সিঁদূর রাঙা মেঘ পর্ব-৯+১০

0
1276

#সিঁদূর_রাঙা_মেঘ
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

পর্ব_৯,১০

দিনক্ষণ পাল্টায়। সাথে পাল্টায় সময়, মানুষ, এবং তাদের মনের রং। তেমনি পাল্টে গেছিল কুহু আর ইউসুফের জীবন চারটি বছর আগেই। হুট করেই ইউসুফের বিদেশ যাওয়ার ডেট পড়ে যায়। কুহু তখন মুখ ভাড় করে বসে দিন পার করে! ইউসুফে তাতে মোটেও ভাল লাগচ্ছিল না। সে চায়না তার বাবুইপাখি এমন চুপসে থাকুক। সে চায় তার বাবুইপাখি তার চলে যাওয়ার পড়েও সুখে থাকুক। তাই ভেবে ইউসুফ কুহুকে কম্পিউটারের কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। কুহু সময় পার করার জন্য পড়ার পাশা-পাশি বাহ্যিক কাজে অগ্রসর হতে আগ্রহ করে তুলে।এতে অবশ্যি আসাদ খুব খুশি ছিলেন। মেয়ের জন্য তিনি সঠিক সিধান্ত নিয়েছেন তা ভেবেই মনে তার প্রশান্তি যেন। এদিকে ইউসুফের এক মাস পড়েই ফ্লাইট। বাসার সকলেরই তখন মন খারাপ। তাই ইউসুফ পরিবেশ ঠিক করার জন্য একটি গেট টুগেদার রাখলো। সাথে বাসার সবাই ঠিক করলো সেদিন ইউসুফ আর কুহুর কাবিন করিয়ে রাখবে। এতে অনেক খুশি ছিল ইউসুফ আর কুহু।তাদের ভালবাসার একটি নাম পাবে এবার ভেবেই শান্তি অনুভব করছে যেন তারা। কিন্তু কে জানতো? এ শান্তি ময় মুহূর্ত শুধু খনিকের জন্য।

কুহু ইউসুপের কাবিনের দিনটি ছিল জাঁকজমক পূর্ণ। অল্প সময় অনেক মানুষকে দাওয়াত করেছিলেন তার। কুহুকে সেদিন খুব সুন্দর সবুজ লেহেঙ্গা পড়ানো হয়। তার সাথে ম্যাচিং করে ইউসুফকে সবুজ সেরবানি পড়ানো হয়। ইউসুফকে সেদিন যেন আরো ডেশিং,হ্যান্ডসাম লাগছিল। কুহু বান্ধবীরা শুধু ক্রাশের উপ ক্রাশ খেয়েছে। আর হায় আফসোস, হায় আফসোস করেছে।কুহু বান্ধবী নিধি তো কয়েকবার ইউসুফের জন্য প্রেম পত্র পাঠিয়েছে ইউসুফকে দেয়ার জন্য। ইউসুফকে সেই প্রেম পত্র দিতে গিয়ে এক থাপর খেয়েছে সাথে এক গাদা গালি দিয়ে বলেছে,,

—” পাকনামো তো ভালই শিখেছিস। চাকরীও ভালই জুটিয়েছিস। পোষ্ট ওমেন। তাই না? তা কত দেয় টাকা তোকে? ফুপা কে বলেই দি তাহলে, তার মেয়ের টাকা, পয়সা আর না দিতে সে তো চাকরী জুটিয়ে ফেলেছেই প্রেম পত্র বিলি করার। এটা বলবো তুই অনেক পেঁকে গেছিস তোকে বিয়ে দিতে। তাহলেই কাহিনী খতম পয়সা হজম। যতসব। যা ভাগ আর কখনো এমন দেখলে সত্যি রিকশা ওয়ালা ডেকে তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিব তোকে!”

সেদিন বেচারা ছোট কুহু থাপড় খাওয়া গালে হাত দিয়ে ছোট ছোট চোখে ইউসুফের কথা হজম করেছে। মনে মনে ইউসুফ আর নিধিকে গালি দিয়ে গেছে একা ধারে।

কুহু হাসলো। নিধি তার পাশ ঘেষে কাঁদো কাঁদো মুখে বলে উঠলো,,
—” কুহুরে আমি ছেঁকা খেয়ে বেঁকা হয়ে গেলাম।”

কুহু আড় চোখ তাকিয়ে বলল,,
—” কে ছেঁকা দিলো তোকে?”

নিধি কুহুর ঘাড়ে মাথা পেতে হতাশ ভাবে বলল,,
—“কে আবার তোর বর!”
কুহু ভ্রু কুঁচকায়,
–“আমার বর তোর সাথে কবে প্রেম করলো?”
নিধি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,
—” প্রেমিতো করলো না। তাই তো ছেঁকা খাইলাম।”
কুহুর পাশে আরে বান্ধবী মুন বসে ছিল। নিধির কথায় বলল,,
–” চিন্তা করিস না দোস্ত। জিজুর বহুত জোশ জোশ বন্ধু এসেছে। কি যে হ্যান্ডসাম। ”
নিধির চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে আসে পাশে তাকাতেই নিধি চেঁচিয়ে বলল,,
—“দোস্ত পাইছি একটা আমি। এর সাথে লাইন মারমু এখন। দেখ শুধু কেমনে পটলাই।”
বের হয়ে গেল নিধি। পিছন থেকে কুহু আর মুন হেনে কুটকুট। গড়াগড়ি খাচ্ছে যেন? নিধি এই এক বাজে অভ্যাস সুন্দর ছেলে যেখানে তিনি সেখানে।

কুহু আর মুন হাসার মাঝে ঘরে ঢুকে মাইশা। মুখটা তার গম্ভীর দেখালো। মাইশাকে দেখেই মুন বের হয়ে গেল রুম থেকে। কুহু মাইশার এমন মুখ দেখে চিন্তায় পড়ে গেল বলল,,
—“মামনী কিছু হয়েছে? তোমাকে এমন কেন দেখাচ্ছে?”
মাইশা বলল,,
—” আমার কিছু কথা আছে তোর সাথে।”
কুহু উঠে দাঁড়িয়ে মামির হাত ধরে বলল,,
—“বলো কি বলবে মামনী!”
মাইশাকে নার্ভাস দেখালো । ঘেমে নেয়ে একাকার সে। আমতা আমতা করেই যাচ্ছেন তিনি। কিভাবে কথা টুকু বলবে? ভেবেই পাচ্ছেন না তিনি।

পর্ব_১০
ইউসুফ শুয়ে আছে তার ঘরে। বাহিরে তখন প্রবল বৃষ্টি। মাঝে মাঝে আশে পাশে কোথাও বাজ পড়চ্ছে। যার আলোয় অন্ধকার ঘর খানা আলোকিক করছে বার বার। ইউসুফ তার হাতটি উপরে তুললো। হাতের ব্যান্ডেজ করা জায়গায় চোখ বুলিয়ে অন্যদিকে ফিড়লো। মনটা আজ তার ঘুম খারাপ। তেমনি হয়তো আকাশেরও মন খারাপ! তাইতো এই শীতের মাঝেও এমন বর্ষণ করছে আকাশ থেকে?

ইউসুফ উঠে দাঁড়ালো। তার রুমের জানালায় কোনো গ্রীল নেই। খোলা জানালা ভেদ করে বড় পর্দা উড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে। সে সেখানে দাঁড়ালো। বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে লাগচ্ছে তার শরীরে। শান্তি শান্তি লাগচ্ছে খুব। অথচ এবৃষ্টিতেই সেদিন তার চোখের জল মুছে ছিল। কি আশ্চর্য আজকেও তাই।

কুহু এখানে আসার পর থেকেই ইউসুফ যেন ধুকে ধুকে মরছে। না ভালবাসার মানুষটিকে কাছে টানতে পাড়চ্ছে। না তার রাশ ভাড়ি ঘৃণায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে পাড়ছে। আগে কুহু তার থেকে দূরে ছিল তাই কষ্ট গুলো লুকিয়ে রাখতে পারতো সে। কিন্তু কুহু আসার পর থেকেই যেন কষ্ট গুলো ঘৃণায় পরিবর্তন হয়ে ঝলসে দিতে চায়।
অথচ এ কুহুই একসময় তার পুড়ো দুনিয়া জুড়ে ছিল। ছিল তার নয়ন মনি হয়ে। যেদিন প্রথম কুহু পা রাখেছিল তার ঘরে। তখন থেকে পাল্টে যেতে লাগলো সে। চোখ বুঝলো ইউসুফ মনে করতে চাইলো ১৬ বছর বয়সী কিশোরীর কথা।

ইউসুফ বরাবরই বাসায় শান্তশিষ্ট হলেও বাহিরে সবাই তাকে প্লে বয় বলেই জানতো। একটি মেয়েকে তার পাঁচ মিনিট সময় লাগতো না পটাতে। তার আবার প্লাস পয়েন্ট ছিল ইউসুফের মাধুর্য ভরা মুখখানা আর দাম্ভিকতা। যে একবার দেখতো সে যেন হারিয়ে যেতে চাইতো তাতে। ইউসুফও সে সুযোগ লুফে নিতো অনায়াসে।

কিন্তু সে সব বন্ধ হয়ে যায় সেদিন। যেদিন ইউসুফ ঘরে এসে ষোড়শী এক ঘুম কণ্যাকে সোফায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো। মনে যেন তখন এক ধাক্কা লেগে গেছিল তার। ছোট কুহু আজ এতো বড় হয়ে গেছে। কদিন আগেও ফ্রক পড়ে এদিক, সেদিক তাকে ছুটতে দেখেছে সে মেয়েটি এখন ফ্রক ছেড়ে সেলোয়ার সুট পড়তে শুরু করেছে। ক্লান্ত মাঁখা মুখখানি দেখে মায়া হলো ইউসুফের কি সুন্দর বালিশ ছাড়া সোফার এতটুকুন জায়গার মাঝে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।

ইউসুফকে কুহুর পাশে বসে থাকতে দেখে মাইশা হেসে বলল,,
—“কখন এলি? ”
—“মাত্রই মা! ও কুহু না?”
মাইশা আবার হাসলো। রান্না ঘর থেকে সব কাজ শেষ করে মাত্রই বের হয়েছে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলতে লাগলো,
—” হে! মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে দেখছিস?”
ইউসুফ মাথা নাড়ালো। কুহু মায়াবী মুখ খানা দিকে ঘোড় লাগা চাহনিতে চেয়ে বলল,,
—” হে মা অনেক সুন্দর হয়েছে। একদম মাধা ঝিম ধরানোর মত। ” পরের কথাটুকু বিড়বিড় করে বলল ইউসুফ। যা শুন্তে পেল না মাইশা।

ইউসুফের আজো যেন চোখে ভাসে সেই ছোট কুহুকে। লম্বা দুটি বেনুনী। টানা চোখ আর সুন্দর ফকফকে গায়ের রং। একদম শুকনো। আর এখন কুহু মোটা হয়েছে। আগে থেকে আরো সুন্দর হয়েছে। গালের টসটসা মাংসগুলো যেন আরো বেড়েছে। ইউসুফ সব সময় কুহু গাল টিপে দিতো তাতেই কুহু রেগে মেগে আগুন হয়ে চেঁচামেচি করতো খুব।বলতো,,

—” আপনি খুব খারাপ ইউসুফ ভাই!”
ইউসুফ তখন কুহুর মাথার চুল টেনে বলত,,
–” আদর করছি বলে খারাপ হয়ে গেলাম। নে তবে চুল টুনা খা!”
কুহু তখন ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠতো। হাসলো ইউসুফ। মানুষ পালটে গেলেও পাল্টায় না মানুষের স্মৃতি গুলো। না পাড়া যায় ভুলতে সেই মানুষ গুলোকে। এই তো সে কুহুকে ভুলতে রোজ রাতে নেশা করে, শুধু কুহু আর তার স্মৃতি ভুলতে। কিন্তু পারে না। নেশার মাঝেও যেন কুহুর নেশা ছাড়ে না। ভালবাসা নামক শব্দটি খুব খারাপ। কখনো মন থেকে হয়ে গেল তা ভোলা যায় না। না তার স্মৃতি গুলো মুছে ফেলা যায়। কিন্তু ইউসুফের দিক ব্যতিক্রম। না সে মুছে ফেলতে চায় না ভুলতে, সে চায় নিজে শেষ হতে নয়তো তার ভালবাসার মানুষটিকে নিজ হাতে শেষ করে দিতে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে