সুখের খোঁজে পর্ব-২০+২১

0
710

#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২০)
#মৌমিতা হোসেন

নিতুর ঘুম ভাঙে দশটায়। তৌসিফ এর হাতটা সরিয়ে দিয়ে আস্তে করে উঠে কোন রকম শাড়ি পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। দীর্ঘ গোসল শেষে বের হয়ে দেখে তৌসিফ তখনও ঘুমে বিভোর। নিতু লাল টকটকে একটা শাড়ি পরে। শাড়িটা ওর মায়ের। নিতুর বাবা মারা যাওয়ার পর সালেহা বেগম আর এতো রঙিন শাড়ি পড়তে চায়না।আর পরা উচিতও নয়।তাই নিতু কে দিয়ে দেয়।আজ তাই নিতু এই শাড়িটাই পরে। কাজল,টিপ, চুড়ি পরে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়। আপনমনে হাসে।এমন সময় তৌসিফ চোখ খুলে নিতু কে একা একা হাসতে দেখে বলে,”কি ব্যাপার নিতু একা একা হাসছো কেনো?”

নিতু চমকে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ এর ঘুম ভেঙেছে।ওর তাকানো দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।বলে,”কোই না তো।হাসছিনা তো। আপনি… আপনি কখন উঠেছেন?”

তৌসিফ উত্তর দেয় ,”যখন তুমি বের হয়ে লাল টকটকে শাড়ি পড়ে লাল পরী সাজছিলে তখন। মাশাআল্লাহ নিতু তুমি সত্যি….”

নিতু লজ্জায় আর থাকতে পারলো না।এক দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে নেড়ে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। নাস্তা বানাতে নিলে আবার তৌসিফ নিতু নিতু করে ডাকতে থাকে। নিতু রুমে গেলে দেখে তৌসিফ ওয়াশরুমে। তৌসিফ চিৎকার করে,”আমার কাপড় কোথায় নিতু?”

“এইতো দিচ্ছি অপেক্ষা করেন একটু।”নিতু তোয়ালে,শার্ট বের করে রাখতে নিলে দেখে তৌসিফ ওয়াশরুমের দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে। তৌসিফ বলে, “আমার জন্য নীল পাঞ্জাবি বের করো।আর তুমি একটা নীল রঙের শাড়ি পরে রেডি হও। আমরা আজ সারাদিন বাইরে বেড়াবো।”

বলেই দরজা লাগিয়ে দেয়। নিতু কিছুই বুঝতে পারেনা তাই চুপ করে বসে থাকে। কারন ও তো একটা সুন্দর শাড়ি পরেই আছে। আবার পাল্টাতে হবে কেনো?আর মনে মনে খুব খুশী হয় কারন এই প্রথম ও তৌসিফ এর সাথে কোথাও বেড়াতে যাবে।

এর মধ্যে তৌসিফ বের হয়ে দেখে নিতু বসে আছে।নিতু ও তৌসিফ কে খুব পরখ করে দেখতে থাকে।আজ মানুষটাকে অন্য রকম লাগছে। খুব আপন মনে হচ্ছে। ভালোবাসা যে এতো সুন্দর এক অনুভুতি এটা আগে জানা ছিলোনা। তৌসিফ নিতুর সামনে এসে বলে,”কি ব্যাপার নিতু রেডি হও। বসে আছো কেনো? আমি জানি আমি দেখতে ভালো।আর এখনতো আমি পুরোপুরি তোমার।যখন মন চাইবে দেখতে পারবে।কেউ বাধা দেয়ার নেই।তাই এখন আগে চলো কোথাও ঘুরতে যাই। সারাদিন বাইরে ঘুরবো,খাবো তারপর বাসায় ফিরবো। তোমাকে নিয়ে এতো দিনে একবার ও কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি তাই ভালোবাসার প্রথম দিনটি সুন্দর ভাবে কাটাতে চাই।”

নিতু চুপচাপ তৌসিফ এর কথা শুনছিলো। খুব ভালো লাগছে শুনতে।এমন সময় তৌসিফ কানের কাছে মুখ এনে বললো,”তুমি কি চাচ্ছো বলোতো। মানে আমি কি শাড়ি পড়িয়ে দেবো? নাকি সারাদিন ঘরে বসেই তোমাকে ভালোবাসবো। মানে তোমার ইচ্ছে টা আমাকে একটু খুলে বললে ভালো হয়।অবশ্য ঘরে বসে তোমাকে ভালোবাসতেও……”নিতু তৌসিফ এর মুখ চেপে ধরে।আর কোন কথা বলতে দেয়না।

তৌসিফ না চাইলেও জোর করে ওকে বারান্দায় পাঠিয়ে দেয়।আর নিতু আজ ইচ্ছে মতো সাজে। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়।

বারান্দায় গাছগুলো আজ তৌসিফ এর নজরে পরে।এই কদিনেই নিতুর ভালোবাসায় সবগুলো গাছে নতুন কলি এসেছে,জবা গাছে ফুল ফুটেছে। গাছগুলো যেমন কারো আদরে,যত্নে আজ এতো সতেজ। তেমনি তৌসিফ এর মনটাও আজ নিতুর ভালোবাসায়,যত্নে প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে।এসব ভাবনার মাঝেই নিতুর ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় তৌসিফ। নিতু কে দেখে হা করে তাকিয়ে দেখতে থাকে আর বলে,”মাশাআল্লাহ। তোমাকে পুরো পরির মতো লাগছে।লাল শাড়ির পরিবর্তে এটা পড়তে বললাম যাতে তোমাকে কম সুন্দর দেখা যায়। কিন্তু সেতো একই কথা হলো।এটাও তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”

নিতু কিছু বুঝতে না পারায় জিজ্ঞেস করে,”মানে কি? আপনি লাল শাড়ি পাল্টে কেনো এটা পড়তে বলেছেন? আপনি কি চান না যে আমাকে সুন্দর লাগুক?”

“হুম অবশ্যই চাই সুন্দর লাগুক ।আর সেটা শুধু আমি একা দেখবো।লাল শাড়িতে তোমাকে অনেক বেশী মোহনীয় লাগছিলো।তাই পাল্টাতে বলেছিলাম।কারন আমি চাইনা আমার বৌকে আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখে সুন্দর বলুক। কিন্তু দেখো কোনই লাভ হলোনা।কারন নীল রঙেও তোমায় অসাধারণ লাগছে।”

“তাহলে কি এখন আবার অন্য শাড়ি পড়বো?”

“না থাক এটা পড়েই চলো।”

নিতু হেসে দেয়। ভাবে প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষ এমন বোকা বোকা কথাও বলে? হিংসুটে হয়ে যায়? হঠাৎ তৌসিফ এসে নিতু কে জড়িয়ে ধরে বলে,”ভালোবাসি ।”নিতু আর কোন কথা খুঁজে পায়না। দুজন মিলে সারাদিন বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, খাওয়া দাওয়া করে।রাতে বাসায় ফেরার সময় অনেক দিন পর সিঁড়িতে হঠাৎ তপুর সাথে দেখা হয়। তপু দুজনকে একসাথে এভাবে হাসি খুশি দেখে বেশ খুশী হয়। নিতু তপু কে দেখে সালাম জানায়।ঐ ঘটনার পর নিতুর আর তপুর সাথে দেখা হয়নি। অনেকটা ইচ্ছা করেও দেখা করেনি।কারন ও বুঝতে পেরেছে যে কোন কারনে হয়তো দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ চলছে।এই দ্বন্দ মেটানোর আগ পর্যন্ত তপু ভাইয়ের সাথে কথা বলা যাবেনা।তাই গতো কদিন তপু কে এড়িয়ে গেছে নিতু। কিন্তু আজ সামনে চলে আসায় সালাম দিতে হয়েছে।

তপু সালামের উত্তর দেয়।বলে,”কেমন আছো নিতু? তোমাকে আজকাল দেখাই যায়না।”

নিতু তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া। মায়ের বাসায় গিয়েছিলাম।আর বাসায় আসার পর থেকে সময় হয়নি তাই হয়তো…।”

“আচ্ছা সমস্যা নেই। ভালো আছো এটাই বড় কথা।”

তৌসিফ নিতুর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,”তুমি ঘরে যাও। আমি আসছি একটু পরে।”

নিতু বুঝতে পারে তৌসিফ এর নির্দেশ।তাই বলে,”ঠিক আছে।”

তপুর দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইয়া যাই তাহলে।সময় করে বাসায় আসবেন।”নিতু বাসায় চলে যায়।

তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে তপু বলে,”কীরে এভাবে নিতু কে যেতে বললি কেনো?কোন সমস্যা?আর সারাদিন কোথায় ছিলি?”

“বলেছি আমার ইচ্ছা। তোকে বলতে হবে?আর বৌকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম।এতেও কি কোন সমস্যা আছে?”

“নারে কোন সমস্যা নেই।তোর বৌকে নিয়ে তুই যেখানে ইচ্ছা যেতে পারিস। অনেক দিন পর দেখা হলো। সম্পর্কে আমরা ভাই হই।তাই এটুকু তো জিজ্ঞেস করতেই পারি নাকি বলিস?”

“আমি চাই না আমার আর নিতুর মাঝে তুই কখনো কোন কথা বলিস।আর ভাই হই বলছিস? আমাদের মাঝে কি ভাই ভাই সম্পর্ক আছে? কিছু থাকলে তা হলো হিংসা, রেষারেষি। ছোটবেলার মতো ভালোবাসাটা এখন আর নেই।”কথা গুলো বলে তৌসিফ ওপরে উঠে যায়। তপু কে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না। তপু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জানেনা তৌসিফ এর ভূল ধারণা কবে দুর হবে। তপু এখনো সেই ছোট তৌসিফ কে খুব মিস করে ,সেই ভাইকে ফিরে পেতে চায় কিন্তু তা আর বলার সুযোগ হয়না।

নিতু ওপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শ্বশুর কে ফোন করে ভালোমন্দ খবর নেয়। শ্বশুর জানায় যে পরদিন সকালে চলে আসবে। তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে আসলে ক্লান্ত থাকায় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের রাজ্যে চলে যায়।

তৌসিফ নিতুর সময়টা খুব ভালোই কাটছে। সারাদিন সংসারের কাজের মাঝে যখনই সময় পায় তৌসিফ এর সাথে একটু কথা হয়। জুঁই,বিথিরা মাঝে মাঝে আসে ওদের সাথে গল্প করে, শ্বশুর এর সেবা করে,আর সব কিছুর মধ্যে বেশি ভালো লাগে তৌসিফ এর কেয়ারিং।যতো দিন যাচ্ছে তৌসিফ যেনো ততোটাই নিতুর প্রেমে পাগল হচ্ছে।যখন তখন বাসায় এসেই নিতু কে কাছে টেনে নেয়,ওর জন্য টুকটাক উপহার নিয়ে আসা সব মিলিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছে নিতু।

তবে শতো চেষ্টা করেও তৌসিফ কে দোকানে পাঠাতে পারেনা নিতু।ওসবের জন্য নাকি সারাজীবন পরে আছে। এখন সময় নাকি বৌকে ভালোবাসার। নিতু কি বলবে খুঁজে পায়না ।তাই চুপ থাকে।আকবর আলিও এখন তৌসিফ কে দোকানে যাওয়ার কথা খুব একটা বলেনা।কারন সে বুঝতে পেরেছে যেহেতু বৌমার জন্য এই ভবঘুরে ছেলেটা অবশেষে ঘরমুখো হয়েছে সেহেতু পরিবারের দায়িত্ব একদিন না একদিন ঠিকই নেবে।তাই ছেলেকে ছেলের মতোই ছেড়ে দিয়েছে।

কেটে যায় বেশ কিছুদিন।যতো দিন যাচ্ছে দুজনের ভালোবাসাটাও ততো গভীর হচ্ছে। কয়েকদিন ধরেই নিতুর শরীরটা ভালো না। খুব ক্লান্ত লাগে, অল্পতেই হাঁপিয়ে যায়,খেতেও পারছেনা ঠিকমতো। একবার ভাবে মা কে ফোন করে বলবে কিন্তু টেনশন করবে তাই আর কিছু বলেনা।আর তৌসিফ তো আরো বেশি চিন্তা করবে তাই ওকেও কিছু বলেনা।আজ সকাল থেকেই শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে।তাই রাহেলা নিতু কে কাজ করতে দেয়না। রান্না ঘর থেকে বের করে চেয়ারে বসিয়ে একাই নাস্তা রেডি করে টেবিলে দেয়।এর মধ্যে তৌসিফ আর আকবর আলি টেবিলে এসে নিতু কে এভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। তৌসিফ বলে,”কি ব্যাপার নিতু এভাবে বসে আছো যে?কোন সমস্যা?”

নিতু উত্তর দেবে তার আগেই দৌড়ে আবার বেসিনে যায়,বমি হয়। তৌসিফ আর আকবর আলি নিতুর অবস্থা দেখে খুব অস্থির হয়ে যায়।আকবর আলি তৌসিফ কে বলে,”আজকেই বৌ মা’কে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যা। কদিন থেকেই দেখছি ওকে অন্যরকম লাগছে।এসব কি আমি খেয়াল করবো?”

নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”বৌমা তোমাকে বলছি। খবরদার আজ ঘরের কোন কাজ করতে যাবেনা।রেস্ট নাও।আজ আমরা রাহেলার রান্নাই খাবো।”

তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। বাসায় থাক। বৌমার দিকে খেয়াল রাখিস।”এসব বলে তিনি চিন্তাযুক্ত চেহারায় দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

শ্বশুর এর এতো ভালোবাসা দেখে নিতু খুব খুশি হয়। বাবার কথা খুব মনে পরে। বাবার জায়গাটা শ্বশুর আব্বা পুরোপুরি নিয়ে নিয়েছে।এমন শ্বশুরকে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হতে থাকে।এরই মাঝে তৌসিফ বলে,”কি ব্যাপার নিতু তোমার শরীর এতোটা খারাপ বলোনি কেনো?এখনো খারাপ লাগছে? একটু কিছু খাও তারপর নাহয় রেস্ট নাও।”

নিতু সবার ভালোবাসা পেয়ে আবেগে কেঁদে দেয়। নিতুর কান্না দেখে তৌসিফ অস্থির হয়ে যায়। নিতু কান্না বন্ধ করে বলে,”আসোলে গতো কিছুদিন ধরেই শরীর খুব খারাপ লাগছে।সব কিছুতেই অস্থির লাগে,খেতে নিলে বমি পায়।খেতেও পারছিনা।”এসব শুনে তৌসিফ একটু চিন্তায় পরে যায়।

তখন রাহেলা বলে,”মনে হইতাছে খুশির খবর আইবো।বৌ মনি মনে হয় মা হইবো।”এসব শুনে তৌসিফ আর নিতু দুজনই খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রাহেলার দিকে।

চলবে……

#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২১)
#মৌমিতা হোসেন

রাহেলার কথা শুনে তৌসিফ আর নিতু কিছুক্ষণ চুপ করে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।কি বলবে বুঝতে পারেনা। নিতুর খেয়াল হয় গতো দুমাস ধরে ওর পিরিয়ড বন্ধ।আগেও মাঝে মাঝে নিতুর পিরিয়ড অনিয়মিত হতো।বিশেষ করে যখন কোন বিষয়ে বেশি টেনশন করতো বা ঝামেলায় থাকতো তখন।তাই বিয়ের পরে এটা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু বিয়ের পর বরং ওর খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।যাই হোক তৌসিফ রাহেলার দিকে তাকিয়ে বলে,”আন্দাজি বেশি কথা বলো না তো। বেশি কথা বলা আমার পছন্দ না।যাও গিয়ে নিতুর জন্য খাওয়ার কিছু নিয়ে আসো।”

রাহেলা একটু মন খারাপ করে। ওনার বয়স অনুযায়ী যেই অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা থেকেই তো বলেছে বৌ মনিকে।বলে,”আইচ্ছা যাইতাছি আমি।”মন খারাপ করে নিতুর জন্য নাস্তা আনতে চলে যায়।

নিতু কি বলবে খুঁজে পায়না। খুব চিন্তায় পরে যায়।বিশেষ করে তৌসিফ বিষয়টা কীভাবে নেবে সেই চিন্তায় থাকে।এর মাঝে তৌসিফ বলে,”সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো ডাক্তার এর কাছে যাবো।”

“আরে বাদ দিন তো।তেমন কিছু না। এমনি হয়তো বমি পেয়েছ।ডাক্তার দেখাতে হবে না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করলেই দেখবেন ভালো হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।”

তৌসিফ একটু বিরক্ত হয়।বলে,”চুপ করো তো।যেটা বলেছি সেটা শোনো। রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।আজ বেশি লাফালাফি করলে পা বেঁধে রাখবো বলে রাখলাম।”তৌসিফ এর মেজাজ দেখে নিতু চুপ হয়ে যায় মিটমিট করে হাসে।

রাহেলা নাস্তা আনলে নিতু একটু খায়। খেতে নিলেই বমি পায় তাই বেশি খেতে পারেনা।এরপর রুমে গিয়ে রেস্ট নেয়। সারাদিনে তৌসিফ আর নিতু কে ঘরের বাইরে যেতে দেয়নি। খুব টেনশনে ছিলো ও।কারন সত্যি যদি নিতু প্রেগনেন্ট হয়!!এর মানে তো তৌসিফ ও বাবা হবে।এখনি এতো বড় দায়িত্ব ও কীভাবে নেবে? আবার কেমন এক ভালো লাগার অনুভূতি ও সৃষ্টি হয়। বিকেলে নিতু কে নিয়ে ডাক্তার এর কাছে যায়। কিছু টেস্ট দেয় সেগুলো করায়।বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়।

আকবর আলি ওদের দেখে বললো,”এখন কি অবস্থা বৌ মায়ের?ডাক্তার কি বলেছে?”

“কিছু টেস্ট দিয়েছে। করিয়ে এসেছি।কাল সকালে রিপোর্ট পাবো তারপর বোঝা যাবে।”

“আচ্ছা। তাহলে তো সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।তেমন কিছু হয়তো হয়নি। মেয়েটা সারাদিন এতো পরিশ্রম করে। নিজের যত্ন নেয়না। দুর্বলতা থেকেও হতে পারে।যাক সকালে দেখি রিপোর্ট এ কি আসে। বৌমাকে কোন কাজ করতে দিসনা।রেস্ট নিতে বল। আমিও শুয়ে পরি।”চিন্তিত চেহারা নিয়ে আকবর আলি রুমে চলে যায়।

এদিকে নিতু কে রাতেও আজ তৌসিফ কোন কাজ করতে দেয়নি। খুব যত্ন নেয় নিতুর। তবে সকাল থেকে কথা কম বলছে তৌসিফ। সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে। রুমে এসে দু’জনই চুপচাপ শুয়ে পরে।কারো চোখেই ঘুম নেই আবার কোনো কথাও নেই। কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর নিতু বলে,”একটা কথা বলি?”

“হুম বলো।”

“আমার না খুব ভয় লাগছে, চিন্তা লাগছে। মানে কেমন জানি লাগছে ঠিক বোঝাতে পারবো না।আর আপনাকেও দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব চিন্তিত। তাই সব মিলিয়ে কেমন জানি….”

তৌসিফ নিতুর মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।আর বলে,”এতো রাতে তোমাকে এতো চিন্তা করতে হবে না। আমি একটু চিন্তিত এটা ঠিক। আমার একমাত্র গুলমুলু বউটা অসুস্থ এই কারনে।অন্য কিছু না।”

“যদি খালা যেটা বলেছে সেটা হয়?তাহলেও কি আপনি খুশি হবেন? নাকি রাগ করবেন?”

“কেনো রাগ করবো?বোকার মতো কথা বলছো কেনো? এটা ঠিক একটু চিন্তিত।কারন এখনি এতো তাড়াতাড়ি এই দায়িত্ব আমি ঠিকভাবে পালন করতে পারবো কিনা জানিনা।তাই বলে রাগ করবো সেটা হবে কেনো। পাগলী একটা। যাক আল্লাহ ভরসা। এখন ঘুমাও তো।”-তৌসিফ নিতু কে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো করে চুমু খায়।মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিতু ও আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।

খুব ভোরে ঐ দিন দু’জনেরই ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিতুর শরীর এখন একটু ভালো লাগছে। তবুও ওঠার সাথে সাথেই তৌসিফ বলে,”কোথায় যাচ্ছো?”

“ওমা! উঠতে হবে না?নাস্তা খাবেন না?খালা চলে আসবে এখন ।কাজ আছে তো।”

“না কোনো কাজ নেই।আজ তোমাকে কোন কাজ করতে হবে না।উঠেছো ভালো কথা কিন্তু রান্না ঘরে যেতে হবে না। রাহেলা খালা যা বানাবে আজ তাই খাবো।আজ খালাকে বলে আসো সব একা করতে।”

নিতু খুব খুশি হয় ওর প্রতি তৌসিফ এর এতো চিন্তা দেখে। আবার খালা একা সব কীভাবে করবে সেটা নিয়ে একটু চিন্তায় পরে যায়। নিতু বলে,”ঠিক আছে কিছু করবো না। কিন্তু কি বানাবে সেটা বলতে তো যেতে হবে নাকি?আর আপনি আজ এতো ভোরে উঠেছেন কেনো?কি হয়েছে?”

“না এমনি।আজ ঘুম ভেঙ্গে গেলো।কেমন অস্থির লাগছে।দশটায় তোমার রিপোর্ট আনতে যাবো।কি আসবে রিপোর্ট এ আল্লাহ জানে।”

“বুঝতে পেরেছিলাম যে এজন্য আপনার চোখে আজ ঘুম নেই। বেশি চিন্তা করবেন না প্লিজ। আপনার চিন্তা দেখে আমার ও চিন্তা লাগছে।”

নিতু কে চিন্তিত দেখে তৌসিফ কথা ঘুরায়।বলে,”আরে আমিতো এমনি বলেছি।এতো চিন্তার কিছু নেই। তুমি যাও বলে আসো নাস্তা বানাতে।”নিতু উঠে যেতে নিলে তৌসিফ আবার নিতুর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে এনে কপালে আদর দিয়ে মৃদু হেসে বলে,”এবার যাও।”

নিতুর মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।মনে মনে ভাবে,”এই কি সেই কটকট করা মানুষটা?এখন ওকে কতোই না ভালোবাসে।”এই সুখ যেনো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকে সেটাই কামনা করে। নিতু ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে যেয়ে খালাকে কাজের নির্দেশনা দেয়।

রাহেলা হেঁসে বলে,”বৌ মনি আফনে চুপচাপ বহেন। আমি সব করতাছি। চিন্তা কইরেন না।আর আমি শিউর যে আফনের পেডে বাচ্চা।আফনে মা ওইবেন।”

নিতুর কেমন যেনো লাগতে থাকে ওনার কথা শুনে। রাহেলা আবার বলে,”বাচ্চা পেডে আইলে যেসব সমস্যা হয় সেই সবডিতো আফনের মধ্যে দেখতাছি।হেরপরেও আফনেগো ডাক্তার দেহান লাগবে? আমাগো আবার এইসব ডাক্তার দেহানের ঝামেলা ছিলো না।”

নিতুর আজ আর ভালো লাগে না রাহেলা খালার এতো এতো কথা শুনতে।আবার বমি পায়।তাই দ্রুত রান্নাঘর থেকে চলে যায়। রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ না ঘুমিয়ে ঘড়ি দেখছে আর পায়চারি করছে। নিতু একটু স্বাভাবিক হয়ে বলে,”বসুন তো।কি শুরু করেছেন?”

“যেতে হবে তো।তাই রেডি হলাম।”

“আসুন একটু কথা বলি। দশটা বাজলে যাবেন”নিতু তৌসিফ কে ডেকে শুয়ে পরে।

“আচ্ছা” বলে তৌসিফ নিতুর পাশে গিয়ে বসে ।বলে,”কী ব্যাপার নিতু খারাপ লাগছে?”

নিতু মাথা নাড়ে। কথা বলতে ডাকলেও ভালো লাগছিলো না। তাই তৌসিফ এর হাত ধরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কিছু সময় পর সবাই নাস্তা করে।আকবর আলি দোকানে চলে যায়। তৌসিফ রিপোর্ট আনতে যায়। রিপোর্ট এ দেখে পজিটিভ এসেছে।দেখে তৌসিফ এর কেমন যেনো লাগতে থাকে।ও কি করবে বুঝতে পারছিলো না।তাই বাসায় না গিয়ে সোজা বাবার দোকানে চলে যায়।আকবর আলি এ সময়ে ছেলেকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। ছেলের কাছে এসে বলে,”কি হয়েছে বাবা?তুই এ সময়ে এখানে কেনো?কোনো সমস্যা? বৌমার রিপোর্ট এনেছিস?কি হয়েছে বল।”

তৌসিফ চুপচাপ বাবার হাতে রিপোর্ট ধরিয়ে দেয়। আকবর আলি তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দেখে।দেখে খুশিতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।বলে,” আরে আমি দাদা হবো?এমন খুশির খবরে তুই এমন চেহারা করে রেখেছিস কেনো?বাবা হওয়া জীবনে কতো আনন্দের সেটা কি তুই বুঝতে পারছিস?”

কর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই একজন মিষ্টির দোকানে যা মিষ্টি নিয়ে আয়। আমি দাদা হবো। আমার সংসারে আমার খেলার সঙ্গী আসবে।কতো আনন্দের দিন আজ।”টাকা বের করে দিয়ে ছেলের কাছে আসে।

তৌসিফ বাবাকে বলে,”বাবা আমার যেনো কেমন লাগছে। তোমার আজ দোকানে বসতে হবে না । তুমি আমার সাথে বাসায় চলো।”

“ঠিক আছে চল বাবা।”আকবর আলি ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পারে। দুজন মিলে দোকান থেকে মিষ্টি কিনে বাসায় যায়।ওপরে গিয়ে দেখে নিতুর পাশে জুঁই, বিথি, সাদিয়া,চাচিরা সবাই বসে আছে। সকালে রাহেলা আন্দাজের ওপর ভিত্তি করেই সবাইকে নিতুর খবর জানায়।আর সেই খবর পেয়েই সবাই আনন্দে ওদের বাসায় এসে নিতু কে ঘিরে বসে থাকে।আকবর আলি সবাইকে আবারও কনফার্ম করে।চাচিরা খুশি হয় দাদি হবে,বিথিরা তো কতো পরিকল্পনা শুরু করে। ফুপি হবে যেই সেই ব্যাপার!!চাচিরা কতো উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে নিতু কে। নিতু লজ্জায় মাথা নিচু করে সবার সব কথা শুনছে। নিতু ঠিক অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত বুঝতে পারছেনা। সবাই মিষ্টি মুখ করে।

এতোটা সময় তৌসিফ ও চুপচাপ সব দেখতে থাকে,শুনতে থাকে।কি বলবে,কি বলা উচিত বুঝতে পারেনা।নিতুর শরীর হঠাৎ খারাপ লাগতে থাকায় চাচিরা সবাইকে যার যার কাজে যেতে বলে। নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায়।যাওয়ার আগে তৌসিফ কে বলে,”বাবা এখন কিন্তু অনেক দায়িত্ব।বাবা হওয়া এতোটাও সহজ নয়।তাই এখন অন্তত আস্তে আস্তে সংসার এর দায়িত্ব নে।তোর বাবাকে বিশ্রাম করতে দে। অনেক তো হলো। কখনো তোকে কিছু বলিনি। এবার নিতুর জন্য, নতুন অতিথির জন্য নিজেকে পাল্টে ফেল। নিতুর খেয়াল রাখিস। গেলাম আমরা।”

নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”বৌমা যখন যা দরকার নিশ্চিন্তে বলো কিন্তু।”চাচিরা চলে যায়। বাড়িতে আজ যেনো উৎসব চলছে।আকবর আলি সবাইকে আজ ওনাদের বাসায় খেতে বলেন।ফোন দিয়ে নিতুর মা’কে সুখবরটা জানায়।আর দাওয়াত দেয়। কিন্তু সেতু, সাজিদ এর পরীক্ষা থাকায় ওরা আসতে পারবে না জানায়। সালেহা বেগম খবর শুনে খুশিতে কেঁদে দেয়।

সবাই চলে গেলে তৌসিফ ধীরপায়ে হেঁটে নিতুর পাশে গিয়ে বসে। নিতুর হাতটা ধরে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিতু খানিক লজ্জা পায়, অস্বস্তি হয় ওর। নিচের দিকে তাকিয়েই জানতে চায়,”এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?কি হয়েছে?”

তৌসিফ আদরমাখা কন্ঠে বলে,”কিছু হয়নি তো। আমি একটু আমার গুলুমুলু বৌ টাকে দেখছি।এ সময় তো মেয়েরা অনেক মোটা হয়ে যায়।স্বাস্থ্য ভালো হয়। মানে গুলুমুলু হয়। তুমিও কি এতো গুলুমুলু হয়ে যাবে?”

নিতুর রাগ হয়। এখনি তৌসিফ এই বিষয়ে চিন্তা করছে?এর মানে মোটা হয়ে গেলে তৌসিফ আর নিতু কে ভালোবাসবে না?এসব চিন্তা করতে করতে বলেই ফেলে,”এর মানে কি? আপনি কি তখন আমায় আর ভালোবাসবেন না ?”

“আরে ধুর ভালোবাসবো না কেনো? আমিতো এমনি বললাম। তুমি খুশি হয়েছো তো নিতু রানি?”

“আপনি খুশি হলে আমিও খুশি । তবে অনেক ভয় লাগছে, অস্থির লাগছে।”

তৌসিফ মনে মনে বেশ টেনশন করলেও নিতু কে সেটা বুঝতে দেয়না। মুখে হাসি এনে নিতু কে জড়িয়ে ধরে বলে,”কোন দুশ্চিন্তা করোনা। আমি আছিতো তোমার পাশে। দেখবে সব ঠিক হবে। সন্ধ্যায় রিপোর্ট নিয়ে কিন্তু ডাক্তার এর কাছে যেতে হবে। তাই সময়মতো রেডি থেকো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”বলে নিতু চুপচাপ বসে রইল।

সারাদিনে নিতু কে আর রান্না ঘরে ঢুকতে দেয়না কেউ।আজ চাচিরাই সব রান্না করলো। সবাই মিলে বেশ আনন্দ করলো। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার বাসায় চলে গেলো।নিতু ও ক্লান্ত থাকায় রুমে এসে ঘুমিয়ে পরে। সন্ধ্যায় তৌসিফ নিতু কে নিয়ে ডাক্তার এর কাছে যায়।ডাক্তার বলে,” সব ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই। তবে এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা না নিলে ভালো হতো।”যাই হোক ডাক্তার কিছু নিয়ম কানুন বলে দেয় আর সাবধানে থাকতে বলে। পুরোটা সময় তৌসিফ খুব মনোযোগ দিয়ে ডাক্তার এর সব কথা শোনে।আর কীভাবে নিতুর সর্বোচ্চ খেয়াল রাখা যায় সেসব হিসেব কষতে থাকে।

বাসায় ফিরেই শুরু হয়ে যায় তৌসিফ এর কর্মকান্ড। কীভাবে কী করলে নিতুর ভালো হবে,ও সুস্থ থাকবে সেসব নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকো তৌসিফ।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে