চোখে তার বোনের জন্য দূর্বলতা রয়েছে। তবুও তার এখানে কিছু করার ছিলো না। কারণ তার বোন যে তাজফিকে মন থেকে ভালোবাসে। তাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারতো না।

রাতের খাবার সবাই এক সঙ্গে খেলো। তাজফি প্রথমবার এতো তৃপ্তি করে খেয়েছে। রিক্তা বেগমকে একটু পর পর চোখ মুছতে দেখেছে তাজফি। মায়েরা বোধহয় এমনই হয়।

‘এখনি যাবেন তাজফি ভাই?’

‘হ্যাঁ, সারে এগারোটা বাজে। অনেক রাত হলো।’

‘বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে।’

‘হোক, আমি একটা রিকশা নিয়ে চলে যাবো!’

‘আপনার কাছে তো টাকা নেই বললেন!’

‘বাসায় টাকা আছে, আমার সঙ্গে নেই শুধু। ওখানে গিয়ে টাকা দিবো! কিছু বলবে?’

নুরিশা মাথা নত করলো। মাথা নত করে বললো, ‘আজকে আমি সাজুগুজু করেছিলাম। আপনি কি তা লক্ষ্য করেন নি?’

‘করেছি!’

‘তাহলে প্রশংসা করতে এমন কার্পণ্য বোধ করার মানে কি?’

‘আমি যে প্রশংসা করতে পারি না বালিকা।’

মন খারাপ করে বললো, ‘আচ্ছা, আপনি যান!’

‘সত্যি কথা বলবো?’

‘বলুন!’

‘আজকে তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘এয়্যাহ?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমার হি’টলার বাপের জন্য এখানে থাকাটা রিস্ক। দেখা গেলো আগামীকাল এখান থেকে আমার লাশ বের হচ্ছে। বউ নিয়ে আর যা-ওয়া হচ্ছে না।’

‘তাজফি ভাই, সব সময় বাজে কথা।’ রেগে গেলো নুরিশা।

‘আজ থেকে যান না তাজফি ভাই! বৃষ্টিতে ভিজবেন না।’

তাজফি আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই৷ সে নুরিশা কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

‘আজ এখানে থাকলে দ্বিতীয় বার তোমার সর্বনাশ হবে বালিকা।’

‘কি হবে?’

‘তোমায় ছুঁতে ইচ্ছে হবে। আমার হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হওয়া প্রেমের বিষে তুমি দগ্ধ হবে। এই বৃষ্টি ভেজা রাতকে মনে হবে আলোকজ্জ্বল, চাঁদনী রাত। আমার বুকের খাঁচায় লুকিয়ে রেখে তোমার হৃদস্পন্দনের শব্দ গুনতে ইচ্ছে হবে। তখন অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দেবো। কথা বলার জন্য ঘরের এই কোণ থেকে ঐ কোণ ছুটাছুটি করবো। তুমি তখন বারণ করতে পারবে না। তোমার দু-চোখ আমাকে আগ্রাসী করে তুলবে। তোমার এই নিরবতার মধ্যে লুকিয়ে থাকবে হাজারো গীতিকথা! আমাকে বেপরোয়া করে দেবে, আর তুমি দগ্ধ হবে প্রেম অনলে, সোনার কন্যা!’

‘আমি আপনার প্রেমে দগ্ধ হতে চাই তাজফি ভাই! আজ থেকে যান!’

তাজফি মুচকি হেসে গান ধরলো। গান গাইতে গাইতে সে হাঁটা ধরলো।

“একটা ছিল সোনার কন্যা
মেঘ বরণ কেশ,
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ
দুই চোখে তার আহারে কি মায়া
নদীর জলে পড়ল কন্যার ছাঁয়া
তাহার কথা বলি
তাহার কথা বলতে বলতে নাও দৌঁড়াইয়া চলি!

কন্যার ছিল দীঘল চুল
তাহার কেশে জবা ফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করল ভুল
কন্যা ভুল করিস না
ও কন্যা ভুল করিস না

আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না
হাত খালি গলা খালি
কন্যার নাকে নাকফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করল ভুল
এখন নিজের কথা বলি

নিজের কথা বলতে বলতে
নাও দৌঁড়াইয়া চলি
সবুজ বরণ লাও ডগায়
দুধসাদা ফুল ধরে
ভুল করা কন্যার লাগি
মন আনচান করে
আমার মন আনচান করে।”

নুরিশা দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিলো তার প্রিয়তমকে।
ভালোবাসলে টান টা দুজনের দিক থেকেই থাকতে হয়। আর যে সম্পর্কগুলোতে পরস্পরের ওপর একে ওপরের বিশ্বাস আর ভালোবাসা থাকে সেই সম্পর্কগুলোই পূর্ণতা পায়। নুরিশা মনে করে তাদের দুজনের প্রতি এই টান আজীবন, শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থেকে যাবে।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে