সে আমারই পর্ব-৬+৭

0
280

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৬

মেডিকেল কলেজের সবথেকে হ্যান্ডসাম এবং ড্যাসিং বয় আফরান ইততেয়াজ। একদম চকলেট বয়। তার আবার গার্লফ্রেন্ড এর অভাব নেই। আজ একজনের সঙ্গে দ্যাখা যায়, তো কাল আর একজনের সঙ্গে। শেষ বর্ষ ছিল তার। বেশ জমিয়ে মেয়ে নিয়ে ঘুরেছে। তবে ডেটিং প্রর্যন্তই সীমাবদ্ধ। একটু হাত ধরাধরি আর গালে একটা চুমু, ব্যস। অতি ঘনিষ্ঠ হওয়া তার ধাঁচে নেই। তারপর ভালো লাগল না, ছেড়ে দিল। এভাবেই চলে আসছে তার জীবন। আজ সে এসেছে খালামনির বাড়ি। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই। আসবে আর খালামনির হাতের সুস্বাদু খাবার গপগপিয়ে গিলবে। খালামনিকে দ্যাখা মাত্রই তাকে ঝাপটে ধরে বলল,

“ওহহো খালামনি! কেমন আছ তুমি?”

মিসেস সীমা মুচকি হেসে বললেন,

“ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? তোর তো খোঁজই পাওয়া যায় না।”

আফরান ধপ করে সোফায় বসে বলল,

“আর বলো না, খালামনি। পড়ালেখার এতো চাপ! কি খেয়ে ডাক্তারি পড়তে গেলাম কে জানে?”

“এভাবে বলছিস কেন? এই বছরটা গেলেই তো তোর নামের আগে ডাক্তার বসবে। কি ভালোটাই না লাগবে শুনতে বল তো? ডক্টর আফরান ইততেয়াজ!”

আফরান মৃদু হাসে। জিজ্ঞেস করে,

“তোমার ব’দমাশ গুলো কই সব? দেখতে পাচ্ছি না তো।”

“নাজ আর ফারদিন গিয়েছে ভার্সিটিতে। আর দৃষ, কলেজের নবীন বরণে যাবে বলে রেডি হচ্ছে হয়তো।”

আফরান এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“আচ্ছা? আমি দৃষের সঙ্গে দ্যাখা করে আসি। আমিই নাহয় কলেজে নামিয়ে দেব।”

সে সিড়ি বেয়ে চলে গেল। মিসেস সীমা বোনপোর জন্য নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কতদিন পর এলো ছেলেটা! পড়ালেখার চাপে তো আসতেই পারে না।

আফরান দৃষ্টির রুমে নক করে প্রবেশ করার প্রয়োজন অনুভব করল না। সে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল। কোনোদিকে না তাকিয়েই বলল,

“কিরে পিচ্চি! শুনলাম আজ নাকি তোদের কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান! সুন্দরী কোনো মেয়ে পাওয়া যাবে তোদের কলেজে? তবে তোর মতো কচি না, আরও বড় লাগবে।”

“আপনি না সেদিন একটা মেয়ে নিয়ে রেস্টুরেন্টে টাকা উড়িয়ে এলেন? আবার কি?”

আফরান চোখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি কে ড্রেসিং টেবিলের সামনে আবিষ্কার করল। পেছন থেকে তার মুখ দ্যাখা গেল না। সে বিছানায় ধপ করে বসে বলল,

“ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতোই থাক। আর ঢং করে আবার শাড়ি পরছিস কেন? সেই তো লাগবে শ্যাওড়া গাছের পে’ত্নির মতো।”

আফরানের কথায় দৃষ্টি রেগে গেল খুব। হাতে থাকা বক্সটি শব্দ করে রেখে এক প্রকার তেড়ে গেল তার দিকে। এক হাত কোমরে গুঁজে, অন্য হাত নাড়িয়ে বলল,

“দেখুন আফরান ভাই! আমাকে একদম রাগাবেন না। আজ একটা ভালো দিন। আমার কলেজের প্রথম দিন। তাই আমি মোটেও মেজাজ খারাপ করতে চাইছি না।”

আফরান ভড়কে পেছন দিকে একটু ঝুঁকে গেল। দৃষ্টির দিকে চোখ পড়তেই কলিজা ছ্যা’ত করে উঠল। ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। লাল নাকে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা রমনীকে দেখে মুহূর্তেই মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গেল। ফোলানো গালে তাকে আরও আকর্ষণীয় দেখাল। কপাল বেয়ে নামল সরু ঘামের রেখা তার। ঝাঁপসা হয়ে এলো চশমা। অকস্মাৎ নজর আটকাল তার গলদেশের মাঝ বরাবর ধূসর রঙা তিলটির দিকে। আফরান গলায় পানি শূন্যতা অনুভব করল। মনে হলো ওই তিলটি ছুঁতে না পারলে সে এই মুহূর্তে ম’রে যাবে। সে দৃষ্টির হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের উরুর উপর বসাল। শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল কোমর। হকচকিয়ে গেল সে। আফরানের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

“কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে।”

আফরানের কান পর্যন্ত তা পৌঁছাল না। এমন তো আগে কোনো মেয়েকে দেখে হয়নি। আফরান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অধর ঠেকাল ঠিক তিলটির উপর। দৃষ্টির দেহ ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল। খামচে ধরল তার চুল। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় তার দেহ নেতিয়ে পড়ছে। তবে আফরান থেমে নেই। তার গলায় শক্ত একটা কামড় বসিয়ে তবেই থামল সে। মুখ উঁচিয়ে দৃষ্টির মুখের দিকে তাকাতেই দেখল সে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। ঘোর থেকে বের হলো আফরান। থমকাল সে। কি করে ফেলেছে ভাবতেই হতভম্ব হয়ে পড়ল। ঢোক গিলে বলল,

“দৃষ, আমার কথাটা..”

“আপনি খুব খারাপ, আফরান ভাই।”

ডুকরে উঠল সে। আফরানের বড্ড অনুশোচনা হচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটার সাথে এমনটা করা মোটেও ঠিক হয়নি। সে কখনও কোনো মেয়েকে এভাবে ছুঁয়ে দেয়নি। তাহলে দৃষ্টিকে কেন? তার কি হয়েছিল সে নিজেও জানে না। এক হাতে দৃষ্টির চোখ মুছিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,

“দৃষ পাখি! আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। কাঁদিস না প্লিজ।”

দৃষ্টি তাকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। জড়ানো গলায় তেজ ঢেলে বলল,

“আমি ভেবেছিলাম আপনি কেবল বাইরের মেয়েদের সাথেই! কিন্তু আপনি বোনের সাথেও..। আপনার চরিত্র এতো খারাপ! ছিঃ!”

আফরান রেগে গেল। কপালের রগ ফুলে উঠল। তার দিকে তেড়ে গিয়ে শক্ত করে বাহু আঁকড়ে বলল,

“কি করি আমি বাইরের মেয়েদের সাথে? বল! কি করি? শুধু তাদের নিয়ে একটু ঘোরাফেরা করি, ব্যস। তাদের কাউকে আমি ভালোবাসি না, দৃষ।”

অতঃপর এক হাতে তার গাল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“আর কি বললি? বোন! তুই আমার বোন নস, দৃষ। আজ থেকে তোকে আমি বোন বলেই মানি না। বুঝেছিস তুই?”

একটু থেমে তাকে আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলে,

“এভাবে সেজেছিস কেন? হু? ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল। এক্ষুনি সব মুছবি।”

বলেই সে নিজেই পকেটে থেকে রুমাল বের করে দৃষ্টির মুখ ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে। এতে লাল বর্ণ ধারণ করে মেয়েটার মুখ। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বুঝতে পারে না আফরান আজ হঠাৎ এমন করছে কেন? ছোট্ট মন কিছুই বুঝছে না। আফরান সব মুছে ফেলে তবেই ক্ষান্ত হয়। অতঃপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চাপা কন্ঠে বলে,

“আজ তুই কোথাও যাবি না। এভাবে এই শাড়ি পরে তো একদমই না। নো ওয়ে। আমি খালামনিকে বলে দেব যে তোর শরীর খারাপ।”

সে হনহনিয়ে প্রস্থান করে। রাগে সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। দৃষ্টি মুখে হাত চেপে কাঁদে। তার ভালো মানুষ আফরান ভাই এই প্রথম এমন ব্যবহার করেছে। আগে কখনও কারো সাথে সে এমন ব্যবহার করতে দ্যাখেনি। আজ নিজে দোষ করে, দৃষ্টির উপর রাগ দেখিয়ে চলে গেল। দৃষ্টি শাড়ি সহ শাওয়ারের নিচে বসে। আফরানের ঠোঁট ছোঁয়ানো জায়গা অনবরত ঘষতে ঘষতে বিড়বিড় করে,

“আপনি খারাপ, আফরান ভাই। আপনি খুব খারাপ।”

অতিরিক্ত ভেজার ফলে দৃষ্টি ধুম জ্বরে পড়ল। ছোট মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে! মিসেস সীমার মাথায় প্রথমেই আফরানের নাম এলো। সে তো ভবিষ্যত ডাক্তার, এখন নিশ্চয় দৃষ্টির অবস্থা বুঝবে। তিনি তাকে সংবাদ দিলেন। খবর পেয়ে এক প্রকার উড়ে চলে এলো আফরান। এসে দেখল, দৃষ্টি বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। সে নিজেই তার মাথায় জল পট্টি দেওয়া শুরু করল। খেয়াল করল দৃষ্টি ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে। কান এগিয়ে শুনতে পেল,

“আপনি খুব খারাপ, আফরান ভাই। আমি আপনার সাথে আর কথা বলব না।”

আফরান মৃদু হাসে। মিসেস সীমা কে পাঠিয়ে দেয় সুপ আনার জন্য। তিনি চলে গেলে সে ঝুঁকে দৃষ্টির উত্তপ্ত কপালে অধর ছুঁইয়ে বলল,

“আ’ম স্যরি, দৃষ। আমি কখনও কারো সাথে এমন করিনি। আমার কি হয়েছিল আমি জানি না। তুই ছোট এবং খালামনির মেয়ে বলে তোকে কখনও আমি ভালো করে দেখিইনি। কিন্তু কাল শাড়িতে তোকে খুব বড় বড় লাগছিল। আমার বুকে তুই নতুন ব্যথার সৃষ্টি করেছিস, দৃষ।”

অতঃপর সে তার গলদেশে দাগের উপর আলতো বুড়ো আঙুল বুলিয়ে দিল।

তারপর থেকে আফরানের আর কোনো মেয়ে ভালো লাগে না। কারো সাথে ফ্লার্ট করতেও মন চায় না। চারপাশের সব যেন বিরক্তিকর। কোনো মেয়ে তার পেছনে ঘুরলেই সে দূর দূর করে তাড়িয়েছে। ভালো লাগে না তার, ভালো লাগে না। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ওই পিচ্চি মেয়েটাই ঘুরঘুর করতে থাকে। আফরান চোখ বন্ধ করে দৃষ্টির নিষ্পাপ মুখ স্মরণ করে আওড়ায়,

“সব দোষ তোর, দৃষ। সব। তোর জন্যই আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। এ আমার কি সর্বনা’শ করে দিলি তুই? তোকে ছাড়া কোনো মেয়ের কথা ভাবতেই পারছি না। এখন যে এই খারাপ আমি থেকে তোর মুক্তি নেই। আমি তোকে মুক্তি দেব না।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৭

আজ পায়েল এসেছে দৃষ্টির বাড়িতে। মিসেস সীমা অনেক বার করে তাকে আসতে বলেছেন, কিন্তু সে সময়ই পায়নি। আজ সুযোগ বুঝে দৃষ্টির সঙ্গে চলেই এলো।‌ দৃষ্টির রুম থেকে দু’জনে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামল। এখন লাঞ্চের সময়। ডাইনিং টেবিলে বসে তারা টুকিটাকি কথা বলতে লাগল। মিসেস সীমা এবং মিসেস বিউটি রান্না ঘর থেকে খাবার এনে রাখছেন টেবিলে। কথা বলার মাঝেই কেউ এসে পায়েলের পাশে চেয়ার টেনে বসল। পায়েল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ফারদিন কে দেখে চুপসে গেল। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া! ভালো আছেন?”

দৃষ্টি ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসল। ফারদিন ফোন থেকে মুখ তুলে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছি। বসো।”

পায়েল আবার ধপ করে বসে পড়ল। এই ফারদিন কে য’মের মতো ভয় পায় সে। ফারদিন আবার বলে,

“পড়ালেখা চলছে তো ভালো মতো?”

“হ্যাঁ ভাইয়া।”

“গুড। ভালো করে পড়বে। ফাঁকি দেবে না।”

পায়েল ঘাড় বাঁকায়। দৃষ্টিকে হাসতে দেখে চোখ পাকিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“হাসছিস কেন?”

“তো কি করব? এমন একটা ভাব করলি যেন ভাইয়া স্যার আর তুই স্টুডেন্ট।”

“না না, তোর ভাই য’ম আর আমি সাধারণ পা’পী মানুষ।”

দৃষ্টি খিলখিলিয়ে হাসে। বলে,

“এতো ভয় পাস ভাইয়া কে?”

পায়েল দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বলে,

“ভয় পাব না? সে কোন একবার ভাইয়াকে ভুল করে নাজ আপু ভেবে বসেছিলাম। আর বলেছিলাম ‘আপু! আপনি কি যেমন খুশি তেমন সাজো তে নাম দিয়েছেন? একদম ছেলেদের মতো লাগছে।’ সেই যে ধমকটা দিয়েছিল আমাকে ইয়ার! আমি ইহকালে তা ভুলব না। একটু নাহয় গালটা টেনে দিয়েছিলাম, এতে কেউ এমন ধমক দেয়?”

“এতো কীসের কথা হচ্ছে, দৃষ? চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে যা।”

ভাইয়ের কথায় দু’জনে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। পায়েল পাশের য’মদূতের ভয়ে নাকে মুখে গিলে সবার আগেই উঠে গেল।

দৃষ্টি রুমে এসে দেখল পায়েল চার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টিকে দেখেই সে আহাজারি শুরু করল,

“তোর ওই গু’ন্ডা ভাইয়ের ঠ্যালায় আমি একটুও খেতে পারলাম না রে, দৃষ। ইশ! কত মজা হয়েছিল খাবার গুলো। পাশে য’ম বসে থাকলে কি আর ভালো করে খাওয়া যায়?”

“তুই ভাইয়াকে একটু বেশিই ভয় পাস। এটা তোর দোষ, ভাইয়ার না। আর খেতে পারিস নি এটাও তোর দোষ।”

“তুই নিজের ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বললি! এই তুই আমার বন্ধু! আজ থেকে তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি চললাম।”

চললাম বলেও পায়েল শুয়েই থাকল। দৃষ্টি ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“কি হলো? যা!”

“দ্যাখ! আমার এখন প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেই চলে যাব। একদম পাক্কা।”

দৃষ্টি হাসল। জীবনে এতো ব্যথা নিয়েও মেয়েটা কীভাবে এতো হাসি খুশি প্রাণখোলা থাকে সেটাই সে ভাবে।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত যতটা ভালো কেটেছে, তার থেকে খারাপ কাটছে এখন। বাড়ি ফিরতেই বড় চাচির প্রশ্নের মুখোমুখি হলো পায়েল,

“কোথায় গিয়েছিলি? এতো দেরি হলো কেন আসতে?”

পায়েল স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

“সেটা তুমি জেনে কি করবে? আমার ইচ্ছে।”

খেপে গেলেন মহিলা। তেড়ে এসে চুলের মুঠি ধরলেন। কুঁকড়ে উঠে আর্তনাদ করল পায়েল। তিনি বিশ্রী ভাষা দিয়ে বললেন,

“শা’লী! বাপ নাই মা নাই তার আবার তেজ! কারে দ্যাখাস তেজ? বসে বসে অন্ন ধ্বংস করে তেজ দ্যাখাতে আসিস! বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াই পড়াই কি তোর তেজ দ্যাখার জন্য? আজ তোর খাওয়া বন্ধ।‌ কাপড় ভিজিয়ে রেখেছি, সব এক্ষুনি ধুয়ে দিবি। যা, দূর হ।”

ধাক্কা দিলেন। পায়েলের এখন এসব সয়ে গিয়েছে। গায়ে লাগে না। তবে বাবা মা তুলে কথা বললে খারাপ লাগে খুব। সে নিজের ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হাসে। ঘরে ব্যাগ রেখে এসে কল পাড়ে কাপড় কাচতে বসে। সে জানে চাচি এখন তাকে মে’রে ফেললেও কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। তারা সকলে নিরব দর্শক। মজা লুটতে পিছ পা হয় না তারা।
পায়েল কাপড় কাচে আর মৃদু হেসে আওড়ায়,

“আমি শক্ত হলেও এরা শোধরাবে না, দৃষ। যার নিজের মাথার উপরই কেউ নেই তাকে কি কেউ গণ্য করে?”

তূরাগ নিজের ঘরের ব্যালকনিতে বসে গিটারের টুংটাং সুর তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারংবার তার সুর এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বার বার চোখে ভাসছে গোল চশমায় আবদ্ধ চোখ জোড়া। কানে বাজছে কাঁচের চুড়ির টুংটাং শব্দ। তূরাগ অতিষ্ট হয়ে গিটার রেখে দিল। সে সব সময় মেয়েদের থেকে দূরে থাকে। এই প্রর্যন্ত মা,বোন ব্যতীত কোনো মেয়ে তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আর কোথাকার কোন মেয়ে সরাসরি তার বুকে হামলা চালালো! এ এক প্রকার দণ্ডনীয় অপরাধ!
আফরান দুহাতে দুই কাপ কফি নিয়ে ভাইয়ের রুমে প্রবেশ করল। আনমনা ভাইকে দেখে ডাকল,

“তূরাগ!”

তার ভাবনা ভঙ্গ হলো। নড়েচড়ে উঠে বলল,

“হু?”

“এই নে কফি।”

তূরাগ হাত বাড়িয়ে নেয়। আফরান জায়গা দখল করে নেয় তার পাশে। কফিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

“কি ভাবছিস এতো?”

“আচ্ছা ভাই? আমি কি খুব খারাপ গাই? আর আমাকে দেখতেও খারাপ?”

আফরানের ঠোঁট পুড়’তে যেয়েও পুড়’ল না। হা করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”

“বল না?”

আফরান সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,

“তুই কেমন দেখতে এবং কেমন গাস সেটা তোর ফ্যান ফলোয়ারই বলে দিচ্ছে। তোর বা আমার কথাই তা পরিবর্তন হবে না।”

তূরাগ মিনমিন করে বলল,

“তবে ওই মেয়েটা এমন বলল কেন?”

আফরান অবাক হয়ে বলে,

“কোন মেয়ে?”

তূরাগ মুখ কুঁচকে বলে,

“আরে তোর ওই বোন। কত কি না বলল আমাকে! আমি খারাপ গাই, আমাকে দেখতে খারাপ। আমাকে সে শিম্পা’ঞ্জি বলেছে। আমি নাকি গিটার নিয়ে স্টেজে লাফালাফি করি।”

আফরান হো হো করে হেসে ফেলল। হেসে তার গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। সে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

“তুই নাজের কথা বলছিস! সিরিয়াসলি! শোন ভাই, নাজ একটু অন্য রকম। যে যাকে পছন্দ করে তাকে মন প্রাণ দিয়ে পছন্দ করে। আর যাকে পছন্দ করে না, তাকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না। মেয়ে টার মন খুব কোমল বুঝলি তো? দৃষ্টির মতো কঠিন নয়। কেউ রুড বিহ্যাব করলে সে রেগে যায় ভীষণ। আর যত রকমের আজে বাজে কথা সব তার নামে বলে। শুধুই তার সামনে, অন্য কারো না।”

একটু থেমে আবার বলে,

“তুই হয়তো একটু রুড হয়েছিস। তাই এমন বলেছে। সিরিয়াসলি নিস না।”

তূরাগ কিছু বলল না। তবে মেয়েটাকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করল। সে জিজ্ঞেস করল,

“কাল লিভ নিয়েছিস কেন?”

আফরান কফিতে চুমুক দিয়ে একটু থেমে বলে,

“অনেক দিন হলো খালামনির সাথে দ্যাখা করি না। রেগে আছে খুব আমার উপর। তাই তার রাগ ভাঙাতে যেতে হবে। এমনিতেই শশুর আমাকে দু চোক্ষে সহ্য করতে পারে না। তার সামনে দিয়ে একটু ঘুর ঘুর করে আসব।”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“সহ্য করতে পারে না কেন?”

“আর বলিস না! ছাত্র জীবনে এতো মেয়ে নিয়ে ঘুরলাম, কেউ না কেউ ঠিকই ধরে ফেলেছে। একদিন শশুরের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন থেকেই আমার নামটাও তার কানে বি’ষ। যদি জানতাম ওই লোক আমার ভবিষ্যত শশুর হবে তাহলে একটু সাবধানে থাকতাম।”

“শশুর হবে বলে তো মনে হয় না। দেখলাম তো দৃষ্টি তোকে দেখতেই পারে না। কেমন ফোঁস ফোঁস করছিল।”

মুচকি হাসে আফরান। আকাশের জ্বল জ্বল করা নক্ষত্র রাশির দিকে দৃষ্টি তাক করে বলে,

“কোনো উপায় নেই। সে নিজেই নিজের সর্বনা’শ ডেকেছিল। আমি যেচে পড়ে কিছু করিনি। যদি না সে শাড়ি পরত আর না আমি তাকে দেখে হুঁশ জ্ঞান হারাতাম। সে নিজেই আমার মন মস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়েছে। এখন যখন ডক্টর আফরান ইততেয়াজের মাথা খারাপ করেই দিয়েছে, তখন চায়লেও সে আমার, না চায়লেও সে আমারই।”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে