সাপলুডুর সমাপ্তিতে পর্ব-০৪

0
728

#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম

০৪

সে বললো
“এটা তো মাত্র সিম্পল একটা রিলেশন। আল্লাহ না করুক, তোমার যদি কয়েকটা বিয়েও হয়, এবং একটা বিয়েও না টিকে… এবং সে সময়েও যদি তুমি আমার কাছে ফিরে আসো.. আমি কখনোই তোমাকে ফেরাবো না। আমার ভালোবাসার দরজা সর্বদায় তোমার জন্য খোলা থাকবে।

উনার কথা শুনে আমার কপালে খানিক ভাজ পরলো। কেন যানি কথাটা আমার মনে ধরলো না, এ দুনিয়াতে এমন মানুষ আছে বলে আমার মনে হয় না। কখন কার কাছে যেনো শুনেছিলাম, “খালি কলসি, বাজে বেশ”। এক্ষেত্রেও এমন হবে না তো?
আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম
“আমার প্রতি আপনার এতো ভালোবাসা?
“বিশ্বাস হয় না?
“কিছুক্ষণ আগেও হয়েছিলো, কিন্তু আপনার এই কথা শুনার পর সেটা কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে। এ জগতে এমন প্রেমিক মানুষ আছে বলে আমার মনে হয় না।
সে দৃঢ়ভাবে বললো
“আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসি তনু।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম…
“বাসলেই ভালো।

সেদিন আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। কেন যেনো মনে হলো এ ভালোবাসা সত্য নয়। তাও মুখের উপর কিছু বললাম না, ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দিলাম। তার প্রতি যতটুকু নরম হয়েছিলাম, সে কথাটা শোনার ঠিক ততটাই কঠিন হয়ে গেলাম। হুট করে কাউকে আর বিশ্বাস করা যাবে না।

সেদিনের পর থেকে ইগ্নোর করতে থাকলাম। ফোন দিলেও রিসিভ করতাম না, বার বার কল করতে করতে এক সময় সেই কল করা বন্ধ করে দিতো। একদিন কলেজে যাবার পথে সেই সজল নামের ছেলেটিকে দেখলাম রাস্তার পাশে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে তাকে ইগ্নোর করে চলে যেতে চাইলেও পরে আর ইগ্নোর করতে পারলাম না, যখন দেখলাম সে বার বার হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ বুলাচ্ছে। আমি রাস্তার পাশে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াতেই আমার বান্ধবী অবাক হয়ে বললো
“কি রে, এখানে দাঁড়ালি যে?
আমি ওকে আঙ্গুলের ইশারা করে সজলকে দেখালাম।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা বোরকা পরিহিত মেয়ে এসে উঠলো তার বাইকে। মেয়েটা আমার চাইতে বয়সে কিছুটা হলেও বড় হবে তা বুঝাই যাচ্ছে। আমি আমার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে বললাম
“কিরে, তুই তো বলেছিলি ও আমাকে প্রচুর ভালোবাসে। তাহলে এটা কি?
সে আমতা-আমতা করে বললো
“হয়তো ওর বোন হবে কিংবা আত্মীয়।
“কিন্তু ওদের হাবভাবে আমার তো তা মনে হচ্ছে না!

আমার বান্ধবীর কপালে ভাজ পরলো। সে শক্ত গলায় বললো
“দাঁড়া, আমি দেখছি।
সে হনহন করে চলে গেলো সজলের দিকে। সজল তখন বাইকে স্টার্ট দিতে যাবে ঠিক তখনই আমার বান্ধবীটা বলে উঠলো
“আরে সজল ভাইয়া যে।
সজল কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো ওর দিকে। এরপর বাইকে বসা সেই মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফেরালো ওর দিকে। বললো
“আরে পাপিয়া যে।
পাপিয়া মৃদু হেসে বললো
” কোথাও যাচ্ছেন নাকি? এই আপুটা কে? আপনার বোন?

বাইকে বসা মেয়েটা বোরকা পরা থাকলেও তার মুখমণ্ডল খোলা ছিলো। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই বুঝা গেলো কথাটায় সে বেশ রেগে গেছে। সে সজলকে উদ্দেশ্য করে বললো
“এই মেয়েটা কে?
সজল প্রথমে বলতে কিছুটা দ্বিধা করলেও পরে বললো
“তুমি চিনবে না তাকে। আমার ছোটবোনের মতো।
এরপর আবার পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো
“কিছু বলবে?
“জানতে চাইছিলাম উনি আপনার কি কি হয়।
“আমার গার্লফ্রেন্ড।
পাপিয়া অবাক হয়ে বললো
“কিন্তু আপনি তো তনু কে পছন্দ করতেন যতটুকু আমি জানি। ইনফ্যাক্ট আপনি নিজেই আমাকে বলেছিলেন।

ওদের কাছ থেকে আমার দূরত্ব বেশি ছিলো না, তাই ওদের সমস্ত কথাবার্তা আমার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। যদিও এই মুহূর্তে পাপিয়াকে থামানো উচিৎ ছিলো আমার, গার্লফ্রেন্ড সামনে আছে তাই। কিন্তু সত্যটা আমারও জানতে ইচ্ছে করছিলো খুব। তাই একমনে কথা গুলো শুনতে লাগলাম দাঁড়িয়ে।

পাপিয়া যখন সজলকে প্রশ্নটা করলো তার উত্তরে সজল বেশ ক্ষেপে গেলো। ক্ষিপ্ত কন্ঠে সে বলে উঠলো..
“আমার গার্লফ্রেন্ডের সামনে কি আমাকে অপমান করার জন্য আসছো তুমি?
“অপমান কেন করবো, আমিতো জাস্ট জানতে চাইছি।
“তাহলে শুনো, তোমার বান্ধবী এমন কোনো স্বর্ণের টুকরো নয় যে তার জন্য আমি বছরের পর বছর অপেক্ষা করবো।

কথাটা শোনার পর আর এক মুহূর্তও সেখানে দাড়ালো না পাপিয়া। হনহন করে চলে এলো আমার কাছে। সজলও তখন একবার আমার দিকে তাকালো, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম সাথে সাথেই।

বিকেলে সজলের নাম্বার থেকে আমার ফোনে কল এলো। আমি রিসিভ করতেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলো
“তোমার বান্ধবীকে দিয়ে আজ এভাবে আমাকে ছোট না করলেও পারতে।
আমি শান্ত গলায় বললাম
“আমি কি করলাম?
“সবেমাত্র আমাদের প্রেমটা শুরু হয়েছে, আর তাতেই তুমি তোমার বান্ধবীকে দিয়ে বাধা দিতে শুরু করে দিলে? নিজে তো আমায় ভালো বাসলেই না, আবার অন্যকেও ভালোবাসতে দিবে না। কেমন মেয়ে মানুষ তুমি?

আমি মুচকি হাসলাম। ধীর গলায় বললাম
“এখনো আমার একটা বিয়েও হলো না, ডিভোর্সও হলোনা, তার আগেই আপনার মন থেকে আমার প্রতি ভালোবাসা উধাও হয়ে গেলো? ভালোবাসার দরজাটাও দেখছি বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে আমিই ঠিক ছিলাম…

সে এবার একটু নরম হয়ে বললো
“তুমি তো আমায় ভালো বাসো নি, তাহলে আমি কোন আশায় তোমার জন্য অপেক্ষা করবো?
আমি বললাম
” আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করেন নি, তাতে আমি খুশিই হয়েছি। কারণ অপেক্ষা অনেক কষ্টের, আর ভালোবাসা না পাওয়া আরো বেশি কষ্টের। আপনি আমার অপেক্ষায় থাকলে সেই কষ্টটাই পেতেন। আমি আপনাকে আদৌ ভালোবাসতে পারতাম কিনা জানিনা।

সেদিনের পর ওর আর আমার আর কোনো যোগাযোগ হয় নি। আমিও সবকিছু ভুলে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। তবে একটা জিনিস কনফার্ম হলাম যে সজল আমাকে।কখনোই সত্যিকারের ভালোবাসেনি। সত্যি সত্যি ভালোবাসলে এতো তারাতাড়ি আমাকে ভুলে অন্য কাউকে মন দেওয়া সম্ভব হতো না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম এটার জন্য যে, আল্লাহ আমাকে দ্বিতীয় বারের মতো মন ভাঙ্গার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।

ইন্টার মিডিয়েড শেষ করে অনার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন। একটা ভালো কলেজে চান্স পেয়েছি। ব্যাপারটা আমার জন্য সুখকর, কিন্তু আমার কাছের কয়েকটা বান্ধবী আমার সাথে চান্স পায় নি.. আর কয়েক জনের বিয়ে হয়ে গেছে এক্সামের পরপরই। যে কারণে আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরি। ওদের ছাড়া একা একা কলেজে যাওয়া আমার জন্য মোটেও সহজ ছিলো না।

একেতো কলেজটা ছিলো বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, তার উপর পরিচিত কেউ নেই সেখানে। আমি মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পরেছিলাম। কিন্তু বাবা মায়ের এতো কষ্টের টাকায় ভর্তি হয়েছি, যে কারণে টাকার মায়াতে হলেও কলেজে যেতেই হবে।

আবারও লেখাপড়ায় মন দিলাম। নতুন কলেজ, নতুন মুখ.. সবকিছুই নতুন। এতো এতো নতুনের ভীড়ে নিজেকে খুবই একা মনে হতে লাগলো। বার বার মনে হতে থাকলো, নতুন করে হলেও কিছু বন্ধু বান্ধব জুটলে মন্দ হতোনা। আমি আমার ক্লাসের মেয়েদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা শুরু করলাম। সবাই আমার সাথে কথা বলছে, মিশছে.. কিন্তু মনের মত কাউকেই পাচ্ছিনা। পুরোনো বান্ধবীদের খুব মিস করতে লাগলাম।

এভাবেই যাচ্ছিলো দিন। মাসখানেক পরে আমাদের ক্লাসে আরেকটা নতুন মুখের দেখা পেলাম। সে কোনো মেয়ে নয়, একটা ছেলে। আগেই ভর্তি হয়েছিলো, কিন্তু এতদিন আসেনি। আমার মতো সেও এই কলেজে নতুন, তারও কোনো বন্ধু নেই এখানে।।ক্লাসের একটা কোনায় একদম একা একা বসে আছে সে। আমি সেদিকে নজর দিলাম না তেমন। সেদিনই ক্লাসের শেষে দোতলায় কলেজের কেরাণীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম কোনো একটা বিষয় জানার জন্য। ফিরে আসার পথে দেখা হলো সেই ছেলেটির সাথে। আমি তাকে পাশ কেটে চলে আসতে চাইলে আমাকে পেছন থেকে ডাকলো।

আমি দাঁড়িয়ে পরলাম। প্রশ্ন করলাম
“কিছু বলবেন?
“তোমার নামটা জানতে পারি?
” কেন?
“আমার এ কলেজে পরিচিত কেউ নেই, আর রেগুলার কলেজে আসতেও পারবোনা আমি। ছোটখাটো একটা ব্যবসা আছে আমার সেজন্য। তাই তোমার সাথে একটু পরিচিত হতে চাই।
যেহেতু আমাদের সাথে পড়ে তাই আমি উনার সাথে পরিচিত হলাম। ছেলেটা ভালোই, দেখতেও দারুণ। বেশ ভালোই কথাবার্তা হলো আমাদের। শেষে সে আমার ফোন নাম্বার চাইলো যেনো কলেজে না আসলেও আমার মাধ্যমে কলেজের আপডেট ইনফরমেশন পেতে পারে। আমি প্রথমে ফোন নাম্বার দিতে অস্বীকার করলে সে আমায় বলে বসে
“আমি তোমার ক্লাসমেট, তাহলে আমাকে ফোন নাম্বার দিতে তোমার সমস্যাটা কোথায়?

মনে মনে ভাবলাম,
“ঠিকই তো। একসাথে পড়ি, তাহলে নাম্বার দেওয়াই যায়।
বলে রাখা ভালো, তখন আমার হাতে এন্ড্রয়েড ফোন ছিলো। ভাইয়ার কাছে দাবী করেছিলাম ইন্টার পাশের পর যেনো আমাকে একটা ফোন কিনে দেয়। ভাইয়া কিনেও দিয়েছিলো।।

পরবর্তীতে তার সাথে আমি ফেইসবুকেও এড হই। প্রায়ই সে আমাকে ফেইসবুকে নক দিতো, কলেজ সম্পর্কে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করতো। ফোনেও কথা হতো মাঝে মাঝে। তার ব্যক্তিত্বও অসাধারণ… কথাবার্তায় সেটা বুঝা যায়। আমার ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিতো সবসময়।। একসময় সে আমাকে বন্ধুত্বের অফার দেয়। আমি বিনাবাক্যে সেটা গ্রহণ করি।

ইদানিং সে নিয়মিত কলেজে এটেন্ট করে। রেগুলার ক্লাস করে। আমার পাশের বেঞ্চেই সে বসে। তার ভাষ্যমতে, আমার মতো ভালো বন্ধু পাওয়া দুষ্কর। সেসব কথায় আমি তেমন কান দেই না। ছেলেরা মেয়েদের এমন কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। দিনে দিনে আমাদের বন্ধত্ব খুবই গভীর হতে থাকে। তার কথাবার্তা, হাঁটাচলা, ব্যক্তিত্ব, হাসি.. সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। ভালোই লাগে তাকে… ফেইসবুকে যখন দেখি ‘মোঃ মৃদুল হাসান’ নামটা জ্বলজ্বল করছে তখন মুখে হাসি ফোটে আমার। মনে মনে আল্লাহর কাছে ইচ্ছা পোষণ করে, সে যেনো সর্বদায় আমার ভালো বন্ধু হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাকে ভালোবেসে ফেলি.. তবে সে দুঃসাহস বেশি সময় টিকে থাকে না।

মৃদুলের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর জানতে পারি সে আমার থেকে দুই বছরের সিনিয়র, কোনো কারণবশত সে দুই বছর গ্যাপ দিয়ে এবারে এখানে ভর্তি হয়েছে।

দিন যতই গড়াচ্ছিলো, আমাদের বন্ধুত্বের গভীরতাও চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছিলো।

এর মাঝে ভালো একটা প্রাইভেট টিউটরের সন্ধান করতে থাকি আমি, আমার সাব্জেক্ট ছিলো একাউন্টটিং.. সে কারণে প্রাইভেট পড়াটা ছিলো আবশ্যিক। মৃদুলের মাধ্যমে ভালো একটা প্রাইভেট টিচারের সন্ধানও পেয়ে যাই।

বেশ ভালোই কাটছিলো দিনকাল, কলেজ, প্রাইভেট, মৃদুলের বন্ধুত্ব সব মিলিয়ে অসাধারণ দিন কাটছিলো আমার।

সেদিন প্রাইভেট শেষ হবার পর মৃদুল আমাকে কিছু কথা বলার জন্য ডাকে। আমি বুঝতে পারি সে কি বলতে চায়। সে যে আমার প্রতি দুর্বল সেটাও আমার অজানা নয়। তবে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করি না।।

আমার মনের ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করে মৃদুল আমাকে সেদিনই প্রপোজ করে বসে। আমি বুঝতে পারিনা কি উত্তর দিবো তাকে। না পারছিলাম ভালোবাসা গ্রহণ করতে, আর না পারছিলাম সেটা অস্বীকার করে ওর ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করতে। কি করা উচিত আমার?

আমাকে চিন্তিত দেখে মৃদুল আমাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দেয়। তবে সন্ধ্যার সময় সে আমার কাছে পজেটিভ উত্তরই আশা করে।

অনেক চিন্তা ভাবনার পর আমি একটা সিদ্ধান্ত নেই। সন্ধ্যের পর আমি তাকে উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নেই। তবে মুখে নয়, লিখে। আমি ফেইসবুকের মেসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করতে থাকি আমার মনের অব্যক্ত কথা।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে