সুখের খোঁজে পর্ব-২২+২৩

0
591

#সুখের খোঁজে…… (পর্ব -২২)
#মৌমিতা হোসেন

বাসায় এসে তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে নিতু কে ফ্রেশ হতে বলে। নিতুর শরীর খারাপ লাগায় কোন কথা না বলে ফ্রেশ হতে চলে যায়।বের হয়ে দেখে রুমে তৌসিফ নেই।তোয়ালে নেড়ে খাবার দিতে রান্নাঘরে যেতে নিলেই দেখে তৌসিফ টেবিলে খাবার দিচ্ছে, বাবাকে খেতে ডাকছে । নিতু কে দেখেই ডেকে চেয়ার টেনে দিলো বসার জন্য। নিতু কিছু বলতে যাবে অমনি মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।বলে,”আজ থেকে তোমার রান্নাঘরে ঘোরাঘুরি করা বারন।”

নিতু অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”মানে কি? ঘরের এতো কাজ কে করবে?পাগল হয়েছেন?”

“হুম পাগল হয়েছি।ডাক্তার বলেছে শোনোনি?পুরো রেস্ট নিতে হবে।ভারী কাজ করা নিষেধ। তাহলে সমস্যা হবে।”

“আরে, এসব তো ডাক্তার বলবেই।তাই বলে ওদের কথা শুনে শুধু বসে শুয়ে থাকলে কি হবে?”

এর মাঝে আকবর আলি এসে বলেন,”কি হয়েছে?কি নিয়ে তোদের এতো কথা চলছে শুনি।আর ডাক্তার কি বলেছে।”

“সেটাই তো বলছি নিতু কে।ডাক্তার বলেছে বেশি কাজ করা যাবেনা। বেশি বেশি রেস্ট নিতে হবে। কিন্তু ও শুনছেই না।”

“বৌ মা ডাক্তার যদি বলে তাহলে তো মানতেই হবে।”

“সেটাই বাবা। তুমি একটু বলে দাও নিতুকে।”

নিতু তখন বেশ বিরক্ত হয় তৌসিফ এর ওপর।আর বলে,”বাবা ওনাকে বলুন বেশি বাড়াবাড়ি না করতে।ডাক্তার যেভাবে বলেছে আমি সেভাবেই চলবো।ডাক্তার আমাকে কাজ করতে মানা করেনি।বলেছে সাবধানে চলতে ,ধীরে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করতে। আমি সেভাবেই করবো।আর আমার কাজে যেনো উনি বাধা না দেয়।যদি পারে তাহলে যেনো দোকানে যাওয়া শুরু করে। এতে আপনার উপকার হবে বাবা।কারন আপনার শরীর ভালো না।আর কেউ খেয়াল না করলেও আমার চোখে এটা ঠিকই ধরা পড়েছে।”হঠাৎ করে অনেক সাহস করে কথাগুলো বলে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে শ্বশুর এবং তৌসিফ দু’জনই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ওর কথা শুনছে। তৌসিফ এর চাহনি দেখে মনে হচ্ছে আজ ওর খবর আছে।কি করবে ভেবে পায়না।

সাথে সাথে আবার মাথা নিচু করে বলে, “দুঃখিত । আমি কি খুব বেশি কিছু বলেছি?কোন ভুল কিছু বললে মাফ করে দেবেন।”

এতোক্ষণ ধরে নিতুর কথা শুনে আকবর আলি বলেন,”না বৌমা একটুও ভুল বলিস নি।সব ঠিক বলেছিস। আমাকে নিয়ে যে আমার মেয়ে এতো ভাবে সেটা দেখে খুব ভালো লাগলো ‌আমার। তৌসিফ দোকানে যাবে কিনা সেটা আমার জানা নেই তবে তুই যে বলেছিস এতেই আনন্দে আমার বুকটা ভরে গেছে।আর একটা কথা সংসার টা তোর।তাই কীভাবে কী করলে ভালো হবে সেটা তুই ভালো বুঝবি। তবে হ্যা শরীর খারাপ করে কোন কাজ করা যাবেনা বৌমা। দরকার হলে রাহেলার কাজ বাড়িয়ে দে।বেতন বাড়িয়ে দে।মোটকথা আমার বৌমাকে সুস্থ থাকতে হবে।”

নিতু বাবার কথা শুনে বেশ খুশী হয়। হাসিমুখে বলে ধন্যবাদ বাবা।এর মধ্যে তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে দেখে রাগি চোখে ওকে দেখছে। নিতু চুপচাপ আর কোন কথা না বলে খেতে বসে।খাওয়ার সময় আর কেউ কারো দিকে একবার এর জন্য তাকায়নি। নিতু মনে মনে ভাবছে আজতো ওর খবর আছে। তৌসিফ খেয়ে রুমে চলে যায়। নিতু কে কাজের ব্যাপারে আর কিছু বলেনা। নিতুর একটু মনটা খারাপ হয়।সব গুছিয়ে নিতু রুমে গেলে দেখে তৌসিফ রুমে নেই আর বারান্দায় দরজা চাপানো। নিতু বারান্দার দরজা খুলতে নিলেই তৌসিফ বলে ওঠে,”দরজা খুলোনা নিতু। আমি সিগারেট খাচ্ছি। তোমাদের ক্ষতি হবে তাই দরজা চাপানো। আমি আসছি একটু পরে।”

নিতু শুনে আবার অবাক হয়। সাথে তৌসিফ এর চিন্তা দেখে খুশিও হয়।ও ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পরে।এরই মধ্যে তৌসিফ ও ফ্রেশ হয়ে এসে নিতুর পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। নিতু বলে,”আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?”

তৌসিফ নিতুর কপালে চুমু খেয়ে বলে ,”করেছি তবে অল্প। আমার নিতু দেখলাম আজ বেশ সাহসী হয়ে গেছে। আমার মুখের ওপর কতো গুলো কথা বললো।বাচ্চার খবর পাওয়ার সাথে সাথে এতো পাওয়ার আর বাচ্চা যখন চলে আসবে তখন কি অবস্থা হবে সেটা ভাবছি।”

খানিক লজ্জা পায় নিতু।বলে,”সাহস কোথায় দেখালাম?দেখুন সারাদিন আমরা এই তিনজন মাত্র মানুষ।খালা বেশির ভাগ কাজ করে দেবে। বাকিটুকু যদি না করি তাহলে কীভাবে হবে।আর মা বলেছে,এ সময় সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে নাকি ক্ষতি হয়। একটু কাজকর্ম করতে হয়।আর আমি নিশ্চই এমন কোন কাজ করবো না যেটায় আমার বা বাচ্চার কোনো ক্ষতি হতে পারে।”

এতোক্ষণ চুপচাপ শুনে তৌসিফ বললো,”বুঝলাম। তবে সাবধানে করবে কিন্তু।যদি দেখি তুমি অসুস্থ হয়েছো তাহলে কিন্তু সব কাজ বন্ধ করে রুমে আটকে রাখবো মনে থাকে যেনো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে মনে থাকবে। আমি এমন কিছু করবো না যাতে অসুস্থ হতে পারি।হলো?”

“হলো।নিতু?”

“হুম বলুন।”

“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার বাবার দিকে এতো খেয়াল রাখার জন্য।”

নিতু মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে বললো,”আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে লাভ কি। বাবার দিকে খেয়াল রাখা আপনার ও দায়িত্ব।আর এখনতো নতুন অতিথি আসছে। তাই বলছিলাম যে, আমার একটা কথা রাখবেন?”

“হুম অবশ্যই রাখবো যদি রাখার মতো হয়।বলো।”

“প্লিজ কাল থেকে আপনি বাবার সাথে দোকানে যান।কাজ বুঝে নেন।দোকানের দায়িত্ব বুঝে নেন। বাবাকে এখন একটু বিশ্রাম দেন।বয়স হয়েছে বাবার। একটু বোঝার চেষ্টা করুন।”

তৌসিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”ঠিক আছে। কাল থেকে আমি দোকানে যাবো হলো তো?”

নিতু বুঝতে পারেনি যে তৌসিফ এতো সহজে ওর কথা মেনে নেবে। খুব অবাক হয় তৌসিফ এর কথা শুনে। খুশিতে জড়িয়ে ধরে ওকে।বলে,”অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।আর অনেক ভালোবাসি। অনেক।”

“আমিও অনেক ভালোবাসি তোমাকে।আর তোমার কথা মেনে নেয়ার জন্য আমাকে কিন্তু তোমার কোন উপহার দেয়া উচিত।”

“আমি? আমি আপনাকে কি দেবো বলুন। আমার কাছে তো আপনাকে দেয়ার মতো কিছুই নেই।”

তৌসিফ দুষ্টু হাসি দিয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”কে বলেছে তোমার কাছে আমাকে দেয়ার মতো কিছুই নেই। তোমার কাছে যা আছে তা অন্য কারো কাছে নেই।”

নিতু তৌসিফ এর কথা বুঝতে পেরে লজ্জায় ওর বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তৌসিফ বলে,”কদিন পর আমার বাচ্চার মা হবে অথচ এখনো এতো লজ্জা? তাহলে কীভাবে কি করবো?”

নিতু তৌসিফ এর লাগাম ছাড়া কথা বন্ধ করার জন্য ওর মুখের ওপর হাত দেয়। তৌসিফ নিতুর হাতে পরম আবেশে আদর দিয়ে জড়িয়ে ধরে। চলতে থাকে দুজনের লাগাম ছাড়া ভালোবাসা।

পরদিন সকালে তৌসিফ রেডি হয়ে এসে বাবার সাথে বসে নাস্তা শেষ করে।অন্য সময় নিতু পরে নাস্তা খেলেও আজ ওর সাথেই বসায়।কারন নিতু যাতে ঠিকমতো খায়। নাস্তা শেষে আকবর চলে যেতে নিলে তৌসিফ বলে,”বাবা দাঁড়াও। আমিও যাবো তোমার সাথে।”

আকবর আলি, নিতু দুজনই অবাক হয়। তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কেনো কিছু বলবি?”

“হুম। আমিও বের হবো তোমার সাথে। মানে আজ থেকে আমিও তোমার সাথে গিয়ে দোকানে বসবো। কিছু দিন কাজগুলো আমাকে শিখিয়ে দিও।তারপর আমি কাজ শিখে ফেললে তোমাকে আর যেতে হবে না।আজ থেকে দোকানের দায়িত্ব নিতে চাই বাবা। দেবে না বুঝিয়ে?”

আকবর আলি একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছেলের কথা শুনছে। বিশ্বাস হচ্ছে না। কেঁদে ফেলে তিনি। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।বলে,”সত্যি তুই যাবি?আজ থেকে তাহলে আমি চিন্তা মুক্ত হলাম? তোকে নিয়ে আমার আর কোন চিন্তা নেই।আর কোন চিন্তা নেই।”

তৌসিফ ও বাবাকে জড়িয়ে ধরে। নিতুও খুশি হয়ে বাবার -ছেলের মধ্যকার ভালোবাসা দেখতে থাকে। তৌসিফ রাজি হলেও নিতু ভেবেছিলো আরো কিছু দিন পরে হয়তো যাবে দোকানে। কিন্তু সত্যি আজকেই এমন পরিবর্তন দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।

আকবর আলি নিতুর কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।বলে,”আজকে এসব সম্ভব হয়েছে শুধু মাত্র তোর জন্য। তোকে ছেলের বৌ করে এনে আমি জিতে গেছিরে।এই জীবনে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আমার সব চিন্তা শেষ। তোরা দুজনে সুখে থাকবি এটাই দোয়া করি। ভালো থাকিস মা।”

নিতুর শ্বশুর এর দোয়ায় আর মমতা মাখানো ভালোবাসায় ওর বাবার কথা মনে পড়ে।আজ মনে হচ্ছে ওর মতো সুখি আর কেউ নেই।

তৌসিফ বলে,”বাবা মেয়ের ভালোবাসা শেষ হলে এখন চলো বাবা আমরা যাই।

“হুম চল। দেরি হয়ে গেলো।”

বের হবার আগে নিতু যাতে অতিরিক্ত কোন কাজ না করে সেই ব্যাপারে সাবধান করে দেয়।আর রাহেলা কে বলে যায় নিতুর দিকে খেয়াল রাখতে।দুজন বেরিয়ে পড়লে নিতু রাহেলা কে নিয়ে ঘরের রান্না সহ সব কাজ শেষ করে। রাহেলা অবশ্য নিতু কে তেমন কোন কাজ করতে দেয়না। নিজেই বেশির ভাগ কাজ করে। দুপুরে শ্বশুর আর তৌসিফ দুজন খেতে আসে। বিকেলে আবার যায়। বাসায় ফিরতে রাত এগারোটা বেজে যায়। আজ তৌসিফ কে দেখে প্রচন্ড ক্লান্ত মনে হয়। তৌসিফ আজ বুঝতে পারে দোকানে সারাদিন ওর বাবা কতোটা কষ্ট করে।মনে মনে ঠিক করে বাবাকে আর এতো কষ্ট করতে দেবেনা।সব বুঝে নেয়ার পর থেকে বাবাকে বলবে বাসায় বসে বিশ্রাম নিতে।

কেটে যায় সাত মাস। নিতুর প্রেগনেন্সির নয় মাস শেষ।ওজন অনেকটাই বেড়ে গেছে এই কয় মাসে।আর বেশি দিন বাকি নেই ডেলিভারির। সামনের মাসেই ডেট দিয়েছে। শরীরটা কয়েকদিন থেকেই খারাপ লাগছে।এখন উঠতে, বসতে, খেতে সব কিছুতেই কষ্ট হয় নিতুর।শুলেই মন হয় যেনো শ্বাস নিতে পারছেনা। আয়নায় নিজেকে দেখতে বিশ্রি লাগে।বিশাল বড় পেট।গতো কয়মাস থেকেই আর শাড়ি পড়তে পারেনা।ঢোলা জামা, পেটিকোট পড়তে হচ্ছে।সাজলেও নিজেকে বিরক্ত লাগে দেখতে। বাবুটা হঠাৎ হঠাৎ পেটে লাথি মারে,নড়াচড়া করে তখন কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভূতি আসে।ওর ভেতরে একটা প্রান একটু একটু করে বড় হচ্ছে।ওর নিজের সন্তান।ভাবা যায়!!

গতো এই কয় মাস তৌসিফ এর অতিরিক্ত ভালোবাসায় নিতুর অবস্থা খারাপ।এখন নিয়ম করেই রোজ দোকানে যায়।আকবর আলি এখন আর দোকানে যায়না।সব বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করে তৌসিফ এর মনোযোগ এখন শুধু পরিবার আর দোকানের দিকে। সকালে দোকানে যাওয়ার আগে একসাথে নাস্তা খাওয়া, দোকানে যাওয়ার পর থেকে শুরু হয় তৌসিফ এর ফোন।ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে আর নিতুর সব কাজ পর্যবেক্ষণ করে। নিতু মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত হলেও আবার তৌসিফ এর ভালোবাসা দেখে খুশিতে মন ভরে যায়।নিয়ম করে রোজ দুপুরে বাসায় আসার সময় নিতুর জন্য ফুলের মালা নিয়ে আসে , খোঁপায় পড়িয়ে দেয়।রাতে নিয়ম করে পেটের ওপর কান পেতে নতুন সদস্যের সাথে কথা বলবে , পেটে চুমু খাবে, আহ্লাদ করবে।

আজকেও রাতে ঘুমোতে এসে নিতু কে জড়িয়ে ধরে বলছে, “আমার কিন্তু একটা মা চাই বলে দিলাম। মাকে আমি ছোটবেলায় হারিয়েছি তাই আমি চাই আমাদের প্রথম বাচ্চাটা মেয়ে হোক।”

নিতু বলে,”আল্লাহ যা দেয় তাতেই খুশি হবেন। দোয়া করুন যেনো আল্লাহ একটা সুস্থ বাচ্চা দেন। আমারতো এটুকুই চাওয়া।”

“ঠিক আছে তাও তোমার কথাই মেনে নিলাম। তবে মেয়ে হলে আমি বেশি খুশি।”বলে আবার পেটে চুমু খেয়ে নিতু কে জড়িয় ধরে শুয়ে পরে।এসব দেখে নিতু প্রায়ই আবেগে কেঁদে দেয়।ভাবে এতো সুখ ওর কপালে সইবে তো।

আকবর আলি এখন বাসাতেই থাকে। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া, হাঁটাহাঁটি করা, খাওয়া,ঘুম এই হলো ওনার কাজ। নিতু কে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে।

জুঁই, বিথি, সাদিয়া প্রতিদিন একবার করে বিকেলে এসে নিতু কে দেখে যায়।চাচিরাও ভালো মন্দ রান্না হলে নিতু কে দিয়ে যায়। নিতুর বেশ সুন্দর সময় কাটে। তবে শরীরটা আজকাল ভালো লাগে না।

তপুর একটা চাকরি হয়েছে। নিতু শুনে বেশ খুশী হয়। তৌসিফ পছন্দ না করায় সহজে তপুর সামনে যায়না নিতু। তবে মনে মনে ঠিক করে বাবুটা পৃথিবীতে এলে দুভাই এর মধ্যে যাতে সম্পর্ক ভালো হয় সেই ব্যবস্থা করবে।

আজ সকাল থেকেই নিতুর শরীরটা ভালো লাগছে না।কেমন যেনো অস্থির লাগছে।গতো সপ্তাহে ডাক্তার দেখানোর পর বলেছিলো যে পানি কমে গেছে।বাচ্চার নড়াচড়া যেনো খেয়াল রাখে।আজ সকাল থেকে মনে হচ্ছে বাবুটা কম নড়ছে।তাই কেমন যেনো অস্থির লাগছে নিতুর।

চলবে…….

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -২৩)
#মৌমিতা হোসেন

সকাল থেকেই খারাপ লাগলেও বিষয়টা তৌসিফ কে জানায়নি নিতু।ভেবেছে ঠিক হয়ে যাবে।কারন ডেলিভারি ডেট আরো দশ দিন পরে ছিলো। তৌসিফ অবশ্য প্রতিদিন খাওয়ার আগে নিতু কে নিয়ে একসাথে বসে নাস্তা খেয়ে সব ঔষধ খাইয়ে তারপর দোকানে যায়।যাওয়ার আগে সবাইকে বারবার বলে যায় যেনো নিতুর খেয়াল রাখে।কোন সমস্যা হলেই যেনো ফোন দেয়।আরো অনেক কিছু। সবাই এসব দেখে মিটমিট করে হাসে। তৌসিফ কে সবাই এখন মজা করে “বৌ পাগল “ডাকে।যদিও পেছনেই সবাই ডাকে। সামনে বলার সাহস কারো নেই।তবে তৌসিফ এর কেনো জানি এতে একটুও রাগ হয়না।ও বেশ মজা পায়।মনে মনে ওর এই ডাকটা ভালোই লাগে।আর নিতু এসবে বেশ লজ্জা পায়।

যাই হোক আজকেও তৌসিফ নাস্তা শেষ করেই দোকানে যায়। তবে আজ যাওয়ার আগে কেমন অস্থির লাগছিলো। নিতু কে ছেড়ে যেতে ইচ্ছেই করছিলো না। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে বলছিলো,”বৌ আজ না যাই।কেনো জানি ভালো লাগছে না।”

নিতুর খারাপ লাগলেও বুঝতে না দিয়ে বলে,”না যান। সবাইতো বাসাতেই আছে। সমস্যা হলেই আপনাকে ফোন দেবো আমি। চিন্তা করবেন না একদম।”

“ঠিক আছে।মনে থাকে যেনো। খারাপ লাগলেই ফোন দেবে।”বলে একটা হাসি দিয়ে নিতু কে জড়িয়ে ধরে কপালে,গালে আদর দিয়ে চলে যায়। এটাও অবশ্য এখন তৌসিফ এর প্রতিদিনের কাজ।

তৌসিফ যাওয়ার পরেই নিতু রুমে এসে শুয়ে পড়ে।আজ আর কি রান্না হবে বা কোন কিছুই রাহেলাকে বলেনা। রাহেলা ভাবে হয়তো খারাপ লাগছে নিতুর তাই আর ডাকতে যায়না।আপন মনে অন্যান্য কাজ করতে থাকে।

এদিকে নিতুর হঠাৎ পেট ব্যাথা শুরু হয়। খারাপ লাগতে থাকে। মায়ের কথা মনে পড়ে। সালেহা গতো সপ্তাহেই এসে দেখে গেছে মেয়েকে। সাথে নিয়ে যেতে চাইলে তৌসিফ বাঁধা দেয়।ও নাকি নিতু কে ছেড়ে থাকতে পারবেনা ।তাই নিতুও তৌসিফ এর কথা ভেবে যায়নি।পেটের ওপর হাত রেখে শুধু এপাশ ওপাশ করতে থাকে।মনে মনে ঠিক করে তৌসিফ কে ফোন দেবে।ফোন নেয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠতে নিলেই ব্যাথায় আবার বসে পরে। হঠাৎ প্রচন্ড ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিলে রাহেলা দৌড়ে নিতুর রুমে আসে। নিতুর অবস্থা দেখে আতঙ্কে কি করবে ভেবে পায়না রাহেলা। আকবর আলি তখনই বাজারে গিয়েছে মাত্র। রাহেলা তৌসিফ কে ফোন দেয়। কিন্তু লাইন ব্যস্ত আসলে দৌড়ে চাচিদের ডাকে। সবাই তাড়াতাড়ি এসে নিতুর অবস্থা দেখে বুঝতে পারে ডেলিভারি পেইন উঠেছে। নিতু কে কীভাবে হসপিটালে নিয়ে যাবে এসব নিয়ে যখন সবাই চিন্তিত তখন তপু খবর পেয়ে দৌড়ে আসে।

তপুর অন্য কাজ থাকায় আজ তপু অফিসে যায়না।সেই কাজের জন্য বের হবে এমন সময় বিথির কাছে নিতুর অবস্থার কথা শুনে দৌড়ে আসে। নিতু কে দেখেই আগে সিএনজিতে করে হসপিটালে নিয়ে আসে। ওদের সাথে তপুর মা, জুঁই ও আসে।আর এদিকে আকবর আলি খবর পেয়ে ওনারা অন্য গাড়িতে করে হাসপাতালে চলে আসে।পথেই ফোন করে তৌসিফ কে খবরটা জানায়।খবর শুনেই তৌসিফ দোকান বন্ধ করে রওনা দেয়। নিতু কে হসপিটালে ইমারজেন্সি তে ভর্তি করানো হয়।

এরই মাঝে তৌসিফ হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে এসে নিতু কে খুঁজতে থাকলে আকবর আলি ছেলের কাছে এসে বলে,”চিন্তা করিস না বাবা। নিতু ওটিতে আছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর । ইনশাআল্লাহ ভালো খবর আসবে।আজ তপু না থাকলে তো বিপদেই পরে যেতাম।ভাগ্যিস ও আজ ছিলো।”

তৌসিফ নিতুর চিন্তায় বাবার কথা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না।চুপ করে ওটির সামনে গিয়ে বসে পড়ে।মনে মনে বলতে থাকে,”কেনো আজ আমি তোমাকে ছেড়ে গেলাম নিতু। ওটিতে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে দেখতে পেলাম না। কথা ছিলো এই কষ্টের পুরো সময়টা আমি তোমার পাশে থাকবো। কিন্তু পারলাম না। আমার ব্যর্থতা যে আমি তোমাকে দেখে তোমার যে কষ্ট হচ্ছিলো সেটা বুঝতে পারিনি।তুমি … তুমি নিশ্চই আমাকে খুজছিলে।”ঘামে ভেজা শার্ট, এলোমেলো চুল সব মিলিয়ে পাগল লাগছিলো তৌসিফ কে ‌।মনে মনে আল্লাহকে বারবার স্মরন করতে থাকে তৌসিফ।

অন্য সবাই ও খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। তপু এসে তৌসিফ এর কাঁধে হাত রেখে চিন্তা না করার জন্য ইশারা দেয়। তৌসিফ কিছু বলেনা।প্রায় ঘন্টাখানেক পর নার্স একটা ধবধবে সাদা ছোট্ট একটা পরীকে নিয়ে এসে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে হয়েছে। প্রথমে কে কোলে নেবেন?কার কাছে দেবো?”

সবাই দৌড়ে যায়। সাথে তৌসিফ ও।চাচি নাতিকে কোলে নেয়। সবাই ছোট বাবুকে দেখে যখন মহাখুশি তৌসিফ তখন নার্স এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমার নিতু কেমন আছে?ও ঠিক আছে তো? আমি কি ওর কাছে একটু যেতে পারবো?”

নার্স বলেন,”না স্যার। ওনার এখন সেন্স নেই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একটু দুর্বল হয়ে গেছে।রক্ত দিতে হয়েছে। ঘন্টা দুয়েক পর দেখতে পারবেন। তবে আলহামদুলিল্লাহ যে নরমাল ডেলিভারী হয়েছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”এমন সময় চাচি সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাকে এনে তৌসিফ এর সামনে ধরে বলে,”তোর মেয়েকে কোলে নিবি না বাবা?দেখ কি সুন্দর ফুটফুটে চাঁদের মতো মেয়ে হয়েছে তোর। মাশাআল্লাহ।”

তৌসিফ এর যেনো এতোক্ষণে মেয়ের কথা খেয়াল হলো। তাকিয়ে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগলো । সত্যি একেবারে পরী।চাচির দিকে হাত বাড়াতেই তৌসিফ এর কোলে দিয়ে দিলো। তৌসিফ কোলে নিলো ঠিক তবে কীভাবে সামলাবে বুঝতে পারছিলো না।এতো তুলতুলে নরম!বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে।মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বলে, “মাশাআল্লাহ।”আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব সুখ আজ ওর ঝুলিতে এসে জমেছে।চোখ থেকে না চাইতেও পানি গড়িয়ে পরে।বলে ,”আজ থেকে আমি তোকে তুলি নামে ডাকবো। তুলোর মতো নরম তুই তাই তুই হলি আমার তুলি।”

তৌসিফ এর কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে দেয়। তপু এসে মেয়ের কানে আযান দেয়।চাচা হয়েছে তাই তপুর আনন্দ কোনো অংশে কম নয়।এরই মাঝে ঠোট ফুলিয়ে কান্না শুরু করলে তৌসিফ অস্থির হয়ে যায়।বলে,”চাচি তাড়াতাড়ি নার্স কে ডাকেন।বাবু কাঁদছে । দেখেন না কোন সমস্যা হলো কিনা।”

তৌসিফ এর অস্থিরতা দেখে আর কথা শুনে আবার সবাই হেসে দেয়।চাচি এসে তাড়াতাড়ি কোলে নেয়।আর বলে,”এতো অস্থির হতে হবে না বাবা।ওর ক্ষুধা পেয়েছে তাই হয়তো কাঁদছে। ওকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যেতে হবে। একটু খাওয়াতে হবে।”

তৌসিফ কপাল কুঁচকে বলে,”কিন্তু নিতু তো ঘুমাচ্ছে।ওর কাছে এখন না নিলে হয়না চাচি? মানে ওর কষ্ট হবে তো।”

“না বাবা কষ্ট হবে না।তুই এখানে বসে থাক।এতো চিন্তা করতে হবে না তোকে।পাগল একটা।”বলে হাসি দিয়ে বাবুকে নিয়ে চাচি নিতুর কেবিনে ঢোকে।

ডাক্তার বলেছে,নিতুর জ্ঞান ফিরলে আজকেই রাতে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে।তাই সবাই বাসায় চলে যায়। তবে হসপিটালে তৌসিফ এর সাথে তপু আর নিতুর মা থেকে যায়।খবর পেয়েই তিনি সাজিদ, সেতুকে নিয়ে রওনা দেন।আর সরাসরি হাসপাতালে চলে আসেন। নাতিকে দেখে যেনো আনন্দের সীমা থাকে না সালেহার।আজ নিতুর বাবার কথা খুব মনে পড়ছে সালেহা বেগম এর। মানুষটা বেঁচে থাকলে কতো খুশি না হতো আজ।

প্রায় ৩ ঘন্টা পরে পর নিতুর জ্ঞান ফেরে। প্রথমেই নিতু তৌসিফ কে খোঁজে। তৌসিফ নিতুর পাশেই বসে ছিলো। নিতু কে চোখ খুলতে দেখতেই ওর হাতে, কপালে চুমু খায়। মাথায় পরম আবেশে হাত বুলিয়ে দেয় আর মৃদু স্বরে বলে,”ধন্যবাদ প্রিয়। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

তৌসিফ কে বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে নিতুর আর বুঝতে বাকি থাকে না। তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে তাই নিতু একটা হাসি দেয় আর বলে,”ভালোবাসি।”মা রুমে থাকায় দুজনের আর তেমন কোন কথাই হয়না।

নিতু কে নিয়ে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। পুরো বাড়িতে আনন্দের আমেজ।আকবর আলি তো বাড়ি ফিরেই মিষ্টি কিনে সবার বাসায় দেয়া শুরু করেছে। আনন্দের যেনো শেষ নেই। রাহেলা আজ আর বাসায় যায়না।তার বৌমনির বাবু হয়েছে তাকে এই অবস্থায় রেখে যায় কীভাবে? সবার আনন্দ দেখে নিতু কেঁদে দেয়।

রাতে আজ সালেহা ঘুমায় মেয়ের সাথে।প্রথমে অবশ্য এটা শুনে তৌসিফ একটু অমত করে । কিন্তু যখন দেখে রাতে বাচ্চা সামলাতে হবে আর বাচ্চার ব্যাপারে তৌসিফ নিতু কারোরি কোন জ্ঞান নেই।তখন নিতুর অনুরোধে তৌসিফ অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাতে রাজি হয়।

প্রথম সাতদিন বাসায় মেহমান, নিতুর অসুস্থতা সব মিলিয়ে তৌসিফ নিতুর কাছে গিয়ে একটু একাকী সময় কাটাতে পারেনি বা কোন গল্প করতে পারেনি।এই এক সপ্তাহ দুজনের কাছে মনে হচ্ছিলো বছরেরও বেশি সময়। সারাদিন বাসায় মেহমান। তৌসিফ দুর থেকে শুধু নিতু কে দেখেছে আর চোখে চোখে দুজন কথা বলেছে।যখন সুযোগ পেয়েছে ছোট বাবুকে একটু কোলে তুলে নিয়েছে,আদর দিয়েছে।এই কদিনেই মনে হচ্ছিলো দুজনের মাঝে অনেক কথা জমেছে । কখন জমানো কথাগুলো বলবে দুজন দুজনকে সেই অপেক্ষায় থাকে দুজন।

বাচ্চার আকিকা দিয়ে নাম রাখে তাসফিয়া তুলি।আকিকা দেয়ার পর নিতুর মা,ভাই-বোন সবাই চলে যায়। সেতু, সাজিদ এর পরীক্ষা থাকায় সালেহা ইচ্ছা থাকলেও নিতুর কাছে বেশিদিন থাকতে পারেনা। তৌসিফ অপেক্ষায় থাকে কখন নিতু কে একা পাবে।দুজন একটু একাকী কথা বলবে। কিন্তু রাতে বাচ্চাকে সামলাতেই দুজন বেশ হিমশিম খায়। একটু পরপর খাওয়ানো, কাঁথা পরিবর্তন করা,ঘুম পরানো সব মিলিয়ে দুজনের নতুন এক অভিজ্ঞতা। অবশেষে ভোরে মেয়েকে ঘুম পারিয়ে নিতু তৌসিফ এর পাশে শুয়ে পড়লে তৌসিফ নিতু কে জড়িয়ে ধরে।বলে,”অনেক ধন্যবাদ আমাকে এতো সুন্দর একটা পরী উপহার দেয়ার জন্য।ঐ দিন তো তোমাকে দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।যেই সময়টা তোমার পাশে থাকা উচিত ছিলো সেই সময়টাই আমি থাকতে পারিনি। এজন্য দুঃখিত।”

“আপনাকেও ধন্যবাদ। আমার জীবনটা আজ পরিপূর্ণ হয়েছে। আল্লাহর কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। মাঝে মাঝে ভয় হয় জানেন?মনে হয় এই আনন্দ,এই সুখ আমার জীবনে স্থায়ী হবে তো?”

“আল্লাহ যেনো আমাদের জীবনে এই সুখ লম্বা সময় রাখে সেই দোয়া করছি। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমাকে আমার পাশে চাই।আল্লাহর কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই আমার।”

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে