সে ফিরে আসবেই পর্ব-০৮

0
1106

#সে_ফিরে_আসবেই
#৮ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



রাতে মানহার গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো।ঠান্ডাও লেগে বসেছে ঝাঁকিয়ে। এখনও মা মা করছে মেয়েটা।
আচ্ছা আমি কী করবো বলুন তো?
আত্মীয় স্বজন সহ ওর সব বন্ধুদের বাসায় খুঁজ করেছি। কোথাও নীলা নেই।কেউ তার খবর জানে না। এদিকে তমালের ঠিকানাও আমি জানি না।
মানহার জন্য আমি কী করবো এখন?মেয়েটা তো মা মা করে শেষ হয়ে যাচ্ছে!
একটু আগে ডাক্তার এসেছিলেন বাসায়। তিনি অষুধ পত্তর দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু যাওয়ার সময় বলে গিয়েছেন,’অষুধ পত্তরে তো কাজ হবে না বাবা। মেয়ের মা ছাড়া মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে না কিছুতেই!আর তুমি তো ওকে জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারবে না। এমনকি অষুধও না। তোমার মেয়ে খুব জেদি!’
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর মাকে ফোন করেছিলাম। শাশুড়ি মা নয়। আমার নিজের মাকে।
মা আমার গলা শুনেই আন্দাজ করে ফেললেন কিছু একটা। তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠে বললেন,’কী হয়েছে বাবা? কোন সমস্যা?’
আমি ধরা গলায় বললাম,’মা মানহার অবস্থা ভালো না! কিছু খাচ্ছে ধাচ্ছে না। সারাদিন মা মা করে কাঁদছে!’
মা স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,’নীলা কোথায়?কী হয়েছে?ঝগড়া করেছিস তোরা?’
আমি মার কাছে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না।মাও অসুস্থ।তার হার্টের সমস্যা। মাকে কী টেনশন দেয়া উচিৎ? তবুও সবকিছু মার কাছে খুলে বললাম।
মা শুনে শান্ত গলায় বললেন,’কেন ওর কথাগুলো শুনিসনি তুই?কেন?রাগের মাথায় কোন কিছু করা কী ভালো?ধর তুই মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছিস।আজ অংক পরীক্ষা।তো হলো কী তোর কোন অংকই মনে পড়ছে না।মনে হচ্ছে তুই কিছুই পারবি না! এখন কী করবি তুই? রেগেমেগে আগুন হয়ে খাতা ছিঁড়ে খুঁড়ে হলের ভেতর ফেলে রেখে আসবি?
মোটেও না। এটা করলে সারা জীবন তোকেই পস্তাতে হবে। তোকে যা করতে হবে তা হলো ঠান্ডা মাথায় বসে ভাবতে হবে।মনে করতে হবে সবকিছু। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। আস্তে আস্তে তখন দেখবি সবকিছু সহজ হয়ে উঠছে।তুই সবকিছুই পারছিস!আর এটা তো তোদের জীবন। নীলা তোর স্ত্রী। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি সম্পর্ক ওর সাথে তোর!ওর সাথে এমন করাটা তোর খুব ভুল হয়েছে!’
আমার খুব খারাপ লাগছে।কান্না পাচ্ছে। নিজের উপর নিজেরই রাগ লাগছে।আমি অসহায়ের মতো করে মাকে বললাম,’মা আমি কী করবো বলুন তো! আমার আর সহ্য হচ্ছে না।মেয়েটাও মা মা করতে করতে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে।জ্বর উঠেছে গা কেঁপে।ঠান্ডাও লেগেছে। এখনও মা মা করছে।সিরাপটা পর্যন্ত মুখে তুলছে না।’
মা তখন কঠিন গলায় বললেন,’বাবা হওয়া কোন সহজ কাজ না রে ফাহাদ!বড় কঠিন কাজ! এখন তোরা বড় হয়েছিস। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাচ্চাই রয়ে গেছিস!তোর ছোট্ট একটা ভুলের কারণে তোর মেয়েটা ঝুঁকির মুখে! নীলা যদি রাগ করে কোথাও চলে যায়,আর না ফিরে তখন মেয়েকে কী জবাব দিবি তুই?আর তোর কাছ থেকে মানহার অবস্থা শুনে তো মনে হচ্ছে ও ঝুঁকিতে আছে। আচ্ছা আল্লাহ না করুন ওর যদি কিছু হয়ে যায় তখন তুই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি কোন ভাবে?’
মার কথাগুলো আর ভালো লাগছে না।আমি ফোন রেখে দিয়ে কাঁদতে বসেছি।চোখ থেকে টপটপ করে জল‌ গড়িয়ে পড়ছে আমার!নির্বোধ বালকের মতো দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।আর ভাবছি,একটা ভুল তিন তিনটে জীবন এলোমেলো করে দিতে পারে কীভাবে!

মানহা জ্বর নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।আমি খুব সাবধানে ওকে ঘুমে রেখেই ড্রপার দিয়ে ওর মুখে সিরাপ পুরে দিলাম।মানহা টের পেলো না।ওর শরীর খুব গরম হয়ে গেছে।কপালে জলপট্টি দেয়া প্রয়োজন। শরীরটাও ঠান্ডা পানি দিয়ে একটু মুছে দিলে ভালো হবে।তাপটা কমবে।

মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে হঠাৎ দূর্বল গলায় মানহা বলতে লাগলো,’মা,মা পানি খাবো!’
আমিও তখন আধঘুমে। বসে বসেই ঝিঁমুচ্ছিলাম। মেয়েকে এমন অসুখে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারিনি বলেই বসে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। তখন কিছুটা তন্দ্রাভাব আমার চোখেও এসেছিল।তাই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।মানহার দূর্বল আর শুকনো গলা শুনে ঝট করে ঘুম ভেঙ্গে গেল।আমি তাড়াহুড়ো করে তৎক্ষণাৎ বিছানা থেকে নেমে ওর জন্য গ্লাস ভর্তি ঠান্ডা পানি নিয়ে এলাম।
মানহা পানি মুখে নিয়েই হড়হড় করে বমি করে দিলো। পেটে তো আর কিছু নাই। সামান্য পানিই বের হয়েছে বমি হয়ে।
এবার মানহা কেমন ছটফট করছে।বলছে,’মা,ও মা শরীর জ্বলছে!’
আমার তখন হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় একটি হাদীসের কথা। আমাদের নবী সাঃ ওখানে মায়ের অধিকারের কথা তিনবার বলেছেন।আর বাবার কথা বলেছেন একবার। আগে এই কথাটির গুরুত্ব বুঝিনি। একবার এ নিয়ে তর্কও করেছিলাম মার সাথে। বলেছিলাম,বাবারা যেখানে অর্থনৈতিক সবকিছুর যোগান দেয়, সংসারের দেখভাল করে, ছেলে মেয়ের ভরণপোষণের সব দায় দায়িত্ব নেয় সেখানে মার অধিকার বেশি হয়ে গেলো কী করে?
কিন্তু আজ আমি বুঝতে পারছি সবকিছু। মায়ের হাতের শীতল স্পর্শ কিংবা মায়ের ওমের মতো পৃথিবীর আর কোন আরামদায়ক বস্তু নেই।এমনকি জান্নাতের মূ্ল্যও মায়ের চেয়ে কম।কম বলেই মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত।আমি কী করলাম এটা! একটা ছোট্ট সন্তানকে তার জান্নাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। আল্লাহ আমায় এর জন্য কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। কিছুতেই না!

সে রাতে আমার আর ঘুম হয় না।মানহার ছটফটানি আমার বুকের ভেতর ঝড় তুলে।ওর দিকে তাকিয়ে থাকি আমি বোকার মতো।মানহা এখন আর মা মা বলছে না।তার শরীর অতি দূর্বল হয়ে পড়ছে।কথা বলার কিংবা কাঁদার আর শক্তি নেই তার শরীরে!
আমি কিচেনে গিয়ে ওর জন্য নুডুলস করে নিয়ে আসি।ও স্যুপ আর নুডুলস খুব পছন্দ করে।নুডুলস করেছি এই জন্য যে জ্বরের মুখে হয়তোবা ঝালটা ওর ভালো লাগবে। কিন্তু নুডুলস করে এনে ওর মুখে দিতেই ও মুখ সরিয়ে নিয়ে বললো,’তিতে।বাজে লাগছে!’
আমি ওকে সান্তনা দেই।বলি ,’মা একটু খাও শুধু।খেলেই সুস্থ হয়ে যাবে।’
মানহা দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বলে,’খাবো না।’

রাত কাবার হয়ে এলে মানহা আবার ঘুমিয়ে পড়ে।ওর দিকে তাকানো যায় না।পরীর মতো ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটার চেহারার কী হাল হয়েছে! চোখের নীচে কেমন কালি জমে গেছে।মুখটা মলিন হয়ে আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে জন্মরোগা মেয়ে!
আমি ওর ঘুমন্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলি,’মা আমি শিগগির তোমার মাকে খুঁজে বের করবো। এমনকি সে যদি সুদূর সুইজারল্যান্ড চলে যায় ওখানেও যেতে আমি রাজি। তোমার মাকে আমি তোমার কাছে ফিরিয়ে আনবোই আনবো!সে ফিরে আসবে। শিগগির ফিরে আসবে!

ফজরের আজান হলে আমি উঠে অজু করি।বহু বহুদিন পর ফজরের নামাজ পড়তে বসি।মনে প্রশান্তির এক ঢেউ খেলে যায় তখন। নামাজ শেষে খোদার দরবারে কেঁদে কেঁদে আর্জি পেশ করি।বলি,’হে রহমান অর রহিম।তুমিই তো পৃথিবীর মানুষদের পালনকর্তা।তুমিই রোগ নিরাময়কারী।তুমিই তো ভাঙ্গা হৃদয়, আর ভাঙ্গা সংসারের জোড়া দানকারী! মাবুদ গো, আমার ছোট্ট মেয়েটা অসুখের দখলে ছটফট করছে।ওর মাকে আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে নিরাময় দান করো। এবং তুমি দ্রুত তার মাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে এনে দাও। আমি ভুল করেছি।আমি পাপিষ্ঠ। আমার পাপের শাস্তি তুমি আমার পবিত্র, মাসুম মেয়েটাকে দিও না!’
দোয়া শেষ হতেই হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। মুহূর্তে আমার ভেতরটা কেমন নাড়া দিয়ে উঠে।ডিসপ্লেতে তাকিয়ে দেখি মা ফোন করেছেন। ফোন রিসিভ করতেই মা ও পাশ থেকে বলেন,’তুই তো অত সকালে সজাগ থাকস না। আজ সজাগ কীভাবে? কল দেয়ার আগেই রিসিভ করে ফেললি!’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,’মা,আজ নামাজ পড়ছি।’
মা তখন খানিক হেসে বললেন,’যা তোর অপরাধ কিছুটা মার্জনা করা গেলো।আজ আটটার ট্রেনে করে তোর বাসায় আসছি ইনশাআল্লাহ!’
কেন আসছেন হঠাৎ করে? আগে বলেননি কেন আসবেন?এসব বলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এসবের কিছুই বলতে পারলাম না আমি। কেন জানি আমার ভীষণ ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। মোবাইল ফোন গালে চেপে রেখেই আমি কেঁদে উঠলাম।


#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে