সে আমারই পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
311

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৩

পূর্ণিমার রাত। আকাশে জ্বল জ্বল করছে থালার মত চাঁদ আর অসংখ্য নক্ষত্ররাশি। এই রাতেই তো কপোত কপোতীরা চন্দ্র বিলাস করে থাকে। একে অপরের বাহুতে আবদ্ধ হয়ে চাঁদ দ্যাখে। এক সময়ে হয়তো সময়েরও খেয়াল থাকে না। কেটে যায় মুহূর্তর পর মুহূর্ত। এই রোমাঞ্চকর মুহূর্তে তূরাগ একা। ব্যালকনিতে নিজের গিটার কোলে নিয়ে বসে আছে সে। এটাই তার নিঃসঙ্গতার একমাত্র সঙ্গী। তার যখন চন্দ্র বিলাস করার মানুষটি এসে যাবে তখনও এই গিটার তার সাথে থাকবে। বড্ড আপন যে! সে টুং শব্দে আওয়াজ তোলে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে ওঠে বোকা বোকা সুশ্রী চেহারা। প্রসস্ত হাসে সে। হঠাৎ করেই সুর তোলে।

“লিখে যাই, গল্প না থাকুক
ভুলে যাই যন্ত্রণাটুকু,
মন আমার তোর ইশারায়
খুঁজে বেড়ায় স্বপ্ন স্বপ্ন দেশ।

দূরে যায়, অল্প অল্প সে
সত্যি না, গল্প গল্প সে,
মন আমার সবই হারায়
খুঁজে বেড়ায় তোরই যে আবেশ।

দিন শুরু তোর কথায়
তুই ছাড়া নামে না রাত চাঁদ থেকে।

উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে।

আকাশে দৃষ্টি তোর, বৃষ্টি তোর
মনে মেঘ জমে,
জানালার হাওয়াতে, ছাওয়াতে
মনের রোদ কমে।

চলে যাই দু’চোখের পথে
বলে যাই কথা তোরই যে,
মন আমার ভবঘুরে যাবে দূরে
তোকে না পেলে।

কেন তুই দূরে দূরে বল
আকাশে উড়ে উড়ে চল,
মিশে যাই এই আকাশে তোর বাতাসে
পাখনা মেলে।

দিন শুরু তোর কথায়
তুই ছাড়া নামে না রাত চাঁদ থেকে।

উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে।

আকাশে দৃষ্টি তোর, বৃষ্টি তোর
মনে মেঘ জমে,
জানালার হাওয়াতে, ছাওয়াতে
মনের রোদ কমে।”

পুরো গানটা শেষ করে সে থামে। চোখ বন্ধ করে ভাবে এখনও। তার নিঃসঙ্গ জীবনে ভালোবাসার রং লাগতে পারে সে ভাবেইনি কখনও। তাও কে? একটা বোকা, চঞ্চল মেয়ে। যা সম্পূর্ণ তার স্বভাবের বিপরীত!

বেশ কদিন ধরে বাড়ির লোকের হাবভাব ভালো লাগছে না পায়েলের। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে এবং আড়ালে ফুসুর ফুসুর করে। নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে কোনো ষড়’যন্ত্র করা হচ্ছে? কিন্তু কি করবে তারা? এবার কি একেবারেই মে’রে ফেলবে? তাচ্ছিল্য হাসে পায়েল। যে ভেতর থেকে অনেক আগেই ম’রে গিয়েছে তাকে আর কি মা’রবে? তবে তার মনের মধ্যে কেমন একটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।

ফারদিন এলাকায় নেই। এটা কোনো ভাবে জানতে পেরেছিল সোহেল। সেই থেকেই তারা পাকাপাকি ভাবে পায়েল কে বিদায় করার জন্য পরিকল্পনায় মেতেছে। ফারদিন নেই মানে পায়েল কে বাঁচানোর কেউ নেই। এই মোক্ষম সুযোগ কে হাতছাড়া করবে? তবে তাদের এই পরিকল্পনা আড়াল থেকে শুনে ফেলল ছোট চাচার ছেলে মাহিন। সে পায়েল বলতে পাগল। পায়েল আপুই একমাত্র ব্যক্তি যে তার সাথে সময় কাটায়। খুব আদর করে। পায়েল কে নিয়ে এমন কথা শুনে আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে গেল তার। দৌড়ে গেল পায়েলের রুমে।
পায়েল কেবল বই নিয়ে বসেছিল। এমন সময় দৌড়ে প্রবেশ করে হাঁপাতে লাগল সে। পায়েল তার মাথায় হাত রেখে বলল,

“কি হয়েছে ভাই? ওভাবে দৌড়ে এলি কেন?”

“আপু! আপু!”

“কি হয়েছে, বল?”

“আ আপু, ওরা তোমার..”

সে আর বলতে পারল না। হাজির হলো বড় চাচী এবং ছোট চাচী। বড় চাচী দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,

“দেখেছিস ছোট? কি বলেছিলাম আমি? বলেছিলাম না যে ও’কে চোখে চোখে রাখ, নাহলে আমাদের সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেবে!”

ছোট চাচী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। তার হাত খপ করে চেপে ধরে বললেন,

“অ’মানুষ পেটে ধরেছি আমি। চল তোকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে দিচ্ছি। আর কোনো দিনও সাধের পায়েল আপুর কথা মুখে আনবি না।”

তিনি মাহিনকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। তার চুপসানো ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখেও পায়েল কিছু করতে পারল না। নিশ্চয়ই এখন তাকে খুব মা’রবে ছোট চাচী? বড় চাচী বললেন,

“তোর ফোনটা কোথায়?”

পায়েল ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কেন? আমার ফোন দিয়ে তোমার কি কাজ?”

বড় চাচী রেগে গেলেন তবে সেটা প্রকাশ না করেই টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতিয়ে নিলেন। শয়তানি হেসে বললেন,

“খুব তেজ না? তোর বিষ দাঁত ভাঙার ব্যবস্থা করেছি। আর মাত্র কিছুক্ষণ। তারপর?”

কন্ঠ নিচু করে বললেন,

“তোকে বেচে দেব।”

বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে বাইরে থেকে দরজা আটকাতে ভুললেন না। পায়েল বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বড় চাচীর কথা গুলো পুরোপুরি ভাবে মস্তিষ্কে আঘাত হানতেই সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। পায়েল ভাবতেও পারেনি তারা এত নিচে নামতে পারে! এখন কি করবে সে? ফোনটাও নিয়ে গেল, এখন কি হবে? পায়েল কে তাড়ানোর জন্য তারা এমন একটা জঘন্য খেলা খেলতেও পিছ পা হলো না! ছোট চাচা বাড়িতে নেই, অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছেন কিছু দিনের জন্য। তাকে এখন কে বাঁচাবে? দরজা ধাক্কাধাক্কি করল কিছুক্ষণ, চেঁচাল। কিন্তু কেউ শুনল না। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই ফারদিনের চেহারা স্বচ্ছ জলের ন্যায় ভেসে উঠল। ফারদিন! একমাত্র ফারদিনই পারে তাকে বাঁচাতে। কিন্তু তার সাথে তো সেদিনের পর থেকে আর কথাই হয়নি, আর না যোগাযোগ। পায়েল নিজের মাথার চুল খামচে ধরল। সব শেষ হয়ে যাবে, সব।

রাতে বড় চাচী আবার রুমে এলেন। হাতে তার শাড়িসহ আরও কিছু জিনিসপত্র। পায়েল নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। বড় চাচী তাড়া দিয়ে বলেন,

“এগুলো পরে তৈরি হয়ে নে। তাড়াতাড়ি।”

পায়েল তাকিয়ে দেখল বিয়ের শাড়ি! হতভম্ব হয়ে গেল সে। সেগুলো সব ছুড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলল,

“কি করতে চায়ছ তোমরা? আমি কিছুতেই এসব পরব না।”

ক্ষেপে গেলেন মহিলা। কষিয়ে কয়েকটা চ’ড় বসালেন তার গালে। চুলের মুঠি চেপে ধরে বললেন,

“পরবি না মানে! এক্ষুনি এসব পরবি। নাহলে কি হবে জানিস তো? মাহিনকে মা’রতে মা’রতে বোধহয় মে’রেই ফেলবে ছোট। এমনিতেও আধম’রা হয়ে আছে।”

পায়েল বুক কেঁপে উঠল। ছোট্ট চেহারা কল্পনা করতেই চোখের বাধ ভাঙল। গাল বেয়ে অশ্রু নামতে লাগল। ছোট্ট ছেলেটাকেও এরা ছাড় দিচ্ছে না? কেমন পাষাণ এরা? পায়েল এদের কিছু না হলেও মাহিন তো এদের ছেলে! ঘৃণায় বিষিয়ে ওঠে তার মন, মস্তিষ্ক।

আজ পায়েলের বিয়ে। সকলে মিলে এক পঞ্চাশোর্ধ বুড়োর সাথে পায়েলের বিয়ে ঠিক করেছে। এতে অবশ্য তারা মোটা অংকের টাকা পেয়েছে। সহজ কথায় পায়েল কে তারা বিক্রি করে দিচ্ছে। সকলের চক্ষু অগোচরে এই রাতে তাদের আয়োজন। একটু হলেও তাদের আয়োজন করতে হচ্ছে। তাই কি? আপদ বিদেয় হলেই শান্তি। একটু পরেই বরপক্ষ চলে আসবে। হঠাৎ করেই বাইরে থেকে ঢাক ঢোল পেটানোর আওয়াজ এলো। প্রচন্ড জোরে বাজনা বাজছে বাইরে। তারা একে অপরের মুখে চাওয়া চাওয়ি করে। ভ্রু কুঁচকে ভাবে, এই বয়সে বুড়োর আমোদ ফুর্তির কমতি নেই। ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে বিয়ে করতে এসেছে। পর মুহূর্তে ক্ষিণ আতঙ্কিত হলো। লোকজন জানা জানি হয়ে গেলে আবার কিছু হবে না তো?
বাইরে বেরিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হলো তাদের। বড় চাচী, ছোট চাচী, বড় চাচা এবং সোহেল হা করে তাকিয়ে রইল। ব্যান্ড দলের সাথে নাচানাচি করছে এক দল ছেলেপেলে। আশ্চর্য জনক ব্যাপার হলো, বরবেশে থাকা বুড়ো লোকটাও নাচছে। তবে তার মুখটা পাগড়ির সামনে ঝুলন্ত ঝালরের নিচে ঢেকে গিয়েছে। বড় চাচী মাথায় চাপ প্রয়োগ করে মনে করলেন হিন্দি সিরিয়ালে তিনি এমন পাগড়ি দেখেছেন। তবে সামনাসামনি দেখে চমকে গিয়েছেন। বুড়ো কি হিন্দি সিরিয়াল দ্যাখে নাকি!

পায়েল পুতুলের ন্যায় ঘরে বসে আছে। তাকে বন্দি করে রেখে গিয়েছে বড় চাচী। ছোট্ট মাহিনের কথা ভেবে সে নিজেকে বধু রূপে সাজিয়েছে। কার জন্য সেজেছে সে জানে না। বাইরে থেকে আওয়াজ এসে তার কানে ধাক্কা খাচ্ছে। অবাক হলো সেও। আজকালকার যুগে এমন গান বাজিয়ে কে বিয়ে করতে আসে? সে একটু খেয়াল করে শুনতে পেল,

“চোখ তুলে দ্যাখো না কে এসেছে!”

প্রশেনজিৎ এর এই গানটা বাজছে। সে শুনতেই থাকল। কে এসেছে?

সোহেল হা করে তাকিয়ে বলল,

“এই বুড়ো এভাবে নাচছে কীভাবে, মা? গায়ে শক্তি আছে দেখছি!”

বড় চাচী বললেন,

“কচি মেয়ে বিয়ে করবে ভেবে বুড়োর আনন্দ আর ধরছে না।”

একটা ছেলে নাচতে নাচতে এগিয়ে এলো। দাঁত বের করে হেসে বলল,

“কিছু মনে করবেন না, আন্টি। আসলে বয়স হলেও দাদু মনের দিক থেকে এখনও ইয়ং। আপনারা বরনের ব্যবস্থা করুন।”

কেউ আর মাথা ঘামালো না। যত দ্রুত বিয়েটা হয়ে যাবে, তত দ্রুতই তাদের শান্তি।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৪

রাত্রের নিস্তব্ধ পরিবেশ মুহূর্তেই কোলাহল পূর্ণ হয়ে উঠেছে। গান বাজছে উচ্চ শব্দে। এতক্ষণ কেউ বুঝতে না পারলেও এখন পারছে যে বিয়ে লেগেছে! বড় চাচী মনে মনে একটু অবাক হচ্ছেন। যদিও বরপক্ষ থেকে কোনো মহিলা আসার কথা ছিল না। কিন্তু এত ইয়ং ছেলেপেলে এলো কোথা থেকে? বুড়োর সাথে তো বুড়োই মানায়। তাই না? এসব ছোট ছোট ছেলেদের নাচ গান চলে নাকি! তিনি মিষ্টির বাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে বরের কোনো হেলদোল নেই। সে আড়াল থেকে মুখ বের করছে না। পাশ থেকে একটা ছেলে বলল,

“কিছু মনে করবেন না, আন্টি। দাদু ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে তাই মুখ দ্যাখাতে চায়ছে না। একেবারে বিয়ের পরই মুখ দ্যাখাবে। আপনি বরং তখনই মিষ্টি খাওয়াবেন।”

বড় চাচী বুড়োর ঢং দেখে আড়ালে মুখ বাঁকালেন। বুড়োকে ভেতরে নিয়ে বসালেন। বাইরের গান বাজনা কিছু মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। বুড়ো সেই ছেলেটাকে ডেকে কানে কানে কিছু বলল। ছেলেটা হেসে বলল,

“আন্টি, এখন কনে কে নিয়ে আসুন। আমাদের দাদুর আর তর সইছে না।”

সকলে হেসে উঠল। বড় চাচী আর ছোট চাচী চলে গেলেন পায়েল কে নিয়ে আসতে। কাজী লেখালেখি করছে। ছেলেটা কাজীর কানের কাছে ঝুঁকে কিছু বলল। কাজী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবার লিখতে শুরু করে। বড় চাচা ভ্রু কুঁচকে বললেন,

“তুমি কি বললে ওনার কানে?”

“আরে আপনারা হাইপার হবেন না। দাদুর নামের বানান ভুল ছিল সেটাই ঠিক করে দিলাম। পরে যদি সমস্যা হতো?”

বড় চাচা আর কিছু বললেন না। চারিদিকে অদ্ভুত কান্ড ঘটছে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে গেলেই তিনি বাঁচেন।

বড় চাচী এবং ছোট চাচী পায়েল কে নিয়ে আসলেন। যান্ত্রিক মানবীর ন্যায় হেঁটে আসছে সে। তারা তাকে বরের পাশে বসিয়ে দিলেন। পায়েল শুকনো মুখ তুলে আশে পাশে মাহিনকে খোঁজার চেষ্টা করল।‌ পেল না। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল,

“মাহিন কোথায় ছোট চাচী?”

“আছে রুমে।”

“একটু নিয়ে আসবে ও’কে।”

তিনি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,

“আগে বিয়ের ঝামেলা শেষ কর। তারপর দেখছি।”

পায়েল আর কিছু বলল না। বুক ফেটে কান্না আসতে চায়লেও সে চেপে রাখে। আজ বাবা মা থাকলে তাকে এমন দিন দেখতে হতো না। দৃষ্টি! তার সাথে কি আর দ্যাখা হবে? এরা বিয়ের পর কোথায় নিয়ে যাবে, কে জানে? হয়তো কোনোদিন আর কারো সাথে দ্যাখা হবে না। আর ফারদিন! ফারদিন কে নিয়ে তার মনে উদয় হওয়া অনুভূতি এখানেই শেষ হবে। এখানেই, আজই ম’রণ হবে তার সকল সুপ্ত অনুভূতির। কেউ কখনও জানবে না। যাকে ঘিরে এই অনুভূতি, সেও না।
কাজীর কথায় হুঁশ ফেরে তার। কাজী তার কানে কিছু বলল। কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারল না ঠিক।

“একি কাজী সাহেব! আপনি কানে কানে বলছেন কেন?”

বড় চাচীর কথায় সেই ছেলেটি বলল,

“আন্টি, দাদুই অনুরোধ করেছেন। তিনি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছেন। আসলে তিনি ভীষণ লাজুক। প্রথম বিয়ের সময়ও তিনি এমন করেছিলেন।”

এমন কথা বাপের জন্মে কেউ শোনেনি। লজ্জার কারণে কানে কানে বলে বিয়ে পড়ানো! অতঃপর কাজী পায়েল কে কবুল বলতে বলল। শ্বাস রোধ হয়ে এলো। গলা আটকে এলো। ছোট চাচী একটু ঝুঁকে কানের কাছে বললেন,

“কবুল বলে দে চুপচাপ। নাহলে মাহিন আবারও মা’র খাবে। সকাল থেকেই ও’কে না খাইয়ে রেখেছি। তুই ভালো মেয়ের মতো বিয়ে না করলে রাতেও খাবার পাবে না।”

পায়েল ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সারাজীবন ঘৃণা করে গেলেও তাদের প্রতি এই ঘৃণা শেষ হবে না। বাধ্য হয়ে কবুল বলল সে। এবার বরের পালা। তাকে কবুল বলতে বললে সে একটু থেমে থেমে তিন বার কবুল বলে দিল। মুহূর্তে শরীর কেঁপে উঠল পায়েলের। এ কীভাবে সম্ভব! এ কার কন্ঠ শুনলো ও? বুড়ো বরের শক্ত গম্ভীর কণ্ঠের কবুল শুনে হতভম্ব হলো সকলেই। পায়েল ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাল। কাঁপা হাত বাড়িয়ে পাগড়ি এক টানে খুলে ফেলল। আঁকতে উঠে তারা পিছিয়ে গেল এক পা। পায়েলের মাথা ভনভন করে উঠল। বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এ কাকে দেখছে! কীভাবে সম্ভব! বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইল শক্ত, গম্ভীর, নির্লিপ্ত মুখের দিকে। ফারদিনের তাদের বিস্ময়ে কোনো যায়‌ আসল না। হাত বাড়িয়ে কলম নিয়ে সই করল। এগিয়ে দিল পায়েলের দিকে। সে এখনও তাকিয়ে। স্বপ্ন না বাস্তব তা বোঝার চেষ্টা করছে। ফারদিন থমথমে কন্ঠে বলল,

“সাইন করো, ফাস্ট!”

পায়েল ঘোরের মধ্যে থেকেই সই করে দিল। কীভাবে কি হয়ে গেল! সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের অভিনন্দন জানাতে লাগল। পায়েল হা করে চেয়ে রইল। ফারদিন উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল কয়েক পা। বড় চাচা ঢোক গিলে বললেন,

“ত তুমি! তুমি এখানে? আসল বর কোথায়?”

ফারদিন বাঁকা হাসল। কন্ঠ উঁচিয়ে বলল,

“বরকে! ওপস্ প্রাক্তন বরকে নিয়ে আয়। বর তো এখন আমি, তাই না? চাচা শশুর মশাই?”

বাইরে কোথা থেকে যেন বুড়োকে নিয়ে আসে। বুড়োর হাত মুখ বাধা। ফারদিন এগিয়ে তার মুখের বাধন খুলে দেয়। তাচ্ছিল্য করে বলে,

“কচি মেয়েকে বিয়ে করার দেখি খুব শখ বুড়োর। শখ মিটিয়ে দিয়েছি একদম।”

বুড়ো ভয়ার্ত মুখে তাকিয়ে বলে,

“ছেড়ে দাও আমাকে। আমি এদের টাকা দিয়েছিলাম। এই মেয়েকে আমার কাছে বিক্রি করেছে তারা।”

ফারদিন চোয়াল শক্ত করে তাকায়। হুংকার ছেড়ে বলে,

“আপনাদের এতোই অভাব পড়েছে যে নিজের বাড়ির মেয়েকে বেচে দিতে দু বার ভাবলেন না? ছিঃ! টাকাগুলো এনে দেবেন নাকি আমি!”

বড় চাচী শক্ত হবার চেষ্টা করে বলেন,

“তুমি আমাদের ভয় দ্যাখাচ্ছ! আমরা এক্ষুনি পুলিশ ডাকব। এই সোহেল পুলিশকে ফোন কর।”

ফারদিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে তার সাথে থাকা ছেলেদের দিকে তাকায়। তারা হো হো করে হেসে ওঠে। ফারদিন ভয় পাবার ভান করে বলে,

“ওরে বাবা! আমি তো ভয় পেয়েছি চাচী শাশুড়ি মা। দয়া করে আমাকে পুলিশে দেবেন না। পুলিশ কে আমি খুব ভয় পাই। প্লিজ?”

বলেই আবার হেসে ওঠে। যেন এমন মজার ব্যাপার আর দুটি নেই। একটা লোক এগিয়ে আসে। ফারদিনের পাশে দাঁড়ায়। ফারদিন আলাপ করিয়ে দেয়,

“এই যে আমার সিনিয়র বড় ভাই, এই এলাকারই থানার এসআই। কষ্ট করে আর ফোন করার দরকার নেই শাশুড়ি মা। আপনি বরং ভাইকে সব খুলে বলুন।”

থরথর করে কাঁপতে থাকেন মহিলা। সিনিয়র ভাই বন্দু’ক বের করে সোহেলের কপালে ঠেকায়। বড় চাচী আঁতকে উঠলেন। সোহেল শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। সিনিয়র ভাই বললেন,

“কি হচ্ছিল এখানে? জোর করে একটা যুবতী মেয়েকে একটা বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছিলেন আপনারা? আর এই মেয়েটার উপর দিনের পর দিন অত্যাচার করে এসেছেন! জানেন এর জন্য আপনাদের ঠিক কি শাস্তি হতে পারে?”

বড় চাচী কেঁদে উঠলেন। সিনিয়র ভাইয়ের হাতে পায়ে ধরে বললেন,

“আমার ছেলেকে ছেড়ে দিন, স্যার। আমরা সব টাকা দিয়ে দিচ্ছি।”

বড় চাচা দৌড়ে গিয়ে রুম থেকে টাকা বের করে দিলেন। দুই লাখ টাকা নিয়েছিলেন তারা। আবারও আকুতি করে বলল,

“ছেড়ে দিন, স্যার।”

“আমার হাতে কিছুই নেই। যদি ফারদিন বলে তো ছেড়ে দেব।”

এবার তারা ফারদিনের কাছে হাত জোড় করে। ফারদিন ভাবলেশহীন ভাবে বলে,

“আপনারা আমার দোষী না। আপনারা যার কাছে দোষী তার কাছে ক্ষমা চান। সে যদি মাফ করে দেয়, তাহলে এবারের মতো বেঁচে যাবেন।”

তারা ইতস্তত করে। পায়েলের কাছে ক্ষমা চায়তে হতে পারে এটা তারা ভাবেনি কোনোদিন। তারা পায়েলের সামনে গেল। পায়েল তখনও বসে বসে ফারদিন কে দেখছিল। দৃষ্টি সরায়নি এক মুহূর্তের জন্যও। বড় চাচার কথায় সে তাদের দিকে তাকায়,

“আমাদের ক্ষমা করে দে, মা। তোর উপর অনেক অন্যায় করেছি। আমাদের বাঁচা তুই।”

পায়েল উঠে দাঁড়াল। একে একে বড় চাচী, ছোট চাচী, সোহেল তার কাছে ক্ষমা চায়। পায়েলের তাদের ক্ষমা করতে মন চায় না। তাদের বছরের পর বছর করা অন্যায় গুলো হিসেব করলে তার ক্ষমা কক্ষনো হবে না। তবে ক্ষমা করা মহৎ গুণ। সে বলল,

“ক্ষমা করে দিয়েছি।”

তারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ফারদিন বলল,

“তাহলে শশুর শাশুড়ি এবং শালা বাবু! বেঁচে গেলেন! এখন সবাইকে মিষ্টি মুখ করান মেয়ের বিয়ে দিলেন, নাচানাচি করে এদের কষ্ট হয়ে গিয়েছে ঠান্ডা শরবতেরও ব্যবস্থা করুন।”

বড় চাচী, ছোট চাচী চলে যেতে নিলেই পায়েল বলল,

“মাহিন কে দিয়ে যাও ছোট চাচী।”

ছোট চাচী আড়চোখে ফারদিন কে একবার দেখে নিয়ে মাহিন কে নিয়ে এলেন। অতঃপর রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। পায়েল মাহিন কে দেখে কেঁদে ফেলল। জড়িয়ে ধরল তাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল গাল দুটো লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই খুব মে’রেছে! আদুরে কন্ঠে বলল,

“মা খুব মে’রেছে ভাই?”

মাহিন মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। ফারদিন হুট করে এসে তাকে কোলে উঠিয়ে বলল,

“আর কেউ মা’রবে না শালাবাবু। আমি আছি না? গায়ে হাত দিলে একদম দেখে নেব। ঠিক আছে?”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৫

ফারদিনের সাথে কমপক্ষে বিশ জন ছেলেপেলে এসেছে। কিছু তার বন্ধু, কিছু জুনিয়র আবার কয়েকজন সিনিয়র ভাই। সকলে তার শুভাকাঙ্ক্ষী। তারা নিজেদের সুবিধে মতো জায়গা দেখে বসে পড়েছে। নাচ গান করতে করতে সত্যিই ক্লান্ত তারা। বড় চাচী এবং ছোট চাচী তাদের জন্য শরবত এবং মিষ্টির ব্যবস্থা করছেন। সোহেল রান্না ঘর থেকে সেগুলো এনে সবাইকে দিচ্ছে। মুখ কালো হয়ে আছে তাদের। তবুও না করে উপায় নেই।
মাহিন ফারদিনের কোলে থেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকে দেখল। জিজ্ঞেস করল,

“তুমি কে? বরের মতো সেজেছ কেন? তুমি কি তাহলে পায়েল আপুর বর?”

কথাটা শুনে পায়েলের বুকের ধুকপুক বেড়ে গেল। ভাবতেই অবাক লাগছে ফারদিন তার স্বামী! এটা কি কখনও ভেবেছিল ও? ফারদিন হেসে বলে,

“হ্যাঁ, আমি তোমার দুলাভাই।”

“কিন্তু আমি শুনেছিলাম ওরা আপুকে একটা বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে। তাহলে তোমার সাথে কেন দিল?”

ফারদিন তার গাল টেনে দিয়ে বলল,

“ম্যাজিক!”

মাহিন গোল গোল চোখে তাকায়। ফারদিন তাকে নামিয়ে দেয়। সে আবার গিয়ে পায়েলের পাশে বসে। গদগদ হয়ে বলে,

“দুলাভাই কত্ত হ্যান্ডসাম আপু! আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”

পায়েল ফারদিন কে এক পলক দেখে নিল। সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সিনিয়র ভাইদের সাথে কথা বলতে। ফারদিনের আজ এই পদক্ষেপ তার বাড়িতে মেনে নেবে তো? দ্বিধায় পড়ে সে।

খাওয়া দাওয়া শেষে পায়েল কে নিয়ে বেরিয়ে এলো ফারদিন। কাউকে বিদায় দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করল না। কেউ তার আপন নয়। গাড়ি যতই বাড়ির দিকে এগোচ্ছে ততোই পায়েলের হৃদযন্ত্রের লাফালাফি বেড়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড ভয় লাগছে তার। মনে হচ্ছে আজকের পর থেকে আঙ্কেল আন্টি কেউ তাকে আর ভালোবাসবে না, আদর করবে না। সে ফারদিনের দিকে তাকাল। সে নির্বিকার ভাবে ফোন চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও একটাও বাক্য বিনিময় করেনি তার সাথে। হঠাৎ পায়েলের মনে প্রশ্ন এলো, ফারদিন বিয়েটা কেন করল? তাকে বুড়োর হাত থেকে বাঁচাতে! নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভব হলো। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে বাইরে চেয়ে রইল।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। বন্ধুরা আগে ভাগে নেমে গিয়ে কলিং বেল বাজাল। এখন রাত এগারোটা। এই রাতে কে এলো ভাবতে ভাবতে মিসেস সীমা দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলতেই তার বন্ধুরা বলল,

“কেমন আছেন আন্টি? আমরা ভালো আছি। আন্টি একটু কাজ আছে। আমরা গেলাম।”

তারা তড়িঘড়ি করে ফারদিনের রুমে চলে গেল। মিসেস সীমা বিস্ময় কাটিয়ে সামনে তাকাতেই হোঁচট খেলেন। চোখের ভুল ভেবে চোখ ঝাপটে আবার তাকালেন। কিন্তু না, তিনি ঠিকই দেখছেন। বিস্ফোরিত কন্ঠে বললেন,

“ফারদিন! পায়েল! তোরা এভাবে!”

ফারদিন ক্লান্ত অনুভব করছে। ধকল কম যায়নি। সে ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

“বিয়ে করে এসেছি, মা। বউকে বরণ করে নাও।”

পায়েল কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস সীমা তার দিকে তাকালেন। তাকেও বেশ ক্লান্ত দ্যাখাচ্ছে। তিনি কি করবেন খুঁজে পেলেন না। সকলে এখন গভীর ঘুমে মগ্ন। ডাকা কি ঠিক হবে? তাছাড়া ছেলে যখন বিয়ে করেই এসেছে ডাকলেও তাদের আর কিছু করার নেই। বরং ফাহাদ আবরার রেগে টেগে গেলে যদি তাদের ঢুকতে না দেন? বুদ্ধিমতী তিনি খুব কম আওয়াজ করে তাদের বরণ শেষে ভেতরে প্রবেশ করালেন। জিজ্ঞেস করলেন না কিছু। সকালে নাহয় সবাই একসাথে শুনবেন। রুমে যেতে ইশারা করে নিজের রুমে চলে গেলেন।‌ ফাহাদ আবরার ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললেন।

ফারদিন নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। পায়েল বুঝল না যে, সে এখন যাবে কোথায়? এ বাড়িতে এসে সব সময় দৃষ্টির রুমে থাকা হয়েছে। আজও যাবে কি? দৃষ্টির রুম রেখে ফারনাজের রুম তারপর একদম কোণে ফারদিনের। পায়েল হুট করে দৃষ্টির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে নক করতে নিলেই বাঁধা পেল। ফারদিন হাত টেনে সরিয়ে আনল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“দৃষের রুমে ধাক্কাতে যাচ্ছিলে কেন?”

ফারদিন এই প্রথম তার সাথে কথা বলল। তাও আবার কঠোর স্বরে। কষ্ট পেল সে। তবুও সেটা প্রকাশ না করে বলল,

“না মানে আমি তো দৃষের রুমে থাকতাম। তাই..”

ফারদিন শীতল কন্ঠে বলল,

“তুমি দৃষের ফ্রেন্ড হয়ে এ বাড়িতে আসো নি। যার পরিচয়ে এসেছ তার সাথেই থাকছ তুমি।”

পায়েলের সারা শরীরে কম্পন উঠে গেল। ফারদিন তা অনুভব করল। তার হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের রুমের সামনে দাঁড় করাল। তখনই রুম থেকে বেরিয়ে এলো তার দুই বন্ধু। ফারদিনের ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

“কিছু মনে করিস না বন্ধু। তাড়াহুড়োয় ভালো মতো কিছুই করতে পারলাম না। যেটুকু করতে পেরেছি আপাতত সেটুকুতেই খুশি থাক।”

অতঃপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

“হ্যাপি বাসর।”

তাদের পাকনামোতে ফারদিন শক্ত হাতে মাথায় গাট্টা মা’রল। মুখ কুঁচকে নিল সে। ফারদিন গমগমে কন্ঠে বলল,

“যা, গেস্ট রুমে আজ রাত থেকে যা।”

তারা সম্মতি দিয়ে চলে গেল। ফারদিন রুমে প্রবেশ করল। স্বল্প পরিমিতিতে সাজানো দেখে তার কোনো হেলদোল হলো না। পায়েল কে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো।”

যেন আদেশ দিল তাকে। পায়েল গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করল। বাসর ঘরের ন্যায় রুম সাজানো দেখে ঢোক গিলল। এসবের মানে কি! তার আকাশ পাতাল ভাবার মাঝে ফারদিন দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। গা থেকে পাঞ্জাবি আলাদাও করে ফেলেছে। ওয়ারড্রব খুলে জিজ্ঞেস করল,

“ফ্রেশ হবে?”

পায়েল তার দিকে তাকাল। উদাম দেহের পিঠ নজরে আসতেই শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। লজ্জায় তৎক্ষণাৎ পেছনে ঘুরে গেল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,

“নির্লজ্জ! নির্লজ্জ!”

ফারদিন আবার বলে,

“কি হলো? কিছু জিজ্ঞেস করলাম আমি।”

সে আমতা আমতা করে বলে,

“না মানে হ্যাঁ।”

ফারদিন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকে পরখ করে বলল,

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তারপর তুমি যাবে।”

সে জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। পায়েল থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। আজ থেকে এই রুমেই থাকতে হবে! সে আগে কখনও এই রুমে আসেনি। সে আশে পাশে তাকিয়ে দেখল। খুবই পরিপাটি করে গোছানো রুম। ভালো লাগল তার। বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। সাজানো বলতে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছে বিছানায় আর কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতেই সুন্দর লাগছে তার কাছে।
দশ মিনিটে ফারদিন শাওয়ার নিয়ে বের হলো। খালি গায়েই ট্রাউজার পরে বের হলো। পায়েলের দৃষ্টি তার দিকে যেতেই আবার সে লজ্জা পেল। ফারদিন সামনে এসে তার হাতে তোয়ালে দিয়ে বলল,

“আমি রুমের মধ্যে প্রায় এভাবেই থাকি। তোমাকে মানিয়ে নিতে হবে। লজ্জায় নুইয়ে পড়লে চলবে না। যত দ্রুত পারো অভ্যস্থ হও। কি বলেছি বুঝেছ?”

পায়েল ঘাড় কাত করে আবার বিড়বিড় করে,

“নির্লজ্জ!”

ফারদিন ওয়ারড্রব থেকে একটা টি শার্ট এবং একটা ট্রাউজার তার হাতে দিল। পায়েল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল,

“ফ্রেশ হয়ে এগুলোই আপাতত পরতে হবে। আমার রুমে মেয়েদের কোনো জিনিস নেই।”

পায়েল উপায় না পেয়ে সেগুলো হাতে নিয়েই ফ্রেশ হতে চলে গেল। শাওয়ার নিতেই অর্ধেক ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ইতস্তত করে ফারদিনের টিশার্ট ট্রাউজার পরে নিল। ভীষণ লজ্জা লাগছে। আগে কখনও ছেলেদের পোশাক পরেনি সে। অদ্ভুত তো লাগবেই। সে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। শাড়িটা কি করবে ভেবে পেল না।

“ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে এসো।”

সে চুপচাপ চলে গেল। শাড়ি সহ অন্যগুলো মেলে দিয়ে আবার ফিরে এলো। ট্রাউজার পায়ের নিয়ে পড়ছে। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে খুব। কয়েকবার তো হোঁচটও খেল। আর টিশার্ট তো কাঁধ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। হাঁটুর উপরে পড়েছে সেটা। সে টেনে টুনে ঠিক করছে বারবার। ফারদিন তার দিকেই শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পায়েল আড়চোখে তাকিয়ে দেখল গায়ে টিশার্ট জড়িয়েছে সে। স্বস্তির শ্বাস ফেলল। উদাম গায়ে কোনো পুরুষকে সব সময় সামনে দ্যাখা, যদিও সে তার স্বামী! তবুও অসম্ভব।
ফারদিন শুয়ে পড়েছে। শান্ত কন্ঠে বলল,

“শুয়ে পড়ো। অনেক ক্লান্ত নিশ্চয়?”

পায়েল কি করবে? কোথায় শোবে? দাঁড়িয়ে ভাবতেই থাকল। ফারদিন আবারও বলল,

“কি ভাবছ? বিছানায় সমস্যা কোনো? আমি ফুল গুলো ফেলে দিয়েছি। নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়তে পার। আমার শোয়া খারাপ নয়।”

শেষের কথাটা দ্বারা কি বোঝাতে চায়ল তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। পায়েল কি একবারও বলেছে গায়ে হাত পা তুলে দেওয়ার কথা? ঘুমের মধ্যে তো একটু এদিক ওদিক হতেই পারে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এক পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। একটু তাকাল তার দিকে। চোখে উপর এক হাত আড়াআড়ি ভাজ করে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সে। পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ রাতটা কীভাবে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল! ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সকালে ঘুম প্রতিদিনের থেকে একটু দেরিতেই ভাঙল পায়েলের। চোখ পিটপিট করে মেলল। পাশে তাকাতেই থমকে গেল। ফারদিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হকচকিয়ে গেল সে। কিছু মুহূর্তের জন্য হয়তো ভুলেই বসেছিল, সে এখন ফারদিনের স্ত্রী! নিজের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। কাঁধ বেয়ে টিশার্ট অনেকটা নিচে নেমে আছে। লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল। এক লাফ দিয়ে উঠে এক প্রকার দৌড়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করল। ফারদিন সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট মেলে হাসল। তার হাসি দেখলে পায়েল নিশ্চয় আরেক দফা লজ্জা পেত। সে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দৃষ্টির রুমে নক করতেই সে খুলে দিল। সেও সবে ঘুম থেকে উঠেছে। রাতে ঘুম না হবার ফলে উঠতে একটু দেরি হয়। সে এখনও ফ্রেশ হয়নি। ফ্রেশ হতেই যাচ্ছিল, তখন ফারদিন নক করল। সে জিজ্ঞেস করল,

“ভাইয়া তুমি! কখন এলে?”

সে ভাইকে এ সময়ে আশা করেনি। বাড়িতে ছিল না সে। আর না থাকলেও সকাল সকাল বোনের রুমে নক করার কোনো রেকর্ড তার নেই। ফারদিন সে কথার জবাব দিল না। প্রসঙ্গের ধারে কাছেও না যেয়ে বলল,

“তোর একটা ড্রেস দে তো, দৃষ।”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে