সে আমারই পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
305

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৬

দৃষ্টি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। কানে বোধ হয় ভুল শুনল। ঘুম থেকে মাত্রই উঠে মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছে মনে হলো। নাহলে তার প্রশ্নের জবাবে ফারদিনের এহেন উদ্ভট কথা! কখনোই সম্ভব নয়। সে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কি? কি বললে, ভাইয়া?”

ফারদিন বিরক্ত হয়। তা সম্পূর্ণ মুখশ্রীতে ফুটিয়ে তুলে বলে,

“দৃষ, দ্রুত তোর একটা জামা আর তার সাথে যা লাগবে সব কিছু দে। তাড়াতাড়ি কর। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব? ফ্রেশ হইনি এখনও।”

দৃষ্টি হকচকায়। তবে সে ঠিকই শুনেছিল। কিন্তু তার জামা দিয়ে ফারদিনের কি কাজ? জীবনেও কখনও সে ভাইকে মেয়েদের জামা পরতে দ্যাখেনি। দৃষ্টির মাথাটা ঠিক কাজ করছে না। সে কল্পনা করতে করতে এগিয়ে ওয়ারড্রব থেকে একটা জামা, পাজামা ও একটা ওড়না বের করে দিল। ফারদিন জামা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করল না। তৎক্ষণাৎ লম্বা লম্বা পা ফেলে রুমে প্রবেশ করে দরজা আটল। দৃষ্টি সেদিকে চেয়ে সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলল।

ফারদিন রুমে এসে পায়েল কে পেল না। অর্থাৎ সে এখনও ওয়াশ রুমে আছে। সে এগিয়ে নক করল। গমগমে কন্ঠে বলল,

“পায়েল! তুমি কি ভেতরে আছ?”

ফারদিনের কন্ঠে পায়েল চমকায়। লজ্জায় গুটিয়ে যায়। নিজেকে স্বাভাবিক করে মিনমিনিয়ে বলে,

“ইয়ে মানে, আমি ভুল করে শাওয়ার ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভিজে গিয়েছি। কিন্তু এখন কি করব?”

ফারদিন ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

“ফুল কোথাকার!”

কন্ঠনালিতে আওয়াজ এনে বলে,

“দরজা খোলো। আমি ড্রেস এনেছি।”

পায়েল ভাবুক হলো। এতো সকালে ফারদিন জামা জোগাড় করল কোথা থেকে? জিজ্ঞেস করল,

“আপনি জামা পেলেন কোথায়? আবার আপনার জামা দিচ্ছেন না তো? আমি কিন্তু ওসব পরতে পারব না।”

ফারদিনের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে দরজায় একটা থাবা বসিয়ে বলে,

“আমি এখানে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। আর আমাকেও ফ্রেশ হতে হবে। এক্ষুনি দরজা খোলো আর এগুলো নাও। আর একটা কথা বলেছ তো, দরজা ভেঙে ঢুকব।”

পায়েল ঢোক গিলল। ধীরে ধীরে দরজা একটু খুলে হাত বের করে দিল। ফারদিন কে বিশ্বাস নেই। সে পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু শুধু সে কখনোই হুমকি দেয় না। হাতের নাগালে কাপড় পেতেই তৎক্ষণাৎ হাত ভেরতে এনে দরজা দিল। দেখল একটা থ্রি পিস। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। পরপরই শাওয়ার শেষ করে কাপড় পাল্টে, ফারদিনের কাপড় ধুয়ে বের হলো। ফারদিন সোফায় বসে ছিল। পায়েল বের হতেই তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি স্থির করে উঠে দাঁড়াল। পায়েল বিব্রত হলো। আবারও সে উদাম গায়ে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। ফারদিন ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটিয়ে আরও একটু এগিয়ে গেল। পায়েল যেন নড়তে ভুলে গেল। হাত বাড়াল সে, এক টানে পায়েলের চুল থেকে তোয়ালে ছাড়িয়ে নিল। পরপরই নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“আমি আসার আগে রুম থেকে বের হবে না। কেউ ডাকলেও না। মনে থাকবে?”

পায়েল বহু কষ্টে মাথা দোলায়। দৌড়ে ব্যালকনিতে চলে যায়। ফারদিন কে ওভাবে কাছে আসতে দেখে দম বন্ধ হয়েই যাচ্ছিল তার। উল্টো পাল্টা চিন্তা আসছিল মনে! সে লম্বা একটা শ্বাস নিল। টিশার্ট, ট্রাউজার মেলে দিয়ে রুমে এসে চুপ করে বসে রইল।

ফ্রেশ হয়ে বের হলো দৃষ্টি। টেবিলের উপরে রাখা ফোনটার দিকে নজর যেতেই সে এগোলো। হাতে নিয়ে দেখল রোজকার মতন রেজিস্টার্ড নম্বর থেকে অসংখ্য কল। যেন ব্যক্তিটি বিরক্ত হয় না একটুও। একটি মেসেজও এসেছে। মেসেজটি পড়েই সে থম মে’রে রইল।

“ফোন না ধরে তুই কি বোঝাতে চায়ছিস? তুই আমাকে তোর জীবন থেকে এক্কেবারে আউট করে দিয়েছিস? তবে চোখ খুলে দেখে রাখ, এই আফরান থেকে তোর মুক্তি নেই। আমার সাথে কথা বন্ধ করে কি ভুলটাই না করলি তুই, দৃষ! এর হিসেব আমি দেশে ফিরে গুনে গুনে নেব। এখন ভালো মতন শান্তিতে ঘুমিয়ে নে। তোর ঘুম হারাম করার জন্য খুব শীঘ্রই ফিরব আমি। তারপর? তারপর যে আমি কি করব দৃষ! সেটা আমি এলেই দেখতে পাবি। এখন বলব না কারণ তুই ভীষণ লজ্জা পাবি, আর তোর ওই লজ্জামাখা মুখ দ্যাখার জন্য আমি ওখানে নেই। আর হ্যাঁ! আমি মোটেও ভালো মানুষ নই।”

এতো হুমকি ধামকি পাবার পরও দৃষ্টি তার সাথে কথা বলবে না। যা খুশি করুক। খেয়ে তো আর ফেলবে না? সে ফোন জায়গায় রেখে নিচে নেমে এলো। আজ অফ ডে, সবাই একটু দেরিতেই উঠেছে। ডাইনিং টেবিলে বাবা ও ছোট বাবা বসে রয়েছেন। আর মা ও ছোট মা টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রাখছেন। ছোট রা কেউই এখনও আসেনি, শুধু সে ছাড়া। সে চেয়ার টেনে বসে বাবা ও ছোট বাবার সাথে কুশল বিনিময় করল। ফাহাদ আবরার ছোট মেয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুমি কি অসুস্থ, মা? শুকিয়ে যাচ্ছ যেন।”

দৃষ্টি একটু হেসে বলল,

“কই বাবা? তেমন কিছু নয়।”

মিসেস সীমা ভাজির বাটি শব্দ করে টেবিলে রেখে ফোড়ন কেটে বললেন,

“তেমন কিছু না? আপনি ঠিকই বলেছেন। দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে দেখেছেন? খাওয়া দাওয়া করে কিছু ঠিক মতো? অর্ধেক খেয়ে সব সময় উঠে যায়। পুরো খাবার খায় কখনও? তো ও অসুস্থ হবে না তো আমি হবো?”

ফাহাদ আবরার আদুরে কন্ঠে বললেন,

“আমাকে বলো, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? আমি নাহয় ডাক্তার দেখিয়ে আনব। পড়ালেখার চাপ একদম নেওয়ার দরকার নেই। ধীরে সুস্থে পড়লেই হবে। ঠিক আছে?”

দৃষ্টি মাথা দুলিয়ে বলে,

“জি, বাবা। আমার খারাপ লাগলে আমি বলব।”

একটু পরই ফারনাজ নেমে এলো। সে দৃষ্টির পাশে চেয়ার টেনে বসল। মিসেস সীমা পরিবেশন শুরু করলেন। আজ বন্যা এবং বর্ষণ একটু দেরিতে উঠবে। তারা পরে খেয়ে নেবে। ফারনাজ রুটি ছিড়ে মুখে দিল। দৃষ্টি সিঁড়ি দিকে পড়তেই কন্ঠস্বর উঁচিয়ে বলল,

“আরে পায়েল! তুমি কবে এলে? অনেক দিন পর এলে যে! কেমন আছ?”

দৃষ্টির হাত থেমে গেল। মিসেস সীমা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাজের মাঝে তিনি ভুলেই বসেছিলেন ছেলের কীর্তি। দৃষ্টি চোখ তুলে তাকায়। পায়েল ফারদিনের পেছনে কাচুমাচু হয়ে নামছে। পরনে দৃষ্টির সেই জামাটা যেটা আজ সে ফারদিন কে দিয়েছিল। তারা নেমে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। দৃষ্টি জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে পায়েলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় ঢুকছে না কিছু। ফাহাদ আবরার বললেন,

“পায়েল মামনি বসো। তুমি কখন এসেছ? রাতে তো তোমাকে ডিনারের সময় দেখলাম না।”

পায়েলের বুক দুরুদুরু কাঁপছে। কেউই হয়তো খেয়াল করেনি যে সে ফারদিনের ঘর থেকে বেরিয়েছে। ফারদিন গলা খাঁকারি দিল। মিসেস সীমা বো”মা বিস্ফোরণের জন্য মনে মনে তৈরি হলেন। ফারদিন স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

“আমি বিয়ে করেছি, বাবা।”

ফাহাদ আবরারের হাত থেমে গেল। তিনি বোধহয় ভুল শুনলেন। বয়সও তো হয়েছে। চোখের পাওয়ার যখন কমেছে, কানেরটা কমতে কতক্ষণ? তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“কি বললে?”

ফারদিন পুনরায় নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

“আমি বিয়ে করেছি।”

মনে হলো ছোট খাটো একটা বাজ পড়ল তার মাথায়। তিনি ধপ করে দাঁড়িয়ে বললেন,

“এসব কি বলছ তুমি? সকাল সকাল এটা কেমন ধরনের মশকরা?”

মিসেস সীমার গলা শুকিয়ে গেল। তিনি পাশে থাকা মিসেস বিউটির হাত খপ করে ধরে ফেললেন। মিসেস বিউটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি মাথা নাড়লেন। তিনি যা বোঝার বুঝে গেলেন। ফারদিন টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিয়ের কথা বলতে সে একটুও সংকোচ বোধ করছে না। সে সামনে তাকিয়েই বলল,

“মশকরা নয়, বাবা। তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি মশকরা করি না।”

ফাহাদ আবরার বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখছেন। তিনি কখনও ভাবতেই পারেননি যে ছেলে নিজে বিয়ে করে এসে, সে কথা তার সামনে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে বলবে। তিনি তার মধ্যে একটুও অপরাধবোধ দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,

“যা করার তা তো করেই ফেলেছ। এখন বলছ কেন? তুমি বিয়ে করেছ, বেশ। বউ আমি ঘরে তুলব না। তুমি বেরিয়ে যাও। যাকে তাকে আমি বাড়িতে জায়গা দেব না।”

পায়েলের চোখের কোণে জল জমে। কি হবে এখন? মিসেস সীমা স্বামীকে বোঝাতে চায়লেন,

“ওর কথাটা একটু শুনে দেখুন। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছিল। নয়তো ও এভাবে বিয়ে করর ছেলে নয়। আমার ছেলেকে আমি চিনি।”

ফাহাদ আবরার ধমকালেন,

“তুমি চুপ করো। ছেলেকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুমিই তুলেছ। এখন ছেলের হয়ে সাফাই গায়তে হবে না।”

অতঃপর ফারদিনের দিকে চেয়ে বললেন,

“তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বেরিয়ে যাও এক্ষুনি। পায়েল মামনি বসো। নাস্তা করে নাও।”

দৃষ্টি শীতল দৃষ্টিতে পায়েলের দিকে তাকিয়ে। পায়েল তার নজরে নজর মেলাতে পারছে না। সে মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিন বলে,

“বউকে বাড়িতে তোলা হয়ে গিয়েছে, বাবা।”

ফাহাদ আবরার প্রচুর রেগে যাচ্ছেন। তার প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। রাগের চোটে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ছেন তিনি। চিৎকার করে বললেন,

“ডাকো তাকে। আর বের হও আমার বাড়ি থেকে। লজ্জা করে না? বাবার অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করে বউ ঘরে তুলতে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এই দিনও আমাকে দেখতে হলো।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৭

গমগমে বাড়ির পরিবেশ। সকলে থমকিত, চমকিত। বাড়ির ছেলের হঠাৎ এমন কাজ তাদের হজম করতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। তার উপর ফাহাদ আবরারের টগবগিয়ে ওঠা রাগ! সবটা মিলিয়ে মিসেস সীমার মাথা ভনভন করে ঘুরছে। মনে হচ্ছে এখনই ঠাস করে পড়ে যাবেন তিনি। একদিকে স্বামী অন্যদিকে ছেলে! কার পক্ষ নেবেন তিনি?
সকলের নাস্তা করা লাটে উঠেছে। আজ বোধহয় আর খাওয়া হবে না। ফাহাদ আবরার আবার চিৎকার করে উঠলেন,

“আমার প্রেশারের ওষুধ টা এনে দাও। প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে আমার, তোমার গুণধর ছেলের জন্য।”

মিসেস সীমা হম্বিতম্বি করে ছুটে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এলেন। ফাহাদ আবরার পানি দিয়ে তা টুপ করে গিলে নিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিলেন। ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,

“তুমি এখনও আমার বাড়ি থেকে বের হওনি?”

ফারদিন কপাল চুলকে বলল,

“আগে আমার বউকে দোয়া দাও। তারপর যাচ্ছি। পায়েল, যাও সবাইকে একে একে সালাম করো।”

আরও একটা বাজ পড়ল যেন। পায়েল ইতোমধ্যে কেঁদে কেটে গাল ভিজিয়ে ফেলেছে। আকাশ পাতাল বিভিন্ন কথা ভেবে, মনে মনেই হাউমাউ করে কেঁদেছে। ফারদিনের কথায় সে কেঁপে ওঠে। শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে যায়। কাঁপা কন্ঠে বলে,

“আ আসসালামু আলাইকুম, আঙ্কেল।”

ফারদিন ধমক দেয়,

“আঙ্কেল কি? বাবা বলো।”

পায়েল কেঁদেই ফেলল। নাক টেনে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম, বাবা।”

ফাহাদ আবরার হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন। তিনি কি বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। পায়েল মাথা নিচু করে কান পেতে রইল জবাব পাবার আশায়। সম্বিত ফিরে পেয়ে ফাহাদ আবরার হকচকিয়ে বললেন,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি! মানে, তুমি পায়েল কে বিয়ে করেছ?”

ফারদিন সাঁই দেয়। পরপরই বলে,

“পায়েল চলো। গুছিয়ে নাও।”

মিসেস সীমা ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাত উঁচিয়ে মাথায় বুলিয়ে বললেন,

“গুছিয়ে নেবে কেন, বাবা?”

“বাবা’ই তো বলল চলে যেতে।”

পায়েল এখনও কেঁদে যাচ্ছে চুপচাপ। ফাহাদ আবরার নরম হলেন। আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় রাগ তার নিমিষেই ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি বললেন,

“কাঁদছ কেন, মামনি? কোথাও যাচ্ছ না তোমরা।”

সকলে অবাক হয়ে তাকায়। পায়েল অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ফাহাদ আবরার আলতো হেসে বলেন,

“আমি তো ভেবেছিলাম এই বখাটে না জানি কোন মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। কেমন মেয়ে, ওর মতোই ছন্নছাড়া কিনা? কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে ও জীবনে একটা ভালো কাজ করেছে। তোমাকে বিয়ে করেছে। তোমার মতো লক্ষ্মী একটা মেয়ে ছেলের বউ হলে, না মেনে থাকা যায়? তুমি তো আমার আরেকটা মেয়ে।”

খুশি হলো সকলে। খুশিতে পায়েল আবারও কেঁদে ফেলল। ফাহাদ আবরার তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

“কেঁদো না। আর কখনও কাঁদবে না তুমি। এখন বসো তো আমার পাশে, নাস্তা করে নাও।”

মিসেস সীমা এবং মিসেস বিউটি আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পরিবেশনে। ফারদিন স্মিত হেসে বসে পড়ে। সে জানে তার বাবা পায়েল কে কখনো ফেরাবে না। খাওয়ার মাঝে সকলে জেনে নেয় হঠাৎ বিয়ে হবার ঘটনা। ফারদিন বলে,

“আমি ট্যুরে গিয়েছিলাম, সেই সুযোগে ওর মামা মামীরা জোর করে ওর বিয়ে ঠিক করেছিল এক বুড়োর সাথে। কিন্তু আমি জেনে যায়। সব সময় ওর বাড়ির আশে পাশে আমার পাহারা থাকত। কারণ আমি ওর মামা মামী দের একদম বিশ্বাস করি না। কাজের লোককে টাকা খাইয়ে বিয়ের খবর জেনে যায় পাহারা দেওয়া ছেলেটা। তারপর আমাকে জানায়। আমি তখনই চলে আসি। পরিকল্পনা করে বুড়ো কে কিডন্যাপ করে তার জায়গায় আমি যায়। এখানে আমাকে আমার সিনিয়র ভাইয়েরাও অনেক সাহায্য করেছে।”

সকলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ফাহাদ আবরার বললেন,

“যা হবার হয়ে গিয়েছে। পায়েলের এখন একটাই পরিচয় সেটা হচ্ছে ও আবরার বাড়ির ছেলের বউ। ওর কোনো অযত্ন এখানে হবে না। তোমার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলেই বড় করে রিসিভশান হবে।”

পায়েলের চোখের কোণে জল জমে। এতো সুখ সে পাবে, কখনও কল্পনাও করেনি। ভেবেছিল অত্যাচার সহ্য করতে করতে এক সময় হয়তো শেষ হয়ে যাবে। নিজের একটা পরিবার পাবে সে ভাবেইনি কোনোদিন।

ফারদিনের বন্ধুরা আগেই প্রস্থান করেছে। ফাহাদ আবরারের রোষের মুখে তারা পড়তে চায়নি। মিসেস সীমা রান্নাঘরে যেতেই ফ্রিজ ঘেঁটে যা পেয়েছে তাই মুখে দিয়ে ভেগেছে। কারণ তিনি খালি মুখে যেতে দিচ্ছিলেন না এবং এটাও কথা নিয়েছেন যে তারা খুব শীঘ্রই দাওয়াতে আসবে।

খাওয়া শেষ হতেই দৃষ্টি দাঁড়াল না এক মুহূর্তও। গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেল। পায়েল করুণ দৃষ্টিতে সেদিকে দেখল। ফারনাজ যাবার আগে তাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছে। পায়েল তার ভাইয়ের বউ হয়েছে এতে তার আনন্দের শেষ নেই। খাওয়া শেষে মিসেস সীমা ও মিসেস বিউটির সাথে কাজে হাত লাগাল। যদিও তারা মানা করেছিলেন। গুছিয়েই সে দৃষ্টির রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। ইতস্তত করে ভেতরে প্রবেশ করবে কি করবে না ভেবে।

“একদিনের মধ্যেই আমি তোর এতো পর হয়ে গেলাম যে আমার রুমে আসবি কিনা সেটা তোকে দাঁড়িয়ে ভাবতে হচ্ছে! ভাবীর কাছে কি ননদ একদিনের মধ্যেই বিরক্তির মানুষ হয়ে গেল?”

দৃষ্টির কন্ঠে চমকে ওঠে সে। নিজেকে সামলে দরজা ঠেলে প্রবেশ করে। দৃষ্টি ভাবলেশহীন ভাবে মুখের সামনে বই মেলে ধরে বসে আছে বিছানায়। পায়েল তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মৃদু কন্ঠে ডাকে,

“দৃষ।”

দৃষ্টি মুখের সামনে থেকে বই সরায়। অতঃপর অবাক হবার ভান করে বলে,

“আরে ভাবী! দাঁড়িয়ে আছেন কেন? প্লিজ বসুন। নাকি ননদের ঘরে আপনার বসতে অসুবিধা আছে?”

পায়েল ধপ করে তার সামনে বসে তার হাত চেপে ধরে। ছলছল চোখে চেয়ে বলে,

“এভাবে কথা বলছিস কেন, দৃষ? আমি কি কিছু করেছি?”

“তোর বাড়িতে এতো সমস্যা হচ্ছিল তা আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করিস নি? ভাইয়া যদি ঠিক সময়ে যেয়ে না পৌঁছাত তবে কি হতো? বুড়োকে বিয়ে করতিস?”

“আমি কিছুই বুঝিনি। ওরা আমার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছিল। আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে ওরা এমন নিচ পরিকল্পনা করে রেখেছে। তারপর যখন জানলাম তখন আমার ফোনটা কেড়ে নিল। বিশ্বাস কর আমার কোনো উপায় ছিল না। আমি যে কতটা অসহায় ছিলাম তা তোকে বলে বোঝাতে পারব না। প্লিজ আমার উপর রাগ করে থাকিস না। তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে বল?”

বলতে বলতে সে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিল। দৃষ্টি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে তাকে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“তোর কান্নার দিন শেষ। আমি বলেছিলাম না যে তোর জীবনে কেউ আসবে? তবে সে কেউটা যে আমারই ভাই হবে সেটা ভাবিনি।”

একটু থেমে সে পায়েলের চোখের কোণ মুছে দিয়ে বলে,

“তবে ভালোই হলো, আজ থেকে তুই আমি একসাথে থাকব। একসাথে কলেজ যাব, একসাথে আসব।”

পায়েল হেসে ফেলল। নাক টেনে রসিকতা করে বলল,

“তা তো হবে না ননদিনী। খুব তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেব। এসব ননদের জ্বালা সহ্য করতে পারব না বাপু।”

একটু থেমে ফিসফিসিয়ে বলে,

“বিয়ে তো হয়ে আছেই। সে এলেই তুই টাটা বাই বাই।”

দৃষ্টি মুখ গম্ভীর করে বলল,

“সহ্য করতে হবে। কোথাও যাচ্ছি না আমি। সে এলেও না। যাও ভাবী, আমার জন্য ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত নিয়ে এসো। নাহলে কিন্তু ভাইয়ের কাছে তোমার নামে নালিশ করে মা’র খাওয়াব।”

পায়েল একটু ভয় পাবার ভান করল। পরপরই দুজন শব্দ করে হেসে ফেলল। ফারদিন পায়েল কে ডাকতে এসে রুমের বাইরে থেকে এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে নীরবে সরে গেল। যা গেল মেয়েটার উপর দিয়ে, একটু রিল্যাক্স হোক।

গাড়িটি সামনে থামতেই ফারনাজ দাঁড়িয়ে গেল। এতো দিনে তার চেনা হয়ে গিয়েছে। গাড়ি থেকে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি নেমে দাঁড়াতেই সে দু হাত বাড়িয়ে দিল। ব্যক্তিটি বোধহয় একটু হাসল। কিন্তু তার সানগ্লাস এবং মাস্ক ভেদ করে তা বেরিয়ে আসতে পারল না। লোকটি আরও একটু এগিয়ে তার চশমা খুলে নিয়ে চোখ বাঁধল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আর হাত বাঁধার প্রয়োজন নেই।”

চোখ বেঁধে দিয়েই তাকে গাড়িতে বসাল। গাড়ি চলতে শুরু করলে ফারনাজ জিজ্ঞেস করল,

“আপনি আজ হাত বাঁধলেন না কেন?”

“কারণ আমি জানি তুমি শান্ত মেয়ে হয়ে বসে থাকবে।”

“তবে চোখটা কেন বাঁধলেন? এমনিতেও তো আপনার চেহারা বোঝার কোনো উপায় থাকে না।”

“গাড়িতে ওঠার পর আমি সানগ্লাস মাস্ক খুলে রাখি।”

বোকা ফারনাজের মাথায় একটা বিষয় আসতেই সে হাত বাড়িয়ে চোখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। তবে পারল না। লোকটার হাসির শব্দ পেল। যেন সে ভীষণ মজা পেয়েছে।

“বোকা মেয়ে! আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়? এই বাঁধন এমন ভাবে দেওয়া যেটা আমি ছাড়া আর কেউ খুলতে পারবে না।”

ফারনাজ মুখ কালো করে ফেলল। বলল,

“আমাকে এভাবে বসিয়ে রেখে আপনার কি লাভ?”

লোকটা কেমন অদ্ভুত ভাবে বলল,

“শান্তি পাই। আমার সকল ক্লান্তি দূর হয়।”

ফারনাজ মুখ হা হয়ে গেল। তাকে এভাবে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে কীসের শান্তি তার? কেমন ক্লান্তি দূর?

“এতো ভেবো না। তোমার মোটা মাথায় ঢুকবে না।”

অপমানে মুখ থমথমে করে ফারনাজ তার ভাবনা বাদ দিল। এই লোকটা শুধু তাকে কথায় কথায় অপমান করে। ফারনাজের তো ইচ্ছে হয় লোকটাকে তুলে একটা আছাড় মা’রতে। পরপরই নিজের সাইজ আর লোকটার সাইজ তুলনা করে সে তার ইচ্ছে থেকে পিছিয়ে আসে। তার মতো শরীর নিয়ে অত বড় দানবীয় শরীর তুলে আছাড় দেওয়া ইহকালে সম্ভব নয়। ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে বসে থাকে। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে এই লোকের সঙ্গ তার ভালো না লাগলেও খারাপ লাগে না।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৮

চকচকে এমন সুন্দর একটা দিনে ফারদিন পায়েল কে নিয়ে বেরিয়েছে। পায়েল এখনও জানে না যে তারা যাচ্ছে কোথায়। সকালে নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়েছে তারা। সাথে একটা কাপড়ের ব্যাগও আছে। পায়েল তাকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাতে পারল না। শুধু চলল সাথে সাথে।
নিজের বাড়ির সামনে রিক্সা থামতেই পায়েল হকচকিয়ে গেল। ফারদিন হঠাৎ এখানে কেন এলো? তাও আবার ব্যাগ গুছিয়ে। ফারদিন রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। ব্যাগ হাতে নিয়ে দেখল পায়েল এখনও চুপ করে বসে আছে। সে একটু জোরে বলল,

“নামছ না কেন?”

পায়েল ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে নেমে পড়ল। ফারদিন ব্যাগ হাতে এগোলো। পায়েল তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে মিনমিন করে বলল,

“আপনি হঠাৎ এখানে নিয়ে এলেন কেন?”

ফারদিন দাঁড়িয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলল,

“শশুর বাড়ি বেড়াতে এসেছি। বউকে ফেলে রেখে আসতাম কীভাবে?”

পায়েল ড্যাব ড্যাব করে তাকায়। ফারদিন এক আনাও পাত্তা না দিয়ে গটগটিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। হাক ছাড়ে,

“বড় চাচী শাশুড়ি! ছোট চাচী শাশুড়ি! আরে কই গেলেন সব? বাড়ির জামাই এসেছে, সে দিকে কারোর খেয়াল আছে?”

পায়েল এতক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। ফারদিনের হাক ডাক শুনে অবাক হলো সে। এমন আচরণ তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একদমই যায় না। ফারদিনের চিৎকার শুনে বড় চাচী, ছোট চাচী বেরিয়ে এলেন। বিরাট ধাক্কা খেয়েছেন তারা। কস্মিনকালেও হয়তো ভাবেননি যে আপদ আবার ঘাড়ে চেপে বসবে। বড় চাচী মেকি হেসে বললেন,

“আরে জামাই বাবা যে! হঠাৎ কি মনে করে?”

ফারদিন হাতের ব্যাগটা ফেলে সোফায় ধপ করে বসল। ক্লান্তির শ্বাস ফেলে বলল,

“এটা কেমন প্রশ্ন বড় শাশুড়ি? বিয়ের পর যে মেয়ে জামাই বেড়াতে আসে সেটা আপনারা জানেন না? আমরা এসেছি আপনাদের তো খুশি হওয়া উচিত। এতো কষ্ট করে এসেছি কোথায় শরবত টরবত দেবেন তা না করে দাঁড়িয়ে আছেন! বাই দ্য ওয়ে! আপনারা আমাদের দেখে খুশি হয়েছেন তো?”

দু’জনে জোর পূর্বক হেসে ঘাড় নেড়ে বোঝাল যে তারা খুশিতে ম’রে যাচ্ছে। ফারদিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“ঠিক আছে। আমি রুমে যাচ্ছি বিশ্রামের জন্য। ছোট শাশুড়ি ব্যাগটা উপরে দিয়ে আসবেন। আর বড় শাশুড়ি দ্রুত রান্নার আয়োজন করুন।”

বলে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। পায়েলের রুমের দরজা খুলে সে এক পলক দেখে আবার নেমে এলো। আবারও সোফায় বসে বলল,

“নাহ! সব পরে হবে। আগে রুমটা ভালো করে ঘসে মেজে পরিষ্কার করে চকচকে করে দিন। যান।”

তাদের মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। পায়েল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল দেখছে। বড় চাচী হেসে বললেন,

“ওইটুকু তো পায়েলই করে দিতে পারবে। পায়েল, তুই যা পরিষ্কার করে দে।”

ফারদিন কড়া কন্ঠে বলল,

“না। আপনারা যাবেন। আর পায়েল এখানে বসে আমার সেবা করবে। আপনারা যাবেন নাকি আমি!”

ছোট চাচী তাড়াতাড়ি বললেন,

“তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না, বাবা। আমরা এক্ষুনি সব করে দিচ্ছি। তুমি বসো, হ্যাঁ? আর পায়েল, জামাই বাবাকে ঠান্ডা পানি দে। মাথা ঠান্ডা হবে। এতো মাথা গরম করে চলে নাকি? চলো, আপা চলো।”

দু’জনে উপরে চলে গেল। পায়েল ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলে ফারদিন বলে,

“হা করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? স্বামী যে কষ্ট করে এলো তার খেয়াল আছে? যাও ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো। পারলে আমার মাথায় ঢালো।”

পায়েল মাথা নিচু করে রান্না ঘর থেকে পানি এনে দিল। ফারদিন তা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে টি টেবিলে রেখে দিল। পায়েল বলল,

“আপনি বসুন, আমি একটু ওনাদের সাহায্য করি।”

“তার কোনো দরকার নেই। আমার পাশে চুপ করে বসে থাকবে। তারপর আমি গেলে আমার সাথেই রুমে যাবে এবং আমার সাথেই রুম থেকে বের হবে। আমি ছাড়া একটা মুহূর্তও না। তাদের তো জামাইয়ের ভীষণ শখ ছিল। তাই তোমাকে ধরে বিয়ে দিচ্ছিল। এবার একটু জামাইকে আপ্যায়ন করুক। বুঝেছ?”

পায়েল মাথা কাত হয়ে সাঁই জানিয়ে তার পাশে বসে। যে কাজ বড় চাচী ছোট চাচী জীবনেও করেননি আজ তাদের তাই করতে হচ্ছে। পায়েলের এতে একটুও খারাপ লাগছে না। হয়তো এটা হবারই ছিল। ধর্মের কল তো বাতাসে নড়ে, তাই না?

বাড়িতে তেমন কিছু না থাকায় মাছ ডিম দিয়ে আয়োজন করেছেন তারা। এতে ফারদিন একটু রাগারাগী করল। এটা কেমন জামাই আদর বলে? না গরু না খাসি না মুরগি। তার রাগের তোপে ভেজা বেড়াল হয়ে গেল সব। বড় চাচী বললেন,

“এখন এই খাও বাবা। তারপর বিকেলে তোমার বড় শশুর কে পাঠাব বাজারে।”

ফারদিন খাওয়া শুরু করল। পাশে জোর করে পায়েল কে বসিয়ে রেখেছে। না চাওয়া সত্ত্বেও তাকে খেতে হচ্ছে। যে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছেন তার দুই চাচী। ফারদিন মাছটা একটু মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিল। নাক কুঁচকে বলল,

“ওয়াক থু! এ কোনো রান্নার জাত হলো? এতো লবন! মাছটাও কাঁচা মনে হচ্ছে। আমি এখন খাব টা কি?”

বড় চাচী কাঁচুমাচু হয়ে বললেন,

“ডিম দিয়ে খাও, বাবা।”

ফারদিন সেটাও মুখে নিয়ে ফেলে দিল। টেবিলের উপর এক থাবা বসিয়ে বলল,

“কি রেঁধেছেন এগুলো? এসব মানুষে খায়? আপনারা এসব খান! এক্ষুনি নতুন কিছু বানিয়ে নিয়ে আসুন। নয়তো পেট খালি থাকলে আমার মাথা ভীষণ গরম হয়ে যায়। কি থেকে কি করে বসব জানি না।”

ভয় পেলেন তারা। ছুটে চলে গেলেন রান্নাঘরে ভালো করে কিছু বানানোর প্রচেষ্টায়। পায়েল খাবার খেয়েছে এবং তার কাছে মোটামুটি ঠিক লেগেছে। এমন অখাদ্য নয় যে মুখে তোলা যাবে না। সে বলল,

“খাবার তো ভালোই আছে। আপনি খেতে পারছেন না কেন?”

“তোমাকে এতো ভাবা লাগবে না। খাওয়া হয়ে গিয়েছে?”

সে মাথা নাড়ল। তার খাওয়া শেষ। ফারদিন আবার বলে,

“রুমে যাও তাহলে। শুয়ে একটা ঘুম দেবে। আমি খাওয়া শেষ করেই আসছি। যাও।”

তার আদেশে সে চুপচাপ উঠে রুমে চলে গেল। হঠাৎই তার মনে পড়ল আগেরকার দিনের কথা। খাবারে সামান্য একটু লবণের পরিমাণ কমবেশি হলে তাকে তা আবার রান্না করতে হতো। যতক্ষণ না তাদের মনে শান্তি হতো ততক্ষণ তাকে একই খাবার বার বার বানাতে হতো। এর সাথে তো কটু কথা এবং গায়ে হাত তোলাও ছিল। এসব কথা মনে পড়তেই পায়েল শান্ত হয়ে গেল। সকল চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে সে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। এবার থেকে ফারদিন যা ইচ্ছে করুক, সে কিছু বলবে না আর ভাববেও না।

আজ দৃষ্টি এবং পায়েল একসাথে কলেজে এসেছে। খুব ভালো ভাবেই তারা ক্লাসগুলো সম্পন্ন করল। তবে বের হবার সময় বাঁধ সাধল মৃন্ময়। সে চওড়া হেসে বলল,

“কেমন আছ, দৃষ্টি?”

দৃষ্টি সৌজন্য হেসে বলল,

“ভালো আছি, স্যার। আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও ভালো আছি। কদিন বেশ ব্যস্ত ছিলাম বুঝলে? তাই তোমার সাথে দ্যাখা করা হয়ে ওঠেনি।”

দৃষ্টির মনে হলো মৃন্ময় তাকে কৈফিয়ত দিচ্ছে। যেখানে সে কিছুই জানতে চায়নি এবং মৃন্ময় কলেজে আছে কি নেই এটাও তার নজরে আসেনি। সে জোরপূর্বক হাসল একটু। পরপরই আফরানের কথা মনে পড়তেই গা হিম হয়ে গেল। সে আফরানের স্ত্রী, তার সাথে মৃন্ময়ের এমন আচরণ কখনোই সাঝে না। মৃন্ময় আবার বলল,

“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। তোমার কি সময় হবে?”

দৃষ্টি ঢোক গিলল। সে ভেবে দেখত যদি সে আফরানের স্ত্রী না হতো। কিন্তু আফরান তাকে বেঁধে রেখে গিয়েছে, এখন কোনো কিছুই সম্ভব নয়। অসম্ভব! পায়েল কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের শ্রোতার ভূমিকা পালন করছে। এই স্যারের হাব ভাব দেখেই তার মনে হয় যে দৃষ্টিকে সে খুব পছন্দ করে। আর সে একশো শতাংশ নিশ্চিত। তবে দৃষ্টি আফরান স্যারের বউ। এটা জানতে পারলে যে তিনি কি ঝটকাটাই না খাবেন! পায়েলের ভীষণ মায়া হলো। আহারে! তাদের বেচারা মৃন্ময় স্যারটা।
দৃষ্টি আমতা আমতা করে বলল,

“না মানে স্যার। আমাকে তো বাড়িতে যেতে হবে। একটু দেরি করলেই বাড়িতে খুব রাগারাগী করে। কলেজের সময়টুকু ছাড়া আমার বাইরে থাকা একদম অনুমতি নেই।”

মৃন্ময় একটু আহত হলো। সে অনেক আগে থেকেই দৃষ্টির সাথে আলাদা কথা বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ তার এখনও আসেনি। নানা বাহানা দিয়ে দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এবং দৃষ্টির সাথে সেটা আলোচনা করতে চায়ছিল। তবে তা হলো না। এখন তাকে আলোচনা ছাড়াই সরাসরি পদক্ষেপ নিতে হবে। দৃষ্টি মাথা নিচু করে বলল,

“স্যরি স্যার।”

মৃন্ময় মৃদু হেসে বলল,

“কোনো সমস্যা নেই। বাড়িতে যাও, সাবধানে যেও।”

বলেই মৃন্ময় প্রস্থান করল। পায়েল হতাশ শ্বাস ফেলে বলল,

“ওনাকে এভাবে ফিরিয়ে দিলি কেন? আমি শিয়র আজ তোকে প্রপোজ করত।”

দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“হ্যাঁ আর একজন এসে আমার ঘাড় মটকে দিক। যত্তসব অসহ্য! ওই একটা লোকের জন্য আমার জীবন ঝালাপালা হয়ে গেল।”

“ঝালাপালা হয়ে গেল? তাকে এত্তো ভালোবাসিস, আড়ালে কাঁদিস। চলে গিয়েছে বলে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেও কবে ফিরবে তার জন্য দিন গুনিস। আর আমাকে এসব বিশ্বাস করতে বলিস?”

দৃষ্টি রেগে কটমটিয়ে চেয়ে বলে,

“কচু ভালোবাসি। আমি কাউকে ভালোবাসি না। আমার এতো ঠ্যাকা পড়েনি যে তাকে ভালোবাসতে যাব।”

সে হনহনিয়ে এগোলো। পায়েল ঠোঁট চেপে হেসে তার পিছু গেল। সে তো সব দ্যাখে, দৃষ্টির চাল চলন। মাঝে মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। লুকিয়ে তাকে কাঁদতেও দেখেছে। অভিমান অভিযোগ পুষে রাখতে গিয়ে দৃষ্টি মাঝে মধ্যে নীরবে কাঁদে। আফরানের অনুপস্থিতি যে তাকে পোড়ায় তা পায়েল খুব ভালো ভাবেই বোঝে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে