সুচরিতা পর্ব-২০+২১

0
504

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-বিশ
মাহবুবা বিথী

রাতে সুসমিতা সুচরিতার কাছে শুয়ে খোকনের বিষয়ে কিছু তথ্য দিলো যা শুনে সুচরিতার মনটা সত্যি খারাপ হয়ে গেল। যে ছেলেকে নিয়ে ওর মা এতো স্বপ্ন দেখে সেই ছেলে শেষ পর্যন্ত তার সম্মান রক্ষা করতে পারবে তো? এলাকার কিছু খারাপ ছেলেদের সঙ্গে পড়েছে খোকন। এসব শুনে সুচরিতা বললো,
—–আম্মা ওকে শাসন করে না?
—–আম্মার কথা শুনলে তো শাসন করবে। আব্বা অসুস্থ হওয়ার কারনে ও লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে। সেদিন ও আমাকে আম্মার সামনে যেভাবে অপমান করলো, অবাক হয়ে গেলাম আম্মা একটা প্রতিবাদ পর্যন্ত করলো না। অথচ আমি ওর বড়।
——কি বিষয়ে বলেছে?
—–আমিতো যেহেতু মাঠ কর্মী হিসেবে কাজ করছি তাই রেগুলার ক্লাস করতে পারিনা। সেদিন অফিস করে আমার বন্ধুদের কাছে পড়া বুঝে নিতে গিয়েছিলাম। বাসায় ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। আম্মু অনেক বকাঝকা করে। খোকন ও আম্মুর কথায় ফোড়ন দিয়ে বলে,”কোথায় নষ্টামী করছিলে যে ফিরতে তোমার এতো রাত হলো”। আমি অবাক হয়ে খোকনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ছেলে হিসেবে আম্মার কথা অনুযায়ী এই সংসারের দায় তো ওর নেওয়া উচিত ছিলো অথচ মেয়ে হয়ে এই দায় তো আমি মাথায় তুলে নিলাম। এবং সংসারের চাকাটা ঠিকঠাকভাবে চলার জন্য টাকার যোগান দিয়ে যাচ্ছি অথচ পুরুস্কার হিসাবে এটা কি আমার প্রাপ্য ছিলো? ওর মুখে একটুও আটকালো না। অথচ আমি তো ওর বড় বোন। ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর গালে কষে থাপ্পড় লাগাই। কিন্তু ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে ঘৃনা ছাড়া আর কিছুই করার ইচ্ছে ছিলো না। সবাইকে ওর নিজের মতো মনে করে।
সুসমিতার কথা শুনে সুচরিতার মনটা কেমন কু,ডেকে উঠলো। খোকনের আবার কোনো খারাপ দোষ হলো কিনা। তাই সুসমিতাকে ও বললো,
—-ওর স্বভাব চরিত্র ঠিক আছে?
—–ওর রুমে মেয়েদের ন্যুড ছবি দেখেছি।
—-আম্মাকে বলিসনি?
——-বলেছি। আম্মা ওকে জিজ্ঞাসা করাতে বলেছে ওর বন্ধু রাসেল এগুলো এনেছে।
—–রাসেল মাঝে মাঝে আসতো। ঐ ঘটনার পর আর আসে না। কিন্তু এর মাঝে অফিস থেকে ফেরার পথে রাসেলের সাথে দেখা হয়েছিলো। ও বলেছে এগুলো খোকন এনে নিজে ভালো থাকার জন্য ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে। ও লজ্জায় আমাদের বাড়িমুখো হয় না। খোকনের সাথে মিশে না। আম্মাকে ন্যুড ছবির কথা জানিয়ে দিয়েছি বলে ঐ রাগ ঝাড়তে আমাকে সেদিন ঐভাবে অপমান করেছে।
—–আম্মা কি ওর কথা বিশ্বাস করেছে?
—–হুম।আম্মার ধারনা ও দুধে ধোয়া তুলশি পাতা। আম্মাও রাসেলের ঘাড়ে দোষ দিয়েছে।
—–আম্মার কাছে এই প্রসঙ্গে আমি কথা বলবো।
——না,আপু তুমি আমার এই বিষয় নিয়ে আম্মার সাথে কথা বলো না। শুধু শুধু অশান্তি বাড়বে। আসছো কয়েকদিনের জন্য শান্তিতে থাকো। তুমিও যে ওখানে খুব ভালো থাকো তাতো নয়। তোমাকে বহুত অশান্তি সহ্য করতে হয়। তুমি আমাকে কিছু না বললেও আমি তোমার মুখ দেখে ঠিক বুঝতে পারি।

কারিমার ছলচাতুরী বুঝেও একটু শান্তিতে থাকার জন্য সুচরিতা বাবার বাড়িতে এসেছিলো। অথচ এখানেও অশান্তির আগুন জ্বলছে।
দু,দিন পর অনেক রাতে খোকন বাড়ি ফিরেছিলো। তা দেখে সুচরিতা ওকে বললো,
—–তোর না সামনে এইচএসসি পরীক্ষা তাহলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাত এগারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলি?
——সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিবো না। নিজে তো বিয়ে শাদি করে স্বার্থপরের মতো নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছো। আমরা ভিক্ষা করে খাবো না যোগালীর কাজ করে ভাত খাবো তাতে তোমার কি?গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াও দামি শাড়ি কাপড় পরো এদিকে আমার ফরমফিলাপের টাকা যোগাড় হয় না। উনি আসছেন আবার কৈফিয়ত নিতে।
সুচরিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–আম্মা খোকন এসব কি বলে গেল?
——কেন শুধু অশান্তি করছিস। ও তো ভুল কিছু বলেনি। আর তোমাকে বিয়ে দিয়েছি। তুমি আর আমার সংসারে মাথা ঘামিও না। এই যে তোমার বাবা অসুস্থ হয়েছে তুমি এসে কটাদিন তোমার বাবার সেবা করেছো?
সুচরিতা ওর মায়ের মুখের দিকে হা, করে তাকিয়ে থাকলো। ও বুঝে পেলো না মা এটা কিভাবে বললো? মা কি পেরেছিলো উনার সংসার ফেলে নানার সেবা করতে? তাহলে ওকে কিভাবে এই কথা বলে?
বড় বড় কথা বলে খোকনও নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। সুচরিতা অবাক হয়ে খোকনের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবে দোষ করলো আবার কথাও শুনিয়ে গেল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আরো অবাক হয়। ওর মায়ের যেন কোনো ভাবান্তর নেই। ভাবটা এমন খোকন যা বলেছে ঠিক বলেছে। সুচরিতা যদিও ভেবেছিলো এই সুবাদে খোকনকে একটু শাসাবে কিন্তু খোকন আর মায়ের ব্যবহারে কিছুই বলতে পারলো না।
যার উপরে একদিন এই সংসারের দায়িত্ব পড়বে তার এহেন অবস্থায় সুচরিতার দিশেহারার মতো লাগলো। ঘরে এসব চিৎকারে ওদের বাবা লাঠি ধরে হেঁটে আস্তে আস্তে ড্রইংরুমের সোফায় এসে বসলো। নিজের কিছু করতে না পারার অক্ষমতায় ফ্যাল ফ্যাল করে সুচরিতার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর ওর বাবার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ওর বাবা মায়ের সংসারের এই হালে ওর খুব অসহায়বোধ হতে লাগলো। সুচরিতা রুমে ফিরে সুসমিতাকে বললো,
——খোকনের আচরণে আমি খুব হতাশ। তবে শোভনের দিকে খেয়াল রাখিস। ওর লেখাপড়ার খরচ তো তুই বহন করছিস। ও যেহেতু এখনও ছোটো আছে ওকে ভালোমতো গড়ে পিঠে নিতে হবে। খোকনের মতো হতে দেওয়া যাবে না।
সে রাতে সুচরিতার চোখে ঘুম এলো না। বারান্দায় বসে নিরবে ওর চোখের পানি ঝড়ছে। কিভাবে ওর মায়ের সংসারটা চলবে আর ওর ভাইবোনের ভবিষ্যত কি এটা নিয়ে ও শঙ্কিত। তবে ওর খুব কষ্ট হলো। ওর মা ওর বিয়ে দিয়েই খালাস। ও বাড়িতে সকাল থেকে রাত অবধি কিভাবে ওর দিনগুলো পার হয় তার খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করেনি ওর মা। খোকন আর ওর মা ধরেই নিয়েছে ও খুব সুখে সংসার করে খাচ্ছে। অথচ প্রতিটি মুহুর্তে ওকে কি লড়াই করতে হয় তা শুধু আল্লাহপাক জানে।
আজ কয়েকদিন হয় হিমেল মেয়েটাকে দেখে না। আর অনেকদিনের অভ্যাস। সুচরিতা না থাকাতে রাতে ঘরে আসলে খুব খারাপ লাগে। তাই অস্থির হয়ে সুচরিতাকে ফোন দিয়ে বললো
——কি ব্যাপার ডার্লিং ভাইবোনদের পেয়ে আমার কথা মনে হয় ভুলেই গেছো।
সুচরিতাও দুষ্টুমি করে বললো,
——তুমি আমার আত্মার সাথে মিশে আছো। তোমাকে কি ভোলা যায়?
কিন্তু সুচরিতা ওর পরিবারের এই দৈন্যতা হিমেলের কাছে প্রকাশ করতে চায় না। তাই হিমেলকে বললো,
——-আসলে বিয়ের পর নিজের সংসার ফেলে মেয়েদের কোথাও থাকতে ভালো লাগে না। তুমি আসলে আমি তোমার সাথে ও বাড়িতে চলে যাবো।আর একটা কথা ছিলো?
——বলো,
——না, মানে আমার কিছু টাকার দরকার ছিলো।
——-কতো?
——- পাঁচহাজার টাকা লাগবে। আসলে খোকনের ফরমফিলাপের টাকা এখন ম্যানেজ করা যায়নি। এ নিয়ে ওর খুব মন খারাপ।
——আচ্ছা সমস্যা নাই। আসার দিন নিয়ে আসবো। তুমি এটা নিয়ে টেনশন করো না।
যদিও হিমেল খোকনের উপর খুব বিভক্ত তবুও সুচরিতার কথা শুনে ফরমফিলাপের টাকা দিতে রাজি হলো। হিমেলও খেয়াল করেছে খোকনের চলাফেরায় উদ্যতভাব।
এর মাঝে শোভনও এসে সুচরিতার কাছে খোকনের নামে নালিশ করলো। সুযোগ পেলেই বিনা কারনে খোকন ওকে পেটায়। খাওয়ার সময় মুরগীর ভালো ভালো টুকরোগুলো নিজের প্লেটে তুলে নেয়। আর শোভনকে হাড় হাড্ডিগুলো তুলে দেয়। সুচরিতা শোভনের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। মানুষের মন এতো নীচুমানের কিভাবে হতে পারে? অথচ ওর বাবা চাকরি করে যা আয় করেছে তার সিংহভাগ ওদের খাওয়া পড়ার পিছনে ব্যয় করেছে। অথচ সেই পরিবারের ছেলে হয়ে খোকনের মন মানসিকতা এতো সংকীর্ণ হলো কিভাবে ও বুঝে পায় না।

সপ্তাহখানিক থাকার কথা থাকলেও পাঁচদিন পর হিমেল বিকেলবেলা সুচরিতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়িতে চলে আসে। সুচরিতার হাতে পাঁচহাজার টাকা তুলে দেয়। সুচরিতা আসলেই কয়েকটাদিন মায়ের সংসারে একটু শান্তিতে থাকতে এসেছিলো। কিন্তু সংসারের এই পারিপার্শ্বিকতায় বাপের বাড়তে ওর আর থাকতে মন চাইলো না। এটুকু ও বুঝেছে বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে যে জোরটা ছিলো এখন আর তা নেই।
অতঃপর সুচরিতা ওর মায়ের হাতে খোকনের ফরমফিলাপের টাকা ওর বাবার ওষুধের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে খোকনকে ডেকে বলে,
——পরীক্ষা সামনে চলে আসছে তাই বদমায়েসি বাদ দিয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগ দাও। অনেক কষ্ট করে টাকা যোগাড় করতে হয় কথাটা মনে রেখো।
অবশ্য ওর কথা শুনে মা, আর খোকন কোনো রিঅ্যাকশন দিলো না। সুচরিতাও ড্রইংরুমে হিমেলের সাথে কথা বলতে চলে গেল। বাচ্চার কান্নার শব্দ পেয়ে রুমে যাওয়ার সময় শুনতে পায় খোকন ওর মাকে বলছে,
—–তোমার মেয়ে টাকা দিতে না দিতেই খোঁটা দেওয়া শুরু করলো।
কুত্তার লেজ হাজারো তেল মর্দন করলেও সোজা হয় না এই কথাটার যথার্থ মমার্থ সুচরিতা অনুধাবন করতে পারলো।
বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে চলে আসলো। সুসমিতা চা আর নাস্তা দিলো ড্রইংরুমে। নাস্তা করে সবার কাছে বিদায় নিয়ে সুচরিতা শ্বশুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো আর মনে মনে ভাবলো কাল থেকে আবার সেই কূটকাচালীর সংসারে জীবনটাকে চালিয়ে নিতে হবে।

চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-একুশ
মাহবুবা বিথী

গাড়ি যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার দিয়ে কল্যানপুরের দিকে ছুটে চলছে। হিমেল গাড়ির সামনের আয়নায় সুচরিতাকে দেখছে। হিমেল অবশ্য সুচরিতাকে গাড়ির সামনে সিটে ওর পাশে বসতে বলেছিলো। সুচরিতা বলেছিলো বাচ্চা নিয়ে পিছনে বসতেই ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে। ও মনে হয় একটু একা থাকতে চাচ্ছে। হিমেল গাড়ি ড্রাইভ করা অবস্থায় বুঝতে পারছে সুচরিতার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বাবার বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় প্রতিটি মেয়ের খুব কষ্ট হয়।গাড়ির ভিতর সুনশান নিরবতা। জানালার কাঁচ দিয়ে সুচরিতা বাইরে তাকিয়ে আছে। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের মায়াবী
আলো সুচরিতার মুখে পড়াতে ওকে যেন স্বর্গের অপ্সরীর মতো লাগছে। বারবার হিমেল আয়নায় সুচরিতাকে দেখছে। তারপরও সুচরিতার অবয়বে বিষাদের ছায়া। একসময় নিরবতা ভেঙ্গে হিমেল বললো,
—–তোমার মনে হয় মনটা খুব খারাপ লাগছে। আমার কারনে তোমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হলো। নয়ত তুমি আরো কয়েকটা দিন থাকতে পারতে।
—–আমি একদম ঠিক আছি।
সুচরিতা ভাবছে ওর কপালে মনে হয় এই মুহুর্তে শান্তি লেখা নেই। এটা হয়ত আল্লাহপাকের তরফ থেকে ওর পরীক্ষা। আল্লাহপাক তার বান্দাকে যখন নিজের কাছে পেতে চান তখন তার সমস্ত আপনজনকে সরিয়ে নেন। যাতে সেই বান্দা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহপাকের দরবারে সঁপে দেয়।
হিমেল আর কোনো কথা বাড়ালো না। আসলে সুচরিতার মনটা খারাপ ভিন্ন কারনে। ছোটোবেলা থেকে যখন বড় হতে থাকে মা সবসময় বলতো, মেয়ে হয়ে জন্মেছো তোমায় ত্যাগ করতে হবে। ও ভাবে শ্বশুরবাড়ির দোষ দিয়ে কি হবে। মায়ের এই কথা শুনে বড় হওয়া সুচরিতার মননে আর মস্তিস্কে ত্যাগ করা শব্দটা গেঁথে গেছে। যারফলে ঐ জায়গা থেকে ও বের হয়ে আসতে পারে না। কিন্তু ও ওর মেয়েকে কোনোদিন ত্যাগ করতে বলবে না। বরং ও বলবে” তোমার যেটা হক তুমি সেটা আদায় করে নিবে। কোনোদিন নিজের হক ছেড়ে দিবে না”।
ও কোলে পিঠে করে ভাই দুটোকে বড় করেছে। খোকনটা ওর থেকে আট বছরের ছোটো। ওকে কোলে নিতে গিয়ে কোমরটাতে একসময় কালো দাগ পড়ে গিয়েছিলো। অথচ আজ বড় বড় কথা বলতে ওর মুখে আটকায় না। আর শোভন ওর তো এখনও চোখ ফুটেনি।
হঠাৎ করে গাড়ি ব্রেক কষে থেমে যাওয়াতে সুচরিতার ভাবনার জগতে ছেদ পড়লো। সুচরিতা একটু অবাক হয়ে বললো,
——কি ব্যাপার গাড়ি থামালে কেন?
——কতদিন তোমায় নিয়ে বাইরে খাওয়া হয় না। চল কোথাও একটু গলা ভেজাই।
——বাবুকে নিয়ে আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে না।
—–সমস্যা নাই আমি ওকে কোলে নিচ্ছি।
গাড়ির দরজা খুলে হিমেল বাচ্চাটাকে কোলে নিলো। সুচরিতাও গাড়ি থেকে নেমে দুজনে সাতমসজিদ রোডে ম্যাডশেফ এ ঢুকলো। হিমেল দুজনের জন্য দুটো নাগা বার্গার অর্ডার করলো। বাবুটার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে দুজনে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে জুসটা হাতে নিয়ে ওরা গাড়িতে গিয়ে বসলো। তারপর হিমেল একটানে গাড়ি চালিয়ে কল্যানপুরে পৌঁছে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত সাড়ে দশটা বাজে। ডোরবেল বাজাতে কারিমা এসে দরজা খুলে দিয়ে সুচরিতাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
—–এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে? আরোও কটাদিন থাকতে পারতে? তোমরা ডিনার করে আসছো তো?আমি আর মা ডিনার করে ফেলেছি। ঘরে এই মুহুর্তে কোনো খাবারও নাই। তোমরা খেতে চাইলে আবার রান্না করতে হবে।
হিমেল একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—–আমরা ডিনার করেই আসছি। ওদের আমিই জোর করে নিয়ে আসছি। খালি ঘরে আমার দমবন্ধ লাগে।
——আসলে আমি ভাবলাম আপনি তো শ্বশুর বাড়ি গিয়েছেন। নিশ্চয় ডিনার করেই ফিরবেন। তাই আমি আর মা সকাল সকাল ডিনার করে ফেলেছি।আর সুচরিতাকে সাথে করে নিয়ে আসবেন তাতো বলে যাননি। তাই বললাম আর কি!
সুচরিতা শাশুড়ীর ঘরে গিয়ে দেখা করে নিজের রুমে গেল। আর মনে মনে ভাবলো কারিমার ভদ্রতা জ্ঞানের কতো অভাব। এই সংসারের যাবতীয় খরচ হিমেল চালায় অথচ মাতব্বরী ভাবখানা দেখাবেন উনি ষোলো আনার উপর আঠারো আনা। আর ও কিছু বললে অমনি শাশুড়ী মা বলবেন,”আমার সংসারের শান্তি নষ্ট করো না। কারিমা তোমার বড় ওকে সে সম্মানটুকু তোমার দেওয়া উচিত”। আর এখন ভাসুর বিদেশে চলে যাওয়াতে শাশুড়ীর আহ্লাদে আটখানা,লেজা মুড়ো দশখানা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা ভেবেই মনে হয় হিমেল ওকে নিয়ে বাইরে থেকে খেয়ে আসছে। ও ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বাচ্চাকে বেস্টফিডিং করালো। হিমেলও ফ্রেস হয়ে এসে বিছানায় বাবুটার পাশে শুয়ে পড়ে বললো,
—–আজ আমার ভীষণ ভালো লাগছে। তুমি ছাড়া চারদিকটা ভীষণ শুন্য মনে হয়। আজ আমার খুব ভালো ঘুম হবে।
সুচরিতার নিরবতায় হিমেল আবারও বললো,
——তুমি কিছু বলছো না যে? মন কি এখনও খারাপ?
——না,বাবুকে বেস্ট ফিডিং করানো পর একটু ক্ষুধা ক্ষুধা লাগছে।
——মেজ ভাবির কান্ডজ্ঞানের খুব অভাব। এরকম হাড়িপাতিল মুছে কেউ খায় এটা আমার জানা ছিলো না। একটু কষ্ট করে রাতটা পার করো।
——তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। সামনের সপ্তাহে আমার রেজাল্ট দিবে।
—–এতো খুব ভালো খবর।
——হুম,তবে আমি কিন্তু মাস্টার্সে ভর্তি হবো।
——তোমার যখন লেখাপড়ার এতো ইচ্ছে যত বাঁধাই আসুক তোমাকে মাস্টার্স কমপ্লিট করাবো। এটা নিয়ে তুমি কোনো প্যারা নিও না।
——-আমাদের আর একটা কাজ বাকি আছে। বাবুটার একটা নাম রাখতে হবে।
——-ও আমি ঠিক করে ফেলেছি।
——আমাকে একটু জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?
——প্রাথমিকভাবে আমার আর আম্মুর পছন্দ হয়েছে। এখন তোমার পছন্দ হলেই ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিবো।
——তা, কি ঠিক করলে?
—–তৈয়বা। সুন্দর না?
——হুম,
একটুপরেই হিমেলের মৃদু নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল। কিন্তু সুচরিতার চোখে ঘুম আসছে না। ওর ক্ষুধাটা বেশ চাগিয়ে উঠছে। এই মুহুর্তে কিছু মুখে না দিলে ওর দুচোখে ঘুম আসবে না। শোয়া থেকে ও সাবধানে উঠলো যাতে বাবুটার ঘুম ভেঙ্গে না যায়। ডাইনিং রুমে গিয়ে লাইট জ্বালালো না। যদি আবার লাইটের আলোয় শাশুড়ী মায়ের কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে যায় তাহলে উনি আবার বিরক্ত হতে পারেন। সুচরিতা ফ্রীজটা খুলে একটু খাবার খুঁজতে লাগলো। পাশের রুমে দরজার নীচ দিয়ে আলোর রশ্নি দেখা যাচ্ছে। কথাও শুনা যাচ্ছে। জেবার গলা শোনা যায়। মনে হয় কারিমা ফোনে সোহেলের সাথে কথা বলছে। মাঝে মাঝে সুচরিতা খিলখিল করে কারিমার হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সুচরিতা অবাক হয়ে ভাবে চাকরি নাই, বউ বাচ্চার জন্য আজ অবধি একটা ফুটা পয়সা পাঠাতে পারলো না। তারপরও মুখ দিয়ে রঙের কথা কিভাবে বের হয়? আধখানা তরমুজ দেখতে পেলো। ওখান থেকে কিছুটা কেটে খেয়ে বাকিটা ফ্রীজে রেখে দিলো। এমন সময় ওর মনে হলো কারিমার রুমের দরজার কাছ থেকে কার যেন একটা ছায়া সরে গেল। সুচরিতা ভাবলো এভাবে লুকিয়ে দেখার কি হলো ও বুঝতে পারলো না। ওর একবার কারিমার দরজায় আড়ি পাততে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ও পারলো না। মানসিকতায় বাঁধলো।
যাইহোক ক্ষুধা মিটে যাওয়াতে ঘুমটা ভালো হলো। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর ওর শাশুড়ী মা আর কারিমার কথা শুনতে পেলো। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেস হয়ে দরজা খুলে যখন কিচেনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে সময় কারিমা ওর শাশুড়ীকে বলছে,
——সুচরিতাদের মনে হয় আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ।
——-তুমি কল্যানপুর থেকে যাত্রাবাড়ির খবর কিভাবে সংগ্রহ করলে?
——যাত্রাবাড়ির মেয়েটা তো আবার এ বাড়িতে থাকে। কথায় আছে না অভাবে স্বভাব নষ্ট। এই কয়দিন মনে হয় বাপের বাড়িতে ঠিকমতো খেতে পায়নি। তাই কাল রাত্রিতে একটার সময় সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সুচরিতা ফ্রীজ খুলে তরমুজ বের করে খায়। আমি সে সময় জেবার জন্য পানি আনতে রুমের বাইরে গিয়ে দেখি সুচরিতা চুরি করে তরমুজ খাচ্ছে। ইচ্ছে করেই ওর সামনে আসিনি। ভাবলাম আমাকে দেখলে ও হয়তো লজ্জা পাবে।
রাগে সুচরিতার শরীর জ্বলতে লাগলো। তাই বের হয়ে বললো,
——ভাবী আপনি বের হলেই পারতেন। খুব ছোটো মনের মানুষ আপনি। এই সংসারটা আমারও। এখানে চুরির প্রশ্ন আসছে কেন?
——এই সংসারটা তোমার না আমারও না। এটা মায়ের সংসার। চোরের মায়ের আবার বড় গলা। ( কারিমা ঝাঁঝ দেখিয়ে বললো)
—–আম্মা ভাবি এসব কি বলছে?
——একসাথে থাকতে গেলে দুচার কথা হয়। তোমরা সাত সকালে অশান্তি করো না। হিমেলের জন্য নাস্তা রেডী করো। ওর অফিস আছে।
এ কথা বলে শাশুড়ী মা নিজের রুমে চলে গেলেন। অপমানে লজ্জায় সুচরিতার চোখ ফেটে বাদলের অঝোর ধারা বইতে শুরু করলো। এটাও ওর কপালে লেখা ছিলো। নিজের সংসারে চোর সাব্যাস্ত হতে হলো। কি ভাগ্য সুচরিতার! ও নাস্তা রেডী করে রুমে গিয়ে হিমেলকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। ঘুম থেকে উঠে সুচরিতার টকটকে লাল চোখ দেখে বললো,
—–কি ব্যাপার তোমার চোখের এই অবস্থা কেন?
সুচরিতা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
——তুমি তো চোরকে বিয়ে করেছো।
——তোমার মাথা ঠিক আছে। কি বলছো এসব?
——মাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো।
হিমেল ফ্রেস না হয়ে ওর মায়ের রুমে গিয়ে বললো,
——কি ব্যাপার মা এসব কি শুনছি?
——হিমেল তুই তো আমার সাথে কখনও এভাবে উচ্চস্বরে কথা বলিসনি? বিয়ের পর আস্তে আস্তে তোর এই উন্নতি হয়েছে।
——মা, আমি সংসারের টপ টু বটম সমস্ত খরচ মুখ বুঝে করি। এর বিনিময়ে আমি তো চাইবো আমার ঘরে শান্তি থাক।
——-এখানে অশান্তির কি দেখলি? একসাথে থাকতে গেলে দুচার কথা হয়। তাই বলে সেটা গায়ে মাখতে হবে কেন? আমি তো ওকে কিছু বলিনি। যা গোসল করে নাস্তা খেয়ে অফিসে যা। আমার হয়েছে যত জ্বালা।
হিমেল মুখ ভার করে ঘরে এসে গোসল করে নাস্তা না খেয়ে অফিসে চলে গেল। সুচরিতা আগেই জানতো হিমেল এই কাজ করবে। এই জন্য টিফিন বক্স রেডী করে ড্রাইভারের কাছে বক্স পৌঁছে দিয়েছিলো। হিমেল অফিসে যাওয়ার পর ওর মা এসে বললো,
——শান্তি হলোতো এবার? আমার ছেলেটাকে না খাইয়ে অফিসে না পাঠালে তোমার চলছিলো না।
সুচরিতা মুখে কিছু না বলে আপন মনে কিচেনে দুপুরের রান্নার যোগাড় করতে লাগলো। কারন এক কথায় দু কথায় শাশুড়ীর সাথে লেগে গেলে আমার হিমেলের কাছে সুচরিতার নামে অভিযোগ করা হবে। অতঃপর আবারো সেই অন্যায় না করেও শাশুড়ী মায়ের কাছে মাফ চাইতে হবে। সুচরিতার এসব নাটক আর ভালো লাগে না।
দুপুরে লাঞ্চের সময় ড্রাইভার টিফিন বক্সটা হিমেলের কাছে পৌঁছে দিলো। হিমেল ড্রাইভারকে বললো,
—–কি ব্যাপার মতি বাসা থেকে খাবার পাঠয়েছে?
—না,স্যার সকালে ম্যাডাম টিফিন বক্সটা দিয়ে বলেছে লাঞ্চের সময় আপনাকে দিয়ে দিতে।
লাঞ্চ বক্সটা দিয়ে মতি চলে গেল। হিমেলের সুচরিতার জন্য কষ্ট হতে লাগলো। এতো কিছুর পরেও সুচরিতার দায়িত্বের ক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি নাই। হিমেল জানে ওর মেজভাবিটা কুটিল। সারাক্ষণ কূটনামী করতে থাকে। প্রতিদিন সুচরিতাকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। হিমেলের ও খুব অসহায় ফিল হতে লাগলো। কি করে এই পরিস্থির উত্তরণ ঘটবে ও বুঝতে পারছে না। তারউপর করোনা ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াতে ব্যবসার অবস্থাও খুব একটা ভালো না। এদিকে ওর মেজভাই সোহেল কোনো টাকা পয়সা পাঠাতে পারছে না। উল্টো তার সংসারের সবকিছু হিমেলকে সামলাতে হচ্ছে। বড় ভাই তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সব দায় যেন হিমেলের ঘাড়ে উপর চেপে বসে আছে

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে