সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-১৯

0
891

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১৯
#সুমাইয়া_আফরিন

ইরা চেয়ারে বসে বসে বিস্কুট খাচ্ছে। হঠাৎ দরজায় জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজ পেল সে।
আওয়াজটা এতই তীক্ষ্ম ছিল যে ইরা, লারা, মিমি আর অনু সবাই চমকে গেল।
মনে হচ্ছে এখনই দরজা ভেঙে কোনো মহিশ ভেতরে ঢুকে আসবে।

ইরা বিস্কুটের বয়েম টেবিলে রেখে দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই ইরাকে এক হাতে ধাক্কা দিয়ে রাফাত হনহন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
ইরা এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না যার কারনে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে সে।

রাফাত আগুনের বেগে অনুর রুমে ঢুকে গেল। অনু রাফাতকে দেখে চমকে লাফিয়ে উঠল।
বিছানায় পা ভাজ করে বসে ছিল সে। বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে উঠতেই গালে সজোড়ে থাপ্পর পড়ল তার।
মাহি এক থাপ্পরে মাটিতে বসে পড়েছে। নিজেকে কোনোভাবে সামলিয়ে উঠে দাড়াতেই রাফাত আরেকটা থাপ্পর বসিয়ে দিল তার গালে।

ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বুঝে উঠতে পারল না সবাই।
নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল অনুর। মাথাটা যেন ভন ভন করে ঘুরছে তার।
লারা, মিমি আর ইরা রাফাতের এমন অগ্নিমূর্তি দেখে অবাক হচ্ছে প্রতিটামূর্তে। অনুকে রাফাত এমন অমানুষিকভাবে কেন মারলো তা তাদের বোধগম্য নয়। দরজার কাছে হা করে তাকিয়ে আছে তারা।

অনু কোনোরকমে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে রাফাতের দিকে তাকালো।
অনুর বেদনাভরা দৃষ্টিও যেন রাফাতের মন গলাতে পারছে না।
অনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফাত অনুর দিকে এগিয়ে গেল।
অনু ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলে রাফাত অনুর হাত ধরে হ্যাচকা টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসে।
অনুর নরম গালদুটো শক্ত করে নিজের এক হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে রাফাত। অনুর মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে বলে ওঠে,

‘তোর এত বড় সাহস তুই আমার ফোন কেটে দিস?নিজেকে কি মনে করিস তুই? আমার সাথে এক রাত কাটানোর জন্য মেয়েরা লাইন দিয়ে থাকে আর তুই আমার ফোন কেটে দিস? এতো দেমাক কোথা থেকে আসে শুনি?’

অনু ব্যথায় হালকা আর্তনাদ করে উঠল। অনুর ব্যথায় হয়তো রাফাতের হুশ আসে। এক ঝাকি দিয়ে অনু মুখটা ছেড়ে দেয় রাফাত। অনু ব্যথায় কুকড়ে উঠছে। অনুর মনে হচ্ছে তার গাল দুটো কেউ টেনে ছিড়ে দিয়েছে। অনু রাফাতের সামনে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। অনুর কান্না দেখে রাফাতের রাগ মুহূর্তেই পানি হয়ে গেল। অনুর জন্য এক রাশ মায়া ভাসতে লাগল তার নয়নজুড়ে।

অনুকে এভাবে নির্মমভাবে মারার জন্য মাথায় আগুন ধরে গেছে ইরা,লারা আর মিমির। মিমি নিজের রাগকে আয়ত্তে রাখতে না পেরে উচু স্বরে বলে উঠল,

‘আপনি অনুকে থাপ্পর কেন মারলেন? আপনার সাহস কি হয়, আমাদের বাড়িতে এসে অনুকে থাপ্পর মারার?

লারা মিমিকে সমর্থন করে ক্ষুদ্ধ স্বরে বলে উঠল,

‘ আপনি অনুকে বলছেন ওর সাহস কি করে হয় আপনার ফোন কেটে দেওয়ার?আরে বাবা, এই কথাটা কি আপনি ভালোভাবে বলতে পারতেন না? আপনি জানেন আপনার নামে নারী নির্যাতনের কেইস লাগাতে পারি আমরা?’

রাফাত লারার কথায় ফিচেল হাসল।ব্যঙ্গানো ভঙ্গিতে বলে উঠল,

‘ওহ রিয়েলি? আসলে, আমিও দেখতে চাই, তোমরা কেস করো কীভাবে? সারাদিন পুলিশ স্টেশনে বসে থাকলেও কোনো অফিসারের সাহস হবে না এফআইআর লেখার।’

রাফাতের কথায় হতভম্বিত হয়ে গেল তারা। অনু আর নিজের রাগকে সামলাতে পারলো না। একে তো নির্মমভাবে গায়ে হাত তুলেছে সে তারপরে আবার তর্কও করছে রাফাত। রাফাতের প্রত্যেকটা কথা এখন অনুর কাছে বিষের মতো লাগতে থাকল। অনু নিজের চোখ মুছে ক্রুব্দ্ধভাবে বলে উঠল,

‘কি সমস্যা আপনার? এমন কেন করছেন আপনি?’

রাফাত লারার থেকে চোখ সরিয়ে অনুর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল। রাফাত অবাক চক্ষুতে অনুকে জিজ্ঞাসা করল,

‘তোমার কি হয়েছে সেটা আগে বলো? আমার ফোন বারবার কেন কেটে দিচ্ছিলে তুমি? তুমি আমাকে কি পেয়েছো? আমি খেলার পুতুল?যখন চাইলাম খেললাম আর যখন মন চাইল ফেলে দিলাম! আজকে বিকালে তুমি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছো আমি করেছি। বাট যখন আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি তুমি ফোন ধরার প্রয়োজন বোধটাও করলে না। কেন অনু? কেন? আশা করি এর উত্তরটা তোমার কাছে আছে।’

রাফাতের কথাগুলো তীরের মতো বিধতে লাগলো অনুর ছোট্ট হৃদয়ে। খুবই কর্কশ স্বরে কথাগুলো বলছে রাফাত। অনুর মনে পড়ে যাচ্ছে কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো,

কিছুক্ষন আগে,

অনু মেয়েটার কান্নামিশ্রিত কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেল। অনু এক প্রকার থমকে বসে রইল চেয়ারটার উপর। মূর্তিও হয়তো এতটা শক্ত হয়ে বসে থাকতে পারে না যতটা অনু পারছে। মেয়েটার কন্ঠে অনু অস্ফুট বেদনা খুজে পাচ্ছিল। কিন্তু রাফাতের মেসেজগুলোও অস্বীকার করতে পারছে না সে। রাফাত তাকে মিথ্যা কথা বলছে নাকি এই মেয়েটা?

দুই রাস্তার মাঝে আটকে পড়েছে অনু। কোন রাস্তাটা সঠিক আর কোনটা ভুল কিছুই বোধগম্য নয় তার। একজন মানুষ কি করে এতটা ভালো অভিনয় করতে পারে?অনুর বুঝতে বাকি নেই যে দুইজনের মধ্যে কেউ তো নাটক করছে কিন্তু যে নাটক করছে অসাধারন অভিনয় করছে সেই নাটকে। দর্শকদের মন খুব সহজেই মাতিয়ে নিতে পারছে সে।

অনু পুরো পৃথিবী যখন ঠিক ভুলে অন্ধকার হয়ে আসছিল ঠিক তখনই রাফাতের কল আসে। অনু সেই মুহূর্তে কারো ফোনকল ধরার মতো অবস্থায় ছিল না যার কারনে বারবার কেটে দিচ্ছিল রাফাতের ফোন। আর সেই কারনেই রাফাত এত পরিমান রেগে গেছে।

‘কি অনু,কিছু তো বলো? নাকি এখন তুমি বোবা হয়ে গেছো?’

রাফাতের ডাকে অতীত থেকে ফিরে আসে অনু। মাথা নিচু করে ভবছিল সে ঘটনাগুলো। অনু রাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমি ফোনে কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না রাফাত। আপনি সবকিছু না জেনে কথা বলবেন না। আমি মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি রাফাত।প্লিজ আমাকে আর এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না।’

অনুর কথায় রাফাতের মনটা মোচর দিয়ে উঠল। রাফাত বুঝতে পারছে না হঠাৎ অনু এভাবে কথা বলছে কেন? আর কি কারনে অনু মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে? রাফাত খুব ভালো করেই জানে অনুকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলে অনু ঠিক তার বিপরীত উত্তর দেবে। তাই রাফাত নিজেকে কোনোভাবে শান্ত রাখার চেষ্টা করল।

অনু মাথা নিচু করে রাফাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনুর এমন ব্যবহার রাফাতের কছে অনেকটা অন্যরকম ও রহস্যজনক লাগছে। রাফাত বুঝতে পারছে তার নামে অনু কিছু একটা দেখেছে বা শুনেছে বা জেনেছে যা মোটেই তার পছন্দ হয়নি। সেই অজানা অপছন্দ লাগা বিষয়টি জানার জন্য রাফাত এক কঠিন ও ঝুকিপূর্ন সিদ্ধান্ত নিল।যার জন্য হয়তো প্রতিমুহূর্তে অনুকে অপমানিত হতে হবে। কিন্তু সব অপমানের যে অনু যোগ্য জবাব দিতে পারবে তা রাফাত খুব ভালোভাবেই জানে। যার জন্যেই সে এই সিদ্ধান্ত গ্রহন করল।

চলবে,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে