সে আমারই পর্ব-৮+৯

0
288

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৮

আফরান তো এসেছেই সাথে তূরাগ কেও টেনে নিয়ে এসেছে। আফরান কে দ্যাখা মাত্রই ছোট্ট বন্যা তার গলা ধরে ঝুলে পড়ল। আফরান তাকে বগলদাবা করে একে একে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে নিল। মিসেস সীমা তাকে দেখে গদগদ হয়ে বললেন,

“তুই এসেছিস! ডাক্তার হয়ে যাবার পর তো তোর আর দ্যাখাই পাওয়া যায় না। ভুলেই গিয়েছিস খালামনি কে।”

আফরান তাকে আলতো আলিঙ্গন করে বলল,

“খালামনিকে কীভাবে ভুলে যাই? তাই তো ছুটি নিয়ে চলে এলাম। আগে থেকেই বলে দিচ্ছি দুপুরে এবং রাতে খেয়ে তবেই ফিরব। রান্না বসাও।”

মিসেস সীমা খুব খুশি হলেন। দুই জা মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রান্নার আয়োজনে।
আজ শুক্রবার হওয়ায় ফাহাদ আবরার এবং রামিজ আবরার বাড়িতেই আছেন। আফরান আড়ালে তূরাগকে চোখ টিপে ফাহাদ আবরারের পাশে বসে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,

“শ.. আই মিন আঙ্কেল কেমন আছেন?”

ফাহাদ আবরারের মুখ থমথমে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আফরানের আগমনে তিনি খুশি হননি। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“ভালো।”

আফরান হাসল। রামিজ আবরার হাসি মুখে তার সাথে টুকটাক কথা বললেন। তূরাগের সাথেও আলাপ করিয়ে দিল আফরান। অতঃপর বলল,

“খালামনির কাছে শুনলাম আপনার প্রেশার হাই থাকে সব সময়। একবার হাসপাতালে গেলেও তো পারেন।”

ফাহাদ আবরার তাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন,

“তার কোনো দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।”

“তা কি করে হয়? আপনার খুব কাছের একজন আত্মীয় হওয়ার সুবাদে এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি যাওয়ার সময় আপনার চেক আপ করে যাব।”

ফাহাদ আবরার গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। তার এসবে কোনো আগ্রহ নেই।
বর্ষণ ঘর থেকে বেরিয়ে তূরাগ কে দেখে হা করে চেয়ে রইল। তূরাগের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখতে লাগল। তূরাগের অস্বস্তি হলো খুব। তাও জোর পূর্বক বসে রইল। পর মুহূর্তে বর্ষণ চেঁচিয়ে উঠল,

“উরিম্মা! এতো বড় রকস্টার আমাদের বাড়িতে! আমি স্বপ্ন দেখছি। হায় আল্লাহ্!”

তূরাগ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মৃদু হাসল। এভাবে রিয়্যাক্ট করার কি আছে? আফরান তার মাথায় চাটি মেরে বলল,

“ঠিকই দেখছিস। রকস্টার তূরাগ ইততেয়াজ সশরীরে তোদের বাড়িতে উপস্থিত আছে।”

বর্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। ফিরে এলো হাতে কাগজ কলম নিয়ে। চকচকে চোখে তাকিয়ে বলল,

“আপনার আমি অনেক বড় ফ্যান। টিভিতে কত দেখেছি। ভাবতেও পারিনি আপনাকে সামনাসামনি কখনও দেখতে পাব। অটোগ্রাফ প্লিজ।”

তূরাগ হাত বাড়িয়ে কাগজ কলম নিয়ে অটোগ্রাফ দিল। এতে বর্ষণের পোষাল না। অনুরোধের কন্ঠে বলল,

“আপনার সাথে একটা সেলফি নিতে পারি? স্কুলের বন্ধুদের দ্যাখাব।”

আফরান তাকে গুঁতো দিয়ে বলল,

“বাচ্চা ছেলে একটা সেলফি চায়ছে। দিয়ে দে।”

তূরাগ রাজি হলো। বর্ষণ বলল,

“এখানে ছবি ভালো হবে না। চলুন ছাদে যাই।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তূরাগ তার সাথে গেল। বাচ্চা ছেলে, তার মন খারাপ করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। ছাদে গিয়ে সেলফি তুলল কয়েকটা কিন্তু বর্ষণের মন মতো হলো না। তার থেকে তূরাগ অনেকটা লম্বা হওয়ায় ঠিক জমছে না। মুখ কালো করে ফেলল সে। হঠাৎ গুনগুন করে গানের শব্দে ছাদের অপর পাশে গেল তারা। দেখল ফারনাজ গুনগুন করছে আর ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। তূরাগ ফারনাজ কে দেখেই বিরক্ত হলো। মুখে ফুটে উঠল তা। বর্ষণ ডাকল,

“নাজ আপু! দ্যাখো আমাদের বাড়িতে কে এসেছে!”

ফারনাজ মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। তূরাগকে দেখে মুখ ভঙ্গি অতি স্বাভাবিক রেখে বলল,

“কে এসেছে?”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকাল। ফারনাজ কি তাকে দেখল না? সে কি অদৃশ্য? বর্ষণ অবাক কন্ঠে বলল,

“এই যে রকস্টারকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না?”

ফারনাজ আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বলল,

“এতে আমি নাচানাচি করার মতো কিছু দেখছি না। তোর রকস্টার তুই পানি দিয়ে গিলে খা।”

তূরাগের চোয়াল কিঞ্চিত শক্ত হলো। ইচ্ছে করল এই মেয়ের চশমা খুলে কানের নিচে চটাস চটাস কয়েকটা দিতে। বর্ষণ বলল,

“ধুর! তুমি সব সময় মজা করো! শোনো না নাজ আপু? আমার রকস্টারের সাথে কয়েকটা ছবি তুলে দেবে?”

“না, পারব না।”

“দাও না প্লিজ? আমি আমার বন্ধুদের দ্যাখাব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ?”

ফারনাজ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। নিজের ফোন তাক করে বলল,

“ঠিক হয়ে দাঁড়া।”

বর্ষণ ঠিকঠাক হয়ে তূরাগের পাশে দাঁড়াল। তূরাগ মুখ গম্ভীর করে রাখল। ফারনাজ মনে মনে ভেংচি কাটল,

“পাথর মানব কোথাকার!”

হঠাৎ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলতেই কৌশলে ফোনের স্ন্যাপচ্যাট অ্যাপে ক্লিক করল। বিভিন্ন স্টিকার দিয়ে জুম করে কেবল তূরাগের ছবি তুলল। মনে মনে সে হেসে কুটিকুটি হলো। তবে বাইরে থেকে একদম স্বাভাবিক থাকল। একটু পর বলল,

“তোর ওই ফোনটা দে। আমার ফোনে ছবি ভালো আসছে না।”

তূরাগ মহা বিরক্ত হলো। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে এভাবে? বর্ষণ ফোন এগিয়ে দিলে সে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে দিয়ে দিল। তূরাগ ছাদ থেকে নেমে গেল তৎক্ষণাৎ। ফারনাজ কুটিল হেসে বলল,

“আমার ফোন ভেঙেছিলেন না? এবার আপনার এই ছবি দিয়ে মজা দ্যাখাব আপনাকে। নাকানিচুবানি না খাওয়ালে আমার নাম ফারনাজ আবরার নয়, হুহ।”

আফরান এসেছে শুনে দৃষ্টি দোর দিয়ে রুমে বসে আছে। ওই লু’চু ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছে’ই তার নেই। সে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে। বই পড়ার জন্য হলেও তাকে কেউ বিরক্ত করবে না।
দরজায় নক পড়ার শব্দে সে বই থেকে মুখ তুলল। এখন আবার কে এলো? কন্ঠস্বর উঁচিয়ে বলল,

“কে? পড়ছি আমি।”

“দৃষ আপু, আমি।”

বন্যার কন্ঠ শুনে সে নিশ্চিন্ত হলো। বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দিল। মাথা নিচু করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কিছু বলবি? ভেতরে আয়।”

“অবশ্যই। কেন নয়? বন্যা তুমি যাও, তোমার জন্য যে চকলেট গুলো এনেছি ওগুলো খাও। আর ভাইয়ার সাথে শেয়ার করবে। ঠিক আছে?”

আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আফরান। দৃষ্টি চমকাল। বন্যা ঘাড় কাত করে হেলতে দুলতে চলে গেল। সামনে স্বয়ং আফরান দাঁড়িয়ে আছে ভেবেই দৃষ্টি দ্রুত দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হলেই আফরান শক্ত পোক্ত হাতে দরজা আটকে ফেলল। অতঃপর দরজা ঠেলে প্রবেশ করে নিজেই দরজা লক করে দিল। দৃষ্টি ঢোক গিলে নিজেকে সামলে শক্ত কন্ঠে বলল,

“আপনি এখানে কেন? এক্ষুনি বেরিয়ে যান রুম থেকে।”

আফরান এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। চশমা দ্বারা আবৃত ওই তীক্ষ্ম চোখ জোড়ায় দৃষ্টি কখনও তাকাতে পারে না। আফরান মৃদু কন্ঠে বলল,

“কখন থেকে বসে আছি। তোর দ্যাখা নেই। রুমের মধ্যে ঘাপটি মে’রে বসে আছিস কেন?”

দৃষ্টি মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার ইচ্ছে, আমি রুম থেকে বের হবো কি হবো না।”

আফরান খুব আয়েশ করে দৃষ্টির বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। দৃষ্টি হতভম্ব। সে এগিয়ে গিয়ে চাপা কন্ঠে বলল,

“আশ্চর্য! আপনি এখানে শুয়ে পড়লেন কেন? উঠুন, আর বাইরে যান।”

“তোর ইচ্ছে তুই বাইরে যাসনি, আমারও ইচ্ছে আমি এখানে শুয়ে পড়েছি।”

“দেখুন আফরান ভাই! বাবা..”

আফরান দৃষ্টি কে হাতের কাছে পেয়ে সুযোগ ছাড়ল না। হেঁচকা টানে তাকে নিজের উপর ফেলল। দৃষ্টি শ্বাস রোধ হয়ে আসতে চায়ল। উঠে যেতে নিলেই আফরান শক্ত করে হাত চেপে ধরল। এক হাতে তার সামনের চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

“তোর বাপ বাড়িতে নেই। জামাইয়ের জন্য বাজার করতে গিয়েছে। তাই সে আসবে না তার জামাইয়ের কাজে ব্যাগড়া দিতে।”

দৃষ্টি ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। জামাই বলতে আফরান কাকে বুঝিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। সে মোচড়া মুচড়ি করে বল,

“ছাড়ুন আমাকে।”

“আরে এখন তো ছেড়েই দেব। কিন্তু যখন ধরার মোক্ষম সময় হবে তখন তুই ছাড় পাবি না রে দৃষ। তুই তখন ফি’নিস একদম!”

আফরান আরও কিছু বলতে চায়ল কিন্তু মিসেস বিউটির কন্ঠস্বরে বাঁধা পড়ল।

“দৃষ! কি করছিস তুই রুমে বসে? বাইরে দ্যাখ আফরান এসেছে আর তার ভাই এসেছে। সে আবার রকস্টার। আয় তাদের সাথে কথা টথা বল।”

দৃষ্টি কীভাবে বলবে? যে তাদের পেয়ারের আফরান তার রুমেই চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে? তাকে শ্বাসও নিতে দিচ্ছে না। সে জোর পূর্বক আফরানকে ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,

“আমি পড়ছি, ছোট মা। একটু পরেই বের হচ্ছি। তুমি যাও।”

চলবে..
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৯

আফরান কে বাঁচাতে মিথ্যে বলে দৃষ্টি ফেঁসে গেল। আফরান তাকে ক্ষণে ক্ষণে খোঁচাচ্ছে।

“কি রে! তুই তো সত্যিটা বলতেই পারতিস। যে আমি তোর রুমে ঢুকে তোকে..”

“চুপ করুন আপনি। আপনার কথা বলে দিলে কি ভাবত সবাই? আপনি আর আমি দরজা বন্ধ করে কি করছিলাম?”

আফরান দুষ্টু হেসে দৃষ্টির গা ঘেঁষে বসে। কন্ঠস্বর নামিয়ে বলে,

“সবাই দেখে নিলে খুব ভালো হতো রে। তোকে ধরে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিত। আর সত্যি বলছি আমি একটুও রাগ করতাম না।”

দৃষ্টি বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

“আপনার এসব ফালতু কথা বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই না? চুপচাপ বসবেন নাহয় এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন।”

“আহা! রাগ করিস কেন? রাগ করলে তোর নাক লাল হয় জানিস? আর ইচ্ছে করে..”

দৃষ্টি তার মুখ চেপে ধরল। ধৈর্য্যহীন হয়ে বলে,

“আপনি দয়া করে আপনার মুখের লাগাম টানুন। মানুষ এতোটা ঠোঁট কা’টা হয় কীভাবে?”

আফরান সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দৃষ্টির হাতের পাতায় ঠোঁট ঠেসে ধরল। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বলল,

“আমি তো লাগামেই আছি রে দৃষ। এতেই তোর সহ্য হচ্ছে না? আর যখন লাগাম ছাড়া হবো তখন সহ্য করবি কীভাবে?”

দৃষ্টির কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। ভেতরে ভেতরে লজ্জায় নুইয়ে পড়লেও বাইরে প্রকাশ করে না। হাত টেনে সরিয়ে নেয়। বলে,

“ডাক্তার আর লেকচারার হয়েছেন কি করতে? এই চ্যাপ্টার বুঝিয়ে দিন।”

আফরান হতাশ শ্বাস ফেলে। হা হুতাশ করে বলে,

“তোকে যা বোঝাতে চাই তা তো বুঝবি না। শুধু পারবি নাকে দড়ি দিয়ে আমাকে ঘোরাতে।”

দৃষ্টি ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইল। তার যে পেট ফেটে হাসি আসছে, তা বোঝার বিন্দু মাত্র উপায় নেই। আফরান আর উপায় না পেয়ে বই মেলল। তার এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে বাসর ঘরেও বলবে ‘এই চ্যাপ্টার বুঝিয়ে দিন।’ আর তার বাসর মাঠে মা’রা যাবে।

দুপুরে খাবার পর ফারনাজ নিজের রুমে বসে তূরাগের ছবি গুলো দেখছে আর হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। বন্যা তার রুমে এসে বলল,

“নাজ আপু! তোমাকে নিচে ডাকছে।”

ফারনাজ হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

“পরে যাব। আগে এদিকে আয় তোকে মজার কিছু দ্যাখাই।”

বন্যা দুই লাফে ফারনাজের কাছে গেল। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“কই দেখি?”

ফারনাজ তাকে তূরাগের কিছু ছবি দ্যাখাল। বন্যা হি হি করে হেসে উঠল। হাসল ফারনাজও। সেই মুহূর্তে এক কন্ঠস্বর পাওয়া গেলে,

“কি করছ তোমরা, নাজ আপু?”

ফারনাজ না তাকিয়েই বলল,

“বর্ষণ এদিকে আয় তোকে একটা জিনিস দ্যাখাই।”

বর্ষণ রুমে প্রবেশ করে বলল,

“পরে দেখব। আমি এখন রকস্টার কে বাড়িটা ঘুরিয়ে দ্যাখাচ্ছি। এই দেখুন, এটা হলো নাজ আপুর রুম।”

তূরাগের কথা কানে আসতেই ফারনাজ এক ঝটকায় ফোন পেছনে লুকিয়ে ফেলল। মুখ তুলে তূরাগের থমথমে মুখশ্রী দৃষ্টিগোচর হলো। বর্ষণ বলল,

“চলুন এবার দৃষ আপুর রুমে যাই।”

তারা প্রস্থান করতে নিলেই বন্যা বলল,

“এই ভাইয়া! দ্যাখো নাজ আপুর ফোনে এই ভাইয়াটার ফানি ফানি ফটো আছে। এসো দ্যাখো।”

ফারনাজ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। এই মেয়ে যে এভাবে হাটে হাড়ি ভেঙে দেবে, তা কে জানত? তূরাগের চলমান পা থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে ফারনাজের চুপসানো মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত করে। সে এগিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কার ফটো? আমার?”

“হ্যাঁ তোমার। খুব ভালো লাগছে দেখতে।”

ফারনাজ ঢোক গেলে বারংবার। ফোনটা সে কিছুতেই ওই লোকের হাতে পড়তে দেবে না। আগেরবার আছড়ে ভাঙার ফলে তার হাজার টাকা খসে গেল ফোনের পেছনে। না, এবার কিছুতেই না। সে ধমকে উঠে বলল,

“কি বলছিস! কোনো ফানি ফটো টটো নেই। যা আমার রুম থেকে বের হ। ঘুমাব এখন। যা, যা।”

তূরাগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বেরিয়ে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ফারনাজ। যাক, তার ফোনটা বোধহয় এবারের মতো বেঁচে গেল।

সুযোগ বুঝে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে ফারনাজের রুমে ঢুকে পড়ল সে। দরজাটা চাপিয়ে দিল সাবধানে। দৃষ্টি নিক্ষেপ করল বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। এই ভোলাভালা মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে কেউ বলবে যে এর পেটে পেটে এত শয়’তানী বুদ্ধি? ফোঁস করে শ্বাস ফেলে তূরাগ এগোয়। না চায়তেও তার ওড়না টেনে ঠিক করে। অতঃপর আশে পাশে কাঙ্ক্ষিত জিনিস খোঁজে, কিন্তু পায় না। না পেরে ফারনাজকে ডাকে সে,

“এই মেয়ে! এই!”

ফারনাজ ঘুমে কাত। তূরাগ বিরক্ত হয়। মানুষ এমন ম”রার মতো ঘুমায় কীভাবে? এখন তো একে তুলে ছুড়ে ফেললেও টের পাবে না। সে তার গালে একটা শক্ত চাপড় দিল,

“এই মেয়ে!”

ফারনাজ লাফিয়ে উঠল। ‘কে’ ‘কে’ করতে করতে পাশে হাতড়িয়ে চশমা নিয়ে চোখে দিল। কাছাকাছি তূরাগকে দেখে চিৎকার করতে নিলেই সে মুখে হাত ঠেসে আটকে দিল।

“চুপ! চেঁচাবে না একদম। লোকে খারাপ ভাববে। আমার কোনো খারাপ ইন্টেনশন নেই।”

ফারনাজ মুখে হাত চাপা অবস্থাতেই কথা বলে। তবে সেগুলো বোঝা যায় না। তূরাগ হাত সরায়।

“আপনি আমার ঘরে এসেছেন কেন? কি উদ্দেশ্য আপনার? হায় আল্লাহ্! আমি তাহলে ঠিকই শুনেছি রকস্টার দের ক্যারেক্টর ঢিলা হয়।”

তূরাগ দাঁতে দাঁত পিষে চাপা কন্ঠে ধমক দেয়,

“আমি তোমার এসব ফালতু বকবক শুনতে আসিনি। ফোন কোথায় তোমার?”

ফারনাজ সতর্ক হয়। তূরাগের অকস্মাৎ তার রুমে হাম’লা করার কারণ মস্তিষ্ক ধরে ফেলে। হড়বড়িয়ে বলে,

“নেই! আমার ফোন নেই।”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে,

“সরো।”

ফারনাজ তার কথা অনুযায়ী বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। তূরাগ বিছানা উল্টে পাল্টে দ্যাখে, কিন্তু পায় না। অতিষ্ট হয়ে বলে,

“কোথায় ফোন?”

“নেই তো।”

তূরাগ তেড়ে আসে। ফারনাজ ভয়ে দেওয়ালে লেগে দাঁড়ায়। তূরাগ তার অতি নিকটে এসে হিসহিসিয়ে বলে,

“বলো ফোন কোথায়?”

সে কাঁপা কন্ঠে বলে,

“ব বলব না।”

তূরাগ তিন আঙুলে তার গাল চেপে ধরে শক্ত করে,

“দ্যাখো ফারনাজ! আমি মোটেও মজা করার মুডে নেই, আর না কখনো থাকি। ভালোই ভালোই বলে দাও ফোন কোথায়, নাহলে চড়িয়ে তোমার গাল লাল করব। বলো!”

ফারনাজের দৃষ্টি ঝাপসা হয়। এভাবে কেউ কখনও তাকে মা’রার হুমকি দেয়নি। গালে ব্যথাও লাগছে। সে ফুঁপিয়ে উঠে বলে,

“আপনি খারাপ। আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান।”

তূরাগ হতভম্ব। হাত সরিয়ে নিল। এইটুকুতে এই মেয়ে কাঁদতে বসল! আশ্চর্য তো! সে বলল,

“যাব। তোমার রুমে থাকতে আসিনি আমি। ফোন থেকে আমার ছবি ডিলিট করো। আমি চলে যাচ্ছি।”

তূরাগের উপর ফারনাজের রাগ হলো খুব। চশমার নিচ দিয়ে চোখ মুছে ওয়ারড্রব থেকে ফোন বের করল। তূরাগকে অবাক করে দিয়ে নিজের ফোন নিজেই সজোরে আছাড় মা’রল সে। তিন টুকরোতে ভাগ হয়ে গেল তা। সে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“এবার শান্তি? ফোনটাই আর রাখলাম না। এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যান। আপনার মতো খারাপ ব্যবহার কেউ কখনও করেনি আমার সাথে। আপনার মুখ কখনও দেখতে চাই না। দরকার পড়লে এই ভাঙা ফোন নিয়ে যান। আপনার কোনো ছবি দরকার নেই আমার।”

তূরাগ থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। সে তো শুধু ছবিগুলো ডিলিটই করতে বলেছিল, তাতে এতো রাগ! নিজের ফোন নিজেই ভেঙে ফেলল! সে বলতে চায়ল,

“শোনো মেয়ে..”

“কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি। আপনি বেরিয়ে যান।”

তূরাগ আর দাঁড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করল না। গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেল। ফারনাজ নিজের ভাঙা ফোনের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চোখের জল ফেলল। তূরাগ কি বুঝতে পারল ফারনাজ তার ফোন ভাঙার থেকে তার কঠোর ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে? তার কোমল হৃদয়ে আঘাত লেগেছে?
কোনো কিছুর শব্দ পেয়ে আফরান এসে দাঁড়িয়েছিল ফারনাজের ঘরের সামনে। শক্ত মুখের তূরাগকে বের হতে দেখে বলল,

“কি হয়েছে রে? শব্দ হলো কীসের?”

তূরাগের মাথায় আগুন। সে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে,

“সেটা ওই বেয়াক্কেল, অভ’দ্র মেয়েকে জিজ্ঞেস কর।”

তূরাগ সোজা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আফরান হা করে দেখে গেল তার প্রস্থান। কি হলো ব্যাপারটা?

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে